দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- নয়
কানাডায় এখন সামার। প্রতিটি
ডুপ্লেক্স-ট্রিপ্লেক্স বাসার চারপাশে প্রচুর খালি জায়গা ও প্রস্ফুটিত ফুলের বাগান।
কোন বাসায় পাকা সীমানা দেয়াল নেই। পাকা দেয়ালের বদলে আছে কাট ও স্টিলের হালকা
বেড়া। তাই বিভিন্ন বাসার বাগান মিলে মিশে সুদূর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত সুবিশাল
উদ্যানে রূপ নেয়। ২৫/৩০ তলা যেসব বহুতল অট্টলিকা রয়েছে, যেখানে ৫০০/৬০০
পরিবার লোকজন বসবাস করে, সেই অট্টালিকাগুলোও সুবিশাল উদ্যানের
মধ্যে রয়েছে। মানুষ, গাড়ি কখনও টুকাটুকি হয়না। বহুতল ভবনগুলো
দূরে দূরে এমনভাবে নির্মিত যে এক ভবনের ছায়া অন্য ভবনে পড়তে পারেনা।
টরেন্টো শহরের সড়কগুলো চার থেকে ষোল লেনবিশিষ্ট।
তা ছাড়া প্রতি রাস্থার দু’পাশে সুপ্রশস্ত ফুটপাথ ও বাইসাইকেল
চালানোর আলাদা লেন রয়েছে। এখানে গ্রাউন্ড, আন্ডারগ্রাউন্ড ও
ওভারগ্রাউন্ড এই তিন দিক দিয়েই রাস্থা নির্মিত। সর্বত্র গ্রাউন্ড ট্রেন ও আন্ডার
গ্রাউন্ড ট্রেন চলাচল করে। কুসুম সজ্জিত পার্কে হাঁটার সময় হঠাৎ টের পাওয়া যায় মাটির
তলায় ভূমি কাপিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। সারাটা টরেন্টো মহানগর জুড়ে উদ্যান আর উদ্যান।
আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কিংবা পুন্যশহর সিলেটকে টরেন্টোর মত পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত করা কখনও সম্ভব হবেনা। কারন আমাদের শহরগুলোতে এত জায়গা বের করে আনা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় দক্ষিনে কোন জনশূন্য দ্বীপে কিংবা হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওরের মত কোন জনহীন এলাকায় এধরনের শহরের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনা করলে তো হবেনা, আমাদের এত টাকা কোথায়? এত প্রযুক্ত কোথায়, কমিট্মেন্ট ও সততা কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডার সীমান্ত জুড়ে
পাঁচটি অপূর্ব সুন্দর লেক রয়েছে। এই লেকগুলো যেন এক একটা সমুদ্র। কূলকিনারাহীন এই
লেকগুলো আয়তনে বাংলাদেশ, ভূটান কিংবা শ্রীলঙ্কার মত ছোট ছোট এক
একটা দেশে সমান। ছয় সাত মাইল প্রশস্ত জলপথ দ্বারা একটির সাথে অন্যটি জড়িয়ে রয়েছে।
এই লেকগুলোর পারে কোথায়ও বেলাভূমি, কোথায়ও পাহাড়, কোথায়ও সমতল ঘাসের
গালিচা, কোথায়ও পাখিডাকা জলাবন। এদেরই মধ্যকার এক
মিলনকেন্দ্র নায়েগ্রা জলপ্রপাত।
লেকগুলোর নাম ভারী সুন্দর। পশ্চিম হতে
শুরু করে পূর্বদিকে একে একে রয়েছে লেক সুপিরিয়র, লেক মিশিগান, লেক হুরন, লেক ইরি এবং লেক
ওন্টারিও। এই পাঁচটি লেকের পানি একে একে এসে লেক ওন্টারিওতে জমা হয় এবং লাব্রাডা
প্রনালী দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত হয়। আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত
এই লেক জলপথ আমেরিকা-কানাডার সেরা আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও পণ্য পরিবহন লাইন।
কানাডার সর্ববৃহৎ মহানগর টরেন্টো। এই শহরে ছয়ত্রিশ লক্ষ মানুষের বসবাস। গড়ে প্রতি
দশ জন কানাডাবাসী একজন এই শহরের বাসিন্দা। শহরটি লেক ওন্টারিওর পারে গড়ে উঠেছে।
৯ আগষ্ট ২০১৬ সাল। উজ্জ্বল রোদেলা বিকেল।
আমরা দুইটি গাড়ি ভরে টরেন্টোর উপকন্ঠে Blueffer’s park দেখতে যাই। একটি
গাড়ি ভাগনা রুহুল ও অন্যটি ভাগনা-বউ সিদরাত ড্রাইভ করে নিয়ে যান। কোন এক অপূর্ব
সুন্দর রাস্থা দিয়ে গাড়ি অগ্রসর হয়। রাস্থার দু’পাশে বিচিত্র
বৃক্ষলতা ও বনফুলের সমাহার। এই দৃশ্যাবলী অনেকটা আমাদের শ্রীমঙ্গলের রাস্থাপাশের
সাথে তুলনীয়। এখানে সবুজ চায়ের বন আর সেখানে সবুজ মিহি ঘাসের গালিচা পাহাড়কে ঘিরে
রেখেছে।
আমাদের গাড়ি দু’টি Blueffer’s
park এর পার্কিং এরিয়া হতে বের হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে
লোকজনকে আনন্দমত্ত দেখতে পাই। লেকের পার শক্ত পাতরে বাঁধানো। অথচ নিচে বালির
অপুর্ব সৈকত। ছোট ছোট বর্নিল উর্মিমালা আচড়ে পড়ছে সে সৈকতে। এখানে পাহাড় ও লেকের
অপূর্ব সুন্দর সম্মিলন ঘটেছে। লেকে স্পিডবোট চড়ে লোক জলবিহার করছে। সাদা ফ্যালকন
পাখিরা উড়ছে। পাশে পাখি ও মৎস্যের অভয়ারণ্য। লেক এসে ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের ভাঁজে।
ছোট ছোট ভাসমান সেতু দিয়ে অভয়ারন্যে প্রবেশ করি। এযেন বাংলাদেশের বাইক্কার বিলের
জলাবন। বনের ঝোপঝাড়ে ছোট্ট ছোট্ট পাখির বাসা। মা পাখিরা বাসায় বসে ডিমে তাপ
দিচ্ছে। একেবারে হাতের কাছে, চোখের সামনে। সুসভ্য কানাডাবাসী কেউ কোন
ধরনের যন্ত্রনা করছেনা প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিদেরে। জলহাঁস ও রাজহাঁস দলবেঁধে
সাঁতার কাটছে। মা হাঁসের পিছনে পাঁচ ছয়টি ছানাও নির্ভয়ে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে।
নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাদের দেশের জলে এভাবে বাচ্চা নিয়ে বুনো
হাঁসগুলো কি সাঁতার কাটার সাহস করবে।
এখানে ক্যানাডা সরকার মাছের প্রচুর পোনা
উৎপাদন করে। পোনা বড় হলে তা ছেড়ে দেয় কানাডার শত শত লেকে।
নিবিড় বনে ডাকা মেঠো পথ। পথে দু’পাশে কাশবন, ছনবন, মুর্তাবন ও জলাবন।
বনের ধারের জলে পদ্ম ভেট ও শাপলা মৃদুমন্দ বাতাসে মাথা নাড়ছে। দু’চোখের পাতা বন্ধ
করে আমি এখানে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল দেখার স্বাদ গ্রহন করলাম। এই অভয়ারন্যে
শীতকালে যান্ত্রিক উপায়ে পানি উষ্ণ রাখা হয়, যাতে মৎস্য ও
পাখিকূল বেঁচে রয়। লেকের পারে দুগ্ধধবল পাতরের খাড়া পাহাড় নয়ন বিমোহিত করে। এই
হৃদের তীরের বিচটিও সমুদ্র সৈকতের মত। এলোমেলো হাওয়ার মাঝে সন্ধ্যা নামছে। আহা কি
যে আরাম। কানাডার সামার সত্যই অসাধারন।
কানাডার সামারের সুন্দর প্রকৃতি ও আরামদায়ক আবহাওয়া উপভোগ করার জন্য স্কুল কলেজ একটানা দুইমাস বন্ধ থাকে। কানাডার সমৃদ্ধ ও সুখী নানা ধর্ম, বর্ন, জাতির লোকজন মিঠেকড়া রোদে সুশীতল বাতাসে জীবনটাকে শতভাগ উপভোগ করে নেয়। চারদিকে তাকালে মনে হয় তাদের জীবনে কোন দুঃখ নেই, জ্বালা-যন্ত্রনা নেই। দেশটার সবাই যেন আনন্দে মাতোয়ারা।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন