বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফর পর্ব-এক

 


দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফর পর্ব-এক

যাত্রাঃ ১৫ জুলাই ২০১৬ দেশেফেরাঃ ২৭জুলাই ২০১৬ ক্যানাডা গমনঃ ৭ জুলাই ২০১৬

যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডার সীমান্তের দুইপার ঘুরে দেখাঃ

এবারের রমজান মাস, প্রচন্ড গরম। এই গরমে যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা সফরের সিন্ধান্ত নেই। ঈদের ছুটি ১১ দিন, সেইসাথে যোগ করে আর ১৮ দিন ছুটি নেই। ১লা জুলাই ২০১৬ সাল। আমিরাত এয়ারলাইনে রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দর হতে যাত্রা শুরু করি। সাড়ে চার ঘন্টা পর দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। দুবাই হতে আমিরাতের বিমানটি ইরান-তুরস্ক-ইউরোপ হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে চলে আসে। ২৫ রমজান, ২জুলাই ২০১৬ সাল আমাদের দৈত্যাকার উড়োজাহাজটি প্রায় সাতশত যাত্রি নিয়ে নিউইয়র্কের অনেক উত্তরের রাজ্য ম্যাসাসুসেটের রাজধানী বোস্টনে অবতরণ করে। তখন সকাল সাড়ে নয়টা। দুবাই হতে আকাশে উড়ার পর টেলিভিশন পর্দায় সিএনএনের মাধ্যমে বারবার ঢাকার দুইজন পুলিশ অফিসার ও বিশজন নিরপরাধ বিদেশীর নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে নিদারূন মর্মাহত হই। পাঁচ হামলাকারী দুবৃত্ত নিহত ও একজন জীবিত ধৃত হবার খবরো আসে। বোস্টন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার প্রথমেই আমরা ঢাকার গোলশান হামলা সম্পর্কে অবগত কিনা জানতে চান। আমি ও জেফার বললাম, আমরা উড়োজাহাজের টিভিতে এই খবর পেয়েছি। এইচ এস অফিসার জেফারকে বললেন, বাংলাদেশ কি বিপদজনক দেশ? অচিরেই বাংলাদেশ কি পাকিস্থান, আফগানিস্থান, সোমালিয়ার মত ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হবে? জেফার বলল, মনে হয়না। পাকিস্থান ও আফগানিস্থানে জঙ্গী দুবৃত্তরা প্রতিদিন বোমা ফোটায়, মানুষ মারে। বাংলাদেশের এই হত্যাকান্ড বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়; এখানে কেউ জঙ্গীবাদ বা উগ্রবাদ পছন্দ করেনা। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এই শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তার ধারনা বাংলাদেশ একটি নরক। এইদেশ মশা মাছি আর আবর্জনায় ভরা। আবহাওয়া উষ্ণ প্রস্রবনের মত আর্দ্র ও গরম। তার উপর বজ্জাত জঙ্গীদের উৎপাত। তার উপদেশ সুযোগ যখন পেয়েছেন ফেলে আসা নরকে আর ফিরবেন না। আমরা যদিও কিছুদিন পর বাংলাদেশে ফিরে যাবো, তারপরও বললাম, ইয়েস থ্যাংকস। তিনি আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করার উপদেশ দিয়ে মালামাল পরীক্ষা করে ছেড়ে দেন। দুবাই এয়ারপোর্টে একজন আত্মীয়ের দেখা পাই। তিনি আমার ভাতিজী এমেলির জীবনসঙ্গী দেওয়ান তওফিক মজিদ লায়েকের খালাতো ভাই। তার বাড়ি তাজপুর, ওসমানীনগর। তিনি দেড়যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে আছেন। তিনি সদ্য বিবাহিতা সঙ্গিনীকে নিয়ে মিশিগান যাচ্ছেন। আমরা গল্প করে করে এয়ারপোর্টের বাহিরে চলে আসি। ভদ্রলোকের স্ত্রী চিরতরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে চলে আসায় চিন্তিত ও আনমনা অবস্থায় ছিলেন। আমরা তিনজন সিলেটিকে পেয়ে তিনি দারূন স্বস্তি পেয়ে আলাপে মেতে উঠে। ভদ্রলোক নানা গল্প করেন। দেওয়ান মজিদ লায়েক, খালা রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, খালু রাগীব আলী কিছুই আলোচনায় বাদ গেলনা।

বোস্টন আমেরিকার একটি পর্যটন নগরী। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যায়বহুল জীবনযাত্রার একটি শহর। এই শহরটিকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডীর শহরো বলা হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের সৈকতে অসংখ্য চর ও দ্বীপমালা নিয়ে শহরটি গড়ে উঠেছে। নীলজলের ঢেউয়ে রাজহাসের মত ভাসমান চর ও দ্বীপগুলো রাস্থা ও সেতু দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত রয়েছে। নীল জলরাশিতে বিচরন করছে অসংখ্য স্পিডবোট। বোস্টন শহরে তখন আটলান্টিক হতে ঠান্ডা বাতাস আসছে, যেন এয়ারকন্ডিশন মেশিন হতে বেরিয়ে আসা মজাদার বাতাস। গাছের পাতা ও বাগানের কুসুমরাজি বাতাসে দোল দিচ্ছে। ব্যাস্ত শহর বোস্টন অথচ শহরটি অরন্যের মত নির্জন। এখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ট কুটনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্টান রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিতে নিযুক্ত কর্মকর্তারা শিক্ষাগ্রহনকরে থাকেন। বিমানবন্দর হতে বের হয়ে তিনচার ঘন্টা বোস্টনের রৌদ্রজ্জোল শীতল দিনটি বেশ উপভোগ করি, অথচ গতকাল বাংলাদেশে রেখে এসেছি ভ্যাঁপসা গরম আবহাওয়া। এযেন তীব্র গ্রীষ্মকাল হতে সরাসরি হীম শীতকালে ঢুকে পড়া। বিকেল সাড়ে চারটায় মিশিগান যেতে আমরা জেটব্লু এয়ারলাইনের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে বোস্টন ছাড়বো। সংযোগ ফ্লাইট। ফ্লাইট ছাড়ার ঘন্টা দেড়েক আগে এসে আমরা বিমানবন্দর ডুকি। যথাসময়ে জেটব্লু ছেড়ে দিলো। বিমানে উঠার আগেই ছোটমামাকে জানিয়ে দিলাম আড়াই ঘন্টা পর আমরা ডেট্রয়েট অবতরণ করছি। উড়ালযান হতে বেরিয়ে বেল্টে এসেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ছোটমামা শহিদ চৌধুরী। মামার সাথে সাত আট বছর পর দেখা। লম্বা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা মামাকে অনেক বয়স্ক মুরব্বী মানুষ মনে হল। সাথে ছিল তার কনিষ্ট কন্যা জেরিন, যার সাথে এই আমার প্রথম দেখা।

ছোটমামা শহিদ চৌধুরী ছিলেন বড়লেখা দক্ষিনভাগের একজন ক্রীড়া সংঘটক। খেলার জন্য যেন তার জন্ম। তার ধ্যান-ঞ্জান সব জুড়ে ছিল খেলা আর খেলা। দক্ষিনভাগ স্কুলমাঠে আমরা ফুটবল খেলতাম এবং মামা বলের সাথে দৌড়ে দৌড়ে বাঁশি বাজাতেন। দক্ষিনভাগ বাজারে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হত, মামা ছিলেন ধারাভাষ্যকার। মামার খেলা নিয়ে কি যে উৎসাহ। তখন ছিল রেডিওর যুগ। মামা কানের কাছে রেডিও রেখে খেলার বিবরন শুনতেন চোখ বন্ধ করে। বিকেলে মামা সওদা করতে ছুটতেন দক্ষিনভাগ কিংবা রতুলি বাজারে। ব্যাগ নিয়ে পিছু পিছু ছুটতো হাসমতি ঝির দুইপুত্র ছাকিল ও অকিল। হাসমতি ঝির পরিবারের ঠিকানা কেউ জানেনা। বৃটিশ আমলে আমার নানা শিশু হাসমতি ঝিকে কুড়িয়ে এনে সারাজীবন লালন-পালন করেন। তিনি আমার মায়ের সমবয়সী ছিলেন। নানার পালাপোষা আর একজন খুব সাদাসিদে লোক ছিলেন, যাকে আমরা বলতাম অসির মামু। নানা হাসমতি ঝিকে এই অসির মামুর সাথে বিয়ে দেন। এই হাসমতি ঝিয়ের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা আজ আমার নানার বিশাল জমিদার বাড়ির বাসিন্দা। মূল বাসিন্দারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মনে হয়না তাদের পরবর্তী বংশধর কেউ মসজিদ ও বড় দিঘীওয়ালা বিশাল জমিদার বাড়িতে কখনও ফিরে আসবে। একবার আমি এই বাড়িতে গিয়ে গরু-শিরনি করি। কিছু বালকদের বলতে শুনি হাসমতির বাড়ির শিরনি। হ্যাঁ বাড়িটির বর্তমান পরিচয় হাসমতির বাড়ি। সময় সব বিস্মৃত করে দেয় সহজেই। দেশে ছোটমামা রাতে তাস, দাবা, দশ-পঁচিশ, ক্যারম খেলা সমাপন করে মধ্যরাত পার করে ঘরে ফিরতেন। আমেরিকায় এসে সেই মামা এখন পুরোদস্তুর একজন সংসারী মানুষ। সারারাত ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন ও দিনে ঘুমান। সাপ্তাহে চারদিন ডিউটি। তবে মাঝেমধ্যে সঙ্গীসাথি নিয়ে বরশি বাইতে যান মিশিগান লেকে, রাতভর মাছ ধরে ভোরে ঘরে ফিরেন। তার মেয়ে সুফার স্বামীকে নিয়ে বরশি বেয়ে রাত পার করে দেন।

ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে বড় বক্সওয়াগন গাড়িতে মালামাল তুলা হয়ে গেল। কিশোরী জেরিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিশাল আটলেনের মার্কিন রাস্থা দিয়ে গাড়ি ছুটালো। আটমাস আগে এসে আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াসিংটন ডিসি, কলম্বিয়া, আটলান্টা ঘুরেছি। তখন আটলান্টিক মহাসাগরপারের নয়টি স্টেইট সফর করি। এবার আর নতুন দুটি স্টেইটে পা রাখলাম, একটি ম্যাসাসুসেট, যাহা যুক্তরাষ্ট্রের সুদূর উত্তরের আটলান্টিকপারের রাজ্য। অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডার সীমান্তবর্তী লেইক-রাজ্য মিশিগান। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি রাজ্যের মধ্যে ফেডারেল সরকারের অধীনস্থ ওয়াশিংটন ডিসি সহ এগারটি স্টেইট সফর করা আমাদের হয়ে গেল। রাজ্যগুলো- নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেন্সিলবানিয়া, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি, নর্থ-ক্যারোলিনা, সাউথ-ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, ম্যাসাসুসেট ও মিশিগান। ডেট্রয়েট স্টেইট মিশিগানের সবচেয়ে বড় শহর। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পনগরী। মিশিগান রাজ্যের আয়তন ৯৬,৭১৬ বর্গমাইল, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১.৭৫ গুন বড় ও বৃটেনের সমান। রাজ্যটি দুইটি উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত। লেক সুপিরিয়র ও লেক মিশিগানের মধ্যে একটি উপদ্বীপ রয়েছে এবং অন্য উপদ্বীপটির অবস্থান লেক মিশিগান ও লেক হুরনের মাঝে। সাগরের মত বিশাল এই লেকগুলো কানাডার সীমান্ত ঘেষে ছয়-সাত মাইল প্রশস্থ নদী বা চ্যানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সীমান্তের এই লেকগুলো বিশাল কূলকিনারাহীন এক একটা সমুদ্র। ডেট্রয়েট বড় মহানগর হলেও মিশিগান রাজ্যের রাজধানী ছোট্ট শহর লেন্সি। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন