বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফর পর্ব- দুই

 


দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফর পর্ব- দুই

আমাদের বক্সোয়াগন গাড়িটি এসে ছোটমামার তালবটের বাসার সামনে এসে থামে। বিদেশে জায়গার বিদগুটে নাম মনে রাখা বেশ কষ্টকর, কিন্তু বাংলাদেশের দুইটি গাছ তাল ও বটের নামে এলাকাটির নাম হওয়ায় সহজে স্মৃতিতে বসে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের দশটা আবাসিক এলাকার মত একটি আবাসন। রাস্থার পাশে সারিবদ্ধ প্রায় একই ডিজাইনের সারিবদ্ধ বাড়িগুলোর মধ্যে একটি তিতলা বাসা। সামনে গাড়ি আঙ্গিনা এবং পিছনে ফল-ফুল সুভিত প্রাঙ্গন। এই পিছন প্রাঙ্গণের উর্বর মাটিতে কদু, ঝিঙ্গা, লালশাক, পাটশাক, ডেঙ্গা, মরিচ, দেড়েস ইত্যাদির সবজি বাগান। বাসার পিছন দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের মেঠো পথের মত সবুজে ছাওয়া পথ। দুদিকে ঝুলে আছে থোকা থোকা বুনো আঙ্গুর। ঐ আঙ্গুরলতা ঘেরা পথে মামী আমাদেরকে হাঁটতে নিয়ে যান। তখন মনে হল এযে বাংলার কোন ছায়াঘেরা পল্লী পথ। উন্নত দেশ, তাই এই নির্জন পথটিও পিচ ডাকা।

আমার মামী সেবন চৌধুরী। বড়লেখার দাসেরবাজার তার বাপের বাড়ি। তিনি কঠোর পরিশ্রমী একজন সহজ সরল মহিলা। মানুষের প্রতি তার দয়ামায়ার কোন শেষ নেই। দক্ষিভাগের চারু নামের একটি মেয়ে তার কাজ করতো। চারুর ছেলেমেয়েকে কোন ধরনের জীবিকায় লাগিয়ে দেওতার জন্য মামী এক হাজার মার্কিন ডলার আমার হাতে তুলে দেন।

মামী তার বাগানে ফলানো শাকসবজি আমাদের জন্য সযতনে রান্না করেন। অনেক বাচ্চা-কাচ্চার বড় এক সংসার মামা ও মামী বটগাছের মত ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। ছেলে তাওহিদ ওয়াশিংটন ডিসিতে চাকুরী করে। গতবছর আমরা ওয়াশিংটন অবস্থানকালে সে তার পত্নী সুমাইয়াকে নিয়ে আসে। তারা আমাদেরকে নিয়ে মেরিল্যান্ড, বিখ্যাত টার্কি মসজিদ কম্পেক্স ও পটোমাক নদীর তীরের নগরী ও স্কাই-হুইলারে নিয়ে যায়। তাওহীদের বউ সুমাইয়া যুক্তরাষ্ট্রের মাস্টার্স। অন্য মামাতো ভাই রাহিদ লেখাপড়া শেষ করে নিউজার্সি স্টেইটে চাকুরী নিয়েছে। অফিসের কাজে সদ্য সে জার্মানী হতে ঘুরে এসেছে। বড় মামাতো বোন আরফার স্বামী সাদিক চৌধুরী, তারা সপরিবারে নিউইয়র্কে বসবাস করেন। সাদিক চৌধুরী ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া গ্রামের সন্থান। মামাতো বন তুফার স্বামী নিয়াজ চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জের রনকেলী গ্রামে। তিনি বালক বয়সে নিউইয়র্ক যান। কিছুদিন হয় তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে মিশিগানের বাসিন্দা হন। তিনি ভাল বংশের ভাল মনের মানুষ। ছোটমামার তালবটের বাসার প্রতিবেশী তারা। তুফার ছোট্টমেয়ে মাহদিয়া খুব চঞ্চল, সব সময় সে ইংরেজিতে বকবক করে। বাসা থেকে বেরিয়ে সে চুপে চুপে চলে আসে নানার বাসায়। সারাদিন নাচে আর ইংলিশে কবিতা ও ছড়া বকে যায়- Twinkle, twinkle shining star./ How I wounder, what you are. মাহদিয়ার দুইটি জমজ ভাই হাসান এবং হোসেন। জমজ ভাই দুটি বিছানার বাসিন্দা। ক্ষুদে জমজদুটি প্রায়ই অসুস্থ থাকে, তাই তুফার দিন যায় হাসাহ-হুসেনের সেবা-শুশ্রুষায়। মামার অন্যমেয়ে সুফা সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি। হেসে হেসে কথা বলে। তার কথায় সব সময় হাস্যরসের ছিটা বর্ষন হয়। সুফার স্বামী আলম ভাই স্মার্ট ও পরিশ্রমী লোক। তিনি আমাদেরকে সারাটা ডেট্রয়েট শহর ঘুরে দেখান। তাদের একমাত্র ছেলে মিরাজকে নিয়ে হোটেল স্যুটের মত পরিপাটি একটি সুন্দর বাসায় ভাড়া থাকেন। মামার ছোট্ট মেয়ে জেরিনের জন্ম নিউইয়র্ক। এখনও সে বাংলাদেশ দেখেনি। সে মাথায় হিজাবপরা ভদ্রগোছের স্বল্পভাষী একজন কিশোরী। আর্ত মানুষের সেবা করে সে আনন্দ পায়। তাই নার্সিং কলেজে সে অধ্যয়ন করছে। সে আমেরিকান খাবার পছন্দ করে, মামির রান্না একটু আধটু চেখে দেখে এবং সুন্দর গাড়ি চালায়। বাংলা পড়তে জানেনা। আমার লিখা বইয়ের দুটি গল্প কাজের মেয়ে কুঠিনাএবং সেই মুখতার অনুরোধে পড়ে শুনাই। ছোট্ট খুকির মত কানটা আমার ঠুটের কাছে এনে মনযোগ দিয়ে শুনে বুঝার চেষ্টা করে। সে বাংলা পড়তে না পারলেও শুনে ও বুঝে। তবে বাংলা Eroding and decoding করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। বাংলায় (সিলেটি বাংলা) কথা বলতে জড়তা নিয়ে সময়ক্ষেপন করে কথা বলতে পারে। মেয়েটি পাক্কা নামাজি ও রোজাদার। আশপাশের ভিনজাতির লোকজনের খবরাখবর নেয়। তাই সাদা-কাল-বাদামী সবাই তাকে বেশ ভালবাসে।

৩ জুলাই ২০১৬ সাল শুক্রবার। মামা ড্রাইভ করে আমাদেরকে পার্শবর্তী নূর-মসজিদে নিয়ে যান। মসজিদের পার্কিং-স্পেস খালি নেই। তাই দূরে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে হেঁটে মসজিদে প্রবেশ করি। এই মসজিদের ৭০% মুসল্লী সিলেটি আদমি। খতিব আরবী ও ইংরেজীর মিশেলে বক্তৃতা দেন। নামাজ শেষে মসজিদের চারপাশ সিলেটি ভাইসাবদের কোলাহলে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার গুঞ্জরনে মুখরিত হয়ে পড়ে।

ওয়ান ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিবলে ইরাক ও আফগানিস্থান দখল করে নেয়। একসাথে দুইটি যুদ্ধের খরচ জোগাতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা (Economical recition) শুরু হয়। মিশিগানে অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ চাকুরী হারিয়ে বেকার হয়। আমেরিকানদের তেমন সঞ্চয়ের অভ্যাস নেই। তারা বাংলাদেশী টাকায় প্রচুর রোজগার করে অথচ রোজগারের আগেই ঋনের টাকায় ঘি খায়। তাদের আয়ের সিংহভাগ টাকা ঋনের কিস্তি পরিশোধে চলে যায়। চাকুরী হারানো মানুষগুলো Mortgage Loan এর কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা পানির দরে বাড়ি বিক্রি শুরু করে। কেউবা ব্যাংকের হাতে বন্ধকী বাড়ি অর্পন করে অন্য স্টেটে চলে যায়। তখন নিউইয়র্ক হতে দলে দলে সিলেটিরা ছুটে আসেন এবং পানির দরে ডেট্রয়েটে বাড়ি কেনা শুরু করেন। বাংলাদেশ হতে যুক্তরাষ্ট্রে আসা লোকজন ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহরের কঠিন জীবন সংগ্রামে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকে গ্রাম্য শহর ও শিল্পনগরী ডেট্রয়েটে পাড়ি জমান। লন্ডনের মত ডেট্রয়েট এখন একটি সিলেটি অধ্যুষিত শহর।(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন