বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- তিন

 


দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- তিন

রাতে তারাবী পড়তে আবার যাই নূর মসজিদে। আট রাকাত নামাজ পড়া শেষ হলে মসজিদ হতে অসংখ্য মানুষ একসাথে বের হয়ে যান। মসজিদের প্রায় অর্ধেক শূন্য হয়ে যায়। পড়ে মামার কাছে জানলাম, এই জামাতের আরবী ও ইয়ামেনি মুসল্লীরা আট রাকাত তারাবী নামাজ পড়ে বেরিয়ে যান। আমাদের মত সুদীর্ঘ্য বিশ রাকাত তারাবী পড়ার নিয়ম তাদের নেই।

নামাজ পড়া শেষ হওয়ামাত্র একজন দাড়িওয়ালা মুসল্লী আমাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। চিনতে দেরী হলনা তিনি আমার কৌশরের বন্ধু পাশের তুড়ুকখলা গ্রামের কালামিয়া সাহেবের পুত্র মওদুদ। জানতাম তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন কিন্তু মিশিগানের তালবটের নুর-মসজিদে এসে তার দেখা পাবো ভাবতে পারিনি। মওদুদের বাবা কালামিয়া ছিলেন আমার আব্বার একজন সুহৃদ ও ভক্ত বন্ধু। ১৯৭৬ সালে তিনি আব্বাকে গ্রামের চেয়ারম্যান পদে দাড় করিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং আব্বার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেন।

পরবর্তী তারাবীর জামাতে তুরুকখলার সাব রেজিস্টার মসরু মিয়ার পুত্র কয়েস আহমদের সাথে দেখা হল। তিনি ছিলেন আমার বড়বোন রেহার সহপাঠী। কয়েস ভাই কিছুদিন আগে সিলেটের দরগাগেটে ব্যবসা বন্ধ করে মিশিগান এসেছেন। প্রবাসে নতুন জীবন সাজাতে সদ্য যুদ্ধে নেমেছেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে কঠোর পরিশ্রম তাকে পরিশ্রান্ত করে ফেলেছে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হল- দেশে ছিলাম, ভালই ছিলাম, এখন দেখি উপায় নাই, কোনবা পথে নিতাইগঞ্জ যাই। খুব পরহেজগার সাব রেজিস্টার মসরু মিয়া ছিলেন আব্বার বাল্যবন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল সারাটা জীবন। বুড়ো বয়সে একে অন্যকে দেখতে হেঁটে হেঁটে পরস্পরের বাড়ি ছুটে যেতেন। চায়ে চুমুক দিয়ে দির্ঘ্য সময় বসে গল্প করতেন। দুজনই ছিলেন দীর্ঘ্যজীবি ও নির্লোভ। অতি ধার্মিক ও সৎ। বর্তমানকালের ঘুষখোর সাব রেজিস্টারদের সাথে তার কোন তুলনাই হয়না। তিনি ছনের ছাউনির মাটির ঘরে সততার সাথে জীবন কাটান। মওদুদের আব্বা কালামিয়া আব্বাকে পীরের মত মান্য করতেন, হয়ত তিনিও আব্বার বাল্যবন্ধু।

আরেক তারাবীতে নাটেশ্বর গ্রামের আতিকের স্বাক্ষাত পাই। সে ডিভি (ডাইভার্সারি ভিসা) পেয়ে কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। এখন সে বাড়ি গাড়ি কিনে এখানে সুপ্রতিষ্টিত। আতিক আমার শালা-কুটুম। তার বাসায় দাওয়াত পাই কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া হলনা।

ছোটমামার বাসায় ইফতার এক মহা অনুস্টান। মামাতো ভাইবোনেরা সবাই প্রচুর ইফতারী কিনে নিয়ে সপরিবারে এখানে চলে আসে। ছোটমামির হাতে তৈরী হরেক রকমের মিলে দেশী বিদেশী খাদ্যে টেবিল উপচে যায়। আশপাশের আরবী ইয়ামেনী বাসা হতেও প্রচুর ইফতার উপহার আসে। প্রতিদিন সবাই মিলে উৎসবের আমেজে ইফতার পর্ব সমাপন হয়। তারপর ড্রয়িং রোমে জায়নামাজ বিছায়ে মামার ইমামতিতে মাগরিবের জামাত হয়।

একদিন ইফতারে শরিক হন একজন ইয়ামেনী যুবক। দেখতে হালকা-পাতলা তনু, রঙ্গ আমাদের মত শ্যামলা, কুকড়ানো চুল। অনেকটা আমার পুত্র জেফারের মত। এই ইয়ামেনী যুবক আমার মামাত ভাই রাহিদের বন্ধু। আমি এই ইয়ামেনীকে বললাম, একজন ইয়ামেনী দরবেশ হজরত শাহজালাল(রঃ) আমাদের সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। তার নামেই ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামকরন করা হয়েছে। আমার কথা শুনে সে বেশ খুশী হল, তবে বিষয়টা সিলেটি প্রতিবেশী মারফত তার আগেই হয়ত জানা ছিল। আমি বললাম, হজরত শাহজালাল(রঃ) আমাদের দেশে অতি সম্মানিত নাম। আমার একথা শুনে সে জবাব দেয়, তার সম্মান অবশ্যই বেশী হতে পারে, তবে তা কোনমতে সাহাবী, তাবেইন কিংবা তাবে-তাবেইনদের সমান নয়। হ্যাঁ, অবশ্যই সমান হতে পারেনা বলেই আমি থেমে যাই, আর কথা বাড়াতে যাইনি।

এই ইয়ামেনী ছেলেটির নাম মেকি। মেকির ইমামতিতে ঐদিন ইফতারের পর আমরা বাসায় মাগরিবের নামাজ আদায় করি।(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন