চিত্রঃ জর্জ ওয়াশিংটন মনুমেন্টের সামনে পুত্র জেফার,ওয়াশিংটন ডিসি যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- বিশ
যুক্তরাষ্ট্রে
বসবাসরত মুসলমানরা বেশ সংঘটিত। তারা একই নেইভারহোডে বসবাস করা পছন্দ করেন এবং
মসজিদ কমপ্লেক্স কেন্দ্রিক মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। ইসলামকে মার্কিন
সমাজের সহিত মানিয়ে নিতে এক উত্তম ও আধুনিক ব্যবস্থায় তারা ধর্মকে সাজিয়ে নেন। নর,
নারী ও শিশু সবাই একসাথে মসজিদে যান। আসলে মসজিদ এখানে তাদের সম্মিলন কেন্দ্র।
এখানে তারা ইসলাম ধর্মকে সব ধরনের রাজনীতি ও উগ্রবাদ হতে মুক্ত রাখেন। তারা
ইসলামকে শান্তি ও মানবতার ধর্ম হিসাবে উপস্থাপনে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। মসজিদে
খেলাধূলা, মেলা, অনুষ্টান, পাঠাগার ও সম্মিলন কেন্দ্র গড়ে তুলেন। মুসলিম
ছেলেমেয়েরা বিধর্মীদের প্রেমের খপ্পরে যাতে না পড়ে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম
যুবক ও যুবতীদের মধ্যে শরিয়া সম্মত প্রেম করার বৈধতা রয়েছে। শরিয়া সম্মত প্রেম হল
বিয়েপূর্ব নরনারীর পারস্পারিক বুঝাপড়ার জন্য শরিয়ত সম্মত মেলামেশা। একজন কুমারী
হিজাবপরা মেয়ের সাথে অবিবাহিত মুসলিম তরুনের বিবাহপূর্ব স্পর্শবিহীন ভালবাসা।
যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা কেবল নারী নয়, বিধর্মী লোকজনকেও মসজিদে আমন্ত্রন করেন। তাদেরকে মসজিদে মুসলিম জীবন পর্যবেক্ষন করার সুযোগ করে দেন। বিধর্মীদের জন্য মসজিদে কিছু জায়গা বরাদ্ধ রাখা হয়। তারা এখানে বসে স্কলারদের ভাষন শুনেন ও মুসলিম সমাজের ভাতৃত্ব, সাম্য ও ন্যায়নিষ্টতা প্রত্যক্ষ করেন। ফলে অনেকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহন করে থাকেন। অথচ বাংলাদেশে নারী ও বিধর্মীদেরকে মসজিদে ঢুকতে দেয়া হয়না। আমেরিকায় আমি যে সব জায়গায় অবস্থান করেছি সেসব স্থানে বেশিরভাগ মুসলিম মেয়েদেরকে হিজাব পরে চলাফেরা করতে দেখেছি। আমার মামাতো ভাইদের ছোট ছোট কিশোরী মেয়েরাও হিজাব পরে। তবে দুইচার জন অত্যাধুনিক মুসলিম মেয়েরা আমেরিকান বেশে চলাফেরা করলে তাদেরকে অনেকটা স্পেনিশ মনে হয়। কোন কোন আমেরিকান প্রশ্ন করেন বাঙ্গালীদের আদি নারী-পুরুষ কি স্পেনিশ ছিলেন? দীর্ঘ্যদিন আমেরিকায় বসবাসরত বাঙ্গালীরা গৃহাভ্যন্তরে বাঙ্গালিত্ব ধরে রেখেছেন। খাবারদাবার, অতিথি আপ্যায়নে তাদের বাঙ্গালী স্বভাব অটুট।
স্থুলাকৃতির মানুষের দেশ হিসাবে আমেরিকা দুনিয়ায় প্রথম। রকমারি খাদ্যের প্রাচুর্য্যতা, আর্থিক সচ্ছলতা, কায়িক শ্রমহীনতা ও ব্যয়ামহীনতা দেশটির ৩৩% মানুষকে স্থুলদেহ করে দেয়। এমন মোঠা মানুষ বাংলাদেশে একজনও চোখে পড়েনা। মানুষ স্থুলাকৃতি হওয়া নিজের জন্য যেমন সমস্যা, তেমনি এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম সাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যা। আমেরিকার বয়স্ক দম্পতি ও সঙ্গীরা সেজেগুজে একে অন্যের হাত, কোমর বা গাড় ধরে চলাফেরা করেন, বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগেনা বরং বেশ ভাল লাগে। আমেরিকান তরুন তরুনিরা স্বাধীনতাকে ইচ্ছেমত উপভোগ করেন। ট্রেনে বাসে পার্কে রাস্থায় যুবক যুবতীদের অনেকে আলিঙ্গনবদ্ধ ও চুম্বনরত অবস্থায় বেসামাল হয়ে যান। এযেন তাদের এক ধরনের মানবাধিকার। কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকায় না। আমরা নতুন ভ্রমনকারী না দেখার ভান করে আড়চোখে দেখে নেই। পরিবারের জুনিয়র সদস্য নিয়ে বের হয়ে এধরনের পরিস্থিতির সামনে পড়া খুব অস্বস্থিকর। একে পশ্চিমারা ইংরেজিতে বলে 'পাবলিক ডিস্প্লে অব এফেকশন' বা সংক্ষেপে পিডিএ। পিডিএ নিয়ে মার্কিন মুল্লুকে বিতর্ক রয়েছে। ৮০ ভাগ মানুষ পিডিএ সমর্তন করলেও ২০ ভাগ নিষিদ্ধের পক্ষে মত দেন। শিশু কিশোরদের উপর পিডিএ র বিরূপ প্রভাব পড়ে নিশ্চিত। তাই প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে এক মিলিয়নের উপর অনভিপ্রেত কিশোরী গর্ভধারনের ঘটনা সংঘটিত হয়।
আমেরিকার সমাজ শহুরে সমাজ। এখানে খুব অল্প লোকই গ্রামে বসবাস করেন। তবে আমেরিকার শহরগুলো গ্রামের মত নিরিবিলি ও খোলামেলা। বাংলাদেশের শহর গাদাগাদি ঘনবসতি, ময়লা ও অপরিচ্ছন্ন, হিজিবিজি বস্তি। আমেরিকার শহরে এসব নেই। ব্যবসা, সেবা ও শিল্প আমেরিকানদের আসল জীবিকা। তবে কৃষিতেও আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গম, তুলা, আলু, দুধ, মাছ ও মাংস আমেরিকায় উৎপাদন হয়। খনিজ সম্পদেও দেশটি সেরা। তৈল, কয়লা ও লোহা উৎপাদনে আমেরিকা বিশ্বের প্রথমসারির দেশ।
চিত্রঃ নিউইয়র্ক ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনের স্মৃতি সৌধের সামনে পুত্র জেফার কুরেশীএখানে জমি
ছোট ছোট টুকরো নয়। সব ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় বড় যান্ত্রিক খামার। এদেশে সব পেশাই
সম্মানজনক। কোন কাজকেই তারা ছোট বা হীন গন্য করেনা।
আমেরিকানদের
পোষাক সংস্কৃতিও বৈচিত্রময়। তারা বিচিত্র বিচিত্র ধরনের পোষাক পরে চলাফেরা করে। যে
যাই পরুক না কেন কেউ কারো পানে ফিরে থাকায় না। কারো লম্বা চুল, কারো ছোট ছোট চুল,
কারো বেনী বাঁধা, কারো খোলা, কারো ছেড়া প্যান্ট, কেউবা উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ, কেউবা
ভিক্ষুকের থলী নিয়ে চলাফেরা করে। কালোরা প্রায়ই রাস্থা ঘাটে ড্যান্স করে, গান গায়,
নিগ্রো মেয়েরা লম্বা বিছার মত ঝুলানো পচিশ ত্রিশটি চুলের বেনী নিয়ে গর্বভরে হাঁটে,
যেন তারা রূপে রুপে অপরূপা।
আমাদের
দেশের লোকজন একটা সামান্য ব্রিফকেস নিয়ে শূন্যহাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে।
শূন্য হতেই তাদের যাত্রা শুরু হয়। তাই প্রথম প্রজন্মের জীবন হয় কষ্টকর ও অস্থির।
তারা যুক্তরাষ্ট্রের হাইটেক ফাস্ট সমাজে হয় বেমানান। আমেরিকার সমাজ, ভাষা ও
সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। তাই স্বদেশীদের ভীড়ে ভীড়ে তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে।
নিউইয়র্কে
প্রতিমাসে আড়াই-তিন হাজার ডলার রুজি করে দেড় হাজার ডলার বাসাভাড়ায় চলে যায়। খাবার
ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করে একজনের আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই নবাগতদের
স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কাজ করতে হয়। এভাবেই সংগ্রাম করে করে এক প্রজন্ম পার হয়।
তবে তাদের সন্থানরা আমেরিকান হয়ে উঠে। আমেরিকায় উচ্চ কিংবা অর্ধ শিক্ষিত হলেই
চাকুরীর অভাব নেই। চাকুরি মরগেজ করে ঋন নিয়ে তারা সহজেই হাইফাই বাড়ি ও গাড়ির মালিক
হয়। এই প্রজন্মের জীবন হয় সুখ, শান্তি ও প্রাচুর্য্যময়।
আমেরিকায়
সন্থানদেরে শিক্ষিত করে দিলেই হলো, বাংলাদেশের মত তাদের জন্য ধনসম্পদ সঞ্চয় করে
রাখার প্রয়োজন নেই। এখানে সন্থানরাও মাবাবার সম্পদের জন্য লালায়িত নয়। তারা
জীবনটাকে সাগরের উচ্ছল ঢেউয়ের মত উপভোগ করে। আমাদের মত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য
চিন্তা করে তাদের মরতে হয়না। এখানে আমিই আমার আরম্ভ, আমিই আমার শেষ।
আমেরিকা
নিরবতার দেশ। রাস্থায় গাড়ি বেপু বাজায়না, শব্দ করেনা। মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলেনা,
অনুষ্টানে হৈ চৈ করেনা। হাজার হাজার মানুষ কোথায়ও জমায়েত হলে নিরব বসে থাকে, টু
শব্দ করেনা। মানুষ ভদ্র ও সুশৃংখল। সর্বত্র লাইন ধরে কাজ করে। কোন কাজে কোন অফিসে
গেলেই কম্পিটারে নাম ও আসার কারন এন্ট্রি দিতে হয়। সিরিয়াল অনুযায়ী লাউড স্পিকারে
ডাক আসে।
আমাদের
দেশে ধনী লোকেরা একটু বেশী মর্যাদা পান। যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কারো সাহায্যের জন্য
লালায়িত নয়। গরীবের চাওয়া পাওয়া সব রাষ্ট্রের কাছে, কোন ধনী কিংবা প্রভাবশালীর
কাছে নয়। তাই এখানে ধনী, গরীব, প্রভাবশালী সবাই একই মর্যাদা ভোগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ধনী গরীব সবাই নিজস্ব গাড়ি বাড়ি নিয়ে উন্নত জীবন
যাপন করে, এখানে সবাই রাজা, নিজের রাজত্বে। এখানে ধনী ও গরীবের জীবনমানের বৈষম্য
খুব একটা বুঝা যায়না।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্টত্বকে আমি সম্মান জানাই। বিশ্ব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় তাদের অবদান অপরিসীম। আমেরিকানদের অসাধারন জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রঞ্জা ও কর্মকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি দেশটির আর উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে সফর কাহিনীর ইতি টানলাম। (সমাপ্ত) ইসফাক কুরেশী।
চিত্রঃ কলম্বিয়া সাউথ ক্যারোলিনায় মেঝ সমন্দি জামিল ভাইয়ের বাসায় আমি ইসফাক কুরেশী ও ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন