দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- পাঁচ
৫ জুলাই ২০১৬ সাল। পবিত্র ঈদের দিন। গত ঈদ উৎযাপন করি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে। এবার পালন করছি মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েটে, বাংলাদেশ হতে বারহাজার মাইল দূরে এক বাঙ্গালী অধ্যুষিত মার্কিন শহরে। ভোরে ঈদের স্নান সেরে ৩০ মিনিট প্রাত্যহিক হাঁটা সমাপন করে নেই। মামী ও জেরিন গত দুইতিন দিন ধরে ঈদ উপলক্ষে মাংস সিঙ্গারা, চটপটি, পুডিন, পাপওয়ান, রজানিয়া (আমেরিকান খাদ্য), কুকিজ, প্রিংকিজ মিক্স ইত্যাদি পদের খাবার প্রস্তুত করেন। দেশী বিদেশী সব খাবারেরই একটু একটু স্বাধ নেই। ছোটমামা তার বৌমা ডাঃ নুরজাহান বেগমের জন্য দামী ঈদপোষাক কিনে রেখেছেন। আমি ও জেফার বাদ যাইনি। মামার উপহার ঈদের জামা পরে ঈদমাঠে যাবার জন্য গাড়িতে উঠি।
এক বিশাল পার্কের এক প্রান্তে ঈদের জামাত হবে। কার্পেট দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ঘাসের জমিন। বাহিরে খাবার পানির উত্তম সরবরাহ আছে। সেদিনের ঈদ জামাতে প্রায় পাচ-ছয় হাজার মানুষের সমাগম হয়। জামাতের শতকরা আশিভাগ মানুষই সিলেটি। প্রথম খতিব ইংরেজীতে ভাষন দেন। দ্বিতীয় খতিব খাস সিলেটি ভাষায় তার সুদীর্ঘ্য বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যের বিষয়- এই অমুসলিম দেশে ছেলে মেয়েদের প্রতি নজরদারী রাখা। খতিব সিলেটি ভাষায় স্মরন করে দেন, সন্থানরা বিগড়ে গিয়ে ধর্মচ্যুত হয়ে গেলে সবার আম যাবে, ছালাও যাবে। আমেরিকায় হিজরত করার পূন্য জলে ভেসে যাবে। ডেট্রয়েট পার্কের এই ঈদগাহকে মনে হল বিশাল আমেরিকায় যেন এক টুকরো সিলেট। জামাত শেষে আমাদের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক আবু আহমদ খসরু ভাইকে পাই, যিনি আমাদের সাগরদিঘীর পারের প্রতিবেশী।
মিশিগান শীতপ্রধান অঞ্চল। মিশিগানে এখন
সামার। শীতাঞ্চলে সামার খুব আরামদায়ক ঋতু।এখানে দিন লন্ডনের
মত দীর্ঘ্য, তবে রোদে তেমন উত্তাপ নেই। উত্তাপ বেশী
হলে অঞ্চলটা সুদীর্ঘ্য দিনের তীব্র উত্তাপে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেত। ভোরের আজান হয়
সকাল তিনটায় এবং মাগরিব বিকেল নয়টায়। রমজানে তাই উপবাস কাল একটানা আটারো ঘন্টা।
এখানে আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীর মত তাপমাত্রা, তবে বাতাস শুষ্ক।
সব সময় উথাল-পাথাল বাতাস বয়। আসমান মেঘলা অথচ বৃষ্টিহীন। প্রায়ই হালকা হালকা
বৃষ্টি হতে দেখি কিন্তু আমাদের দেশের মত ঝুম বৃষ্টি হতে দেখিনি। তবে শুনেছি শীতে
মাঝে মধ্যে রাজ্যটি বরফে ঢেকে যায়।
তুফার শিশুপুত্র হাসান হাসপাতালে। নিয়াজ
ভাই ও আমি তাকে দেখতে হাসপাতালে যাই। মেশিনে হাত ঢুকিয়ে জীবানু-নাশক গরম পানিতে
হাত ধুয়ে খালিপায়ে শিশু ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে হয়। অনিন্দ্যসুন্দরী ফর্সা সেবিকারা
পরম মমতায় নানা বর্ন ও জাতের বাচ্চাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
মামার পাশের বাসার এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি
বসবাস করেন। ভদ্র মহিলার সাবেক প্রেমিক এলে স্বামী মহাশয় স্বেচ্ছায় উদাও হয়ে যান।
আবার তিনচার দিন পর প্রেমিক চলে গেলে স্বামী বেচারা এসে হাজির হন। মামীর ভাষায় এসব
বিদেশীদের কোন জিদ ঈর্ষে নেই। তারা সবকিছু মেনে নিতে পারে। এমন কি বউয়ের
প্রেমিককেও সুযোগ করে দেয়।
ছোটমামাকে সব সময় দক্ষিনভাগের কিছুলোক
সঙ্গ দিত। নমির আলী ও বিধান বাবু ছায়ার মত তাকে অনুসরন করত। বহু বছর পর আমাকে কাছে
পেয়ে মামা তার অতীতের বাংলাদেশ জীবনের স্মৃতিচারন করলেন। বললেন, বাংলাদেশে
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চুরি-চামারী বেড়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্থ সদ্য স্বাধীন দেশ। জিরো
ফান্ড নিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু। চারদিকে শুধু অভাব আর অভাব। নানাবাড়িতে চোরের
উপদ্রপ শুরু হলো। সুপারী চোর সব সুপারী নিয়ে যাচ্ছে। মামা একদিন সুপারী গাছে
ধারালো ব্লেড বসিয়ে দেন। পরদিন গাছের তলায় সুপারি-ছড়া পড়ে আছে। চোর ব্লেডে কাটা
পড়ে সুপারী ফেলে পালায়। ফোটা ফোটা রক্ত অনুসরন করে মামা চোরের বাড়িতে হাজির হন।
চামড়া কেটে চোরের করুন অবস্থা। পরদিন হতে সুপারী চুরি বন্ধ হলো।
কোন এক রাতে সিংচোর এসে নানাবাড়ির কাষ্টনির্মিত প্রাচীন ঘরটিতে শাবল দিয়ে সিদ কাটা শুরু করে। মামা চোরের আগমন বুঝতে পেরে বড় বুজালী দাও নিয়ে ইদুর ধরার অপেক্ষায় শিকারী বিড়ালের মত খাপ ধরে বসে থাকেন। তার চোখের সামনে মাটিতে একটি গর্ত দেখা গেল। সিদকাটা শেষ হল, মামা শিকারের মাথাটার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথমে সিদ চ্যানেলে চোর টর্স মেরে পরীক্ষা করল। এবার মামার বুজালী দাও রেডি। মামা চরম উত্তেজিত চোরের মাথা ঘরের ভিতরে ডুকছে। চোরের মস্তকে মামা প্রানসপে কোপ বসালেন। বুজালীর কোপ খাওয়া চোরের কোন চিৎকার শুনা গেলনা। কেবল একটা ঝরঝর শব্দ হল। দেখা গেল- চোরের মাথা নয় বরং চোর প্রেরিত লাটির অগ্রভাগে বেঁধে পাঠানো একটি মাটির হাড়িতে কোপ পড়েছে। চোর দৌড়ে পালায়। চোরের পিছু অনেক ধাওয়া করেও অন্ধকারে চোরধরা সম্ভব হলনা। তবে একটা লাভ হল এরপর আর কোনদিন চোর সিদ কাটতে এবাড়িতে আসেনি। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন