দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- তের
১১ জুলাই ২০১৬ সাল। পাশের ডেন্টনিয়া পার্কে বেড়াই। ১৮৯৭ সালে এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি ডেন্টনিয়া পার্ক প্রতিষ্টা করেন। তারা এই পার্কে জমি দান করে অমর হন। পার্কফলকে তাদের নাম ঠিকানা ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লিখা রয়েছে।
ডেন্টনিয়া পার্ক আমাদের অবস্থান
ক্রিসেন্ট টাউনের সন্নিকটে হওয়ায় প্রতিদিন এই পার্কের মাঠে আমার প্রাত্যহিক হাঁটা
ও দৌড়ার রুটিনওয়ার্ক সেরে নিতাম।
প্রতিদিনের মত এই পার্কে আজও টিচাররা
স্কুলশিশুদের নিয়ে এসেছেন। বাচ্চারা ঘাসের গালিচায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, দোলনা চড়ছে, পিছলে পড়ছে, উঠানামা করছে।
টিচাররা বাচ্চাদের সাথে খেলা করছেন, খাবার দিচ্ছেন।
ডেন্টনিয়া পার্কে চেয়ার টেবিল দাবা বোর্ড, খেলার মাট সব আছে।
পাশের টেনিস মাটে কিশোরেরা খেলছে। মিশ্রবর্নের দক্ষিন ভারতীয় কিছু তরুণ মাটের
একপ্রান্তে ক্রিকেট খেলছে।
ডেন্টনিয়া পার্কে একদিন অনেক দৌড়ায়ে আমি
ক্লান্ত হয়ে টিলার সবুজ ঘাসের গালিচায় ঘুমিয়ে পড়ি। মাথার উপর ছিল ম্যাপল গাছের
ছায়া। পাশে বাচ্চারা ঘাসে গড়াগড়ি করছে। কানাডার মিঠে কড়া রোদে ও সুশীতল উচ্ছল
বাতাসে বেশ কদিন ব্যায়াম করে পার্কের বেঞ্চিতে শোয়ামাত্রই গভীর ঘুমের রাজ্যে
হারিয়ে যাই। এসব উন্নত দেশের লোকজন প্রকৃতির স্পন্দন সহজে অনুধাবন করতে পারে।
এখানকার নির্জনতা আমার মনে ধ্যানাবস্থা তৈরি করে। আমি এদেশের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত
হয়ে মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যেতাম।
বাসায় ফিরে এক মজলিশে বললাম, টরেন্টো আমার দেখা
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট নগরী। উর্মি বলল, মামা আপনি
মন্ট্রিল, কেলগেরী কিংবা ভেনকুভার দেখেন নি।
টরেন্টো কানাডার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ন শহর। মন্ট্রিল, কেলগেরী আর
সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন শহর। ভেঙ্কুভার শহরের তো কোন তুলনাই হয়না। প্রশান্ত মহাসাগর ও
রকি পর্বতমালার কাছের শহর ভেঙ্কুভার জাতিসংঘের শ্রেষ্ট নগর সুচকে পরপর ছয়বার
একনম্বর হবার গৌরব অর্জন করে। আমার চাচাত ভাতিজী টুনি এই শহরের নাগরিক। সে আমাকে
ভেঙ্কুবারে আমন্ত্রন জানালেও সময় স্বল্পতায় প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূরের এই শহরে
যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
বাংলা প্রবাদ হল, হাড়ির একটি ভাতে
টিপুনি দিলে পুরো হাড়ির খবর মেলে। মজলিশের সবার কথাবার্তা হতে অনুমান করি আমি
কানাডার সবচেয়ে মন্দ ভাতে টিপুনী দিয়েছি। আমি বলি, ক্যানাডা একটি
স্বর্গ উদ্যান। ডেন্টনিয়া পার্কে যখন প্রথম হাঁটি মনে হল তখন, এই বাগানপারের
মানুষ ভাগ্যবান। এই পার্কে হেঁটে খেলে দৌড়ে আরামে দিন কাটাতে পারবে। পরে টরেন্টো
শহরের যেদিকে যাই, চেয়ে দেখি সবকটি বাসাবাড়ি কোন না কোন
প্রাকৃতিক বন, উদ্যান, পার্ক, জলাভূমি, খেলামাট
পরিবেষ্টিত। উর্মি বলল, বাংলাদেশ হতে এখানে প্রথম আসার পর
আমাদেরো কানাডার সবকিছু খুব ভাল লাগতো, আমরা উদ্যানে
উদ্যানে ঘুরে বেড়াতাম কিন্তু এখন তেমনটি মনে হয়না।
ভাগনা রুহুল আমাকে অবাক করে বলে- কানাডার
মানুষ বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে সুখী নয়। এরা স্বল্পবাক এবং কুকুর নিয়ে একা একা
ঘুরে বেড়ায়। এরা আমাদের মত দলবদ্ধ ও সামাজিক নয়। তাদের মুখে হাসিখুশি নেই। অথচ
বাংলাদেশের মানুষ গরীব হলেও ওদের চেয়ে হাসিখুশি। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা কম, তারা অল্পে সন্তুষ্ট
তাই সুখী। সবকিছু বেশী বেশী পেয়ে যাওয়ায় কানাডাবাসী কোন কিছুরই মূল্য বুঝেনা।
রুহুলের ভাষায়- বাতাস ছাড়া আমরা দশ মিনিটও বাঁচতে পারিনা অথচ এই বাতাস ফ্রি দানের
জন্য আমরা কেউ কি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করি। না, করিনা।
কানাডাবাসীর ক্ষেত্রে রূহুলের যুক্তি আমার কাছে সঠিকই মনে হল।
রূহুল আরেকটি হিসাব আমার সামনে পেশ করল, ক্যানাডা ও আমেরিকায় প্রায় দশকোটি কুকুর সযতনে পোষা হয়। কুকুরখাদ্যের দাম শিশুখাদ্যের চেয়ে বেশী। কুকুর স্যাম্পুর দাম মানব স্যাম্পুর চেয়ে বেশী। দিনে দেখাশুনা করার জন্য কুকুর রাখালকে প্রচুর অর্থ প্রদান করতে হয়। কুকুর প্রতি মাসে পাঁচ শত ডলার করে খরচ হলে দশকোটি কুকুরের জন্য দেশ দু’টির বাৎসরিক খরচ ষাট হাজার কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বাংলাদেশের বাজেটের দেড়গুনেরও বেশী।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন