বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফরপর্ব- চৌদ্দ

 


দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- মাস্যাসুসেট
, মিশিগান এবং ক্যানাডা সফর পর্ব- চৌদ্দ

একজন বাংলাদেশী মা এবং একজন ক্যানাডিয়ান মায়ের তুলনা করতে গিয়ে রুহুল একটি গল্প বলে যায়। রুহুলের এক বন্ধু দুইতিন মাস আগে বাংলাদেশ গিয়ে তার অসুস্থ্য বৃদ্ধ মাকে দেখে ফিরে এসেছে। ফেরার কিছুদিনের মধ্যে মায়ের স্বাস্থ্যের আর অবনতি হলে সে বসের কাছে আবার ছুটি চাইলে বস খুব অবাক হন। কারন বৃদ্ধ মাবাবার প্রতি পশ্চিমাদের তেমন দরদ কিংবা আসক্তি নেই। বুড়ো মা-বাপ অসুস্থ্য হলে হাসপাতালে ভর্তি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। বাকি সব দায়িত্ব সরকারের। রূহুলের বন্ধুকে ছুটি দিতে অনিচ্ছুক বসকে বলল, দেখুন আপনি যখন বাচ্চা ছিলেন আপনার মা আপনাকে ফেলে কুকুর কোলে নিয়ে ঘুরেছে, আর আপনি কাঙ্গালের মত পিছু পিছু হেটেছেন। আপনার মা আপনাকে বেবি-সিটারে ফেলে দিন পার করেছেন। আর আমার মা আমাকে ২৪ ঘন্টা কোলে-পিঠে-বুকে জড়িয়ে রেখে বড় করেছেন। অভাব অনটনের বাংলাদেশে নিজে খেয়ে নাখেয়ে আমাকে খাওয়াতেন। পরম মায়া-মমতায় পেলে-পুষে মানুষ করেছেন।

এবার বাংলাদেশী কলিগের বক্তব্য শুনে ক্যানাডিয়ান বস সত্যটা অনুধাবন করেন এবং বাংলাদেশে যাবার জন্য আবার ছুটি মঞ্জুর করে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্যানাডায় সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ধর্মের কোন প্রভাব নেই। মাইক বাজিয়ে হৈ চৈ করে পথে প্রান্তে ধর্মপ্রচারের কোন সুযোগ নেই। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেও খৃস্টধর্মের তেমন হস্থক্ষেপ নেই। আসলে এই খৃস্টধর্ম অনেক উদার, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর অতি মাতব্বরি করতে যায়না। আমাদের মত ফরজ/ ওয়াজিব বলে তাদের কিছু নেই। আমরা বলি Islam is the whole code of life তারা ধর্মকে whole code of life মনে করেনা। খৃস্টধর্ম কেবল একটা বিশ্বাসের বিষয় ও ধর্ম-সংস্কৃতি হিসাবে টিকে আছে। তারা মনে করে ধর্ম হল পরকাল ও ঈশ্বর বিষয়ক ব্যাপার, দুনিয়াবী কাজে ধর্মের হস্তক্ষেপের কোন দরকার নেই। এখানে যীশু আল্লাহর অবতার ও তার কুমারি মা মেরী সম্মানিতা মহিলা। যুক্তরাষ্ট্রের মত কানাডায়ও উপাসনালয়ে মাইকে আজান কিংবা ঘন্টাধ্বনী বাজিয়ে শব্দদুষন করার অনুমতি নেই। এমন কি এই দুই দেশে রাস্থায় গাড়ির হর্ন শুনাও ভাগ্যের ব্যাপার।

কানাডার লোকজন গৃহে কিংবা উপাসনালয়ে নিরবে নির্জনে ধর্মপালন করেন। ডেট্রয়েটের ঈদের জামাতের উপর পুলিশের গোয়েন্দা ড্রোন উড়তে দেখি। কানাডায় রাজনীতিবিহীন  ধর্মচর্চা চলে। এখানে ধর্ম কেবল আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক বিষয়। জাগতিক কাজ চলে সংসদে রচিত রাষ্ট্রীয় আইনে, এখানে ধর্মীয় আইন অকার্য্যকর। কানাডার প্রায় বাসায় আজান মেশিন রয়েছে। নামাজের সময় হলে আজান মেশিনে স্বয়ংক্রিয় আজান বাজে। মক্কা-মদিনা মসজিদের মধু-সুরে ধ্বনিত আজান ঘরবাসীকে জাগিয়ে তুলে।

ক্রিসেন্ট টাউন বেবিকেয়ার স্কুল পরিদর্শনঃ  

একদিন আমি রূহুলের শিশুকন্যা নাতনী সুহার স্কুল দেখতে যাই। উদ্দেশ্য কানাডার মত উন্নত দেশের স্কুল কেমন চলে তা কাছ থেকে দেখা। প্রতিটি শিশুর জন্য বরাদ্ধ চেয়ার ও টেবিলে শিশুর নাম ইংরেজীতে লিখা আছে। খেলনা ও বইখাতা রাখার জন্য প্রতিটি শিশুর আলাদা আলাদা গ্লাস ক্যাবিনেট রয়েছে। প্রতিটি বাচ্চার কুষ্টিনামা (Family tree) বৃক্ষ ও ডাল আকারে দেয়ালে দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাইবোনের ফটো সহকারে রাখা হয়। প্রতিটি বাচ্চার একটি বড় ফটো তার আলমিরার উপর রাখা থাকে। শিশুদেরকে স্কুলে ব্রেকফাস্ট করানো হয়। প্রতিদিন ছুটির আগে ত্রিশ মিনিট অভিভাবক সহ বাচ্চাদের একটি ক্লাস হয়। স্কুলে ভর্তির পর চিকিৎসক এসে বাচ্চাদের চোখ কান ও বডি পরীক্ষা করে দেখেন। একজন টিচারের বিপরীতে পাঁচ ছয় জন শিশুছাত্র রাখা হয়। এখানকার স্কুলে বাচ্চাদের আচার আচরন, খেলাধুলা, পোষাক পরিচ্ছেদ, সাংস্কৃতিক কার্যাবলী ইত্যাদির উপর পরীক্ষা নিয়ে নম্বার প্রদান করা হয়। স্কুলে ও বাসায় দুইসেট বই থাকায় বাচ্চাদেরকে ভারী স্কুলব্যাগ বহন করতে হয়না ছুটির আগের ছাত্র-অভিভাবক ক্লাসে আমিও নাতিন সুহার সাথে ক্লাশে যোগ দেই। অনিন্দ্যসুন্দরী অল্প বয়স্কা টিচারদের রূপ সৌন্দর্য্যে স্কুলঘর যেন আলোকিত হয়ে আছে। মাদুরের উপর প্রথমে বাচ্চারা বৃত্তাকারে বসে। তাদের পিছনে আরেক বৃত্ত রচনা করে বসেন অভিভাবকরা। প্রথমে সবাই একে একে নিজ নিজ নাম ও ঠিকানা বলে যান। আমার পালা এলে নাম বলে ঠিকানা দিলাম বাংলাদেশ। বললাম আমি একজন লেখক ও পর্যটক। শ্বেতাঙ্গিনী টিচাররা হাসিমুখে মাটিতে দুহাতে আঘাত করে ছড়া পড়েন। শিশুরা সাথে উচ্চারন করে। তারপর ক্লাস শেষ হয়। কানাডার শিশুরা আমাদের শিশুদের চেয়ে অনেক ভাগ্যবান। আমাদের বাচ্চারা এত সুন্দর স্কুল, ফ্রি লান্স, খেলাসামগ্রী, স্কুলমাট, পাঠকক্ষ পায়না।(চলবে)

                   



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন