শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- পাঁচ


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর
  পর্ব- পাঁচ

সেই বিচিত্র ইতিহাসের স্বাক্ষী এই এলিস দ্বীপ এবং এই অভিবাসী জাদুঘর। এই জাদুঘর এত বড় ও সমৃদ্ধ যে এটি কয়েকতলা ভবন নিয়ে গঠিত। এই জাদুঘর বিশাল জ্ঞানসাগর। এই জাদুঘর অধ্যয়ন করতে হলে কয়েকদিন লেগে যাবে। তিন চার ঘন্টার সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রথম তলার মাত্র ২০-২৫% দেখা হল, যা পুরো জাদুঘরের মাত্র ৪-৫% এর বেশী নয়। এই সামান্য দর্শনেই আমেরিকায় মানবসভ্যতার বিশাল বিবর্তন চোখের সামনে ফুটে উঠে।

জাদুঘর হতে বের হয়ে এলিস দ্বীপের একটি পার্কের চেয়ারে বসি। পার্কের কিনারায় আমেরিকায় আগত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার প্রথম অভিবাসী ব্যক্তির নাম স্টিলবোর্ডে লেখা আছে। এই হাজার হাজার মানুষের তালিকায় আছেন প্রথম বাংলাদেশী অভিবাসী ইব্রাহিম চৌধুরী, যিনি এই শতকের প্রথম দিকে জাহাজে চড়ে কোলকাতা হতে নিউইয়র্ক আসেন। তাকে বলা হয় বাংলাদেশীদের ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তিনি বৃটিশ আমলে সিলেট বিভাগের নবীগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। নিউইয়র্কে তিনি অনেক মসজিদ প্রতিস্টায় জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশী কমিউনিটি সেবায় সদা নিবেদিতপ্রান সদ্যপ্রয়াত এই বাংলাদেশী নেতা তার কাজের জন্য বাংলাদেশীদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

এলিস দ্বীপ দেখা শেষ হলে আবার জাহাজে চড়ি। হার্ডসন নদীর যে জেটি থেকে সকালে আমরা যাত্রা শুরু করি, সেই জেঠিতে এসে যাত্রা শেষ হয়। জেঠির বাহিরে এসে আরাফ ভাইকে পাই। তিনি কার নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় আছেন।

আরিফ ভাই আমাদেরকে নিয়ে পাশেই Ground-“0” তে নিয়ে যান। এই Ground-“0” এক সময় ছিল বিশ্ববিখ্যাত World Trade Center. সন্ত্রাসী হামলায় World Trade Center ধ্বংস হয়ে যাবার পর এখন এখানে আছে কেবল স্মৃতিকাঠামো। এই কাঠামোর সামনে বিশাল স্মৃতিপুকুর। পুকুরপারে চতুর্দিক পরিবেষ্টন করে আছে স্মৃতিফলক। এই স্মৃতিফলকে টুইন-টাওয়ার হামলায় নিহত সাড়ে চার হাজার মানুষের সবকটি নাম ক্ষুধাই করা রয়েছে। পুকুরের ঈষৎ ঢালু পার ঘেষে নিচে গড়িয়ে নামছে ফোঁটা ফোঁটা কান্নার জল। চারপারের ঢালু বেয়ে একদম কান্নার গতিতে গড়িয়ে পড়া সব জল একটি চতুষ্কোন চৌবাচ্চায় জমে হারিয়ে যায়। কাছেই টুইন টাওয়ার এলাকায় গড়ে উঠেছে ৭০/৮০ তলা ভবন। সময় নেই, তাই এই ভবনে যাওয়া হলনা।

সন্ধ্যায় ভাগ্নি বিভার বাসায় খেতে যাই। আমার খালাতো বোন এলি আপার তিন মেয়ে বিভা, সুমি ও ইপা সপরিবারে এসে জমায়েত হল এই বাসায়। তিন ভাগ্নিই নানাপদের খাবার তৈরী করে নিয়ে আসেন। একটি বড় টেবিল খাবারে খাবারে ভরে যায়। দেশী ও বিদেশী খাবার। সবাই কষ্ট করে সযতনে এত খাবার নিয়ে এসেছে আমাদেরকে খাওয়াতে, তাই নাখেলে তাদের মনঃকষ্ট হবে ভেবে একটু একটু করে সব খাবারের স্বাদ নেই। খানিক পরে এবাসায় আসে ভাগনা বাবু ও ইপক। ডিনার শেষে রাতের নিউইয়র্ক দেখাতে তারা আমাদেরকে নিয়ে বের হয়। এস্টোরিয়া পার্কের ধারে হার্ডসন নদীর মধ্যভাগে সেতুপথ দিয়ে দৌড়ে যাই। সেতুগুলো মাঝনদীর ভাসমান বৈঠকখানায় গিয়ে শেষ হয়। শীত শীত লাগে তাই শীত তাড়াতে এই দৌড়া দৌড়ি। ওপারে আলো ঝলমলে বহুতল ভবনের সারিমালা- বিশ্বের শ্রেষ্ট বানিজ্যকেন্দ্র ম্যানহাটন। ওইখানে দূর হতে চেয়ে দেখি জাতিসংঘের সদরদপ্তর।

নিউইয়র্ক স্টেইটের আয়তন ৪৭,২২৪ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা এক কোটি বিরাশী লক্ষ। নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজধানী কিন্তু নিউইয়র্ক সিটি নয়। নিউইয়র্ক হতে অনেক দূরে আলবেনী নামক ছোট্ট শহরে। নিউইয়র্ক শহরের একটি বড় অংশ নিউজার্সি স্টেটে ঢুকে আছে। রড আইল্যান্ড, নিউজার্সি ও কানেক্টিকাট স্টেইটের খুব কাছে নিউইয়র্ক শহরের অবস্থান। নিউইয়র্ক স্টেট যুক্তরাষ্ট্রের প্রানকেন্দ্র, তাই এই স্টেটকে বলা হয় এম্পায়ার স্টেট।

ম্যানহ্যাটনের ফুটপাতে দুইজন কালো লোককে ভিক্ষে করতে দেখি। ধন ঐশ্বর্য্যে ভরা যুক্তরাষ্ট্রে এই ভিক্ষুক দেখা আমার কাছে বেমানান মনে হল। আমি ভিক্ষা দিতে চাইলে রিপা বাধা দিয়ে বলল, ওরা অলস ও নেশাগ্রস্ত, নেশার জন্য ভিক্ষা করছে। দানের টাকায় ওরা নেশা টানবে। তাই পুন্যের বদলে পাপই হবে। সরকারী সাহায্যের টাকায় নেশার খরচ হয়না, তাই নাকি এই ভিক্ষাবৃত্তি। কেবল কালো নয়, একজন সাদা বৃদ্ধকেও আমি ম্যানহাটনের ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করতে দেখেছি। তার সামনে একটি ছোট সাইনবোর্ডে লিখা- “Please give me a dollar, God will bless you.”

২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, সোমবার। আজ মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি যাবো। অন লাইনে টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আমার মোবাইলে Megabus.com এর প্রেরিত ম্যাসেজই টিকেট। রিপা গাড়ি চালিয়ে নিউইয়র্কের বারো রাস্থা তেরো গলী পেরিয়ে মেগাবাস ডট কমের আস্থানায় আমাদেরকে নেয়ে আসে। এখানে প্রাইভেট কারের পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় তাকে দ্রুত চলে যেতে হল। মেঘাবাসে উঠার জন্য মানুষ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এবার মেঘবাস সামনে আসে। বাসটি আমাদের গ্রিনলাইনের বড় বাসের চেয়ে দেড়গুন লম্বা এবং দুতলা। দুইজন কালো লোক মাল উঠান। কোন সিটে বসব জানতে চাইলে হেল্পার বললেন, যেখানে খুশি বসতে পারেন। আমরা দুতলার একদম সামনের সিটে গিয়ে বসি এবং প্রিয় আমেরিকা এবার নয়নভরে দেখবো তোমাকে। আমেরিকার জাতীয় মহাসড়ক অতি উন্নত। নিউইয়র্ক হতে ওয়াশিংটন ডিসির দূরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল। মহাসড়কের লেন সংখ্যা ২৪টি। প্রতিলেন আমাদের প্রায় দুইলেনের সমান। এই ২৪ লেন ছাড়াও পুলিশ ও এম্বুল্যান্সের জন্য আলাদা লেন রয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উন্নত কার, ক্যারাভান গাড়ি, বাস, লরি শা শা করে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির লাইটের আলো জ্বলজ্বল করছে। তৈল ও পন্যবাহী বাইশ চাকার নীল লরিগুলো আমাদের দেশের ২৪/২৫ টি ট্রাকের সমান মালামাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়ও আমাদের রাস্থার উপর দিয়ে কোথায়ও নিচ দিয়ে ১৫/২০ লেনের মহাসড়ক ওভারব্রিজ বা আন্ডারব্রিজ হয়ে চলে গেছে। মহাসড়কে চলার পথে কোথায়ও কোন বাধা নেই। সর্বত্র সাইনবোর্ডে পথ নির্দেশনা রয়েছে। সড়কের দুপাশে পাইন, ম্যাপল ও বির্চের বন। বাংলাদেশের মত অনেক নদী ও জলাবন চোখে পড়ে। দুপাশে ঘন সবুজের হাতছানি। বাংলাদেশে যত গাড়ি আছে, যেন এই মহাসড়কের ৪০/৫০ মাইলে তার চেয়ে বেশি গাড়ি আছে। (চলবে) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন