যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- চার
এবার আমরা Rope way vehicle চড়ে তারপথে হার্ডসন নদী পার হয়ে ম্যানহাটন প্রবেশ করি। এই ম্যানহাটন
বিশ্বের বানিজ্যিক রাজধানী, পৃথিবীর সব বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানীর প্রধান কিংবা
উপপ্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। এখানে সুউচ্চ দুইটি টাওয়ার নিয়ে আকাশ ছুঁয়ে
দাড়িয়ে ছিল World Trade Centre. আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ বছর আগে
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে মাত্র আটারো মিনিটের ব্যবধানে এই দুইটি টাওয়ারের উপর
সন্ত্রাসীদের ছিনতাই করা দুইটি বিমান আচড়ে পড়ে। আগুন জ্বলে ওঠে দুইটি টাওয়ারে,
তারপর ধ্বসে পড়ে মাটির সাথে মিশে যায় যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব World Trade
Centre. চারশত ফায়ার সার্বিস কর্মিসহ নিহত হন সাড়ে চার হাজার মানুষ। এই সন্ত্রাসী হামলার বদলা নিতে আফগানিস্থান ও ইরাক মার্কিন হামলায়
বিদ্ধস্থ হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে এখানে এক গোপন বৈঠকে বসেন বৈজ্ঞানিক
আইনস্টাইন, বৈজ্ঞানিক ওপেন হেইমার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। সেদিন তাদের
গৃহীত ম্যানহাটন প্রজেক্ট বিশ্বে পারমানবিক যুগের সূচনা করে এবং তা জাপানের
হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরী পারমানবিক বোমায় বিধ্বস্থ হবার পথ রচনা করে। ম্যানহাটনের
সড়কগুলো ঢাকার তুলনায় অনেক বড়। বিশাল বিশাল রাস্থা ও ফুটপাথের কিনার ঘেষে দাঁড়িয়ে
আছে আকাশচুম্বী ভবনের সারি। এই ভবনমালার চূড়া দেখতে হলে ঘাড় পিছনের দিকে ৪৫ ডিগ্রী
বাকাতে হবে। রাতে আমরা হার্ডসন নদীর ওপারের এস্টোরিয়া পার্ক হতে ম্যানহাটনের দিকে
তাকিয়ে আলো ঝলমলে অপরূপ ম্যানহ্যাটন দেখে বিমুগ্ধ হই। সেদিন বেশকিছু বিদেশী ফল
প্লাম, চেরি ও পিচের স্বাদ নেই। সাপ্তাহের নিদৃষ্ট দিনে রাস্থার গার্বেজে ফেলা ভাল
ভাল মেট্রেস, কাপড়, কাট ও ইলেকট্রিক পন্য দেখি যা আমাদের দেশের লোকেরা পেলে খুশী
হয়ে বাড়ি নিয়ে যেত।
ঐদিন আমরা
হার্ডসন নদীর মাঝে ভাসমান সুন্দর দ্বীপ রোজভেল্ট আইল্যান্ড সফর করি। ছোট্ট এই
দ্বীপের চারপাশের জলসীমা ঘেষে রয়েছে সড়ক ও ফুলবাগ। বাগান, গ্যালারী, খেলার মাট, বসার
স্থান, শিশুপার্ক এবং সুরম্য ভবনমালায় সজ্জিত রূজভেল্ট আইল্যান্ড। এই আবাসিক
দ্বীপে মানুষের উপভোগের সব ব্যবস্থা রয়েছে। এই দ্বীপে ফ্ল্যাটের দাম আকাশছুঁয়া এবং
আমেরিকার ধনীরা এখানে বসবাস করেন। এই দ্বীপের ঝিরঝিরে বাতাস ও মিঠে মিঠে রোদ
মনটাকে কবি করে দেয়। বিদেশি বৃক্ষচ্ছায়ে লন টেনিস মাটের ছোট্ট গ্যালারীতে বসি।
পার্কের সুন্দর ব্রেঞ্চিতে বসে মনে হল এগুলোতে ঘুমিয়ে রাত কাটানো যাবে। এখানে
মশামাছি নেই, নেই ধূলা বালি ময়লা। তাই বাংলাদেশের মত এখানে পরা কাপড় সহজে ময়লা
হয়না। রোজভেল্ট আইল্যান্ড আয়তনে বড়জুর আমাদের সাগরদিঘীরপার এলাকা হবে। সড়ক ও
ফুটপাথ প্রশস্ত। এক অদ্ভুদ স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য ও নিরবতা এই আবাসিক দ্বীপটিকে
প্রশান্তি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
২০
সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, রবিবার। আজ আমরা মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি যাবার আয়োজন
করি। রিপা লেপটপে বসে অনলাইনে মেঘাবাস ডট কমের তিনটি টিকেট কাটে। ক্রেডিট কার্ডে
সে বিল পরিশোধ করে। সাথে সাথে ম্যাসেজ আসে। এই ম্যাসেজই বাসের টিকেট। আমি রিপাকে
টিকেটের দাম দিতে চাইলে সে নেয়নি। আমাদের দেশে টিকেট করতে কাউন্টারে দৌড়াতে হয়।
হাইটেক আমেরিকায় এসব ঝক্কি ঝামেলা নেই। এদিন আরাফ ভাই আমাদেরকে স্টাচু আফ লিবার্টি
দেখাতে নিয়ে যান। পথে তিনি গাড়ি থামিয়ে হার্ডসন নদীতে নোঙ্গর করা কলম্বাসের
পালতোলা তিনটি জাহাজ নিনা, পিন্টা ও সান্তামেরিয়া দেখান। এই ধরনের তিনটি জাহাজে
আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেন।
একসময় আমরা
হার্ডসন নদীতীরের একটি জেটিতে আসি। আটলান্টিক উপকূলের কয়েকটি পর্যটন দ্বীপে যাবার
টিকেট কিনতে লাইনে দাড়াই। আমেরিকানরা সুশৃংখল, যে কোন ব্যাপারে তারা লাইন ধরেন।
নিরাপত্তা পরীক্ষা করার পর আমরা একে একে সবাই এইটি তিনতলা ব্যাসেলে আরোহন করি।
এবার ব্যাসেলটি হার্ডসন নদীর ভাটি পূর্বদিকে আটলান্টিক মহাসাগর পানে যাত্রা শুরু
করে। নিউইয়র্ক মহানগর এমন একটি শহর যা হার্ডসন নদী, কিছু দীপাঞ্চল ও আটলান্টিক
উপকূলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই নদী আমাদের পদ্মা মেঘনা যমুনার মত বিশাল, যাহা
বেশকিছু রাজ্য ও সাগরসম লেকের পানি আটলান্টিক মহাসাগরে নীল জলরাশিতে হয়ে নিয়ে যায়।
নিউইয়র্ক
শহর নদী ও সাগরের মাঝে প্রসারিত কয়েকটি দ্বীপ-উপদ্বীপ যেমন এলিস আইল্যান্ড,
রোজভেল্ট আইল্যান্ড, লিবার্টি আইল্যান্ড, লঙআইল্যান্ড উপদ্বীপ এবং নদী-সাগরের
উপকূল নিয়ে গড়ে উঠেছে।
আমাদের
পর্যটন জাহাজ নানা জাতি ভাষার লোকে পূর্ন। তারা জাহাজের কিনারায় দাড়িয়ে ছবি তুলছে,
জাহাজের দোকান হতে চকলেট, পানীয়, বিস্কিট কিনে খাচ্ছে। নদী দিয়ে স্টিমার ও
স্পিডবোট সা সা করে ছুটে ছলছে। হঠাৎ চোখের সামনে স্টাচু অব লিবার্টি দেখা গেল।
জাহাজ এসে স্টাচু অব লিবার্টি দ্বীপের জেটিতে নোঙর করে। স্টাচু আফ লিবার্টি দ্বীপটির
আয়তন তিন একর, যা আমাদের এমসি কলেজমাটের
মত হবে। এই দ্বীপ হার্ডসন নদীর মোহনায় আটলান্টিক মহাসাগরের কূল ঘেষে অবস্থিত।
আমেরিকার অন্য দ্বীপগুলোর মত এই দ্বীপে আছে সান বাঁধানো তীর, তীরের সীমানা বরাবর
সড়ক ও বাউন্ডারী। রাস্থার নিচে এসে আচড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। আমরা জেটি হতে নেমেই হেঁটে হেঁটে একবার পুরো দ্বীপটি প্রদক্ষিন করে আসি।
স্টাচু আফ লিবার্টি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্মারক-স্মরনী। এই মহিলা স্টাচুটির
বগলে বই এবং হাতে জ্বলন্ত মশাল। এই স্টাচুর ফেস ইমা নামীয় একজন বিখ্যাত মহিলা
কবির। একটি কয়েক তলা ভবনের উপর এই বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। বৃটিশদের
বিরূদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ফরাসীরা মার্কিনীদেরে সাহায্য করে। যুক্তরাষ্ট্র
স্বাধীন হলে ফরাসীরা এই মূর্তি তৈরী করে জাহাজে যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়ে দেয়। পর্যটকগন
সিড়ি বেয়ে বেয়ে নারী মূর্তির মশাল পর্যন্ত পৌঁছে যান। স্টাচু আফ লিবার্টির সামনে
বাজার আছে। এখানে স্টাচু আফ লিবার্টির মিনিয়েচার, চা, কফি, বিস্কিট ইত্যাদি রমরমা
ব্যবসা চলে। এবারে জাহাজে উঠার ডাক পড়ে। স্টাচু আফ লিবার্টি দেখা শেষ, আমরা আবার
লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি।
জাহাজ
আমাদেরকে এবার আরেকটি দ্বীপে নিয়ে যায়। এই দ্বীপটির নাম এলিস আইল্যান্ড। এই
দ্বীপের প্রধান আকর্ষন বিখ্যাত ইমিগ্রেন্ড মিউজিয়াম। এই দ্বীপে নেমে অধিকাংশ
আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। আমেরিকায় আগত আদিম
ইমিগ্রেন্টদের বিস্তারিত ইতিহাস, সচিত্র তথ্য ও নিদর্শন সহকারে এই জাদুঘরে
সংরক্ষিত রয়েছে। এই জাদুঘরে আছে প্রাচীন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ জনগুষ্টির পোশাক
পরিচ্ছেদ, ব্যবহার্য্য পন্য, লাটি, ছড়ি, তরবারি,হ্যাট ইত্যাদি। আফ্রিকা হতে হাত-পা
বেঁধে ধরে আনা উলঙ্গ- অর্ধ উলঙ্গ কালো কৃত দাস-দাসীদের প্রামান্য চিত্রাবলী। দড়ি ও
জিঞ্জির পরানো নিগ্রো নরনারী বিক্রয়ের জন্য এই এলিস দ্বীপে নামানোর সন ও তারিখ সহ
বিবরন। সেযুগে শিল্পীদের আঁকা কিংবা ক্যামেরায় তুলা দলবদ্ধ কৃতদাসের সারি। হাত-পা
বাঁধা উলঙ্গ মানব সন্থানদের পণ্য হিসাবে বাজারে বিক্রয়ের ছবি দেখে গা শিউরে উঠে।
আরব ও ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা অসংখ্য বালকদেরে ধরে বেঁধে জুরপূর্বক জাহাজে তুলে
আফ্রিকা হতে এলিস দ্বীপে নিয়ে আসে। এই দুর্ভাগা বালকেরা চিরদিনের জন্য পরিবার
পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। শ্বেতকায় জমিদাররা
তাদের শত শত একর জমি চাষে এসব কৃতদাসদের নায্য পারিশ্রমিক ছাড়াই ব্যবহার করে।
তাদের শ্রমে ও ঘামে যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক কৃষি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিনত হয়। কালো
নিগ্রো জাতির মত মজলুম জাতি পৃথিবীতে বোঢ হয় খুব কমই আছে। নুতন দুনিয়া আমেরিকা
আবিস্কার হলো। ইউরোপ হতে শ্বেতাঙ্গ ভাগ্যান্বেষীরা দলে দলে জাহাজ ভর্তি হয়ে ছুটলো
আমেরিকায়। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদেরে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিজামা দখল করা
হলো। নতুন দেশ ও ক্ষেত-খামার গড়তে হলে প্রচুর মজুর চাই। এই সস্তা মজুরের চাহিদা মেঠাতে শিকলে বেঁধে বড় বড় জাহাজ বুজাই করে নিয়ে আসা হল আফ্রিকান নিগ্রোদেরে।
বর্তমান যুগে গরু-ছাগল যেভাবে চালান দেয়া হয় ঠিক সেভাবেই। এই ক্ষুধার্ত উলঙ্গ কালো
মানুষগুলোর কত লাশ যে জাহাজ হতে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে তার হিসাব কে রাখে।
এসব কালো দাসদের পরিশ্রম এবং শ্বেতাঙ্গদের ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট উন্নত দেশরূপে গড়ে উঠেছে। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন