শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- তিন


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর  পর্ব- তিন

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রোজ বৃহস্পতিবার। আমেরিকার বৃহৎ ও শ্রেষ্ট নগরী নিউইয়র্কে আমার প্রথম ভোর দর্শন। নামাজ পড়ে প্রাতঃভ্রমনে বের হই। রিপার বাসার ঠিকানাঃ ৩১-০৬-৮২ জ্যাকসনহাইট, ইস্ট এলমাস্ট। ৩১ নং এভিনিউয়ের ৮২ নং সড়কের ৬ নং বাসা।  প্রতিটি এভিনিউতে সবগুলো বাসার ডিজাইন প্রায় একই। আমেরিকায় নিজের ইচ্ছেমত বাসার ডিজাইন করা যায় না। সরকার যে এলাকায় যে ডিজাইন নির্ধারন করে দেয় সে ডিজাইনে বাসা নির্মিত হয়। বাসার বহির্ডিজাইন চুল পরিমান কমবেশ করতে হলে কতৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। এদেশে ধনী ও গরীবের তারতম্য খুব একটা বুঝা যায়না। এক এলাকার ধনী গরীব সবাই একই ধরনের বাসার বসবাস করেন। সারিবদ্ধ বাসাগুলোর সামনে ফুল ও পাতাবাহারের বাগান। তাতে মা-ম্যারী, যীশু, বিড়াল, হাঁস, পাখির ভাস্কর্য্য। ফুটপাত মসৃন কোথায়ও কোন উঁচুনিচু নেই। তাই চোখমুদে এসব ফুটপাথে হাঁটা যায়। আমাদের ফুটপাথের মত আচাড় খাবার সম্ভাবনা নেই। বেবীসিটার, ট্রলী, পঙ্গুচেয়ারে বসে মানুষ এই মসৃন ফুটপাথে আরামছে ঘুরে বেড়ায়।  কিংবা   এশহরের ফুটপাতগুলো আমাদের দেশের রাস্থার মত সুপ্রশস্থ, ফুটপাতে লাগানো সবুজ বৃক্ষগুলো পথচলার পথে কোন বিঘ্ন তৈরী করেনা। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় মনে হয় কোন বাগানে হাঁটছি। রাস্থা পারাপারে এখানে লাইট সংক্ষেত অনুসরন করতে হয়।

লান্সের পর রিপা আমাদেরকে ম্যানহাটান ও সেন্ট্রাল পার্ক দেখতে নিয়ে যায়। কারপার্কিং সমস্যা এড়াতে আমরা ভূতল ট্রেনে ম্যানহাটান যাই। আমাদের দেশে ভুতল ট্রেন চড়ার সুযোগ নেই, তাই আমাদের জন্য ভূতল ট্রেন চড়ার আনন্দই আলাদা। বাসার কাছেই রাস্থার কিনারায় একটি ঘরে ডুকে চলন্ত সিড়ি বেয়ে অনেক নিচে ভূতল স্টেশনে নেমে যাই। আমি সিঙ্গাপুরে ভুতল ট্রেন চড়লেও জেফার ও ডাঃ নুরজাহান বেগমের এটাই জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা।

ভুতল ট্রেন আমাদেরকে সেন্ট্রাল পার্কে নিয়ে যায়। লং আইল্যান্ড হল হার্ডসন নদীর মোহনার একটি সুদীর্ঘ্য উপদ্বীপ। এই উপদ্বীপের শুরুটায় সাড়ে তিন বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিশাল সেন্ট্রাল পার্ক। এই পার্কের কাছেই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিখ্যাত ম্যানহাটান টাউন। সেন্ট্রাল পার্ক মানব সৃষ্ট, অথচ মনে হয় প্রাকৃতিক বাগান। এখানে আছে মানুষের হাতে গড়া, পাহাড়, টিলা, হ্রদ ও বনভূমি। ঘোড়ার গাড়িতে বসে মানুষ ঘুরে বেড়ায় সারাটা সেন্ট্রাল পার্ক। ঘোড়ার মলমূত্র কখনও মাটিতে পরেনা, কৃত্রিমভাবে বসানো ব্যাগে ডুকে, তাই সড়ক দুষিত হয়না।

সেন্টার পার্কে আমাদের রিকশারও দেখা পেলাম। নানা চিত্রকর্মে সাজানো একদম ঢাকাইয়া রিকশা। রিকশা আমেরিকানদের কাছে বিরল প্রজাতির অদ্ভুদ ত্রিচক্র যান। ব্যাটারী চালিত এসব রিকশা চালিয়ে অনেকে কম কষ্টে বেশী রুজি করছেন। এসব রিক্সারোহী অনেক পর্যটক হয়ত আদৌ জানেনা বাংলাদেশে ব্যাটারী নয়, মানুষ প্যাডেল মেরে রিকশা চালায়। গায়ের জুর খাটিয়ে মানুষ রিকশা চালায় শুনলে তারা অবাক হত, সেই সাথে দুঃখও পেত। 

পর্যটকদেরকে সামনে বসায়ে মূহুর্তের মধ্যে অবিকল ছবি একে দিচ্ছে দক্ষ শিল্পীরা, ছোট্ট পরিচ্ছন্ন দোকানে বসে পানীয় ও বিস্কুট বিক্রি করছে দোকানীরা। শর্মা, বার্গার, চা ও কফির দোকানও সরগরম। ডান্স করে ও গান গেয়ে টু পয়সা কামাই করছেন আফ্রিকান কালো নর্তক ও গায়কের দল। সেন্ট্রাল পার্ক এত বড় যে সারাদিন হেঁটেও সারাটা পার্ক দেখা সম্ভব হবেনা। লেকের নীল জলে পাখি ও বুনো হাঁস সাঁতার কাটছে।

পার্কের অপুর্ব সুন্দর ফোয়ারায় আসেন দুইজন সুসজ্জিত চীনা বরকনে। কনের দুঘধবল ড্রেস এত লম্বা যে মাটি ঝাড়ু দিচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যে আরেক জোড়া বরকনে সেজেগুজে এসে হাজির হন। তাদের সাথে আসেন একদল ফেন। এই কনের পোষাক হালকা গোলাপী এবং ঘাসের গালিচা ছুঁয়ে আছে। এই পার্কে বসে কেউবা একমনে গিটার বাজাচ্ছে, কেউবা পিয়ানো।

সেন্ট্রাল পার্কের রাস্থার কিনারায় অবক্ষমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমেরিকার সব বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বিজ্ঞানী, আইনবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সেন্ট্রাল পার্কে আছে জাদুঘর, দাবা ও পাশা খেলার মঞ্চ, ব্যায়ামাগার। আমি বৃক্ষলতাবিদ নই। তাই এসব অজানা বৃক্ষলতা ও ফলফুলের বিবরন দেবার সাধ্য আমার নেই। এই পার্কের মাটির নিচ দিয়ে জালের মত বিস্তৃত রয়েছে ট্রেন ও ট্যানেল। এখানে মাটির নিচে যে এক ব্যস্ত জগত, তা উপরের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে বুঝার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে উচুউচু আসমান ছোঁয়া ভবনমালার ম্যানহাটানের সব দুষন চুষে নিচ্ছে এই সেন্টার পার্ক এবং আশপাশের নদী ও সাগর। আশপাশের ব্যস্ত ভবনের মানুষগুলো কাজের ফাঁকে এখানে এসে নিজেদেরকে সতেজ করে নেয়।

সেন্ট্রাল পার্কের কিনারায় বসে আমরা জনপ্রিয় আরবী খাবার জায়রা কিনে খাই। জায়রা হল চিকেন, কারি, সালাদ ও সসের মিশ্রন যা বড় রুটির মধ্যে আমাদের পানের খিলির মত করে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। জায়রা এত বড় যে খেতে বেশ সুস্বাধু হলেও পুরোটা খাওয়া আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। শুক্রবার। আজ রাতে আমেরিকান স্নেপার ফিস (Snaper fish) খাই। রিপা খুব মজা করে মাছটি রান্না করেছে, খেতে একদম আমাদের ইলিশের স্বাদ। ভোর হলে আরেক এভিনিউতে হাঁটি। অনেক বাসা বাগানে বক, পাখি, বাঘ ও সিংহ মূর্তি। কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে বসা খরগোস মূর্তির ঝুড়িতে ফোটে আছে প্রাকৃতিক ফুল। বাগানে ছেয়ে আছে গাঁদা, গোলাপ, টিউলিপ, কলা ও তারাফুল।

কিছু লোকজন কুকুর নিয়ে হাঁটছে। কুকুরের মলত্যাগের সময় দেখা গেল একজন লোক কুকুরের পায়ুর নিচে টিস্যু পেপার ধরে মল হাতে তুলে নেন। তারপর পকেট হয়ে ব্যাগ বের করে এই মল বহন করে যথাস্থানে ফেলতে নিয়ে যান। জেফার অবাক কুকুরের মল লোকটা মাটিতে পরতে দেয়নি। কোথায়ও কুকুরের মল পড়লে খবর আছে। কুকুরের মালিকের ঠিকানার টিকেট যাবে, জরিমানা হবে। আমেরিকানরা তাই তাদের প্রিয় কুকুরের মল নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নেয়। একটা কুকুর পোষতে তারা একজন মানুষ পোষার খরচ বহন করে।

মামা আমি ও জেফার জুমুয়ার নামাজ পড়তে কুইন্সের মসজিদে যাই। আমেরিকা নিরব নিস্থব্ধ দেশ। যে কোন ধরনের শব্দ দুষন এদেশে নিষিদ্ধ। তারা গীর্জায় ঘন্টি, মন্দিরে ঢোলক কিংবা মসজিদে মাইকে আজান বাজাতে দেয়না। এদেশে ধর্মপালন যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাংলাদেশীদের পরিচালিত এই মসজিদের ইমাম একজন বাংলাদেশী। তিনি ইংরেজীতে খুতবা পাঠ করেন। দুতলা এই মসজিদে কোন গম্বুজ কিংবা মিনার নেই। সেই জুমুয়ার জামাতে প্রায় শতাধিক মুসল্লী শরীক হন।

বের হয়ে মসজিদের বাহিরে স্থুপাকারে রাখা বেশ কিছু বাংলা পত্রিকা পাই। পত্রিকাগুলোর নাম ‘সাপ্তাহিক প্রবাসী’ ‘সাপ্তাহিক বাঙ্গালী’ ইত্যাদি। বাংলাদেশীদের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এসব পত্রিকা বিনামূল্যে বিতরন করা হয়। হাসিনা, খালেদা, এরশাদ হতে শুরু করে দেশের সব খবরই এসব পত্রিকায় রয়েছে। এমন কি নিউইয়র্ক হোটেলে অনুষ্টিত মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ও আওয়ামী লিগ নেতা সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর শোকসভার বিবরন পাঠক হিসাবে পেয়ে যাই। আসলে নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করার একটা তীব্র বাসনা সবস্থানেই মানুষের মধ্যে রয়েছে। তা দেশ হউক, নতুবা বিদেশ হউক। আমাদের প্রবাসীরাও এই বাসনার বাহিরে নন। তারা এসব ক্ষুদে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোতে নিজেদের খবর, অবস্থান, ব্যবসাপাতির প্রচারনা সব চালিয়ে যান।

রাতে আমার বেগম ডাঃ নুরজাহানের রনকেলী গ্রামের মামাতো বোন হোসনা আপা- মুনিম ভাই দম্পতির ত্রিতলা বাসায় যাই। তারা বেসমেন্ট ও দুতলায় থাকেন এবং উপরে ভাড়াটিয়া আছেন। এখানে আমরা নানাপদের খাবার খাই ও একশত ডলার উপহার পাই। এবাসার কাছেই আমার মামাতো বোন আরফার বাসা। সে বাসায় আরফা ও তার স্বামী সাদিক চৌধুরীকে পাই। সাদিক চৌধুরীর বাড়ি ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া গ্রামে। তাদের দুই কন্যা রাইসা ও রিমা, একমাত্র পুত্র আয়মনকে নিয়ে তাদের সুখী পরিবার। এখানেও বর্ননাতীত খাবার খেয়ে আর একশত ডলার গিফট মানিব্যাগে ঢুকাই। রাতে আমাদের ঘাটি রিপার বাসায় ফিরে আসি।

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫, শনিবার। রিপা আমাদেরকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে নিয়ে যায়। চারতলা ভবনের বিশাল যাদুগর। চৌদ্দ পনের মিলিয়ন বছর আগের ডায়নুসারের সুবিশাল দেহকঙ্কাল দেখি। ডায়নুসারের এই কঙ্কালের উচ্চতা দেড়তলা ভবনের সমান হবে, যা দৈর্ঘ্যে ৩৫/৪০ ফুটের কম হবেনা। এখনে ডায়নুসার, মামথ, নীলতিমি ইত্যাদি প্রানীর ফসিল দেখে অন্য হলে যাই। সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত পন্য, শিকার ও যুদ্ধাস্ত্র, ঘরবাড়ির নমুনা দেখি। এখানে মিনিয়েচার করে রাখা রেড ইন্ডিয়ান গ্রাম, গ্রামের সর্দার সভা, রেড ইন্ডিয়ানদের পশু শিকার, মাছধরা ও কৃষি জীবন গ্লাসের ভিতর সাজানো আছে। কাঁচের প্রকুষ্টে রয়েছে বনে বিচরণরত অবস্থায় নানা প্রজাতির পশু, পাখি, সর্প ইত্যাদি। নুরজাহান বেগম পা ব্যথায় হাঁটতে অক্ষম, তাকে বসায়ে রেখে আমরা হেঁটে হেঁটে দেখে আসি। প্রায় তিনঘন্টা হেঁটে চারতলা জাদুঘরের কেবল নিচতলার একটি অংশ দেখা হয়, যা পুরো জাদুঘরের বড়জুর ১০-১৫% এর বেশী হবেনা।

এবার যে ভবনে ঢুকি, সেখানে নানা তথ্য উপাথ্য সহকারে ডারউইনের পূর্ন বিবর্তনবাদ সাজানো আছে। চারপায়ে ভর করে চলা বানর(এসস) হতে দুইপায়ে ভর করে বানর(প্রাইমেটর) এবং এই বানর(প্রাইমেটর) হতে আদি হোমসেপিয়ান্স ও নিয়ানথান্ডাল মানব প্রজাতির উদ্ভব ও বিকাশ এখানে প্রদর্শন করা আছে।

আমেরিকার এক একটা জাদুঘর, মুক্তজ্ঞানের এক একটা বিশাল ভান্ডার। খাতা কলম নিয়ে এই সব জাদুঘরে ঢুকে কয়েকদিন সময় নিয়ে এক একটা গ্যালারী পর্যবেক্ষন করতে হবে। ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এসব জাদুঘরকে তাদের গবেষনা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন। লন্ডন জাদুঘরে সমাজ বিজ্ঞানী কার্লমার্ক্স সামাজিক দন্দ্ববাদের উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন