যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- দুই
আটলান্টিক
পার হয়ে কানাডার আকাশসীমা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঈশান কোনের স্টেইট মাইন,
ম্যাসাসুটেট ও রডআইল্যান্ড হয়ে নিউইয়র্ক জেএফকে বিমানবন্দরে অবতরণ করি।
ইমিগ্রেশনের ঝামেলা আবুধাবিতে সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় জেএফকে থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসি। বেল্ট
হতে ছয়টি ব্যাগ ও তিনটি হ্যান্ডব্যাগ দুইটি ট্রলীতে তুলে তিনজন বাহিরে এসেই মামাতো
বোন রিপা চৌধুরীকে পেয়ে যাই। বেশ বড়সড় একটি গাড়ি ড্রাইভ করে তিনি এসেছেন। পিছনের
বড় বেনেটে সব মালামাল সহজে জায়গা হলো।
অনেক বছর
পর মামাতো বোন রিপাকে দেখি। মনে সংশয় ছিল এত বছরে খানিকটা দূর হয়ে গেলাম নাকি? তার
মুখের দিকে তাকিয়ে অতীতের স্মৃতি মনে হল এবং একটা দুঃখবোধও হল ওরা আত্মীয়স্বজন
দেশখেস ছেড়ে সুদূর বিদেশ বিভূইয়ে পড়ে আছে। গাড়িতে চড়ে বসলাম। রিপা গাড়ি চালিয়ে
৩০/৩৫ মিনিটে কুইন্সে তাদের বাসায় পৌঁছে।
কিছুক্ষনের
মধ্যে টের পেলাম সে-তো ঐ আগের রিপাই রয়ে গেছে। ১৯৯৪ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর
আগের ছোট্ট রিপন। বড়লেখার দক্ষিনভাগ গ্রামের ফ্রকপরা সেই বালিকা রিপন এখন
দুইকন্যার জননী। জৈষ্ট্যা কন্যা বারতম ক্লাশের ছাত্রি মুনিয়াত চৌধুরী জিন্সপ্যান্ট
ও ট্রাউজার পরা আমেরিকান কিশোরী। কনিষ্টা কন্যা নিয়ামা ছয় বছরের শিশু। সারাদিন
ইংলিশে বকবক করে বেড়ায়। সে স্কুলে যায়। আমেরিকায় স্কুলে বাচ্চাদের খাবার দাবার,
খেলাধূলা, পড়ালেখা সব দায়দায়িত্ব স্কুল কতৃপক্ষের উপর বর্তায়। তাই স্কুলে বাচ্চা
পাঠিয়ে মা-বাবার দায়িত্ব শেষ। বাচ্চাকে স্কুলবাসে তুলে দেয়া এবং কাছে নামিয়ে দিলে
কেউ নিয়ে আসলেই হলো। শিশুরাও স্কুলে যেতে খুব উদগ্রীব। আমেরিকান শিশুদের এক
অতিপ্রিয় জায়গা হল স্কুল।
বলা যায়
আমেরিকা দেখা আমার জীবনের একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নরাজ্যে আমি এখন হাজির। JFK International
Airport হতে বের হয়েই আমার স্বপ্নের দেশ আমেরিকার রাস্থায় চোখ মেলি।
শুনে এসেছি নিউইয়র্ক খুব ব্যস্ত নগরী। তাই ভাবনায় ছিল এখানে জাম থাকবে, তাড়াহুড়া
থাকবে, মানুষের হৈ চৈ থাকবে। কিন্তু দেখি উল্টো চিত্র। এক
প্রচ্ছন্ন শান্তি ও নিরবতা যেন শহরটাকে জড়িয়ে আছে। ঝকঝকে সুন্দর সুন্দর গাড়ি
দেখছি, সবগুলো শব্দহীন। রাস্থায় লোকজন তেমন নেই, যে দুইচার জন লোক দেখছি তাদেরকে
বেশ সুখী ও প্রশান্ত লাগছে। মানুষগুলো বাংলাদেশের লোকজনের চেয়ে অনেক সুঠাম ও
তরতাজা।
মেঘহীন গাড়
নীল আকাশ, উত্তাপহীন ঝরঝরে রোদ, আমাদের অগ্রাহায়নের মত মিষ্টি শীতল আবহাওয়া বেশ
আরামদায়ক। কারটি বড় বড় রাস্থা দিয়ে যাচ্ছে, কোথায়ও সুড়ঙ্গ পথ, কোথায়ও মাথার উপর
দিয়ে গড়গড় করে ট্রেন যাচ্ছে। রাস্থার দুইপাশে বৃক্ষসারি ও বনভূমি। দু‘তলা, ত্রিতলা, ওভারব্রিজ অতিক্রম করে
গন্তব্যে পৌছি। এবার ব্যাগেজ নামানোর পালা। রিপা হয়ত ভাবছে আমরা ব্যাগ টানতে
অভ্যস্ত নই। ব্যানেট খোলে সে টানাটানি শুরু করলে আমি ও জেফার গিয়ে শরীক হই। এদেশে
নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। ব্যাগগুলো এক এক করে বাসার সামনের রাস্থায় রাখি।
এবার রিপার হ্যাজবেন্ড আরিফ চৌধুরীর সাথে পরিচয় হয়। তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকেলী
গ্রামের জাতক। তার চাচা আওয়ামী লিগ নেতা সদ্যপ্রয়াত সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান
সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী। অন্যচাচা ওলী হাউজিংয়ের স্বত্তাধিকারী শাহীন চৌধুরী। আরাফ
চৌধুরীর সাথে মেলামেশা হল। নিঃসন্দেহে তিনি একজন সজ্জন লোক। বিনয় ও ভদ্রতায় তিনি
তুলনাবিহীন।
রিপার বাসা
সুন্দর এবং সুপরিকল্পিত। বাসার সামনে বাগান ও ড্রাইভওয়ে। অর্ধমাটির নিচে
বেসমেন্টে একটি ছোট্ট বাসা ভাড়া দেয়া আছে। ড্রাইভওয়ে গাড়িটির বাসস্থান। মাটি লেবেল
হতে ছোট্ট সিড়ি বেয়ে ৪/৫ ফুট নিচে নেমে বেসমেন্ট এবং ৪/৫ ফুট উপরে উঠলেই দুতলার
বারান্দা। সামনে হলুদ গাঁদা, লাল মরিচ ও সুন্দর ফুলবাগান। বাগানে প্রতিদিন
খাদ্যকনা ছিটিয়ে দেয়া হয়, পাখির ঝাঁক এসে খেয়ে যায়। বারান্দার দরজা দিয়ে ঢুকে একটি
করিডোর, জুতা ও কাপড় রাখার আলমিরা। একটি বড় ড্রয়িং রোম, ছয় ইঞ্চি উপরে ডাইনিং,
কিচের ও বাথরোম। ডাইনিংয়ের পিছনে বড় বারান্দা। এই বারান্দা হতে লোহার সিড়ি নেমে
গেছে পিছনের বাগান চত্বরে। এই বাগানে সাদা মরিচ, নাগা মরিচ, লেবু, কদু, শিম এবং
নামনাজানা নানা বিদেশী ফুল ফুটে আছে। এই বাগানে একটি ছোট্ট প্যান্ডেল, এই
প্যান্ডেলে গায়েহলুদ, জন্মদিন, পারিবারিক পার্টি ইত্যাদি অনুষ্টান করা হয়। বাগান
চত্বরের চারদিকে চিকন রডের জালি বেড়া। বেড়ায় লতাফুল ঝুলে আছে। ২য় তলার ড্রয়িং হতে
একটি কাটের সিড়ি তিনতলায় চলে গেছে। এই ত্রিতলায় তিনটি বড় বেডরোম ও দুইটি বাথরোম,
একটি বড় ও অন্যটি ছোট। সারাটা বাসা দামী কার্পেট মুড়ানো। অত্যাধুনিক বাড়িতে রয়েছে
সেন্ট্রাল এসি ও হিটার। গরম ও ঠান্ডা পানি লাইন। সবকিছু যান্ত্রিক, বাসাটি
মার্ভেলাস।
মামা
আব্দুর রহমান চৌধুরী ও মামীর সাথে এবাসায় দেখা হল বহু বছর পর। মামা-মামি তাদের বড়
কক্ষ আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে ড্রয়িংরোমে রাতে ঘুমান। আমেরিকান বাসায় বেড ও ড্রয়িং কক্ষ
সবই সমান। এখানে মশামাছি না থাকায় মানুষ মশারী নামক জিনিসটা চেনেনা। বাসার
তাপমাত্রা সবসময় একই থাকায় গায়ে কম্বল জড়ালেও চলে, না জড়ালেও কিছু যায় আসেনা। একটু
গরম কাপড় গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেই স্বপ্নীল ঘুমে রাত পার হয়।
আমাদের সৌভাগ্য রিপা এখন কোন জবে নেই। আমেরিকার দিন বাংলাদেশের রাত। তাই দিনে তন্দ্রাভাব কাটেনা এবং দিনের বেলা আমাদের রাতের মত ঘুম হয়। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে জাগার পর রিপা আমাদেরকে নিউইয়র্কের আকর্ষন টাইমস্কয়ারে নিয়ে যায়। টাইমস্কয়ার আমেরিকান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রচারনা ও বিজ্ঞাপন এলাকা। রাতের টাইমস্কয়ার কোম্পানীগুলোর বিজ্ঞাপন বাতির নানারঙ্গের বিচিত্র আলোর নাচনে ঝলমল করে। সড়কের আশপাশে বিশাল বিশাল নিয়ন বাতি ও মনিটরে একের পর এক বিজ্ঞাপন আলোর বন্যা বয়ে যায়। প্রচারনার এই রংখেলা উপভোগ করতে অসংখ্য নরনারী আলোসাগরে ঘুর ঘুর করছেন, যেন প্রদীপের পাশে পতঙ্গের উড়াউড়ি। পাবলিসিটি উপভোগ করার জন্য টাইমস্কয়ারে গ্যালারীও রয়েছে। ম্যাচখেলার স্টেডিয়ামের মত সাজানো গ্যালারীতে নানা ধর্ম বর্ন ও জাতির শত শত মানুষ বসে আছে। তাদের পোষাক-পরিচ্ছেদ, ভাষা ও সংস্কৃতি সবই বিচিত্র। তারপর আসি হার্ডসন নদীর তীরে এস্টোরিয়া পার্কে যেখানে আমার মামা ফজলুর রহমান চৌধুরী তার প্রবাস জীবন কাটান। এখানে মামার তিনপুত্র মুর্শেদ, ফরহাদ ও জাহেদ বড় হয়। নদীপারে পার্ক এবং এই পার্কের কিনারায় মামার বাসা। উপভোগ করার মত সুন্দর একটি জায়গা এই এস্টোরিয়া পার্ক। হার্ডসন নদীতীর সুন্দর করে বাঁধানো। সেতু টেনে নদীর বুকে সাজানো অনেক বৈঠকখানা। টলমলে জল ও শীতল বাতাসে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায়। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন