যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- এক
যাত্রাঃ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, ফেরাঃ ১৮ অক্টোবর ২০১৫ সাল, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানঃ ৩৩ দিন
আমি এমন একটি রাষ্ট্রের ভ্রমনকাহিনী লিখতে বসেছি, যাকে বলা হয় স্বপ্নের দেশ, অমিত সম্ভাবনার দেশ। কেউবা বলেন- একমুখো সড়ক (One way root), যেখানে কেউ একবার কোনমতে ডুকে গেলে আর ফিরে আসেনা। এক অদৃশ্য আকর্ষন তাকে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়। তার মাইন্ড সেটিং পরিবর্তন করে ফেলে। ধনী গরীব যিনিই দেশটিতে প্রবেশ করেন, তিনিই নিজের অজান্তে দেশটির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যান। এই দেশটি আধুনিক সভ্যতার ধারক, বাহক ও কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর ইতিহাসে এক এক যুগে এক একটি রাষ্ট্রের হাতে পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধন-ঐশ্যর্য, ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয়। প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল চীন, আসিরিয়া, মিশর ও ব্যাবিলন। তারপর আসে গ্রীক ও পারসিকরা। গ্রীকদের পর রোমানরা বিশ্বসভ্যতার নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। মধ্যযুগে কিছুকাল মুসলমানরা সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রন করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর বারোক যুগে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর বিশ্বসভ্যতার নিয়ন্ত্রন চলে যায় পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশিক শক্তি বৃটেন, ফরাসী ও পর্তুগীজদের হাত হতে বিশ্বশক্তির নিয়ন্ত্রন ধীরে ধীরে পেয়ে যায় রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯০ সালের পর রুশ প্রেসিডেন্ট গর্বাসেভের পেরেস্ট্রাইকা ও গ্লাসনষ্টের প্রভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর একক পরাশক্তি এবং একছত্র নিয়ন্ত্রকে পরিনত হয়।
দেশটি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাহা ৫০টি আলাদা আলাদা পতাকা, সরকার, আইনসভা, রাজধানী
বিশিষ্ট রাষ্ট্রের সম্মিলিত মহাদেশ। দেশটির আয়তন ৩৭,৯৬, ৭৪২ বর্গমাইল। এই পঞ্চাশটি
রাজ্য ছাড়াও একটি কেন্দ্রশাসিত ডিস্ট্রিক কলম্বিয়া ও পাঁচটি টেরিটরী রয়েছে। মূল
ভূখন্ড হতে শত শত মাইল দূরে রয়েছে হাওয়াই, আলাস্কা এবং গোয়াম দ্বীপ। দেশটি এত বড়
যে পাশাপাশি বিছানো ৬৮টি বাংলাদেশ কিংবা ৪০টি বৃটেনের আয়তনের সমান। আয়তনে রাশিয়া ও
কানাডার পরই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ক্যানাডা ও রাশিয়া বরফে ঢাকা হলেও
ভাগ্যবান যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে সীমাহীন শস্য শ্যামল ভূমি ও মূল্যবান
খনি।
বৈচিত্রময়
দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এখানে প্রতিটি স্টেইটে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্মারক চিহ্ন,
আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতি, বৃক্ষলতা ও জীবন বৈচিত্র। প্রতিটি স্টেইটে রয়েছে পর্যটকদের
দেখার জন্য স্পেশাল কিছু না কিছু চমক। উত্তরের স্টেইটগুলো শীতল, দক্ষিনের উষ্ণ এবং
মধ্যভাগ নাতিশীতুষ্ণ। আলাস্কা বরফে আবৃত আবার নেভাদা মরুময়। কার্লিফোনিয়ায় বিরাজ
করে চিরবসন্ত। প্রশান্ত মহাসাগরের অথৈ জলরাশিতে ভেসে আছে হাওয়াই। ফ্লোরিডায় রয়েছে
একেবারেই বাংলাদেশের আবহাওয়া ও বৃক্ষলতা। আমাদের ঘরের কাছে এশিয়ায় তাদের গোয়াম
টেরিটিরী।
প্রাচীনকাল
হতে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পাঁচটি সাম্রাজ্যেরও একটি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলো হল চীনের তাং সাম্রাজ্য, মোঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ সাম্রাজ্য ও মার্কিন
সাম্রাজ্য। দেশটি প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বসেরা। মহাকাশ গবেষনা ও অভিযান,
পারমানবিক ও জেনেটিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও তথ্য প্রযুক্তিতে দেশটির শ্রেষ্টত্ব
রয়েছে।
১৯৭৪ সালে
আমার মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী মামী কোহিনূর চৌধুরীর হাত ধরে আমেরিকায় পাড়ি
জমান। আমি যৌবনে আমেরিকা যাবার স্বপ্ন দেখতাম। ১৯৮৬ সালে নিউজার্সির আটলান্টিক
কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হই। মেঝমামা স্পন্সর (Affidavit in financial support) করেন। কলেজ হতে আই-২০ হাতে আসে। মতিঝিল আদমজি কোর্টে ছিল ইউ এস ভিসা
ইন্টারভিউ অফিস। শেষরাতে এসে এখানে লাইনে দাড়িয়ে স্টুডেন্টস ভিসা ইন্টারভিউ দেই।
লাল ড্রেস পরা একজন শ্বেতাঙ্গিনী আমার ইন্টারভিউ নেন। কিন্তু ভিসা পাইনি। দুইদিন
পর আবার আবেদন করলে তেমন কোন ইন্টারভিউ না নিয়েই পাসপোর্টে রিলিজ সিল মেরে ফেরত
দেয়। সেদিন প্রতিজ্ঞা করি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর কখনও ভিসা চাইবনা। পরবর্তীকালে
অনেক দেশ সফর করেছি কিন্তু আমেরিকান এম্বেসীতে ভিসার জন্য যাইনি। তবে আমি আল্লাহ
পাকের কাছে যাহা চাই, একটা সময় তা পেয়ে যাই। হয়ত মহান আল্লাহ ঐ সময় ছাত্র ভিসা
পাওয়া আমার জন্য সঙ্গত মনে করেন নি, অথচ সেই ছাত্রভিসা আবেদনের উনত্রিশ বছর পর আমার
সমনদিক জামিল আহমদ চৌধুরীর আবেদনে ইউ এস এম্বেসী আমাদেরকে ডেকে নিয়ে মাইগ্রেশন
ভিসা প্রদান করে। আমি, আমার বেগম ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী এবং একমাত্র পুত্র
জেফার রহমান যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ভিসা পেয়ে মহান আল্লাহ পাকের প্রতি হাজার
শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
১৫
সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল রোজ মঙ্গলবার। ইতিহাদ এয়ারলাইনের একটি বিমানে রাত সাড়ে নয়
ঘটিকায় ঢাকা ছাড়ি। রাত আড়াইটায় আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। এখানে
ইউ এস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আমাদের যাবতীয় ইমিগ্রেশন কাজ সম্পন্ন করে। রাত ৩টা ৪৫
মিনিটে বিশাল আকারের একটি উড়োজাহাজ পাঁচশত যাত্রি নিয়ে আকাশে ডানা মেলে। প্রায়
চৌদ্দঘন্টা উড়ে নিউইয়র্ক সময় ১০ টা ৩০ মিনিটে আমাদেরকে নিয়ে জন এফ কেনেডি
অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ঢাকা হতে নিউইয়র্ক পৌছতে সময় লাগে মোঠ ২০/২১
ঘন্টা। অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য প্রায় বার হাজার মাইলের কম নয়।
ঢাকা হতে
ম্যাপের সরলরেখায় বিমান আবুধাবী যায়। কিন্তু আবুধাবী হতে নিউইয়র্ক যাত্রাপথ পশ্চিম
বরাবর সরলরেখা ছিলনা। আবুধাবি হতে বিমানটি উত্তরদিকে পারশ্য উপসাগর পার হয়ে ইরানে
প্রবেশ করে। ইরানের উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী ভূভাগ দিয়ে
আমরা রাশিয়ায় প্রবেশ করি। তারপর জার্মানী ও বাল্টিক সাগর অতিক্রম করে সুইডেন ও
ফিনল্যান্ডের ভূভাগের উপর দিয়ে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের বিশাল জলরাশির উপর চলে
আসি। ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। যথাসময়ে এয়ার হোস্টেসগন খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে যান।
চার পাঁচ ঘন্টা পর ঘুম হতে জেগে মনিটরে দেখি বিমানটি গ্রীনল্যান্ড দ্বীপের উপর চলে
এসেছে। মেরু অঞ্চলের এই দ্বীপের কাহিনী আমি যৌবনে পড়েছি। তাই গ্রীনল্যান্ড দেখতে
জানালা দিয়ে নিচে তাকাই।
এই সেই
বরফাচ্ছন্ন গ্রীনল্যান্ড যার আয়তন আট লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গমাইল।
এখানে এক্সিমো নামের এক অদ্ভুদ জাতি রয়েছে, যারা ইগলু নামের সম্পূর্ন বরফে তৈরি
ঘরে বসবাস করে। এখানে ছয়মাস দিন ও ছয়মাস রাত থাকে। গ্রীষ্মের ছয়মাস এক্সিমোরা
তাদের কুকুর চালিত স্লেজগাড়ি চড়ে সিল মাছ ও শ্বেত হরিন শিকার
করে। গ্রীষ্মকালে শিকার করা মাংস নিয়ে ইগলুতে ঢুকে তারা কাটিয়ে দেয় শীতের ছয় মাস।
বিমানের নিচ দিয়ে তুষার ঝড় বইছে। সৈকতের কাছে সাগর জলে বরফের অজস্র শিলাখন্ড
ভাসছে। প্যাঙ্গুইন পাখি ও সিল মাছ দেখার প্রানান্ত চেষ্টা করি। কিন্তু এত উপর হতে
এসব প্রানী দেখা আদৌ সম্ভব নয়। গ্রীনল্যান্ড হতে আবার সাগরে পড়ি। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন