শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- পনের


 যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর  পর্ব- পনের                                                                                                          

ঘড়ির কাটায় ঠিক রাত ৮টা বেজে গেছে লেজার সো শুরু হল। স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের সামনের মাট হতে কয়েকটি বিশাল আগুনের হলকা বের হয়ে আঁধার রাতকে দিনের মত আলোকিত করে মাইল খানেক উচু পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নিভে। এই আগুন হয়তো মেঘের রাজ্য ছোঁয়ে বাতাসে মিশে। কালো ধুয়ায় আকাশ আর কালো হয়ে যায়। এই আগুনের লেলিহান শিখাগুলো এতই বিশাল ছিল যে গরম এসে আমাদের মেঘে ভেজা শীত খানিকের জন্য তাড়িয়ে দেয়। একটার পর একটা আগুনের হলকা আকাশে উড়ার সময় গরমে কি যে আরাম লাগে ও অন্ধকার রাতে যেন উজ্জ্বল দিন নেমে আসে। হ্যাঁ আমরা বাংলাদেশে ছেলেবেলায় শীতকালে শুকনো পাতা ও খড়ে আগুন লাগিয়ে শীত তাড়াতাম। ছেলে মেয়ে  বুড়ো বুড়ি সবাই মিলে আগুন পোহাতাম।

স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের সমতল গায়ে লেজারের বিচিত্র আলোয় অনুমানিক (৫০০ফুট*৩০০ফুট) এক বিশাল পর্দায় ফুটে উঠে সারাটা জর্জিয়া স্টেট। এই রাজ্যের বন-বনানী, নদী, পাহাড়, জলাভূমি কিছুই বাদ গেলনা। তখন বেজে উঠে জর্জিয়া রাজ্যের রাজ্যসঙ্গীত, সেইসাথে পর্দায় দেখা যায় জর্জিয়ার রাজ্য পতাকা, রাজ্য মানচিত্র, রাজ্য-প্রতীক পিচ (Peach). জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের একটি অসমতল সুন্দর রাজ্য আয়তনে বাংলাদেশ হতে খানিক বড়, ৫৭,৯১৯ বর্গমাইল লোকসংখ্যা মাত্র ৭৫,৬২,০০০ জন এই রাজ্যের বড় শহর ও রাজধানী আটলান্টা ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় জর্জিয়া দক্ষিণের অন্য দশটি রাজ্যের মত দাসপ্রথার সমর্থক ছিল এবং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮৬১-৬৫ সালের সেই গৃহযুদ্ধে আব্রাহাম লিঙ্কন হেরে গেলে আজকের এই প্রবল প্রতাপশালী বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব হয়ত পৃথিবী দেখতে পেতনা আমেরিকার সেই গৃহযুদ্ধ আমরা লেজার সো তে দেখে ইতিহাসকে চোখের সামনে পেয়ে যাই

স্টোন মাউন্টেন পাহাড় পৃষ্টে যে তিনজন ঘোড় সওয়ারের ভাস্কর্য্য রয়েছে, তারা দাসপ্রথার সমর্থনে গৃহযুদ্ধে যোগ দেন আব্রাহাম লিঙ্কনের বিরূদ্ধে যুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে তারা পরাজিত হন এবং পরাজিত হবার পর তরবারী ছুঁড়ে ফেলে আমেরিকায় ঐক্য মেনে নেন লেজার সো তে আমি লক্ষ্য করি জর্জিয়াবাসী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের সাথে তাদের পরাজিত এই তিন সাম্প্রদায়িক নেতাকেও সম্মান প্রদর্শন করে বিষয়টা আমার কাছে পরস্পর বিরোধী আচরণই মনে হয়

স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ে গ্রানাইট খোদাই করে জর্জিয়ানরা গৃহযুদ্ধে পরাজিত তিন নেতার ঘোড় সওয়ার ভাস্কর্য্য তৈরী করে তারা মনে করে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এই নেতারা সঠিক ছিলেন এবং পরবর্তীতে পরাজিত হয়ে যুগের বাস্তবতা বুঝতে পেরে তা মেনে নেন

লেজার সো তে দেখা যায় বজ্রপাতের মত কড়মড় শব্দ করে হঠাৎ বিশাল স্টোন মাউন্টেইন পাহাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে পূরো সুবিশাল পাহাড় যেন প্রবল ভূমিকম্পে চোখের সামনে ধ্বসে পড়ে উদাও হয়ে যায় মনে হয় চোখের সামনে যেন এক কিয়ামতের প্রলয় হয়ে গেছে কিয়ামতের এই ধ্বংসস্থূপ হতে পাহাড়ের গা কেটে নির্মিত তিন ঘোড় সওয়ার মুর্তি জীবন্ত হয়ে ওঠে এই তিনজন অশ্বারোহী হাতে তরবারী নিয়ে ঘোড়ায় পায়ে আগুনের ফুলকি তুলে দ্রুতবেগে দৌড়াতে থাকে এক সময় এই তিন বীর অশ্বারোহী যুদ্ধার তরবারী ভেঙ্গে যায়, ফলে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন জয়ী হন অনুষ্টানের ফাঁকে ফাঁকে চলে আতশবাজি উৎসব আতশবাজির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সশব্দে এক মাইল উচু স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে অজস্র শাখা প্রশাখায় ভাগ হয়ে সারাটা আকাশে ছড়িয়ে যায় আঁধার রাত আলোক পুষ্পে রঙ্গীন হয়ে যায় আগুনের লেলিহান হলকা ও আতশবাজি মাঝে মাঝে রাতটাকে দিনের মত আলোকিত করে দেয় এই সুতীব্র শীতের মধ্যেও সামনের জনতা বসার কয়েক একর জায়গা উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে আরামে ভরে যায়

সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা ভেসে ওঠে শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত দেশপ্রেমিক দশ-বার হাজার জনতা দাঁড়িয়ে যান প্রচন্ড নিনাদে গল্লা ফুটে আকাশ আতশবাজির আলোয় ঝলসে ওঠে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড ধারী, বলা যায় হাফ মার্কিন সিটিজেন ভোট অধিকার ছাড়া বাকি সব অধিকার ও সুযোগ সুবিধা আমাদের রয়েছে তাই বুকে গর্ব নিয়েই দাড়াই এবং মার্কিন পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জাতীয় সঙ্গীত শেষ হয় ঠিক ১০টায় সেই সাথে লেজার সোর সমাপ্তি ঘটে 

একটানা দুই ঘন্টার এই লেজার সো এতই মনোমুগ্ধকর যে এক চরম উত্তেজনার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে দুই ঘন্টা পার হয়ে যায় আমেরিকানরা লেজার টেকনোলজী ব্যবহার করে এত জীবন্ত ও বাস্তব ছবি বানাতে পারে তা নিজে না দেখলে বিশ্বাস হতনা এই সোতে জর্জিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাক্তিজীবন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট ফুটে ওঠে বাংলাদেশের অনুষ্টানের মত এখানে কোন হৈ চৈ নেই এক অখন্ড পিনপতন নিরবতার মধ্য সারাটা অনুষ্টান সমাপ্ত হয় এমন একটি শিক্ষনীয় অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য মহান আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সাথে আমাদের প্রিয় ভাতিজী তাইবাকে জানাই হৃদয় উৎসরিত ধন্যবাদ আমরা যে তার সৌজন্যে ও উৎসাহে এমন একটি অসাধারণ অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পাই

১১ অক্টোবর ২০১৫ সাল, রবিবার ঘুম হতে জেগে হাম্পটন হোটেল ইনের নরম বিছানা ছেড়ে নামাজ পড়ি তারপর ব্রেকফাস্ট সারতে ডাইনিং হলে যাই আমাদের ফ্রেকফাস্ট স্যুট ভাড়ায় সংযুক্ত এখানে ৫০/৬০ ব্যঞ্জনের জানা-অজানা আমেরিকান খাবার ধারাবাহিক সাজিয়ে রাখা সব খাবারই গরম, না হয় যথাযত মেশিনে খাবার তৈরী কিংবা গরম করে নিতে হয় আমরা একটি টেবিলে বসি আমাদের জ্ঞান নেই, ধারনা নেই, কিভাবে আমেরিকান খাবার প্রস্তুত করতে হয় মেজভাবী ও তাইবা মেশিনে মেশিনে গিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরী করে এনে আমাদেরকে পরিবেশন করেন বিচিত্র বিচিত্র আমেরিকান খাবার খেয়ে মনের অজান্তে বলে উঠিশোকর আলহামদুলিল্লাহ

কফি খেয়ে আমরা দুটি কারে চড়ে সারাটা আটলান্টা মহানগর ঘুরে বেড়াই আটলান্টা বেশ বড় শহর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসির চেয়ে ছোট হলেও শহরটি কলম্বিয়ার চেয়ে অনেক বড় আটলান্টার ডাউন টাউন ও নিউ টাউন ঘুরে আমরা অলিম্পিক পল্লীতে যাই এখানে ১৯৯৬ সালে বিশ্ব অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় আমরামশাল প্রজ্জলন স্থম্ব অলিম্পিক-১৯৯৬দেখি আটলান্টা আলিম্পিক পল্লীতে তখন জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল আমরা তাই সেখানে প্রচন্ড ভীড় লক্ষ্য করি আটলান্টায় আমরা বিখ্যাত বিশ্বসংবাদ মিডিয়া সিএনএনের প্রধান কার্যালয় এক নজর দেখে নেই সুরম্য নগরী আটলান্টা, উচু নিচু টিলায় টিলায় সুসজ্জিত বাড়ি ঘর, অফিস আদালত এবার চালক মেঝভাই কলম্বিয়ার দিকে কারের নিশানা করেন (চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন