যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা-নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- ষোল
তাইবাকে আটলান্টায়
বিদায় জানিয়ে আমরা ছুটলাম। আটলান্টাতে
আমাদের দুইদিন ও একরাত বেশ মজায় কেটে যায়। হোটেল ভাড়া
৩০০ ডলার,
লেজার শো ১২০ ডলার, ইন্ডিয়ান হোটেলে খাবার বিল
২০০ ডলার এবং গিফট ও বাজে খরচ মিলে প্রায় ১০০০ ডলার= ৮৫,০০০/= বাংলাদেশী টাকা খরচ হয়। পুরোটাই পরিশোধ করে তাইবা। আমেরিকার কোন এক প্রসিদ্ধ শহরে মাত্র একদিন সপরিবারে অবস্থানে
যে পরিমান অর্থ খরচ হয়, তা বাংলাদেশ হতে গিয়ে বহন করা খুবই কঠিন কাজ। তাই আমেরিকা ভ্রমন অর্থের জুর ছাড়া সম্ভব নয়।
আমাদের কার
জর্জিয়া রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করা মাত্রই ‘Welcome to South Carolina’ লিখা গেট পার হয়ে সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের স্বাগত পর্যটন সেন্টারে প্রবেশ করি। সুন্দর পরিপাটি রেস্ট ও ওয়াশ রূম সজ্জিত এই পর্যটন সেন্টার মহাসড়কের
পাশে অবস্থিত। সেন্টারকে ঘিরে
আছে সুরম্য বৃক্ষশোভিত পাহাড় ও মনোরম লেক। বিতরনের জন্য
থাকিয়ায় পড়ে আছে প্রচুর সাউথ ক্যারোলিনা গাইড। ছোট বড় নানা ধরনের এসব পর্যটন গাইড দামী কাগজে ছাপানো। কিছু গাইড ব্যাগে নেই। সামনের বাগানে
ফটো তুলি ও সাথে আনা খাবার এখানে খেয়ে নেই। এই সেন্টারে
সাউথ ক্যারোলিনার স্মারক চিহ্ন পলমেট্রো ট্রি, রাজ্য পতাকা, রাজ্য মানচিত্র, বড় আকারে প্রদর্শন করা হয়েছে। এই সেন্টারে নাতিশীতুষ্ণ বিকেল পার হয়। রাতের আঁধারে আমরা কলম্বিয়ার বাসায় ফিরে আসি।
১২
অক্টোবর, ২০১৫ সাল, সোমবার। সকাল ১০টায় সাউথ-উয়েল নেইভারহোড ঘুরে দেখি। নেইভারহোড
বলতে এখানে আবাসিক জনপদ বুঝানো হয়। সকাল ১০/১১ টায় রাস্থায় লোকজনের কোন সাড়াশব্দ
নেই, যেন বাংলাদেশের শেষরাতের নিরবতা। বাংলাদেশের জনপদ শেষরাতে জনশূন্য হলেও
পাহারাদার দেখা যায়, এখানে তাও নেই। পাখির কলরবে মুখরিত সুরম্য বৃক্ষঘেরা এই
জনপদের রাস্থায় কাটবিড়ালী দিনে দুপুরে লাফিয়ে বেড়ায়। একটার পর একটা বাউন্ডারী
দেয়ালহীন ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স বাগানবাড়ি। নাম না জানা নানান ফল ও ফুলে নুয়ে আছে
বৃক্ষের ডালপালা। বাগানে বাগানে আছে খরগোস, মা মেরী ও যিশুর মূর্তি। হ্যালোইন
উৎসবের ভূতের বিকট ছবি ও মূর্তি ঝুলছে কোন কোন বাসার গাছের ডালে। প্রতিটি বাসায়
যতজন লোক ততোটি গাড়ি পড়ে আছে বাসার সামনে। উঁচুনিচু ভূমির রাজ্যে প্রকৃতির অপার
সৌন্দর্য্যের সাথে বাড়িগুলো আপন মহিমায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কোথায়ও
মাশা-মাছি নেই, ভাঙ্গাচুরা নেই, নেই ময়লা ড্রেন। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে ভূতল ড্রেন দিয়ে
উদাও হয় বৃষ্টির জল। এখানে নেই কোন চোর ডাকাত কিংবা চাঁদাবাজের উৎপাত। নেই কোন
ভিক্ষুক কিংবা ঋনপ্রার্থীর যন্ত্রনা। মানুষ ঘরের হালকা দরজাটা বন্ধ করে খালি ঘর
রেখে বেরিয়ে যায়, কাজ শেষে ফিরে আসে রাতে। জামিল ভাইয়ের নির্জন বাসা এমনি থাকে অথচ
বিগত পনের বছরে কখনো চুরি হয়নি। প্রতিটি বাসা যেন আমাদের জেমস ফিনলে কোম্পানীর
চা-বাগানের এক একটি বাংলো বাড়ি। প্রতিটি ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স বাগানবাড়িতে ৪/৫ টি
বেডরোম, ডাবল ড্রয়িংরোম, বড় বড় কিচেন, ডাইনিং ও বাথরোম। সামনে ফুলের বাগান, পিছনে
সবুজ লন, রিম্যুট কন্ট্রোল গ্যারেজ, ২/৩ টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। গ্যারেজের সামনের
পাকারাস্থা নাম ড্রাইভওয়ে, যেখানে প্রতি বাসার ৩/৪ টি দামি দামি গাড়ি খোলা আকাশের
নিচে পড়ে থাকে। আমেরিকানরা এত ধনী যে তাদের বাসার প্রতি কক্ষে থাকে ওয়াল টিভি,
ওভেন, ওয়াসিং মেশিন, ডিসক্লিনার মেশিন, কার্পেট ক্লিনিং মেশিন, কফি-শরবত মেশিন,
ঘাস-কাটার মেশিন ও চার পাচটা অত্যাধুনিক ফ্রিজ। সাউথ ক্যারোলিনার প্রকৃতি মনোরম।
বাসা, দোকান, রাস্থা সর্বত্রই আছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রতিটি বাসা এসি ও হিটার
মেশিনে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে সারাক্ষন।
বাসায়
আলাদা কাপড়কক্ষ ও সাজঘর দেখি। এই কক্ষে শত শত হাঙ্গারে ড্রেস ও জুতাধারে জুতা
সাজিয়ে রাখা আছে। আমেরিকানরা এক কাপড় বেশিদিন পরেনা। একটু পুরানো হলেই ফেলে দেয়
এবং নতুন নতুন জামা কাপড়ে ক্লথরোম পূর্ন করে রাখে। এদেশে এত জমি ও সম্পদ পড়ে আছে
যে এসব নিয়ে কোন কাড়াকাড়ি মারামারি নেই। সবকিছু আসমানের নিচে কাজে অকাজে পড়ে আছে।
পুরুষ, নারী, ছাত্র, ছাত্রী সবাই এত ব্যস্ত যে কেউ কারো দিকে তাকানোর খুব একটা সময়
নেই।
১৩ অক্টোবর
২০১৫ সাল, মঙ্গলবার। এইদিন Best Bye Moll যাই এবং অনেক দেখেশুনে ৩৫০ ডলার দামে একটি Lanovo Laptop ক্রয় করি। এই ল্যাপটপ
এতই ভাল যে বিগত পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করছি অথচ কখনও কোন ডিস্টার্ব করেনি। আমরা কলম্বিয়ায় কিছু মার্কিন বহুজাতিক মার্কেটিং কোম্পানী যেমন
ওয়ালমার্ট, বেড এন্ড বাথ, স্যামস, টিজেমাজ এর বড় বড় মল ঘুরে অনেক মালামাল ক্রয় করে বাসায় ফিরি।
শেষ হেমন্তের
মত মজার আবহাওয়া, এই দিন মেঝভাবীর আরমো স্কুল মাটে আমরা ব্যায়াম
করতে যাই। আমেরিকার এই
স্থানীয় স্কুল মাট দেখে বিষ্মিত হই। এখানে আছে ফুটবল
মাট, তিনটি বাস্কেটবল মাট, লন টেনিস মাট, সকারবল মাট, তাছাড়া রেখাটানা বিশাল দৌড়মাট। প্রতিটি মাটে রয়েছে দর্শক গ্যালারী ও ফ্লাড লাইট। এখানে স্কুল বলতে ১২তম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্টান বুঝায়। দেখলাম এখানে একটি সামান্য স্কুলের যে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে, আমাদের
দেশের জেলা ক্রীড়াসংস্থার হাতেও ততোটুকু সুযোগ সুবিধা নেই। সেদিন বুঝলাম বিশ্ব অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রতিবার প্রথম
হয়।
‘আরমো’ হলো
কলম্বিয়া শহরের একটি অঞ্চল। আমাদের সাউথউয়েল
নেইভারহোড এই অঞ্চলের একটি অংশ। পাঠাগারের প্রতি
আকর্ষন আমার আজন্ম। পাঠাগারে আমি
দিনরাত কাটিয়ে দিতে পারি। একটা পশ্চিমা
পাঠাগারের ছুরতহাল করতে আমি এবার ‘আরমো পাবলিক লাইব্রেরী’ পরিদর্শন করি। এখানে এত বিপুল
বইয়ের সমাহার দেখে বিষ্মিত হই। উচু ছাদের বিশাল
পাঠাগার,
চারপাশে সবুজ চত্বর। যথেষ্ট অন্তর
অন্তর জায়গা খালি রেখে বইয়ের রেক বসানো। ফাঁকে ফাঁকে
বসে পড়ার ব্যবস্থা আছে। এই অনলাইন ইবুকের
যুগেও এখানে পাঠকের কোন অভাব নেই।
একটি বই হাতে নেই, এই বইয়ের নাম- ‘The six phases of Universe’ এই বইয়ে বিগব্যাং হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিশ্বসৃষ্টির বাখ্যা আছে। এই মহাবিশ্বের বিবর্তন একে একে ৬টি ধাপে সম্পন্ন হবার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন ও সচিত্র বিবরন রয়েছে। আমেরিকানরা ধ্যানী এবং জ্ঞানী জাতি। তারা কথায় নিরব কিন্তু কর্মে সরব জাতি। তারা যে যেখানে যে কাজটি করে সে তা পূর্ন দায়িত্ব নিয়েই করে। আরমো পাঠাগারে দায়িত্বরতদের কর্ম-তৎপরতা দেখে আমার তাই মনে হল। জেফারের আমেরিকায় এডমিশন টেস্টের সহায়ক একটি বড় বই আমরা হাতে নেই। আমেরিকার এই আঞ্চলিক পাঠাগার আমাদের কেমুসাস পাঠাগার, এমন কি সিলেট বিভাগীয় পাঠাগারের চেয়েও অনেক উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন ও উন্নত। একটা সামান্য পাঠাগার দেখেই বুঝে নেই কেন আমেরিকায় এত জ্ঞানী-গুনী মানুষের সৃষ্টি হয়। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন