যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- চৌদ্দ
৮ম অক্টোবর
২০১৫ সাল, বৃহস্পতিবার। আজ সসিয়াল সিকিউরিটি কার্ড আবেদনের জন্য মেঝভাবী আমাদেরকে কলম্বিয়ার
ফেডারেল ভবনে নিয়ে যান। হোমল্যান্ড
সিকিউরিটি আমাদেরকে পরীক্ষা করে অফিসের ভিতর প্রবেশ করায়। আমরা একটি কম্পিটারে আমাদের সিরিয়াল ও কেন এসেছি লিখে দেই। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর লাউড স্পিকারে আমাদের ডাক আসে। একজন কালো মহিলা হাসিমুখে আমাদের বায়োডাটা কম্পিউটারে এন্ট্রি
করেন। মেঝভাবী দুভাষীর কাজ করেন। আল্লাহের অপার মেহেরবানীতে সহজেই সবকাজ সমাধা হয়ে যায়। বেশ ক্ষিধা পায়, বাসায় ফিরে বাফেলো ফিস ও কলম্বিয়ার
হিলশা ফিস সহকারে মজার খাবার হয়। সাউথ ক্যারোলিনার নদীপথে আমাদের পদ্মা-মেঘনার মত
উজান বেয়ে আটলান্টিকের হিলশা আসে।
৯ম অক্টোবর
২০১৫ সাল, শুক্রবার। সকালে আমরা সবাই সাউথ উয়েল নেইবারহোড আবাসিক এখাকায় ঘুরে
বেড়াই। একটি দামী গাড়ি এসে পাশে থামে। ভাবি নিশ্চয় ভিআইপি কেউ হবেন। জিন্সের
প্যান্ট ও দামী গ্যাঞ্জি পরা একজন স্মার্ট ভদ্রলোক গাড়িতে হতে নামলেন। এবার এই
স্মার্টম্যান গাড়ির পিছন খোলে একটি ছোট ঘাসকাটার মেশিন নামালেন। এই গাড়িতে বসে
তিনি ঘাস কাটতে শুরু করলেন। আশপাশের ঘাস কাটার পর মাট সবুজ গালিচায় রূপ নেয়। এবার
বুঝলাম এই ভিআইপি একজন গ্রাসস-কাটার। ঘাস কাটা
তার পেশা।
জর্জিয়া
স্টেটের রাজধানী আটলান্টা সফরঃ
১০ম
অক্টোবর ২০১৫ সাল, শনিবার। সকালে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আজ ভাই ভাবী আমাদেরকে
নিয়ে তাদের গাড়ি ড্রাইভ করে আরেক স্টেট জর্জিয়ার রাজধানী আটলান্টা নিয়ে যাবেন।
আটলান্টা আমেরিকার একটি শ্রেষ্ট শহর। তাদের উচ্চশিক্ষিতা কন্যা তাইবা চৌধুরী
আটলান্টায় চাকুরী করে। সাউথ ক্যারলিনার রাজধানী কলম্বিয়া হতে আটলান্টার দূরত্ব ২৫০
মাইল। সকাল ১০টা ২০মিনিটে রওয়ানা হই। জর্জিয়া স্টেটের সীমায় আসামাত্র এই রাজ্য
সরকারের নির্মিত সুবিশাল রেস্ট হাউসে প্রবেশ করি। সুন্দর প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত
স্থানে এই রেস্ট হাউসের অবস্থান। এখানে আছে অত্যাধুনিক ওয়াশরোম, বাথরুম, বসার লবী,
ছায়াময় বাগান। এখান থেকে জর্জিয়ার পরিচিতি গাইডবুক ফ্রি নেই। এই বইয়ে জর্জিয়ার
সচিত্র সবকিছুর বিবরন রয়েছে।
দুপুর ১টা ২০ মিনিটে আমরা আটলান্টার হিমালয়া ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। এই হোটেলের নাম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হলেও এর মালিক একজন বাংলাদেশী। হোটেল মালিকের বাড়ি বড়লেখায় এবং হোটেল কর্মিরা সবাই সিলেটি। চিকেন, বিফ, খাসির মাংস, তরকারী, রুটি, পোলাও, বুট ইত্যাদি আলাদা আলাদা কাচের জারে সাজিয়ে রাখা। অন্য টেবিলে ফিরনি, ফল, আইসক্রিম, চা-কফি ইত্যাদি। বুফে খাবার, যার যা খুশি খাবে, বিল নিদৃষ্ট। তাইবা বিল পরিশোধ করলে হোটেল মালিক পাশেই তার গ্রোসারী সপ দেখাতে নিয়ে যান। তাইবা আমরা থাকার জন্য আটলান্টায় আবাসিক হোটেল ভাড়া করেছে। হোটেলের নাম Hampton Inn Hotel Atlanta. দুইজনের স্যুট ১৫০ ডলার প্রতিদিনের ভাড়া। সুসজ্জিত হাইফাই এই হোটেল আমাদের শ্রীমঙ্গল গ্রেন্ড সুলতান হোটেলের অনুরূপ। হোটেল স্যুটের অটো ডোর ও টাচ চাবী। স্যুটে আছে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, এসি, বেড সোফা, বাথ টব, আলনা, ওয়ান টাইম গ্লাস, গার্বেজ বিন, ফোন ইত্যাদি। হোটেলে উঠার আগে তাইবা আমাদেরকে তার বাসা দেখাতে নিয়ে যায়। সুন্দর ছিমছাম বাসা দেখে তার ফুফু নুরজাহান বললেন, ডলার নষ্ট করে হোটেল ভাড়া করার কি দরকার ছিল, এখানেইতো থাকা যেত। ফুফু আপনারা আরামে ঘুমানোর জন্য ভাড়া করেছি। আটলান্টায় কি আর কখনও আপনাদের আসা হবে।
স্টোন মাউন্টেইনে
পৃথিবীর সেরা লেজার-সো দেখতে যাওয়াঃ
এইদিন তাইবা
আমাদেরকে
Stone Mountain Park নিয়ে যায়। আমাদেরকে লেজার-সো দেখাতে সে ১২০ ডলারে ৬টি টিকেট
কিনে। আমাদের গাড়ি
পার্কিং এলাকায় রেখে সামনে এগিয়ে যাই। একটি গ্রানাইট পাতরের পাহাড় খাড়াভাবে মাইল
খানেক উচ্চতা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মাথায় মেঘ লেগে আছে। এক মাইল উচ্চতা
ও কয়েক মাইল বিস্তারের একটি পাতর যেন কেউ মাটিতে পুতে রেখেছে। এই পুতে রাখা কাল
পাতরই হল স্টোন মাউন্টেইন। স্টোন মাউন্টেইনের গা মসৃন উল্লম্ব মাটের মত। পাহাড়ের
উপর পর্যটন কেন্দ্র। শুন্য গ্লাসের কামরায়
চড়ে রজ্জিপথে মানুষ পাহাড়ের উপরে উঠছে।
স্টোন
মাউন্টেইন পর্বতগাত্রে পাতর কেটে তিনজন অশ্বারোহীর ভাস্কর্য্য নির্মান করা হয়েছে
কয়েক যুগ আগে। পাহাড়ের গা খাড়া ও সমতল। কোন বৃক্ষলতা নেই। এই পাহাড়ের সমতল গায়ে
রাতে আলো ও লেজারভিম মিলে এক সুবিশাল প্রাকৃতিক টিভিস্কিন তৈরি করে। পাহাড়ের এই
প্রাকৃতিক দেয়ালে অনুষ্টিত হয় পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ লেজার-সো। দলে দলে মানুষ আসছে। শত
শত মানুষ। পার্কিং জুড়ে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু গাড়ি আর গাড়ি।
ধাপে ধাপে
সাজানো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বানের মত আসা সাদা মানুষের স্রোত হারিয়ে যাচ্ছে। স্টোন
মাউন্টেইন পাহাড়ের পাদদেশে জলাভূমি ও চরাচর। বিচরন করছে বুনোহাঁস ও জলচর পাখি। এই
জলাভূমি ও সামনের সমতলে রাতের আঁধারে অনুষ্টিত হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ট Leser Show. সেদিন রাত ৮ টায় লেজার সো শুরু হয়। দশ বার হাজার মানুষ এই লেজার সো দেখতে সমবেত হয়েছেন। বেশি মানুষই শ্বেতাঙ্গ নরনারী। এই নরনারীরা প্রায় সবাই প্যান্ট সার্ট ট্রাউজার পরা এবং তাদের
গাত্র থেকে বাতাসে পারফিউমের সুগন্ধ আসছে। তাদের সোনালী
চুল ও ডালিম রসে দুধ মাখানো রঙ। তারা পাহাড়ের
ভাঁজে ভাঁজে, উপত্যকার মাটে, ঢালু সবুজে মাদুর পেতে
বসে যান। জেফারের বয়সী
একজন সাদা কিশোরের সাথে তার ভাব জমে ঊঠে। এই কিশোর ফ্লোরিডা
হতে পরিবারের সাথে লেজার সো দেখতে এসেছে। এই অতি সুন্দর
জনগোষ্টিকে দেখে মনে দুঃখ পাই এই ভেবে যে এদের জন্মহার কমে যাবার কারনে এই অপরূপ নৃগোষ্টির
মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং অসুন্দর নৃগোষ্টির মানুষ দ্রুত বাড়ছে। আহা, এই স্বর্গের হুর গেলমানরা কি এক সময় পৃথিবী হতে
নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সামনের মাট একটা প্রাকৃতিক গ্যালারীর মত। প্রথমে উচু উপত্যকা, তার নিচে আরেক উপত্যকা, তার নিচে ঢালু সবুজ মাট যেন প্রকৃতি আপন খেয়ালে স্থানটাকে উৎসব করার জন্য মঞ্চ ও দর্শক গ্যালারী বানিয়ে রেখেছে। রাতের অন্ধকারে মানুষ দলে দলে ঘাসের গালিচায় বসে আছে। আচমকা খানিক বৃষ্টি এসে সবাইকে ভিজিয়ে দেয়। একটু শীত শীত লেগে আমরা কাঁপছি। সময়ানুবর্তিতা আমেরিকার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখানে কোন কিছুতেই সময়ের কোন হেরফের হয়না। বাস, ট্রেন, অফিস, সভা কিংবা অনুষ্টান। আমেরিকায় ঘোষিত সময়ে সব কাজ ঘড়ির কাটায় কাটায় সম্পন্ন হয়। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন