শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- তের

 


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর  পর্ব- তের

৩রা অক্টোবর ২০১৫ সাল, শনিবার আমাদেরকে কলম্বিয়া শহর ঘুরে দেখাতে মেঝভাবী ছুটি নিয়েছেন তিনি কলম্বিয়া আরমো স্কুলের টিচার আমাদের আপ্যায়নে সকালে তিনি নানাপদের খাদ্য প্রস্তুতে সচেষ্ট হন তৈরি করেন ইংলিশ মাফিন, যা চাল গম ভূট্টা যব এধরনের দশটি কণাশস্যের ময়দায় বানানো পাউরুটির সাথে সস, সবজি ও ডিম ইংলিশ মাফিনে সুগার তেমন নেই, তাই ডায়বেটিস রোগীদের আদর্শ খাবার সবুজ, সাদা ও বেগুনী তিন ধরনের ফুলকপির হাফ ভাজি সবজি খাই, যাকে বলা হয় ব্রকলি

দুপুরে ডিম, মাছ, টমেটো, সস, ধনচে পাতা ও মরিচ সমৃদ্ধ থাইস্যুপ খাই মনে হল এমন পুষ্টিকর খাবার রোজ রোজ উদরে গেলে রোগ হবেনা, আয়ু অনেক বেড়ে যাবে বিকেলে মেঝভাবী পিজ্জা(Pizza) তৈরী করেন গোলাকার চেপটা পাউরুটির উপর যতনে মাখানো হয় চিজ, ডিম, টমেটো, সস ও মাখন মেশানো পুষ্টিকর পেইস্টএবাসায় প্রায়ই ডনেট পরিবেশন করা হয় ডনেট হল  সুমিষ্ট ক্রীম মাখানো মজাদার বনরুটি।

৪ঠা অক্টোবর ২০১৫ সাল, রবিবার। গত দুইদিনের অবিরাম বর্ষনে সাউথ কলম্বিয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বাসার পিছনের পাহাড়ের মাঝে ঢালু জমিতে পানি জমে পুকুর হয়ে যায়। প্রবল বর্ষনের জন্য সেইদিন ঘর হতে বের হওয়া যায়নি। বন্যাজনিত কারনে টেলিভিশনে এক ভাষনে স্টেইট গবর্নর কলম্বিয়ার সব অফিস, আদালত, বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করেন। মেঝভাই জামিল চৌধুরী স্টেট গবমেন্ট অফিসে একাউন্ট বিভাগে চাকুরী করেন। তিনি বন্যার কবলে পড়ে বাসা ফিরতে পারেন নি। অফিসের কাছে একটি হোটেলে তিনি রাত কাটান।

৫ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, সোমবার। বন্যায় ঘরে বসে দেশী বিদেশী চ্যানেলের অনুষ্টান ও খবর দেখে পার করি। মেঝভাবী আমেরিকান খাবার তৈরি করেন। বন্যায় সবকিছু বন্ধ, তাই মেঝভাই বাসায় ফিরতে পারছেন না। সাউথ ক্যারোলিনার বন্যা খুব উপভোগ করি। ভাবলাম, এমন বন্যা বাংলাদেশে প্রায়ই হয়। কিন্তু আমেরিকানরা বন্যা নিয়ে যেভাবে মাথা ঘামায় আমরা তেমন করিনা। কারন আমেরিকানদের মত আমাদের কোথায়ও জবাবদিহীতা করতে হয়না। বন্যায় কে মরল, কে বাঁচল। কে ভাসল, কে ডুবল, তানিয়ে বাংলাদেশে কাউকে দ্বায়বদ্ধ 2হতে হয়না। অথচ কলম্বিয়ার বন্যা সাউথ ক্যারোলিনার কর্তা ব্যক্তিদের ঘুম হারাম করে দেয়।

৬ষ্ট অক্টোবর ২০১৫ সাল, মঙ্গলবার। সকাল থেকে মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলা চলে। মেঝভাই আমাদেরকে Social Security card এর জন্য আবেদন করতে কলম্বিয়া ফেডারেল ভবনে নিয়ে যান। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বন্যার জন্য ফেডারেল অফিস বন্ধ। এবার আমরা ফিনলে পার্ক (Finley Park) দেখতে যাই। এই পার্কে মানবসৃষ্ট অপুর্ব সুন্দর কৃত্রিম জলপ্রপাত ও ঝর্নাধারা রয়েছে। ঝর্না সশব্দে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে আসছে। একটি জলাভুমিতে জলপ্রপাতের জলধারা পড়ে শীতল বাতাস বইছে। জলের ছলছল শব্দের সুর বাজছে। সামনের লেকে একটি দ্বীপ, সেতু দিয়ে যেতে হয়। এই ফিনলে পার্কে পাহাড়ের ধাপ কেটে সিড়ি পর সিড়ি নির্মান করে গ্যালারী বানানো হয়েছে। সারাটা গ্যালারী বর্নীল ফুলগাছে আবৃত। কুসুমের ফাঁকে বসে অনেক ছবি তুলি। এটাই আমার দেখা মানুষের তৈরি শ্রেষ্ট জলপ্রপাত। নিঃসন্দেহে ফিনলে পার্ক যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেরা পার্ক।


এইদিন বিকেলে আমরা সুপ্রসিদ্ধ লেইক মারি (Lake Mari) দেখতে যাই অপূর্ব সুন্দর এই লেকের আয়তন ২৬ বর্গমাইল যেন জলভরা কূলহীন হাকালুকি লেকের পাশে রয়েছে একটি সুন্দর পার্ক লেকে ডুকে কিছু সেতু ঝুলে আছে লেকপারে বাঁধের উপর দিয়ে প্রায় দুইতিন মাইল দীর্ঘ্য পাকারাস্থা চলে গেছে এই রাস্থার লেকপারে রেলিং রয়েছে এই সুন্দর রাস্থায় মানুষ হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে বাতাস বেশ ঠান্ডা তাই আমি ও জেফার মনের আনন্দে দৌড়াই এবং সূর্যাস্তের আগেই মাইল দেড়েক ঘুরে আসি লেকের জলে পড়ন্ত বিকেলের রঙিলা সূর্যকে আপন মনে ডুবতে দেখি কলম্বিয়ার অনেক বাসায় তিনচারটি গাড়িতো থাকেই, সেইসাথে সাথে থাকে স্পিডবোট চাকাযুক্ত স্পিডবোট তারা গাড়ি দিয়ে টেনে নেয় লেকে এবং পারের লোহার রেলে চাকা তুলে নামিয়ে দেয় লেকের জলে স্পিডবোটগুলো আকারে মাঝারী, পাঁচসাত জন লোক বোটে আনন্দ ভ্রমন করে সুন্দর বিকেল লেকের জলে আনন্দবিহারে কাটিয়ে দেয়। ফেরার পথে কলম্বিয়ার দুইটি ছোটনদী কনগেরী-রিভার এবং বুশ-রিভারের দেখা পাই। দুই নদীর জল লাল। হ্যাঁ, নদী দু’টি হবে বড়জুর আমাদের মনু কিংবা খোয়াই এবং তারা বয়ে নিচ্ছে সাউথ ক্যারোলিনার লাল পাহাড় ধুঁয়া জল।

৭ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, বুধবার। আমরা সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি দেখতে যাই। তাইবা এই ইউনিভার্সিটির ছাত্রি। আমরা এই ইউনিভার্সিটির বহুতল ভবনের উপর স্থাপিত কালোগ্লাস ঘেরা গোলাকার ক্যাফটেরিয়ায় যাই। এই ক্যাফটেরিয়া ঘুর্নায়মান। এই হোটেলে বসে চা-নাস্তা করে করে ঘুর্নায়মান অবস্থায় সারা কলম্বিয়া শহর দেখা যায়। মেঝভাই একটি গ্যাসস্টেশন হতে গাড়ির পেট্রোল কিনেন। কার্ডে তেলের দাম পরিশোধ করে নিজেই গাড়িতে পেট্রোল ভরে নেন। যত টাকা পরিশোধ হয়েছে, ততো টাকার তেল ডুকা মাত্র মেশিন অটো বন্ধ হয়ে যায়। এই গ্যাস স্টেশনের কার-ওয়াস ব্যবসা রয়েছে। মেঝভাই এখানে কার ওয়াস করেন। কার্ডে ১১ ডলার পরিশোধ করামাত্র সামনের সুড়ং পথে কার ডুকানোর সংক্ষেত আসে। গ্লাসবদ্ধ কারে বসা অবস্থায় প্রথমে সাবান পানি, তারপর পরিস্কার পানি, তারপর এন্টি স্পট ক্রীম এসে ধাপে ধাপে চোখের পলকে গাড়ি ধুয়ে পরিস্কার দেয়। এবার তীব্র বায়ুপ্রবাহ এসে গাড়িকে শুকিয়ে দেয়। এবার গাড়ি ওয়াসিং টিউব হতে বেরিয়া আসেকোন মানুষের হাতের ছোঁয়া ছাড়াই ১০/১২ মিনিটে গাড়ির স্নান ও তৈল মাখা সমাপ্ত হয়।

আজ বাসার সামনের ডাকবাস্ক খুলতেই একটি বড় খাম পাওয়া যায়। খাম খূলতেই বেরিয়ে আসে আমাদের তিনজনের গ্রীনকার্ড। অনেকে ১০/১২ বছরেও গ্রীনকার্ড পান না। আমরা বিশ বাইশ দিনের মধ্যে গ্রীনকার্ড পেয়ে যাওয়ায় হাতে নিয়েই মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাই।

কলম্বিয়ার আবহাওয়া শীতল ও আরামদায়ক। রাস্থায় কেবল হাঁটতে ইচ্ছে হয়। দুপুরে খেয়ে একাকি হাঁটতে বের হই। বড় সড়কের পাশে একটি পুকুরপারে যাই। একজন কালো আফ্রিকান মধ্যবয়সী লোক পুকুরে বরশি ফেলে মাছ ধরছেন। আমি গুড ইভিনিং বলতেই তিনি হাই হ্যালো বলে আমাকে সম্ভাষন জানান। তিনি জলভরা পাত্র আমার দিকে বাড়িয়ে তাতে তার বরশিতে ধরা দশবারটি তেলাপিয়া জাতীয় মাছ দেখান। ভদ্রলোক আমার পরিচয় জেনে নেন। আমার দেশ বাংলাদেশ বললে তিনি চিনতে পারেননি। আমি নিয়ার ইন্ডিয়া বলতেই জবাব দেন, ও কে এশিয়া। আমার দেশ ভ্রমন নিয়ে তিনি জানতে চাইলে আমি একটা বিবরন বলে যাই। আমি এবার তার ইতিকথা জানতে চাই। জানান তার জন্ম সাউথ ক্যারোলিনায়। তিনি জীবনে একবার মাত্র পাশের নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্য সফর করেছেন। আমেরিকার অন্য কোন রাজ্যে তিনি কখনো যাননি। আমি বেশ অবাকই হলাম। আবার ভাবি এতে অবাক হবার কি আছে। একবার ভাগ্না জিন্নুন তার কারের যাত্রি একজন সাদা তরুনীকে অবাক হয়ে ১৪৭২ ফুট উচু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের দিকে বিষ্মিত চোখে তাকাতে দেখে প্রশ্ন করেছিল, কি দেখছেন। মেয়েটি জবাব দেয় তার বাড়ি পেন্সিলবানিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে, কোনদিন নিউইয়র্ক আসেনি, তাই এত উচু ভবন জীবনে কখনও দেখেনি। আসলে আমেরিকায় অনেক অনেক মানুষ আছে যাদের ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে বাইরে দু’পা ফেলিয়া’। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন