যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- বার
রাতে মেঝমামা আমাকে একটি ছবি দেখান। আমাদের সিলেটি পরিচালক শাকুর মজিদ নির্মিত ছবি ‘বৈরাতী’, যা বিয়ানীবাজার সহ সিলেট অঞ্চলে অভিনীত হয়েছে। ছবির ভাষা খাস সিলেটি। এই ছবিতে সিলেটের দুইজন প্রিয় মানুষকে অভিনয় করতে দেখি। তারা পুবালী ব্যাংকের পরিচালক শেখ ওয়াহিদুর রহমান এবং লোকসঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস। এই ছবিতে আমাদের ছেলেবেলার (প্রাক ১৯৮৫ সাল) বিয়ে বাড়ি, দজগন, পান-চিনি, গায়ে হলুদ, পালকি চড়া নববধু, বিয়ের গান, শ্লোক (ফই) প্রতিযোগিতা, নানাবিধ লোকাচার ও রীতিনীতি দেখি। এযেন ওয়াশিংটনে বসে সিলেট ও সিলেটি জীবনে খানিকক্ষন ডুব সাঁতার কাটা। বাল্যকালের সিলেটের লোকজীবন ফিরে দেখা। সেদিন বেশ রাতে মেঝমামার বাসায় গভীর ঘুমে ডুবে যাই।
কিছুদিন আগে আমার বড়খালা আবেদা চৌধুরী জবা বুড়ো বয়সে আমেরিকা ঘুরে আসেন। আমার মেঝমামা তাকে আমেরিকার বিরাট এলাকা ঘুরে দেখান। আমি খালাকে বললাম আপনি ইংলিশ জানেননা। ঢাকা থেকে সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত কেমন করে ঘুরলেন। আমাকে তিনি বললেন আমেরিকা বেড়াতে বেশি কিছু বলতে হয়না, মাত্র তিনটি শব্দ জানলেই সারা আমেরিকা সহজেই চরে বেড়ানো যায়। এই তিনটি শব্দ কি? জানতে চাইলে খালা জবাব দেন, ইয়েস নট এবং এক্সকিউজ মি। কিছু চাইলে ইয়েস, না চাইলে নট। কারো কাছে দাঁড়িয়ে এক্সকিউজ মি বললেই সে সব কাজ করে দেবে। আমেরিকানরা কখনও আমাদের মত দশজনের মজলিশে বসে সশব্দে কিংবা নিরিবে বায়ুত্যাগ করেনা। ঐ কাজের দরকার হলে তারা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে সেরে আসে। তবে যদি দুর্ঘটনা ঘটে বাতাস বেরিয়ে আসে তাহলে আমাদের মত রাখডাক করবেনা কিংবা অস্বীকার করবেনা। মাথা নুয়ায়ে বিনীতভাবে বলবে এক্সকিউজ মি, যেন অন্যায় করে ভদ্রলোক অনুতপ্ত হয়ে মাফ চাইছেন। খেতে বসে তারা ঢেকুর দেয়না। যদি ঢেকুর আটকাতে ফেল মারে তাহলেও বলবে এক্সকিউজ মি। আবার কারো কাছে কোন সাহায্য চাইলে তারা আমাদের মত বলবেনা আমার ব্যাগটা একটু এগিয়ে দিন। বরং ব্যাগ দেখিয়ে বলবে এক্সকিউজ মি। কেউ কারো মনে সামান্যতম বিরক্তি দিলেও বলে এই একই কথা এক্সকিউজ মি। কাছে গিয়ে এক্সকিউজ মি বললেই আমেরিকানরা হাসিমুখে আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাই আমেরিকা যেতে হলে আপনি এক্সকিউজ মির এসব ব্যবহার মনে রাখুন, কাজে লাগবে।
কলম্বিয়া,
সাউথ ক্যারোলিনা সফরঃ
১লা
অক্টোবর ২০১৫ সাল। শেষরাতে মামা-মামি আমাদেরকে ব্রেকফাস্ট করান। মামাতো ভাই জাহেদ
এসে ড্রাইভ করে আমাদেরকে ওয়াশিংটন ডিসির ইউনিয়ন স্টেশনে নিয়ে যায়। মামা আমাদেরকে
মেঘাবাস ডট কমের কাউন্টারে নিয়ে যান। সকাল ৬টায় সাউথ ক্যারোলিনা স্টেটের রাজধানী
কলম্বিয়ার উদ্দেশ্যে দুতলা মেঘাবাস যাত্রা শুরু করে। আমরা বাসে উপর তলার সামনের
সিটে বসি। পথে ভার্জিনিয়া স্টেটের রাজধানী রিচমন্ড, তারপর ডারহাম এবং নর্থ
ক্যারোলিনার রাজধানী রালি অতিক্রম করি। টিকেটে নির্ধারিত সময়ের (৪টা ৫৫মি) ২০
মিনিট আগে গন্তব্যনগরী কলম্বিয়ায় বাস থামে। বাস থেকে নেমেই মেঝভাই জামিল চৌধুরীকে
সামনে পেয়ে যাই। তিনি গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে ডাউন টাউন, নিউ টাউন দেখিয়ে বাসায়
পৌছান।
তিনি আমার
মেঝ সমনদিক জামিল চৌধুরী, তার ডাকনাম শাহজাহান। তিনি মেরিন প্রকৌশলী। তার পত্নী
হাসনাত জাহান চৌধুরী (বিউটি) সিলেটের কানিশাইল গ্রামের কর কর্মকর্তা আফতাব চৌধুরীর
কন্যা। হাসনাত জাহান চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজতত্ত্বে অনার্স সহ
মাস্টার্স। তাদের দুই সন্থান- তাইবা চৌধুরী ও আতিফ চৌধুরী। জামিল চৌধুরী একজন
বুদ্ধিমান ও দায়িত্ববান ব্যাক্তিত্ব। ২০০২ সালে তিনি আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র নিতে
আবেদন করেন এবং তের বছর পর ২০১৫ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ভিসা পাই।
কলম্বিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ও স্টেইট রাজধানী। নিরিবিলি
পরিচ্ছন্ন শহর। বৃক্ষের শহর, ফুলের শহর। আমেরিকা আবিস্কারক কলম্বাসের নামে এই
শহরের নাম কলম্বিয়া। সাউথ ক্যারোলিনা ছোট্ট স্টেইট, আয়তন ৩০,৩১১ বর্গমাইল।
লোকসংখ্যা মাত্র ৩৭,৪২,০০০ জন। এই স্টেইটের নিক নেইম পলমেট্রো স্টেইট। পলমেট্রো এক
ধরনের দামী বৃক্ষ যা এত স্টেটে প্রচুর জন্মে।
মেঝভাই
জামিল চৌধুরীর বাসার সামনে গাড়ি থামল। খুব সুন্দর ঢালু ছাদের ত্রিপ্লেক্স বাসা।
রিমুটে চাপ দিতেই গাড়ি ঘরের দরজা দুদিকে সরে গিয়ে ওপেন হল। উঁচুনিচু টিলাময় সুন্দর
নেচার এলাকায় এই বাগানবাড়ি। সামনের বাগানে নানান জাতের ফুলের সমারোহ। বাসার অন্য
তিন দিকে খালি সবুজ চত্বর। সযতনে রুপন করা আছে সাদা মরিচ, নাগা মরিচ, কদু, শিম
ইত্যাদি। দেশটি আমাদের মত বৃষ্টিবহুল ও খানিক গরম। তাই আমাদের দেশের সব ধরনের ফল,
ফুল, শস্য এখানে হয়।
বাসার
সামনে ঠিকানা লিখা চিটি-বাস্ক এবং পিছনে একটি কাটের মঞ্চ। মঞ্চের কাছেই গার্বেজ
ফেলার প্লাস্টিক আধার। সাপ্তাহে একদিন গাড়ি এসে গার্বেজ নিয়ে যায়। বাসার পিছনে
পুকুরের মত একটি জলাধার। জলাধারের পাশের বনে মাঝে মাঝে হরিন চরে বেড়ায়। জনপদটি আমাদের চা-বাগানের মত সুন্দর। নয়ন ভূলানো সব সুরম্য বিদেশী
বৃক্ষমালার পরিকল্পিত সমারোহ। বাসার নিচতলায় দুইটি ড্রয়িং কক্ষ, বড় ডাইনিং ও
কিচেন। গাড়ি ঘরেও চুলা আছে। ধুয়াযুক্ত রান্না এখানে করা হয় যাতে ঘরে দুষন না হয়।
উপরতলায় চারটি বড় বেড রোম ও দুইটি অত্যাধুনিক বাথ রোম। নিচেতলায়ও একটি বাথরুম আছে।
বেড রোমের সাথে শত হ্যাঙ্গারযুক্ত ড্রেস রোম, যেখানে প্রচুর জুতা ও হ্যাঙ্গারে
পোষাক সাজিয়ে রাখা যায়। থাইগ্লাসের বাথরোম তিন কক্ষ বিশিষ্ট, এককক্ষে হাইকমোড,
একটি অজু গোসলের এবং তৃতীয়টি ড্রয়িং টেবিল ও আয়নাযুক্ত ড্রেসিং রোম। বাথরোমের
ড্রেসিং কক্ষ কার্পেট মোড়ানো। সারাটা বাসা হাইটেক যন্ত্রপাতি সজ্জিত। এখানে বাসায়
এত হাইটেক সুবিধা রয়েছে যে কাজের লোকের কোন দরকার নেই। বাসার চারজনের চারটি গাড়ি
গ্যারেজের সামনের ড্রাইভওয়েতে পড়ে থাকে। পরিবারের সব সদস্যের শিল্পীর আঁকা ছবি,
আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ছবি দেয়ালে শোভা পেতে দেখি। নিচের ড্রয়িং রোমে আমার চাচাত
ভাই শিল্পী সেলিম কুরেশীর আঁকা একটি চিত্রকর্মে গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখে বিমুগ্ধ
হই।
২রা
অক্টোরর, ২০১৫ সাল, শুক্রবার। কলম্বিয়া একটি গ্রাম শহর, একটি অরন্য শহর। ভোর হতে
এশহরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসার ভিতর নাতিশীতুষ্ণ অথচ দরজার বাহিরে পা রাখলেই ঠান্ডা।
অন্যধরনের বৃষ্টি যা বাংলাদেশ হতে খানিক ভিন্ন। এযেন এমন এক অদ্ভুদ বৃষ্টি- যা না
তুষারপাত, না বৃষ্টিপাত। একজন পোস্টম্যান গাড়ি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকবাস্কে
চিটি, বিল ও পত্রিকা রেখে চলে যান।
আমরা উষ্ণ
পানিতে শুক্রবারের সুন্নতি গোসল করি। তারপর জুমুয়ার জামাতে শরিক হতে মেঝভাবী কার
চালিয়ে আমাদেরকে সাত আট মাইল দূরের এক মসজিদে নিয়ে যান। নিচতলায় পুরূষ ও দুতলায়
নারীরা মিলে একটি সম্মিলিত জুমুয়ার জামাত হয়। আরবের মত এখানেও কাউকে সুন্নত, নফল
নামাজ পড়তে দেখিনি। কোন সমবেত মোনাজাতও নেই। মসজিদের বাহিরে দুইটি বেড়াহীন ঘর।
নামাজ শেষে একটি ঘরে নারী এবং অন্যটিতে পুরুষরা জমায়েত হয়ে আড্ডা দেন। এখানে আট দশ
জন বাংলাদেশী ছাত্রের দেখা পাই। তারা বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা
নিতে এসেছে। ঐদিন বিকেলে আমাদের আবাসিক এলাকায় রাস্থা ধরে হাঁটি। সুন্দর সুন্দর
ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স বাগানবাড়ি, ছিমছাম পরিপাঠি। স্বর্গীয় নিরবতার মাঝে পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। লোকজনের আনাগুনা বিরল। দু’একটা গাড়ি এসে বাসার সামনে রিমুট
টিপছে, অটো খোলে যাচ্ছে গ্যারেজ। উদাও গাড়ি সহ মানুষ। এই হল সাউথ ক্যারোলিনা
স্টেটের রাজধানী কলম্বিয়ার একটি জনপদের চালচিত্র। এই জনপদটির নাম South Well
Subdivision. (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন