যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- এগার
২৯
সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। ঐদিন রাতে মামামামি ও আমরা মুর্শেদের বাসায় দাওয়াত খাই।
মুর্শেদপত্নী রাবেয়া নানাপদের পাকিস্তানী খাবার রান্না করেন। রাবেয়া মধ্যম উচ্চতার
চিকন ফর্সা নারী। মনে হয় তিনি দারূন সংসারী। মুর্শেদ ভাল চাকুরী করায় তাকে কোন কাজ
করতে হয়না। তিনি দুইকন্যা মরিয়ম ও আয়শা, পুত্র হামিদকে সযতনে লালন পালন করছেন। তাই
রাবেয়া সংসারের হাল শক্ত মুঠোয় ধরে আছেন। তাদের আলিশান বাড়ি, বাচ্চাদের ভূতল
খেলাঘর, আলাদা পড়াঘর, ঘরের অনেক কক্ষ অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
এই ডিনারে
শরিক হন, মামাতো ভাই ফরহাদ এবং তার বৃটিশ বাঙ্গালী পত্নী জেনী। জেনীর বডি স্লিম
এবং তার মিষ্টি বাঙ্গালী চেহারা। তাদের দুই কন্যা জান্নাহ ও আলিনা। ফরহাদ আই টি
ইঞ্জিনিয়ার। ওয়াশিংটন ডিসির এক বানিজ্যিক ভবনে তার আই টি ফার্ম। তার আইটি ফার্মে
আমরা যাই। হাফপ্যান্ট ও ফ্রক পরা একজন আফগান তরুনি আমাদেরকে রিসিভ করেন। ১৯৭৮ সালে
নিউইয়র্কে জন্মগ্রহনকারী ফরহাদ অল্প বয়সে সুপ্রতিষ্টিত। সে ধার্মিক ও বাগ্মী।
মুসলিম কমিউনিটির বিভিন্ন সভায় সুন্দর ভাষন দেয় সে।
এই ডিনারে আসে
ছোট মামাতো ভাই জাহেদ। অতি সুদর্শন জাহেদের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯৮০ সালে। তার পরমাসুন্দরী
স্প্যানিশ পত্নী আমিনাও সাথে আসেন। আমিনার বডি স্লিম, দুধে আলতা রঙ, দীঘল গঠন, চুল
ও চোখের মনী গাড় কালো। স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহনকারী আমিনা খুব ধার্মিক। জিন্সের
প্যান্ট ও ট্রাউজারের সাথে মাথায় হিজাব পরেন। জাহেদ দম্পতির তিন কন্যা নাসিহা,
জাহরা এবং আরিয়ানা। রাবেয়া ও আমিনা বাংলা খুব একটা বুঝেন না। কেবল চেয়ে থাকেন।
জেনী সিলেটি ভাষায় বক বক করে মজলিশ গরম রাখেন। আমিনা দুই চারটা বাংলা শব্দ বলেন,
তারপর শেষ। সে রাতে মুর্শেদের অত্যাধুনিক আলিশান বাসা ঘুরে ঘুরে দেখি। এমন সুন্দর
বাসা সিলেটে কেন, গোলশানেও বিরল।
৩০
সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। মামির কর্মক্ষেত্র সপার্স সপে (Shoppers Shop) যাই। এখানে মামি পার্ট টাইম কাজ করেন। বলা যায় প্রয়োজনে নয়, সময় কাটাতেই চারঘন্টা কাজ করা। বিশাল মল, এটি সপার্স সপের সারাটা যুক্তরাষ্ট্রে
ছড়ানো অনেকগুলো মলের একটি। এবার গাড়ি একটি ব্যাংকের সামনে যায়। মামা গাড়ি হতে না
নেমেই কারের জানালা দিয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করেন। দুপুরে মামামামি আমাদেরকে
নিয়ে ম্যাকডুনাল্ড বারে যান। এখানে আমরা
চিপস,
চিকেন, সস, সালাদ,
বার্গার খাই। সাথে ছিল সুমিষ্ট
চকলেট,
কফি ও কুক।
ম্যাকডুনাল্ড
হতে বেরিয়ে বার্লিংটন কোট ফেক্টরী ঘুরে দেখি। বাসায় ফিরে খানিক ঘুমাই। ঘুম হতে উঠে তিন চার ঘন্টা মামার কাছে রক্ষিত আট/দশ হাজার
ফটো দর্শন করি। আমার বালকবেলা
ও কৈশরের বেশ কিছু দুর্লভ ফটো পেয়ে যাই। পৃথিবী হতে
অনেক আগে বিদায় নেয়া অনেক আত্মীয় স্বজন যেমন বড়মামা, নানি এবং আমার মরহুমা
মায়ের অনেক পুরাতন ছবি দেখে খানিকের জন্য মোহাবিষ্ট হয়ে যাই। মেঝমামা এলবামে তার ভাইবোনদের প্রত্যেক পরিবারের সদস্যগনের ফটো
আলাদা আলাদা পৃষ্টায় সাজিয়ে রেখেছেন। আমেরিকার আবহাওয়া
অনার্দ্র হওয়ায় ফটো নষ্ট হয়না। তাই হাইটেক
দেশে তৈরী ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের ফটোগুলো এখনো সতেজ রয়েছে। এই ফটোগুলো সুদূর অতীতের কথা নিবৃতে বলে যায়। ফটোগুলোর সযতনে সংরক্ষণ দেখে ভাবলাম, আমাদের
প্রবাসীরা দেশ ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করলেও তারা কখনো তাদের ভাই-বোন, ভাগ্না-ভাগ্নি-ভাতিজী, নিকটাত্মীদেরকে মূহূর্তের জন্য ভূলতে পারেন না। তাইতো দেশের সবার স্মৃতি ধরে রাখার এই সকরুণ কাতরতা।
মেঝমামা এখন
আমাকে আমেরিকায় তার জীবন সংগ্রামের কাহিনী শোনান। সুখ ও দুঃখের স্মৃতিভরা অনেক কেচ্ছা। কিছু কৌতুকও শুনি মামার কাছে। আমার নানাবাড়ি বড়লেখার দক্ষিনভাগ একটি চাবাগান ঘেরা এলাকা। গ্রামের কিছু লোক পাশের চাবাগানে গিয়ে দেশী মদ খেয়ে মাতাল হত। একবার একজন লোক মধ্যরাতে মাতাল হয়ে এসে শোবার ঘর মনে করে গরু ঘরে
ডুকে পড়ে। তারপর গরুর
লেজে বিলি কেটে বলে- আমার ময়নার মা গো, তুমি
সব সময় চুলের দু’টি বেনী বাধো, আজ বেঁধেছ
মাত্র একটি। বলেই আদর করে
লেজে ঠুট লাগাতেই গরুর পিছন পায়ের লাত্থি খেয়ে ছিটকে পড়ে।
দক্ষিনভাগ হিন্দু জন অধ্যুষিত অঞ্চল। একবার কয়েকজন ব্রাক্ষ্মনের মধ্যে দারূন বিতর্ক সৃষ্টি হয়- বিতর্কের বিষয় হল মুসলমানরা স্বর্গে যেতে পারবে কিনা। বেশির ভাগ পুরোহিত মত দেন, এরা গরু খায়, দেবদেবী মানেনা, তাই তারা আদৌ স্বর্গে যেতে পারবেনা। তবে একজন ব্রাক্ষন কেবল ভিন্নমত প্রকাশ করে বললেন যবনরা স্বর্গে যেতেও পারে। অন্য সবাই প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, তা কেমন করে হয়? তিনি জবাব দেন মুসলমানরা ‘হারাম’ শব্দ বলার সময় ‘হা-রাম’ বলে ভগবান রামকে স্মরন করে থাকে। যারা রামকে স্মরণ করে তারা হয়ত ভগবানের দয়ায় স্বর্গে যেতেও পারে। (ইহা নিছক একটি কৌতুক মাত্র। কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলে দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।)
এবার মেঝমামা এক চীনা উপাখ্যান শোনান। তার চীনা-আমেরিকান বন্ধুদের কাছে এই গল্পটি শুনেছেন। একজন চীনা বৃদ্ধ বয়সে পুত্রের সংসারে বসবাস করতেন। পুত্রবধু বৃদ্ধকে সহ্য করতে পারেন না। বউয়ের জ্বলায় বাধ্য হয়ে পুত্র তার বুড়ো বাপকে বাহিরে একটি কুড়েঘর তৈরী করে সেখানে রাখেন। বয়স আর বেড়ে গেলে বুড়োর চেঁচামেচির অভ্যাস আর বেড়ে যায়। অতীষ্ট পুত্রবধু এবার নির্দেশ দেন বুড়োকে বাহিরের কুড়েঘরেও রাখা যাবেনা, তাকে দূরে কোথায়ও পাঠিয়ে দিতে হবে। অনেক খুজাখুজি করে দুরের কোন এক গ্রামে অর্থের বিনিময়ে একটি দরিদ্র পরিবার বুড়োকে রাখতে সম্মত হল। বৃদ্ধের একজন নাতি ছিল, সে দাদাকে খুব ভালবাসতো। বৃদ্ধকে দূরের গ্রামে নির্বাসন দেওয়ার জন্য একটি কাটের বাহন তৈরী করা হল। দাদুর বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে। নাতি মনমরা হয়ে চোখের জল ফেলছে। দাদুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাহনে তুলা হচ্ছে। এসময় নাতি তার বাপকে বলল, আমার একটা অনুরোধ আছে, রাখবে বাবা। কেন রাখবনা, তুমি আমার একমাত্র সন্থান। তোমার অনুরোধ কি না রেখে পারি বাবা। এবার নাতি তার বাপকে বলল, তুমি দাদুকে দূর গ্রামে রেখে আসার সময় এই বাহনটা সাথে নিয়ে আসবে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনের সময় আমি এটা ব্যবহার করতে পারি। বাবা, তুমি যখন দাদুর মত বুড়ো হবে তখন তোমাকে ফেলে আসতে টাকা খরচ করে আমার যেন বাহনটা তৈরী করতে না হয়। একই বাহনে দুজনের কাজ সেরে যাবে। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন