শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- দশ

 


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর  পর্ব- দশ

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সাল, রবিবার সে দিন আমাদেরকে দেখতে আসে মামাতো বোন সোফা ও তার স্বামী আলম সাথে আসে মামাতো ভাই তাওহিদ ও তার বেগম ছাতকের মেয়ে সুমাইয়া তারা মিশিগানে বসবাসকারী আমার ছোটমামা শহীদ চৌধুরীর সন্থান

তারা বিদায়ের পর ইমা আমাদেরকে বালস্টন মলে (Ballston Moll) নিয়ে যায় বিশাল মার্কেটিং মল ভবনের সাথে সংযুক্ত একটি সাততলা পার্কিং প্রতিতলায় প্রায় তিন হাজার করে সাততলা পার্কিং জুড়ে প্রায় বিশ হাজার গাড়ি রাখা যাবে গাড়ি রেখে পার্কিং স্থান ভূলে গেলে গাড়ি খুঁজে বের করা দুরুহ হবে পার্কিং ফি ১ডলার ৩ ঘণ্টা পর ৪ ডলার কার্ডে ফি পরিশোধ করেই পার্কিং স্থানে ঢুকা সম্ভব হয় পার্কিং ব্যবহারের জন্য চারপাশ প্যাচিয়ে অনেক রাস্থা রয়েছে এই পার্কিং স্পেসের একতলায়ই সিলেট শহরের সবগুলো গাড়ি রাখার জায়গা হয়ে যাবে ভার্জিনিয়া ও ওয়াশিংটন ডিসিতে এমন অনেক মল ও পার্কিং রয়েছে

বিকেলে তাওহীদ এসে আমাদেরকে মেরিল্যান্ডে তুর্কি মসজিদ দেখাতে নিয়ে যায়। মসজিদটি তুরস্কের ওসমানীয় মসজিদের নির্মানশৈলীতে নির্মিত।  বড় এক গম্বুজ মসজিদটি দুতলা, দুতলার অর্ধেক স্থান সিনেমাহলের মত খোলা। রয়েছে উন্নত কার্পেট ও ঝাড়বাতি। সামনে আধুনিক অজুখানা ও সুউচ্চ মিনার। বিশাল মসজিদ কমপ্লেক্সে আছে কমিউনিটি সেন্টার, মাদ্রাসা, পাঠাগার ও পার্কিং মাট। অপরূপ সুন্দর এই মসজিদে নরনারীরা স্বস্ব স্থানে উপাসনা ও নামাজ আদায় করছেন। এখানেও লক্ষ্য করি পুরুষের চেয়ে নারী মুসল্লীরাই সংখ্যায় অনেক বেশী। এই মসজিদের ভূগর্বেও কয়েক শত গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।

টার্কি মসজিদ হতে বের হয়ে আমরা মেরিল্যান্ডের ন্যাশনাল হারবারে যাই। ডিসির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আমেরিকার একটি ঐতিহাসিক নদী পটোমাক। একটি ছোট্ট সেতু দিয়ে আমরা নদীর মাঝে স্থাপিত ক্যাপিটেল হুইলে (Capital Wheel) যাই। তাওহীদ ৭৫ ডলারে পাঁচটি টিকেট কেটে আমাদেরকে নিয়ে ক্যাপিটেল হুইলে আরোহন করে। তাওহীদের স্ত্রীর উচ্চতা ভীতি থাকায় হুইলে ঊঠেই ভয় পান ও নেমে যান। হুইল অনেক উপরে উঠলে নদীর ওপারে আলো ঝলমলে ওয়াশিংটন ডিসি চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

পটোমাক আমাদের মেঘনার মত এই বিশাল নদী। এই নদীপারে স্বল্প জলে ও কাদায় ভাসমান মানুষের লাশ প্রত্যক্ষ করি। লাশের গায়ে নদীর ঢেউ এসে পড়ছে। লাশটি যেন কাদাজলে ভাসছে কাছে গিয়ে দেখি এটি মানুষের সত্যিকারের লাশ নয়, শিল্পীর গড়া একটি ভাস্কর্য্য মাত্র।

ন্যাশনেল হারবার হতে ফেরার সময় ছিল ভরা পূর্নিমা আকাশে ঝলমল করছে পূর্ন চাঁদ আচমকা চন্দ্রগ্রহন শুরু হয় একটি কালো মেঘ চাঁদকে ডেকে দেয় রাত ১০ টায় ফিরে আসি ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন, সমনদিক কবির চৌধুরীর বাসায়

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালঃ ঠান্ডা সকালে আমরা সবাই নেচারপার্কে প্রাতঃভ্রমন করি বিকেল ৪টায় মামামামি আসেন আমাদেরকে নিয়ে যান তাদের বাসায়

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালঃ ফজরের নামাজ পড়ি আদম মসজিদে সার্টপ্যান্ট পরিহিত নিগ্রো ঈমাম সাহেব টুপিবিহীন অবস্থায় নামাজ পড়ান নামাজ শেষে এখানেও কোন মোনাজাত করা হয়না

বাসায় ফিরে চা-নাস্তা করে গল্পকথায় ডুবে যাই মেঝমামার কাছে তাদের নিউইয়র্ক জীবনের প্রিয় চিকিৎসক ডাঃ এম এন রায়ের স্মৃতিচারন শুনি ডাঃ রায় কোলকাতার অধিবাসী তিনি ভারতের এমবিবিএস এবং লন্ডনের এফআরসিএস আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি হন নিউইয়র্ক হাসপাতালের একজন স্বনামধন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মামার দুই পুত্র জাহেদ ও ফরহাদের জন্ম হয় ডাঃ রায়ের হাতে মামির সিজারিয়ান অপারেশন করার আগে ও টি হতে বের হয়ে মামাকে বললেন, আমি কহিনুরের পেটে ছুরি চালাই কেমনে, ও যে আমার মেয়ের মত তারপর চোখমুছে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেন একজন বাঙ্গালী বলে মামি ডাঃ এম এন রায়ের কাছে কেবল একজন নিছক রোগী নন, তারচেয়েও অনেক বড় কিছু বাঙ্গালী-বাঙ্গালী এক আত্মীক সম্পর্ক

ডাঃ এম এন রায়ের সব ছিল ধনদৌলত, গাড়ি-বাড়ি, বিদ্যা-বুদ্ধি, চাকুরী-প্রতিষ্টা সব কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্থান সন্থানহীনতা দুঃখ দিলেও উচ্চশিক্ষিতা বৌদিকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার কলকাতা হতে ভ্রাতুষ্পুত্রকে দত্তক নেন। কিন্তু ছেলেটি আমেরিকার জীবন ব্যবস্থায় খাপ খাওয়াতে পারেনি। বড়লোক বাবার এই সন্থানটি দুইতিন বছর পর ফিরে যায় কলকাতায়। আর আসেনি আমেরিকায়।

ডাঃ রায় নিমন্ত্রন পেলেই আসতেন মামার বাসায়। আধুনিক এই মানুষটি গোমাংস হতে শুরু করে সবকিছু খেয়ে সাবাড় করতেন। বৌদি কখনো গোমাংস খেতেন না। স্বামী গোমাংসের আবদার জানালে বৌদি বলতেন, ওর কথায় তোমরা কান দেবেনা এসব ওর সামনে নিয়ে এসোনা- দেশে গিয়ে ওকে এজন্য প্রায়চিত্ত করতে হবে।

বুড়ো হয়ে বৌদি মারা যান প্রিয় পত্নীকে হারিয়ে ডাঃ এম এন রায় একদম একা হয়ে যান বৌদির মরদেহের ছাইয়ের কৌটা সযতনে এনে রাখেন বাসায় ডাঃ রায়ের সম্পদের অভাব ছিলনা বৌদির চিরবিদায়ের পর একজন আইরিশ মহিলা তার জীবন পার্টনার হন ডাঃ রায় আমেরিকায় প্রচুর উপার্জন করেন তার ছিল কয়েকটি দামী বাড়ি, গাড়ি ও প্রচুর সম্পদ বৃদ্ধ বয়সে তিনি শয্যাশায়ী হলে সম্পদের লোভে কিছুলোক তার সেবাযত্নে সচেষ্ট হয় তাদের উদ্দেশ্য মৃত্যুর আগে যদি কিছু ধনসম্পদ লিখে দেন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে কেউ তার সম্পদ লিখে না দিয়ে মারা গেলে রাষ্ট্র এই সম্পদের মালিক হয়ে যায় ডাক্তার মহাশয়ের অতি দরদি লোকেরা সাদা স্ট্যাম্পে তার দস্তখত নিতে তৎপর হয় কিন্তু ডাঃ রায় তার বিশাল সম্পদের কোন উইল না করেই একদিন মারা যান

ডাঃ রায়ের যুক্তরাষ্ট্রে কোন আত্মীয়স্বজন নেই তিনি নিউইয়র্কের বাঙ্গালীদের প্রানের চিকিৎসক। নিউইয়র্কে সেকালে তেমন হিন্দু লোকজন না থাকায় বাঙ্গালী মুসলমানরা ডাঃ রায়ের মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি নিয়ন্ত্রনে গ্যাসের আগুনে শবদাহ করা হয় শবদাহের সুইচে চাপ দিতে হিন্দু লোকজন খোজা হয় কিন্তু কোন হিন্দুলোক পাওয়া গেলনা কোন মন্ত্র পড়ে শেষকৃত্য করা হয়, কেউ জানেনা তাইহরে কৃষ্ণ, হরে রামবলে একজন বিয়ানীবাজারী মর্দে মুমিন সুইচে চাপ দেন কয়েক মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশীদের সুখ দুঃখের সাথী ডাঃ এম এন রায়ের মরদেহ ছাইয়ে পরিনত হয় এই ছাই একটি কৌটায় করে নিয়ে এসে তার শেষ জীবনের স্পাউস শ্বেতাঙ্গিনী আইরিশ মহিলার হাতে সবাই তুলে দেন

এবার প্রয়াত ডাঃ রায়ের সম্পদলোভীরা তার শ্বেতাঙ্গিনী পত্নীর সেবাযত্নে আত্মনিয়োগ করে তারা এই মহিলার শোক সরাতে তাকে দামী মদ পান করিয়ে মাতাল করে রাখে যদি এই শ্বেতাঙ্গিনীকে হাত করে ডাঃ রায়ের ফেলে যাওয়া সম্পদে কিছুটা ভাগ বসানো যায়

এমন সময় আয়ারল্যান্ড হতে এই শ্বেতাঙ্গিনীর দুই ব্যারিস্টার ভাইপো এসে হাজির হন ফুফুকে তারা নিয়ে যায় এবং ডাঃ এম এন রায়ের সব সম্পদ এই আইরিশ মহিলার মালিকানায় চলে যায় সারাজীবন নিউইয়র্কে ডাক্তারী করে মিঃ রায় প্রচুর সম্পদ জমান দারূন হিসেবী ডাঃ রায় তার সম্পদ জীবিতাবস্থায় কোন ভাল কাজে দান করে যাননি কোলকাতার কোন আত্মীয়ও এসব নিতে আসেনি নিঃসন্থান ডাঃ রায়ের বিশাল ধনসম্পদ শেষমেশ  বুড়ো বয়সের স্পাউস আইরিশ মহিলা ও তার দুই ভাইপোর অধিকারে চলে যায়। মেঝমামা বললেন, ভাগ্যবতী এই আইরিশ রমনী, একেই বলে ভাগ্যের লীলাখেলা। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন