যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- নয়
আমরা
হামিদের পিছু পিছু দৌড়ে হাফিয়ে উঠি। এবার হামিদ যেখানে গিয়ে থামল তা আব্রাহাম লিঙ্কন
মেমোরিয়াল। তিনি আমেরিকার ষোলতম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, আমেরিকা হতে অমানবিক
দাসপ্রথা উচ্ছেদকারী প্রেসিডেন্ট, গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্য
রক্ষাকারী প্রেসিডেন্ট, যিনি গেটিসবার্গ এড্রেসে গনতন্ত্রের শ্রেষ্ট সংজ্ঞাদাতা (Democracy is Government of the
people, by the people, for the people) প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। পৃথিবী হতে বর্বর দাসপ্রথা উচ্ছেদে তিনি আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন।
রাতের বিদ্যুতের
আলোয় আমরা বাগানঘেরা হোয়াইট হাউসের সামনে আসি। গাড়ি পার্ক করা বেশ কঠিন কাজ। দূরে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে হেঁটে আসি। ভিতরে ঢুকা যাবেনা। বাহির হতে দেখতে
হবে। গতকাল হোয়াইট হাউসে আসেন ক্যাথলিক ধর্মপ্রধান
ভেটিকানের পোপ বেনেডিক্ট। আজ এসেছেন চীনা
প্রেসিডেন্ট জি জিন পিং। কয়েকজন অনিন্দসুন্দরী
সুসজ্জিত এশিয়ান তরুনীকে চীনের বিচিত্র পোষাকে সজ্জিত হয়ে একটি নতুন পতাকা নিয়ে হোয়াইট
হাউসের সামনে এগিয়ে যেতে দেখি। মামি একটি মেয়েকে
পরিচয় জানতে চাইল জানালো তারা তিব্বতী মেয়ে, তিব্বতের পতাকা নিয়ে প্রেসিডেন্ট
জি জিন পিং এর সামনে তিব্বতে চীনের আগ্রাসনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছে। আমরা তাদের সাথে এগিয়ে যাই। হোয়াইট হাউসের সামনে গিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের বাধা পেয়ে থেমে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে হোয়াইট হাউস দেখে নেই। নয়-এগারোর আগে হোয়াইট হাউস চত্বরে ঢুকা যেত। এখন কড়াকড়ি থাকায় ভিতরে প্রবেশ সম্ভব হয়না। এইখানে যে কোন সাধারন মানুষ প্লেকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যে কোন ব্যাপারে
যে কোন ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে পারে, দাবী দাওয়া জানাতে পারে। এমন কি যুক্তিপূর্ন ভাষায় প্রেসিডন্টের যে কোন কাজের প্রতিবাদ
ও সমালোচনা করতে পারে। মার্কিন গনতন্ত্র
মানুষকে এই অধিকার দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে
অসংখ্য জাদুঘর রয়েছে। বিজ্ঞান জাদুঘর, মহাকাশ
জাদুঘর, ইমিগ্রেন্ট জাদুঘর, সমরাস্ত্র জাদুঘর
সতর্ক নজরে সংক্ষেপে দেখে নেই। এসব জাদুঘর
আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের এক একটা মহাসাগর।
রাতে মুর্শেদের
সৌজন্যে আমরা ও মামা-মামি একটি আফগান হোটেলে ডিনার করি। সুস্বাধু আফগান নানরুটি, কাবুলি মোঠাদানার বুট,
পোলাও, কবাব, সালাদ,
সস ও ডায়েট কোক। এত খাবার সামনে
এগিয়ে দেয় যার অর্ধেকও খাওয়া সম্ভব হয়নি। আমেরিকানরা
হাফ খায়,
হাফ ফেলে দেয়। ধনী দেশের মানুষের
এযেন এক নিষ্টুর অপচয়।
২৬ সেপ্টেম্বর
২০১৫ সাল,
শনিবার। আমেরিকায় নার্সিং
সম্মানজনক পেশা। শাম্মি যুক্তরাষ্ট্রে
নার্সিং পড়ছে। সে যে
হাসপাতালে জড়িত একদিন সেই ভার্জিনিয়া গবর্নমেন্ট হসপিটাল সে আমাদেরকে দেখাতে নিয়ে
যায়। তিনশত বেডের হাসপাতাল। ঢাকায় আমি এপোলো হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড
হাসপাতাল দেখেছি। ভার্জিনিয়া সরকারী হাসপাতাল এত উন্নত ও সুসজ্জিত যে আমাদের এসব
হাসপাতাল সে তুলনায় কিছুই না। ভার্জিনিয়া হাসপাতালে লোকজনের ভীড় নেই, রোগী দেখা
যায়না। সারাটা হাসপাতালে এক ধ্যানময় অরন্যের নিরবতা। হাসপাতালের বাগানের ফাঁকে
ফাঁকে পানির ফোয়ারা, আলোকসজ্জা ও সোফাসেট পাতা। হাসপাতালের পরিবেশ এতই মনোরম ও
পরিপাটি যে রোগী এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে।
আমেরিকায়
চিকিৎসক হওয়া সহজ নয়। কেবল অতি মেধাবীরাই ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পান। ডাক্তারদেরকে
অতি সাবধানে কাজ করতে হয়। প্রতি দশ বৎসর পর পর প্র্যাকটিস বহাল রাখার জন্য পরীক্ষা
দিতে হয়। পাশ না হলে চিকিৎসা করার অনুমতি বাতিল হয়ে যায়। তাই আমেরিকায় ডাক্তারদের
সারা জীবনই পড়তে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে
চিকিৎসকদের ভূল করার কোন সুযোগ নেই। রোগী মামলায় জিতে গেলে মিলিয়ন ডলার জরিমানা
গুনতে হয়। একটি ভূলের মাসুল জরিমানার খাতায় গিয়ে জীবনের সব উপার্জন শূন্য হয়ে যেতে
পারে। তাই এধরনের বিপদ হতে বাঁচতে এখানে ডাক্তাররা ইনস্যুরেন্স করেন যাতে বিপদ হলে
কোম্পানী রক্ষা করে।
ভার্জিনিয়া
একটি ছোট্ট স্টেট। আয়তন ৩৯,৫৯৮ বর্গমাইল। রাজধানী শহর রিচমন্ড, তবে এই স্টেটের
প্রধান শহর ভার্জিনিয়া বিচ। এই স্টেটের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন
ডিসির সীমান্ত রয়েছে এবং এই মহানগরের পশ্চাৎভূমি এই ভার্জিনিয়া স্টেইট। ভার্জিন
শব্দের অর্থ কুমারী। ইংল্যান্ডের চিরকুমারী রানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে এই স্টেইটের
নাম রাখা হয় ভার্জিনিয়া। এই মার্কিন স্টেটটি দি ওল্ড ডমিনিওন স্টেট নামেও পরিচিত।
আসলে সিলেটের মত ভূপ্রকৃতি বিশিষ্ট ভার্জিনিয়া স্টেট ইংল্যান্ডের কুমারী রানীর মতই
সুন্দরী। নামটি নিশ্চয়ই সার্থক বলা যায়।
ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ড এই দুই স্টেটের মাঝখানে ৬১ বর্গমাইল জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি অবস্থিত। এই এলাকার নিয়ন্ত্রন ফেডারেল গভর্নমেন্টের (কেন্দ্র সরকার) হাতে। এখানে সুপরিকল্পিতভাবে ফেডারেল গভর্নমেন্টের সব অফিস আদালত, জাদুঘর, স্থাপনা, স্মৃতিসৌধ, পার্ক ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন ডিসির জনসংখ্যা মাত্র পাচ লক্ষ পচিশ হাজার। ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত বিশাল জনতার সিংহভাগই কেন্দ্রশাসিত ডিসির বাহিরে ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড স্টেটে বসবাস করেন। তারা দিনে ওয়াশিংটনে অফিস ও ব্যবসা করেন, রাতে ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডে ঘুমান। তাই সারাটা ওয়াশিংটন ডিসি বড় বড় সড়ক, বাগান, পার্কিং, নদী ও জলাবেষ্টিত। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন