শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- আট

 



যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর
  পর্ব- আট

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, বৃহস্পতিবার আজ ঈদুল আজহার দিন আমরা ওয়াশিংটন ডিসির দারূল হিজরা মসজিদে ঈদ জামাতে নামাজ পড়ি। আমার বড় সম্মন্দি কবির ভাইয়ের ছোট মেয়ে শ্যামা গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে মসজিদে নিয়ে যায় সে লম্বা ফর্সা ও স্বাস্থ্যবান হিজাবপরা শ্যামাকে এরাবিক মেয়ে মনে হয় পাঁচ ছয় মাইল পথ পেরিয়ে আমরা মসজিদে আসি এখানে পার্কিং স্পেসের কোন অভাব নেই পাশের গীর্জা মুসলমানদের ঈদ জামাতের জন্য তাদের পার্কিং স্পেস সৌজন্যস্বরূপ ছেড়ে দিয়েছে আমেরিকায় বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্ক বিদ্যমান দেখে আমার বেশ ভালই লাগে আরবীদের পরিচালিত এই মসজিদে নামাজ পড়ে আমরা আবার মক্কা-মদীনায় নামাজ পড়ার অনুভূতি পেলাম কালো, সাদা ও মিশ্র বর্নের নানা জাতির উম্মতে মোহাম্মদীর সাথে ঈদ জামাতের পর এখানে কুলাকুলি করে বাপ-পুতে বিশ্ব ভাতৃত্বের স্বাদ গ্রহন করি

বড়ভাবী জেসমিন চৌধুরী সাল্লার শ্রীয়াইয়ের জমিদার কন্যে। তিনি বর্তমান র‍্যাব-প্রধান চৌধুরী আব্রদুল্লাহ আল মামুনের চাচাতো বোন। ভাবী একজন রন্ধন বিশারদ। দেশে রন্ধন শিল্প নিয়ে তিনি বেশ তৎপর ছিলেন। সবার কাছে তার রান্নার বেশ সুনাম ছিল। তিনি ও ভাতিজিরা রাত জেগে তৈরী করেন সন্দেশ, পিঠা, চটপটি, খেজুরী ইত্যাদি বাঙ্গালী খাবার। বাসায় ফিরে বেশ সাধনায় তৈরি সব খাবারই একটু একটু করে চেখে নেই। ডায়েট সেমাই ছিল দারূন মজাদার।

মুয়িদ চৌধুরী বড়ভাবীর ফুফুতো ভাই রাতে তার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রন পাই তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন তবে তার বেগম সাহেবা সায়েদা মেহের চৌধুরী মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসে চাকুরী করেন তাদের বাড়ি মৌলিভীবাজারের চাউতলি এলাকায় তার খুব সুন্দর বিলাসবহুল ত্রিতল বাসা পাশে অনুরূপ আর দুইটি বাসা ভাড়া দেওয়া আছে এই দম্পতির সুদর্শনা দুইকন্যা ফ্লোরা ও তানিয়া দুই বোনই উচ্চশিক্ষিতা এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে ভাল জবে আছেন। মুয়িদ ভাইয়ের বাসায় ভাটিপাড়া, হাজিপুর, ঘিলাছড়া ও চাউতলীর চৌধুরীবংশের অনেকের সাথে দেখা হয়, যারা আমাদের দুরসম্পর্কীয় আত্মীয়। বড় বড় গামলায় সাজিয়ে রাখা খাবার আর খাবার। আমার সামান্য ডায়বেটিস। কতইবা আর খাওয়া যায়।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, শুক্রবার। ভোরে নাস্তা সেরে Tyrol Hill Park আসি পার্ক হতে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নেচার সেন্টারে প্রবেশ করি এই পাহাড়ি এলাকায় সারি সারি পাইন, মেপল, উইলো, অক বৃক্ষের ঘন বন নেচার সেন্টারের নিম্নভূমি বরাবর একটি পরিস্কার পানির ঝর্না বহমান ঝরনার ওপারে পাহাড়ের ধাপে কেটে সুন্দর রাস্থা নানাজাতের বুনো ফল ফুল লতা গ্লুগ্ন রাস্থার ঢালু বেয়ে নিচের ঝরনা পর্যন্ত নেমে বাতাসে দোল খাচ্ছে। এখানে সুরম্য জলাভূমিতে ফোটে আছে শাপলা, পেনা ও জলজ ফুল বনের ফাঁকে ফাঁকে বসে আছে লাল, নীল ও খয়েরি রঙের বাহারী পাখি জলাভূমিতে সাতার কাটছে বুনো পাখি ও হাঁস জলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা পায়ের বক

পাহাড়ি এই সুন্দর নিরব সড়কে জগিং ও সাইক্লিং করছেন কিশোর কিশোরী হতে শুরু করে নব্বই বয়সী বুড়োবুড়িরা যথেষ্ট ঠান্ডা থাকা সত্বেয় সবার গায়ে হাফপ্যান্ট ও গ্যাঞ্জি, পিঠে ঝুলছে পানির বোতল শিশুদেরে সিটারে বসিয়ে কেউবা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকের সাথে আছে তাদের প্রিয় কুকুর

নেচারপার্কের অরন্যে আছে বনভোজন স্থাপনা, এমনকি রেস্টরোমও রয়েছে লোকেরা ছড়ায় বল ছুড়ছে, তাদের কুকুর জলে ঝাঁপ দিয়ে বল নিয়ে আসছে এভাবেই তারা কুকুরের গোসল ও ব্যায়াম সম্পাদন করছে নেচারপার্কে আমি ও জেফার অনেক হাঁটি ও দৌড়ি একদিন এই পার্কে হেঁটে আমার বেগম সাহেবা বেশ ক্লান্ত হয়ে যান বাসায় ফিরতে তার বেশ কষ্ট হয় আমেরিকার এই নেচারপার্ক এত বড় যে এটি সিলেটি শহরের অর্ধেক হয়ে যাবে এই গভীর জঙ্গল হতে বের হবার প্রতিটি রাস্থার মুখে এক একটি সুন্দর শিশুপার্ক ও খেলার মাট রয়েছে শিশুপার্কগুলোতে পুতুলের মত তুলতুলে সুন্দর শিশুরা প্রশান্ত মনে দুলছে, খেলছে এই বিদেশী শিশুরা কারো কোল চড়েনা, কান্নাকাটি করেনা তারা শান্ত ও সুবোধ মানুষ শিশুদেরে কখনো স্পর্শ করেনা হাত নেড়ে কেবল ইশারায় স্নেহ জানায় সাদা শিশুদেরকে দেখে মনে হয় তারা মোমের তৈরী ও চোখ মার্বেল পাতরে বাঁধানো। কালো বাচ্চারাও সুন্দর, তাদের কুকড়ানো বিছাকার কালো চুল যেন কেউ যতনে সাজিয়ে দিয়েছে।



আমার মেজমামা ফজলুর রহমান চৌধুরীর তিনজন পুত্ররত্ন মুর্শেদ, ফরহাদ ও জায়েদ। কেবল মুর্শেদের জন্ম বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে। শিশু বয়সে সে আমেরিকা চলে যায়, তাই বাংলাদেশের কোন স্মৃতি তার নেই। তার শিক্ষা ও বেড়ে উঠা নিউইয়র্কে। মাস্টার্স করে যুক্তরাষ্ট্রে সে বড় চাকুরী করছে। ভার্জিনিয়ায় মুর্শেদের খুব হাইফাই বাগান বাড়ি আছে। সে এডভান্স মডেলের দামী গাড়ি চালায়। মুর্শেদের দামী সাদা জিপ নিয়ে আমরা সারাটা ওয়াশিংটন শহর ঘুরে বেড়াই। তখন ২০১৫ সাল কিন্তু গাড়িটির মডেল ছিল ২০১৬ সাল। আমাদের সাথে ছিল মুর্শেদের তের বছরের একমাত্র পুত্র হামিদ। হামিদ আমার মেঝমামার তিনছেলের একমাত্র পুত্র সন্থান। ডালিমের মত উজ্জল গাত্রবর্নের  হামিদ খুবই সুদর্শন। এত সুন্দর বালক আমেরিকায়ও বিরল। মামা-মামির একমাত্র নাতী হিসাবে এই পরিবারের সবার প্রিয়পাত্র সে। হামিদের আম্মা রাবিয়া খানম একজন পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের কন্যা। মুর্শেদের দুই মিষ্টিকন্যা মরিয়ম, আয়শা, হামিদ এবং আমরা মুর্শেদের পাজেরো কিংবা নিশান পেট্রোলের মত দামী জীপটিতে উঠি। মুর্শেদ চালক, আমি সামনের বাম সিটে তার পাশে বসি। সিট গরম হয়ে শীত তাড়ায়। সিটে কম্পন হয় ও সিট কোমর ম্যাসাজ করে দেয়। জিপিএস (Global positioning system) গাড়ির পথ নির্দেশ করে দেয়।

আমরা পটোমাক নদীর উপর নির্মিত একটি দীর্ঘ্য সেতু পার হয়ে রাস্থার বামদিকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদরদপ্তর পেন্টাগন দর্শন করি ছবিতে দেখা সেই পেন্টাগন যা পঞ্চভূজাকৃতির বিশাল স্থাপনা চারপাশে ঘিরে আছে নিরাপত্তা প্রাঙ্গন কিছুক্ষন পরই আমাদের জিপ এসে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের সামনে পার্কিং করে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতিসৌধ মুসলিম বিজয়স্মরনী দিল্লীর কুতুবমিনার বৃত্তাকার হলেও ওয়াশিংটন মনুমেন্ট একটি বর্গাকার আকাশছোঁয়া মিনার। হয়ত কুতুবমিনার দেখেই আমেরিকানরা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট নির্মানে অনুপ্রানিত হয়। এই মনুমেন্টের চারপাশে বিশাল চত্বর। স্মৃতিমিনারটি এতই উচু যে এই চত্বরে স্থাপিত মার্বেল পাতরের বেঞ্চে শুয়ে আকাশে তাকালে মনুমেন্টের চুড়া দেখা যায়।

ওয়াশিংটন মনুমেন্টের চারপাশে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। এই মনুমেন্ট চত্বর হতে হেঁটে হেঁটে আমরা সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ার মেমোরিয়ালে যাই। হামিদ পিঠে পানির পট নিয়ে সামনে দৌড়াতে থাকে। আমরা তাকে অনুসরন করি। সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ার মেমোরিয়ালে আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের ধারাবাহিক পতাকা ও নাম খুদিত রয়েছে। আরেক হাঁটায় আমরা পৌঁছে যাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন মেমোরিয়ালে। এই মেমোরিয়াল প্রাঙ্গনের সামনে একটি স্বচ্ছজলের লেক। সিড়ি বেয়ে অনেক নিচে নেমে লেকপার। জেফারসন মেমোরিয়াল একটি বড় ভবনের মত স্থাপনা। এই স্থাপনার মাঝখানে একটি স্টেজে প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের বিশাল কালো ব্রুঞ্চের মূর্তি। এখানে এই মূর্তির সামনে আমরা অনেক ছবি উঠাই। ভবনের ওয়ালে ওয়ালে জেফারসনের বেশ কিছু বানী উৎকীর্ন রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ছিলেন একজন আইনজ্ঞ। ইংলিশ হরফে লেখা তার বানী পড়ে মনে হল তিনি একজন একেশ্বরবাদী ধার্মিক লোক ছিলেন। (চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন