শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- সাত

 


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর
  পর্ব- সাত

আমেরিকা এসে সফিক মামু এই প্রথম দেখলেন বাসার পাইপ লাইন দিয়ে কেবল ঠাণ্ডা নয়, গরম পানিও বেরিয়ে আসে আমেরিকায় আদিযুগে আসা বাঙ্গালী হিসাবে মামার একটি কাজ ছিল দেশ হতে আমেরিকায় আসা বৈধ ও অবৈধ বাংলাদেশীদেরে আমেরিকায় লাইন ধরিয়ে দেওয়া একবার একজন সদ্য দেশাগতকে বাসার গেস্টরুমে ঘুমাতে দেন শীতের রাতে হিটারের পট পট শব্দে তার ঘুম হয়নি রাতে হিটার হতে গরম বেরুতে দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান ঘরে আগুন লেগে যাবে ভেবে ভদ্রলোক শেষরাতে দরজা ঠুকে মামার ঘুম ভাঙ্গান আসলে শীতপ্রধান দেশের হিটার সম্পর্কে এই ভদ্রলোকের আদৌ কোন ধারনাই ছিলনা

এবার মামা-মামির কাছে আমেরিকায় একটি মসজিদ নির্মানের কাহিনী শুনি আমেরিকায় মুসলমানরা বলা যায় নবাগত সব জাতি ধর্মের লোকজন আমেরিকায় আসার পর মুসলমানদের শুভাগমন ঘটে উপাসনার জন্য নবাগত মুসলমানদের মসজিদ চাই একবার কয়েকজন অভিবাসী মুসলিম সবাই মিলে একটা মসজিদ নির্মানের সিন্ধান্ত নেন একটা জায়গা সবার পছন্দ হয় জায়গার মালিক একজন শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান, নাম জন মসজিদের জন্য পছন্দের এই জায়গাটা কিনতে সবাই জনের বাসায় যান কিন্তু জন তাদেরকে কোন পাত্তাই দেন নি দরজা হতে বিদায় করে দেন মুমিনের দল হাল ছাড়লেন না, তারা নানা উপহার নিয়ে বৃদ্ধ জনের বাসায় বারবার ধর্না দেন জন মনে মনে ভাবেন, কোন পাত্তা না দেয়া সত্বেও এই লোকেরা নত হয়ে বার বার আসছে ও জায়গাটা তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করছে মুমিনদের ব্যবহারে বিমুগ্ধ জন এবার বললেন, আমার পৈত্রিক জায়গা তোমাদের মসজিদ নির্মানের জন্য আমি দিতে পারি, তবে কোন মূল্য গ্রহন করবনা কারন তোমরা কোন ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আমার কাছে এসো নাই এসেছো তোমাদের সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিস্টান মসজিদ বানাতে

শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান জনের দানের জায়গায় একদিন মসজিদ প্রতিষ্টিত হলো এক জুমুয়ার জামাতে মসজিদের ভূমিদাতা জনকে মসজিদে আসার আমন্ত্রন করা হল মুসল্লিরা ভুমিদানের জন্য জনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান মুসল্লীদের অমায়িক ব্যবহারে জন অভিভূত হন জন প্রতি শুক্রবারে মসজিদে আসেন এবং ঈমাম সাহেবের খুতবা শুনেন কিছুদিন পর জন ঈমামকে বললেন, আমি ইসলাম গ্রহন করব জনের ইসলাম গ্রহনের জন্য এক শুক্রবার ধার্য্য করা হল মুসল্লিরা সকলেই জনের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসেন জন ইসলাম গ্রহন করলেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এক শুক্রবারে মারা গেলেন সেই শুক্রবারে জনের মসজিদে মুসল্লিরা তার জানাজায় শরিক হন

জনের জানাজা শেষ, গল্পও শেষ এবার ভার্জিনিয়ার একটি মসজিদের বর্ননা দেবো এই মসজিদটি মেঝমামার এই বাসার সন্নিকটে এবং মসজিদের আকর্ষনে মামা-মামি এই আবাসনে বাসা নেন এই মসজিদের নাম আদমের মসজিদ (Adam’s Mosque) অতি উচ্চশিক্ষিতরা এই মসজিদ ব্যবস্থাপনা করেন এই মসজিদের পরিচালনা কমিটিতে সাতজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী মহিলা রয়েছেন সিলেটের ফুলবাড়ির একজন উচ্চশিক্ষিত প্রকৌশলী এই মসজিদ কমিটির সদস্য

আদমের মসজিদ বিশাল এলাকা জুড়ে একটি বহুতল কমপ্লেক্স দুতলায় দুইটি বড় হল একদিকের সিড়ি পুরুষরা পুরুষ-হলে ও অন্য সিড়ি দিয়ে হিজাবপরা নারীরা নারী-হলে গিয়ে জামাতে শরিক হন এই মসজিদে নামাজ পড়ে আন্দাজ করি পুরুষ-কক্ষের তুলনায় নারী-কক্ষে মুসল্লির সংখ্যা অনেক বেশি আসলে শিশুরা মায়েদের সাথে এসে মহিলা-কক্ষে মুসল্লিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় ঈমাম মাথায় কোন টুপি ছাড়াই নামাজ পড়ান জুমুয়ার জামাতে ওয়াজ ও খুতবা পাঠকারী একজন স্যুট-কোট-টাই পরা স্মার্ট লোক তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই, তিনি একজন ধর্মীয় হুজুর খুতবার ভাষা ইংরেজী, তবে আরবীর প্রচুর মিশ্রন রয়েছে মসজিদের বহিরাঙ্গনে বিশাল কালো পিচ ডাকা মাট মাটে সাদা তুলিতে টানা গাড়ি পার্কিং মানচিত্র এই বড় মাটে সাত শত গাড়ি পার্কিং ও আগমন- নির্গমন ব্যবস্থা রয়েছে ভার্জিনিয়া ধনী এলাকা এখানে যত মুসল্লী, ততো গাড়ি শুক্রবারে এই বিশাল পার্কিং অপ্রতুল হয়ে যায় তাই আমরা গাড়ি ছাড়া বাসা হতে পায়ে হেটে আদমের মসজিদে যাই

আমেরিকার মসজিদ ঠিক আমাদের মসজিদ নয়। আমেরিকার মসজিদ শুধু পুরুষের নয়, সমভাবে মহিলাদেরও জামাতে নামাজের স্থান। আমেরিকার মসজিদ সাদা-কালো-মিশ্র,  নর-নারী-শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতা মুসলমানদের ধর্মীয় এবং সামাজিক মিলনকেন্দ্র। আদম মসজিদের গ্রাউন্ড লেবেলে যে জায়গায় জুমুয়ার খুতবা হয়, তা একটি বাস্কেট বল খেলার মাট। জামাত শেষে কিশোরেরা এই মাটে বাস্কেট বল খেলেন। মসজিদে আছে উন্নত পাঠাগার, চেয়ার টেবিল সজ্জিত বৈঠকখানা ও পাঠকক্ষ, মুসল্লিদের মেলাঘর। নারী মুসল্লিরা মেলাঘরে নিজেদের হাতে তৈরি নানা পদের খাবার নিয়ে আসেন। সবাই মিলে খান। যুক্তরাষ্ট্র এমন এক দেশ যেখানে খাবারের প্রাচুর্য্য, এখানে কার খাবার কে খায়? তারপরও এই খাদ্য সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করে দেয়।

প্রতি ঈদে মসজিদ চত্বরে ঈদমেলা বসে। শিশুদের জন্য নানা প্রকার খেলাধুলা, হৈ চৈ, আনন্দ উল্লাসের ব্যবস্থা থাকে।

মেঝমামা বললেন, মুসলিম উম্মার অর্ধেক মানুষ মহিলা, অথচ আমাদের দেশে এই অর্ধেক মানুষকে ধর্মগুরুরা মসজিদের মত পবিত্র ও পূন্যময় জায়গা হতে বঞ্চিত করে রাখেন

সে রাতে ৩০/৩৫ মিনিট কার চালিয়ে মামা-মামি আমার বড় সমনদিক কবির আহমদ চৌধুরীর বাসায় আমাদেরকে পৌঁছে দেন।

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, বুধবার। কবির চৌধুরীর বাসা ভার্জিনিয়ার ওয়েলিংটন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। আবহাওয়া আমাদের দেশের শীতকালের মত ঠান্ডা। বড়ভাই আমাদেরকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমনে বের হন। বড় বড় রাস্থা এবং রাস্থার দুপাশে নানান জাতের ফুলের মেলা। ঠান্ডায় হাঁটতে বেশ ভালই লাগে। টিলার উপর একটি সুন্দর পার্কে এলাম। পার্কটির নাম টাইরল হিল পার্ক। সমতল টিলা প্রান্তরের একদিকে শিশুপার্ক ও অন্যদিকে বড় খেলার মাট। প্রান্তরের চারপাশ আবর্তন করে আছে হাঁটা-দৌড়ার পিচ ঢাকা মসৃন রাস্থা। ঐ ডিম্বাকার রাস্থায় আমি জগিং করি। এই পার্কের পাশ দিয়ে একটি সড়ক গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ছোট্ট সাইনবোর্ড লিখা Nature Park. ঐদিন এই নেচার পার্কে গেলাম না ফিরে এলাম বাসায়

সকাল ১১ ঘটিকায় ভাতিজী ইমা ও তার হাজব্যান্ড জাহিদ আমাদেরকে আমেরিকান সিভিল ওয়ার মিউজিয়ামে নিয়ে যায় এই জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা আছে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের অজস্র স্মারক জাদুঘর তত্ত্ববধায়ক আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে আমার সাথে বেশ আলোচনা করেন এই জাদুঘর একটি বড় পার্কের মধ্যে অবস্থিত প্রাঙ্গণে লিখা- Fort Museum Park and Historic Site.  পার্কের বহিঃ প্রাঙ্গণে আমেরিকার সিভিল ওয়ারে ব্যবহৃত কামান ও যুদ্ধাস্ত্র ঘুরে দেখি পার্কের একটি গাছ তলায় প্রচুর পাকা পিচফল পড়ে আছে কিছু পিচ কুড়িয়ে বাসায় এনে ধুয়ে খাই ফলগুলো খুব সুমিষ্ট আমেরিকার লোকজন গাছের নিচের ফল কুড়িয়ে খায়না ওসব কাটবিড়ালী ও পাখিরা খায় (চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন