চিত্রঃ ওয়াশিংটন ডিসিতে মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরীর বাসায় আম্মা ও বড়খালার পরিবারের সব সদস্যের স্মৃতি বিজড়িত অনেক পুরানো ছবির ভান্ডার পেয়ে যাই।
যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- সতের১৪ অক্টোবর
২০১৫ সাল, বুধবার। আজ এই সুন্দর নিরব শহর কলম্বিয়াকে বিদায় জানাতে হবে। বিউটি ভাবী
আমাদেরকে ড্রাইভ করে কলম্বিয়ার মেট্রো ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট (Metro Domestic
Airport) নিয়ে যান। US Airline এর বিমান ছাড়ে সকাল ১০ টায় এবং ওয়াশংটন ডিসির Rosevelt Domestic
Airport এসে পৌঁছে দুপুর ১ টায়। পরবর্তী যাত্রায় ৭২ জন যাত্রি নিয়ে বিমানটি নিউইয়র্ক লেগোডিয়ার
ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট অবতরন করে বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দর দুই ধরনের, আন্তর্জাতিক
ও ডমেস্টিক। ডমেস্টিক এয়ারপোর্টে
কেবল যুক্তরাষ্ট্রির ভিতরের ৫০টি রাজ্য ও কয়েকটি টেরিটোরির বিমান চলাচল করে। লেগোডিয়ার বিমানবন্দরে আমাদেরকে নিতে এসেছেন বাড়মামা আব্দুর রহমান
চৌধুরী ও তার মেয়ে রিপা চৌধুরী। এই বিমানবন্দরের
কাছেই তাদের বাসা। মাত্র ১৫/২০ মিনিটে
বাসায় পৌঁছে যাই। Colombia to Wasington DC to
Newyork প্লেন ভাড়া দেই ৯০*৩= ২৭০ ডলার।
আমরা বাসায়
ফিরলাম,
আর সেইরাত ৮টায় মামা ও মামি দুইমাসের জন্য লন্ডন চলে যান। তাদের দুই সন্থান আফজল ও নিপা লন্ডনে বসবাস করেন। এই রাতে আমাদেরকে নিতে আসেন সেলিম চৌধুরী। তিনি ডাঃ নুরজাহানের খালাতো বোন রেবু আপার মেয়ে দীপার স্বামী। তিনি গাড়ি চালিয়ে ম্যানহাটনে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান।
১৫ অক্টোবর
ঘুম হতে জেগে দীপার ভবনের জিমখানায় যাই। এই জিমখানা
এই ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ব্যবহার করেন। প্রতি ফ্ল্যাটে একটি করে জিমখানার চাবী রয়েছে। দারূন মজাদার ৬/৭ পদের ব্যায়াম করি। যন্ত্রগুলো নিজের ইচ্ছেমত হার্ড-সফট
করা যায়। ব্যায়াম মেশিনে
হাঁটা,
দৌড়া, সাইকেল চালানো, নৌকা
বাওয়া, রোমান জাহাজে বৈঠা মারা, সর্বাঙ্গ
চালনা সব রয়েছে। খেলার মাঝে
সব ব্যায়াম। ব্যায়ামে বেশ
আনন্দ লাগে।
ভবনে রয়েছে
একটি উৎসব হল। এবার সেই উৎসব-হলে
যাই। এই হলের সামনে
একটি সবুজ ছাদবাগানে যাই। এই ভবনবাসীর
ব্যবহারের জন্য নিচে কাপড় ধূয়া ও শুকানোর মেশিন রয়েছে। দীপার একমাত্র পুত্র ওয়াসিম চৌধুরী খুব শান্তশিষ্ট। সে হাইস্কুলের ছাত্র। একমাত্র কন্যা
মহিলা হোস্টেলে থেকে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে।
১৬ অক্টোবর
২০১৫ সাল,
শুক্রবার। রিপার বাসায়
ফিরে কুইন্সের বাংলাদেশী মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়ি। ঈমাম সাহেব একজন বাংলাদেশী। তিনি লেখাপড়া করেছেন মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজীতে খুব সুন্দর খুতবা দেন। ঈমামের কেরাত শুনতে সুমধুর।
১৭ অক্টোবর
২০১৫ সাল,
শনিবার। আমেরিকায়
একমাস একদিন ভ্রমনের শেষপ্রান্তে আমরা। মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী ও মামি কহিনুর চৌধুরী ওয়াশিংটন ডিসি হতে আমাদেরকে
বিদায় জানাতে নিউইয়র্ক এসেছেন। রিপার বাসার কাছেই বাংলাদেশী এলাকা জ্যাকসনহাইট। জ্যাকসনহাইট
ঘুরে ঘুরে মান্নান সুপার মার্কেট, বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসী, গাড়ি মেরামত
কারখানা ইত্যাদি দেখে নেই। অনেক দোকানের সাইনবোর্ড ইংরেজীর সাথে বাংলায় লিখা আছে।
এখানে অনেক বাংলাদেশী লোকজন অবাধে বিচরন করছেন। জ্যাকসনহাইট যেন নিউইয়র্কের মধ্যে
এক টুকরো বাংলাদেশ। ঐ দিন মেঝমামা তার প্রবাস জীবনের স্মৃতিবিজড়িত হার্ডসন নদীপারে
এস্টোরিয়া পার্কে নিয়ে যান। এখানে তার দীর্ঘ্যজীবন কাটানোর বাসায় যাই। বিয়ানীবাজারী একটি পরিবার এখানে ভাড়াটিয়া আছেন।
দারূন শীতের রাতে হার্ডসন নদীর পারে পারে ঝলমল করছে আলোর বন্যায় ভাসা আকাশ ছোঁয়া
অজস্র বর্নিল কাচের ভবনমালা।
১৮ অক্টোবর
২০১৫ সাল,
রবিবার। রিপা ও মেঝমামার
দু’টি কারে চড়ে আমরা জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি। বড় ছয়টি ব্যাগেজের সাথে হাতের তিনটি ছোট ব্যাগও ইতিহাদ এয়ারফ্লাইটের
ক্যারিয়ারে পাঠিয়ে দেই। যথা সময়ে ইতিহাদের
ফ্লাইট শুরু হয়। অবুধাবী এয়ারপোর্টে
নেমে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেক বিমানে চড়ে সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরন
করি। ধানমন্ডিতে রাত্রিযাপন করে পরদিন একটি
ভাড়াকরা মাইক্রোবাসে সিলেট আসি। সেদিন পাঁচ
সাপ্তাহের এক আনন্দভরা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
জীবনের প্রথম
এই যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা আমার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার হলেও আমার গিন্নীর জন্য তা
ছিল খুব চিন্তার বিষয়। চারপাচ বছর আগে একবার তার শরীরে কঠিন রোগ ধরা পড়লে তিনি খুব
মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে অপারেশন করে একই দিনে ফাইব্রয়েড ও
পিত্তপাতর অপসারন করে তিনি এই দুশ্চিন্তা হতে রেহাই পান। তারপর ধীরে ধীরে সেই
মানসিক অস্থিরতা হতে মুক্ত হয়ে সুখ ও প্রশান্তির জীবনে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্র
সফরের প্রস্তুতি নিতেই সেই মানসিক অস্থিরতা তাকে আবার চেপে ধরে। মিরেরময়দান নতুন
চেম্বারে প্রচুর রোগী দেখেন। জেফার এইচ এস সি প্রথমবর্ষে পড়ছে। এমনই এক সময়ে
মাইগ্রেশন ভিসায় যুক্তরাষ্ট্র গমন ডাক্তারী প্র্যাকটিস, ডায়াগনেষ্টিকের কাজ, আমার
চাকুরী ও একমাত্র পুত্রের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী এক মহা
দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তিনি বলতেন এত কষ্ট করে, এত পরিশ্রম করে, দেশে এতকিছু করলাম
এখন বিদেশে গিয়ে আবার শূন্য হতে যাত্রা শুরু করব, তাও আবার পড়ন্ত বয়সে। তার ধারনা
ছিল আমি আমেরিকা গেলে আর ফিরবনা। তাদেরকেও ভূলিয়ে ভালিয়ে আমেরিকায় রেখে দেবো। তাই
তিনি ভাবতেন দেশের এত কষ্ট ও সাধনায় গড়া সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। সেইসাথে মধ্য বয়সের
পর বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জন সবাইকে ফেলে আরেক পরবাসী জীবনযুদ্ধে নামার
বিড়ম্বনাও কম নয়।
ছোটবেলা
হতে বিশ্ব ঘুরে দেখার আমার একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরনে একধাপ এগিয়ে যাওয়ায়
সামান্য দুচিন্তা আমার মনে আছর করলেও সে তুলনায় আনন্দটা ছিল অনেক বেশী। আমার
চাকুরীটা তখনও পচে যায়নি, অতীতের সবগুলো পদোন্নতি ছিল নিয়মিত। তাই আমি নিশ্চিত
ছিলাম চাকুরিতে ফিরে আসব। এবার অন্ততঃ আমেরিকা পর্যবেক্ষন করে পরে চাকুরী ও
প্র্যাকটিস ছাড়া কিংবা রাখার সিদ্ধান্ত নেবো। ডাঃ নুরজাহানকে সান্তনা দেই মনে কর
আমরা স্রেফ একটি বিদেশ সফরে যাচ্ছি, বিশ্বের শ্রেষ্ট এই দেশটিকে পরখ করে মাসখানেক
পরই ফিরে আসব। তিনি তার চেম্বারে আমার ভাগ্নাবউ ডাঃ রেবেকা সুলতানা রিপাকে বসালেন।
তাকে হিস্টারোপ্যাথলজী শিখায়ে বিভিন্ন প্যাথল্যাবে এইসব কাজও দিয়ে যান।
আমি সাধারন ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাই ও ছুটি শেষ হবার আগেই এসে চৌধুরীবাজার শাখায় যোগদান করি। ফিরে এসে কাজে যোগ দিলে ডাঃ নুরজাহান চৌধুরীর মানসিক অস্থিরতা কিছুদিনের মধ্যে দূর হয়। তবে একটি দুশ্চিন্তা রয়ে গেল। জেফার ২০১৬ সালে এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে। তার পরীক্ষার আগেই যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। এইচ এস সি জীবনের ভিত্তি স্থাপনকারী একটি কঠিন পরীক্ষা, সেখানে দুইবর্ষে সে প্রায় আড়াইমাস বাংলাদেশে নেই। তাহলে কেমন হবে তার এই পরীক্ষার ফলাফল? (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন