শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর পর্ব- আটার

 


যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম যাত্রা- নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা সফর  পর্ব- আটার

এবার আমার সচক্ষে দেখা আমেরিকার সমাজব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে আলোচনা করবো। আমেরিকা হল অবাধ স্বাধীনতার দেশ, অন্যভাবে বলা যায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের দেশ। এখানে আগে ব্যক্তি, তারপর রাষ্ট্র। পরিবার হল রাষ্ট্র ও ব্যক্তির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্টান। আমাদের দেশে সন্থানের উপর মাবাবার শাসন থাকে তাদের মৃত্যুর আগ মূহূর্ত পর্যন্ত কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বয়স আটারো পার হলে ব্যক্তির উপর পরিবার বা মাবাবার আর কোন কতৃত্ব চলে না। ব্যক্তি মাবাবার পরিবার হতে বের হয়ে জোড় বেঁধে নতুন বাসা বাধে। বয়স আটারোর আগেও ব্যাক্তির উপর পরিবারের শাসন আমাদের মত এত শক্ত নয়, বলা যায় অনেক শিথিল।  

আমেরিকাবাসী মনে করেনা যুক্তরাষ্ট্র ঐশ্বরিক প্রতিষ্টান। মানুষের ঐক্য ও চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র মানবসৃষ্ট সাম্রাজ্য। দেশটির সংবিধান তৈরী করেছে মানুষ। এই সংবিধান মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রয়োগের ফসল। মানুষের চিন্তাভাবনায় তৈরী বুদ্ধিদীপ্ত আইন কানুনের মাধ্যমেই এই দেশটি পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীন ও সার্বভৌম। রাজ্যে রাজ্যে বিরোধ, জটিল রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীন বিচার বিভাগের রায়ই চুড়ান্ত সমাধান হিসাবে বিবেচিত হয়।

আমাদের দেশে পুলিশ ও বিচার বিভাগকে প্রভাবশালী দুষ্টলোকেরা ছলে বলে কৌশলে নিজস্বার্থে ব্যবহার করে। গরীব ও অসহায় মানুষ এসব প্রতিষ্টানে যেতে ভয় পায়। কিন্তু আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা মজলুমের অনুকূলে। গরীব লোকের মামালা খরচ সরকার বহন করে। শিশু ও নারীরা প্রকৃতিগতভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল, তাই এখানকার আইন শিশু ও নারীকে আলাদাভাবে সুরক্ষা দেয়। আমেরিকায় শাসনের নামে শিশুদেরকে কোন ধরনের কষ্ট দেয়া ও নির্যাতন করা নিষিদ্ধ। এমন কি পিতামাতা কিংবা শিক্ষক শিশুদের গায়ে হাত উঠালে কিংবা গালাগালী করলে বিপদ আছে। নিদৃষ্ট ফোন নম্বারে শিশুরা ফোন করলে মাবাবাকে জেলে যেতে হবে। এমন কি বাচ্চাকে কেড়ে সরকারের তত্বাবধায়নে নিয়ে যেতে পারে। এবং নারীরা ফোনে অভিযোগ করলে মধ্যরাতে পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে পুরুষ সঙ্গী কিংবা স্বামীকে পাকড়াও করে নিয়ে যায়। বিউটি ভাবী আরমো স্কুলের টিচার। একবার ক্লাসে একটি বালক বারবার হৈ চৈ করলে তাকে বললেন, তোমার জন্য অন্যদের ডিস্টার্ব হচ্ছে। তুমি ইচ্ছে হলে বেরিয়ে যেতে পারো। বালকটি তার অভিভাবকদের কাছে বিষয়টি জানালে তারা অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করে। অধ্যক্ষ স্কুলটিচার ভাবীকে ডেকে নিয়ে যা থ্রেড দিলেন তা হলো- শিশুরা মানসিক আঘাত পাবে এমন কিছু ক্লাসে বলা বা করা যাবেনা।

চিত্রঃ বিউটি ভাবি (বামে) আমার সম্মন্দি জামিল চৌধুরীর পত্নী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজতত্বে অনার্স সহ মাস্টার্স। বর্তমানে কলম্বিয়ায় আরমো স্কুলের টিচার।

সাদা পুলিশের বিরুদ্ধে কালোদের প্রতি বিরুপ আচরনের অভিযোগ প্রায়ই শুনা গেলেও আমেরিকার পুলিশকে আমার বেশ সাহায্য প্রবনই মনে হয়েছে। আমেরিকার কালোরা দরিদ্র জনগোষ্টি এবং শিক্ষা দীক্ষা কম হওয়ায় তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবনতা একটু বেশী। একসময় কালোরা ছিল দাস ও সাদারা প্রভূ। আজ সবাই স্বাধীন হলেও সাদা ও কালোদের মধ্যে একটা মানসিক দূরত্ব রয়েই গেছে। কালোদের প্রতি সাদা পুলিশের কঠোর আচরন মাঝে মধ্যে আমেরিকার কোন কোন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক অচলাবস্থা ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

আমেরিকাবাসী মামলা ও পুলিশের টিকেট খাবার ভয়ে সব সময় ভীত সন্তস্ত্র থাকে। আমেরিকার বিচারালয়ে দ্রুত বিচার সম্পন্ন  ও সাজা কার্যকর হয় মামলা (Suit) লাগা ও টিকেট খাওয়ার ভয়ে মানুষ অপকর্ম হতে দূরে থাকে আমেরিকায় ন্যায়বিচার থাকার কারনে কেউ আইন নিজহাতে তুলে নেয়নাও গনপিঠুনির মত ঘটনা আদৌ ঘটেনা দুর্ঘটনা ঘটলে চালকরা পালিয়ে যায়না আমেরিকার আদালতে বাঘে মহিষে একঘাটে জলপান করে

এখন আমেরিকার জীবন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলবো আমেরিকায় মানুষের জীবনকাল তিন পর্বে বিভক্ত প্রথম পর্ব হল নন-এডাল্ট জীবন এজীবন পর্বের ব্যাপ্তি জন্ম থেকে আটারো বছর পর্যন্ত প্রসারিত মাবাবা শিশুদেরে সযতনে প্রতিপালন করে পরিবারের সাথে হেসে খেলে বাল্য কৌশর পার হয় দ্বিতীয় পর্ব হল এডাল্ট জীবন আটার বছর বয়স শেষ হলে এই পর্ব শুরু হয় তখন ছেলে মেয়েরা আর মাবাবার সাথে বসবাস করেনা তারা কলেজ হোস্টেল কিংবা সিঙ্গুল ফ্ল্যাটে চলে যায় আমেরিকানদের যৌনজীবন অবাধ ও স্বাধীন পারস্পারিক সম্মতিতে যে কোন নরনারী বিবাহ ছাড়াও একত্রে বসবাস করতে পারে এই সম্মতিপূর্ন একত্রবাস সমাজ অন্যায় কিছু মনে করেনা দুই জন নর ও নারীর বিবাহ বহির্ভূত এই একত্র বাসকে তারা বলে লিভ টুগেদার যে কোন নর নারী সঙ্গী নিয়ে একত্রে বসবাস করলে কেউ জানতে চাইবেনা তারা বিবাহিত কিনা বরং এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার জানার চেষ্টা করাটা অসভ্যতা কে কারে নিয়ে রাতে ঘুমায়, তারা বিবাহিত না অবিবাহিত, এসব বিষয় নিয়ে কোন মার্কিনীরা কখনও মাথা ঘামায় না

এপর্বে আমেরিকানরা যৌবনকালকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করে বয়স ত্রিশ হলে বিয়ে শাদি করে সন্থান গ্রহনে সচেষ্ট হয় অনেক দম্পতি তাদের সন্থানরা বড় হবার পর বিয়ে করেন এবং সেই বিয়ে অনুষ্টানে সন্থানরা শরিক হন। আমেরিকার মুসলিম জনগোষ্টি ছাড়া অন্যদের বিবাহ বহির্ভুত অবাধ যৌনাচারে কোন পাপবোধ নেই তবে এই যৌনাচার হতে হবে সম্পূর্ন স্বেচ্ছায় ও পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে

অবাধ যৌনাচার আমাদের ধর্মে গোনাহ ই কবিরা (গুরুতর পাপ) শাস্তি এক শত দুররা হতে পাতর ছুঁড়ে প্রাণদণ্ড অথচ ভিন্ন জাতির কাছে ইহা গোনাহে সগীরাও নয় আমেরিকা এমন একটি দেশ, যেখানে সমকামিতাও বৈধ আমেরিকার সমকামী গে পুরুষরা একে অন্যকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীর মত বসবাস করে সমকামী লেসবিয়ান নারীরা নিজেদের মধ্যে অনুরূপ দাম্পত্য জীবন পরিচালিনা করে থাকে এই অদ্ভুদ রীতিনীতির দেশটির ৯৬% মানুষ খৃস্টান ও বাকী ৪% মানুষ ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি তবে মুসলিম জনগোষ্টি ছাড়া ধর্ম-বিশ্বাসী লোকজন এখানে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে 

আমেরিকা জনসংখ্যায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ খৃস্টান দেশ। এখানকার ধর্মীয় জীবন এমন যে ধর্ম এখানে নিজ নিজ ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। তারা আমাদের মত ধর্ম নিয়ে এত মাথা ঘামায় না। ধর্মকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়না। অন্যের ডিস্টার্ব হবার ভয়ে গীর্জা ও মন্দিরে ঘন্টা বাজায় না। তারা মসজিদে উচ্চশব্দে আজান দেয়না। ধর্মকে মার্কিনিরা কেবল আধ্যাত্মিক ও পরলৌকিক বিষয় মনে করে। তারা জাগতিক কাজে, রাজনীতিতে, জ্ঞানচর্চায় ধর্মকে খুব একটা টেনে আনেনা। এখানে কালো, মিশ্র ও শ্বেতদের মধ্যে বর্ন নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হলেও ধর্ম নিয়ে তেমন কোন সাম্প্রদায়িকতা নেই। আমেরিকানরা মনে করে ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়, বিশ্বাসের জিনিস নিয়ে এত হৈ চৈ মারামারির কিবা প্রয়োজন।

আমেরিকার খৃস্টানদের মধ্যে অনেক সম্প্রদায় রয়েছে। যেমন ক্যাথলিক, প্রটেস্টেন্ট ইত্যাদি। ক্যাথলিকদের একটি সম্প্রদায় আমিশ পেন্সিলবানিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। তারা কোন পরিবর্তন বা আধুনিকতা গ্রহন করেনা। তারা যিশুর যুগকে সর্বোত্তম মনে করে। আমেরিকার মত অত্যাধুনিক দেশে বসবাস করেও তারা ইঞ্জিনের গাড়ি চড়েনা, যিশুর যুগের ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে। তাদের গ্রামের রাস্থা পাকা করে না, মেঠোপথ ব্যবহার করে। তাদের জনপদে বিদ্যুৎ নেই, নেই কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি। তাদের গ্রামগুলো যেন দুই হাজার বছর আগের যিশুর জন্মস্থান বেথেলহেমআমিশরা প্রতিপক্ষের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে নেদারল্যান্ড হতে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। তারা বিগত তিনচার শত বছর ধরে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আমেরিকায় টিকে আছে। এখানে যুগের পর যুগ তারা সম্পূর্ন প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন করে যাচ্ছে। (চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন