মঙ্গলবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২২

ফাটাবাঁশের বিষম চিপা

 

      কবি লেখক ব্লগার পর্যটক ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
ফাটাবাঁশের বিষম চিপা

মেঘনার ঢেউভেঙ্গে সাগর পেরিয়ে আমাদের স্পিডবোট একটি সুন্দর উপকূলে আসে। আমরা একে একে সবাই সেই সৈকতে নামি। একটি রাস্থা এসে এখানে সাগরপারে শেষ। রাস্থার দুপাশ পল্লবঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত। রাস্থার দুইদিক দিয়ে দুইটি খাল এসে সাগরে মিশেছে। হুররে, জায়গাটা ভারি সুন্দর, ভারি চমৎকার। 

রাস্থায় জনকয়েক পর্যটক হাঁটাহাঁটি করছে। তাঁরা বলল এই জায়গাটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের বেড়িবাঁধ। সুউচ্চ রাস্থা হতে স্পিডবোটে ফিরে আসছি সবাই। এমন শুভ সময়ে ঘটে গেল এক হরষে বিষাদ। উঁচু সড়ক হতে কর্দমাক্ত খাদ বেয়ে স্পিডবোটে নামার সময় আমাদের রসিক সাথী ফারুক আহমদ উঁচু স্থান হতে পা পিছলে  গোলাকার বলের মত কাদাজলে গড়িয়ে পড়লেন। 

তাকে এতই করুন দেখাল যে আপাদমস্তক পলিকাদায় লেপ্টে একেবারে কিম্ভুতকিমাকার। তাঁর চোখ-মুখ-নাক কিছুই কাদার প্রলেপ হতে রেহাই পায়নি। কাদামাখা ফারুক আহমদকে চেনাই দ্বায়। আহারে, স্যুটেড-বুটেড মানুষটা কি ছিল আর এখন কি বেহাল হল।

বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আচমকা আছাড় খাবার লজ্জায় গাত্রব্যথার আলামত তিনি সযতনে গোপন করলেও আমরা তাঁর ব্যথার কষ্ট মনে মনে বেশ অনুভব করি। সৈকতের কোমর জলে গোসল করলেন, নতুন জামা পরলেন। যাক এবার তাঁকে চেনা গেল, তিনি সেই বেঁটে কৃশকায় ভ্রমণসাথি ফারুক আহমদ। আমরা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলি। 

কাদামাখা ফারুক সাহেবের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে আমরা একরাশ দুঃখ পেলাম সত্য, তবে মনের গহিনে একটা লোকানো হাসিও অপ্রকাশ্যে উঁকিবুকি মারে।  

যাক, ফারুক সাহেব এই শনির দশা হতে বের হয়েই আনন্দবিহারের মাঝে হঠাৎ আপতিত গোমরাভাবটা তাড়াতে কসুর করলেন না। একটা রসালো গল্প বলে ভ্রমণানন্দ আবার জাগিয়ে দেন। মুছে দেন ব্যাদনার রেশ।

গল্পটা ফাটাবাঁশের চিপায় পড়া একজন অসহায় ইমাম সাহেবের। মৌলানা আব্দুল গফুর মোবারকপুরী ঢাকার অভিজাত এলাকার তাকওয়া মসজিদ কমিটির সামনে সুললিত কন্ঠে কেরাত তেলাওত করে ইন্টারভিউ দিয়ে বেশ কঠিন প্রতিযোগিতা পার হয়ে বড় বেতনে ইমামতির চাকুরী পান। শর্ত, প্রতি শুক্রবারে তাঁকে মসজিদে খুতবা পড়ায় আগে ওয়াজ করতে হবে। 

তাকওয়া মসজিদে নতুন ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী যোগদান করলেন। ইমাম হুজুরের কাছে খবর আসে এখানকার বড়লোকেরা খুব বেশি সূরাপায়ী। হুজুর ভাবলেন সুরাপান মহাপাপ। এই নাজায়েজ কাজ হতে মহল্লাবাসীকে উদ্ধার করা দরকার। শুক্রবারে ইমাম হুজুর খুতবায় বললেন, মদ্যপান হারাম, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে খুৎবায় দেখিয়ে দেন যারা মদ্যপান করে তাঁরা দোযখের আগুনে পুড়ে ছারখার হবে। 

ইমাম সাহেব নজির পেশ করেন, মদ্যপানের শাস্তি হতে খলিফা উমর ফারুক(রাঃ) নিজপুত্র আবু শামাকেও রেহাই দেননি। মদ্যপানের শাস্তি আশিটি বেত্রাঘাত। ন্যায়পরায়ণ খলিফা উমর ফারুক(রাঃ) রায় দেন, আবুশামা খলিফার পুত্র, তাই তাঁর শাস্তি দ্বিগুণ, অর্থাৎ একশত ষাটটি দুররা। খলিফা উমর ফারুকের(রাঃ) নির্দেশে জল্লাদ ১৬০ বার দুররা মেরে খলিফার চোখের সামনে তাঁর রুগ্নপুত্র আবুশামাকে হত্যা করে ফেলে। 

পুত্র আবুশ্যামা প্রাণবাঁচানোর জন্য পিতার পায়ে লুটে আকুল আবেদন জানায় কিন্তু পিতা ওমর ফারুককের(রঃ) পাথরকঠিন হৃদয় একটুও টলেনি। মদখোর রুগ্নসন্থানকে পিঠিয়ে হত্যা এক অমানবিক নিষ্ঠুরতা। তবে তাবৎ জনতা খলিফাকে তার ন্যায়পরায়ণতা ও কঠোরতার জন্য বাহবা দিল।

ইমাম মোবারকপুরী উপযুক্ত বিষয়ে বয়ান করে খুব খুশি, প্রথম ওয়াজেই বাজিমাত। নামাজ শেষ হবার পরই ইমাম হুজুরকে তলব করলেন মোতাওয়াল্লি, ইমাম ভাবলেন সুন্দর বয়ানের জন্য নিশ্চয় বাহবা দিতে তাঁকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু ইমাম অবাক হলেন যখন মোতাওয়াল্লি থ্রেট দেন, হুজুর আপনি পয়লা দিনই বয়ানে বেয়াদবির চুড়ান্ত করে ছাড়লেন। আমি আপনার চাকুরীদাতা, আর আপনার এত্তবড় সাহস, আপনি কিনা আমার চোখে চোখ রেখে আমার মদ্যপান নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বললেন। 

শঙ্কিত ইমাম আব্দুল গফুর চাকুরী বাঁচাতে বললেন, মুহতারাম, আপনি মদপান করেন তা আমার জানা ছিলনা, আমাকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি মদ্যপান নিয়ে আর কখনও কোন বয়ান করবনা। 

মোতাওয়াল্লি বললেন আপনি নতুন তাই ভূল করেছেন, এজন্য মাফ করা হলো, তবে সাবধান। 

হুজরায় বসে লোকের কাছে নতুন ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী জানতে চাইলেন, এই অভিজাত পাড়ায় এত এত সুন্দর সুন্দর আলিশান বাসা-বাড়ি-গাড়ি গিজগিজ করছে, এখানকার লোকেরা এত টাকা পায় কোথায়? বোকা মুসল্লিরা বলল টাকা দেন আল্লায়, তাই তাঁরা এত টাকা পায়। তবে সরলের দল চলে গেলে চালাকেরা ইমামকে কানে কানে বলল, হুজুর এসব গাড়ি-বাড়ি আল্লাহ দেন নি, হয়েছে ঘুষের টাকায়। 

তাঁরা জানালো এপাড়ায় ভূমির দাম এত বেশি যে, ঘুষখোর ছাড়া কেউ এখানে বাসা কিনতে পারেনা। 

ইমাম হুজুর ভাবলেন এই শুক্রবারে তাহলে ঘুষ নিয়ে ওয়াজ ফরমাবেন।

ইমাম খুতবায় বুখারি শরিফের হাদিস পেশ করেন, ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়েই দোযখের আগুনে জ্বলবে। শুনালেন, মহানবি(সঃ) তাঁর নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরে কোনধরনের ঘুষ কিংবা উপহার গ্রহণ করতে নিষেধ করে দেন।

ঈমাম সাহেব সুন্দর ওয়াজ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। 

নামাজ শেষে মুসল্লিরা বেরিয়ে গেলেই মসজিদের সেক্রেটারি তাঁকে তলব করলেন। হুজুর আপনি আজ বয়ানে আমাকে অপদস্ত করে ছাড়লেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে ঘুষ নিয়ে এত গলাবাজি করলেন। জানেন, আমি চাইলে আপনার বেতন আটকে দিতে পারি। 

সাবধান ঘুষ নিয়ে আর কখনও টু শব্দটি করবেন না বলে দিচ্ছি। 

ইমাম সাহেব দেখলেন পহেলা মাসের বেতনই আটকে যাচ্ছে। 

তাই ঠেলায় পড়ে বললেন, জী আচ্চা।

ইমাম সাহেব তাঁর ওয়াজের তালিকা হতে মদ ও ঘুষ বাদ দিলেন।

ধানমন্ডি লেকবাগানের একপ্রান্তে এই মসজিদুল তাকওয়া। ইমাম দেখেন এখানে ওখানে নরনারীরা বেপর্দা বসে আড্ডা দেয়। হাইস্কুলের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই স্কুলড্রেসপরা সদ্য হালকা গোঁফগজানো কিশোর কিশোরীরা প্রেম প্রেম খেলায় নিমগ্ন হয়। তরুণ তরুণীরা পরস্পর গা ছোঁয়াছোয়ি করে ঘণ্টার পর ঘন্টা নিরালায় বটতলে বসে গুনাহে জ্বিনা করে যায় অবলীলায়। পাশদিয়ে ভদ্রলোকেরা অনেকেই আসে-যায় কিন্তু কেউ দেখেও দেখেনা, বাঁধাও দেয়না।

ইমাম সাহেবের পাড়াগায়ে মাইয়াগো এসব বেলাজ কাজ কারবারে নেই। হায়রে শহর, এখানে জিনা আর জিনা, এসব দেখার কিংবা আটকাবার মত লোকজন কেউ নেই। 

ইমাম সাহেব ভাবলেন, এবার বেহায়া বেপর্দা বেগানা আওরত নিয়ে ওয়াজ করবেন। 

এই আখেরি জামানার নারীদের বেলেল্লাপনা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। এখানে জিন্সের প্যান্ট-সার্ট পরিহিত নরনারীর চোখের জিনা, ছোঁয়ার জিনা, পোষাক ও সাজসজ্জার জিনা করে, তা নিয়ে বলবেন।  

মুসল্লিরা স্ত্রীজাত বিষয়ক ওয়াজ শুনতে খুব মজা পান, হুজুরকে বাহবা দেন।

ইমাম সাহেবের পল্লীগ্রামে আওরাতরা ধরাধরি করেনা, জড়াজড়ি করেনা, এতসব পাপাচার মোবারকপুরে নেই।

গ্রামবাংলার মাইয়ারা বড় নিরীহ প্রাণী, তাঁরা লজ্জাবতীর লতা অথচ গ্রামের ওয়াজি হুজুররা ইচ্ছেমত সেই অবলাদেরে তুলোধুনো করে নিজেরা আনন্দ পান, মুসল্লিদেরেও আনন্দ দেন।

ইমাম মোবারকপুরী মনে মনে ভাবেন এই মাইয়াগো নিয়্বে ওয়াজ বেশ জমবে।

মাইয়ারা অবলা ও সরলার দল, নিশ্চয় ওদেরে নিয়ে ওয়াজ করে কোন বিপদও হবেনা। 

ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী পরের শুক্রবারের বয়ান তাই মাইয়ামানুষের জন্য বরাদ্ধ করলেন।

ইমাম সাহেব খুতবায় একটি হাদিস বয়ান করলেন। মহানবি(সঃ) বলেছেন, আমি যদি আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করার নির্দেশনা পেতাম, তাহলে মহিলাদেরে তাঁদের নিজ নিজ স্বামীগণকে সেজদা করার আদেশ দিতাম।

রাসুলে খোদা(সঃ) মেরাজের রাতে দোজখ দর্শনকালে দেখতে পান সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই নারী।

কারণ তাঁদের বেপর্দা চলাফেরা ও স্বামীর সাথে বেয়াদবি। 

পুরুষরা একসাথে চারজন বিবি রাখতে পারবেন, কিন্তু মহিলাদের বেলায় একজনের বেশি স্বামী রাখা দুরস্ত নেই।

পিতৃসম্পদে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক।

সাওয়াল বেটা হলে দুইটা ছাগল, বেটি হলে একটা ছাগলই আকিকায় যথেষ্ট।

একজন পুরুষের সাক্ষী সমান দুইজন নারীর সাক্ষী।

স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশত।

"তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র স্বরূপ। সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর" সূরা বাকারা ২২৩ নং আয়াত।

যেই নারীর প্রতি স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে রাত কাটাবে সেই নারীর প্রতি ফেরেশতারা সারারাত লানত বর্ষণ করেন। 

আপত্তিকর বিষয় বউরা অবাধ্য হলে দুচারটা ঘা-চটকনা লাগিয়ে দেবার অনুমতি শরিয়ত স্বামী ব্যাটাদের দিয়েছে।

সবশেষে কবিতা, পতিভক্তি কর সব সতী নারীগণে, বেহেশতে করবে বাস নিজস্বামী সনে।

বয়ান শুনে একজন নারী পাশের নারীকে বলল, বোন আমি ওকে নিয়ে দুনিয়ায় বড় মুছিবতে আছি। স্বর্গে গিয়ে ঐ ফাজিলের সঙ্গি হব, মাফ চাই।

দ্বিতীয়জন, আমারও একই দশা বোন, হে দয়াময় আল্লাহ্‌, জান্নাত দাও না দাও আপত্তি নেই, পরকালে কেবল ওদের কবল হতে মুক্তি চাই।

তৃতীয় মহিলা ফেরেশতাদের সারারাতের লানত বর্ষণ নিয়ে বলল, ফেরেশতাদের কি খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই, কোন নারী তাঁর স্বামীকে খুশী করল কি করলনা, তাই নিয়ে রাতভর জেগে থেকে লানত মারবেন।

খতিব মোবারকপূরী খুব খুশি তিনি একখান জাঁদরেল ওয়াজ বহুদিন পর করেছেন। এবার ইনশাহাল্লাহ মুসল্লিরা খুশি হবে, সাবাস সাবাস করবে।

তাকওয়া মসজিদের ভূমিতল কক্ষে নারী মুসল্লিরা নামাজ পড়েন। ঢাবি, বুয়েট, ডিএমসি, চবি, সাস্ট ইত্যাদি পাশ করে রাষ্ট্রের উঁচুপদে বসা জাঁদরেল জাঁদরেল মহিলারা এখানে জামাতে আসেন। 

তাঁরা এই ওয়াজ শুনে বেশ অপমানবোধ করলেন। সম্মানিত মুহতারামারা খতিবের উপর ভীষণ চটে গেলেন। 

তাঁরা বাসায় ফিরে কর্তাদেরে বললেন, এই নতুন খতিব নারী বিদ্বেষী। ওকে বিদায় করুন নইলে আমরা নারীবাদীরা রাজপথে আন্দোলনে নামব।

গিন্নীদের ধাক্কা খেয়ে কর্তারা মসজিদে জমায়েত হয়ে ইমাম সাহেবকে রেগে বললেন, নারীরা কিভাবে চলাফেরা করবে, কোথায় যাবে, এটা তাঁদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাঁরা কি পরবেন, কেমনে সাজবেন, কার সাথে নাচবেন এটা তাঁদের স্বাধীনতা। এসব নিয়ে আপনার ভাবনার দরকার নেই, বয়ানেরও দরকার নেই। 

পুরুষের চেয়ে নারীদেরকে খাটো করে ওয়াজ করলেন আপনি, আর বিপদে পড়লাম আমরা। বেগমদের রণহুঙ্কারে আমরা এখন ঘরছাড়া হবার উপক্রম।

কর্তারা চরম আদেশ দিলেন, ইমাম সাহেব আজ থেকে নারী বিষয়ে আর কোন ওয়াজ করবেন না প্লিজ। দেশের স্পিকার মহিলা, প্রধানমন্ত্রী মহিলা, বিরোধীদলের নেত্রী মহিলা। আপনি মহিলা বিষয়ে কথা বলে দয়া করে আমাদের সবার উপর কোন বিপদ টেনে আনবেন না। 

নারীগণ কর্তাদেরে ঘরছাড়া করবেন এটা আবার ক্যামন কথা। বিষয়টা ইমামকে বেশ ভাবিয়ে দিল। 

বোকারা বুঝবে না, ইমাম সাহেব তাই চালাক মুসল্লিদেরে হুজরায় ডাকলেন। 

তাঁরা হুজরায় ঢুকেই দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিল। 

তারা ফিসফিস করে হুজুরকে বলল, মসজিদ কমিটির সদস্য এইসব শ্রদ্ধাভাজন সাবেক সচিব, মুখ্যসচিব, এমপি, জজ, ব্যারিস্টার, মেজর জেনারেলরা সবাই ঘরজামাই। তাঁরা বড়লোকের মাইয়া বিয়ে করে এই অভিজাত পাড়ায় শ্বশুরবাড়ির বাসিন্দা। তাঁদের লাগাম শক্ত করে ধরে আছেন পাওয়ারফুল বেগমরা। বেগমেরা ক্রুদ্ধ হলে তাঁদেরকে বাসা হতে তাড়িয়ে দেয়া মাত্র এক মিনিটের ব্যাপার। তাই এপাড়ার সাহেবরা বেগমদেরে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পান।

শরিয়তে একাধিক স্ত্রী রাখা দুরস্ত হলেও একাধিক স্বামী রাখা দুরস্ত নয়। 

নইলে এই বড়লোকের এক একজন মাইয়াগোর ঘরে গোটা দুইচারজন স্বামীদাস বসে বসে পত্নীসেবা করতেন।

একজন অতি চালাক বলল, ইমাম সাহেব, আপনি বেগম রোকিয়ার নারীস্থান পড়েছেন?

না, পড়িনি।

তবে শুনুন, বেগম রোকিয়ার নারীস্থানের পুরুষরা ঘরে পর্দাবদ্ধ থাকে। তাঁরা রান্নাবান্না করে, বাচ্চা লালনপালন করে, গৃহবন্দি থাকে। নারীরা বাইরে পুরুষের মত চরে বেড়ায়।

ইমাম হুজুর কিছুক্ষণ ধ্যান করে বললেন, বাহ্যিক হায়হালতে এই অভিজাত পাড়া পুরুষস্থান মনে হলেও বাতেনে দেখছি বেগম রোকিয়ার কিতাবের নারীস্থান।

সাবাস, হুজুর আপনি এবার সঠিক রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন। আল্লাহ আপনাকে প্রচুর ইলমে লাদ্দুনি দান করেছেন।  

চালাকেরা বলল, হুজুর মাইয়াগো নিয়ে আর কোন ওয়াজ করে নিজের সর্বনাশ করবেন না। আল্লাহ না করুক, ওরা চাইলে অজামিনযোগ্য নারী অপমান দমন আইনে আপনাকে চিরদিনের জন্য জেলেও পাঠিয়ে দিতে পারে। 

ভীত মনে ইমাম হুজুর বললেন, বহুত আচ্ছা। 

হে আল্লাহ রাহমানুর রাহিম, দয়া করুন, আওরাতদের চাবুক হতে একটিবার আমাকে বাঁচিয়ে দিন। আজ থাইকা আমি আর কোনদিন আওরাতগো বয়ান করব না।

ইমাম সাহেব পস্তালেন তাঁর ভান্ডার হতে বয়ানের আরেকটা মজার জিনিস নাই হয়ে গেল। 

ইমাম অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন আগামী শুক্রবার ওয়াজের বিষয় হবে সুদ।

ইমাম হুজুর হাদিস বললেন, সুদ দেয়া, সুদ নেয়া, সুদে সহযোগিতা করা, সুদের হিসাব নিকাশ করা, সুদের চুক্তিনামায় স্বাক্ষি হওয়া সবই হারাম।

সুদ খাওয়া গোনাহে কবিরা। নবিজি(সঃ) বলেছেন, যে সুদ খাইলো সে যেন নিজ মায়ের সাথে জিনা করল।  

নামাজ শেষে মুসল্লিরা বেশ হৈ চৈ শুরু করলেন। 

একদল বলল, আমরা সুদে ধার নিয়ে বাসা, বাড়ি, গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ কিনেছি। সুদের ঋণে ব্যবসা করছি। এখন আমাদের কি হবে গো।

আরেক দল বলল, আমরা সুদি ব্যাংক ও এনজিওতে চাকুরী করি। চাকুরী ছেড়ে দিলে ইমাম সাহেব কি আমাদের বৌবাচ্চাদের ভাত কাপড় যোগান দিবেন।

গরিব মুসল্লিরা বলল, আমরা এনজিও হতে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করে খাই। আমাদের ব্যবসা বন্ধ হলে সপরিবারে না খেয়ে মরব। আগে দুনিয়ায় বাঁচি। পরে আখেরাত। আখেরাত আসুক, তখন দেখা যাবে।

মাওলানা আব্দুল গফুর মোবারকপুরী জনতার হাল্লাগোল্লায় পড়ে সুবহান আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ জপে জপে মহান আল্লার দরবারে আবেদন জানান আল্লাহ আমাকে বাঁচাও, এই সুদখোর মুসল্লিরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে গো আল্লাহ।

এই অভিজাত পাড়ায় অনেক লেডিস ক্লাব, হনী ক্লাব, মেডান ক্লাব আছে। ইমাম শুনতে পান এসব ক্লাবে জুয়ার আসর বসে। জুয়াড়িরা জুয়া খেলে সারারাত পার করে। 

ইমাম হুজুর মাথায় হাত দিয়ে ভাবেন, আহারে এত লোক জুয়া খেলে দোযখে যাবে। আর আমরা নীরবে দেখে দেখে যাব। অন্ততঃ একজন মানুষকেও যদি দোজখের আগুন হতে বাঁচানো যায়, তা ছোট্ট পূণ্যকাজ না। আমার বয়ানে একটা মানুষ যদি জুয়া ছাড়ে তবে খতিব হিসাবে আমার জীবন ধন্য।

ইমাম হুজুর জুয়া ও জুয়াড়ি নিয়ে যত মসলা মাসায়েল আছে যোগাড় করলেন। পরের শুক্রবারের ওয়াজে সব বর্ষণ করলেন। নামাজ শেষে ইমাম তাঁর হুজরায় ঢুকলেন। 

ইমাম হুজুরের পিছু পিছু তাঁর একজন সুহৃদ মুসল্লিও ঢুকে বললেন, হুজুর আপনি এ কি করলেন। আপনাদের দৌড় বড়জুর মসজিদ। উঁচু অদৃশ্য দেয়ালঘেরা মাদ্রাসা নামক দুর্গ হতে এসেছেন। আপনারা আখেরাত নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত থাকেন যে দুনিয়ার কোন খবরই রাখেন না।

কিসের খবর? জানতে চান ইমাম। 

কিসের আবার, এসব জুয়াড়িদের হাত কতখানি লম্বা তা কি আপনি জানেন। 

পাড়ার গুন্ডা মাস্তান, পুলিশ, কমিশনার, এমপি হয়ে মন্ত্রিপরিষদ পর্যন্ত এদের সিন্ডিকেট। জুয়াক্লাবের কমিশন পাতাল টু আসমান পর্যন্ত সবাই খায়। দোয়া করি, আপনি যে বয়ান করেছেন আল্লাহপাক তা যেন ওদের কানের পর্দায় না পৌছায়। ওরা শুনলে আপনাকে জীবন্ত কবরে পাঠিয়ে দেবে।          

মাওলানা আব্দুল গফুর মোবারকপুরী ভাবনায় পড়লেন, তাঁর ইলিমের গোদামের মাল যেভাবে নিঃশেষ হচ্ছে, আগামী শুক্রবার তিনি কি বিষয়ে বয়ান করবেন।

ইমামের আলেম বন্ধুরা বলল, কেন? ইসলামে কি বয়ানের জিনিসের কোন অভাব আছে। Islam is the  whole code of life.

একজন উচ্চশিক্ষিত বলল, এটা ইসলাম ধর্মের জবরদস্তি। Whole code of life বলে ইসলাম ধর্ম মানুষের সব ধরনের কাজে হস্তক্ষেপ করে। মানুষের উঠ-বস, হাগু-মুতু, স্বামী-স্ত্রীর কুতুকুতু সবই ধর্মের অচলায়তনে বন্দি করে দেয়। হউল কোড অফ লাইফ মানুষকে ধর্মের পুতুলে পরিণত করে। 

Whole code of life এর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ আর মুক্তচিন্তা ও মুক্তকর্ম করতে পারেনা। সে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা হারায়। তাইতো মুসলমানরা এত মেধাশূন্য।  

তারচে আপনি জাকাত নিয়ে বলতে পারেন। 

বলতে পারি, তবে জাকাত যে ধনীদের পকেট খালি করে। 

এই জামানার ধনীরা তাঁদের স্বার্থহানী হয়না, ধর্মের এসব বিধান মানেন। যেখানে স্বার্থে টান পরে সেখানে তাঁরা নেই। তাই জাকাত নিয়ে এই কলিযুগে বয়ান করা অরণ্যে রোদন।

তাহলে আপনি ইসলামের রাজনীতি ও জেহাদ বিষয়ে বয়ান করতে পারেন।

অনেক আলোচনার পর শেষসিন্ধান্ত হল পরের শুক্রবারে ইসলামি রাষ্ট্র ও জেহাদের বয়ান দিবেন হুজুর মোবারকপূরী। 

ইমাম মোবারকপুরী জেহাদের একটি চটিবই বন্ধুর কাছ থেকে ধার করলেন। এখানে জেহাদের গুরুত্ব ও জেহাদের অগণিত ফজিলত লেখা আছে। শত শত অনিন্দ্যসুন্দরী হুর গেলমান শরাবান তহুরা হাতে নিয়ে জেহাদের সব শহিদানদের অপেক্ষায় জান্নাতে অধির আগ্রহে বসে আছে। 

জান্নাতের হুরসুন্দরীরা চিরযৌবনা, যতবারই উপবিষ্ট হন না কেন তাঁরা তাকত হারায়না। 

প্রতিবারই সোহবতের পর তাঁরা আবার নতুনভাবে কুমারিত্ব লাভ করে।

সবাই বলল, সুবহান আল্লাহ।

শুক্রবারের বয়ানে জেহাদের এই চটিবইয়ের সব মালামাল অকাতরে ঢেলে দেন আব্দুল গফুর মোবারকপূরী। দারূন উদ্দিপনাময় বয়ান শুনে জনকয়েক ইসলামি রাজনীতি করা ওলামা তাকে উপাধি দেন মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদি। নতুন লকব পেয়ে ইমাম হুজুর খুশিতে আটকানা। অনেক অনেক মোল্লাহ মুসল্লিরা তাঁকে বাহবা দেন। তাতে হুজুরের জেহাদের জজবা শতগুণ বেড়ে যায়।  

জিন্দাবাদের চুটে উল্লাসিত হুজুর আব্দুল গফুরের রাতে চোখে ঘুম আসছে না। 

সামান্য মোবারকপুরী থেকে এখন জেহাদি হয়ে গেলাম। ইমাম ছিলাম, আজ ইসলামি নেতাও হয়ে গেলুম রে।

চোখে একটু তন্দ্রাভাব আসতেই মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদি মোবারকপুরী স্বপ্নে দেখেন, হাজার হাজার সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ও টুপিধারীরা বঙ্গভবনে ঢুকে গেছে। দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম হয়ে গেছে। নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর আওয়াজ আসছে। 

আচমকা দরজায় ধুড়ুম ধুড়ুম ধাক্কার শব্দে ইমাম গফুরের ঘুম ছুটে যায়।

আপনারা কারা দরজার কড়া নাড়ছেন?

আমরা গোয়েন্দা সংস্থার লোক। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। দরজা খোলুন নইলে কপাট ভেঙ্গে ঢুকতে বাধ্য হব।      

কেন এসেছেন?

আপনাকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সামনে যেতে হবে।

কাউন্টার টেরোরিজম আবার কি? আমার বাবাও এই নাম শুনেনি।

আগে দরজা খোলেন, এই তাগুতি শক্তির নাম যথাসময়ে জানবেন, কেমন।

হুজরাখানায় ওয়াজ বানাতে ধার করে আনা জেহাদের চটিবইসহ মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদিকে ধরে নিয়ে গেল এন এস আই এর লোকজন। হুজুরের ফল কাটার ছুরিও আলামত হিসাবে জব্দ করল।      

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের মুখোমুখি ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী আল জেহাদি। 

আপনি কি বাংলাভাইয়ের লোক?

না।

আপনি কি শায়েখ আব্দুর রহমানের নাম শুনেছেন?

না, শুনিনি।

জে এম বি/ আল্লার দল করেছেন?

না। করিনি।

নিশ্চয় আই এস/ আল কায়দার ফাঁদে পড়েছেন?

না, আমি একজন নিরীহ আলেম। কারো ফাঁদেটাদে পড়িনি। কোন জঙ্গি দলে আমি নেই।

জঙ্গিদলে নেই, তাহলে জঙ্গি ওয়াজ করছেন কেন?

আর করবনা। আমার বউবাচ্চারা কান্নাকাটি করছে, চাকুরিটাও হারাবো। আপনাদের পায়ে পড়ি আমাকে মাফ করুন।  

তবে মুচলেকা দেন, জীবনে আর কখনও জঙ্গি বয়ান করবেন না। 

মুচলেকা দিলাম, জীবনে এমন কাজ আর হবেনা, দয়া করে এইবার ছেড়ে দিন।

আপনার জেহাদি টাইটেল বাদ দিন।

ওটা আমি লাগাইনি। মতলববাজরা দিয়েছে, ওদেরে চিনিনা। আজ থেকে ‘জেহাদি’ উপাধি বাদ দিলাম। 

ফজরের নামাজে এসে মুসল্লিরা জানলো জঙ্গি কানেকশনের কারণে ইমাম সাহেব পুলিশ হেফাজতে।

দুদিন পর মসজিদ কমিটির সভা বসল। ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরীকে ডাকা হল। 

কমিটির লোকজন মহাবিরক্ত।

আপনাকে নিয়ে আমরা আর পারছিনা। আপনি প্রতিটি ওয়াজে একটা না একটা জংঘট বাঁধিয়ে দেন। আপনি চাকুরী করবেন, না কি চলে যাবেন, স্পষ্ট করে বলে দিন।   

সাতজোড়া জুতার তলা ক্ষয় করার পর আপনাদের দয়ায় এই চাকুরী পেয়েছি। মেহেরবানরা তাড়িয়ে দিলে আমি যাব কোথায়? সংসার চালাতে আমাকে রাস্থায় রাস্থায় হাতপাততে হবে যে। 

কমিটি সদস্যরা বললেন, কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে একটা উপায় বের করুন, যাতে ইমাম হুজুর বাঁচেন, আমরাও বাঁচি। কমিটির ক্ষমতাবান সভ্য সাবেক সচিব আবুল হাসনাত ম করিম একটা সহজ রাস্থা বাতলে দেন।

ইমাম সাহেব আপনি তো ভাল আরবি-ফার্সি জানেন?

হ্যাঁ জানি।

এখন থেকে বাংলা বাদ, কেবল আরবি-ফার্সি-উর্দুতে ওয়াজ করবেন। 

কেন? আরবি-ফার্সি-উর্দু তো আমজনতা বুঝবে না।

না, সবার সবকিছু বুঝনের দরকার নাই। কেবল আলেম উলামারাই বুঝলে চলবে। আগে নিজের পিঠ বাঁচান।

বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে দুই চারটা ইংলিশ বলা যাবে কি? একটু একটু ইংলিশ ছাড়া পান্ডিত্য জাহির হয়না স্যার।

আরে পান্ডিত্য দেখাতে গিয়ে আর বড় বিপদে পড়বেন।

কেন?

এই দেশ চালায় ইংরেজি জানেওয়ালারা। দেশবিদেশে ইংলিশ পড়ে এসে তাঁরা এদেশের সব উঁচু ডালে ডালে বাসা বাঁধে। তাঁরা আপনাকে ছাড়বেনা। আপনার সব ভূলেবালেভরা ইংরেজি ওরা ধরে ফেলবে। পান্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে অপদস্ত হবেন। ভাগ্যের জুরে জেলের ঘাট থেকে সে রাতে ফিরে এসেছেন, এবার ক্রসফায়ারে পড়বেন। হেনস্তা কারে কয় হাড়ে হাড়ে টাহর পাবেন, আমরা কেউই আপনাকে তখন বাঁচাতে পারবনা।

মসজিদ কমিটির বিজ্ঞ সদস্য সাবেক সচিব আ হা ম করিম দারুন বিরক্ত।  

পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের মত আঙ্গুল উচিয়ে ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপূরীকে তিনি শক্ত ঝাড়ি দেন, বক বক বন্ধ করুন। বাংলা-ইংরেজি নয়, কেবল আরবি-ফার্সি-উর্দু এই তিনই হবে জুমুয়া বয়ানের একমাত্র ধর্মভাষা।

জি জনাব, তাই হবে, তাই হবে।     

গল্পে গল্পে আমাদের স্পিডবোট নিঝুমদ্বীপের নৌঘাটে এসে হাজির। গল্পের শুরু হাতিয়ায়, নিঝুমদ্বীপে এসে শেষ। 

সর্বজনাব সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু, ফারুক আহমদ, এনায়েত উল্লাহ, আরিফ রাব্বানী, সৈয়দ মোঃ ইয়াহিয়া ও ইসফাক কুরেশি নামীয় ছয়জন পূবালিয়ান পর্যটক গল্পের ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপূরী আল জেহাদিকে নীলদরিয়ায় বিসর্জন দিয়ে নিঝুমদ্বীপের হরিণবনের নিঝুম হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেন।

রচনাকালঃ ডিসেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। 

রচনা স্থানঃ ধানমন্ডি, ঢাকা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন