কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
মাকে নিয়ে আমি অনেকবার লিখতে
চেয়েছি, কিন্তু লিখতে পারিনি। এক অব্যক্ত ব্যদনা আমার কলমটাকে আটকে দেয়। কলমের
কালি যেন হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে বেরিয়ে এসে রক্তের অজস্র লালফোটা হয়ে যায়, যা আমার
লিখার কাগজটাকে সিক্ত করে দেয়। মাকে নিয়ে লিখা ব্যদনার লাল কালিতে লেপ্টে একদম
এলোমেলো হয়ে যায়। অনেক অনেক বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখালিখি করা হলেও আজ ২০১৯ সাল
পর্যন্ত কেবলমাত্র মাকে নিয়ে আমি কিছুই লিখতে পারিনি। ৯ মার্চ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ,
২৭ মাঘ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ রোজ শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিন ঘটিকায় তিনি চলে যাবার পর
আমি তাকে ভূলে যাবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু একদিনও ভূলে থাকতে পারিনি। এমন কোন
দিনই সম্ভবতঃ আমার অতিবাহিত হয়নি যেদিন আমি বার কয়েক পড়িনি মহানবির(সঃ) শিখানো সেই
দোয়া- ‘রব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানে সগিরা’ অর্থ- হে আল্লাহ তুমি আমার
মা-বাবাকে সেভাবে স্নেহযত্ন কর, যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে স্নেহযত্ন করেছেন।
মাকে নিয়ে আমার অনেক গল্প আছে,
নানা প্রসঙ্গে তাকে নিয়ে খাপছাড়া অনেক গল্প আমি এই আত্মকথায় ইতিমধ্যে বলে ফেলেছি।
আমি চাইনা কোন কথাই এখানে পুনরুক্ত হউক।
আমার মা ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী
রমণী। তার ছিল দুধে আলতা মিশানো গায়ের রঙ্গ। দীর্ঘাঙ্গিনী মায়ের ছিল মেধহীন এক
সুন্দর শারীরিক গঠন। আমার মা ছিলেন তার সময়ের উল্লেখ করার মত একজন শ্রেষ্টা
সুন্দরী মহিলা।
আমার মায়ের বয়স যখন মাত্র পচিশ
ছাব্বিশ বছর তখন আমি দাউদপুরের অজপাড়াগাঁয়ে ১৯৬৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর জনম নেই। শৈশবে
মাকে একটি কালো শাড়ি পরতে দেখতাম, এই শাড়িপরা মাকে দেখে মনে হত কালোমেঘের ভিতরে
যেন পুর্ণিমার চাঁদ লুকিয়ে আছে।
আমার ছোটবোন মান্না ছাড়া
অন্যবোনরা কেঊই দেখতে একদম তার তার মত হননি। তবে অনেক লোকজন কৈশোরে আমাকে বলতেন
আপনি মেয়ে হলে আপনার মায়েরই প্রতিরূপ হতেন। আপনার কতাবার্তা, চালচলন, চেহারা,
দেহগঠন ও গায়ের রঙ সবকিছুই এই মহিয়সী নারীর সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়।
একদিন গল্পকালে মা বললেন, তার
বিয়ে ঠিক হবার আগে কিছুলোক এখানে এসে কনের গীবত গায়। আমরা অবাক হয়ে বললাম, তোমার
মাঝে এমন কি ক্রুটি আছে যা কেউ গাইতে পারে। আমরা কোনদিনই মায়ের কোন দুষ ক্রুটি পাই
নি। এবার মা বললেন, কেউ নাকি বলেছে তিনি একদিকে তাকালে মনেহয় অন্যদিকে তাকিয়ে
আছেন। তাই পুনরায় কনে পরখ করতে কয়েকজন বিশেষঞ্জ মহিলা নানাবাড়ি পাতারিয়া ছুটে যান।
কিন্তু এই বিশেষঞ্জ মহিলাগন অনেক অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও কনের মধ্যে আপত্তিকর
কিছুই খুঁজে পাননি। অযথা আমার নানার ডিনার সাবাড় করে ফিরে
আসেন।
এই গল্পশুনে আমরা বিস্ময়ের
দৃষ্টি মেলে মায়ের দুই চোখের তারায় আমাদের চোখ রাখি কিছু খোঁজে পাওয়া যায় কিনা। এবার আমরা খুঁজে পেলাম তার একটি চোখ সত্যই ট্যারা কিন্তু
এতই ক্ষীন ট্যারা যে, তা খোঁজে বের করতে হলে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হবে।
এবার আমরা কিছু বলার আগেই মা
বললেন, তোমরা যা দেখলে তাকে লোকে বলে লক্ষি ট্যারা। আমরা বললাম ‘ট্যারা’ ট্যারাই,
তা আবার লক্ষি হয় কেমনে? মা বললেন- হয়। তাবৎ লোকজনের ধারণা এই ধরনের ঈষৎ ট্যারা হওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ, তাই
এধরনের ট্যারা মানুষ হয় ভাগ্যবান। তাই আগের জামানার মুরব্বীরা চোখের এই ক্রুটির
নাম দিয়াছেন-‘সৌভাগ্য বা লক্ষি ট্যারা’।
তাহলে আমার মা কি ভাগ্যবতী
ছিলেন? তিনিতো কোন রাজকন্যা কিংবা রাজবধু ছিলেন না, তবে সেই জামানার প্রেক্ষাপটে
তিনি সত্যিই ছিলেন ভাগ্যবতী। তার বাবা ছিলেন বড় জমিদার। ত্রিশবিঘা বাড়ির উত্তরের
চাবাগান ঘেরা হাওরটির একছত্র মালিকানা ছিল তারি হাতে। বাবার সংসার ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি
আসার সময় মা তার বাড়িতে রেখে আসেন চৌদ্দজন কাজের লোক। কিন্তু বাবার বাড়ির ঐশ্যর্য
নিয়ে তাকে কোনদিন বিন্দুমাত্র কোন অহংকার করতে দেখিনি।
নানা ছিলেন জামানার শ্রেষ্ট আলেম
ও বিস্কুটি পীর সাহেবের খলিফা। আমার মা ছিলেন তার কন্যা ও শ্রেষ্টা মুরিদা। মা তার
বাবাকে মনে করতেন আধ্যাত্মিক গুরু, চলমান দুনিয়ার
সর্বশ্রেষ্ট মানব। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তিনি তার পিতৃস্মৃতি ভুলতে
পারেননি। নানা বিয়ের সময় কন্যাকে সোনা রূপার সাথে একটি কোরান শরিফ, একটি ওজিফা,
একটি দলালুল খয়রাত এবং একটি মখসুদুল মুমিন উপহার দেন। দলালুল খয়রাত তিনি সাতদিনে
খতম করতেন। এই সাতদিনের সীমারেখা নানা নিজহাতে বাংলায় লিখে দেন। নানার হাতের লিখা
সেই সামান্য বাংলা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। বাবার বাড়ির দেয়া অন্যসব মালামালের সাথে
এই বইগুলো একসময় পুরানো হয়ে গেলেও মা তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সযতনে আগলে রাখেন।
নানাবাড়িতে প্রচুর কাটাল গাছ
জন্মে। নানার দেয়া খাট পালং চেয়ার টেবিল ছিল পরিপক্ষ কাটালবৃক্ষের কাটে নির্মিত
মজবুত ও টেকসই। তার সারা জীবনেও এসব কাটপণ্য গুনপোকায় ধরে নি।
বিলাতি ডিনার সেট খুব যতনে পাহারা দিতেন, যাতে বাপের বাড়ির এই ভঙ্গুর চিনামাটির
স্মৃতিটুকু হঠাৎ ধপাস করে ভেঙ্গে না যায়। তার বিয়ের লাল শাড়ি আমি শৈশবে দেখেছি
কিন্তু জানি না পরে কেমন করে যেন হারিয়ে গেল।
মা কিছুদিন পর পরই তার বাবা
কিংবা মাকে স্বপ্নে দেখতেন। স্বপ্নে তার শৈশবের স্মৃতিময় বাপের বাড়িও দেখতেন। ঘুম
থেকে উঠে এইসব স্বপ্নের বিবরণ আমাদেরকে শুনাতেন। তিনি স্বপ্নের
তাবীরও করতেন। অনেক সময় তিনি স্বপ্নের মধ্যে যা দেখতেন পরে তা সত্য হয়ে যেত।
আমার মা ছিলেন স্বশিক্ষিতা
মহিলা। মা শৈশবে পাঠশালা যাবার গল্প বলতেন। সেইযুগে মেয়েদের হাইস্কুলে পড়া ছিল
নিষিদ্ধ গন্দম ফল, তদুপরী তিনি ছিলেন একজন পীরের কন্যা ও কট্টর আলেমের ছোটবোন।
মৌলানা বড়ভাই মাহমুদুর রহমান ও বড় হুজুর বাবা খলিলুর রহমান পাঠশালা সমাপ্ত হলে মেয়েদের হাইস্কুলে পড়ানোর কোন আগ্রহ দেখালেন না। তাই মা ও খালাদের সবার লেখাপড়া পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করেই থেমে যায়।
পাঠশালা পাস করার পর বোরকা পরে
তাদের সবাইকে পর্দা করতে হত। বাপ-চাচাদের পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি বাড়িতে যেতে
মা-খালারা একটি মশারীর ভিতর ঢুকতেন, মশারীর চারকোন ধরতেন চারজন
বুয়া, তারপর বেরুতে হত। মায়ের ভাষ্য শোনে মনে হয়েছে নানাবাড়িতে মা-খালারা ছিলেন
আসলেই অবরোধবাসিনী।
আম্মা তার শৈশবে চাচাত বোন
খোদেজা আপার বাড়িতে প্রায়ই রাত যাপনের গল্প বলতেন। সেই বাড়িটি আজকের পশ্চিমের
লস্করের বাড়ি। এই বাড়িতে কয়েকজন বুয়া নিয়ে খোদেজা খালা একাকী বসবাস করতেন। আমার
নানার দুই ভাইয়ের মধ্যে তাদের একমাত্র পুত্র ও একমাত্র কন্যা বিনিময়ের
মাধ্যমে দুই পরিবার সংযুক্ত হয়ে বাড়িটি এক
পরিবারের সম্পদে পরিণত হয়। খোদেজা খালার বড় বাড়িটির পরিবেশ ছিল
ভুতুড়ে। এই পুরূষহীন বাড়িতে বয়স্কা চাচাতো বোনের সাথে মনে মনে ভুতের এক অদৃশ্য ভয়
নিয়ে বালিকা মা-খালারা রাত কাটাতেন।
মা বলতেন তার পাঠশালার এক
সহপাঠির মাথা ছিল অস্বাভাবিক মোটা, বুদ্ধিশুদ্ধিও ছিল কম। মাস্টার সাহেব ওর মাথায়
কঞ্চি দিয়ে গুতো মেরেমেরে বলতেন এই এত্ত মোটামাথা সম্পূর্ণটা গোবরে ভরা। মাস্টার
ছেলেটাকে নিয়ে হাসি টাট্টা করতেন। তা দেখে মা দুঃখ পেতেন। অথচ আজকাল এধরনের
বাচ্চাদেরকে প্রতিবন্দী হিসাবে গণ্য করা হয় এবং পরম মমতার দৃষ্টিতে
দেখা হয়। আসলে সে যুগের শিক্ষকদের কোন ধারণাই ছিল না, এধরনের
মানসিক প্রতিবন্ধি কেউ স্বইচ্ছায় হয় নি, হয়েছে সে প্রকৃতির এক অদ্ভুদ খেয়ালে
যেখানে মানুষের কোন হাত নেই। আওয়ামী লীগ নেতা ইমান উদ্দিন ছিলেন আম্মার পাঠশালার সহপাঠি, যিনি কয়েক মেয়াদ দক্ষিণভাগের ইউপি চেয়ারম্যান ও বড়লেখার এম পি ছিলেন। ইমান উদ্দিন আজ আর দুনিয়ায় নেই।
এই ধুসর পৃথিবীতে সব কর্মকান্ডের
বিপরীতে লাভালাভের একটা হিসেব নিকেশ থাকে, সব দানের পিছনে প্রতিদান প্রাপ্তির
লোভ-লালসা লুকিয়ে থাকে। আমার জীবনের অভিঞ্জতা হতে দেখেছি কেবলমাত্র আমার মায়ের
উজাড় করে দেয়া সব স্নেহ ভালবাসা ছিল একদম নিরেট খাঁটি এবং
অকৃত্রিম। এখানে কোন খাদ ছিল না, ছিল না কিছু ফেরত পাবার আশা কিংবা দাবী। এমনও
দেখেছি খেতে বসে প্রায়ই ভাল খাবার মাছ মাংসের টুকরো মা-বাবা তাদের প্লেটে অল্পই
নিচ্ছেন, আমরা ভাইবোনেরা যাতে সবাই বেশি করে পেয়ে যাই, তাই মাছের মাথা, মোরগের
রান, ইলিশের তৈলাক্ত পেট নিজেরা না খেয়ে সন্তানদের জন্যে রেখে দিচ্ছেন।
আমাদের বাড়িতে আম, কাটাল, লিচু,
সুপারি, নারকেল সহ প্রচুর মৌসুমী ফল হত। আমার মা উক্ত ফসলাদি তুলার পর একটি অংশ
আশপাশের মানুষের মাঝে বিতরণ করে দিতেন। এমন কি
পুকুরের মাছ ধরা হলেও তাই করতেন। মায়ের বিশ্বাস ছিল এই প্রাকৃতিক ফলফলারী আল্লাহর
অশেষ কৃপায় উৎপন্ন হয়। মানুষকে বিতরণ করলে আল্লাহের অনুগ্রহে
এসব নিয়ামত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ মানুষের স্বার্থপরতা একদম পছন্দ করেন না। লোকজনকে
বিতরণ না করে কেবল নিজে সব উদরে দেওয়া কিংবা বিক্রি করে
দেওয়া এক ধরনের স্বার্থপরতার নামান্তর, যা স্রষ্টার কাছে কোনমতেই পছন্দনীয় হতে
পারে না। মায়ের ধারনা ছিল আল্লাহর রহমত, বরকত ও নিয়ামত পেতে হলে তার প্রতি সব সময়
কৃতঞ্জ থাকতে হবে এবং তার দানের একটি অংশ কৃতঞ্জতা প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ
ভিত্তহীনদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে। আমার মা সব সময় দান
করতেন এবং দানে আনন্দ পেতেন।
কিছুলোক মায়ের কাছ থেকে কর্জে
হাসানা চেয়ে নিত। তাদের একজন মাঝপাড়ায় চাখৈয়ের মা, তিনি সর্বদাই টাকা ধার নিতেন
এবং ঠিক সময়ে ফেরত দিতেন। এই বৃদ্ধার স্বামী ছিলেন গ্রাম্য হাটবাজারের চাল
ব্যাপারী। কিছু পান ব্যাপারী, ছাতা বিক্রেতা, তরকারী বিক্রেতা আমার মায়ের কাছে
নিয়মিত দরকার হলেই কর্জে হাসানা নিয়ে যেত এবং পরে ব্যবসা করে ফেরত দিত। এরা ছিল
সাধারণত চৌধুরীবাজার, মোগলাবাজার ও রাখালগঞ্জ বাজারের ক্ষুদ্র হাঁটবারের ব্যবসায়ী
এবং আমাদের গ্রামের লোকজন। তাদের ব্যবসায় তেমন পুঁজির প্রয়োজন হত না। ফলে এই বিনেসুদের
কর্জে হাসানার টাকা তাদের ক্ষুদে ব্যবসায় খুব উপকারে আসত। মা বলতেন কর্জে হাসানা
প্রদান খুব সওয়াবের কাজ। আমি সারাজীবনই তাকে এই পুন্যের কাজটি করতে দেখেছি।
এই সওয়াবের কাজটি করতে গিয়ে তিনি
প্রচুর টাকা খোয়ান। গরীব মানুষগুলো এই টাকা ধার নিয়ে অনেকে আর ফেরত দিতে পারত না।
যে টাকা হারাতেন, তা দান হিসাবে আবার মাফও করে দিতেন। ফেরত দেবার জন্য তেমন কোন
চাপাচাপি করতেন না। তবে এসব খেলাফি লোকরা কর্জে হাসানা পাবার অযোগ্য হয়ে যেত। যারা
নিয়মিত ফেরত দিত, তারা বারবার মায়ের কাছে কর্জে হাসানা পেয়ে তাদের ক্ষুদ্র হাটুরে
ব্যবসা চালিয়ে যেত।
বর্তমান এই সুদের জামানায়
সাহায্য দেবার নামে এনজিওদের নির্মম গরীব শোষণ দেখে আমি খুব মর্মাহত হই, ঠিক তখনই
আমার মায়ের ‘দান ও কর্জে হাসানা’ বিষয়ক এই শ্বাসত দর্শন ও কার্যকলাপ মনে পড়ে যায়,
যা আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে।
লন্ডন হতে আমার বড়ভাই টাকা পাঠালে
প্রায় সব টাকাই আম্মা দান করে শেষ করে ফেলতেন। এত টাকা আসার পরও প্রায়ই তাদের হাত
শূন্য দেখা যেত। আমার বেগম একদিন বিরক্তির সুরে বললেন, লন্ডনের বড়ভাই কষ্ট করে এত টাকা
পাঠান আর মা খেয়ে না খেয়ে সব দান খয়রাত করে দেন। দরকারের সময় কোন টাকা খুঁজে পাওয়া
যায় না।
আবার বিপরীত চিত্রও দেখতাম।
সেকালে গ্রামের কোথাও কোন ব্যাংক ছিল না। বাড়িঘর ছিল অনিরাপদ ও বাশবেতের তৈরী।
লোকজন বিশেষ করে মহিলারা তাদের টাকা নিরাপদে রাখার কোন জায়গা খোঁজে পেত না। তাই
গায়ের কিছু লোক এসে আম্মার কাছে টাকা নিয়ে হাজির হয়ে বলত, মাইঝি আমার এই কিছু টাকা
আপনি গচ্ছিত রাখেন, পরে কোনদিন এসে ফেরত নিয়ে যাব। আম্মা এই টাকা আলমারিতে তালা
মেরে রাখতেন। তারা যখনই ফেরত চাইত, তখনই ফেরত দিতেন।
আজ ব্যাংকে চাকুরী করে মনে মনে
ভাবি সেকালে আমার গাঁয়ে কোন ব্যাংক ছিল না সত্য, তবে দাউদপুর গ্রামের অনেক লোকজনের একটি অতি বিশ্বস্ত
সাইনবোর্ডবিহীন জীবন্ত ব্যাংক ছিল, সেই ব্যাংকটি ছিলেন আমার মা জনাবা আসমতুন্নেছা
চৌধুরী। মা এই কাজেরও একটি সুন্দর নাম দেন-‘আমানতদারী’। তিনি বলতেন আল্লাহর
রসুল(সঃ) ছিলেন আমানতদার। তিনি হিজরতের রাতে তার কাছে মক্কার লোকজনের গচ্ছিত রাখা
মালামাল ফেরত দেয়ার জন্য জীবন ঝুঁকি সত্বেও তার ঘরে হজরত আলীকে(রহঃ) রেখে আসেন। এই
আমানতদারীর জন্যই নবিজি ইসলাম প্রচারের আগেই মক্কাবাসীর কাছ থেকে একটি উপাধি পান-
‘আল আমিন বা বিশ্বস্ত’। মায়ের ধারণা ছিল আমানতদার হওয়া খুব
সৌভাগ্যময় পূণ্যের কাজ। তাই মা শত ঝুঁকি নিয়েও কোন বিরক্তি
ছাড়াই নিঃস্বার্থভাবে জীবনভর আমানতদারী করে যান।
আমার মায়ের এই কর্জে হাসানা
কিংবা আমানতদারীর মত বিষয়গুলো হয়ত খুব তুচ্ছ ব্যাপার, কিন্তু এসব বিষয়ের গুরুত্ব
আমার চোখ এড়াতে পারে নি। আমার মনে এই সামান্য বিষয়গুলো বেশ দাগ কেটে অসামান্য হয়ে
ধরা পড়ে। এই ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ কাজগুলো এক সময় পাহাড়সম উচ্চতা ও ওজন নিয়ে
সমাজের মহাকল্যাণের কারণ হতে পারে।
আমার মাকে সব সময় কোন না কোন ছোট
ছোট রোগ যন্ত্রণা দিত। ১৯৮৪ এবং ১৯৮৫ সালে তার বুকে ব্যথা
অনুভুত হতে থাকে। এই ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। চিকিৎসক গ্যাস্টিকের ঔষধ এবং
ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল টেবলেট দেন। পরে এসব ঔষধে কোন কাজ হত না। একদিন রাতে
তাকে পেটের ব্যথায় ভীষন কাহিল করে ফেলে। সারারাত ব্যাথায় ছটফট করতে থাকেন। তীব্র
যন্ত্রণায় বিছানায় গড়াগড়ি যান। আমি মধ্যরাতে পশ্চিমের বাড়িতে
গিয়ে চাচাতো ভাই ডাঃ এন এ চৌধুরী ওরফে ডাঃ গোলাম নবি ভাইকে ঘুম হতে ডেকে তুলে নিয়ে
আসি। তিনি ব্যথানাশক ইনজেকশন পুশ করেন। সাথে সাথে ব্যাথা চলে যায় এবং ঘুমিয়ে পড়েন।
এবার ঘন ঘন ব্যথার আক্রমণ শুরু
হয়। এইব্যথা যখন কমে আসত তিনি তখন একদম নিস্তেজ হয়ে যেতেন। প্রায়ই গভীর রাতে ব্যথা
শুরু হত, এই ব্যথা হতে তাকে মুক্ত করতে শিরায় ইনজেকশন পুশ করতে হত। মাঝে মাঝে
হ্যারিক্যান জ্বালিয়ে রাতের শেষভাগে আমাদের মাঝপাড়ার গ্রাম্য চিকিৎসক আকমল আলীর
বাড়িতে উপনীত হতাম। তিনি এসে শিরায় ইনজেকশন পুশ করে দিলে দ্রুত ব্যথা নিবৃত হত। মা
তখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতেন।
কোন এক বাদল রাতে আম্মা ব্যথায়
ছটফট করতে থাকলে আমি রাস্থার কাদাপানি দলে খালি পায়ে ডাঃ আকমল আলীর বাড়িতে যাই।
তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তারপর ডাঃ এন এ চৌধুরীর (গোলাম নবী ভাই) ঘরে গিয়ে জানলাম
তিনি তার একমাত্র বোন মমতা আপার চট্টগ্রামের বাসায় বেড়াতে গেছেন। এদিকে আম্মাকে
বাড়িতে তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে রেখে এসেছি। সেইরাত যেন দীঘ্য হয়ে গেল। কোনমতে রাত
পোহাচ্ছে না। মায়ের কষ্ট নিবারণে এবার বৃষ্টিতে ভিজে তুড়ুকখলার দিকে পা বাড়ালাম। লুঙ্গিতুলে
হাঁটুজলে দীর্ঘপথ হেটে আব্বার প্রিয়ছাত্র উরফি মিয়ার দরজায় গিয়ে শেষরাতে
কড়া নাড়লাম। তিনি সাথে সাথে তার টর্স লাইট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। জলা রাস্থায়
হেঁটে হেঁটে এসে আম্মার শিরায় ইনজেকশন পুশ করে বেরুনোর একটু পরই আমাদের মসজিদের
চারতলা মিনার হতে আজানের সুর ভেসে এলো। উরফি মিয়া একজন বিনয়ী পরোপকারী
ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আজ নেই, আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন।
ভাবতে অবাক লাগে সেইকালে
রোগীর শিরায় একটি ইনজেকশন দিতে রাতভর কত না দৌড় ঝাপ দিয়েছি। অথচ আজ এসব কাজ ডাল
ভাত। আমার ঘরে আজ প্রায় সবাই ডাক্তার। ডায়বেটিস রোগীরা নিজেই প্রতিদিন নিজ শরীরে
বারবার ইনসুলিন পুশ করছেন।
তখনকার সময় সিলেট সরকারি
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া আর কোন বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা হাসপাতাল ছিলনা।
একদিন তাকে কাজলশাহ নিয়ে গিয়ে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের
অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল খালেকের অধীনে ভর্তি করা হল। সিলেটের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ
আব্দুল খালেক সাহেবের নাম অনেক শুনেছি, এইবার আমি এই প্রথম তাকে সরাসরি দেখলাম।
শ্যামলা বর্ণ হালকা পাতলা তনু, চেহারাটা নিরীহ ভদ্রলোকের মত। গাঁয়ে সেটে আছে কালো
প্যান্ট ও সাদা সার্ট। তবে ইস্ত্রিহীন সাদামাটা।
আম্মাকে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ খাইয়ে
এক্স-রে করা হয়। রিপোর্টে পিত্তপাতর হবার আশংকা করা হল। লোকে বলত ডাঃ খালেক সাহেব
খুব গরম লোক, তারসাথে কথা বলা যায়না। আমি তাকে নিয়ে লোকের এই ধারনার কোন ভিত্তি
খোঁজে পেলাম না। ডাঃ আব্দুল খালেক একদিন আমাকে তার সামনে বসিয়ে আম্মার রোগের
সবগুলো কাগজ গভীর মনোযোগ সহকারে দেখে
আমাকে তাই বললেন। সেকালে আজকালকার মত আল্ট্রাসনোগ্রাম ছিলনা। তাই রোগ নির্ণয় করা তখন এত সহজ কাজ ছিল না।
সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
আমি অসুস্থ মায়ের বেডে তার পাশে শুয়ে কিংবা বসে থাকতাম। প্রায়দিন বিকেলে অনেক
আত্মীয়স্বজন এসে আম্মাকে দেখে যেতেন। মনে পড়ে আম্মাকে বেডে রেখে আমার ফুফুতো অলিদ
ভাইয়ের মেয়ে সেফুর শেখঘাটের বাসায় একবার দুইতিন রাত কাটাই। ভাতিজি জামাই ফুলবাড়ির ইঞ্জিনিয়ার
জাকারিয়া চৌধুরী মশারী টাঙ্গিয়ে খুব যত্ন সহকারে এই তরুণ চাচা শ্বশুরকে ঘুম পাড়িয়ে
দিতেন।
এবার চিকিৎসকরা বললেন, অপারেশন
করে বের করিয়ে নিয়ে আসতে হবে পিত্তপাতর এবং রোগীকে সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করে
দেওয়া হবে। কিন্তু সে সময় অপারেশন ছিল খুব সেকেলে ও কষ্টকর। নাক দিয়ে সুদীঘ্য পাইপ
ঢুকিয়ে পাকস্থলীতে নিয়ে যাওয়া হত। পিত্তপাতর অপারেশনে বড় আকারে ছয় সাত ইঞ্চি লম্বা
করে পেঠ কাটা হত। সেলাইয়ের পর প্রান্তদিয়ে একটি পাইপ ঢুকায়ে ড্রেনলাইন তৈরি করে
দেওয়া হত। এই পাইপ দিয়ে বেশ কিছুদিন রক্ত বেরিয়ে এসে প্লাস্টিক থলীতে জমা হত। রোগী
ভাল হতে তিনচার সাপ্তাহ সময় লেগে যেত। আর ইনফেকশন হলে তো রোগী কোনদিন মুক্তি পাবেন
তার কোন হিসেবই ছিলনা।
এসব নানাকিছু ভেবে পরে এসে
অপারেশন করাবো বলে মাকে নিয়ে দাউদপুর ফিরে গেলাম। একবার তীব্র ব্যাথার সাথে আম্মার
জন্ডিস হয়ে যায়। আবার সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে নিয়ে আসি।
পনের বিশ দিনের চিকিৎসায় রোগ কমে যায়, আবার বাড়ি ফিরে যাই। এই মেহমানখানায় আম্মাকে
নিয়ে বারবার আসি আবার ফিরে যাই। পিত্তপাতর অপারেশন করা আর হয়ে ঊঠেনা।
একদিন হাসপাতালে আম্মাকে দেখতে
আসেন আমাদের আত্মীয় ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল। তিনি আমার ভাগ্না, অথচ তারই
ধমক খেলাম। তিনি বললেন, বসে থাকবেন না জলদি অপারেশন করান নইলে ক্যান্সার হয়ে যাবে,
তখন মাকে হারাবেন। ডাঃ দুলাল পরে বিএমএর সভাপতি হন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ডি
জি হয়ে অবসর গ্রহণ করেন।
আম্মার ঘনঘন জন্ডিস হচ্ছে,
পিত্তপাথুরী ব্যাথাও বারবার হামলা করছে। মেডিসিন চিকিৎসায় আর কাজ হবে না, তাই ১৯৮৬
সালে আম্মার পিত্তপাথর অপারেশনের চুড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণ করি। ধরাধরপুর গ্রামের
আমাদের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ লোকমান আলীর অধীনে
সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই অপারেশন করার সিন্ধান্ত হল। একদিন তাবলীগ
জামাতের লোকজনের মত গাট্টিবুচকা নিয়ে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে
আম্মাকে ভর্তি করলাম। অধ্যাপক সৈয়দ লোকমান আলীর পত্নী আমার ছোটখালার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া,
খালা একদিন মাকে নিয়ে এই ডাক্তার সাহেবের মেডিক্যাল কলেজের সরকারি বাসায় নিয়ে যান। এখানে সৈয়দ লোকমান আলীর অর্ধবয়েসী সুদর্শনা পত্নীর
সাক্ষাত পেলাম, চানাস্তাও করা হল। এই বাসায় ডাঃ সৈয়দ লোকমান আলীর ছোট্ট দুইটি বালক
পুত্র ও একজন বালিকা কন্যার দেখাও পেলাম। ডাঃ সৈয়দ লোকমান আলী আমাদের সামনে সোফায়
বসে অভয় দিলেন, আমরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাশেই হাসপাতালের কেবিনে ফিরলাম।
বর্তমানে লেপারস্কপির মাধ্যমে
খুব সহজেই পিত্তপাতর অপারেশন করা হয় এবং রোগী তিন দিনের মধ্যেই ভাল হয়ে বেরিয়ে
যায়। অথচ সেকালে এই অপারেশনে এক মহাযঞ্জের আয়োজন চলে। অপারেশনের পূর্বে রোগীকে
অনেক মেডিক্যাল টেস্ট করার পর অপারেশনের তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
অপারেশনের দিন দাউদপুরের বাড়ির
সবাই হাসপাতালে আসেন। মামা, খালা, ফুফুরা সপরিবারে সবাই এসে হাজির হন। মানুষ তখন
অপারেশনকে খুব ভয় পেত এবং মনে করত এই বুঝি শেষ। রোগী অপারেশন থিয়েটার হতে বেঁচে
ফিরে আসবেন এমন বিশ্বাস মানুষ খুব অল্পই পোষণ করত। এযেন চিরবিদায়ে পাঠানোর পালা,
যদি ফিরে আসেন তাহবে ভাগ্যের খেলা। শহরের আত্মীয়রা ওজিফা ও তসবিহ নিয়ে এসে ভীড়
জমান। এবার দোয়া-দুরূদ ও খতমে ইউনুসের খতম আরম্ভ হল। কে কোন দোয়া কতবার পড়বেন তাও
ভাগ করে দেওয়া হল। অপারেশন থিয়েটারের সামনে এবং কেবিনে স্বজনভীড় তৈরি হল।
অপারেশনের দিন সকালবেলা অধ্যাপক
সৈয়দ লোকমান আলীর সার্জারি টিমে কর্মরত আবাসিক সার্জন মনীপুরী চিকিৎসক ডাঃ প্রমোদ
রঞ্জন সিংহ রোগীর কেবিনে এসে হাজির হন। তিনি রোগীর পালস ও প্রেসার পরীক্ষা করে মনীপুরী সুরে বললেন আপনার বায়ু যায়। আম্মা তার কথার অর্থ
বুঝলেন না। আমি বুঝিয়ে বললে উত্তর দেন, যায় তবে অল্পস্বল্প।
এবার ডাঃ প্রমোদ রঞ্জন সিংহ একটি
লম্বা নল বের করলেন। রোগীকে মুখদিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বলে নাসারন্ধ দিয়ে প্রায়
দুইফুট পরিমান দীর্ঘনল দ্রুতগতিতে ঢুকিয়ে
পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দেন। মায়ের দু’চোখ দিয়ে জলের ফোয়ারা
বেরুতে থাকে। এবার তাকে নিয়ে ট্রলি ছুটল অপারেশন থিয়েটারে, ট্রলির পিছনে পিছনে
স্বজনদের একটি বড় মিছিল অপারেশন থিয়েটারের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল। চিকিৎসকগণ ভীড়
করতে নিষেধ করলেও তাতে তেমন কাজ হল না। সবাই রোগিনীর মমতায় একেবারে ইসকে মাতোয়ারা।
অপারেশন থিয়েটারে একজন চিকিৎসক
আম্মাকে বললেম, খালাম্মা আপনার অপারেশন করার জন্য আমি আজ সুরা ইয়াসিন পড়ে
হাসপাতালে এসেছি। আম্মা এই চিকিৎসকের কথা শোনে বেশ সাহস পান ও তার জন্য মনভরে দোয়া
করেন। তিন চার ঘন্টা পর শোনাগেল রোগীর অপারেশন শেষ এবং ঈষৎ ঞ্জান ফিরছে। ট্রলিতে
চাদরে ডাকা রোগী বেরিয়ে আসলেন। ঈষৎ নড়াচড়া করছেন, কোন কথা বলছেন না। তাকে সোজা পোস্ট
অপারেশন সার্ভিস থিয়েটারে ২৪ ঘন্টার জন্য নিবিড় পরিচয্যায় রাখা হল। পরদিন তাকে
নিয়ে আসা হল কেবিনে।
ভাল হয়ে বাড়ি ফেরার পর বেশ কিছুদিন
সাত ইঞ্চি দীর্ঘ সেলাই রেখায় চুলকানি করত। এবার ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে
পরবর্তী বেশ কয়েকটি বছর তার ভালই কাটল। ১৯৯২ সালে আবার তার শরীরে সমস্যা হয়।
মস্তিস্কে গরম অনুভব, গাঁয়ে ব্যথা, দুর্বলতা, গা জ্বালাপুড়া ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়।
আমরা তার শরির টিপে দিতাম। পায়ের উপর আমাকে বসায়ে আরাম পেতেন।
আমার ছোটবোন মান্নার স্বামী
লিয়াকত চৌধুরী তখন ব্যবসা করতে ঢাকা চলে যান। একবার আমি ব্যাংকের এক প্রশিক্ষণে ঢাকা যাই। আমার জৈষ্ঠভ্রাতা তাহমিদ চৌধুরীও তখন আলবার্ট ডেভিট ঔষধ কোম্পানির চাকুরির সুবাদে ঢাকায় ছিলেন। আম্মা তার মেয়েকে
দেখতে আমার সাথে ঢাকা ছুটে যান। শাহজাহানপুরের একটি বাসায় তারা ভাড়া থাকতেন।
ভাগ্না মুন্না ও ভাগ্নী লিজা হাটিহাটি পা পা অবস্থা হতে সবেমাত্র বেরিয়ে এসেছে। এই
বাসার অন্য তলায় থাকতেন তার ব্যবসায়িক পার্টনার সিলেটের মিরুভাই। এই দুই বাসায়
আড্ডা দিয়ে আমরা তখন বেশ আনন্দে সময় পার করতাম।
বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী প্রায়ই মোটর
সাইকেল চালিয়ে শাহজাহানপুর আসতেন। আমরা তিন ভাইবোন এবং দুই বাচ্চাবয়েসী ভাগ্না
ভাগ্নি মিলে তখন ঢাকার অনেক জায়গা ভ্রমণ করি। ছোট আপা আম্মাকে ঢাকা দেখাতে
শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা, রমনাপার্ক, সংসদ ভবন ইত্যাদি ঘুরে বেড়ান। কিন্তু আম্মা
একটু চলাফেরা করলেই ক্লান্ত হয়ে যান, একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন। ছোট আপা একদিন
আম্মাকে ডাক্তার দেখালে তার দেহে পুরোমাত্রায় ডায়বেটিস ধরা পড়ে। চিকিৎসক এবার পথ্য
দেন, সেইসাথে খাবারদাবার ও চলাফেরায় বেশ বাধা নিষেধ আরোপ করেন। কখন যে আম্মার
শরীরে ডায়বেটিস হয়েছে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। দুই চার বছর হয়ত এই গুপ্তরোগ নিয়েই
তিনি চিকিৎসাবিহীন পার করে দেন। যাক ঢাকায় এসে ডায়বেটিস ধরা পড়ে তার লাভই হল।
ডায়বেটিস ঘুনপোকার মত মানবদেহ ধীরে ধীরে খেয়ে জর জর করে ফেলে। চোখ, হার্ট, কিডনি নষ্ট করে দেয়। আমাদের মনে হল তার ভাগ্য ভাল এই জালিম রোগটা ধরা পরেছে,
এবার সাবধানে চললেই তিনি সুস্থদেহে দীর্ঘায়ু হবেন।
কিছুদিন ডাক্তারের নির্দেশ মত
ঢাকায় চলাফেরা করে আম্মাকে নিয়ে একদিন সিলেটে এসে আবার ফিরে গেলাম জন্মগ্রাম
দাউদপুরে, সেই বড়পুকুর পেরিয়ে সেই গবাক্ষতরুর ছায়াঘেরা লম্বা টিনের পাকাঘরে। সেই
দিনগুলো ছিল আমাদের জীবনের বেশ সোনালি দিন। বাড়িতে আমরা
ভাইবোনেরা এসে প্রায়ই সপরিবারে জমায়েত হতাম। ভাগ্নি পলি এখানে থেকে মনির আহমদ
একাডেমিতে অধ্যয়ন করত। নয় মাইল দূরের ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা হতে বড়বোন রেহা,
কানিহাটি কিংবা সিরাজনগর চা বাগান হতে সেহা, দশ মাইল দূরের রনকেলী হতে মান্না
সপরিবারে এসে প্রায়ই বাড়ি জমিয়ে রাখতেন। আম্মা তার সন্থানদেরে কাছে রাখতে পছন্দ
করতেন। পুত্র কন্যা নাতি নাতনীরা তাকে ঘিরে থাকলে আনন্দে তার মনের আকাশ ছেয়ে যেত।
তারা সামনে না থাকলে সবার সাহ্নিধ্যের জন্য অস্থির হয়ে যেতেন। কেউ দাউদপুর আসতে
কোন কারণে কয়েক সাপ্তাহ পার করলে তিনি নিজেই বাড়িঘর ফেলে রেখে ছুটে যেতেন তিন
মেয়ের আস্থানায় কিংবা তার ভাইবোনদের দেখতে বাপের বাড়ি পাতারিয়ায়।
জ্ঞানচর্চায় আমার দিন কাটতো
সিলেট শহরের কলেজে ও পাঠাগারে, সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম পল্লীর ছায়াঘেরা কূলে। সিলেট
হতে ফিরে আসতে দেরী হলে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। আসার পর সামনে পড়ামাত্র রেগে চটে
উঠতেন। সেইকালে মোবাইল ফোনের কোন অস্থিত্ব ছিলনা, তাই কোন কারণে দেরি হলে খবর
পাঠানোর কোন উপায় ছিল না। মায়ের বকুনি খেয়ে তাই ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আর কোনদিন এভাবে
দেরি করবনা কথা দিয়ে আপাততঃ রক্ষা পেতাম।
একদিন বিকেলে সিলেট হতে বড়ি ফিরে
ঘরে এক বিষন্নতা লক্ষ্য করলাম। আব্বা পালঙ্কে সঠান হয়ে শুয়ে আছেন, আম্মারও মনমরা
ভাবসাব। এবার আব্বা মুখ খুললেন এবং খুব দুঃখ নিয়ে বললেন এবার এই এত বয়সে এসে আমি
ঘর বৈঠকি হয়ে গেলাম। আমি জিঞ্জেস করলাম কি হয়েছে। আব্বা বললেন আমার অর্ধাঙ্গ অবস
হয়ে গেছে। তার ব্লাডপ্রেসার, ডায়বেটিস
কিছুই ছিলনা যে স্টোক করবে। আমি নিশ্চিত ছিলাম তার স্টোক করেনি। ডাক্তার
চিকিৎসা করলে তিনি কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে যান।
আমার মায়ের জীবনের শেষপ্রান্ত
তেমন মসৃন ছিল না। তার মাটির ঘরটা ডায়বেটিস নামক ঘুনে খেয়ে খেয়ে নিঃশ্বেষ করে
ফেলে। এসময় তিনি ইনসুলিন নির্ভর হয়ে যান। আমি ও ডাঃ নুরজাহান তার শরীরে প্রচুর
ইনসুলিন পুশ করে দিতাম। এতকিছু করার পরও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রন করা যেত না। লন্ডন হয়ে
আমার বড়ভাই তাহমিদ চৌধুরী প্রচুর চিকন সূচের সিরিঞ্জ পাঠাতেন। মায়ের শরীর তখন
ওজনহীন হয়ে যায়। চোখের জ্যোতি একদম কমে আসে। চশমা চোখে দিয়েও কোরান শরীফ এবং ওজিফা
পাঠে তাকে বেশ বেগ পেতে হত। জীবনের শেষবেলায় এসে ডাইনিং কিংবা ওয়াসরুমে যেতেও তাকে
ধরে সাপোর্ট দিতে হত।
একবার তীব্র শীতের দিনে মায়ের
ঠোট একদিকে সামান্য বাকা হতে থাকে। আমরা কেউ বিষয়টি খেয়াল করিনি। পাশের বাড়ির তসী
ঝি এসে মাকে দেখে পাশের ঘরের ভাবির কাছে বললেন, মাইজিকে আমরা হয়ত আর বেশিদিন পাবনা।
ভাবি জানতে চাইলেন কেন? তিনি বললেন, মাইজির ঠোট বাকা হয়ে যাচ্ছে, লক্ষণটা দেখে
আমার তাই মনে হচ্ছে তিনি পরপারের দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
আমার ছোটখালা ও মেঝমামা দুজনের
ঠোট জীবনের কোন এক সময় ঈষৎ বাকা হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি বেশ চিন্তিত হই
এবং আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানকে নিয়ে বাড়ি এসে মাকে সিলেটে নিয়ে যাই। আমাদের
নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক মেডিসিন বিশেষঞ্জ ডাঃ নাজমুল ইসলাম ভাইয়ের সাগরদিঘিপারের
বাসায় নিয়ে তাকে দেখাই। ডাঃ নাজমুল ভাই বললেন তীব্র শীত লেগে তার পার্শিয়াল
ডিজঅর্ডার হয়েছে। যাক আপনারা সাথে সাথে চলে এসেছেন, চিন্তার কোন কারণ নেই চিকিৎসা
হলেই দ্রুত তিনি সেরে উঠবেন। হ্যা ঘটলও তাই, কিছুদিনের মধ্যে তিনি ভাল হয়ে যান।
ঠোটও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
আম্মা অনেক কাজের মেয়ে পুষতেন।
কয়েক বছর আম্মার সাথে অবস্থান করে এরা বিয়ের লায়েক হলে বিদায় হত। এসব মেয়েদেরে
নামাজ রোজা তেলাওত শেখাতেন। তবে এসব মেয়েদের পড়ানো ছিল বেশ কঠিন কাজ। এদের
মস্তিস্ক ছিল খুবই দুর্বল, কিছুই সহজে সেথায় ঢুকতনা। শমি কিছুই মনে রাখতে পারত না।
তাকে কেবল সুরা এখলাস দিয়ে নামাজ পড়তে শেখান। বানেছা নামের মেয়েটির বাড়ি ছিল
ফেঞ্চুগঞ্জ, সে বিয়ের পর মারা যায়। মিনা নামে একটি বুদ্ধিহীন পাগলাটে মেয়ে ছিল,
তাকে কলিমা মুখস্ত কারানো সম্ভব হয়নি। কিছু শেখানোর পরই সে ভূলে যায়। সে দশ
পর্যন্ত গননাও শেখতে পারেনি। তার সব ধরনের উৎপাত মায়ের গা-সহা হয়ে যায়। পাগলীটাকে
আমি সিলেটে এনে একজন রিকশা চালকের কাছে বিয়ে দেই। সে আমাদের নর্থইস্ট মেডিক্যাল
কলেজের কাছে বসবাস করে। আমার বেগম সাহেবা আজও তাকে নিয়মিত সাহায্য দিয়ে যান।
২০০১ সাল হতে মা-বাবা আমার
সাগরদিঘিরপারের বাসায় এবং দাউদপুর গ্রামে আবর্তন করে সময় পার করতেন। গ্রামের বাড়ির
প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিল অবর্ণনীয়। সিলেটে কিছুদিন অবস্থান করেই তারা
আবার গ্রামের বাড়ি ছুটে যেতেন। বাড়ির ধান, মাছ, সুপারি ও ফলমূল সংগ্রহ করে সবাইকে
বিতরণ করে দিয়ে খুব আনন্দ পেতেন।
আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম
চৌধুরী মায়ের শারীরিক অসুস্থতার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। সামান্য কিছু হলেই
বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতেন। আম্মা এই পুত্রবধুকে তার কন্যাদের চেয়েও বেশিমাত্রায়
স্নেহ করতেন। মা অনেক সময় ঔষধ নিয়ম মাফিক খেতেন না। ডায়বেটিস বৃদ্ধিপেলে নফল রোজা
রাখতেন, তিনি বুঝতেন না যে রোজা
ডায়বেটিসের জন্য ক্ষতিকর। রোজায় শরীর পর্যাপ্ত শর্করা না পেয়ে ইচ্ছেমত
চর্বি ভেঙ্গে মাঝেমধ্যে ডায়বেটিস বৃদ্ধি করে দেয়। চিকিৎসকের নির্দেশ মত ঔষধ খেতেও
ভুলে যেতেন।
একসময় তার ক্রিটুমিন খুববেশি
বৃদ্ধি পায়। কলেষ্টোরল নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসক তাকে এক ধরনের ছোট্ট
লম্বাকার টেবলেট এটোবা দেন, যাকে মা বলতেন ক্ষীরার (শশা) বিচি। পায়েও এক ধরনের
শীতিলতা অনুভব করতেন। বালিশের উপর দুই পা রেখে আমাকে তাতে বসতে বলতেন। আমি তার
কথায় বসতাম ও হাত পা এসব টিপে দিতাম। কাছে শুয়ে আমি তার শরীর পর্যবেক্ষণ করতাম। শৈশবে
যে মাকে দেখেছি সেই মা এখন নেই। শরীরের কয়েকটি হাড় চামড়ার নিচে পড়ে আছে। তার ওজনহীন
দেহটাকে একটা লম্বাকার চিকন কোলবালিশ মনে হত।
২০০৭ সালের ২৪ নবেম্বর আব্বার
মৃত্যুর পর হতে আম্মা আমাদের সাগরদীঘির পারের বাসায় বসবাস করেন। আমার ছোটভাইও তার
বিয়ের আগ পর্যন্ত এই বাসায় থেকে জালালাবাদ গ্যাসে চাকুরি করত। আমার সৌভাগ্য মা-বাবাকে
আমি তাদের জীবনের শেষমূহুর্ত পর্যন্ত কাছে পাই। এই সৌভাগ্য কিন্তু অনেক লোকেরই
কপালে জুটেনা। প্রতিদিন আম্মাকে দেখতে অনেক আত্মীয় স্বজন আমার বাসায় আসতেন। বাসা
স্বজনদের পদচারণায় সর্বক্ষণ সরগরম থাকত। অফিসে কর্মব্যস্ত সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে
এক আনন্দঘন পরিবেশে সাতার দিতাম।
২০১০, ২০১১ এবং ২০১২ সাল এই
তিনটি বছর আমার মায়ের শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিলনা। একটার পর একটা শারিরীক বিপর্যয়
এসে তাকে নিদারূণ কষ্ট দেয়। বেশ কয়েকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। শরীরে বারবার
রক্তশূন্যতা দেখা দিলে আমি ও নিশাত বেশ কয়েকবার তাকে রক্ত প্রদান করে হয়ত বিন্দু
পরিমান মাতৃদুগ্ধের ঋণ শোধ করি। অসুস্থ্য হলেই রনকেলী হতে ছোট আপা মান্না এসে তার
খুব সেবাযত্ন করতেন। বড়বোন রেহার শরীর তখন খুব একটা ভাল যাচ্ছিলনা। অসুস্থ বড়বোন
রেহা আম্মার সেবাযত্ন করতে তেমন সক্ষম না হলেও প্রায়ই এসে মায়ের বিছানায় বসে
থাকতেন। তার এই বসে থাকাটা আম্মাকে খুব আনন্দ দিত ও তখন তিনি ভাল হয়ে যেতেন।
একবার মায়ের কাশী হয়, অবস্থা
গুরুতর হলে আমরা তাকে সেফওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলাম। এই হাসপাতালে আমার পত্নী ডাঃ
নুরজাহান বেগম চৌধুরী তার সার্জিক্যাল রোগীদেরকে ভর্তি করতেন। এখানে সবাই পরিচিত,
সেই সুবাদে তাকে প্রায়ই এখানেই ভর্তি করা হত। এবার আম্মার রোগ কমার কোন লক্ষণ দেখা
গেলনা। কাশি বেড়েই চলল। অধ্যাপক ডাঃ আব্দুর রকিব তার চিকিৎসা দিলেন। ঔষধ খাবার পর
তার ব্যামো দেখা দিত। অবস্থা এমন দাড়ালো যে কোন কিছু খাওয়ামাত্রই ব্যামো হয়ে
বেরিয়ে আসত। অবস্থা এমন হল যে তাকে উন্নত চিকিৎসায় ঢাকা নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন
উপায় ছিলনা। আবার ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার মত শারীরিক অবস্থাও নেই। আমি বিমানের চারটি
টিকেট কটলাম। এবার এই গুরুতর অসুস্থ্য রোগীকে বিমানে উঠায়ে দেবার দায়িত্ব নেন আমার
বেগমের মামাতো ভাই সিলেটের তখনকার সিভিল সার্জন ডাঃ আহমেদুর রেজা চৌধুরী। সিভিল
সার্জনের স্পেশাল এম্বুল্যান্স আম্মাকে নিয়ে সিলেট বিমান বন্দরের জরুরি গেটদিয়ে
ডুকে বিমানের সিড়ির কাছে গিয়ে থামল।
বিমানে আরোহণ করেই আমার
কর্মক্ষেত্র পুবালী ব্যাংকের দুইজন মনির আহমদ নামীয় পরিচালকের দেখা পাই। একজন
ভাদেশ্বরের এবং অন্যজন আমার আপনজন তুড়ুকখলার মনির আহমদ। ঢাকা বিমানবন্দর হতে
বেরিয়ে দেখতে পাই আমার ছোট সমনদিক আজিজ ভাই একটি এম্বুল্যান্স নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে
আছেন। এবার আমি একজন পরোপকারী মানুষের কথা বলব, তিনি আজিজ ভাইয়ের শ্বাশুড়ির চাচাতো
ভাই এডভোকেট সোয়েব আহমদ চৌধুরী। তার বাড়ি বিলগাও, পাগলা, সুনামগঞ্জ। তার মা আমার
চাচি করনশ্রী গ্রামের আজিমা খাতুন চৌধুরীর আপন চাচাতো বোন। বারডেম হাসপাতালে তার
বিশেষ হটলাইন ছিল। সেই সুবাধে তিনি আম্মাকে যখনই আমরা চিকিৎসায় ঢাকায় নিয়ে গেছি,
তিনি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে সাথে সাথে বারডেমে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতেন। আমরা তার
কাছে কৃতঞ্জ, তিনি সব কাজকর্ম ফেলে আমাদের জন্য বারডেমে ছুটে আসতেন। বর্তমানে তিনি
সপরিবারে যুক্তরাষ্টে বসবাস করছেন।
বারডেমের এগারতলায় একটি কেবিনে
আমরা স্থান পেলাম। সিলেটে চিকিৎসক যেইসব পরীক্ষা করেন, সেইসব টেষ্ট এখানে আবার করা
হয়। সিলেটে চেস্ট এক্সরে রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি। এখানে টেস্ট রিপোর্টে বলা হল
ফুসফুসে একটি ফোরা রয়েছে। এবার নতুন ঔষধ প্রয়োগ করা হল। তার স্বাস্থ্যের দ্রুত
উন্নতি হল। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সেরে উঠলেন ও ভাল হয়ে সিলেট ফিরে আসেন।
আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী
বললেন সিলেটে যে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল তা তার শরীরে রিএকশন করে এই নাজুক
শারীরিক অবস্থার জন্ম দিয়েছিল। জীবনের শেষদিকে এভাবে বেশ কয়েকবার তিনি এরকম নাজুক
অবস্থায় পড়লে তাকে আমি ঢাকা নিয়ে যাই। প্রতিবারই সব কাজ ফেলে রেখে তার সাথে যান
আমার বেগম ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ও ছোটবোন আনিছা চৌধুরী মান্না।
আম্মাকে বারডেমে নিয়ে এসে এখানে
এক নতুন বন্ধুর দেখা পাই। তবে সেই বন্ধু কোন লোক নয়, একটি গ্রন্থাগার, জাতীয়
গ্রন্থাগার শাহবাগ। এখানে নানান ভাসমান পাঠকের সাথে বসে বসে মজার মজার সব বই পড়ে
সময় কাটানোর সুযোগ নিতাম। একজন পাঠকের স্মৃতি আমার বেশ মনে আছে। মধ্যবয়েসী অগুছালো
একজন সাধারণ মানুষ। আমি কোন একটি বই এনে কাছে বসামাত্রই বইটির ভিতর কি আছে অনর্গল
বলে যান। আমি ভিতরে চোখ রেখে দেখলাম তার কথা বর্ণে বর্ণে সঠিক। বিষ্মিত হয়ে আমি
আরও বেশ কিছু বই তার সামনে হাজির করলাম। এবারও তিনি প্রতিটি বইয়ে হাত রেখে ভিতরে
কি কি মালামাল রয়েছে তার সঠিক খবরা খবর জানিয়ে দিলেন। তার জ্ঞানের এত ধার দেখে
আমার মনে হল লোকটি বেশভূষায় অতি সাধারণ মনে হলেও হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা
অতি উচ্চশিক্ষিত কেঊ হবেন। এবার ভদ্রলোকের লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি
বললেন ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি অকৃতদ্বার এবং সিএনজি বেবিট্যাক্সি
চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পুরান ঢাকার এই ভদ্রলোক আমাকে আর বললেন, সংসারহীন
মানুষ হিসাবে তার খরচপাতি তেমন নেই। টাক্সি চালিয়ে চলার মত টাকা বেরিয়ে আসলেই তিনি
এই পাঠাগারে ঢুকে পড়েন এবং বই পড়ে পড়ে সময় কাটিয়ে দেন। আসলে আমি ঢাকার জাতীয়
গ্রন্থাগারে এমন একজন সত্যিকারের গ্রন্থপ্রেমিকের দেখা পেলাম, যিনি এখানে জ্ঞানসাগরে
সাতার কেটেকেটে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজেকে একজন সবজান্তা মহাজ্ঞানীতে পরিণত
করেছেন। এই মহাজ্ঞানীকে কেউ চিনেনি, চেনার চেষ্টাও করেনি, এমনকি তিনিও নিজেকে
চিনতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ।
থাক এসব কথা, আবার আমার মায়ের
কথায় ফিরে এলাম। এত রোগ এত কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি আমার মায়ের ছিল হিমালয়ের
মত এক অবিচল বিশ্বাস। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তাকে এই খানিকটা শারীরিক
যন্ত্রনা দিয়ে তার ছোটখাট গোনাহ থাকলে তা সব মুছে দিচ্ছেন। তাই মহান আল্লাহর প্রতি
তার কোন অভিযোগ নেই, তিনি সুখে দুঃখে সব অবস্থায়ই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও
সন্তুষ্টি নিয়েই জীবন কাটান। তিনি প্রায়ই বলতেন মাতৃগর্ব হয়ে আজ পর্যন্ত আল্লাহ যে
নিয়ামত রহমত ও বরকত তাকে দিয়েছেন সে তুলনায় এই কষ্ট আর এমন কি? আমাদেরকে বিনামূল্য
আল্লাহ যে আলো, বাতাস, পানি ইত্যাদি জীবনভর দিয়ে যান তার দামও আমরা মানুষের পক্ষে
কোনদিন শোধ করা সম্ভব নয়। অথচ হাসপাতালে ভর্তি হলে আমরা ঘন্টায় হাজার টাকা দরে
অক্সিজেন কিনে বাঁচার চেষ্টা করি।
মা বলতেন আমাদের প্রাণ বছরের পর
বছর টিকে আছে হার্টের সামান্য ভাল্বের উপর যা আল্লাহ মাতৃগর্বে দান করে দেন। এসব
বানী শুনেশুনে আল্লাহের প্রতি সর্বাবস্থায় কৃতঞ্জ থাকার শিক্ষাটা আমার মায়ের কাছ
থেকে আমি গ্রহণ করি।
সর্বাবস্থায় আল্লাহের প্রতি নির্ভরশীল
থাকার শিক্ষাটাও এই একই জায়গায় পেয়েছি। বিপদে আপদে আম্মা আল্লাহের প্রতি সব সপে
দিয়ে নির্ভার হয়ে বিপদ উত্তরণে কাজ করে যেতেন। দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে সব চেয়ে
নিতেন, এযেন আপনজনের দরবারে নিজের সব অভাব অভিযোগ পেশ করে নিজেকে হালকা করে নেয়া।
আসমাউল হুসনা অর্থাৎ আল্লাহের নিরানব্বই নাম আম্মা প্রতিদিন জপ করতেন। আল্লাহের
নিরানব্বই নামের প্রতি এক অবিচল সুধারনা তাকে উপহার দিয়েছিল একটি সুখী শান্তিময়
আত্মসন্তুষ্ট জীবন, যে জীবনের কাছে রোগশোক, দুঃখকষ্ট সামান্য শিশির বিন্দু ছাড়া
কিছু নয়।
আম্মা প্রতিদিন বাদ জোহর সালাতুত
তাসবিহের সুদীর্ঘ্য নামাজ পড়তেন। এই চার রাকাত নামাজ পড়তে তার প্রায় অর্ধঘন্টা সময়
পেরিয়ে যেত। তিনি শেষরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত। আম্মার আরেকটি
স্বভাব ছিল তিনি হাত উঠায়ে প্রায়ই সশব্দে মিনতির সুরে সুদীর্ঘ্য মোনাজাত করতেন।
শেষরাতে তাহাজ্জুদ পরবর্তী সময়ে তিনি মোনাজাতে কাঁদতেন, সেই কান্না হালকা ঘুমের
মধ্যে আমার কর্ণকুহরে এসে হানা দিত। আল্লাহর দরবারে মুনাজাত কালে তার এই
কান্নাকাটি দেখে আমি মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম। এই কান্নার আমি কোন কারণ খুঁজে পেতাম
না। একদিন এই কান্না শোনে আমি বললাম, তুমি আর এমন কি পাপ করেছ যে আল্লাহর কাছে
হাউমাউ করে কাঁদতে হবে? এত কাঁদতে হবেনা, যে সামান্য টুকটাক পাপ আছে তা তোমার
ইবাদাতির ঠেলায় হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তার মুনাজাতের মধ্যে দুনিয়া আখেরাতের বিচিত্র
সব চাওয়া পাওয়ার সমাবেশ ঘটতো। ইমানের সাথে কলেমা পড়ে মউত, ভাল দিনে মরণ হওয়া, সকরাতুল
মউত ও গোর আজাব মাফ, হাশরের ঘাটপার, পুলসেরাতের সেতুপার, জান্নাতুল ফেরদাউস লাভ,
বিশেষ করে দোযখের আজাব হতে পরিত্রাণ, সন্থান ও ভাইবোনদের শুভকামনা, মরহুম মা-বাবার
গোনাহ মাফ ও জন্নাত কামনা, সবার জন্য দুনিয়া আখেরাতের মঙ্গলকামনা ইত্যাদি আবদারে
ভরা করুন সুরের কাতরকন্ঠ মুনাজাতে দীর্ঘ্য সময় পার হয়ে যেত। তিনি আরেকটি কথা
বললেন, মুনাজাতে হাত তুলে দুনিয়ার সব মুমিন মুমিনার জন্য দোয়া করতে হয়, নইলে
আল্লাহের কাছে এই লোক কৃপণ বান্দা হিসাবে গন্য হয়ে যায়।
একদিন তার সুদীর্ঘ্য মুনাজাত
সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বললাম, ছোট্ট বাচ্চাদের মত তুমি আল্লাহর কাছে এত
এত আবদার করছ যে আল্লাহ শুনতে শুনতে হয়ত বিরক্ত হয়ে যাবেন। মুনাজাত শেষ করে আমাকে
বললেন, আল্লাহের কোন কিছুরই অভাব নেই, তাই বান্দা যতকিছুই চায়না কেন তিনি বিরক্ত
হন না বরং খুশী হন।
মায়ের কাছে মুনাজাতে মকবুল নামে
একটি দোয়ার বই ছিল, এই বইটি পড়ে আমি আল্লাহর কাছে মানুষের কতকিছু যে চাওয়ার আছে
তার একটা সুদীর্ঘ ফর্দ আবিস্কার করলাম। এই বইটি পড়া না হলে আল্লাহর দরবারে কত বিষয়
যে চাওয়া যায় তা আমার জানা হতনা। কোন বারে, কোন মাসে, কোন রোগে, কিভাবে মৃত্যু হতে
হবে থেকে শুরু করে ইহকাল, পরকাল, এবং জীবন ও জগতের চাওয়া পাওয়ার এমন কিছু নেই যা
এখানে প্রার্থনা করার তালিকায় নেই। আম্মা গড়গড় করে এই দোয়ার বই পড়ে সাতদিনে এক খতম
করতেন। তাই আল্লাহর দরবারে পৃথিবীর যতসব বিচিত্র আবদার আছে সবই প্রতি সাপ্তাহে
একবার চাওয়া হয়ে যেত।
ডায়বেটিস ও কিডনি সমস্যার মধ্যে
একবার দেখা দিল আরেকটি নতুন সমস্যা, সেটি চোখের সমস্যা। চোখে তিনি চশমা পরে বহুদিন
ধরে কোরান, ওজিফা ও দলালুল খয়রাত তেলাওত করে আসছেন। এবার চশমায় কাজ হচ্ছেনা। একদিন
বললেন কোরান তেলাওত করতে না পারলে জীবনে বেচে থেকে লাভ কি? আমরা ডাক্তার দেখালে
কেটারেক্ট অপারেশনের কথা বললেন ডাক্তার। অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিসের জন্য তখন মায়ের
চক্ষু অপারেশন ঝুকিপূর্ণ। চক্ষু বিশেষঞ্জ ডাঃ সাখায়ত হোসেন একটি চোখ অপারেশন করলে
তার শারীরিক অবস্থার এমন অবনতি হল যে মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে চলে যান। পনের বিশ দিন
চিকিৎসার পর সেরে উঠলেন। এই চোখে তিনি যথেষ্ট দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কোরান
তেলাওয়ের কাজ এই চোখ দিয়েই চলল। প্রথম চোখ অপারেশনে আম্মার কষ্ট ও ঝুঁকি দেখে
দ্বিতীয় চোখটি অপারেশন করানোর সাহস করেন নি আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী।
আমার মায়ের জীবনের সাথে খুব
জড়িয়ে ছিল একটি শহর। হাওরের জলের ঢেউয়ের মধ্যে ভেসে থাকা সুরমাপারের নিরব শহর
সুনামগঞ্জ। ১৯৫৪ সালের ২৫ মার্চ বিয়ের পরই তিনি কোন একসময় চলে যান আব্বার
কর্মক্ষেত্রে এই মহকুমা শহরে। আব্বা ছিলেন সুনামগঞ্জ ভূমিরাজস্ব অফিসের কানুন গো।
এই জ্যুৎস্না প্লাবিত শহরের সুরমাপারে ছিল অফিস কাম বাসা। নদীর বুক চিরে জাহাজ,
স্টিমার ও পালটানা নৌকা চলার দৃশ্য তাকে বিমুগ্ধ করত। মা সুরমানদীর একটি জলচর
প্রানীর গল্প বলতেন। মাছের আকৃতির প্রাণীটকে একটি সুদীর্ঘ্য ‘হু’ শব্দ করে জল হতে
লাফ দিয়ে উপরের বাতাসে উঠে আবার জলে পড়ত। সুনামগঞ্জের মানুষের কাছে শুনে আম্মাও এই
জলজ মাছজাতীয় প্রাণীটির নাম বলতেন-‘হু’। বিষয়টি আমার মনে দাগ কাটে। আমি আম্মার এই
প্রাণীটির খোজখবর নিয়ে বিগতদিনে জানতে পারলাম এর নাম শুশুক, যা এক ধরনের মিঠাপানির
ডলফিন। এখন শুশুকের দেখা তেমন মেলেনা, এটা আজ বিরল প্রজাতির প্রাণী। আমি কিছুদিন
কুশিয়ারাপারের চন্দরপুর শাখার ব্যবস্থাপক ছিলাম, তখন ভাগ্যক্রমে পাশের নদীতে
আম্মার বর্ণিত এই জলজপ্রাণীকে সশব্দে লাফ দিয়ে উপরে উঠে আবার জলে তলিয়ে যেতে দেখি।
তখনই মনে পড়ে গেল এযে সুনামগঞ্জের সুরমানদীতে দেখা আমার মায়ের সেই ‘হু’ এর সাথে
ভাগ্যক্রমে আমারও যে দেখা হয়ে গেল।
এই সুনামগঞ্জে আমার বড় দুইবোনের
জন্ম হয়। এই বাসার আরেক চরিত্র ছিলেন আম্মার কালাভাই। মুরব্বী এই কালাভাই
সুনামগঞ্জ কানুন গো অফিসে পিয়নের কাজ করতেন। তিনি মাছ-মাংশ কাটা শাকসবজি বানানো
হতে শুরু করে রান্নাবান্না সব কাজে আম্মাকে সহায়তা করতেন। আম্মার কালাভাই আমার বড়
দুই বোনকে শৈশবে কোলেপিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আম্মা বলতেন সুনামগঞ্জের মানুষ গরুর
মাংশ খেতে জানতনা, তারা গরুর পায়া ফেলে দিত। আম্মা একদিন কালাভাইকে বললেন এই ফেলে
দেয়া পা নিয়ে আসতে। এবার কালাভাইকে দিয়ে গরুর পা ভালভাবে কেটে সাতকরা দিয়ে পায়া
রান্না করেন। আম্মার কালাভাই রান্নাকরা এই পায়া খেয়ে বললেন এত মজার খাবার তিনি আর
আগে কখনও খাননি।
মায়ের মুখে সুনামগঞ্জ যাত্রাপথের
যে বিবরণ শুনেছি তাতে মনে হয় উনিশ শ ষাটের দশকে সিলেট হতে সুনামগঞ্জ পৌছা আজকের
সিলেট হতে রাজধানী ঢাকায় পৌছার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন কাজ ছিল। সিলেট হতে ট্রেনে
কিংবা মুড়ির টিনমার্কা বাসে ছাতক পৌছে তারপর লঞ্চে করে সুনামগঞ্জ যেতে হত।
অন্যরুটে ছিল চারটি ফেরি, প্রতিটি ফেরি গাড়িসহ পার হয়ে সুনামগঞ্জ পৌছতে মোঠামুঠি
একটি পুরো দিন লেগে যেত। বাসও ছিল হাতেগুনা, ঘন্টাখানিক পরপর এক একটি বাস
আম্বরখানা বাস টার্মিনাল হতে সুনামগঞ্জ যাত্রা করত। সাতসকালে দাউদপুর হতে বের হয়ে
সিলেট শহরে এসে আম্বরখানায় বাসে চেপে সুনামগঞ্জ যেতে যেতে সন্ধ্যা গনিয়ে আসত।
একবার আমার বড়মামা মৌলভী মাহমুদুর রহমান চুঙ্গাপুড়া নিয়ে সুনামগঞ্জে বোনের বাসায়
যাবার জন্য ছাতকে এসে লঞ্চে ঊঠেন। তারসাথে উক্ত লঞ্চে ঊঠেন কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা।
তারা বাশের ভিতর আটালো বিরুন ভাত দেখে অবাক হয়ে যায়। উর্দুতে তারা এই বিষয় নিয়ে
বাক্যবানে মামাকে বেশ অতীষ্ট করে তুলে। বাশের ভিতরে ভাত এই পশ্চিমাদের চৌদ্দ পুরুষ
কেউ কখনও দেখেনি। বড়মামা সুনামগঞ্জের বাসায় এসে বললেন, পাঞ্জাবীদের প্রশ্নের জবাব
দিতে দিতে এতই বিরক্তি লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল এই চুঙ্গাপুড়ার আটি সুরমার জলে ছুড়ে
ফেলে দেই।
এসব সুদীর্ঘ্য যাত্রাপথে তাইয়ুম
করে বাসের ছিটে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করা হত বিভিন্ন ওয়াক্তের সফরকালীন সংক্ষিপ্ত
দুই রাকাত ফরজ কসর নামাজ।
শৈশবে নানাবাড়িতে আমরা সবাই যখন
জমায়েত হতাম, তখন মা, দুই খালা ও নানি একসাথে নামাজ পড়তেন। আমার এক শখের খেলা ছিল
তারা সেজদায় গেলে তাদের পীঠে চড়ে বসা। অনেক সময় মা ও খালাদের চেহারা প্রায় একই
হওয়ায় আমি প্রার্থক্য নিরূপন করতে পারতাম না। বিশেষ করে সেজদারতা ছোটখালাকে মা মনে
করে তার পিঠে লাফ দিতাম। পরে যখন ভ্রান্তি ধরা পড়ত বেশ লজ্জা পেতাম।
শৈশবে আমার মাঝে মাঝে জ্বর হত।
এই সর্দি জ্বর সাধারণত তিনচার দিনে ভাল হয়ে যেত। আমাদের জ্বর হলে মা অস্থির হয়ে
যেতেন। শরীর জ্বরে জ্বলে উঠলে মাথায় পানি ঢালতেন, টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে দিতেন।
কাছে বসে বসে কপাল ও মাথা ম্যাসাজ করতেন, সারা গায়ে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতেন।
পেটে পীড়া হলে ডাব খাওয়াতেন, রোগে খাবারে অরুচি হলে বার্লি, খিচুড়ি, সাগু ইত্যাদি
আলাদা রান্না করে আমাদের মুখে তুলে দিতেন। শৈশবে আমার একবার হাম হয়। সারাটা শরীরের
চামড়ায় ছোট ছোট অজস্র ফুস্কা হয়ে গাত্র লালবর্ণ ধারন করে। আমি গায়ের ব্যদনা এবং
চুলকানিতে অস্থির হয়ে পড়ি। আম্মা জায়নামাজে বসে উচ্চশব্দে কেদে কেদে আল্লাহর
দরবারে আমার রোগমুক্তির আবদার জানান। গরম পানিতে নিমপাতা সেদ্ধ করে সেই পানিতে
প্রতিদিন গোসল করাতেন। মা তখন আমার কাছে শুয়ে রাত জেগে সেবা করতেন। আজ বুঝতে পারি
সেই সময় বিভিন্ন রোগে আমার যতটা না কষ্ট হত, তারচেয়ে অনেক বেশী মানসিক কষ্ট হত
মায়ের। রোগ হলে আমার অনিষ্ট হবার চিন্তায় মা তখন ঘুমহীন রাত পার করে দিতেন। আমি
বয়স্ক হবার পরও আমার বিরহ জ্বালা তিনি
একদম সহ্য করতে পারতেন না। দুইচার দিন তার কাছ থেকে দূরে চলে গেলে অস্থিরতায় তার
রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত। ফিরে আসার পর বুকে জড়িয়ে স্নেহাদ্র কন্ঠে শক্ত একটা ধমক
দিতেন- কোন খোজ খবর নেই, এত দিন ছিলে কোথায়? এমনটি যেন আর না হয়। দাউদপুরের
পূর্বচৌধুরীবাড়ি এবং সেই বাড়ির সেই টিনের পাকাঘরটি আমার মায়ের এসব কীর্তিকলাপের
সাক্ষী হয়ে আজও ঠায় দাড়িয়ে আছে।
মুরগি যেমন পালকের নিচে তার
বাচ্চাদেরকে নিরাপদে আগলে রাখে আমার মাও তেমনই তার মায়াভরা আচলের নিচে আমাকে এই
দুঃখ সুখের যাপিত জীবনের একটানা আটচল্লিশ বছর জড়িয়ে রেখেছিলেন।
আমার বড়ই দুঃখ মায়ের জীবনের
গোধুলিবেলায় আমি খুব ব্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপনা করছি, বিশাল
বই প্রকাশ করছি, এমবিএ পড়ছি, ব্যবসা করছি। দুনিয়ার যত্তসব লাভালাভের জন্য আমি তখন
পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে বাসায় আমার অবস্থান কমে আসে। মা তখন বারবার অসুস্থ্য হন,
হাসপাতালে ভর্তি হন, আবার কিছুটা সেরে উঠে ফিরে আসেন। শত ব্যস্থতার মধ্যেও আমার
চিকিৎসক পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম তাকে বিরামহীন সেবা দিয়ে যান। আম্মার রক্তে
ক্রিটুমিন বেড়ে ৫/৬ মাত্রা পার হয়ে যায়। আমাদের আত্মীয় কিডনি বিশেষঞ্জ ডাঃ নাজমুস
সাকিব বলছেন কিছুদিনের মধ্যেই কিডনি ডায়লাইসিসের প্রয়োজন
হতে পারে। তিনি আম্মার হাতের শিরা কেটে ফিস্টুলা বসানোর পরামর্শ দেন। ফেস্টুলা
বসানো থাকলে প্রয়োজন হলেই কিডনি ডায়লাইসিস করা যাবে। আমি
অপেক্ষায় থাকলাম, আসুক নষ্ট সময়, তখন দেখা যাবে। আগেবাগে কেন হাতের রগ কেটে তাকে
অগ্রীম কষ্ট দিতে যাব। আর একজন চিকিৎসকের কাছে আমি দারূন ঋণী,
তিনি কিডনি বিশেষঞ্জ ডাঃ আলমগীর চৌধুরী। জকিগঞ্জের শাহবাগের সন্থান এই চিকিৎসক খুব
প্রাণবন্ত ব্যস্ত মানুষ। তিনি বড্ড রসিক, কথাবার্তায় লোক হাসান। আমরা তার কোন
আত্মীয় নই, অথচ সুতীব্র রোগীর ভীড়ে আম্মাকে দেখে কোনদিন তিনি কোন ভিজিট গ্রহণ
করেননি।
আম্মার শরীরটা তখন বর্ষার মনুর
বাঁধের অবস্থায় রূপ নেয়। যে বাধের একদিক মেরামত করলে অন্যদিক ধ্বসে যায়। সেইদিক
সামাল দিলে আরেক দিকে ফাটল ধরে। একসময় সবদিকই টালমাটাল হয়ে পড়ে। আম্মার শরীরে তাই
ঘটল। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে আসে না, তার উপর মরার উপর খড়ার ঘার
হয়ের একদিন তার নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হতে
আরম্ভ হল। শ্বাসমারের মত বেশ জুরে জুরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলেন। আমার মায়ের
শরীরে শত রোগ থাকলেও কোনদিন রক্তচাপ ছিল না। এই প্রথমবারের মত কিছুটা রক্তচাপও তার
এসে হানা দিল। নিউমুনিয়া প্রকট হলে যেমন হয় তেমনি একটা অবস্থায় আম্মা চলে গেলেন।
আমি প্রতিদিন পালঙ্কে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইতাম। তখন তিনি এতই দুর্বল ছিলেন
যে তাকে ধরেধরে বাথরুম ও ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যেতে হত। কথা বলতেও তার বেশ বেগ পেতে
হত।
আমরা কালবিলম্ব না করে আবার
সেফওয়ে হাসপাতালে তাকে ভর্তি করলাম। এবার তার চিকিৎসা করেন আমাদের নর্থ ইস্ট
মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক হৃদরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ ফারুক উদ্দিন এবং ডাঃ অশোক কুমার
কুন্ড। আমি বরইকান্দি শাখা হতে ফেরার পথে রাতে হাসপাতালে উঠে অনেকক্ষণ তার পাশে বসে
থাকতাম। একের পর এক আত্মীয়স্বজন তখন তাকে দেখতে আসতেন। আমার ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা,
বড়খালা জবা, ছোটবোন মান্না, বড়বোন রেহা ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার পত্নী ডাঃ
নুরজাহান এখানে বসে রইতেন। মা প্রায়ই হাসপাতালে আসতেন, আবার সুস্থ্য হয়ে ফিরে
যেতেন। আমি ভাবলাম এটিতো রূটিন ওয়ার্ক। অন্যবারের মত এবারও ভাল হয়ে ফিরে যাবেন।
কিন্তু আমার মায়ের এই সেফওয়ে হাসপাতালে এই যে তার শেষ আগমন তা আমি কল্পনাও করতে
পারি নি।
আমার পরিবার চিকিৎসক পরিবেষ্ঠিত
একটি পরিবার বলা যায়। বিশেষজ্ঞগণ আম্মার ডায়বেটিস, কিডনি ও চোখ নিয়েই এতদিন
ব্যাতিব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ করে তার হার্ট যে এত নষ্ট হয়ে গেল কেউ তার খবর পান নি।
নিয়মিত চেকআপেও হার্টের কোন দুর্বলতা ধরা পড়েনি। ফলে শেষমেষ কিডনি নয়, হৃদরোগই তার
যমদূত হয়ে হাজির হল।
এসময় আমার কাঁধে দুইটি দায়িত্ব
এসে হাজির হয়। একটি এমবিএ সেমিস্টার ফাইন্যাল পরীক্ষা এবং অন্যটি কক্সবাজারে
ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন। জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলনের তারিখ ছিল ৯ম ও ১০ম
ফেব্রুয়ারি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সম্মেলনে খুব আনন্দ হয়, খাওয়া
দাওয়া হয়, গানবাজনা হৈচৈ ফুর্তি হয়, সমুদ্র সৈকতে হাটাফেরা ও সমুদ্রস্নান করা হয়।
সবচেয়ে বড় পাওনা অতীতের অনেক সহকর্মীকে বহুদিন পর বুকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ হয়। অথচ এই
দিবস দুটি আম্মার মৃত্যু ও দাফনের এক গভীর শোকস্মৃতি হয়ে আমার বুকের গহীনে বিষাক্ত
বল্লমের ফলা হয়ে গেঁথে আছে।
শৈশব হতে মনে হত মা-বাবা আমার
অমর ও অক্ষয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসেও আমার তাই মনে
হত। মা আমার ভাল হয়ে বাসায় ফেরে আসবেন, এই ভাবনায় আমি সিলেটের ব্যবস্থাপকদের সাথে
সম্মিলিত ভাড়া করা কক্সবাজার যাবার একটি মাইক্রোবাস অগ্রিম বুক করি। সিলেট হতে
আমাদের মাইক্রোবাসের যাত্রার তারিখ ছিল ৭ম ফেব্রুয়ারি ২০১৩ রাত ৯ ঘটিকা। আগের দিন
৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আম্মাকে ফলো আপ করতে আসেন ডাঃ ফারুক উদ্দিন ভাই। তাকে বললাম,
দুদিন পর কক্সবাজারে আমার ব্যাংকের সম্মেলন, আমি কি যেতে পারি? এবার তিনি একটি ধমক
দিলেন, কি বলছেন এসব? তার হার্টের অবস্থা খুবই নাজুক, আপনি সিলেট হতে সরবেন না।
তার এই ধমক খেয়ে আমার মনটা আঁতকে উঠল, এক হিমঠান্ডা বরফের ছাই যেন কে আমার হৃদয়কে
চেপে ধরল। আম্মার যে এক অমর অজর সত্বা আমার মনে অঙ্কিত হয়ে আছে, তবে কি তা তিরোহিত
হতে যাচ্ছে। আমি বললাম, ভাল চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা নিয়ে যাই। ডাঃ ফারুক ভাই
বললেন রোগীর যে পজিশন তাকে এখন মোভ করানো যাবেনা। ভাগ্যক্রমে যদি একটু ভাল হয়ে
ওঠেন তাহলে নেয়ার চেষ্টা করবেন।
এবার আমি পুবালী ব্যাংকের
সিলেটের অঞ্চলপ্রধান মোসাদ্দিক চৌধুরী স্যারকে ফোন করে বললাম, স্যার আমার মায়ের
শরীর খুব খারাপ, আমি কক্সবাজার যেতে পারবনা। আমার পরিবর্তে বরইকান্দি শাখার
এসিস্টেন্ট কায়সার আহমদকে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়, কায়সার আগে কোনদিন কক্সবাজার
যায়নি। মোসাদ্দিক চৌধুরী স্যার প্রথমে বললেন, তা কেমন করে হয় আপনার নামতো নিশ্চিত
করা হয়ে গেছে। তারপর খুব কষ্টভরা মনে আমাকে সম্মতি দিলেন। এবার আমি কায়সারকে ফোন
করে আমার পরিবর্তে কক্সবাজার যাবার নির্দেশনা দিলে কায়সার খুশীতে আটকানা হয়ে আমার
বাসায় এসে ব্যাংকের ভিজিটবক্স ও অফিস অর্ডার নিয়ে যায়। কায়সার কক্সবাজার হতে ফিরে
এসে বলল, স্যার কক্সবাজার যে এত সুন্দর তা আগে বুঝতে পারিনি, নইলে কবে যে সেখানে
যেতাম।
কক্সবাজারে আমার বন্ধুরা যখন
আনন্দে, আমি তখন ভীষণ বিপদে। মায়ের কখন যে কি হয় এই শঙ্কায় আমার
চোখে মুখে ঘুম নেই।
আম্মা তার লন্ডনের পুত্র তাহমিদ
এবং কানাডা প্রবাসী কন্যা সেহার মুখখানি একটি বারের জন্য দেখতে উদগ্রীব হয়ে উঠেন।
অবশ্য লন্ডনের ভাইকে কিছুদিন আগে আমি ফোনে বলেছিলাম, আম্মার শরীর খুব একটা ভাল
যাচ্ছেনা, কখন কি হয় বলা যায়না। সম্ভব হলে একবার এসে শেষদেখা করে গেলে ভাল হয়।
কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। সেহা বছরখানেক আগে এসে দেখে যান। আমার ছোটভাই নিশাতের
শিশুকন্যা জাইমার প্রতি মায়ের এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। বারবার কেবল জাইমা জাইমা
করতেন। এই নাতনিকে মা পান তার পড়ন্ত বিকেলের খুবই ক্ষণকাল, তাই আল্লাহ হয়ত শিশু
জাইমার প্রতি তার অন্তরে এত স্নেহমমতা তৈরি করে দেন। শুক্রবার ও শনিবার ছুটি, এই
দুইটি দুঃসহ দিন সেফওয়ে হাসপাতালে মায়ের রোগশয্যার কাছে বসে কাটিয়ে দেই। তখন মায়ের
পাশে পাশে ছিলেন ভাগনা তাঞ্জির, তানভীর, হিমু, পুত্র জেফার, নিশাত, মান্না, রেহা,
ছোটখালা এবং বড়খালা। মায়ের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ফুসফুস যেন বাতাস টেনে নিতে
পারছে না। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসছে যন্ত্রণাময় অস্ফুট ঘরঘর আওয়াজ।
এত যন্ত্রণার মধ্যেও প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে শোনা গেল বেরিয়ে আসছে ‘আল্লাহু,
আল্লাহু’ জিকির। আত্মীয়রা এসে একে একে দেখে বিদায় নিচ্ছেন। সবার চোখে তখন আতংকের
জলছাপ।
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। শনিবার
সন্ধ্যা পর ছিল আমার এমবিএ পরীক্ষা। তাই আমাকে বাসায় দিনের বেলা কিছুটা পড়তে হল।
সন্ধ্যার পর বাগবাড়িতে অবস্থিত সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েই
আবার ছুটে গেলাম হাসপাতালে আম্মার রোগশয্যায়। শুক্রবার ছূটির দিন হওয়ায় দুইদিনের
রোগী জমে শনিবারে আমার পত্নীর চেম্বারে প্রচুর রোগীর ভীড় হয়। আমরা দুজন এক
শশব্যস্ত শনিবার পার করলাম। রাত বারটার পর আম্মার হাত পা ছুয়ে মাথায় হাত রেখে
বললাম আমরা আসি। মা কষ্টে কষ্টে বললেন, দিনে তোমাদের প্রচুর ডিউটি, যাও কালকে দেখা
হবে। পাশে বসা ছোটখালাও বললেন তোমরা বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নাও। হাসপাতালে আম্মার
কাছে পড়ে রইলেন অগ্রজা মান্না, অনুজ নিশাত ও ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা।
সেফওয়ে হাসপাতাল হতে পুত্র জেফার
ও বড়খালাকে নিয়ে এবার আমরা জেফার ভবনে ফিরে গেলাম। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতে না আসতেই
টেলিফোন পাই রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কাজের মেয়ে ছোটজরি আমাকে মৃদু
ঘুম হতে ডেকে তুলল। আমার লাল কারটি ড্রাইভ করে সবাইকে নিয়ে রাত দেড়টায় ছুটে গেলাম
হাসপাতালে আম্মার রোগশয্যায়।
আমি কখনও কোন মানুষের মরণযন্ত্রণা
খুব একটা মনযোগ দিয়ে দেখি নি। অথচ এবার আমার মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণা তার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় চোখে আমাকে দেখতে হল। মৃত্যুযন্ত্রণা যে কত কঠিন সে দিন আমি হাড়ে হাড়ে প্রত্যক্ষ করি। মা একবার বসাতে বলছেন,
আমরা ধরে বসালে আবার শুয়ে যেতে চাইছেন। শুয়া হতে আবার বসার জন্য ইশারা করছেন।
প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে আসছে। এক একটি নিঃশ্বাস নিতে যেন তার
শতবর্ষ পার হচ্ছে। কথাবলা থেমে গেছে, ঠোটে কেবল অস্ফুট মৃদু আল্লাহু আল্লাহু শব্দ
লেগে আছে। মা উত্তর শির হতে চাইলেন। আমরা তার শিয়র উত্তরদিক করলাম। পশ্চিমে কিবলা
কাবার দিকে মা তার বদন ফিরিয়ে নিলেন। আল্লাহের নাম জপে জপে নির্ভিকচিত্তে আম্মা
পরপারে পারি দেবার জন্য যেন প্রস্তুতি নেন। এটাইতো একজন খাঁটি মুমিনা বান্দার আলামত।
আমার দুই খালাম্মা জবা ও মরিয়ম মায়ের পাশে বসে তার কানের কাছে কলেমা শুনাচ্ছেন। অগ্রজা মান্না ও রেহা চোখ মুছেমুছে স্রষ্টার জিকির করছেন। অনুজ নিশাতের অসহায় চাহনি। বাল্যকালে আমি সুরা ইয়াসিন মুখস্ত করি। আমি তখন তারাবি নামাজের হাফিজদের মত বেশ জুরে জুরে সুরা ইয়াসিন মুখস্ত পড়তে থাকি। একসময় আম্মার নাড়াচড়া কমে আসে। আমি পায়ে হাত দিয়ে দেখলাম পা দুটি হিমঠান্ডা হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে নিঃশ্বাসের লাফালাফি মিলিয়ে আসছে। চোখদুটির মনি স্থির হয়ে যাচ্ছে। ডাঃ নুরজাহান ব্লাডপ্রেসার খুঁজে পাচ্ছেন না। এবার মায়ের ঠোট মৃদু কেঁপে উঠলো। আমরা সুস্পষ্ট শোনলাম তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা বললেন মায়ের
পেঠের ভিতর হতে দুনিয়ায় গ্রহণ করা শেষ খাদ্য ও পানীয় সব বেরিয়ে এসেছে। এবার আমার
চিকিৎসক বেগম সাহেবা আম্মার পালসে হাত রেখে বললেন পালসও আর তেমন অনুভব করা
যাচ্ছেনা। আম্মা চুপে চুপে নিস্থব্দ হয়ে গেলেন, তখন নেমে এল কিয়ামত দিবসের এক
প্রগাঢ় অন্ধকার। আমার মনে হল মায়ের প্রাণটা যেন ধিরলয়ে দেহখাচা
হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই ঠোটের মাঝদিয়ে বেরিয়ে আকাশে আল্লাহের মাঝে চিরকালের জন্য
মিশে গেল। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহির রাজেউন’।
ছোটখালা নিচের নষ্ট বেডকাভার
টেনে পাশের গার্বেজে ছূড়ে ফেললেন। বড়খালা সাদা চাদরে আম্মার মুখটা ঢেকে দিলেন। কে
যেন তখন ঘড়ি দেখে বললেন রাত তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট। মনে পড়ে গেল আম্মা শেষরাতের
যে সময়টিতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে প্রভূর দরবারে কান্নাকাটি করতেন, এই সেই সময়টিতে
তিনি তার প্রভুর সাহ্নিধ্যে চলে গেলেন।
মায়ের মৃত্যুশোক মুহুর্তেই এক
বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত আমাদের হৃদয়ে এসে প্রবল আঘাত হানলো। আমরা সবাই এবার ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম- বেশ
জুরেই কাদলাম, কেঁদে যদি একটু শান্তি পাই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, শোকানলে
জ্বলেপুড়ে আমরা ছারখার হয়ে যাচ্ছি প্রভু! দয়া কর, রক্ষা কর আর যে সহ্য হয় না। আজ
আমাদের প্রিয়তম মা আমাদের মাঝে নেই। এই যে মূহুর্তের মধ্যে চিরদিনের মত তিনি বিদায়
নিলেন পিছনে ফেলে রেখে তার প্রিয় ভ্রাতা ভগ্নি পুত্র কন্যা নাতি নাতনি সহায়
সম্পত্তি সংসার, বিদায় নিলেন এতদিনের তার জমানো সব স্নেহ-মায়া-মমতা ভালবাসা মাটির
এ ধরাধামে চিরবিসর্জন দিয়ে। এযেন নিয়তির এক নিষ্টুর পরিহাস, মাত্র তিয়াত্তুর বছর
বয়সে তার এই মৃত্যুতে ঢাকা, সিলেট, দাউদপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ক্যানাডায় তার
সব পরিচিতজনকে স্থব্দ করে দেয়। বড় করুণ, বড় নির্মম এই বিদায় ! কি করুন, কি অসহনীয়
এই বিয়োগ ব্যথা। এই শোকের কঠোর ও নিষ্টুর আঘাতে মনটা যেন কাচের মত ভেঙ্গে চৌচির
হয়ে যায়। মনেহল সেইদিন আকাশে বাতাসে যেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কেবল বেদনার
সুর, বিষাদের সুর।
মা আমার এইমাত্র চলে গেলেন, তাকে
নিয়ে কত কথা মনে পড়ে যায়, স্মৃতি রোমান্তন হয় হৃদয়ের গভীর গহীনে- সব কথা আজ ব্যথা
হয়ে ভেসে বেড়ায় মনের আঙিনায়। শৈশব হতে আনন্দের অতিশয্যে দিশেহারা হয়ে কত যে মায়ের
কোলে আশ্রয় নিতাম, মাকে কেন্দ্র করে আমরা ছয় ভাইবোন মিলে হারিয়ে যেতাম রূপকথার
কল্পলোকে। সেই আত্মিক সম্পর্ক ছিল হিমালয়ের মত অটল অবিচল। মা তার মন উজাড় করে দিয়ে
ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের কল্যানে আমাদের শুভচিন্তায়
আমাদের কাজে পার করে দেন। আজ মায়ের সাথে কাটিয়ে দেওয়া সেই সুদীর্ঘ্য দিনগুলো যেন
স্মৃতি হয়ে গেল। মায়ের সাথে সেই উচ্ছাসময় সুখানন্দে ভরা দিনগুলোর স্মৃতি চির
অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের মনের মানস কোঠায়। আর হারিয়ে যাওয়া বিদায় নেওয়া দিনের
স্মৃতিকে আকড়ে ধরে কেটে যাবে আমাদের জীবনের বাকি সব দিনগুলো।
জানি আমাদের সবাইকে বিদায় নিতে
হবে এই অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে, হ্যা সেই একই পথ ধরে হাটছি আমরা সবাই পাড়ি দিতে
পরপারে।
‘মৃত্যুই চিরন্তন সত্য’- এই সহজ
সত্য কথাটাকে কেন জানি আমরা সহজভাবে নিতে পারিনা। আর পারিনা বলেই অসহনীয় যন্ত্রণায়
বুক ছটফট করে, আঘাতে আঘাতে বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আগুনের লেলিহান শিখার মত
জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় এই হৃদয়খানি। সব জানি সব বুঝি তারপরও কেন আমার মনটা
বহুদিন মাতৃশোকে অশান্ত হয়ে কেবল জ্বলতে থাকে।
৯ আগস্ট ২০১৩ শেষরাতে আম্মা
অসহ্য ব্যদনায় ছটফট করছেন, বাকরোদ্ধ কন্ঠ, অসহ্য যন্ত্রণার মঝে তার সেই করুন ও
অসহায় চাহনি মনে হলে আমার অন্তরাত্মা আজও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। নীরবে নিভৃতে
বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত বহুদিন দুই চোখের সীমানা উপচে নেমে আসত জল। এই শোক-দুঃখ
ব্যথা-ব্যদনা আর শত আর্তনাদের মাঝে শান্তি পাই, স্বস্তি পাই এই ভেবে যে দুঃসহ
জ্বালা আর যন্ত্রণার মধ্যেও তিনি পূত্র কন্যা নাতি নাতনি পরিজন পরিবেষ্টিত থেকে
দুনিয়ার মায়াজালকে ছিন্ন করে যেন পূর্ণভাবে নিজেকে আত্মসমর্পিত করলেন রব্বুল
আলামিনের করতলে। প্রাণের আকুতি আর গভীর প্রত্যয় নিয়ে ডাকছিলেন মহান
আল্লাহতায়ালাকে। শেষ মূহূর্তেও তার মুখে জারি ছিল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক, জন্ম
মৃত্যুর মালিক আল্লাহপাকের পবিত্র নাম। মধ্যরাতের পর আমার উচ্চস্বরে মুখস্ত সুরা
ইয়াসিন পাঠ তিনি নিবিষ্ট মনে শুনছিলেন। মা আমার কলিমা পাঠ করে নিজেকে সমর্পণ করে দিলেন আল্লাহ তায়ালার পাক দরবারে। মহান আল্লাহের নাম জপমালা করে
নির্ভিক চিত্তে পরপারে পাড়ি দেবার এই দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে আমার বিশ্বাস করতে
দ্বিধা হত। তার এই ঈমানি যাত্রা দেখে আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে গেল। এটাই তো নেকগার
বান্দার আলামত।
আম্মার প্রাণহীন দেহটাকে আমরা হাসপাতালে খুব একটা বেশিক্ষণ রাখি নি।
কালবিলম্ব না করে নিয়ে যাই সাগরদিঘিপারের বাসায়, জেফার ভবনে। মুহুর্তের মধ্যে তার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। রাত
পোহাতেই বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত স্বজন-বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা ছুটে এলো জেফার ভবনে।
স্বজন হারা ব্যদনায় সবাই কাঁদছে, পুত্র কাঁদছে, কন্যা কাঁদছে, ভাই বোনেরা কাঁদছে,
নাতি নাতনিরা কাঁদছে, কাঁদছেন বাসায় আসা সব আত্মীয় অনাত্মীয়। আশপাশের লোকজন করুন
নয়নে জল ছলছল চোখে অবলোকন করল এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দুখের দহনে করুণ রোদনে জেফার ভবন ও এর আশপাশ এলাকা যেন বিষাদপুরীতে পরিণত হল। বাসায় আসা স্বজনদের ‘এই ব্যথাতুর আঁখি, কাঁদো কাঁদো মুখ-/ দেখি আর
শুধু হু হু করে বুক’। না, আমি আর লিখতে পারছি না, আমার চোখ যে ঝাপসা হয়ে আসছে
রোদনে।
আমার মা আজ একজন ভি আই পি। তাকে
দেখতে আজ এত এত মানুষ আমার বাসায় ছুটে আসছেন। সবাই হৃদয় উজাড় করে চোখের জলে বুক
ভাসিয়ে আমার মায়ের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করছেন। কিছুদিন আগেও মাকে বলতে শুনেছি- আমি
মৃত্যুকে ভয় করি না, কি নিয়ে আমি পরপারে পাড়ি দেবো সেই শঙ্কায় সেই ভয়ে কেবল বিচলিত
আছি। এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মাঝে নিঃশেষ হল আমার পরম ধার্মিকা পিরানী মায়ের জীবনের
শেষ দিনগুলো।
মৃত্যুর ভয়ে ভীত ছিলেন না আমার
মা- তাহলে কিসের ভয় ছিল তার মনে? সেই ভয় আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ে তারাইতো বিচলিত
হয় যারা তার প্রিয়জন।
মায়ের পবিত্র দেহটা ছিল বাসার বড়
কক্ষে। আম্মা আব্বা তাদের জীবনের শেষবেলা এইকক্ষে অনেকগুলো দিন কাটান। আমাদের
শোবার কক্ষে এসি না লাগিয়েও আমি বৃদ্ধ মা-বাবার আরামের জন্য অনেক আগে একোঠায়
এয়ারকন্ডশন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এয়ারকন্ডিশন চালু রাখলাম সারাক্ষণ, ভাবটা এমন মা আমার এসির শীতল বাতাসটা যেন খেয়ে যান শেষমেষ।
সকাল ৮/৯ ঘটিকায় মাকে গোসল
করানোর জন্য আমরা ধরাধরি করে বাসার গ্লাসঘেরা উত্তর-পশ্চিম কক্ষে নিয়ে আসলাম। এই
কক্ষের একপাশে পর্দা টানিয়ে গোসলের ছোট্ট চৌকি রাখা হল। এবার আম্মার লাশ আমরা সবাই
ধরাধরি করে পর্দার ভিতরে নিয়ে আসলাম। ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা, আম্মার মামাতো বোন
গিনিখালা, ছোট আপা মান্না, এলি আপা, কলি আপা, তসকিয়া ভাবীসহ কয়েকজন আত্মীয় মহিলা
এবং কাজের লোক ছামিনা, সেনুরা ও জরি আম্মার শেষ গোসল খুব সুন্দরভাবে সমাধা করলেন।
আম্মা ফরজ হজ্জ পালনকালে নিজের জন্য মক্কাশরিফ হতে কাফনের কাপড় নিয়ে
এসেছিলেন। ছোটখালা ও গীনিখালা অতি সযতনে আম্মাকে এই কাফনের সাদা কাপড় পরিয়ে দিলেন।
এই কক্ষের পালঙ্কে আম্মাকে কাফনে জড়িয়ে ঘুমিয়ে রাখা হল। ধুনার সুগন্ধ ও আতর
গোলাপের খুশবে কক্ষটি ভরে গেল।
বাসায় মেহমানরা গিজগিজ করছেন,
বহুকাল দেখা হয় নি এমন আত্মীয়স্বজনকেও দেখলাম। আম্মাকে একনজর দেখার জন্য চাতক
পাখির মত তারা কফিনের চারপাশে ঘুরঘুর করছেন। মায়ের চারপাশ ঘিরে আত্মীয়া মহিলাগন
দোয়া দুরুদ পড়ছেন। গোসল দেওয়ার পর আবার আম্মাকে দেখতে গেলাম। আমি যেতেই জলি আপা
আম্মার মুখের উপর হতে কাফনের কাপড় সরিয়ে দিলেন। আমার সামনে প্রকাশিত হল আমার মায়ের
অপূর্ব সুন্দর চাঁদবদন, বেরিয়ে এলো এক বেহেশতি চেহারা। দুগ্ধবরণ চেহারায় যেন আল্লাহর নুর চমকাচ্ছে। আমার মাকে আমি এত সুন্দর জীবনের
কোনদিন দেখি নি।
মায়ের হিমশীতল কপালে জুড়িয়ে
দিলাম জীবনের শেষ চুম্বন। শৈশবে মায়ের কূলে বসে তার গালে অনেক অনেক চুমু খেয়েছি,
সেই চুমু ছিল নিস্পাপ এক আপত্য স্নেহের, এক দুর্বার আনন্দের। আমার সেই শৈশব আর
নেই, আজকে পরিণত বয়সে মায়ের কপালে আকা এই শেষ চুম্বন আমার হৃদয়রাজ্যে রচনা করে দিল
এক শোকের মহাকাব্য, বিষাদের মহাসাগর। দুচোখ হয়ে গেল যেন মাধবকুন্ডের জলপ্রপাতের এক
অবিশ্রান্ত ঝরনাধারা। খুব গরমে যেমন প্রকৃতিতে বৃষ্টি নামে তেমনি এই দুঃখের অসহ্য
দহনে একটু স্বস্তি দিতে নয়নে নেমে এলো নোনাবৃষ্টির জল।
এবার মায়ের বড়ই স্নেহের বোনপো
মাহবুব আহমদ চৌধুরী ওরফে বুলবুল ভাই আবেগে কাতর হয়ে এক সুদীর্ঘ্য মুনাজাত পরিচালনা
করলেন। মহান আল্লাহর দরবারে আমরা সব নরনারী সম্মিলিত হাত তুললাম। এবার চোখের জলে
বুক ভাসিয়ে পরম করুনাময় আল্লাহপাকের দরবারে সবাই মিলে আহাজারি করলো ফরিয়াদ জানালো-
আমার মাকে যেন দয়াময় মার্জনা করে দেন, জান্নাতুল ফেরদাউস চিরস্থায়ী ঠিকানা করে দেন।
বুলবুল ভাই এক দারুন বেদনাবিধুর অর্থবহ দোয়াইনা করলেন। আকুতি আর মিনতিভরা কন্ঠে
তার এই মুনাজাত এক সময় মাতম ধ্বনীতে পরিনত হল। অবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই অঝুরে
কাঁদলেন। সেদিন বুঝলাম আমার মাকে তারা কতটুকুনা ভালবাসত, কতটুকুনা তিনি জয় করে
নিয়েছিলেন সকলের মন। এটাইতো আমার মায়ের জীবনের এক বড় সার্থকতা।
সিলেটে অবস্থানরত আমাদের বংশের
লোকজনের সাধারণত দুইবার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সিন্ধান্ত হল মায়ের প্রথম জানাজা হবে
জোহরের জামাতের পর মহান ওলিআল্লাহ হজরত শাহ জালালের(রহঃ) দরগায় এবং দ্বিতীয়
জানাজাটি হবে দাউদপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে। জানাজার সময় ঘনিয়ে আসছে। বাসা
হতে মাকে বের করার সময় গনিয়ে এলো- আবার বাসায় সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সারিবদ্ধ
ভাবে গাড়ির বহর আম্মার লাশবাহী এম্বুল্যান্সের পিছুপিছু ছুটে উপনীত হল প্রায় এক
কিলোমিটার দূরে হজরত শাহ জালালের(রহঃ) দরগায়। দরগাহ মসজিদের পশ্চিমে জানাজার জন্য
রয়েছে মুর্দা রাখার ঘর। এই মুর্দাঘরে পাঁচ বছর আগে ২৪ নভেম্বর ২০০৮ সালে নিয়ে
এসেছিলাম আমার প্রিয় পিতার লাশ, আর আজ জানাজার জন্য এখানে নিয়ে আসলাম প্রাণের
চেয়েও প্রিয় মাকে। শহরের আত্মীয় পরিচিতরা এখানে জানাজায় শরিক হন। আমার পূবালী
ব্যাংকের অনেকেও এখানে আসতে দেখলাম। জোহরের ফরজ নামাজ শেষ হওয়ামাত্রই দেড়দুই হাজার
মুসল্লি জানাজার নামাজ আদায় করার জন্য স্বস্বস্থানে দাড়িয়ে যান। আমি, তারেক ভাই,
বুলবুল ভাই ও নিশাত দাউদপুরের জানাজা জামাতে শরিক হবার জন্য এখানে জানাজা হতে বিরত
রইলাম। দাউদপুর যাবেন না শহরের এমন সব আত্মীয় পরিজনরা এখানেই জানাজায় শরিক হলেন।
এখন আম্মা তার বাড়ি ফিরবেন, সেই
বাড়ি যে বাড়িতে নববধু হয়ে এসেছিলেন প্রায় আটান্ন বছর আগে ২৫ মার্চ ১৯৫৪
খ্রিস্টাব্দে। এই সেই বাড়ি সেই ঘর যেখানে ছড়িয়ে আছে সাত সন্থান প্রতিপালনের অনেক
কাহিনি, যেখানে প্রতিটি ধুলিকনায় মিশে আছে তার সুখ দুঃখ, আনন্দ ব্যদনার অজস্র
স্মৃতিমালা। ১০ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল, বিশ্ববিখ্যাত দরবেশ হজরত শাহজালালের(রহঃ)
মসজিদে জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষ হলে মায়ের কফিন সবাই ধরাধরি করে আবার নিয়ে
আসেন এম্বুলেন্সে। এবার সারিবদ্ধভাবে গাড়িরবহর কফিনের পিছুপিছু ছুটে এগিয়ে যায় আট
মাইল দূরে দক্ষিন সুরমা উপজেলা অফিসের পুর্বদিকে দাউদপুর গ্রামে। দাউদপুর
পুর্বচৌধুরী বাড়ি, বাড়িতে আছেন আমার কয়েকঘর চাচাতো ভাইয়ের পরিবার। আমাদের ঘর
জনশূন্য, আমরা সবাই জীবনযুদ্ধে বাহিরে। এক সময়ের জমজমাট ঘরটি আজ শূন্য ভিটে।
মানুষের অভাবে যেন খা খা করছে। বাড়ির সেবায়েত শহিদ আমাদের আগমন উপলক্ষে যতটুকু
সম্ভব ঘরদোর পরিস্কার করে রাখে।
বহুদিন পর মাকে নিয়ে আমাদের
বাড়িফেরা, ধানতুলার মৌসুম শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে মাটিলেপা উঠোনে এখনও তেমন গজায়নি
ঘাস। কিছু ধানের খড় এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উঠোনের প্রান্তজুড়ে দুএকটা হলুদ
গাদাফুলের বাস। পাশের বরইগাছ ফলে নুয়ে রয়েছে। সদ্য শীতশেষে বসন্ত সমাগত। বাড়ির আম,
জাম, লিচুগাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। মক্ষিকার গুনগুন সুর কানে আসছে। ছাতিম গাছের
সাদাফুল বাতাসে সুবাস ছড়াচ্ছে। পশ্চিমের বাশবনে করুন সুরে ঘুঘুরা গান গাইছে। বড়
পুকুর পারের শিমুল গাছটা গাঢ়লাল হয়ে যেন জ্বলছে। হ্যা মা বলতেন শিমুল ফুল যে বছর
যত বেশি গাঢ় লাল হয়, সে বছর তত বেশি গরম পড়ে। পুকুরপারের কৃষ্ণচূড়া সারি হতে
দুইচারটা রক্তকলি বের হয়ে বসন্তের শুভবার্তা জানান দিচ্ছে।
আম্মার কফিনবাহী গাড়ি সোজা বাড়ির
উঠোনে চলে গেল। আম্মা শেষবারের মত তার ঘরে ঢুকলেন নিথর শরীরে। আগেই বাড়ির আঙ্গিনা
ছিল লোকে লোকারন্য। গ্রামের মহিলারা চোখ মুছতে মুছতে বলাবলি করলেন, মাইঝি মরেননি,
আসলে আমরাই মরেছি। আজ থেকে আমরা এতিম হয়ে গেলাম। আমাদের সবার আশ্রয় শেষ হয়ে গেল।
সামনের বড় কক্ষে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে নারী ও শিশুরা আম্মার মুখ দেখলেন। কলিমা শাহাদাত
পড়ে পড়ে তারা অশ্রুসজল চোখে বেরিয়ে আসলেন। এবার সকলের মুখে শুনা গেল আম্মার
প্রশংসার কথা, সবার প্রতি তার সহানুভূতি আর সহমর্মিতার কথা। মায়ের অকৃত্রিম ভাল
লাগা আর ভালবাসার কথা ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র, সবখানে। সবার মন যে তিনি কতটুকু জয় করে
নিয়েছিলেন তা তো তার জীবদ্দশায় আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারিনি। মনে মনে উচ্চারন
করলাম মধুকবি মাইকেল মদুসুধন দত্তের অমর সেই পঙক্তি- ‘জন্মিলে মরিতে হবে, কে কোথা
অমর কবে? চিরস্থির করে নীড় হায়রে জীবন নদে?/ সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি
ভূলে, মনের মন্দিরে যারে সেবে সর্বজন’।
ফজর ও জোহরের নামাজের পর দাউদপুর
জামে মসজিদ হতে ঘোষনা হল ঐ দিন আসরের জামাতের পর মসজিদ সংলগ্ন ঈদগায় আম্মার নামাজে
জানাজা অনুষ্টিত হবে। আসরের নামাজের সময় গনিয়ে আসছে। এবার এই বাড়ি ছেড়ে আম্মার
চিরবিদায়ের সময় এসে গেল। আম্মার সোনামুখটি কাফনের কাপড়ে চিরআবৃত করামাত্র আবার
সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কেদে কেদে সবাই আম্মার মাগফেরাতের জন্য আবেদন জানালো
পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে। বিরহের সুরে মনটা চিৎকার করে কয়- বুক ফেটে যায়, তবুও দিতে
হবে বিদায়। তখন সান্তনার বানী হয়ে কন্ঠে আসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার
লাইন- ‘এ অনন্ত চরাচরে, স্বর্গ মর্ত ছেয়ে, সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর
ক্রন্দন, যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’।
আমাদের মসজিদে ছিল বিশেষভাবে
কাস্টনির্মিত একটি লাশবহনের খাটিয়া। সিলেটের মানুষ এই খাটিয়াকে বলতো ‘করাল’। এবার আম্মাকে
এই করালে উঠানো হল। আবার বাড়িভর্তি প্রিয়জনদের বুকের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে আকাশ
বাতাস ভারি হয়ে গেল। কেউকেউ উচ্চশব্দে ভেঙ্গে পরলেন কান্নায়। উপস্থিত সবার চোখ
বেয়ে বৃষ্টির মত টপ টপ করে অশ্রু ঝরল- এমনই যন্ত্রনার কিছুক্ষণ চলে গেল
নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতায়। এবার করাল কাধে তুলে নেই আমরা সবাই। মিছিল সহকারে এসে
ঈদগাহের পশ্চিম প্রান্তে জানাজার জন্য রাখা হল তাকে। আসরের জামাতের পর হাজার দেড়েক
মুছল্লি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন জানাজায়। জানাজা পড়ালেন সেই সময়ের জামে
মসজিদের ইমাম হাফিজ মৌলানা আসকর আলী, ঠিকানাঃ চানপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ। জানাজার পর
জামাতের সামনে দাড়িয়ে আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, আমার আম্মা কিংবা আব্বা যদি
কোনদিন নিজের অজান্তে কিংবা অসাবধানতায় কাউকে কোন দুঃখ কিংবা মনোকষ্ট দিয়ে থাকেন
তাহলে নিজগুণে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদের কাছে কারও কোন পাওনা কিংবা দাবি দাওয়া
থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। কিন্তু কোন অভিযোগকারী কিংবা পাওনাদার পাওয়া গেলনা।
পাশে কে একজন বললেন, মায়েতার আমল
আখলাক কেমন ছিল? লোকজন উচ্চশব্দে সমস্বরে স্বাক্ষি দিলেন ‘খুব ভাল’।
তখন বিকেল প্রায় সাড়ে পাচটা।
সদ্য বসন্তের হালকা শীতল আবহাওয়া। চারপাশে বসন্তি বাতাস বইছে। নামাজান্তে আমরা
আবার করাল কাঁধে তুলে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে গেলাম দাউদপুর জামে মসজিদের সামনে
দাউদপুর মাদ্রাসা সংলগ্ন শান্ত-স্নিগ্ধ-ছায়াঘেরা আমাদের পুর্ব চৌধুরীবাড়ির
পারিবারিক গোরস্থানে। তখন শতকন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল কলেমা শাহাদতের বানী-‘আশহাদু
আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লাশরিকালাহু ওয়াশাদু আন্না মুহাম্মদান আব্দুহু
ও রাসুলুহু’। আমাদের গোরস্থানের গাঘেষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভুমিতে দাড়িয়ে
আছে হজরত শাহজালালের(রহঃ) সহচর বিখ্যাত দরবেশ হজরত শাহদাউদ কুরেশীর(রহঃ) পবিত্র
মাজার শরিফ ও মাজার মসজিদ। এই পুত পবিত্র মাজারের ওসিলায় আমাদের এই গোরস্থান দিনভর
অনবরতঃ জেয়ারত করে যান অজস্র পুন্যার্থী লোকজন।
আম্মার কবরটি খনন করেন চারজন।
প্রথমজন লালই পুতির ছেলে তসব্বির আলী, যিনি বাল্যকালে আমাকে কাঁধে তুলে ঘুরে
বেড়াতেন। দ্বিতীয়জন আমার অগ্রজের খেলার সাথী গেদন আলীর পুত্র আলখাস আলী, তৃতীয়জন
আমাদের পাড়ার মনাই আলীর পুত্র মুতলিব আলী এবং চতুর্থ জন আমাদের কুনারপাড়ার আব্দুল
খালিক। তাদেরকে সহায়তা করেন মনাই আলীর আরেক পুত্র শহিদ আলী।
একজন বললেন কবরটা এত সুন্দর
হয়েছে যে মনে হচ্ছে এযেন এক টুকরো বেহেশত। অন্যজন বললেন, এ কবর হতে যেন আল্লাহর
নুর বেরুচ্ছে। আরেকজন গ্রামবাসী বললেন, কবরটা যেন হাসছে। আমার গাঁয়ের সহজ সরল
মানুষের মুখে কবরের হাসির গল্প শুনে এই দারুন শোকের মুহুর্তেও মনের গহীনে ঈষৎ হাসি
পেল।
পাঁচ বছর আগে ২৪ নবেম্বর ২০০৮
সালের হেমন্তকালের সন্ধ্যায় এই সদ্য খননকৃত কবরের ঠিক পশ্চিমের কবরটিতে আমি নিজে
নেমে আমার জনক সফিকুর রহমান চৌধুরীকে শুইয়ে দেই। আর আজ ১০ ডিসেম্বের ২০১৩ সালের
বসন্তকালের এই স্বর্নালী সন্ধ্যায় আমার জন্মদাত্রি জননী আসমতুন্নেছা চৌধুরীকে তার
পাশে এই কবরে চিরকালের ঘুম পাড়িয়ে দিতে এসেছি। এবার আমি আবার এই সাড়ে তিন হাত গভীর
মাটির খোলা কবরে নামি, আমার সাথে কবরে নামে ছোটভাই নিশাত এবং বড়ভাগ্না লবিদ। পর্দা
দিয়ে ঢাকা করাল হতে কয়েকজন আমাদের দিকে লাশ এগিয়ে দেন। আমরা তিনজন কাপনপরা মাকে
সযতনে ঘুম পাড়িয়ে দেই কোদালে মসৃন করা মাটির বিছানায়। মাটির ঘরের চালায় আমাদের
বাশঝাড়ের বাস বসানো হল। তারপর বাশের উপর দ্বিস্থরে বসানো হল বাশের চাটাই। কবরের
চারকোনে চার কুল-ছুরা পড়ে চারটি বাশের খুটি গাথা হল। এবার অতি যত্নে মাটি দিয়ে
চিরদিনের জন্য ডেকে দেওয়া হল আমার মায়ের চিরদিনের মাটির নিদমহল। সুদীর্ঘ্য জীবন
একসাথে কাটিয়ে আমার জনক ও জননী চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে রইলেন পাশাপাশি কবরের নিরব
নিরালায়।
মাকে সমাহিত করে তার মাগফেরাতের
জন্য হাত তুলে সবাই মোনাজাত করে এবার আমরা ছুটে গেলাম পাশের দাউদপুর জামে মসজিদে
মাগরিবের জামাতে। প্রিয় মা আমার পড়ে রইলেন, একাকি ও অনাদরে, কবরদেশের নিঝুম
নিরালায়। মাকে এভাবে ফেলে আসতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো- আপনমনে বিড়বিড় করে নিজেকে
শোধাই- ‘অবুঝ মন, মনরে আমার, তুই ফেলে এসেছিস কারে। যার রক্তে মাংশে দশমাস
পরিপুষ্ট হয়ে তুই এসেছিলে জগতে, পৃথিবীতে এসেই যার বুকের দুগ্ধ করেছিলে পান,
সারাটা জীবনভর ছিলে যার আচলের শান্তিসুখের আবরণে, এই সেই তুলনাহীনা, এই সেই জন’।
এবার আমার জন্মঘরে ফিরলাম,
আমাদেরকে সান্তনা দিতে অনেকেই ছুটে এসেছেন। সহানুভূতি জানাতে আসা স্বজন বন্ধুদের
ভীড়ে ঘরে কোথাও স্থান নেই। কিন্তু কয়েকযুগ ধরে যার কল কোলাহলে মুখরিত হত এই
আঙ্গিনাখানি- তিনি যে আর নেই। তাই বুঝি তার অবর্তমানে সব নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এ কি
মৌনতা? এ কি নিরবতা? নির্লিপ্ত হয়ে গেছে সব। বুকফাটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছাড়া কারো মুখে
কোন কথা ছিলনা। সময় গড়িয়ে গেল, একে একে সবাই বিদায় নিলেন।
দাউদপুরের বাড়ি, মধ্যরাত।
বাহিরে অন্ধকার। একাকি বসে আটচল্লিশ বছর জুড়ে দেখা হারানো মাকে খোঁজে বেড়াই আপন
মনে। সেইরাতে আমি নীরবে নিভৃতে অন্ধকারে বসে লোকচক্ষুর আড়ালে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে
বুকটাকে হালকা করার এক অভাবনীয় প্রচেষ্টা চালাই। কিন্তু আমার জানা ছিল এই শ্বাসত
সত্য- ‘যে যাবার যায় চলে আসেনা ফিরিয়া, স্মৃতি তার দেয় ব্যথা রহিয়া রহিয়া’। আবার
মনকে বললাম- রহিয়া রহিয়া এই সুতীব্র ব্যথা পাবার জন্য বুঝি একে একে সব প্রিয়জন
হারিয়ে হে ইসফাক কুরেশী তুমি, একাকি এ সরাইখানায় রয়েছ বাচিয়া।
অনেকে আমাদের জন্য খাবার পাঠাতে
চাইলেন। আমরা আগ্রহ দেখালাম না। জুহেনা ভাবী বললেন মা জীবিত থাকাকালে তাকে তার
মৃত্যুর পর খাবার পাঠাতে বলেছেন। তাই আমরা তার অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারলাম না।
চাচাতো ফরহাদ ভাই ও জুহেনা ভাবী প্রচুর খাবার পাঠালেন। বাড়িতে আগত সব আত্মীয় স্বজন
এই খাবার খেয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান।
পরদিন চাচাত খসরু ভাই খাবার পাঠালেন। আমরা দশ বার জন লোক, এত খাবার কে
খাবে? যারা সামনে আসলো তারা সবাই খেয়ে গেল
ইচ্ছেমত।
কিছুদিন পর এই বসন্তের কোন একদিন
মাবাবার স্মরণে জিয়াফত করতে দাউদপুরের শূন্য কুটিরে ফিরলাম। মাবাবা শুন্য বাড়ি,
মাতৃশূন্য ঘর মনটাকে হাহাকারে খান খান করে দিল। একদিকে আখনি পোলাও রান্না হচ্ছে,
লোকজন এসে আঙ্গিনার প্যান্ডেলে বসে খাওয়া দাওয়া করছেন, গল্পগোজব করে চলে যাচ্ছেন,
আর এ সময় আমার হৃদয়বীনায় শোকের এক অগ্নিসুর নীরবে দহন করে যায়। বাহিরে বসন্তের ফুল
ফুটেছে, পাখি গান গাইছে- ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি
গায় গান, আহা আজি এ বসন্তে’ অথচ আজিকার এই বসন্ত উৎসবে আমার জন্মগৃহে সবচেয়ে
প্রিয়জন মাবাবা নেই। খোকা বাড়ি আসার জন্য কেউ আর এখানে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকবেনা।
অস্থির হয়ে ছটফট করবেনা, ফোন করে বলবেনা- বাড়ি আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন খোকা? আর
কেউ ভাববেনা, আমাদের পর এই অবুঝ পুতটা সংসারে চলবে কেমনে? হৃদয় ভারী হয়ে গেল যখন
ভাবলাম- বিদেশ কিংবা সিলেট শহর হতে বাড়ি ফিরে এখানে আব্বা-আম্মার সোনামুখ দুটি
খুঁজে পাওয়া যাবেনা আর কোনদিন।
'কোনদিন পড়বেনা মোর পায়ের
চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে’- গানের এই চিরন্তন নিষ্টুর
বাণীটি যেন এই শূন্যগৃহে আমার পিতামাতার জীবনে চিরসত্যে পরিণত হয়ে গেল।
অনুচ্চ স্বরে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কিছু লাইন আবৃতি করলাম-
পৃথিবীর সব রঙ্গ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ্গে
ঝিলমিল;
সবপাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ
জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি
বসিবার বনলতা সেন।‘
সন্ধ্যা আসে; ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
মাবাবার সাথে হাজার স্মৃতি
বিজড়িত সুদীর্ঘকালের সুখের জীবনটা চুপেচুপে নিভে গেল। মাবাবা আল্লাহর বাড়ি চলে
গেলেন, আমার সামনে পড়ে রইল কেবল অন্ধকার।
এবার সব হারিয়ে ফিরলাম আমার বনলতা সেন ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর আস্থানায়, সিলেট শহরে একমাত্র সন্থান জেফারকে নিয়ে সাজানো আরেক সংসার বাগানে। হয়ত এটাই হবে আমার বাকি জীবনের শেষ আশ্রম, যেখানে এক সময় আলো হয়ে আসবে পূত্রবধু ও নাতি নাতনির দল। তারপর এমন এক সময় ঘনিয়ে আসবে যখন একে একে সংঘটিত হবে বনলতা সেন ও কবি জীবনানন্দের চিরবিদায়ের পালা।
মায়ের চিরযাত্রার পর তাকে বেশ ঘনঘন স্বপ্নে দেখি। মনে হত তাকে আমি একদম জীবন্ত অবস্থায় দেখছি। যখনই স্বপ্নের মধ্যে মনে হয়ে যেত তিনি যে জীবিত নেই, তখনই সেই স্বপ্নটি কেমন যেন এলোমেলো হয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেত। একরাতে আমি আম্মাকে প্রশান্তচিত্তে এক অনন্যসুন্দর বাগানবাড়ীতে দেখতে পাই। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি, অনেক অনেক বাগান বাড়ি দেখেছি কিন্তু এরূপ মনোরম শোভাময় বাগান বাড়ি কোথায়ও দেখি নি। আরেকবার স্বপ্নের মধ্যে আমি আকাশের পানে তাকাই। সেখানে আমি চাদের মত আলো বিতরণকারী বিশাল মেঘখন্ড দেখতে পাই। সেই মেঘখন্ডের উপর আম্মাকে বেশ প্রসন্ন বদনে দেখি। আব্বাকেও তার মৃত্যুর পর ঘনঘন স্বপ্নে দেখতাম। আমি তাদেরকে স্বপ্নে দেখে যখনই জড়িয়ে ধরতে যেতাম, তখনই ঘুম ভেঙ্গে যেত। আম্মার মৃত্যুর দুই তিন দিন পর আমার লন্ডন প্রবাসী বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর আমাকে ফোন করে বললেন, আমি স্বপ্নে খালাম্মাকে একেবারে বেহেশতের মধ্যে উপবিষ্ট দেখতে পেয়েছি। তারপর সময় যতই গড়াতে থাকে মাবাবাকে স্বপ্নে দেখা আমার ততই হ্রাস পেতে থাকে। আসলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে স্মৃতি যত ঝাপসা হয়, স্বপ্নও তত দূরে পালাতে থাকে। তারপর এমন এক সময় আসে যখন হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে স্বপ্নে দেখা একেবারে স্থিমিত হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন