শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

কেন এ জীবনের কথা বলা

 

কেন এ জীবনের কথা বলা

হে পৃথিবী, আমি তোমাকে আমার জীবনের গল্প শোনাবো। তোমার বুকে কত মানুষ যুগে যুগে আসে আর যায়, তাঁদের কেউই এখানে থাকেনা। আসা যাবার খেলা চলে সর্বদা। শেষবেলা আমি এলাম, আমার যাত্রা এখন চলছে।

আমি চৌধূরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী একজন অতি সাধার মানুষ। যে মানুষটাকে বলা যায় সাধারণ্যে সাধার। আত্মজীবনী হয় বিখ্যাত সব লোকজনের যারা যশঃ, খ্যাতি, মর্যাদা, অর্থভিত্ত ও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেন। হে পৃথিবী, তোমার কোলে বসে খেলা করেন জাদরেল সব সামরিক ও বেসামরিক আমলারা, তাঁরা অবসরে গিয়ে লিখেন আত্মকাহিনি। রমরমা স্মৃতিকথা লিখেন রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগ কেউ কেউ নিজে নিজে লিখেন, আর যারা জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতা, সঙ্গীত শিল্পী, অভিনেতা ও ক্রীড়াবিদ সেলিব্রেটি, তাদের জীবনী লিখেন অনুরাগী ভক্তরা তাদের ফ্যানরা এক নিঃশ্বাসে এসব জীবনী পড়ে যান পৃথিবী তুমি নীরব দর্শক হয়ে রও তাঁদের জীবনের।  

আমার এক বড়ভাই সাবেক সচিব, জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ১৯৯০ সালের প্রথম তত্থাবধায়ক সাহাবউদ্দিন সরকারের বানিজ্য উপদেষ্টা ইমামউদ্দিন চৌধূরী লিখেন সুখপাঠ্য আত্মজীবনী “স্মৃতির সমুদ্র”, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্য দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ফুফুতো ভাই ডঃ সদরুউদ্দিন চৌধুরী লিখেন “আত্মকথা”, বিমুগ্ধ হয়ে পড়লাম প্রাক্ত পররাস্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরীর “জীবনের বালুকাবেলায়”, প্রাক্ত সচিব মোঃ মোফজ্জিল করিমের সুলিখিত আত্মজীবনী “সোনালি সকাল, দুরন্ত দুপুর” এবং “আপন ভুবন, অচেনা আকাশ”, ব্রিগেডিয়ার জোবায়ের সিদ্দিকি আমাকে স্নেহ করতেন উপহার পেয়ে কয়েকবার পড়লাম তার স্মৃতিকাহিনি “স্মৃতির অলিন্দে”

আমি বিগত ত্রিশ বছর ধরে শখের বসে প্রচুর লেখালেখি করে আসছি ভারতের প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবুল কালামের আগুনের ডানা, হের হিটলারের মাইন ক্যাম্প, মার্কিন ফাস্টলেডি হিলারি রডহাম ক্লিনটনের লিভিং হিস্ট্রি, তুজুখে বাবুর, আকবরনামা, হুমায়ুননামা, জাহাঙ্গিরনামা ইত্যাদি গ্রন্থপাঠে আমার মনে আত্মজীবনী লিখার এক আদম্য দৃষ্টতা জেগে উঠে আমি মধ্যযুগের রাজা বাদশাহ নাইবা হলাম, এযুগের একজন লেখক ও কবিতো হয়েছি, এটা এমন কম কিসের আমি চারটি মহাদেশ ঘুরেছি, ত্রিশহাজার ফুট উপর দিয়ে উড়েছি দেশ হতে দেশান্তরে, পেয়েছি দ্রুতগামী যান্ত্রিক যান, টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার, এয়ারকুলার, আর কত কি; যাহা আলেক্সজান্ডার দি গ্রেট, বাদশা হারুনুর রশিদ কিংবা সম্রাট আকবরের ভাগ্যেও জুটে নাই। পৃথিবী তুমি আমাকে জ্ঞান বিঞ্জানের এমন মধুময় যুগে আশ্রয় দিয়েছ। বলত আমার সৌভাগ্য কম কিসের?

মানুষের সচেতন মন যা করার ভাবনা গ্রহ করে তার অবচেতন মন সেদিকে চুপে চুপে এগিয়ে যায় তখন সচেতন মনের সাজানো সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবচেতন মন পথে নেমে যায়। মনে যখন স্বপ্ন সৃষ্টি হয়, সেই স্বপ্নই তাকে দ্রুত বাস্তবায়নের পথে তাড়িয়ে নিয়ে যায়আমার নেই কোন ডায়েরি কিংবা লিখে রাখা স্মৃতির ডালা এই সাধার মস্তিস্কটাকে সম্বল করে আল্লাহর নামে এগিয়ে গেলাম তৈরি করলাম ধারাবাহিক স্মৃতির প্লট প্রবাহ সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধুদের সাহায্য নিলাম কলেজ জীবনে একটি খাতায় লিখে ছিলাম প্রাইমারি ও হাইস্কুল জীবনের কিছু কিছু বিরল কাহিনি, বহু বছর পর তাও এই বই রচনায় কাজে লাগে

আমি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে মনের মনিকোঠা হতে অজস্র তথ্য বের করে এনে এই গ্রন্থে ধারাবাহিক সংযুক্ত করি। কিছু স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়, কিছু স্মৃতি দেয় ব্যদনা। এসব স্মৃতি রোমন্থন করে আমি পুলকিত হ। ফেলে আসা অতীত জীবন্ত হয়ে আবির্ভূত হয় আমার সামনে। কিছু স্মৃতি আমাকে কাঁদায়, আবার কিছু স্মৃতি উপহার দেয় আনন্দ যা আমার ঠুটের কোণে ফুটিয়ে তুলে প্রচ্ছন্ন হাসির ঝলক। এতদিনের নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে ওঠা এসব স্মৃতিরা হয়ে যায় আমি ইসফাক কুরেশীর অমূল্য মনিমাণিক্য, কার এই স্মৃতিরা বলে যায় আমার জীবনের যত সব হারানো দিনের কথা, যা হয়ে যায় আমার জীবনের শ্বাসত ইতিহাস। হে পৃথিবী সত্যিই তুমি খুব সুন্দর, তারচেয়ে সুন্দর তোমার কোলে আমার এই জীবন, আমার এই বেঁচে থাকা।       

হে পৃথিবী, হে গ্লোভাল ভিলেজ, আল্লাহর অপার মেহেরবানিতে তোমার বুকের বেশ কিছু দেশভ্রমণের সুযোগ আমার ভাগ্যে জুটেছে। ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্যসহ আমার ভ্রম তালিকায় অনেক দেশ রয়েছে। এই বিদেশ সফরমালা আমার মনের এক সুতীব্র জ্ঞানতৃষ্ণার ফসল, প্রতিটি সফরে এসব দেশকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভবে বাস্তবতার আলোতে ফেলে অধ্যয়ন করেছি এবং লিখে এনেছি ডায়রির পাতায়।

দার্শনিক সেইন্ট অগাস্টিন বলেছেন “দুনিয়া হচ্ছে একটি বইয়ের দুটি পাতা, যে ভ্রম করল না সে এই বইয়ের একটিমাত্র পাতা পড়ল”এই দুনিয়া ভ্রমমালা আমার জীবন কাহিনিরই অংশ। প্রতিটি দেশের ভ্রমণকাহিনি আমার লিখাই ছিল। ভ্রমণকাহিনি পাঠে মানুষের বেশ আকর্ষণ ছে। ভাবলাম আমার এই ভ্রমকাহিনি যদি আত্মজীবনীতে ঢুকে পড়ে তাহলে কেমন হয়। মনে হল এই জীবনস্মৃতি ও ভ্রমণস্মৃতির সমন্বয় পাঠকের কাছে  অবশ্যই ভালই লাগবে।

ভ্রমণকাহিনিতে অল্প সম সীমায় বেশি লেখার সমাবেশ ঘটে, অথচ একজন সাধার লেখকের যাপিত জীবনে সুদীর্ঘ সময়ের কাহিনি লেখা হয় অল্পস্বল্প। ভ্রমণকালে বিভিন্ন দেশ ও জাতির লোকজনের জীবনাচার কৃষ্টি সংস্কৃতি ধর্ম ভাষা আবহাওয়া পরিবেশ ইত্যাদি পঞ্চইন্দ্রগ্রাহ্য অভিজ্ঞতার আলোকে জনে জনে ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গের তুলিতে চিত্রিত হয়। আমার ভ্রমণ কাহিনির বর্ণ-গন্ধ-স্বাধ কেবল আমারই এবং দেশে দেশে আমার এই পর্যটন এই জীবনেরই এক আকর্ষণীয় অংশবিশেষ। হে পৃথিবী, আমার এই বিদেশ ভ্রমণকাহিনি সময়ের ক্রমানুসারে এই আত্মজীবনী গ্রন্থে তোমার সন্থানদের সমীপে সযতনে রেখে দিলাম। ফলে আমার এই আত্মকথন হয়ে গেল একদিকে আত্মজীবনী ‘জীবনের খেলাঘরে’, অন্যদিকে চিত্তাকর্ষক এক ভ্রমণকাহিনি ‘দেশ দেশান্তরে’

এই শ্বাসত আত্মসংলাপে- আমার জীবন ও আমার ভ্রমণ, এই দুইটি পৃথক বিষয় গ্রিনটি কাপের পানি ও  চিনির মত মিলেমিশে একাকার হয়ে পরিত হয়েছে এক অবিমিশ্র দ্রবণে যাহা এই ‘জীবনের খেলাঘরে, দেশ দেশান্তরে কেঊকেঊ ভালবাসেন আত্মজীবনী আবার কেঊবা পছন্দ করেন ভ্রমণকাহিনি, সাহিত্যের এই দুই গুরুত্ববাহী ধারার সম্মানিত পাঠকদের সমীপে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার নিবেদন এই জীবন ও ভ্রমণের মনিকাঞ্চনজোড় ‘জীবনের খেলাঘরে’, পৃথিবীর সবার মনে আনন্দ দিলেই আমি ধন্য হই।   

১৯৬৫ সালের ২৩শে ডিসেম্বর পৃথিবীতে শুভাগমনের পর হতে ইতিমধ্যে জীবনের  অর্ধশতাব্দীর বেশি বছর পেরিয়ে এসেছি জন্মের পর যারা ছিলেন সবচেয়ে প্রিয় ও ঘনিষ্ঠজন, বাবা সফিকুর রহমান চৌধূরী ২০০৭ সালের ২৪শে নভেম্বর, মাতা আসমতুন্নেছা চৌধূরী ২০১৩ সালের ১০ই মার্চ, বড়বোন আনিকা চৌধূরী রেহা যাকে আমরা ভাইবোনরা সবাই ফুলবুবু ডাকতাম, তিনি ২০১৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর আমাদেরকে এই মাটির ধরায় ফেলে রেখে চিরদিনের জন্য চলে যান। ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী ও ৩রা মার্চ শ্বাশুড়ি মলিকা খানম চৌধুরী অন্তর্ধাণ হন। প্রিয় মানুষ ই এ চৌধুরীকে হারাই ২৮ জানুয়ারি ২০০৯ সালে। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি হারাই নিঃসন্থান খালা মরিয়মুন্নেসাকে, যিনি মায়ের আপত্যস্নেহ দেন সারাটা জীবনভর। অনেক অনেক প্রাপ্রিয় মানুষের মৃত্যু আমার বুকটাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। চোখের জলে বুকটা ভেসে যায়। এই সবকিছুরই সাক্ষি হয়ে আছ তুমি, হে পৃথিবী।

হে প্রিয় দুনিয়া খানম, তোমার বুকের ভাল মানুষের ভালবাসা যেমন আমাকে আবেগ আপ্লুত ও চিরঋণী করে, তেমনি কিছু নোংরা লোকদের নোংরামি আমার অন্তরটাকে বিষিয়ে দেয় মনে হল আমার এই জীবনে খুব কাছে পাওয়া ও পরখ করে দেখা এইসব বিচিত্র মানুষের কথা পরের প্রজন্মের মানুষের জন্য লিখে রাখতে হবে তারা এই বইটি পড়ে আমাকে দেখবে, আমার সময়কাল দেখবে, আমার আমলের মানুষের রীতিনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, প্রথা, লোকাচার ও সংস্কৃতি দেখবে। আর বিশেষভাবে তারা দেখতে পাবে আমার জীবনকালের প্রিয় জন্মস্থান দাউদপুর ভায়া রেঙ্গা পরগনা ভায়া দক্ষিণসুরমা ভায়া সিলেট মহানগর ভায়া রূপসি বাংলাদেশ হয়ে এই বিশাল পৃথিবী আর হে পৃথিবী তুমি সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকবে, রচনা করবে নতুন নতুন বছর।

হে পৃথিবী, ইটালির ভেনিস বন্দরের মার্কোপলো কিংবা মরক্কোর তাঞ্জিয়ারের বাসিন্দা ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি পড়ে যেমন আমরা একাদশ ও চতূদ্দশ শতাব্দীর তোমাকে দেখতে পাই, আমার এই বইটি পড়ে অনাগতকালের মানুষ তেমনি পেয়ে যাবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৃথিবী নানাপ্রান্ত ঘুরে দেখা আমার আমলের  সেরা সেরা  শহর, বন্দর, দেশ, পর্যটন কেন্দ্র, পাহাড়, সমুদ্র, দ্বীপ ও মানব সভ্যতার প্রাণবন্ত বিবর, যদিও হে পৃথিবী তুমি তখন অনেক বদলে যাবে আজকের তুমি তখন থাকবেনা, যেমন অতীতকালের তুমি আজ আর নেই।

কবি হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, সমকালকে সর্বকালের করার দায়িত্ব লেখকেরই।

হে পৃথিবী, জানিনা এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছি আমি, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন এবং তা কেবল জানে ভবিষ্যৎ।  

বড় দুঃখের কথা শুনো হে পৃথিবী। আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমদ মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে মনের দুঃখে বলেছিলেন জীবনটা এত ছোট কেন? একটা কচ্ছপ ২৫০ বৎসর, কুমির ৩৫০ বৎসর, নীলতিমি ৭০০ বৎসর বেঁচে রয়, অথচ মানুষের ভাগ্যে শত বছরও আয়ুষ্কাল জুটে না। তার ভাষায়- মৃত্যু টের পাওয়া যায়, তার পদশব্দ ক্ষী কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।

হে পৃথিবী, মা আসমতুন্নেছা চৌধুরীর মুখে শৈশবে শুনতাম প্রাচীন পারস্য সম্রাট দারাউসের কাহিনি এই বাদশাহ নাকি চিরযৌবন নিয়ে অনন্তকাল তোমার সুন্দর বুকে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তিনি তার সভাসদদের কাছে মৃত্যুর কারজানতে চাইলেন তারা সম্রাটকে জানালেন স্রষ্টাই পৃথিবীর সব প্রাণী জন্ম দেন, যৌবন দেন, বুড়ো করেন ও মৃত্যু ঘটান কাজেই জগতে মৃত্যু নামক অকাম সৃষ্টিকর্তার কাজ। এই অপকর্ম সংঘটনের জন্য আসলে তিনিই দায়ী, তিনিই একমাত্র আসামি

বাদশাহর মনে এক অদ্ভুদ বুদ্ধি জাগ্রত হল। তিনি ভাবলেন ঈশ্বর যদি মারা যান তাহলে পৃথিবী তোমার বুক হতে মৃত্যু ও বার্ধক্য উধাও হয়ে যাবে পার্সিদের সমাধিস্থল টম্ব অব সাইলেন্ট হতে বাদশাহ প্রচুর শকুন সংগ্রহ করেন এখানে মৃত্যুর পর পার্সিদের লাশ সুর্যমুখী করে ফেলে রাখা হয় শকুনগুলো টম্ব অব সাইলেন্টে প্রচুর লাশ আহার করে করে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয় করে সম্রাটের সেরা তীরান্দাজকে ডাকা হলো, একটি শকট তৈরি করা হল শকুনদের পায়ের সাথে শকটকে বেঁধে দেওয়া হলতীরান্দাজ বীরকে হুকুম দেওয়া হলো এই শকটে চড়ে আকাশে উঠে ঈশ্বরকে তীর ছুড়ে শেষ করে দিতে হবে তীরান্দাজ প্রমাদ গু, যদি বিফল হয় তাহলে গর্দাণ যাবে সে ছিল অতীব ধূর্ত, তাই সে তীরের ফলায় গোপনে  গোরক্ত মাখিয়ে শকটে আরোহন করে এক ঝাঁক শকুন একসাথে উড়ে শকটটাকে অনেক উপরে নিয়ে যায়। এবার পারস্যবীর ঈশ্বর নিধনে মরণ তুন ছূড়লেন। পৃথিবীতে ফিরে এল ঈশ্বরের রক্তমাখা তুন।

সম্রাট দারাউস দারু খুশি ঈশ্বর মারা গেছেন, তাই তাকে আর মরতে হবে না কোনদিন। তিনি বূড়ো হবেন না, সেইসাথে রাজত্ব করবেন অনন্তকাল। কিন্তু সময় বয়ে গেল, যথাসময়ে প্রাচীন পারশ্যের এই হবুচন্দ্র রাজাকে বৃদ্ধ হতে হল, তারপর একদিন মরতে হল

সময় এমন এক জিনিস যা চলে গেলে আর আসেনা। যেমন চলে গেলে ফিরে আসেনা দুরন্ত শৈশব, সোনালি কৈশর, হিরণ্ময় যৌবন কিংবা মৃত্যুর পর আবার এই পার্থিব জীবন, তাঁর সাক্ষি হয়ে আছ লাখ লাখ বছরের সুদীর্ঘ জীবনের অধিকারী তুমি হে পৃথিবী।

মানুষের হায়াত ও মউতের খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতে পারে না মনে হল সহসা আমার উপর যদি চিরবিদায়ের সমন জারি হয়ে যায় তাহলে আমার জীবনের অনেক না বলা কথা, অজস্র গল্পের ফুলঝুরি আমার সাথে কবরের গভীর গহীনে সমাধিস্থ হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষের কাছে তা আর কোনদিনই বলা হবে না। আমার স্বলিখিত একটি সনেটের শেষদুটি চরণ প্রায়ই মনে পড়ে, কিন্তু তুমি মরে গেলে, কোনদিন ফিরবে না আর,/ কিংবা অতিক্রান্ত দিন, এজীবনে ফিরে না আবার তাই হে কোটিয়ায়ু পৃথিবী, ভাবলাম, মরতে যখন হবে, তোমার লোকজনকে সবকিছু বলে মরি।   

সব প্রশংসা এই পবিত্র সত্তা দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিনি আমার স্মৃতির দুয়ার খোলে দেন এবং আমার মনের চোখে এক আলোর প্রতিফলন ঘটান সব অতীত আমার সামনে পরিস্কার করে দেন। কর্ণ সব শুনতে পায় আর চোখ দেখতে পায় সাহ্নিধ্যে আসা সব মানুষের হাসি কান্না সুর। মানুষগুলোর সেইচোখ, সেইমুখ, সেই চেহারা, কথাবলার কৌশল, সেই ব্যাক্তিত্ব সব আমার মনের কল্পনারাজ্যে অবিকল বাস্তব প্রতিবিম্ব হয়ে ধরা দেয় সময়ের শাবলের আঘাতে বদলে যাওয়া প্রকৃতি, সমাজ, সংসার, কৃষ্টি, লোকাচার, এমন কি বদলে যাওয়া আশপাশের অলিগলিও আমার প্রিয় প্রভূ এই মহাবিশ্বের ধারক ও বাহক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন চুপে চুপে আমার ধারণার রাজ্যে সযতনে উপস্থাপন করেন। শপথ মহান জ্ঞানময় আল্লার, যার হস্তে আমার প্রাণ।/ তার পবিত্রতা ও প্রশংসা জপে এই জীবনকাহিনি শুরু করিলাম

মহান আল্লাহ পাকের দয়ায় এক তীব্র জ্ঞানুসন্ধানী মন নিয়ে পৃথিবীতে আমার জন্ম। শৈশবে মায়ের কাছে ছিপারা নিয়ে আরবি পড়তে বসি। মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী বললেন এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি বিশ্বের সবকিছু সৃজন করেছেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম তাহলে আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন। মা উত্তর দেন তাকে কেউ সৃষ্টি করে নি, তিনি নিজেই সৃষ্টি হয়েছেন অর্থাৎ তিনি স্বসৃষ্ট।

মা বললেন “এক” আসলে একটি অনন্য সংখ্যা, যার আগে শূন্য ছাড়া কিছু নেই। স্রষ্টার আগে কোন স্বত্তাকে বসালে আবার প্রশ্ন আসবে ঐ স্বত্তাকে কে বানাল? এভাবে ইতিহীন প্রশ্ন বিরামহীন চলতেই থাকবে কে বানাল, কোন সমাধানে পৌঁছা যাবেনা কোনদিন। তাঁর উপদেশ এক আল্লাহর আগে কি আছে বা ছিল তা নিয়ে চিন্তা কর না, তাহলে সীমাহীন শূন্যের অন্ধকার গহ্বরে পড়ে যাবে এবং কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না। আবার মা বললেন একের পরও চিন্তা কর না কার একের পর দুই, তিন, চার এভাবে সারাটা জীবনভর গুণে গেলেও শেষ সীমার সন্ধান কোনদিনও পাবে না। “ডিম আগে, না কি মোগী আগে” এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে মা কিছুটা বার করে দেন।

মা আস্মতুন্নেছা বলতেন আল্লাহ আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। মায়ের শিক্ষা এক আল্লাহ ছাড়া এই সুন্দর মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে না ও এত সুশৃংখলভাবে চলতে পারে না। কাজেই কখনও আল্লাহকে অস্বীকার কর না, নাস্তিক হইও না। মায়ের এই শিক্ষা আমাকে মনেপ্রাণে একজন একেশ্বরবাদী মানুষে পরিত করে। মা সুরা ফাতেহা পড়ে বোঝান মানুষ দুইভাগে বিভক্তএকদল আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত, আরেক দল অভিশপ্ত ভাল ও সৎ মানুষরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও জান্নাতি খারাপ ও দুষ্ট লোকেরা অভিশপ্ত ও জাহান্নামি তার আশা ও কড়া নির্দেশনা ছিল আমরা যেন প্রথম দলভূক্ত হই মায়ের আদেশ কি অমান্য করা যায় তাই সুরা ফাতেহার ঐ প্রথ দলভুক্ত হয়ে থাকার জন্য অবিরাম চেষ্টা করেছি সারাটা জীবনভর

আমার মা আর বলতেন জন্ম নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ঐ জাতীয় প্রাণী হয় কিন্তু মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েই মানুষ হওয়া যায় না মায়ের ভাষ্য- মানুষ হওয়া সাধনার বিষয়, মানুষ হওয়ার জন্য সারাজীবনই সারাজীবনই যুদ্ধ করতে হয়,  লোভ লালসা, হিংসা বিদ্বেষ, ক্রোধ, কাম ও অহংকার দমন করে সামনে এগিয়ে যেতে হয় সততা ও কর্মনিষ্ঠা ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না মানুষ হতে হলে নিজেকে বিবেকবোধ দ্বারা সত্য সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে হয়

আমার বাবা সফিকুর রহমান চৌধুরী ছিলেন আমার অহংকার তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম কিন্তু গোঁড়া ধর্মান্ধ ছিলেন না বৃটিশ শাসনামলে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বিশাল ভারত উপমহাদেশে তার জন্ম, তিনি ছিলেন বৃটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিন রাষ্ট্র ও যুগের জীবন্ত স্বাক্ষী তিনি বৃটিশ আমলের ইংরেজি শিক্ষিত একজন শিক্ষক আব্রাহামিক তিনটি ধর্ম অনুসরণে তাঁর সুস্পষ্ট বিশ্বাস ছিল- বনি আদম সব সমান, এক আদম ও এক হাওয়া হতে সব মানুষকে সৃষ্টি করে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান কাজেই সব মানুষ একে অন্যের রক্ত বন্ধনে আবদ্ধ আত্মীয় তিনি ধর্ম ভাষা বর্ণ জাতি বেদে মানুষকে আশরাফ আতরাফে ভাগ করা মানতেন না, যদিও তার জন্ম হয়েছিল এক প্রখ্যাত সামন্ত জমিদার ঘরে। ধর্ম নিয়ে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রক্তপাত ও হানাহানিতে বিরক্ত পিতা বলতেন আল্লাহ না চাইলে বিশ্বে এত ধর্ম বর্ণ ভাষা ও শ্রেণি থাকত না। কেবলমাত্র একটিমাত্র ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা একটি জাতি রেখে বাকি সব বর্ণ ধর্ম ভাষা ও জাতিকে আল্লাহ উঠিয়ে দিতেন। কাজেই হানাহানি না করে নিজ ধর্মকে পালন ও অন্য ধর্মকে আমাদের সম্মান দেখানো উচিত জাতি ধর্ম বর্ণ ও ভাষার কারণে একে অন্যকে ঘৃণা করা কখনও ঠিক নয়। এসব নিয়ে হানাহানি ও রক্তারক্তি কান্ড করা খুবই অন্যায় কাজ।

আমার বাবার মতে মানুষের শ্রেণি আসলে দুইটি ধনী ও দরিদ্রআব্বা বলতেন আল্লাহ বৈচিত্রপ্রিয় তাই তিনি তার প্রতিনিধি মানুষকে জাতি ধর্ম বর্ণ ভাষা লিঙ্গ ও ব্যক্তিত্বে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এই বিবেদমালা প্রকৃতি বা স্রষ্টা কতৃক সৃষ্ট আসলে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সবাই সমানমানুষের মধ্যে ধনবৈষম্যকে তিনি স্রষ্টা নয় বরং মানবসৃষ্টই বলে বিশ্বাস করতেন এই ধনবৈষম্য মানুষের মধ্যে উচ্চনীচ বেদাবেদ তৈরি করে প্রকৃতিগতভাবে বুদ্ধিমান ও মেধাবী লোকেরা অধিক ব্যক্তিসম্পত্তি সংগ্রহ করতে পারে ভাগ্যবানরা উত্তরাধিকার সূত্রে ধনসম্পদের মালিক হলেও চরিত্র এবং যোগ্যতা  না থাকলে তা ধরে রাখতে পারে না

ভাল মানুষেরা রাষ্ট্র, বিবেক ও ধর্মের বিধানের ভিতরে অবস্থান করে ধনী হয়, আবার মন্দলোকেরা চুরি ডাকাতি, ঘুষ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাফ, করফাঁকি, আত্মসাত ইত্যাদির মাধ্যমেও ধনী হয় বাবা সফিকুর রহমান চৌধুরী বলতেন সম্পদ সবসময় কিছু মেধাবী ভাল মানুষ অথবা কিছু দুষ্ট বাজে মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয় তখন মানুষের বৃহৎ অংশ বঞ্চিত হয়ে হতদরিদ্র জনগোষ্টিতে পরিণত হয় ধনীরা হয় ক্ষমতাবান ও অভিজাত, আর হতদরিদ্ররা হন অপাংক্তেয় নীচ আমার পিতার উদার শিক্ষা আমাকে একজন বিবেকবান মানবতাবাদী উদারপ্রাণ মানসিক অবস্থা দান করে

সব মানুষকে সম্মান করা, প্রাণভরে ভালবাসা ও দয়া প্রদর্শ আমার জন্মগত স্বভাব যা আমার পিতার বিবেকি শিক্ষার ফসল। বাবা আরও বলতেন প্রতিটি মানুষের দুটি স্বত্তা- ভাল ও মন্দ স্বত্তা। এই দুই স্বত্তার দ্বন্দের ভিতর দিয়া মানুষ পরিচালিত হয়। মানুষের ভাল স্বত্তা হচ্ছে তার বিবেকবোধ যা তাকে ভাল হতে ও ভাল পথে চলতে নির্দেশ দেয়। আর মন্দ স্বত্তা হচ্ছে মানুষের কুপ্রবৃত্তি, লোভ হিংসা- যা মানুষকে অপকর্মের দিকে নিয়ে যায়। তার মতে পুরো মানবজাতিই এই দুই স্বত্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তার অভিমত হল মানুষের ভাল স্বত্তা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় বলেই মানবজাতি আজও টিকে আছেএই দড়ি টানাটানি খেলায় মন্দের টান উপেক্ষা করে বিবেকের টান অল্পবিস্তর জয়ী হয় বলেই এত পাপের পরও মানবসভ্যতা প্রতি শতাব্দীতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাবার শিক্ষা ভাল হও, মন্দকে উপেক্ষা করে যাও। কুপ্রবৃত্তি নয়, বিবেকের দ্বারা চালিত হও। শ্রদ্ধেয় পিতার এই অমুল্য শিক্ষা আমাকে সর্বকাজে সব সময় বিবেকের কাছে জবাবদিহি করে দেয়।

জীবন ও জগতে ইতিহাসের পুনাবৃত্তি ঘটে বারংবার। সবার জীবনগতিও প্রায় একই ধারা অনুসরণ করে। জন্ম, বেড়ে উঠা, যৌবন, বার্ধক্য পার হয়ে পরজগতে পারি দেওয়া। এই বৃত্তের বাহিরে পা রাখার ক্ষমতা কারো নেই। 

মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে যে এক স্নেহের পারিবারিক বৃত্ত আমরা শৈশবে পাই, এক সময় সেই বৃত্ত ভেঙ্গে ভাইবোন সবার আলাদা আলাদা সংসার বৃত্ত রচিত হয়। সংসার ভাঙ্গে, আবার গড়ে, এটাই জীবনের শ্বাসত প্রবাহধারা, এটাই জীবন।

পৃথিবীর সব মানুষের জীবন অর্থবহ হয় নাকেউ সুদীর্ঘ্য জীবনকাল পেয়েও কাজে লাগাতে পারে না। আবার কোন কোন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনও ইতিহাসের কিংবদন্তিতে পরিণত হয় যীশু ৩৫ বৎসরের জীবনে পৃথিবীকে বদলে দেন। হযরত মোহাম্মদে(সঃ) জীবনের শেষ ২৩ বৎসর পৃথিবীর ইতিহাসের প্রবাহধারায় যুগান্তর সৃষ্টি করে। আলেকজান্ডার দি গ্রেট তার ৩৩ বৎসরের ছোট্ট জীবনে তিনটি মহাদেশে বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। আমাদের কবি সুকান্ত ২১ বৎসরে ও কবি মাইকেল মধুসুধন ৪৯ বৎসরের ক্ষুদ্র জীবনে বাংলা কাব্যধারাকে নতুনত্ব দান করে। বৈজ্ঞানিক স্যার আইজেক নিউটন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, আলফা এডিসন প্রমুখ ক্ষজন্মা প্রখ্যাতরা যুগে যুগে পৃথিবীকে ধাপে ধাপে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান

আমি পৃথিবীর জনারণ্যে পথহাটা এক অদম্য পথিক আরও দশজন সাধারণ মানুষের মত সমস্যাসঙ্কুল এক জীবনঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে কোনমতে ঘোড়াটাকে দাবড়িয়ে যাচ্ছি মানুষের জীবন আসলে সুখসুঃখ, হাসিকান্না, মিলন বিরহ, রম্যরোমাঞ্চে ভরা সিনেমা ছাড়া অন্যকিছু নয়। পাঠক যখন বইটি পড়বে হয়তবা নিজের অজান্তে তার নিজের জীবনেরই এক শ্বাসত প্রতিচ্ছবি এখানে দেখতে পাবে। এই প্রতিচ্ছবি পুর্ণাঙ্গ অথবা আংশিকভাবেও প্রতিফলিত হতে পারে তার জীবনের আয়নায়

জীবনের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই। সারাটা জীবন আশায় বুক বেঁধে সামনের দিকে হাঁটার চেষ্টা করেছি। এই আশাই এক প্রবল শক্তি হয়ে আমাকে শত হতাশার মধ্যেও বেঁচে থাকার উৎসাহ যুগিয়েছে। সৎ ও ভাল মানুষ হবার চেষ্টা করেছি। দুঃখ যন্ত্রণা বিপদ আপদকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসাবে সহজেই মেনে নিয়েছি। সুখ শান্তি আনন্দ ও সাফল্যে মহান আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করেছি। অনেক স্বজন হারানো, অনেক অর্থ খোয়ানো, অনেক ব্যর্থতাকে জীবনের নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়েছি। শেষে যোগ বিয়োগ করে মনে হয়েছে হারানোর চেয়ে পাওয়ার পাল্লাটা হাজারগু ভারী। ফুটবলের মাঠে খেলতে নেমে গোল তিনটি খেয়েছি তো কি হয়েছে, খেলা সাঙ্গ হবার পর দেখছি আমি চার গোল করে শেষমেশ অন্ততঃ এক গোলে জয়ী হয়ে গেছি।

সিলেটের দক্ষিণসুরমা উপজেলার দাউদপুর গ্রামে আল্লাহ আমাকে এক অভিজাত অথচ সাধারণ মধ্যভিত্ত ঘরে জন্ম দিয়েছেন অহঙ্কারী হবার মত নয় আমার এই যাপিত জীবন আমি অসাধারণ কেউকেটা কেউ হতে পারি নি তবে মহান আল্লাহ আমাকে এই ধরণীতে আসার পর হতে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিক যে মানসিক  সুখ, শান্তি ও আত্মতৃপ্তি দিয়েছেন তার কোন তুলনা হয় না আমি কিংবদন্তি হতে পারিনি কিন্তু দয়াময় আল্লাহ আমাকে এতই দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নিয়ামত দিয়াছেন যে মনে হয় আমি যেন সুখের রাজা, পৃথিবীতে আমি যেন সবচেয়ে বড় ভাগ্যবান। হে সুন্দর পৃথিবী, আমি ফেসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব ব্লগ পেয়েছি, যা আমার ঠিক আগের প্রজন্মের কাছেও অদৃশ্যই ছিল। সত্যই রাজভাগ্য আমরা সবার।  

দাউদপুর গ্রামে সুদীর্ঘ পাকা টিনের ঘর, খাট, পালং, চৌকি আসবাব, আলাদা ভিটায় রান্না ঘর, ধানের গোদাম, পানিভরা মাটির কলসী, পাকঘরে খাবার চৌকি, বাড়িভরা আম, জাম, নারকেল, কাঠাল, লুকলুকি, লিচু, কলা বারো মাসে নানা নাম না জানা ফল এত সুপারী যেন বাড়িটি এক সুপারী বাগান পিছনের পুকুরটায় কিলবিল কর তেলাপিয়া মাছ বড়শী ফেলতেই উঠে আসছে তেলাপিয়া, পুটি, কাংলা, কৈ মাছে ভরে যেত জলের গামলা, শীতে বিলের টুকরি টুকরি ছোটবড় মাছে সয়লাব হত বাড়ির উঠোন সামনের দিঘিভরা ছিল রুই কাতলা মৃগেলসহ বড়বড় মাছ গোয়ালঘরে দুধেল গাভী, মোরগ হাসের ছোট্টঘর, পোষা কবুতরের বাকবাকুম হাওর ভরা ধান্য জমি, শীতে রবিশস্যে হাস্যমান বাড়ির প্রাঙ্গণ, বসন্তে বাড়ি জুড়ে বিচিত্র ফুলের সমাহার এই বাড়ি ও এই তল্লাটের আপনভোলা একজন রাজা ছিলাম আমি

রাজ্যহীন এই গ্রাম্যরাজা আসলে কোন রতি মহারতি নয় সে আপনাদের মত একজন সামান্য ও নগন্য অতি অতি সাধারণ মানুষ। তার এ জীবনালেখ্য আসলে আপনাদের মত একটি মধ্যভিত্ত জীবনের প্রচ্ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়নীরবে নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে অনাদর অবহেলায় বয়ে যাওয়া আমার এ জীবনটাকে আমি ভালবেসেছি প্রাণভরে। রোগহীন সুস্থদেহ ও প্রশান্তমন নিয়ে এই সাধারণ জীবনটাকে উপভোগ করেছি স্বর্গীয় আনন্দে। আর দশজন মানুষের মত লেখাপড়া শিখতে পা রেখেছি স্কুল কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তর পর্যন্ত।

আমার জীবনের যাত্রাপথ যে লালগালিচা বিছানো ছিল, এমন নয়। এই পথ ছিল কখনও ভঙ্গুর কখনও পিচ্ছিল, কখনও একটু একটু মসৃ হলেও বেশিরভাগ খানাখন্দকে ভরপূর। জীবনে অনেক ভুলভ্রান্তি করেছি, প্রতিটি ভূল হতে শিক্ষা নিয়েছি, সেই শিক্ষা, সেই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছি মস্তিস্কের অদৃশ্য খাতায় এবং তা কাজে লাগিয়ে নিজেকে শুধরে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি একজন দক্ষ গ্রেন্ডমাস্টার দাবাড়ুর মতন। 

জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে শিক্ষাজীবনের শেষপ্রান্তে চব্বিশ বছর বয়সে এসে চাকুরিতে যোগদান করি। সুদের ঘর ব্যাংকের চাকুরি। হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব  বড়ভাই ই এ চৌধুরীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, তার সৌজন্যে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে হলাম পুবালী ব্যাংকের শিক্ষানবিশ জুনিয়র অফিসার, যদিও পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ পাবার কথা ছিল সিনিয়র অফিসারে বেতন সামান্য, সারাদিন খেটে যাই, এই বেতনে কোনমতে টিকে রই। এখানেও গর্ব করার মত কিছু নেই। এযেন জীবনের সমুদ্রজলে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধরত ডুবন্ত এক মানুষের ভাসমান কাটের গুড়ি ধরে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। বন্দি চাকুরে জীবন, দয়ামায়াহীন এক বদ্ধ জীবন। প্রতিষ্ঠান কেবল মুনাফা খোঁজে, তার মুনাফার ক্ষুধা মেঠাতে সর্বক্ষ সবাইকে ব্যস্ত রাখে। রোজ রোজ আটদশ ঘন্টা এই শ্রমশিবিরে ঘেমে ভিজেও এখানে শান্তি নেই, আছে পদে পদে বাধ্যবাধকতা, জবাবদিহিতা এবং ওৎপেতে থাকা অসংখ্য অদৃশ্য বিপদাপদের হাতছানি সেইসাথে আছে রাজনীতি, তৈলবাজি ও কনুই মারামারি, যা চাকুরির শেষপ্রান্তে এসে ভালই অনুভব করি।

সব মানলাম চাকুরির খাতিরে কিন্তু অদৃশ্য কিছু গোলকধাঁধা আমার পিছু ছাড়ে না। এই ব্যাংকের পরিচালকরা সবাই আমার আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শী, সবার অশেষ স্নেহমমতা পেয়েছি এতদিন। একদিন ব্যাংকপ্রধান হন একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কিন্তু এই ব্যাংকপ্রধান আত্মীয়ের শাসনামলে আমি অপাংক্তেয় হয়ে গেলামসিলেটে বসে দেখলাম অতীতে এই ব্যাংকে সিংহ লেজ নাড়াত, আর এখন লেজে সিংহ নাড়ায়

তখন অবাক চোখে দেখলাম সারা দেশের তোষামুদে ও বাকপটু মোসাহেবরা সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। তাদের অবৈধ ক্ষমতার দাপটে চাকুরি করা কষ্টকর হয়ে যায়। এখন আমার কোন সুযোগ সুবিধা নেই, কারণ আমি তোষামুদি জানি না, ষড়যন্ত্র করা জানি না, নিজেকে সুযোগ্য প্রমাণে বড়দের সামনে গিয়ে সত্যমিথ্যা মিশিয়ে লম্বা ভাষ দিতেও জানি না। এই ব্যাংক থেকে আমি কাউকে তোষামুদি করে আদৌ কোনদিন কোন সুবিধা নেই নি, পেতেও চাই নি

২০১৫ সালে আমার প্রাপ্য সামান্য গাড়িঋণ আবেদন সিলেটে বসা সিংহ লেজ দুইবার আমার কাছ থেকে গ্রহকরে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঢাকায় না পাঠিয়ে ফেলে দেন। অথচ তার সাথে এই বিষয়ে মৌখিক আলাপকালে তিনি প্রথমেই ‘না’ বলে দিতে পারতেন। তিনি প্রথমেই ‘না’ বলে দিলে আমি দুইবার কষ্ট করে গাড়িঋণ প্রস্তাব তাঁর কাছে পাঠাতাম না। আমার ঋণ আবেদন হাতে নিয়ে ঢাকায় না পাঠানোর কারণ ঢাকার সিংহপ্রবর, নাকি তাঁর সিলেট ইস্টের লেজ, তা আমার কাছে আজও ধাঁধা হয়ে আছে।    

আমার উপর যেখানে সেখানে মানহানিকর বদলির আদেশও হয়, একজন সিনিয়র এজিএম আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আটার বছর আগে ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করে আসা আমার গ্রামের ছোট্ট শাখায়, যদিও সিলেট শহরের বড় বড় শাখায় আমি কিংবদন্তি ব্যাংকার এমডি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং মহামান্য এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরীর সারাটা আমল জুড়ে প্রায় দশ/বার বৎসর ব্যবস্থাপক হিসাবে সাফল্যের সাথে দায়িত্বপালন করি। তখন দুইবার ব্যাংকের শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপক  পদকও আমার ভাগ্যে জুটে। এই দুই দেশবরেণ্য এম ডি মহোদয়গণের বিদায়ের পর আমি যেন হঠাৎ হয়ে গেলাম খালে পড়া ব্যাংকার। ব্যাংকের তৈলাক্রান্ত পিচ্ছিল মস্তকের ওসব হাবভাব ও আচরণে অবাক হই, হতাশ হয়ে সরে রই।

আর অবাক চোখে দেখি এতদিন যে বা যারা তেল মালিশ করে করে উপরে গেছে, এখন তারাই নিজেদের পায়ে অন্যেদেতৈমর্দণ মহানন্দে উপভোগ করছে। এক সময়ের বিড়ালরা পদলেহন করতে করতে বাঘ হয়ে যায়, আর যারা বাঘ, তারা পদলেহন করতে না পেরে হয়ে যায় বিড়াল। এই হল সুকৌশলে ও তৈলমর্দনে মগডালে বসা আমার আত্মীয় আব্দুল হালিম চৌধুরীর ক্রিয়াকলাপ ও পূবালী ব্যাংকে তাঁর মহান শাসনামলের বাস্তব ছায়াচিত্র।    

এমএসএস; এমবিএ; ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং(সিবিল) এবং জেএআইবিবি; সনদধারী বিগত একযুগে বেশিকালের ব্যবস্থাপক আমি এই প্রথমবারের মত ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সালে কার্যকর প্রমোশনটি হারাই, হারাই প্রাপ্য সম্মানটুকুও অথচ এখানে এসএসসি/ এইচএসসি এবং ব্যাচেলর সনদধারী অজস্র কর্মীরাও এজিম হতে জিএম পর্যন্ত হন কোন বাঁধা ছাড়াই। দুইচার বৎসর কিংবা আদৌ ব্যবস্থাপক না হয়েও অনেকে মহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত হয়েছেন অনায়াসে

প্রমোশন না পেয়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা দ্বিতীয় পর্বের (ডিএআইবিবি) বইগুলো ছুড়ে ফেলে দেই। তেমন আহামরি কিছু নয়, ছোট্ট একটা চাকুরি কোনমতে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তাও যেন অনেকের সহ্য হচ্ছে না। নয়তবা আমার বাহিরের নানা সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা তাদের গাত্রদহনে অকটেন ঢেলে দেয়। হা চৌধুরীর নেতৃত্বে চাকুরি হতে ইস্তোফা দেবার মত হতাশা ও অপমানকর অবস্থায় আমাকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার সব প্রচেষ্টা চলে। এযেন হজরত ইউসুফ নবিকে ধাক্কা মেরে তার গুরুজৈষ্ঠ্য ভাতৃগ কতৃক কুয়ায় নিক্ষেপের মত একটি নির্লজ্জ ঘটনা।

ছিঃ ছিঃ আমার আজ বলতে লজ্জা হয়, এই সব কর্মযজ্ঞের নাটেরগুরু ছিলেন এই ব্যাংকের মগডালে বসা আমার আত্মীয় ঈগল আ হা চৌধুরী তার কন্ঠে আমাকে শুনতে হল সুন্দর সুন্দর নছিহত, আপনার ভাল হবে যদি আমেরিকা চলে যান, আপনাকে ব্যাংকের এই পরিচালক পছন্দ করেন না, সেই পরিচালক রংপুর পাঠাতে চান ইত্যাদি অথচ সিলেটে এইসব পরিচালকদের সাথে আমি সব সময় উঠাবসা ও চলাফেরা করে থাকি। আমেরিকায় বারবার গিয়েও ফিরে আসি, কারণ সেখানে অড্ড জব করতে হবে। আমার চিকিৎসক পত্নীরও সেখানে ভাল কাজ নেই। এতদিনে সাজানো গুছানো সংসার ছেড়ে মধ্যবয়সে আবার ভিনদেশে ভিন পরিবেশে শূন্য হতে যাত্রা শুরু করা চাট্টিখানি কথা নয়। ভাবলাম আগে অবসরে যাই, তারপর আমেরিকায় স্থায়ী হব। 

এক চরম অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে বসে। সেই অসহনীয় যন্ত্রণা হতে মনটাকে অন্যদিকে ফেরাতে ভাবলাম অর্থবহ একটা কিছু করি। লিখি, নিজেকে প্রকাশ করি তাহলে মনটা হালকা হবে, খানিকটা সুখ মিলবে।

ডিসেম্বর ২০১৭ সাল, আমার এই বায়ান্নতম শুভ জন্মমাসের কোন এক কোয়াশাঝরা শীতার্ত ভোরবেলা আমি মৌলভীবাজার শহরের অরেঞ্জটিলার নিরিবিলি পরিবেশে লেপটপ নিয়ে অভ্র সফটওয়ারে লিখতে বসি আমার এই যাপিত জীবনের গল্প “জীবনের খেলাঘরে” আমার আব্বা সফিক চৌধুরী বলতেন, প্রতিটি মুসকিলের পিছনে অনেকগুলো এহসান থাকে। এ যেন ব্যাংকে আমার ভাগ্য বিপর্যয়ের আড়াল হতে বেরিয়ে আসা স্রষ্টা প্রদত্ত এক হসান।

আমার প্রিয় মৌলভীবাজার, আমার প্রাণের শহর মৌলভীবাজার, হে প্রকৃতি কন্যে, তুমি আমার এই লিখার নীরব সাক্ষি হয়ে গেলেআর একজন জীবন্ত মানব এই লিখার সাক্ষি হন, তিনি অরেঞ্জটিলার আমার বাসামেট মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের তরু অধ্যাপক মোঃ মশিউর রহমান।

ব্যাংকের কোন অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান আমার জন্য বিষ গেলার মত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে অতীতের সবসময় প্রতিষ্ঠান চালাতো যোগ্যরা, এখন তাদের জায়গা দখল করে নেয় আপাদমস্থক সব চাপাবাজ ও তেলবাজের দল। পদলেহনই তখন যোগ্যতার আসল মাপকাটি হয়ে যায়। মোসাহেবদের রসাল তেলে আনন্দস্নান করে এমডি আ হা চৌধুরী ওদের হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হন। তাঁর নিজস্ব কোন সত্বা ছিল না। তোষামুদকারীরা তাঁকে লালনীল যা গেলায়, তাই তিনি পান করেন। এসব মোঠামাথাওয়ালাদের শকুনদৃষ্টি হতে পালাতে আমি নিভৃতে আশ্রয় নেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার চেষ্টা করি সেখানেও ঠাঁই নেই, যেন গায়ে পড়ে আমাকে নিয়ে টানাহেচড়া দশ হাজার কর্মীর এই বিরাট প্রতিষ্ঠানে সামান্য আমার প্রতি উপরমহলের এত এত সুদৃষ্টি ও কুদৃষ্টির অবিরাম ঠেলাধাক্কায় টেকা যেন দ্বায়। দশ হাজার কর্মীরা কেউ বুঝি কিছুই নয়, একমাত্র আমি ইসফাক কুরেশীই যেন পুবালী ব্যাংক পিএলসি।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে মানুষের যে কোন শিল্পী সত্তাও অর্থহীন। আমি সামান্য লেখালেখি করি আড়ালে আবডালে নিজবাসায়, তাও অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। আমি ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক, সামান্য বেতনের জন্য এখানে চোখ বুজে পড়ে রই কার বেতনের এই সামান্য টাকাই আমার মুল জীবিকা, বাঁচার উপকরণ। তাই এখানে না পারিলাম মরতে আমি, না পারিলাম বাঁচতে, না পারিলাম সুখের ঐ সোনার হরিণ ধরতে। এখানে আমার স্বপ্ন মরে যায়, আশা পথ হারায়, হতাশা যেন  পিছু ছাড়ে না।

আমার বিবাহভাগ্য সুপ্রসন্ন। দয়ালু প্রভূ আমাকে একজন শান্ত ও স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন সহধর্মিণী দান করেন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হতে এম.বি.বি.এস পাশ করা ভাল বংশের এই উত্তম নারী আল্ট্রাসোনগ্রাফি, হিস্টারোপ্যাথলজি ও গাইনি চিকিৎসায় বেশ সাফল্য পান। আমার প্রতি তার অকৃত্রিম আস্থা ও বিশ্বাস আমাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে দেয়। প্রভিডেন্ট ফান্ড বন্ধক রেখে গ্রহ করা অল্প সুদের ঋণের টাকা ও ডাঃ নূরজাহান চৌধূরীর কষ্টার্জিত অর্থ ব্যবহার করে নানা ধরনের ছোট ছোট ব্যবসা করি। আল্লার মেহেরবানিতে এখানে প্রচুর সফলতা আসে আমার হাতে এসে বালুকারাশি যেন সোনায় পরিণত হয়। ব্যবসার সাফল্য আমাকে প্রেরণা দিত। এই প্রেরণা আমাকে বিষণ্ণতা ও টেনশন হতে মুক্ত রাখত লেখালেখি আমার দুশ্চিন্তাকে হাওয়ায় মিশিয়ে দিত। আসলে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, টেনশন যাই আসুক না কেন মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আমার মনোজগতে প্রতিষ্ঠিত সুধারণা, সুদৃঢ় বিশ্বাস ও নিখাদ কৃতজ্ঞতাবোধ সব ময়লা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিত এবং নিমিষেই আমি সুখময় এক প্রশান্তির  স্বর্গরাজ্যে নিজেকে দেখতে পেতাম।  

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে আমার বয়স বার। সেই বার বৎসর বয়স হতে অনবরত আনমনে নীরবে নিভৃতে লিখে গেছি অনেক অনেক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস ও কলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত হলে এক স্বর্গীয় আনন্দ পেতাম। কিন্তু কোনদিন কারও স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসার ধার ধারি নি। শত শত পৃষ্টা পান্ডুলিপি জমে ফাইল ভরে গেছেকাউকে কোনদিন বলতে যাই নি আমি কবি কিংবা লেখকমনের চিন্তা ও ভাবনাকে কলমের ঠোঁট দিয়ে সাজিয়ে সাজিয়ে লিখে আনন্দ পেতাম। এযেন নিজের সাথে নিজেরই গল্পাচার, নিজের সাথে নিজেই যেন আনন্দে লিপ্ত হওয়া।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে মোঠ দশটি আলাদা আলাদা বইয়ের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র। বইটিও প্রকাশ করলাম একারণে যে, হায়াত ও মউতের খবর কেউ জানতে পারে না। যদি হঠাৎ মারা যাই, তাহলে আমার এই বিশাল লেখামালা চিরদিনের জন্য অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

এখানে দশটি বইয়ের সমাহারে রয়েছে ইতিহাস গ্রন্থ- “হজরত শাহজালাল(রঃ) এবং হজরত শাহদাউদ কুরায়শি(রঃ)” ছোটগল্প গ্রন্থ- “ঝরাপাতা” সনেট কাব্য- “রমণীয় ঘুম ভেঙ্গে গেলে” সিলেট কাব্য- “সিলেট তোমার নাম, আমি কবিতা দিলাম” বিদ্রোহী মানবিক কাব্য- “আমার রক্তে যদি মুক্তি আসে”  প্রেমকাব্য- “যে প্রাণে আগুন জ্বলে” শিশুতোষ কাব্য- “আরম্ভ রাগিণী” বঙ্গপ্রকৃতি কাব্য- “ঋতুচক্রে ইসফাক” প্রবন্ধ ও কলাম গ্রন্থ- “সময়ের দিনলিপি” এবং গানের বই- “লাল গোলাপ” ইত্যাদি

একটি ছোট্ট এ্যালবাম সংযুক্ত ১১৭৬ পৃষ্টার বিশাল এই ডাউস আকারের বইটির প্রকাশনা উৎসবও করা হলনা। বাংলাদেশের মফস্বলের একজন অজানা অচেনা কবি ও লেখক মানুষ আমি, এক নিজস্ব নিভৃত জগতেই আমার বসবাস, আমি সংগোপনে অপ্রকাশ্য হয়ে আজীবন রয়ে গেলাম সেই নিশি জগতেরই একজন লাজুক বাসিন্দা

শুধু একজন লেখক নই, আসলে আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে তীব্র জ্ঞানতৃষ্ণা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বইয়ের পর বই গোগ্রাসে পড়ে সাবাড় করেছি। রাত জেগে জেগে বই পড়েছি। ইতিহাস, সাহিত্য, কবিতা, দর্শন, গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, জ্যোর্তিবিদ্যা, ভূগোল, সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবসা, ধর্মতত্ব, চুড়ান্ত বিজ্ঞান। জ্ঞান বিজ্ঞানের কিছুই আমার পাঠ্যক্ষুধার তালিকা হতে বাদ পড়ে নি। এই পাঠ্যক্ষুধাই আমার লেখালেখির আরেক শক্ত উৎস ও অনুপ্রেরণা।

বিশ্বের এক কঠিন জায়গা বাংলাদেশ। মৌচাকের ভ্রমরের মত গাদাগাদি মানুষ তীব্র জীবনসংগ্রাম করে পাশাপাশি পরস্পর ভালবাসার এক অদৃশ্য জাল তৈরি করে এখানে বেঁচে রয়। এযেন সবাই সবাইকে নিয়ে বাঁচব, আর যদিবা মরতে হয়, তবে সবাই একসাথে মরব। কেউ কাউকে ফেলে যাব না। মহান একাত্তরের মহাসংকটেও এই জাতি জীবন ও মৃত্যুকে এমনই ভাবে পরস্পর ভাগাভাগি করে নিয়েছিল।মানুষের পর মানুষ, ঘরের পর ঘর, জনপদের পর জনপদ, এই হল বাংলাদেশ। সুখ দুখ, আনন্দ ব্যদনা, হাসি ঠাট্টা, রম্যরুমাঞ্চে ভরা এমনই এক গর্বিত বাংলাদেশী জীবন আমার।

স্মৃতিময় এই জীবনের কথামালা আমি সময়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সাজানোর চেষ্টা করেছি। স্মৃতিভ্রান্তি কিংবা স্মৃতিভ্রম হলে তার উপর আমার কোন হাত নেই। তবে লেখার সততা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে আমি সবার উপরে স্থান দিয়েছি। স্মৃতি আমার মস্তিস্কে যে ভাবে উদয় হয়েছে, ঠিক সেভাবেই কলমের ডগায় নিয়ে এসেছি। মহান স্রষ্টার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা সীমাহীন এই কারণে যে তিনি আমাকে অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী করেছেন।  

শৈশবে ততটা বুঝি নি, তবে যতই পূর্ণ হলাম ততই আমার প্রতি বিধাতার অপার করুণা ও মহিমা অঝোর ঝর্ণাধারার মত বর্ষিত হতে দেখি। শরীরের প্রতিটি জীবকোষ, প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, প্রতিটি রক্তকনিকা তার অমূল্য দান। তার বিনামূল্যে বিতরণ তাপ, আলো, বাতাস, পানি ও জন্মক্ষণের মাতৃদুগ্ধ। অদৃশ্য নিয়ামত হল বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, বাকশক্তি, লেখনিশক্তি, কবিত্বশক্তি, সম্মান, সুখ্যাতি ও প্রতিপত্তি।

মনে হলো আল্লাহ আমাকে প্রশান্তি দান ও আত্মার মুক্তির জন্য একেশ্বরবাদী মুসলিম পরিবারে, সুখী ও শিক্ষিত করার জন্য এক উচ্চমধ্যভিত্ত ও জ্ঞানী ঘরে, অতিরিক্ত সম্মান ও প্রতিপত্তি পাবার জন্য এক অভিজাত বংশ ও নরকূলে জন্মদান করেন। আমার জীবনে অর্জিত সব ধনঐশ্যর্য, দেশেবিদেশে ভ্রম, অজস্র লেখামালা, ডিগ্রিফিগ্রি, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড সবই পরম দয়াল আল্লাহপাকে  আপার রহমত, বরকত ও নিয়ামত ছাড়া আর কিছু নয়

এই করুণাময়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আমাকে এতই সাহস যোগা যে কোন ঝড়ঝাপটা আমাকে কোনদিন নুয়াতে পারে নি। সর্বত্র বিরাজমান এই পরমাত্মা যেন গোপনে আমার শাহরগেরও ধারে অবস্থান করে আমাকে সযতনে লালনপালন করে যান। অন্তরের কর্ণে তার আদেশ শুনি- সামনে চল জুর কদমে, আমারই নামে বিবেকের পথে।

বাবা সফিকুর রহমান চৌধুরী বলতেন আস্তে হাঁটে থামে না, তার নাগাল কেউ পায় না তিনি আর বলতেন, মহান আল্লাহতায়ালার ৯৯ গুণবাচক নাম সর্বদা জপ করবে, এই নামসমূহের গুগুলো নিজের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করবে। তাই আল্লাহর ৯৯ নাম জপে জপে আমি হেঁটেছি ধীরে ধীরে কিন্তু না থেমে, সেই কচ্ছপ খরগোসের গল্পের দৌড়ে জেতে যাওয়া শম্বুক প্রাণীটির মতন।

বিখ্যাত ভারতীয় উর্দু কবি আকবর এলাহাবাদি চাকুরের জীবনকাহিনি নয়টি শব্দে প্রকাশ করেছেন- “বি এ কিয়া, নওকর হয়ে, পেনশন মিলি, মর গ্যায়ে”। শিক্ষাজীবনের শেষপ্রান্তে ব্যচেলর হয়ে আমি চাকুরি নেই, যদিও আমি আজ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি আলাদা বিষয়ে মাস্টার্স। এখন আছি ব্যাংকের নওকর হয়ে, তাই আটকলা সমাপ্ত। পেনশনে গেলে আর চারকলা এবং একদিন মরগ্যায়ের মাধ্যমে আমার জীবনের ষোলকলা পুর্ণ হবে। 

বিশ্ববিখ্যাত ইংলিশ কবি ও নাট্যাকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি চিরন্তন বানী প্রায়ই আমার মনে পড়ে “একটা রঙ্গমঞ্চ এই পৃথিবী এবং তাতে খেলোয়াড় সব মানব মানবী”

হ্যাঁ, মন দিয়ে শুনো হে ধূলিধূসর পৃথিবী, আমি তোমার মাঠে বর্তমান সময়ের একজন জীবন্ত খেলোয়াড় এবং জন্মমূহূর্ত হতে প্রতিটি দিন প্রতিটি সেকেন্ড আমি তোমার এই নিয়তির মাঠে কেবল খেলেই যাচ্ছি। গুণেগুণে একদিন আমার জীবন রঙ্গমঞ্চের এই চলমান নাটকের ইতি ঘটবে আমার আত্মাটা বের হয়ে চিরচেনা এই ব্রহ্মান্ডের সীমানা পেরিয়ে চিরজীবন্ত ও চিরস্থায়ী স্বত্বা পরম করুণাময় আল্লাহর রহস্যময় আধ্যাত্মিক জগতে বিলীন হয়ে যাবে। এখানে কফিনে পড়ে রবে সাদা কাফনে ঢাকা আমার দ্রুত পচনশীল এই দেহপিজ্ঞর।

হে পৃথিবী, সেদিন আমার লাশের চারপাশে বসে কাঁদবে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় আপনজন সবাই। শশব্যস্ত তাঁরা শোক পালন করবে বড়জুর চল্লিশ দিন। আমাকে পুতে ফেলা হবে তোমার কোন এক সবুজ ময়দানে। তারপর তোমার বুকে অতীতে সদর্পে বিচরণকারী লক্ষ কোটি জনতার মত মহাকালের কৃষ্ণগহ্বরে চিরতরে হারিয়ে যাব আমি।

আমার এই জীবনটা কেমন? সফলা না কি নিস্ফলা? অর্থবহ না কি অর্থহীন? কাজের না কি অকাজের? ঐতিহাসিক না কি সাধারণ তুচ্ছ? এমন অসংখ্য প্রশ্নের গোলক ধাঁধায় পড়ে মনকে বুঝাই এতসব নিয়ে ভেব না, শুধু কাজ করে যাও। কাজই তোমাকে ভবিষ্যতে মূল্যায়িত করবে। আল্লাহকে স্মরণ কর, তার কাছে ক্ষমা চাও, তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং হাঁটো নতমস্তকে বিবেকের সোজা পথ ধরেতাহলে হয়ত তোমার এই অতি সাধারণ জীবনটাই হয়ে যাবে দুনিয়া ও আখেরাতের দুই পর্বে অমর, অজর এবং অক্ষয়। তখন জানিনা এই তুচ্ছ জীবন হয়ে যেতে পারে সাধারণ্যে স্মরণীয় বরণীয় ও সম্মানীয় সহজ ভাষায় যার অর্থ- সফল ও সার্থক।   

বেহেস্তের লোভ কিংবা দোযখের ভয়ে আমি কখনো পরিচালিত হইনি। আমি একমাত্র পরম স্বত্তা মহান আল্লাহপাকের ভালবাসাকে  কেন্দ্র করে পৃথিবীতে আবর্তিত হয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রথমে মহাশূন্য, তারপর স্রষ্টা এবং তারপর মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। শক্তি সময় ও স্থান এই তিন ডায়মেনশনে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে মহান প্রভু সৃষ্টি, পরিচালনা ও পরিবর্তন করে যাচ্ছেন। আমি সতত মহান স্রষ্টা প্রদত্ত ন্যায়বোধ, স্বাধীন চিন্তা, বিবেক ও বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছি মহান আল্লাহ নিখুঁত, তিনি সত্য ও সুন্দর। সবসময় আমি কেবল চেয়েছি মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালার দয়ামায়া ও ভালবাসা।

আমি দোযখের চেয়েও মহান আল্লাহকেই বেশি ভয় করি এবং বেহেশতের চেয়েও তাঁর নিখাদ স্নেহমায়া ও ভালবাসা অধিক শ্রেয় মনে করি। আমি সারাজীবন কেবল তারই আরাধনা করে গেছি। এই ভবজীবনে যেমন পরমাত্মার স্নেহধন্য হয়েছি, পরকালেও তেমনি মেহেরবান পরমাত্মা আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তায়ালার পরম স্নেহ ও দয়া-মায়া-মমতার ছায়াতলে কোনমতে আশ্রয় পেলেই আমার পরকালও সার্থক হবে

জীবনের খেলাঘরে গ্রন্থটি আমার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এক উজ্জল প্রচ্ছায়া ও ভাবনার জলরঙ জীবনের অজস্র গল্প ও কাহিনির বিচিত্র সমাহার। এই মহাগ্রন্থটি যদি আমার ভাবমূর্তির একটা জীবন্ত ভাস্কর্য্য হয়ে যুগে যুগান্তরে মানুষের চোখে পড়ে, তাদের কাছে পঠিত,  চর্চিত ও আদৃত হয়, সর্বযুগে পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে যদি বারে বারে মুদ্রিত হয়, কেউ না কেউ ইন্টারনেট, ইবুক কিংবা মিডিয়া জগতে যদি বইটিকে সময়ে সময়ে পাঠ ও সংরক্ষণ করেন, জনতার দরবারে বইটিকে সতত তুলে ধরেন, তবেই আমার এই পরিশ্রম ও সাধনা যথার্থই সফল ও সার্থক বলে গণ্য হবে

হে মান্যবর পৃথিবী, আমার জীবন ও কর্মকে তুমি যদি অনন্তকাল মনে রেখো, তাহলেই আমি হয়ে যাব তোমার এক চিরধন্য জাতক,  তোমার এক সৌভাগ্যের বরপূত্র

আমার সর্বকালের সকল সম্মানিত পাঠকগণের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত কামনা করছি। তাঁদের সবার উপর চিরজীবন্ত করুণাময়ের সীমাহীন সুখ, শান্তি ও কৃপা বর্ষিত হউক। ভূমিকা ইতি। আমিন। 

       কবি লেখক ব্লগার ও ব্যাংকার চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন