শৈশবস্মৃতিতে সমুজ্জল গৌরবময় ১৯৭১ সালঃ
মহান এক
অর্জন লক্ষলক্ষ দেশপ্রেমিক শহিদের রক্তে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। এক রক্তক্ষয়ী
মুক্তিযুদ্ধ, লাখো আত্মবলীদান, কোটি
মানুষের বাস্তু হারানো, হাজার হাজার মাবোনের ইজ্জত বিসর্জনের
বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চিরস্মরণীয়
বছর ১৯৭১ সাল। এই সালে আমার জীবনের যষ্ট বৎসরটি অতিবাহিত হয়। এই সময়টাকে মনে হয় আমার
জীবনের সর্বশ্রেষ্ট অধ্যায়। এই সময়ে সংঘটিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ে বিশ্ব
মানচিত্রে বহু শতাব্দী পর স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমাদের অভ্যুদয় ঘটে। তখন
বয়স মাত্র ছয় হলেও আমার গর্ব আমি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজ চোখে দেখেছি। আর দুঃখ, বাঙ্গালীর
এই ইতিহাসশ্রেষ্ট যুদ্ধে অংশগ্রহণের বয়স ও সুযোগ কোনটাই আমার হয়নি। আমি তখন অর্ধনগ্ন ছয় বছরের এক
অবোধ শিশুমাত্র। মনে পড়ে জঙ্গি বিমানের গর্জন শুনে ভয়ে মাকে কিংবা
বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম। বোমার আওয়াজ শুনামাত্র আঙ্গিনা হতে দৌড়ে ঘরে এসে লুকিয়ে যেতাম। আমার দুঃখ একারণে
যে, কোন জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ একবারই হয়, বারবার সংঘটিত হয় না।
বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ মহান আল্লাহ পাকের অপার মেহেরবানিতে
শিশুচোখে দেখলাম, অথচ আফসোস, শিশু বয়সের
কারণে এই মহান যুদ্ধের
মুক্তিযুদ্ধা হবার সৌভাগ্য আমার হল না।
১৯৭১ সালের
জানুয়ারি মাসে আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের
শুভসূচনা হয়। আমি ও বোন আনিছা চৌধুরী মান্নাকে আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী তুরুকখলা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। পাঠশালার শিক্ষকরা আব্বার পরিচিত ছাত্র ও বন্ধুজন। আব্বা শিক্ষকদের হাতে
আমাদেরকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরেন। এই বিদ্যালয়ের ক্লাস
ওয়ানে আমরা দুই ভাইবোন, আমি ও আনিছা চৌধুরী মান্না ভর্তি হলাম। ১৯৬৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় বানচালের প্রতিবাদে রাজনৈতিক
গোলযোগ সারা বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বাংলাদেশ ‘ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা, মানি না, মানব না’
বলে প্রচন্ড প্রতিবাদে গর্জে উঠে। একটানা হরতালে দেশ অচল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের আপাময় জনগণ স্বাধীনতা
যুদ্ধের উম্মাদনায় উদ্দীপ্ত
হয়ে উঠেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ পাঠশালায়
আসা যাওয়া করি, ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এপ্রিল হতে স্কুল খুবসম্ভব বন্ধ হয়ে যায়।
এসময় মেঝবোন সেহা বাড়িতে বসে গান গাইতেন- “মুজিব বাইয়া যাওরে, সাড়ে সাতকোটি
বাঙ্গালির নাও, মুজিব তুমি বাইয়া
যাও, বাইয়া যাওরে। “একটি মুজিবরের কন্ঠ হতে লক্ষ মুজিবরের
কন্ঠধ্বনী উঠে অনুরণী- বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ”। তার
এই গান গাওয়া আমার শিশুমন মুগ্ধ করত।
এসময় লোকজনের মুখে শুনা যেত কর্নেল ওসমানি, দেওয়ান ফরিদ গাজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাবরুল হোসেন বাবুল, বাঘা সিদ্দিকি প্রমুখের বীরত্বের মুখরোচক গল্প ও কাহিনি। গাঁয়ের বালকদেরকে সর্বদা জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে সমস্বরে চিৎকার দিতে শুনতাম। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে ভাসমান নিহত মানুষের লাশের গল্প ও গণহত্যার নানা কাহিনি তখন মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়াত। সিলেট শহর হতে আসা দরগামহল্লার ফুফুতো ভাইদের কাছে শুনা যায় সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের হত্যাকান্ডের কাহিনি। সিলেট শহরের আশপাশের চাবাগানের নিরিহ শ্রমিকদের সারিবদ্ধ দাঁড় করে গুলী করে মেরে ফেলার করুন কাহিনি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।
পাকসেনা ও
রাজাকারদের বিভিন্ন গ্রামে অমানুষিক নির্যাতন, নির্যাতনের নানা বর্বর পদ্ধতি যেমন
মানুষকে পা বেঁধে মাথা নীচ দিকে ঝুলিয়ে পেঠানো, ছুরি দিয়ে
চামড়া উপড়ে মরিচের গুড়া ছিটানো, লাইন ধরিয়ে নদীপারে গোলী করে
সংখ্যালঘু ও স্বাধীনতাপন্থী জনতাকে হত্যা ইত্যাদির করুণ কাহিনি হাওয়ায় উড়ত। নারী ও শিশু হত্যার কিছু করুণ কাহিনি
শুনে মানুষের চোখে অশ্রু নামত। এসব
অনাচার ও অবিচার সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী
করে তুলে। ফলে বিক্ষুব্ধ লোকজন দলেদলে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে
অনুপ্রাণিত হন।
আমাদের
বাংলোয় হুজুরদের আনাগুণা ছিল। তারা ছিলেন পাকিস্তানপন্থী,
তবে রাজাকার নন। তাদের বড় হুজুরের ধারণা বাংলাদেশ দখল
করে নিতে ভারত এই গন্ডগোল বাঁধিয়েছে। কুলাউড়ার কানিহাটি হাজিপুর গ্রামের আমার
ফুফুতো ভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ভারতের মেঘালয়
হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
করেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি গোপনে তার
নানাবাড়ি দাউদপুরে আসতেন। চাচাতো ভাইরা বেশিরভাগ ছিলেন তাঁর
সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুজুরদের সাথে বিতর্ক বাঁধলে হুজুররা একসময় যুক্তিতর্কে হেরে
যেতেন। যুক্তিতর্কে টিকতে না
পেরে একদিন বড়হুজুর বললেন- আপনাদের সাথে আমরা আর তর্কবিতর্ক
করব না, ঈমান অমূল্য
সম্পদ, আর তর্কবিতর্ক করলে আমাদের
ঈমানের ক্ষতি হয়ে যাবে। পাকিস্তানপন্থী হুজুররা এভাবে
যুক্ততর্কে হেরে ইমানের দোহাই দিয়ে পাততাড়ি
গোটাতেন। তাদের শেষ আশ্রয়স্থল,
বিশ্বাসে মুক্তি, তর্কে বহুদূর। তাঁরা বুঝতে অপারগ যে তাঁদের এই
বিশ্বাস ইসলামের চিরন্তন কোন বিশ্বাস নয়, তা পাকিস্তানীদের গেলানো একপ্রকার ভ্রান্ত ধারনা, ভ্রান্ত বিশ্বাস। বাংলাদেশকে উপনিবেশ করে রাখার জন্য এগুলো তাঁদের তৈরি ভূল মতবাদ ও দর্শন ছাড়া কিছু নয়।
স্বাধীনতার
বৎসর আমার দুই ফুফুতো বোন চারখাই সাচানের আসমা আপা এবং শায়েস্থাগঞ্জ দাউদনগরের
জেবু আপা বিপদগ্রস্ত হয়ে সপরিবারে আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।
আসমা আপার পুত্র মাসুম, কন্যা রুজি ও রুহি
আমাদের খেলার সাথী হয়ে যায়। জেবু আপার পুত্র জেনু, শানু ও কন্যা সুহেলি এসে আমাদের দল ভারি করে। যুদ্ধ
চলছে, বোমার শব্দে বাড়ি কাঁপছে, যুদ্ধ বিমান তর্জনগর্জন করছে, পাঠশালা লম্বা বন্ধ। অবসর আর অবসর। বড়দের দিন কাটে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের হারজিত নিয়ে কানাকানি করে। আর আমরা ছোটদের দিন কাটে বাড়ির আঙ্গিনায় সারাদিন খেলাধূলা করে।
আমাদের
বড়চাচা তৈয়বুর রহমানের বড়ছেলে শামসুদ্দোহা চৌধুরী
ছিলেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। সামন্তপ্রথা বিলুপ্তির পর জমিদারি চলে গেলে
সিলেটের সর্বত্র এই কুলীন পরিবারগুলো তীব্র অর্থ সংকটে
আপতিত হয় এবং দারিদ্রতা হঠাৎ তাদের কাঁধে চেপে
বসে। বড়চাচার বড় পরিবার, আয় রোজগার কম। তাই বাধ্য হয়ে তার বড় পুত্র শামসুদ্দোহা চৌধুরী
পাক সেনাবাহিনীতে ঢুকে যান। তিনি তখন কুমিল্লার ময়নামতি
সেনানিবাসের সিগন্যাল কোরে কর্মরত। ২৬শে মার্চ ১৯৭১, যুদ্ধ শুরু হলে বড়চাচার ঘরে ভীষণ
অশান্তি শুরু হয়। শমসু ভাইয়ের কোন খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছেনা। তিনি
জীবিত আছেন, নাকি মারা গেছেন, কেউ কিছু জানাতে পারছেনা। চাচা চাচি
ভাবী সবাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিনরাত দুশ্চিন্তায় অস্থির। এই আশান্তি একসময়
পূরো বাড়ি গ্রাস করে ফেলে।
এপ্রিল মে মাসের
কোন একদিন বড়চাচার ঘরে ভীষণ
কান্নাকাটিতে চারপাশের মানূষ ছুটে আসেন। শামসুদ্দোহা চৌধুরীর ময়নামতি
সেনানিবাসের একজন সহকর্মীর
মাধ্যমে খবর আসে তিনি মার্চের শেষদিকে বেলুচ ডিভিশনের
আক্রমণে শহিদ
হয়েছেন। খবরদাতা সেনাসদস্য সেই
কালোরাতে সেনাব্যারাকে একসাথে ছিলেন ও ভাগ্যক্রমে
সেনানিবাস হতে রাতের অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর ধারণা শামসু ভাইকে ইষ্টব্যঙ্গল রেজিমেন্টের আর অনেক
সৈনিকের সাথে সেইরাতে শহিদ করা হয়েছেন। বড়চাচার ঘরে গ্রামবাসী ভিড় জমান এবং
তাদেরকে ঘিরে সবাই
সান্তনা দেন।
চাচি ও ভাবী
বারবার মূর্ছা যান, সবাই তাঁদের
মাথায় পানি ঢালেন। খবরটাও এত ভাসা ভাসা
ছিল যে, কেউ কেউ বিশ্বাস করলেও অনেকে গোজব মনে করছিলেন। ঘটনাটা এরকম ছিল যে, বেলুচ ডিভিশন
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে অস্ত্রাগারের চাবি দাবি
করে। ইস্টবেঙ্গল চাবি প্রদানে আস্বীকৃতি জানায়। রাতের আধারে আচমকা ইস্টবেঙ্গল
রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈনিকদের উপর সশস্ত্র বেলুচরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাতের
হালকা অস্ত্র নিয়ে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে ইস্টবেঙ্গল
রেজিমেন্টের অনেকে আহত ও নিহত হন, কেউ কেউ পালিয়ে কোনমতে প্রাণরক্ষা
করে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এমনই
একজন ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকের
মাধ্যমে এই দূঃসংবাদটি আমাদের বাড়িতে পৌঁছে। শাহাদতকালে
তার বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ বছর। চাচি
সফিকুন্নেছা চৌধুরী কখনও বিশ্বাস করতেন না তাঁর বড়ছেলে শামসু নেই। আম্মাকে বলতেন, দেখিও
গো রেহার মা, আমার পোয়া একদিন না একদিন বাড়ি ফিরে আইবো।
শহিদ শামসুদ্দোহা চৌধুরী
বড়লেখার গাংকুল গ্রামের মন্ত্রী ও এমপি
এবাদুর রহমান চৌধুরীর চাচা আব্দুস সত্তার চৌধুরীর কন্যা মিসবাহ খানম চৌধুরীর সাথে
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শাহাদাতকালে তার একমাত্র পুত্র বদরুদ্দোহা কুরেশির
বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বৎসর। দুই কন্যা দিপা
ও মাজেদা হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। তিনি মহান
স্বাধীনতা যুদ্ধে দাউদপুর গ্রামের ও
আমাদের বংশের গৌরবময় আত্মদানকারী
একজন শহিদ, তাকে নিয়ে আমরা
রেঙ্গাবাসী গর্বিত, বাংলাদেশ গর্বিত।
তিনি বাংলাদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী একজন অবহেলিত শহিদ। দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীন বাংলাদেশের কোথায়ও এই শহিদের স্মরণে কোন স্মৃতিচিহ্ন আজও নেই। তবে ১৯৮৫ সালে তাকে নিবেদন করে আমি একটি শোকগাঁথা “হে রক্তাক্ত নক্ষত্র” রচনা করি। শোকগাঁথাটি আমার কাব্য “হৃদয়ে বাংলাদেশ” এর অন্তভূক্ত করেছি। আমাদের গ্রামের মুতিরপাড়ার মোল্লাবাড়ির বাট্টি হাফেজ ও কাজির একমাত্র তরুণপুত্র যুদ্ধকালে গোলাগোলীর মাঝে পড়ে শাহাদাত বরণ করেন।
আমাদের স্ববংশীয় মাঝের বাড়ির চাচাতো ভাই হুমায়ূন দাউদ কুরেশি ছিলেন সিলেট বিমানবন্দরের পরিচালক। তিনি চাকুরী ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পিতা হাসিবুর রাজা চৌধুরী তাঁর চিন্তায় অশান্তিতে দিন কাটান। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই জকিগঞ্জ স্বাধীন হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজি হুমায়ূন ভাইকে কিছুদিনের জন্য জকিগঞ্জের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। পরে তিনি নিজ কর্মক্ষেত্র সিলেট বিমানবন্দরে যোগ দেন।
সময়ের সাথে
সাথে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। সিলেট শহরের মাত্র পাঁচ ছয় মাইল দুরত্বের মধ্যে
আমাদের দাউদপুর গ্রামের অবস্থান। গগনের বুকচিরে যুদ্ধবিমানের ঝাঁক প্রচন্ড নিনাদে
যখন সিলেট শহরের পানে উড়ে যেত আমরা ভয়ে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকতাম।
মাঝে মাঝে আকাশে যুদ্ধবিমান একে অন্যকে ধাওয়া করত। পাকাবাড়ির জানালার রড ধরে দাঁড়িয়ে আমরা আকাশপানে তাকিয়ে যুদ্ধবিমানের ডগফাইট
দেখতাম। প্রচন্ড গোলাগোলী ও বোমাবর্ষণের বজ্রনিনাদে
আমাদের পাকা টিনের ঘর বারবার কেঁপে উঠত।
মনে হত ঘরটি বুঝি এখনই মাথার উপর ভেঙ্গে
পড়বে।
আমাদের ঘরের
পিছনে নীচু পাকা এক শীতল কোঠা ছিল। এখানে পূর্ব হতে পশ্চিমে সদা ঠান্ডা বাতাস বইত। গ্রীষ্মের তীব্র গরম হতে রক্ষা পেতে আমরা
এই কোঠায় বসতাম। এই কোঠার উপর আম ও কাঁটাল গাছ ছায়া দিত। আম্মা এই কোঠার পাকাফ্লোর
ধূয়ে মুছে পরিস্কার করে এই যুদ্ধকালীন সময়ে
এখানে আমাদের সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন। মাটি লেবেল হতে খানিকটা নিচে অবস্থিত এই
কোঠা বাংকারের মত কিছুটা নিরাপদ ছিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের উদ্বেগ ও অশান্তির দিনগুলোতে এই কোঠা হয়ে যায় আমাদের শান্তির নীড়। এখানে মাবাবাকে নিয়ে আমরা পাঁচ ভাইবোন রেহা, সেহা, তাহমিদ, মান্না ও আমি এক বিশাল মেলানো বিছানায় ঘুমাতাম। আমরা যখন এই নিদমহলে ঘুমাতাম, উদ্ভিঘ্ন আম্মা আসমতুন্নেছা তখন সারারাত
জেগে জেগে আমাদের শিয়রের কাছে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়তেন। রাতে গগনবিদারী কামানের বজ্রনিনাদে বারবার
সারাটা ঘর কেঁপে উঠত ও আতংকে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যেত, তখন দেখতাম মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী পাশে নির্ঘুম বসে
তসবিহ জপছেন, কোরান তেলাওত করছেন, দেশের শান্তি জন্য প্রার্থনা করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের
শেষদিনগুলোতে একদিন আমাদের গ্রামে মুক্তিবাহিনীর আগমন ঘটে। বাড়ির সামনের
বড়রাস্থা দিয়ে অগণিত মুক্তিযুদ্ধারা কলাম তৈরি করে উত্তর হাওরের
দিকে ধাবিত হন। খাকি পোষাক পরা পিঠে ভারী ব্যাগ, হাতে অস্ত্রসজ্জিত হাজার হাজার মুক্তসেনার
উত্তর হাওরে ধাবমান সারি যেন শেষ হবার নয়, এযেন নদীর সর্পিল বুকচুরে বহমান অগণিত
মানব তরঙ্গমালা। কেউ কেউ রাস্থার পাশে নেমে অস্ত্র
থাক করে পজিশন নিচ্ছিলেন, দুরবিন দিয়ে আকাশ দেখছেন। রাস্থার দুপাশে বাংকার খনন করছেন। ভাতিজা বদরু তখন পাঁচ
বছর বয়সের বাচ্চা, সে ভয়ে কান্না জুড়ে দেয়। একসময় আমিও ভয় পেয়ে বড়পুকুরের দক্ষিণপার
হতে বাড়ির দিকে দৌঁড় দেই। পিছুপিছু আব্বা অভয় দিয়ে আমাকে বাংলোয় নিয়ে আসেন।
শিশুকালে দেখা সেই মুক্তিসেনার সারি আজও মনে
জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। দেশের মুক্তির জন্য অকাতরে প্রাণদানে দৃপ্ত পদক্ষেপে
এগিয়ে যাওয়া সেই মুক্তিবাহিনীর ছবি আমার জীবনের দেখা সর্বশ্রেষ্ট চিত্রকলা, যে দৃশ্য
কোনদিন ভূলবার নয়।
পরদিন এই মুক্তিবাহিনী
গ্রামের উত্তর সীমানা জুড়ে বাংকার খনন শুরু করেন। রাতে
তারা খবর দেয় দেড়মাইল উত্তরে সিলেট-গোলাপগঞ্জ-জকিগঞ্জ সড়কে বড়ধরনের যুদ্ধ হতে পারে। রফিপুর শ্রীরামপুর গ্রামে ঢুকে পাকবাহিনীর গাড়িবহরে হামলা করে তাঁদের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তাঁরা বাড়ি ছেড়ে অপাততঃ চলে যেতে উপদেশ দেয়। বাদ
সন্ধ্যায় বাড়ির নর নারী শিশু সবাই মিলে পাশের গ্রাম তুড়ুকখলায় রওয়ানা হই। মদনগৌরী
গ্রামের দক্ষিণদিকের বুড়িবরাক নদীর মধ্যে একটি বাঁধ দিয়ে হেঁটে
পার হই। আমাদের কর্মচারী তছব্বির আলী ও ইস্কন্দর আলী আমাকে সারাটা
পথ কোলে করেই নিয়ে যান। এই
গ্রামের সজ্জাদ মিয়া সাহেব আব্বার বাল্যবন্ধু ও আজীবন সুহৃদ ছিলেন। তিনি পূবালী ব্যাংকের পরিচালক মনির আহমদের দুলাভাই। আমরা
পনের বিশ জন লোক তার হাওরপারের বড় পাকাবাড়ির
মেহমান হই। এই বাড়িতে আমরা এক প্রাণবন্ত আতিথেয়তা পাই। আব্বার বন্ধুর বাড়িতে আমার
মা চাচিরা তাদের সেবাযত্ন পেয়ে দারুণ কৃতজ্ঞতা বন্ধনে
আবদ্ধ হন। চাচা খলিলুর রহমান বাড়িতে রয়ে যান, রাতে মুক্তবাহিনী তাদের খাবারের জন্য
একটি গরু উপহার চান। চাচা তার সবচেয়ে বড় ষাড় মুক্তিবাহিনীকে দান করে ধন্য হন।
নানি রফিকুন্নেছার কাছে শুনি আরেক কাহিনি। পাতারিয়ার দক্ষিণভাগ গ্রামে আমার
নানাবাড়ির পিছনের বড়বাড়িটি ছিল নানার দুইজন ভাইয়ের
যাদের একজনের একমাত্র পুত্রের সাথে অন্যজনের একমাত্র কন্যার বিয়ে হয়। তারা আম্মার
ইমুভাই ও খোদেজা আপা। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা রকি খানমের বিয়ে হলে এই সুন্দর বড়বাড়িটি
তার স্বামী ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর একজন ভারতীয় লোকের কাছে বিক্রি করে দেন।
লস্কর লকবধারী এই হিজরতকারী ভদ্রলোক আখদ্দস আলী লস্কর
অল্প সময়ে এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে যান। তিনি মুসলিম লিগের
রাজনীতি করতেন এবং দক্ষিণভাগের ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখদ্দস আলী লস্কর স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। আমার বড়মামা মাওলানা মাহদুদুর রহমান চৌধুরী ছিলেন নামজাদা আলেম। তাকে ঘিরে নানাবাড়ির বাংলোয় হুজুরদের মজলিশ জমে উঠত। স্বাধীনতার পুর্বমুহুর্তে তাঁরা ভীষণ শঙ্কিত দেশ বুঝি হিন্দুস্থান দখল করে নিচ্ছে। এসব হুজুররা দেশের স্বাধীনতা নিয়ে যতটা না আগ্রহী, তারচেয়ে হিন্দুস্থানের আগ্রাসন নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
হঠাৎ একদিন
পিছনের বাড়ির রাজাকার নেতা আখদ্দস আলী লস্কর এলেন মাওলানা মামার
এই মজলিশে। দেশ তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। চারদিক থেকে পাকবাহিনীর হারার ও ঢাকায় পালানোর সংবাদ আসছে। গতরাতে আখদ্দস
আলী লস্কর এক ভীতিকর স্বপ্ন দেখেন। তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য এই স্বপ্নের তাবির জানা। তিনি স্বপ্নে দেখেন, এক মশারীর
ভিতর তিনি আটকে আছেন, মশারীর ভিতর অজস্র মশা ভেনভেন করছে। আখদ্দছ
আলী লস্কর দুহাতে মশা মারছেন, হাত লাল হয়ে রক্ত ঝরছে,
কিন্তু মশা মেরে তিনি শেষ করতে পাছেন না। উল্টো মশারাই তাকে খেয়ে
ফেলতেছে।
মজলিসের আলেম ওলামারা অনেক চিন্তাভাবনা করে স্বপ্নের একটা তাবির বের করলেন, মশা হচ্ছে ভারতের চর মুক্তিবাহিনী। শত শত মুক্তিসেনাকে (মশা) হত্যা করার পরও এদের সাথে জেতা যাবেনা। হয়ত এদের হাতে আখদ্দছ আলী লস্করকে একদিন শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে হবে। হুজুরদের মুখে তাঁর দেখা স্বপ্নের এই বাখ্যা শুনে ভীতসন্তস্ত্র লস্কর জানতে চাইলেন মারা গেলে তিনি কি শহিদের মর্যাদা পাবেন। হুজুররা বললেন আপনার উদ্দেশ্য ভাল, আপনি হিন্দুস্থানের আগ্রাসন হতে মুসলিম দেশ পাকিস্তান রক্ষায় কাজ করছেন, আপনি নিশ্চয়ই শহিদের মর্যাদা পাবেন। আকদ্দস আলী লস্কর বেশ স্বস্তি অনুভব করলেন। যাক বাঁচা গেল, মরলে বেহেশতের রাস্থাটা অন্তত খোলাসা আছে।
দেশ মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে গেলে আকদ্দস আলি লস্কর বাড়িতে বিশ পচিশ জন পাহারাদার নিয়োগ করেন। কিন্তু একদিন রাতে সশস্ত্র মুক্তিসেনারা তার বাড়িটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধাদেরে দেখেই লস্করের নিযুক্ত পাহারাদার ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায়। লস্করের দুইজন বউ সুদীর্ঘ ঘরের দুইপ্রান্তে বাস করতেন। আকদ্দস লস্করের ছোটবউকে আমরা রাবিয়া আপা নামে ডাকতাম। তিনি একটি পালঙ্কে শুইতেন, কাজের লোকেরা কাপড়ের পর্দাপাখা টেনে টেনে বাতাস দিত। রাবিয়া আপা আমাদেরকে খুব স্নেহ করতেন। আগের দিন লস্করের একজন জামাতা বেড়াতে আসেন। তিনি সেরাতে বের হয়ে আঙ্গিনায় এলে মুক্তিযুদ্ধাদের দায়ের কোপে মারা যান। দুঃখজনক সত্য হল এই হতভাগা লোকটি আসলে একজন নিস্পাপ মেহমান। নিয়তি তাকে এই মরণকূপ শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আসে। এবার আকদ্দস আলী লস্কর সাহেবের পালা, মুক্তিসেনারা তাকে টেনে হেচড়ে বাহিরে এনে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। লস্করবাড়ির দক্ষিণে এই রাজাকার নেতার পাকা কবরটি আমাদের চোখে পড়ামাত্র মনে পড়ে যেত স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই অতীত উপখ্যান। রাজাকার নেতা আখদ্দছ লস্করের দেখা মশা মারার সেই ভয়াল স্বপ্নের তাবির অচিরেরই যেন সত্য হয়ে গেল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হন, লাখ লাখ লোক দেশের ভিতর বাস্তুচ্যুত হন, কিন্তু আল্লাহ পাকের মেহেবানিতে তুড়ুকখলায় দিনকয়েক অতিথি হয়ে থাকা ছাড়া পুরোটা যুদ্ধকালই দাউদপুরের নিজবাড়িতে আমরা নিরাপদে ছিলাম। এই প্রচন্ড যুদ্ধের মাঝেও কৃষকরা শস্য ফলান, গরু, মোরগহাঁস, মাছ, তরিতরকারির ক্ষেত ছিল অক্ষত। তাই দয়াময়ের অপার মেহেরবানিতে ডাল ভাতের কোন অভাব ঘটেনি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। নিয়াজির আত্মসমর্পণের খবর সারাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জয় বাংলা শ্লোগানে সারা দেশের মানুষ আনন্দে মেতে উঠে। আমার সৌভাগ্য আমি দেশের এই আনন্দের মহেন্দ্রক্ষণে শরিক হবার গৌরবটি শিশুবেলায় উপভোগ করি। আমার বড়চাচার ঘরেও পুত্র ও স্বামী হারানোর যন্ত্রণা প্রকট হয়ে উঠে। ভারতে শরণার্থী জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফেরেন কোটি মানুষ। স্বাধীনতা আসে- “এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন, গান গেয়ে যায়/ এই আমার দেশ, এই আমার প্রেম/ কত আনন্দ ব্যদনায়, মিলন ও বিরহ সঙ্কটে”। এই আনন্দবন্যায় উদ্ভাসিত মানুষের মনে স্বজন হারানোর ব্যদনাও ঝড় তুলে। প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি নগর-মহল্লায় কেউ না কেউ এই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। কেউ নিখোঁজ, কেউবা বহুদিন নিখোঁজ থেকে ঘরে ফিরেছেন।
আমাদের গ্রামের কোনারপাড়ার রাজাকার সর্দার জরাফত আলী মেম্বারের বাড়িতে তখন জনতা হানা দেয়। জরাফত আলীর ঘর হতে বেরিয়ে আসে হিন্দুবাড়ির ডেগডেসকি, দা কুদাল খুন্তাসহ অজস্র মালামাল। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সংখ্যালঘু বিপদগ্রস্ত প্রতিবেশী মানুষগুলোর সেই বিপদের দিনে তারা যখন জীবন বাঁচাতে ব্যতিব্যস্ত, তখন এইসব নরপশুরা মালে গনিমতের ফতোয়া দিয়ে তাদের সর্বস্ব লুন্ঠনের বিবেকহীন খেলায় মেতে উঠে। শৈশবে পাক হানাদার বাহিনীর কীর্তিকলাপ নিয়ে বেশ মুখরোচক গল্প বড়দের মুখে শুনতাম। বাঙ্গালিদেরে তাঁরা আদৌ বিশ্বাস করতনা এবং সন্দেহভাজন আটক জোয়ান বুড়ো সবাইকে লুঙ্গি খুলে খতনা দেখিয়ে নিজের মুসলমানিত্বের প্রমাণ দিতে হত। প্রাণ বাঁচাতে বিধর্মীরা কিছু ছুরা কলেমা মুখস্ত শিখে নেন, ধরা পড়লে এসব তাঁদের রক্ষা কবচের মত কাজ করত। পাঞ্জাবি পরা শশ্রুধারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখলে তাঁরা মাথা নত করে বলত, ইয়া দাড়িওয়ালা পরহেজগার বান্দাকো সালাম হ্যায়।
আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজির আত্মসমর্পণের ছবি যখন বাল্যচোখে দেখি তখন বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই, সুন্নতি দাড়ি ও পাগড়িধারী জগজিত সিং আরোরাকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি এবং দাড়িবিহীন আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজিকে ভারতের জেনারেল আরোরা ভেবে বসি। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সেলুইকাস, বড় হয়ে দেখি পাকিস্তান নামক ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের গালেও দাড়ি নামক সুন্নাতটি নেই। আর দেখি পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালও একজন দাড়িবিহীন লোক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন