সারা দিনমান দৌড় ঝাঁপ খেলা, আমার পাঠশালা জীবনের
দুরন্তবেলাঃ
বিদ্যালয়ের
নামঃ তুড়ুকখলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেঙ্গা দাউদপুর,
দক্ষিণসুরমা, সিলেট।
অবস্থানঃ জানুয়ারি ১৯৭১ হতে ডিসেম্বর ১৯৭৫ সাল
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি- ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালঃ
আমার
স্কুলটির নাম তুড়ুকখলা প্রাইমারি বিদ্যালয়। সিলেট জেলার দক্ষিণসুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের তুড়ুকখলা গ্রামে এই স্কুলের অবস্থান। সিলেট শহর হতে এই স্কুলের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। সিলেটের
প্রাচীন প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম
এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬২ সাল। এখানে আমাদের অনেক
আপনজন ও কয়েক পুরুষের লেখাপড়া করার ইতিহাস রয়েছে। সামনে সুদীর্ঘ্য এম প্যটার্নের বারান্দা টানা, টিনের পাকা ঘরটিতে বড় বড় পাঁচটি ক্লাসরুম ও একটি টিচাররুম ছিল। প্রতিটি
ক্লাসরুমে কয়েকটি বসার ব্রেঞ্চ ও সামনে বই খাতা রাখার ডেক্স সাজানো ছিল।
চেয়ারে আরামে বসা স্যারের সামনে ছিল একটি টেবিল
ও পিছনে ব্লেকবোর্ড। টেবিলে থাকত সইখাতা, বেত ও পড়ানোর
সরজ্ঞাম। চুনের চক দিয়ে লিখে প্রতিবার ডাস্টার দিয়ে ব্লেকবোর্ড মুছে ফেলা হত।
স্কুলের
সামনে ও পিছনে ছিল প্রচুর খালি জায়গা। স্কুলটির ভূমির পরিমান ৬০ ডেসিমেল। পাঠশালার
পিছনদিকে বয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
“আমাদের ছোটনদী”র মত এক নদী, যার নাম বুড়িবরাক। বর্ষায়
ভরাজল ও শীতে শুকিয়ে বুরোক্ষেত, মাঝে শীর্ণ জলধারা।
পাঠশালার পুর্বদিকে
নদীপার জুড়ে ছিল ঘন ছনকিত্তা। অন্য চারপাশে খোলামাঠ ও ধানক্ষেত। এই বিদ্যালয়ের সামনে
একটি টিউবওয়েল ও পিছনে খালপারে ছিল টয়লেট। টয়লেট
এত নোংরা ছিল যে আমি কোনদিন ঢুকি নাই। তখনকার
যুগের ছোট্ট চৌধুরীবাজার পেরিয়ে পুর্বদিকে পাহাড় লাইন বরাবর হেঁটে
বামদিকে তিনশত হাত উত্তরে গিয়ে নদীপারে এই সুন্দর স্কুলটির দেখা মেলত।
প্রতিক্লাসের দায়িত্বে ছিলেন এক একজন শিক্ষক।
আমার পাঠশালা জীবনের সুচনা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালে। যুদ্ধের ডামাডোলে তেমন কোন ক্লাস হয় নি, তাই ক্লাস ওয়ান এলোমেলো চলে যায়। ক্লাস ওয়ানের দায়িত্বে ছিলেন প্রধান শিক্ষক বাবু অশ্বিনী কুমার দাস। পশ্চিম দাউদপুর গ্রামে তার বাড়ি। দাড়িবিহীন সাদা ধুতিপরা অশ্বিনী স্যার তখন বয়সের ভারে জর জর। শিক্ষক ছিলেন পাঁচ ক্লাসের জন্য হাতেগুণা মাত্র পাঁচজন। হেডস্যার বাধ্য হয়ে উপরের ক্লাসের ভাল ছাত্রদেরে প্রেষণে এনে ক্লাস ওয়ানে পড়ানোর কাজ করাতেন। এরাও মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে বেশ খুশি হত। তখন রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পাঠশালায় ক্লাশ হত সাপ্তাহে ছয়দিন। ছাত্ররা কুরাস গাইত, 'শনিবারে হাফ, রবিবারে মাফ/ সোমবারে বেতের মার, বাপ রে বাপ।'
আমরা ক্লাস
ওয়ানে অধ্যয়নকালে বড়ক্লাসের সর্দার ছাত্রটি আমাদেরকে স্কুলের পিছনে নদীপারে নিয়ে উচ্চশ্বরে
বলত এক, তারপর দুই, তারপর তিন, এভাবে সে একশত পর্যন্ত উচ্চারণ করত। আমরা তার সাথে
উচ্চকন্ঠে সমস্বরে প্রতিধ্বনী দিতাম। আমাদের প্রতিধ্বনী বহুদূর
চৌধুরীবাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত।
আমরা টিন বা
কাটের স্লেটে খড়ি পেন্সিল দিয়ে লেখালেখি শিখতাম। ক্লাস ওয়ানে একটা বাজলেই ছুটি। একজন বড় ছাত্র বারান্দায় ঝুলানো পিতলের গোল চাকতিতে
কাটের হাতুড়ি দিয়ে কয়েক মিনিট টং টং ঘন্টা বাজাতো।
ছুটির ঘন্টা বাজার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকা সব ছাত্রছাত্রীরা
সমস্বরে “ছুট্টি” চিৎকার দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে পড়তাম। দরজায় জ্যাম লেগে যেত, কিছু দুষ্ট বাচ্চারা মহানন্দে জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হত, যা প্রতিদিনই
ঘটত।
স্বাধীনতার পরবর্তী বৎসর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বোন আনিছা চৌধুরী মান্না ও আমার আবার পাঠশালা যাত্রা শুরু হয়। মতি, রেহা, সেহা, মান্না, তাহমিদ এই বড় ভাইবোনেরা ইতিমধ্যে পাঠশালা পার হয়ে মোগলাবাজারের রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে চলে গেছেন। আমার ভাদেশ্বরের খালাতো ভাই তারেক আহমদ তখন আমাদের বাড়িতে অবস্থান করে ক্লাস থ্রিতে অধ্যয়ন করছেন। এবার আব্বা সফিক চৌধুরী আমাদেরকে পাঠশালায় নিয়ে ক্লাস টুতে বসালেন। বয়সে বছর তিনেক বড় বোন আনিছা চৌধুরী মান্না ও আমি সহপাঠি। আমার সহপাঠি প্রায় ছেলেরাই ছিল বয়সে অনেক বড়। ক্লাস টিচার টেকই স্যার আমাকে অল্প বয়স্ক মনে করে ক্লাস ওয়ানে পাঠিয়ে দেন। প্রতিদিন আমি এসে ক্লাস টুতে বসি আর স্যার ওয়ানে পাঠান। দুঃখভরা মনে বিষয়টা আম্মাকে জানাই, এই সমস্যা সমাধানে আব্বা সফিক চৌধুরী একদিন পাঠশালায় যান এবং আব্দুর রকিব টেকই স্যারের সাথে আলাপ করে আমার ক্লাসওয়ানে যাত্রা বন্ধ করান। যাক শেষে আমার বিজয় হল।
ক্লাস টুর স্যারের নাম মোহাম্মদ আব্দুর রকিব, তার বাড়ি বিদ্যালয়ের খানিক পুর্বদিকে পুর্বতুরুকখলায়। ছাত্রছাত্রীরা তাকে টেকই স্যার নামে ডাকত। টেকই স্যার রোগা চিকন লোক। তার থুথুনির তলায় ছিল সামান্য ছাগলী দাড়ি। একটু কালো চিটিপড়া ঈষৎ ময়লা পাজ্ঞাবি ও লুঙ্গি পরে স্যার ক্লাসে আসতেন। টেকই স্যারের বেশভূষায় বেশ দারিদ্রতার ছাপ। বুড়িবরাক নদীর পারে প্রচুর মঞ্চিনি গাছের ঝোঁপঝাড়। স্যাররা ছাত্র শাসনে মঞ্চিনির কঞ্চি বেত হিসাবে ব্যবহার করতেন।স্কুলের মেঝ পরিস্কারে মঞ্চিনির ঝাড়ু ব্যবহার করা হত। টেকই স্যার ক্লাসের ফাঁকে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতেন। কোন বড় ছেলে তাকে বাঁশের হাতপাখায় বাতাস করত। স্যারের দিবানিদ্রার সুযোগে বাচ্চারা তীব্র হৈ চৈ শুরু করত, হট্টগোল চরমে পৌঁছিলে স্যারের সুখনিদ্রা ভেঙ্গে যেত। মহাবিরক্ত স্যার রেগে উঠে ক্লাসের একপ্রান্ত হতে বেত মেরে অন্যপ্রান্তে গিয়ে সমাপ্ত করতেন। দোষী কিংবা নির্দোষী সবাই বেত খেত, কেউ রেহাই পেত না।
টেকই স্যার ক্লাসে নারকেলি হোক্কা টানতেন, বড় ছাত্ররা হুঁকা সাজিয়ে দিত। তুড়ুকখলার শাহিন দুষ্টামী করে চিলিমের তামাকে এক আধটু শুকনো গোবর মিশিয়ে দিত। টেকই স্যার হুঁকা টেনে তামাকের গন্ধে কি যেন একটা সামান্য টের পেলেও আসল বিষয় কখনও বুঝতে পারেন নি।
তৃতীয় শ্রেণি
১৯৭৩ সালঃ
আমার বয়স কম ভেবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোন মান্নার সাথে রাখতে চাননি শিক্ষকরা, অথচ বোনের চেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেই ১৯৭৩ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। বড় বড় ছাত্রদের ভীড়ে কচি ছাত্র আমি পরীক্ষায় প্রথম হই। টেকই স্যারের ক্লাস টু হতে আমাকে ক্লাস ওয়ানে নামানো যে ভূল ছিল, তা প্রমাণ হল।
ক্লাস থ্রিতে এসে একজন নিরিহ ভাল হিন্দু স্যারের দেখা পাই। এই আত্মজীবনী রচনাকালে অনেক চেষ্টা করেও এই হিন্দু স্যারের নাম ও ঠিকানা কোথায়ও খুঁজে পাইনি। দূর কোন অঞ্চল হতে এসে এখানে চাকুরি করতেন। আমরা তাঁর নাম জানতাম না, নাম জানার প্রয়োজনও কখনও হয়নি। তিনি নতুন এসেছেন, তাই হয়ে যান নয়াস্যার। টেকই স্যারের মঞ্চিনি বেতের পিটুনী খেয়ে খেয়ে বিরক্ত বাচ্চারা নয়াস্যারের কাছে বেশ স্বস্তিবোধ করে। সাদা সার্ট ও সাদা পেন্ট পরা নয়াস্যার বয়সে তরুণ ও বেশ সুদর্শন। তিনি হাঁটতেন ধীর পদে। আমি নয়াস্যারের হাতে কখনো বেত দেখিনি। ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছে নয়াস্যার প্রিয়জন হয়ে যান।
এক সুদীর্ঘ ছুটির পর একদা আমরা স্কুলে এসে শুনি নয়াস্যার নেই, তিনি মারা গেছেন। সেদিন শ্রেণিকক্ষে এক শোকাবহ অবস্থা তৈরি হয়। এই স্কুলে স্যারের অবস্থান ছিল অল্প কিছুদিন, এই অল্পদিনে তিনি ছাত্রছাত্রীদের অন্তর জয় করে নেন। তুড়ুকখলা পাঠশালায় তিনি উল্কার মত উদয় হন, সবাইকে জয় করেন, আবার উল্কার বেগে হারিয়ে যান। ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরা নয়াস্যারের মৃত্যুতে খুব দুঃখ পায়। মেয়েশিশুরা নয়াস্যারের জন্য সেদিন ক্লাসে কেঁদে কেঁদে চোখ মুছে, নীরবে অশ্রু ফেলে। ছাত্রছাত্রীদের কথাবার্তা ও হাহাকারে বুঝলাম, তাঁদের শিশুমন এই ভেবে বেশী দুঃখ পায়, আহারে, নয়াস্যারের এত সুন্দর দেহখানি চিতার আগুনে পুড়ে দাউ দাউ করে কিভাবে যে ছাই হলো।
এবার ক্লাস টিচার হয়ে এলেন তিন মাইল পুর্বের লক্ষণাবন্দ গ্রামের মঈনউদ্দিন খান স্যার। নয়াস্যারের মৃত্যুতে তিনি এই পাঠশালার শূন্যপদে নতুন এসে যোগ দেন। তিনি ছিলেন আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর ছাত্র। নিজ শিক্ষকের সন্তান হিসাবে আমাদের প্রতি তার ছিল আলাদা এক অনুরাগ, আলাদা এক শুভদৃষ্টি। মইনউদ্দিন স্যারের কড়া শাসনে হৃদয়ে ভীতিভাব থাকলেও তার প্রতি ছিল সবার এক অদৃশ্য আকর্ষণ। আমাদের সার্বিক উন্নয়নে ছিল তার কড়া নজরদারি।
মইন স্যার থাকতেন দক্ষিণ তুড়ুকখলায়, দক্ষিণপাড়ার আমাদের সহপাঠিরা মইনস্যারের সাথে দলবেঁধে স্কুলে আসতেন। তার প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে এই বিদ্যালয় বারবার দক্ষিণসুরমা উপজেলার শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
২৯ জুন ১৯৯৮ সাল। দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকা হাতে
নিয়ে চমকে উঠি। তখন বেলা দুপুর ১২ ঘটিকা। প্রথম পৃষ্ঠায়
ছবিসহ একটি শোকসংবাদ,
একটুপরই বাদ জোহর তার জন্মভূমি লক্ষণাবন্দে
তাকে দাফন করা হবে। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের অতিপ্রিয় মঈন স্যার। ১৯৯৮ সালের
২৬ জুন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তুড়ুকখলায় তার ছোট্ট
জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
মইনউদ্দিন খানস্যার ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে গেছেন সর্বশক্তি নিয়োগ করে, শতভাগ আন্তরিকতায়। আলস্য কিংবা ফাঁকিবাজি তাঁর অভিধানে অনুপস্থিত ছিল। বাচ্চাদেরে মানুষ করতে তাঁর প্রচেষ্টার অন্ত ছিলনা। নামাজ পড়তেন, হাসিখুশি থাকতেন, সবার সাথে সদাচরণ করেতেন, চলতেন সম্মান ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে। তিনি আমার পিতা সফিক চৌধুরীর একজন সত্যিকার আদর্শ ফলোয়ার ছাত্র ছিলেন।
চতুর্থ শ্রেণি
১৯৭৪ সালঃ
১৯৭৪ সালে ভাল ফলাফল নিয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পা রাখি। এখানে এসে সানোয়ার আলী স্যারের দেখা পাই। স্যারকে সবাই খুব ভয় পেত। খানিক মোঠাসোঠা স্যারকে ছেলেরা বলতো গাম্বুলা স্যার। পাঠ্য আদায়ে স্যার ছিলেন খুব কঠোর ও আপোষহীন। বুড়ো স্যার তখন পক্ষাঘাত রোগী। গাম্বুলা স্যার যখন একহাতে লাটিভর দিয়ে হাঁটতেন তখন তার অন্য অবশ হাতে একটি তাসবি ঝুলতো। ঠোট বিড়বিড় করে জপতেন ইয়া আল্লাহু, ইয়া আল্লাহু।
যারা লেখাপড়া পারতনা গাম্বুলা স্যার তাদের প্রতি শক্ত আচরণ করতেন। গাম্বুলা স্যারের ভয়ে দাউদপুর পুর্বপাড়ার সহপাঠি বড়ছাত্র ফয়জুল আলী প্রায়ই স্কুল পালাতো। স্যার তাকে ধরে আনতে কয়েকজন বালককে লেলিয়ে দিতেন। কিন্তু তাকে ছেলেরা ধরার আগেই সে বুড়িবরাক নদীর বাঁধ দিয়ে দাউদপুরে পগারপার হয়ে যেত। ছোট ছোট ছেলেরা এই ষন্ডামার্কা বালকের সাথে দস্তাদস্তি করে নাপেরে হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে আসতো। পরদিন স্কুল পালানোর অপরাধে ফয়জুলের বিচার হত। তাকে স্যার কান ধরে হাঁটুভেঙ্গে মাটিতে বসিয়ে রাখতেন। একদিন ফয়জুলকে গাম্বুলা স্যারের অত্যাচার হতে বাঁচাতে ফয়জুলের দাদিবুড়ি তাঁকে টেনে হিঁচড়ে পাঠশালায় নিয়ে আসেন। বুড়ির অভিযোগ, স্যার আপনি আমার নাতিকে খালি পেঠান, খালি পেঠান, সেই ভয়ে সে স্কুলে আসতে চায়না। স্যার জবাব দেন, তোমার নাতি পড়া পারেনা, স্কুল পালায়, আমি কি করব? বুড়ি নাতিকে মারধর না করার জন্য কাকুতি মিনতি করে সিটে বসিয়ে চলে যান। বুড়ি চলে যাবার ক্ষাণিক পর স্যার গরম হন, হেই শয়তান, তুই কেন বুড়ি দাদিকে নিয়ে এলে। তরে এই বুদ্ধি কে দিছে?
পড়া না পারলে জালিবেতের দু’চার ঘা সপাৎ সপাৎ করে ছাত্রছাত্রীদের পিঠে বসিয়ে দিতেন গাম্বুলা স্যার। পড়া মুখস্ত না পারলে কান ধরে উঠবসও করাতেন। স্যারের বেত খেয়ে বালকদের কেউকেউ হাউমাউ করে কাঁদত।
গাম্বুলা স্যার একপ্রান্ত হতে
পড়া নেওয়া শুরু করে অন্যপ্রান্তে গিয়ে শেষ করতেন, যে পড়া পারতনা দুইটা
করে বেতের ঘা বসাতেন। যারা পারত তাঁরা বেঁচে যেত। আমি
স্যারের দুররা হতে প্রাণ বাঁচাতে
সিট ছেড়ে উঠে যেদিকের পড়া নেয়া শেষ সেদিকের বেঞ্চে বসে যেতাম। পক্ষাঘাতাক্রান্ত
বৃদ্ধ স্যার বিষয়টা বুঝতে পারতেন না, এভাবে প্রতিদিন বেঁচে যেতাম। কিছু ফাজিল বালকেরা
বলত ছাত্রদের অভিশাপে গাম্বুলা স্যারের ডানহাতটি গেছে ও তাঁরা
দোয়া করত স্যারের অন্য হাতটিও যেন অবশ হয়ে যায়, তাহলে প্রাণে বাঁচা যাবে, তিনি আর পেঠাতে পারবেন না। পাঠশালায় গণিত মানে যোগ, বিয়োগ, পূরণ, ভাগ ও নামতা। যারা অঙ্ক পারতনা, তাদেরে স্যার বলতেন, তোদের মাথায় মগজ নেই রে, শুধু গোবর আর গোবর। গাম্বুলা স্যারের
বাড়ি ছিল স্কুল থেকে সোয়া মাইল পুর্বে হিলাইগজ্ঞের কাছে
ডেরাডেমা গ্রামে, যে গ্রামটির নাম বদলে গিয়ে আজ ইসলামপুর হয়ে গেছে।
চতুর্থ শ্রেণিতে আমরা আরেকজন ভাল স্যারকে পাই। তিনি মৌলানা মনির উদ্দিন স্যার। গোলগাল চেহারা,
গালভরা দাড়ি, শ্যামলা গাত্রবর্ণ, নিম্নমধ্যম
উচ্চতা ছিল তাঁর। লম্বা পাজ্ঞাবি ও টুপিবিহীন অবস্থায় তাকে কখনও দেখা যেত না। তার বাড়ি দাউদপুর গ্রামের মুতিরপাড়ার
মোল্লাবাড়ি। তিনি আমার আব্বার বন্ধু ও সুহৃদ ছিলেন। মনির মৌলানা
স্যার আমার বড়মামা বিখ্যাত আলেম হজরত মাওলানা মাহমুদুর রহমান চৌধুরীর(র:) ঘনিষ্ঠ
বন্ধুজন ছিলেন। আলেম বড়মামা আমাদের বাড়ি এলে মনিরউদ্দিন স্যার ছুটে আসতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁরা ধর্মালোচনা করে পার করতেন। কাপ
কাপ চা ও নাস্তা সেদিন নিঃশেষ
হত।
মনির মৌলানা স্যার ছিলেন দেওবন্দ কওমিপন্থী আলেম। আমাদের গ্রামের চৌধুরীগণ কয়েকপুরুষ ধরে সিলসিলায়ে জৈনপুর, বদরপুর, ফুলতলী পীর তরিকানুসারী। তাই পুরো গ্রামবাসীও একই পথের পথিক। এখানে ফুলতলী তরিকার শক্ত অবস্থান। ফুলতলী বিরোধী দেওবন্দ তরিকায় থাকার কারণে অতি ফরহেজগার ও ন্যায়নিষ্ঠ মনিরউদ্দিন মৌলানা স্যার নিজগ্রাম দাউদপুরে ছিলেন অপাংক্তেয়। তাকে সবাই বলত জোয়াল্লিনের মাওলানা। তিনি নামাজ পড়তেন পুর্ব তুড়ুকখলার জোয়াল্লিন মসজিদে, যেখানে দেওবন্দপন্থী ইমাম নামাজ পড়াতেন। তাঁরা নাকি ‘দয়াল্লিন’ শব্দের ভূল উচ্চারণ করে 'জোয়াল্লিন'। দাউদপুর জামে মসজিদে তিনি কখনও নামাজ পড়লে জামাতে শরিক না হয়ে একাকী পড়তেন। দাউদপুর গ্রামে মনির মাওলানা স্যার ছিলেন একজন ভিন্ন মতাবলম্বী। গ্রামের ফুলতলীপন্থী মাওলানাদের একচেটিয়া রাজত্ব, তাঁরা বলতেন, বাহারে, সারা গাঁয়ে তিনি একাকি বেহেশতে যাবেন, আর আমরা বুঝি সবাই দোযখের লাকড়ি হবো। আসলে হুজুরদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতা বলে কিছু কোনকালে ছিলনা, এখনও নেই। এক দলমতের আলেমরা অন্য দলমতের হুজুরের কাছে জাহেল, ফাসেক, মুর্তাদ, গোমরাহ, ইবলিশ ইত্যাদি ছাড়া ভাল কেউ নন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরক্ষণে কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ লোক মুক্তিবাহিনীকে বলে দেয় মনির মৌলানা স্যার পাকিস্তান সমর্থক। মুক্তিসেনারা তাকে ধরে দুররা মারলে তিনি উহ আহ না বলে প্রতি আঘাতের সাথে সাথে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে হেসে উঠতেন। তার অদ্ভুদ আচরণের কারণ জানতে চাইলে মনিরমৌলানা স্যার জবাব দেন আমাকে অন্যায়ভাবে মারা হচ্ছে, তাই প্রতিটি আঘাতকে আমি মহান আল্লাহর নিয়ামত হিসাবে দেখছি, নিশ্চয় দয়াময় আল্লাহ এই আঘাতের বিনিময়ে আমার অজস্র গোনাহ মাফ করে দিচ্ছেন, তাই হাসছি। তাঁর এই জবাব শুনে মুক্তিসেনারা ভাবল লোকটার মাথায় নিশ্চয় ছিট আছে, এই সরল সোজা মানুষ রাজাকার আলবদর হতে পারেনা। তারা বিনয়ের সাথে তাঁকে ছেড়ে দেয়। আসলে পাকসমর্থক হলেও তিনি রাজাকার কিংবা আলবদর ছিলেন না।
আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে শুনেছি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় মাওলানা মনিরউদ্দিন স্যার জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের হয়ে ভারতের পক্ষে কাজ করেন। তুড়ুকখলার মাওলানা আব্দুল জলিল ছিলেন এই দলের নেতা। ১৯৪৭ সালে সিলেট গনভোটে পাকিস্তানভূক্ত হয়ে গেলে মাওলানা আব্দুল জলিল ভারতে হিজরত করেন এবং করিমগঞ্জের এম পি নির্বাচিত হন। মাওলানা মাওদুদীর দল জামাতে ইসলামও সেই সময় ভারত বিভক্তির বিপক্ষে ছিল। অখন্ড ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টি হউক তাঁরা চায়নি।
মনির মৌলানা স্যার আমাদের আমল আখলাকের প্রতি সতর্ক নজর রাখতেন। ইসলামধর্মীয় জ্ঞানে খুব পারদর্শী এই মনির মৌলানা স্যার আমাদেরকে কোরান হাদিস বলতেন, কিভাবে ইসলামি জীবনে অভ্যস্ত হওয়া যায় তাই শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন দুদিনের দুনিয়ার এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, পরকাল চিরস্থায়ী। কাজেই সবসময় দুনিয়া দুনিয়া না করে পরকালকে তোমরা বেশি গুরুত্ব দেবে। নামাজ পড়বে, তেলাওত করবে, আল্লাহকে ডাকবে। বেহেশত পাবার জন্য কাজ করবে। হাদিস বলতেন, আদ্দুনিয়া ই দাজরাতুল আখেরাত অর্থাৎ দুনিয়া আখেরাতের ক্ষেতের জায়গা।
মনির মৌলানা স্যার ছাত্রদেরকে পাঠশালা পাশ করে হাইস্কুলে ভর্তি না হয়ে মাদ্রাসায় যেতে উপদেশ দিতেন। মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, মাওলানা ফরমুজউল্লা সায়দা সাহেব এত বড় একজন আলেম হয়েও তাঁর সব ছেলেকে স্কুলে দেন। দুর্ভাগ্য, একটা ছেলেকেও মাদ্রাসার দীনি এলেম শিখতে পাঠাননি।
মনির মৌলানা স্যার আব্বার একজন সুহৃদ ও ভক্ত বন্ধু ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর আমার
আব্বা সফিক চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় মনির মৌলানা স্যার খুব
আঘাত পান। বেশ কিছুদিন সকালে এসে এসে আব্বার কবর জেয়ারত করতেন। একদিন সিলেটে বসে
শুনলাম মনির মাওলানা স্যার মারা গেছেন। পরের শুক্রবার ব্যাংকের ছুটির ফাঁকে বাড়ি এসে মোল্লাবাড়ির
উত্তরপ্রান্তে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে গিয়ে মনিরউদ্দিন মৌলভি
স্যারের পবিত্র সমাধি জেয়ারত করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসবাসী
করুণ, আমিন।
চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে একদিন তুড়ুকখলার মৌলানা হেলাল উদ্দিন স্যারের পুত্র সহপাঠি দুলুর সাথে কুস্তি লড়ি। সে নিচে পড়ে যায়। তারপর আমার কাবু হতে বের হয়ে ভূদৌড় দিয়ে হেডস্যারের সামনে পালিয়ে যায়। সে দিন আমি প্রধানশিক্ষক অশ্বিনী কুমার স্যারের হাতের একটি থাপ্পড় খাই। বাড়ি এসে আব্বাকে বললাম, হেডস্যার আমাকে মেরেছেন। আব্বা বললেন, কেন মেরেছেন? বললাম একজনের সাথে মারামারি করেছি তাই। বাবা বললেন স্কুলে গেছো পড়তে মারামারি করবে কেন। মেরেছেন তো ভাল করেছেন, খবরদার আর কখনো স্কুলে মারামারি করবেনা।
হেলালউদ্দিন স্যার রেবতী রমন হাইস্কুলে আব্বার সহকর্মী শিক্ষক ছিলেন। দুলুর বাড়িতে লবণে রাসায়নিক মিশিয়ে কস্টিক নামক একধরনের হজমি তৈরি করা হত। স্কুলের ছেলেমেয়েরা কস্টিক কিনে চুষে চুষে খেয়ে জিহ্বা পুড়াতো। বহুবছর দুলু ট্রাক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয় দুলু। মানুষ গাড়ির দরজা কেটে তাকে উদ্ধার করে। সেইবারে কোনমতে প্রাণে রক্ষা পেলে পেশা বদল করে সে হয়ে যায় বনাজি চিকিৎসক, এক কথায় কবিরাজ। সে আমাকে অনেক বনাজি ঔষধ ও চিকিৎসার বই উপহার দেয়। লন্ডন প্রবাসী আমার আরেক সহপাঠি বন্ধু আজাদসহ অনেকেই এই মধ্যবয়সে এসে যৌবন শক্তি বাড়াতে প্রিয় বাল্যবন্ধু দলুর স্মরণাপন্ন হন, সে অতি আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে পথ্য দেয়। কেউকেউ দুলুর প্রশংসা করে বলেন, বন্ধুর বনাজি ঔষধ খেয়ে বেশ ফায়দা পেয়েছি। ভাবে লাভ।
চতুর্থ শ্রেণির বাৎসরিক গণিত পরীক্ষার দিন এক মজার ঘটিনা
ঘটে। পরীক্ষার হলে আমি অঙ্ক মিলাতে পারছিনা। এক সময় পেপার ও প্রশ্নপত্র পকেটে নিয়ে মাস্টার সাহেবকে প্রস্রাবের কথা
বলে বেরিয়ে পড়ি ও বুড়িবরাকের বাঁধের উপর দিয়ে ফাঁড়ি পথে বাড়ি
চলে আসি। বড় ভাইবোনরা অঙ্ক করে দেন। চাচাতো রেশাদ ভাই এসে তামাশা করে বললেন আমি
এক্ষুণি স্কুলে গিয়ে স্যারদেরে বলে দিচ্ছি। অমনি পেপার নিয়ে দৌড়ে পাঠশালায় পৌঁছে
কৌশলে উত্তরপত্র জমা দেই। আমি ফাস্টবয়, তাই
স্যাররা বুঝতেই পারলেন না ক্লাসের এই এক নম্বর
বালক শিশুটি কি কাজ
করে এসেছে। পরীক্ষায় গণিতে সেইবার একশতে শতনম্বরই পেয়ে
যাই।
এই শ্রেণিতে
অধ্যয়নকালে আমি সাঁতার শিখি। এসময় বাড়িতে বেড়াতে আসেন আমার চাচাতো বোন বড়লেখা গাংকুলের
সাদেকা আপা। তার ছেলে সাকের ও টিপু, মেয়ে রেজি ও রেকি আমাদের বাল্যকালের খেলার
সাথী। আমরা অধীর আগ্রহে দাউদপুরে
তাদের আগমনের অপেক্ষায় থাকতাম। তারা এলে সারাদিন খেলাধুলায় হারিয়ে যেত।
বিচিত্র সব খেলা, গোল্লাছুট, কবাডি, সাঁতার, জল ছিটাছিটি, লাইখেলা, মার্বেল, ঢাংগুটি
ইত্যাদি।
একদিন
চাচাতো ভাই ফরহাদ তার ভাগনা ভাগ্নি ও আমাকে সাঁতার শেখাতে সামনের বড়পুকুরে নিয়ে
যান। পেঠের তলায় হাত রেখে কিছুক্ষণ সাঁতরায়ে হঠাৎ ছেড়ে দিতেন। প্রচুর হাবুডুবু খেয়ে
সামান্য সাঁতার শিখা হয়। পরদিন একটু দূরে ছেড়ে দেন। এবার প্রচুর পানি খেয়ে আরেকটু
সাঁতার শিখি। সাঁতার আয়ত্বে আসামাত্র সাঁতারের নেশা আমাকে
পেয়ে বসে। গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে পানিতে সাঁতার কেটে চোখ লাল হয়ে যেত। প্রথম যেদিন
একশত হাত প্রশস্ত পুকুর সাতরে পার হই, মনে হল যেন ইংলিশ চ্যানেল জয় করে ফেলেছি।
আমার বয়ঃবৃদ্ধ বড়চাচা তৈয়বুর রহমান চৌধুরী লাটিতে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন। এই ক্লাসে অধ্যয়নকালে ৫ম মার্চ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পঁচাশী বছর বয়সে মারা যান। বড়চাচার ইন্তেকালই দাউদপুর পূর্ব চৌধুরীবাড়িতে আমার দেখা প্রথম মৃত্যুর ঘটনা।
পঞ্চম শ্রেণি
১৯৭৫ সালঃ
১৯৭৫ সালে
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠি। কি জ্বালা এখানে এসেও আব্বার একজন প্রিয় ছাত্রের
হাতে পড়ি। তাকে আমরা সবাই ডাকতাম কাঞ্চন স্যার। তার প্রকৃত নাম সমরেন্দ্র
চক্রবর্তী। এক মাইল দক্ষিণে
নেগালের রাঘবপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি একটি বাইসাইকেলে করে স্কুলে আসা যাওয়া
করতেন। বেটে শ্যামলা এই স্যারের মুখে ছিল প্রচুর বসন্তের
দাগ। স্যার পানের বাটা নিয়ে স্কুলে আসতেন। একটার পর একটা পানখিলি মুখে পুরতেন।
স্যারের দাঁতের রঙ সুপারিবরণ। আমাদের লেখাপড়ায় ছিল তার সুতীব্র
নজরদারী। কাঞ্চন স্যার ছিলেন বেশ কড়া। তিনি ভাল ছাত্রছাত্রীদেরকে স্নেহ করতেন, বিপরীতে পড়াশুনায় যারা
মন্দ তাদের সাথে খুব
বিরুপ আচরণ করতেন।
সহপাঠি সুব্রত সিংহ বাবলা পড়া না পেরে প্রায়ই কাঞ্চন স্যারের জালিবেতের ঘা খেত। স্যার তখন বয়সে তরুণ। আব্বা হেঁটে হেঁটে মোগলাবাজার উচ্চবিদ্যালয়ে যাবার পথে সর্বদা কাঞ্চন স্যারের মুখামুখি হতেন। আব্বাকে দেখলেই গুরুকে সম্মান জানাতে কাঞ্চন স্যার সাইকেল হতে নেমে মাথানিচু করে আব্বাকে আদাব দিতেন। আমাদের আমলে শিক্ষকরা এত কড়া শাসনের পরও ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসা পেতেন। তাঁরা শিক্ষকদেরকে অন্তরের গভীর গহিন থেকে শ্রদ্ধা করত।
আমরা দুই ভাইবোনের সব দোষগুণ কাঞ্চন স্যার আব্বাকে রাস্থায় বলে দিতেন। কোন বিষয়ে সবলতা কিংবা কোনখানে দুর্বলতা আছে, সব জানাতেন। কাঞ্চন স্যার আমাদেরকে গান শিখাতেন ও গাওয়াতেন। সামিয়ানা আক্তার দিপার গানের বেশ সুরেলা গলা ছিল। দিপা আজ কোথায় আছে জানিনা, তবে দেশাত্ববোধক ও হাসন রাজার গান তার সুমধুর কন্ঠ শুনে আমরা মোহিত হতাম। সবাইকে গাইতে হবে, তাই আমিও গাইতাম ক্ষুদিরামের ফাঁসীর গান-'হাসি হাসি পরবো ফাঁসী, দেখবে ভারতবাসী। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'। সহপাঠি গাট্টা-ওদুদের গলা ঘর্ঘরে, তাকেও কাঞ্চন স্যারের ভয়ে গান গাইতে হত। আমরা তার গান শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝে উঠতে পারতাম না। কিন্তু গরম কাঞ্চন স্যারের সামনে হাসা কিংবা কাঁদা কোনটারই উপায় ছিল না। গানের অনুষ্ঠানে থাকত পিনপতন নীরবতা।
এই ক্লাসেও দুইজন সহপাঠির সহিত খেলাচ্ছলে কুস্তি লড়ি। একজন আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান আবুল মিয়ার ছেলে প্রিয়বন্ধু আজাদ, তার সাথে কুস্তিতে ড্র হয়। সে এখন ইংল্যান্ড প্রবাসী। সে বিয়ে করেছে নিজগ্রাম তুড়ুকখলায়। ২০১৫ সালে সে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে সুন্দরী লন্ডনি ভার্য্যাকে পরিচয় করে দেয়। তাদের আতিত্থেয়তায় আমি বিমুগ্ধ হই। সহপাঠি বন্ধু গাট্টা-ওদুদের সাথে একদিন কুস্তি লড়ি, তবে তার নিচে পড়ে বেশ মার খাই। তুড়ুকখলায় কুটুমবাড়িতে থেকে গাট্টা-ওদুদ পাঠশালায় লেখাপড়া করত, পাঠশালা পাশ করে সে মাদ্রাসায় চলে যায়, তার খবরাখবর আর কোনদিন পাইনি। পূর্ব তুড়ুকখলার মনির আহমদের বাড়ির এলেন মিয়া লিকলিকে লম্বা বালক। সে আমার খুব প্রিয় ছিল। তাঁর মারামারির কৌশল হল একটা বক্সিং মেরে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া। লিকলিকে শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ যুদ্ধে টেকা যে সম্ভব নয়, তা সে ভালই জানত।
একবার পঞ্চম
শ্রেণির ক্লাস টিচার কাঞ্চন স্যার সকালে
ক্লাসে ঢুকে তার
টেবিলে কাগজে মুড়ানো একটি সুন্দর প্যাকেট
পান। কৌতুহলী হয়ে পেকেটটি খোলেই কাঞ্চন স্যার মানব
মলের দেখা পেয়ে ছিঃ ছিঃ করে উঠেন। সহপাঠি সেলিম মিয়া স্যারের আদেশে তখনই পুটলাটি পিছনের বুড়িবরাকে ফেলে দেয়। কাঞ্চন স্যারের ধারণা কোন বয়স্ক গাধা ছেলে তার পিটুনী খেয়ে এই অপকর্ম করেছে। নিশ্চয় স্কুল ছুটির পর গোপনে স্কেল দিয়ে
খুচিয়ে জানালা খোলে ভিতরে ঢুকে কেউ এই
অপরাধ করেছে। কে সেই পাপী? রাগান্বিত স্যার অনেক চেষ্টা
করেও আসামী ধরতে পারলেন না। শেষে
মন্তব্য করলেন- যে যারে পড়ায়, সে তারে চড়ায়। কাঞ্চন স্যার চলে গেলে বালকেরা ফিসফিস করতে শুনি, এটা কবর-জীন্নাতের
কাজ। পাঠশালার পাশের বাড়ির দুষ্টা দুলুকে তুড়ুকখলার
ছেলেরা বলত কবর-জীন্নাত। দুষ্টবালক দুলু একদিন ছেলেদের সাথে লোকাচুরি খেলতে গিয়ে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখোঁজির পর সন্ধান মেলে সে বুড়িবরাক নদীপারে ঝোঁপের মধ্যে বাঁশ হা করা এক কবরের গর্তে
লুকিয়ে আছে। বস, সেদিন হতে সে হয়ে যায় কবর-জীন্নাত। সবাই নিশ্চিত মানবমল রাখার এই পাপকাজটি করেছে কবর-জীন্নাত। সে যে করেছে তাঁর একটি প্রমাণ হল- সেদিন সে পাঠশালায় গরহাজির ছিল।
‘আমাদের গ্রাম’ রচনাটি মুখস্ত বলতে না পারার অপরাধে কাঞ্চন স্যার এক শীতের সন্ধ্যায় সব ছাত্রছাত্রীদেরকে ছুটি না দিয়ে আটকে রাখেন। স্যারের কড়া নির্দেশ ‘আমাদের গ্রাম’ রচনাটি হুবহু মুখস্ত করা শেষ না হলে কাউকে ছাড়বেন না। স্যারের নির্ধারিত রচনাটিতে কেবলমাত্র নিজ নিজ গ্রামের নাম বসিয়ে মুখস্ত বলতে হবে। শীতের ছোট্ট দিন, রাত গণিয়ে এসেছে, আমরা যথাসময়ে বাড়ি না ফেরায় চিন্তিত আম্মা আসমতুন্নেছা তাঁর দুই পুত্রকন্যাকে বাড়ি নিয়ে যেতে অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীকে পাঠশালায় পাঠান। এভাবে অন্যদের অনেক অভিভাবক আসেন, তারা স্যারকে পরদিন রচনাটি মুখস্ত করিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজনিজ ছাত্রদেরকে স্যারের কবল হতে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান।
বহুবছর পর দূঃসংবাদ শুনলাম কাঞ্চন স্যার নেই,
চুন-সাদা-সুপারির স্বেচ্ছাচারে হয়ত তাঁর গালে ক্যান্সার হয়। শুনলাম কাঞ্চন স্যার ভবলোকে বেশ যাতনা পেয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মহান স্রষ্টার কাছে শ্রী সমরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী কাঞ্চন
স্যারের আত্মার সদগতি কামনা করি।
বড়বোন রেহা ও
সেহার কাছে চাচাতো মতিভাইয়ের পাঠশালা পালানোর গল্প শুনতাম। তুড়ুকখলা পাঠশালা ও
চৌধুরীবাজারের মাঝখানে ধানক্ষেতের মধ্যে ছিল আব্বার বন্ধু সজ্জাদ মিয়ার ট্রাক্টরের
ঘর। মতিভাই এই ট্রাক্টর রাখার ঘরে ঘন্টাখানিক সময় লুকিয়ে
থাকতেন। স্যাররা স্কুলে ঢুকে গেলে
ও ক্লাস শুরু হয়ে গেলে চুপে চুপে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। একদিন সদলবলে স্কুল পালানোর
পরামর্শ দিয়ে রেহা, সেহা, তাহমিদ ও ফলখা আপাকে এই ভাঙা ঘরের আড়ালে দলনেতা মতিভাই দীর্ঘক্ষণ লুকিয়ে রাখেন। পাঠশালায় শিক্ষক ও ছাত্রদের আনাগুনা বন্ধ হলে সবাই বাড়ি ফিরে আসেন। সেদিন বন্দিদশায় দীর্ঘ-সময় থেকে বিরক্ত হয়ে তারা বাড়ি এসে
সবাইকে সেই পলায়ন কাহিনি বলে দেন। একাকি পালাতে পালাতে এবার সদলবলে পাঠশালা পালাতে গিয়ে মতিভাই নিজের ক্ষতি করে বসেন। অভিভাবকদের কাছে মতিভাইয়ের স্কুল পালানোর এই পদ্ধতি ফাঁস
হয়ে যায় এবং তাঁর পাঠশালা পলায়ন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
মতিভাই ছিলেন খুব সোজাসাপ্টা লোক। বাড়িতে রেজাভাই ও আব্দুল্লাহ ভাই বলতেন মতি পা লেহন করতে পারে, সাথে সাথে মতিভাই তার পায়ের পাতা জিহবা দিয়ে লেহন শুরু করতেন। তারা বলতেন মতি গোবর খেতে পারে, মতিভাই সাথে সাথে শুকনো কিছু গোবর মুখে পুরে দিতেন। পরবর্তীকালে গাঁয়ের জনকয়েক দুষ্ট প্রকৃতির নব্যধনী লোভী লোকেরা তাঁর সরলতার সুযোগে ভিলেজ পলিটিক্সের মাধ্যমে প্রচুর সুবিধা আদায় করে এবং বাড়ির সামনের দড়ারবন্ধে তাঁর মালিকানাধীন বিঘার পর বিঘা দু’ফসলা জমি পানির দরে হাতিয়ে নেয়, সেইসাথে আমাদেরও প্রচুর ভাল জমি হাতছাড়া হয়।
আমি ছিলাম স্যারদের চোখে ভাল ছাত্র, কিন্তু আসলে হাওরের মধ্যে শিয়াল রাজা। তাই আমি শিয়াল রাজা কোনদিন স্কুল পালাই নি। কিন্তু আমার বড় বড় সহপাঠিরা এইসব কড়া স্যারদের হাত হতে বাঁচতে ক্লাস শুরুর আগে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পিছনের বুড়িবরাক পার হয়ে যেত। এপারে ধরা পড়লে বিপদ, স্যারদের লেলিয়ে দেওয়া বীরেরা কেউ কলারে, কেউ ঘাড়ে, কেউ দুহাতে ধরে আসামিকে স্যারের সামনে হাজির করত। আসামিরা তখন প্রাণ বাঁচাতে স্যার 'আজ মাফ করে দেন, আর কোনদিন স্কুল পালাব না’ বলে হাউমাউ করে কাঁদত। স্যাররা ছিলেন বড় নিষ্ঠুর পাষাণ, এত কান্নাকাটির পরও দু চারটা বেতের ঘা বসিয়ে দিতেন। কিন্তু কোনমতে বুড়িবরাক পার হয়ে গেলে এই নদীর জলকাদা মাড়িয়ে তাদেরকে আর ধরে আনা সম্ভব হত না। তখনকার দিনে কোন স্কুল ড্রেস ছিল না। অনেকে খালিপায়ে স্কুলে আসত। স্কুল পালানো ছেলেরা ছিল বয়সে বড় ও খালিপায়ে লুঙ্গি পরে স্কুলে আসত। এই ষন্ডামার্কা বালকেরা দুনিয়ার সব ধরনের দুরান্তপনা জানত, তবে বরিশাল কোন নদীর পারে অবস্থিত, সিলেট কি জন্য প্রসিদ্ধ, বাংলাদেশ কোন সালে স্বাধীন হয়, 'আমি হব সকালবেলার পাখি' কবিতার চার লাইন, পদ কিংবা বাক্য কি, ইত্যাদি মনে রাখা তাঁদের জন্য যারপরনাই কঠিন কাজ ছিল। তাই স্যারদের বেতের মার হতে তাঁদের বাঁচার একমাত্র পথ ছিল জানালা দিয়ে লাফিয়ে ভূদৌড়ে পালানো।
সাধারণত স্যারদের পাঠ নেওয়ার সময় এলেই এরা মারের ভয়ে পলায়ন করত। আচমকা জানালা দিয়ে লাফ মেরে বের হয়ে উত্তরদিকে দৌড় দিত। বুড়িবরাকের এপার তুড়ুকখলা, ওপার দাউদপুর। চেরাগ আলী, বাবুল আলী, মানিক আলী, ছয়ফুল আলীরা লুঙ্গি কোমরের উপরে তুলে খালের
উরুজল পার হয়ে নিমিশেই দাউদপুরে উদাও হত। তাদের উলঙ্গ নিতম্ব দেখে ছেলেরা হাসাহাসি করত। তাঁরা ওপারে চলে গেলে কার সাধ্য ধরে আনে। স্যারদের লেলিয়ে দেওয়া সৈনিকেরা প্রায়ই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে হাঁফাতো। পরদিন স্কুল পালানোদের বিচারও হত। শাস্তি দু’এক ঘা বেত্রাঘাত
কিংবা কান ধরে উঠাবসা। কবিগুরুর একটি অনুকবিতা আজ
মনে উদয় হল, 'সেই সুমধুর, স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা পলায়ন,/ ভাবিলাম
হায়, আর কি কোথায়, ফিরে পাব সে জীবন'।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নামতা মুখস্ত করা ছিল কঠিন কাজ। একজন উচ্চারণ করত পাঁচ একে পাঁচ,
পাঁচ দুগুণা দশ, পাঁচ তিনে পনর। বাকি সবাই
সমস্বরে চিৎকার দিতাম। ছেলেমেয়েদের এই চিৎকার চৌধুরীবাজার ও বুড়িবরাক নদী পার
হয়ে চারতলা মিনার ও তিন গম্বুজওয়ালা দাউদপুর শাহি মসজিদ পর্যন্ত শোনা যেত। অথচ
আজিকার ক্যালকুলেটরের যুগে নামতা শিখার প্রয়োজন অনেকটা ফুরিয়ে গেছে।
স্কুলের সামনের
মাঠে প্রতিদিন স্কুল আরম্ভ হবার আগে পিটি করানো হত। প্রতিটি ক্লাসের ছাত্র আলাদা
আলাদা লাইন ধরে দাঁড়াত। প্রথমে পতাকা উত্তোলন ও পরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। জাতীয়
সঙ্গীতে মাঠের সবাই কন্ঠ মেলাত। তারপর হত শপথগ্রহণ
অনুষ্ঠান। কাঞ্চন স্যার বলে যেতেন আর আমরা সবাই ডানহাত সামনের
দিকে ভূমি সমান্তরালে তুলে শপথ নিতাম- 'আমি
শপথ করিতেছি যে, আমি দেশের
আইন কানুন মেনে চলব, দেশের সংবিধানের প্রতি সব সময় অনুগত থাকব। বাংলাদেশকে
একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে
সর্বদা স্বচেষ্ট থাকিব'। শপথগ্রহণের পর সোজা
হও, আরামে দাড়াও, তারপর নানা ধরনের শরীরচর্চা করে লাইন ধরে ধরে নিজ নিজ ক্লাসে গমন
করে দীর্ঘক্ষণ রোদে দাড়ানোর পালা সমাপ্ত হত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
গঠনের শপথ মওলানা মনিরউদ্দিন স্যারের একদম
মনঃপুত হত না, তিনি ক্লাসে মাঝে মাঝে বলতেন,
ইসলাম নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামতো অন্যধর্মের লোকের ধর্মেকর্মে কোন বাঁধা
দেয় না। তাহলে আগবাড়িয়ে ৮৫% মুসলমানের এই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা কেন। আড়ালে
আবডালে মুখে যে যাই বলুন না কেন তখন ক্ষমতায়
ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার, তাই প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধীতা
করার ক্ষমতা ও সাহস কারো ছিল না,
মৌলানা স্যারেরও ছিলনা, কারণ
রাষ্টের মূল চারনীতির একনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধীতা করলে চাকুরি যে
থাকবে না।
আমার পাঠশালার স্যাররা সরকারি চাকুরি করতেন, অথচ তারা ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ। সেকালে পাঠ আদায়ে একটু কঠোর আচরণ করা সর্বত্র প্রচলিত ছিল। এই ধরনের আচরণ কেউ দোষের কিছু মনে করতনা। অভিভাবকরা মনে করতেন, ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বাচ্চাদের মঙ্গলের জন্য স্যাররা খানিক কঠোর আচরণ করছেন, দুষ্টামী করার জন্য একটু শাসন করছেন। তাতে এত দোষ কিসের? ছাত্রদেরকে পড়াতে তারা যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন। আজকাল সরকারি অফিস আদালতে যে ফাঁকিবাজি ও দুর্নীতি হয়, তারা এসব হতে পুরাপূরি মুক্ত ছিলেন। তখনকার সময় এত জবাবদিহিতা ছিল না। তারা চাইলে নাকে সরিষার তেল দিয়ে পাঠশালায় শুয়ে বসে সময় কাটাতে পারতেন। অথচ সদ্য স্বাধীন দেশের এই সরকারি শিক্ষকগণ আমাদের অভিভাবকগণের সাথেও সর্বদা যোগাযোগ রাখতেন, পরামর্শ দিতেন। আজ যখন মাঝে মাঝে একাকি বসে চিন্তা করি, তখন মনে হয় পাঠশালায় প্রিয় স্যারদের কঠোর শাসন ও স্নেহমমতা যদি না পেতাম, তাহলে জীবনে টিকে থাকার শক্তি পেতামনা। হয়তো গড্ডালিকা প্রবাহে অতলে হারিয়ে যেতাম।
আজকের দিনের পাঠশালার ছাত্রদের তুলনায় তাদের বয়স ছিল ঢের বেশী। বয়স আট-দশ পার হলে মা-বাবা সন্তানকে পাঠশালার ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি করাতেন। সেই যুগে পাঠশালার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন গরীব কৃষকের সন্থান। খুব ভাল পোষাকাষাক পরার সামর্থ তাদের ছিলনা। তাদের মা-বাবারাও তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। জন্মসূত্রে তাঁরা খুব একটা ভাল মস্তিষ্ক পায়নি। তাই তাদের বেশিরভাগই পরবর্তীকালে পরিনত না হয়েই অকালে হারিয়ে যায়।
এবার আমার জন্ম জন্মান্তরের প্রিয় সহপাঠিদের কথা আপনাদেরকে শুনাব। আমি ভাগ্যবান, তাদের সহপাঠি হয়েছিলাম। তারাও ভাগ্যমান, আমি তাদের শৈশবের স্মৃতিকথা লিখে তাদেরে স্মরণ করছি।
আমার নিজ নিবাস দাউদপুর
পূর্বপাড়ার ছয়ফুল আলী ও ফয়জুল আলী দুইজন
আপন চাচাতো ভাই আমার সহপাঠি ছিল। ছয়ফুলের বাবা মেরুউল্লা লন্ডনি ছিলেন আলকাতরা কালো স্থুলকায়া লোক, দেখতে একদম আফ্রিকান নিগ্রো। তিনি দশ টাকার ভাউচারে লন্ডন গিয়ে
ধনী হন। তার ঘন ঘন বিয়ে করার বাতিক ছিল। প্রতিবছর দেশে এসে প্রচুর টাকার বিনিময়ে
গরিবের মেয়ে দালাল মারফত বিয়ে করতেন। টাকার বিনিময়ে আসা এইসব বউরা পরে টিকত না।
মেরুলন্ডনি লন্ডনে চলে গেলে এসব বউরাও তাদের
পাওনা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে কেটে পড়ত। তাই বুড়ি ছয়ফুলের মা
ছিলেন মেরুলন্ডনির শেষ ভরসা ও পার্মানেন্ট ঠিকানা। ছয়ফুলের
মা আমাদের পাশের বাড়ির গায়ক ইস্রায়েল আলী ভাইয়ের মেয়ে। এই মেরুলন্ডনি বুড়ো বয়সে পার্শ্ববর্তী সিরাজপুর গ্রামে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলতে গিয়ে গ্রামবাসীর
কোপানলে পড়ে একরাতে নিহত হন।
একদিন সিলেট হতে বাসে বাড়ি
ফিরছি। বাসের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি সিরাজপুরে সড়কের খালে একটি লাশ পড়ে আছে।
চারপাশে মানুষের জটলা দেখে বাস থামে। বাস হতে নেমে দেখি লাশটি আমার প্রতিবেশী মেরু
লন্ডনির। তার লাশ বাস সড়কের পাশের
ধানক্ষেত হতে পুলিশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করতে
নিতে এসেছে। দূরের বাড়িতে তাঁকে খুন করে সবুজ ধানক্ষেতের ভিতর
দিয়ে খুনীরা টেনে সড়কের খালে ফেলে রেখেছে। ধানক্ষেতে লাশ নিয়ে আসার রেখা দেখা যাচ্ছে।ছয়ফুল ডান কানে কম শুনত ও কথায় কথায়
দু’একটা আশ্লীল বাক্য ছাড়ত, এসব বাক্য যে অকথ্য তাও সে আদৌ
বুঝত না। ফয়জুল বেশ মাতব্বর ও বুদ্ধিমান কিন্তু পড়ালেখায় অক্ষম। তাই এই দুইভাই
স্যারদের কাছে ছিল চোখের বালি। তারা দুই চাচাত ভাই লন্ডনি সার্ট ও লুঙ্গি পরে স্কুলে আসত।
তিরাশীগাঁওয়ের ভগিরথ বাবু দাউদপুর ইউনিয়ন আফিসের সচিব, সুব্রত সিংহ বাবলা ভগিরথ বাবুর ভাতিজা। সে ছিল গৌরবর্ণ ও শান্ত সুবোধ বালক। হাফপেন্ট ও সাদা সার্ট পরে স্কুলে আসত। পড়া না পেরে নিয়মিত কাঞ্চন স্যারের হাতে জালিবেতের মার খেত। সাব্বির আহমদ পশ্চিম দাউদপুর মোল্লাবাড়ির বাসিন্দা। তার একমাত্র মামা স্বাধীনতা যুদ্ধে গোলাগুলিতে পড়ে মারা গেলে তারা নানাবাড়িতে চলে আসে। সাব্বিরের নানা বাট্টি হাফেজ ছিলেন দাউদপুর ইউনিয়নের বিয়ের কাজি। সাব্বিরের হাতের একটা আঙ্গুল অতিরিক্ত ছিল। সে ছিল শ্যামলা অথচ সবাই তাকে দলা নামে ডাকতো।
সাব্বির আহমদ দলা একসময় সৌদি আরবে চলে যায়। একমাত্র মেয়ে ও তরুণী গিন্নী রেখে অল্প বয়সে সেখানে সে মারা যায়। তার ছোট ভাই কবির আহমদ সাহেদ বিধবা ভাবীকে বিয়ে করে ঘরের বউকে ঘরে রাখে। আমাদের জুনিয়র ক্লাসের ছাত্র কবির আহমদ প্রাইমারি শিক্ষক ও দাউদপুর ইউনিয়নের বিয়ের কাজি।
হাড়িয়ারচরের চকচকে কালো ছেলে ইমরান আলী অন্তঃজেলা ট্রাক চালক ছিল। কঠোর পরিশ্রম করে করে অল্প বয়সে সে পরলোকবাসী হয়। এই পাড়ার আব্দুস শুকুর কিছুদিন দাউদপুর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে সে এখন হুজুর। পুর্ব তুড়ুকখলার মনির আহমদ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা মনির আহমদের বাড়ির ছেলে এ্যালেন। লিকলিকে শ্যামলা এ্যালেন যেন হাওয়ায় উড়ত।
সেলিম আহমদের বাড়ি পশ্চিম তুড়ুকখলা, পিতার একমাত্র সন্তান। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তার আম্মা মারা যান। সেলিমের বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল, তিনি প্রচুর কৃষিজমির মালিক। সেলিমের মা মারা যাবার কিছুদিন পর তার বাবা আমাদের সহপাঠিনী সুয়ারা বেগমের বোন বেলুন বেগমকে বিয়ে করেন। সহপাঠিনী সুয়ারা বেগম সেলিমের খালাম্মা হয়ে গেলেও সেলিম তাকে আগের মত সুয়ারা নামেই ডাকতো।
সেলিম ছিল
কালো ও শক্তিশালী, তাঁর সাথে মারামারিতে কেউ জয়ী হতনা।
তাই বালকদের কেউ কেউ তামাসা করে তাকে ‘পাঠা’ বলত। তবে তাঁকে এই নামে ডাকলেও
সে তেমন রাগ করত না, বিষয়টাকে নিছক কৌতুকই মনে করত। সেলিম আহমদ
এখন তুড়ুকখলার মেম্বার। এই পাড়ার সাবুল ছিল ফর্সা বেঁটে শান্ত বালক। অতিভদ্র সাবুল আহমদ প্রবাসে অল্প বয়সে মারা যায়।
মাওলানা ফরমুজউল্লাহ সায়দা(রঃ) সাহেবের ছেলে পিয়ারা আহমদের সন্তান মোক্তার আহমদ। শ্যামলা দেহবর্ণ, ছোট মুখমন্ডল, চিকন রোগা দেহ, ধারাল নাক ও মুখ বিশিষ্ট মোক্তার ছিল একগুঁয়ে স্বভাবের ভাল মনের মানুষ। মোক্তারের বাপচাচারা সবাই আব্বার ছাত্র। তাদের মুখে আব্বার নানা প্রশংসা শুনে মোক্তার আমার ভক্ত হয়ে যায়। ছেলেদের মারামারিতে সে সব সময় আমার পক্ষ নিত। আমার সম্মান বাঁচাতে সে প্রহরীর মত পাশে এসে দাঁড়াত। মোক্তারের লেখাপড়া হাইস্কুল পেরুয়নি। সে বিয়ে টিয়েও করেনি, দেখা হলে বুকে জড়িয়ে ধরে ও অতীতের গল্প বলে। চিরকুমার মোক্তার আমার প্রাণের চেয়েও আপন।
প্রিয় সহপাঠি তুড়ুকখলার আজাদ, দুলু ও ওদুদের সাথে শৈশবে শক্তিপরীক্ষার কাহিনি আগেই বলেছি। গাট্টা-ওদুদ বেখাপ্পা গলায় কাঞ্চন স্যারের ভয়ে ক্লাসে গান গাইত। একদিন মনিরমৌলানা স্যারের অনুরোধে সে ভিনভাষায় গান গায়। তাঁর সেই গানের দুই লাইন আজও মনে আছে 'আল্লাহু আল্লাহু, দুয়া মাংরা হা হু/ হা লিমান, হু লিমান, হা লিমান হু'। মৌলভি স্যার গান শুনে বললেন, তোমার এই গান আরবি, ফার্সি, না উর্দু, আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। ওদুদ বলল, এই গান আমার মাদ্রাসা পড়ুয়া একজন আত্মীয় শিখিয়েছেন। মৌলানা স্যার হেসে উঠেন, একেতো তোমার ফাঁটাবাঁশের গলা, তাঁর উপর হা লিমান, হু লিমান, হু। মনে পড়ে পঞ্চম শ্রণিতে আমি প্রথম, ওদুদ দ্বিতীয় এবং সামিয়ানা আক্তার দিপা ছিল তৃতীয় স্থানের আধিকারি।
আজাদের ছোটভাই শাহিনকেও সহপাঠি হিসাবে পাঠশালায় পাই। শাহিনের মন ভাল, তবে কেউ তাকে ঠকাতে পারবে না। তুরুর বাড়ি হেতিমগঞ্জে। সে তার মামাবাড়ি তুড়ুকখলায় নানানানির আদরে থেকে পাঠশালায় অধ্যয়ন করত। একটু বয়স্ক তুরু গোল্লাছুট খেলায় যে দলে সে দলের জয় হত। তাই আমি স্কুলমাঠের গোল্লাছুট খেলায় কৌশলে তুরুর দলে ঢুকে খেলতাম। পরে তুরু সিলেটে টাউনবাস চালাত।
আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন মোগলাবাজার হতে টাউনবাসে সিলেট
যাই। বাস হতে নামতেই ড্রাইভার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভাড়া ফিরিয়ে দেন। আমি তাঁর
আচরণে বেশ অবাক হই। এবার ড্রাইভার জানতে চান আমার নাম সেফাক
নাকি। তাঁর মুখপানে অনেকক্ষণ
চেয়ে থেকেও আমি পাঠশালার সেই গোলমুখ মোঠাতাজা তুরুকে চিনতে পারিনি। জিজ্ঞেস করি, আমাকে
চিনলে কেমনে? জবাব পাই- তুমি
একবার হাসছিলে, এই হাসিমুখ দেখে চিনে ফেলেছি তুমি সেফাক। হ্যাঁ আমি সেফাক বললে সে পরিচয়
দেয়, আমি তুরু। শৈশবের সদাহাস্য তরতাজা তুরু কঠিন জীবনসংগ্রামে পড়ে আজ শীর্ণকায়, ও চেহারা একদম মলিন হয়ে গেছে। একটা
হোটেলে চা পান করে করে কিছুক্ষণ আমরা অতীতের
স্মৃতিচারণ করি, তারপর যার
যার পথে হারিয়ে যাই।
শুনেছি তুরু এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছে।
তুড়ুকখলা বড়বাড়ির মোঃ মোস্তফা কামাল আমার সহপাঠি ও আজীবন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাকতালীয় ভাবে আমরা দুইজন সহপাঠির পিতারাও ছিলেন পাঠশালার সহপাঠি এবং দুজনেরই নাম ছিল সফিক। কামালের বাবা সফিক মিয়া অল্প বয়সে মারা যান, আর আব্বা প্রায় তিরানব্বই বছরের দীর্ঘজীবন লাভ করেন। কামাল এখন লন্ডনে সুখী জীবনযাপন করছে। দেশে এলে কখনও আমাকে না দেখে ফিরে যায় না।
সুয়েদ আহনদ তুড়ুকখলার ঈদগাহের পুর্বদিকের বাড়ির ভাইস চেয়ারম্যানের পুত্র। সে সোজাসাপ্টা বালক, পাজ্ঞাবী পরত ও তার নাক দিয়ে সব সময় সর্দি ঝরতো। পশ্চিম তুড়ুকখলার আব্দুল কুদ্দুছ আজ নেই। এই পিচ্চি ভাল ছেলেটি কারো সাথেও নেই, পাছেও নেই।
আমি ও বোন আনিছা মৌলা কুরেশী মান্না, কুদ্দুছ ও তার বোন আছমা, কামাল ও তার বোন ফাতেমা, সাবুল ও তার
বোন সুয়ারা, আমরা এই চারজোড়া ভাইবোন ছিলাম পাঠশালায় সহপাঠি।
তুড়ুকখলা দক্ষিণপাড়ার স্মার্ট বালিকা সামিয়ানা আক্তার দিপা, গোছানো পরিপাঠি পোষাক পরত, বুদ্ধিমতি দিপা সুন্দর গান করত। ‘মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ে বাদ্য আল্লা বাজেরে। মনুমিয়ার দেশেরে, বিয়ার বাদ্য আল্লা বাজেরে। মালকা বানুর সাত ভাই, মনু মিয়ার কেহ নাই’। ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে, কান্দে হাসন রাজার মন ময়নায় রে’। দিপার গাওয়া হাসন রাজার গান, মালকা বানুর গান আজও যেন কানে বাজে।
এই পাড়ার নম্রভদ্র শ্যামলা মিষ্টিমুখ বালিকা শাহানা আক্তার। সে দিপার চাচাতো বোন। এইপাড়ার খুব সুন্দরী, অপরূপ চেহারার একজন বালিকা আমার সহপাঠিনী ছিল, তার নাম টফি। একদিন পঞ্চম শ্রেণিতে মইনউদ্দিন স্যারের ক্লাস চলাকালে খবর আসে টফির বাবা মারা গেছেন। টফি কেঁদে কেঁদে স্কুল হতে বেরিয়ে যায় ও পরে শহরে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়। টফির সাথে সেদিনের পর আর কখনো দেখা হয় নি। জানিনা, এই মেয়েগুলো কোথায় আছে, কোথায় বিয়ে হয়েছে।
সেফুলা বেগম মধ্য তুড়ুকখলার মেয়ে, সাজগোঁজহীন সাদামাটা সুন্দরী বালিকা সে। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে একদিন সেফুলাকে জ্বীনে ধরে। আরেকদিন শাহানাকেও জ্বীনে ধরে, সে আবুল তাবুল বকে আমাদেরকে মারতে থাকে। অন্যান্য শ্রেনির অনেক মেয়েদেরকেও ভূতে ধরে। স্যাররা জ্বীনেধরা মেয়েদেরে ব্রেঞ্চে শুইয়ে রাখতেন। ভূত তাড়াতে মনির মৌলভীস্যার সুরা ইখলাস পড়ে ফু দিতেন। অভিভাবকদেরে ডেকে আনতেন। অনেকক্ষণ আবোল তাবোল বকে তারা সেরে উঠত।
স্কুলের পিছনের নদীপারে একটি শ্মশানঘাট ছিল। কিছুদিন আগে এখানে ওপারের বাসিন্দা রাধা মালাকারের শেষকৃত্য হয়। আমাদের শিক্ষকগণসহ সবার দৃঢ় বিশ্বাস রাধা মালীর আত্মা জ্বীন হয়ে এসে এসব অপকর্ম করছে। পাঠশালার মেয়েদেরে জ্বীনে ধরার বিষয়টি আমার কাছে আজ কেমন যেন রহস্যজনক ব্যাপার মনে হয়। আসলে জ্বীন বা ভূত বলে কি কিছু আছে এই দুনিয়ায়, যা যুগে যুগে মানুষ কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করে আসছে।
মেম্বার সেলিম মিয়ার কাছে জেনেছি, পশ্চিম তুড়ুকখলার সেগুন বেগম নামের সুন্দরী মেয়েটি আজ বেঁচে নেই। সেগুনের বাবা মিয়াধন মিয়া পশ্চিম তুড়ুকখলা হতে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আট মাইল দূরবর্তী সিলেট ডিসি অফিসে যেয়ে চাকুরি করতেন। ১৯৭৭ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় মিয়াধন মিয়া মারা যান। তুড়ুকখলার গুরুস্থান জলে ডুবে যায়। আব্বার কাছে তাঁর কবরের জন্য একটু জায়গা চেয়ে লোক আসে। আব্বা সফিক চৌধুরী অনুমতি দিলে মিয়াধন মিয়াকে আমাদের কবরগায় দাফন করা হয়।
কলুন বেগম পশ্চিম তুড়ুকখলার ভুমিপতি মাহবুবুর রহমানের কন্যা। হলুদ চুল ও পিঙ্গল চোখের বালিকা কলুন বেগম ছিল একদম দীঘল ধবল ইংরেজ বালিকা, যেন মোমের প্রতিমা। তুরুকখলার বালকেরা বলাবলি করত কলুনের বাবা ধনাট্য মাহবুব মিয়া খুব কঠিন হিসেবী লোক। তিনি সারাদিন ধানক্ষেতে শ্রম দিয়ে সময় কাটাতেন, আর কলুনের আম্মা বড় বড় মাছ কিনে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে লুকিয়ে রান্না করে খান। ধনাট্য মাহবুব মিয়ার পাতে এই মাছ যায়না। কারণ কর্তা দেখে ফেললে মাছ কিনে এত টাকা জলে ফেলার জন্য ধরাশায়ী হতে হবে। তাঁর খাদ্য সাদামাঠা শাক ও ডালভাত। কুদ্দুস ও মোক্তার একদিন বলল, কলুনের বাবা গিট্টো খুলেছেন। কিসের গাট্টি জানতে চাইলে তাঁরা বলল, মাহবুব মিয়ার কয়েক প্রজন্ম পূর্বপুরুষ নাকি মাত্র একজন করে পুত্রসন্থান জন্ম দেন। কলুনেরা আনেক ভাইবোন, তাই এই প্রজন্মে কলুনের বাবা অনেক সন্থান জন্ম দিয়ে গিট্টো বংশের গিট্টো খোলেন। তাইতো কয়েক প্রজন্মের সম্পদ জমে ধনাট্য মাহবুব মিয়া ষাট হাল মিরাসের মালিক।
পশ্চিম দাউদপুর মুতিরপাড়ার গোলমুখের শ্যামলা মেয়ে হালিমা খাতুন ছিল আমাদের মাওলানা মনিরউদ্দিন স্যারের কন্যা। দাউদপুর মোল্লাবাড়ির এই মেয়েকে এই অল্প বয়সেও ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হত।
পশ্চিম তুড়ুকখলার মেয়ে মালেকা খানম ও সুয়ারা বেগম। মালেকা বয়স্ক ও শরীর স্বাস্থ্যে বলিয়ান হওয়ায় মেয়েদের উপর কতৃত্ব করত, সে ছিল ক্লাসের মেয়েদের নেত্রী। একটু খাটো সুয়ারা গোলাপী ফর্সা ও পরমা সুন্দরী। সুয়ারা ছিল আমার অগ্রজা আনিছা মৌলা বেগম চৌধুরী মান্নার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তাদের মধ্যে পরস্পরের বাড়িতে আসা যাওয়া বিনিময় হত। সুয়ারা বেগম অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে লন্ডনে চলে যায়। ২০১৫ সালে পুবালী ব্যাংক চৌধুরীবাজার শাখায় বসে শুনলাম সুয়ারা দেশে এসেছে। আমি দেখা করতে চাইলেও নানা কারণে দেখা হলনা। সূয়ারার অগ্রজা বেলুন বিবির সৎপুত্র সহপাঠি সেলিম মিয়া বলল সুয়ারা এখনও অনিন্দসুন্দরী। তাকে দেখলে মনে হয় বয়স এখনও তিরিশ হয়নি। উন্নত দেশ লন্ডনের হাওয়া তাকে তরুণী বয়সে আটকে রেখেছে।
পঞ্চম শ্রেণিতে একদিন স্যার উপস্থিত ছিলেন না। তখন মোক্তার ও মালেকার নেতৃত্বে বরকনে খেলা খেলতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা মৌলানা মনিরউদ্দিন স্যারের হাতে ধরা খায়। মনিরউদ্দিন স্যারের কাছে এটা অনৈসলামিক কাজ ও গুরুতর অপরাধ। এই বেলাজ ও বেশরম কাজে জড়িতরা উপযুক্ত সাজা পান, স্যারের হাতের বেতের প্রহার।
তুড়ুকখলা
দক্ষিণপাড়ার মিন্টুর আব্বার নাম উরফি মিয়া। তারা ছিলেন বংশ পরম্পর পীর। বিশ্বনাথ ও
জগন্নাথপুরে উরফি মিয়ার অনেক মুরিদান ছিলেন। ঘনবর্ষায় সাদা ধবধবে পাজামা পাজ্ঞাবী
পরে মিন্টুর বাবা উরফি মিয়া পীর সাহেব নৌকায় চড়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভাটির গ্রামে
মুরিদানের কাছে ইলমে মারেফত বিতরণে
বেরিয়ে পড়তেন। তিনি ছিলেন আব্বার প্রিয় ছাত্র। আব্বাকে তিনি নিজ পিতার মত শ্রদ্ধা করতেন। মিন্টু পৃথিবীর
অনেক দেশ ঘুরে শিকড়ে ফিরে এসে আবার জন্মভূমি তুড়ুকখলার বাসিন্দা।
সে নিজগ্রামে গড়ে তুলেছে মৎস্যখামার, পোল্ট্রিখামার ও কৃষিখামার। ২০১৫ সালে বসন্তের উতলা হাওয়ায় মিন্টুর খামাররাজ্য ঘুরে ঘুরে একটি
উজ্জ্বল দিন পার করি।
আমার বোন আনিছা মৌলা কুরেশী মান্না গৌরবর্ণ, আমার মায়ের মত পরমাসুন্দরী।
তার বিয়ে হয় রণকেলি গ্রামে, একমাত্র ছেলে সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ তানভির
হোসেন চৌধুরী মুন্না হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও একমাত্র কন্যা লিজা খানম চৌধুরী লন্ডন প্রবাসী।
মধ্যতুড়ুকখলার সহপাঠি রায়হান আহমদ এখন
ট্রেভেলস ব্যবসায়ী, তার পিতা আব্দুর রহমান ছিলেন রেঙ্গা দাউদপুর পোস্ট অফিসের
পোস্টমাস্টার। রায়হান ছিল শান্ত সুবোধ বালক, তাকে কখনো
হৈ হাঙ্গামা করতে দেখি নি।
আরেক সহপাঠি দড়া গ্রামের আলাউদ্দিন ছিল কবি ও ভাবুক বালক। তার বাবা কটাই আলী বয়াতি। বাউল কটাই আলী চৌধুরীবাজারে গান গাইতেন। বালকপূত্র আলাউদ্দিন ঢোল করতাল বাজিয়ে মাথা ধূলিয়ে গ্রাম্য প্রেমের গানে বাবার সাথে কন্ঠমিলাত-'বিষ মাখাইয়া তীরের মুখে, সেই তীর মারলো আমার বুকে। আমার অন্তরায়, আমার কলিজায়, প্রেমশেল মারিল বুকে মরি হায় হায়। জ্বালাইল সে প্রেমের আগুন, জল দিলে তা বাড়ে দ্বিগুণ'। আলাউদ্দিনকে বিটিবিতে একদিন প্রায় একফুট লম্বা বাবড়ি চুল এপাশ ওপাশ ঝাঁকায়ে ঢোলক বাজিয়ে নৃত্য করতে দেখি। হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগায় বাউল আসরে প্রায়ই তার দেখা পেতাম। তার লেখা একটি ছোট গানের চটিবই আমাকে দেখায়। সিলেট বেতারে নাকি এসব গান সে গেয়েছে। আলাউদ্দিন আমাকে কোনদিন নামধরে ডাকত না, কেন যেন আমাকে বেশ লজ্জায় ফেলে ডাকত 'চৌধুরী সাহেব' ও তার ঠুটে সব সময় একটি মিষ্টি হাসি লেগে থাকত। একদিন সে বলল, চৌধুরী সাহেব, আপনাদের জমিজামার অভাব নেই, কোন নির্জন জায়গায় আপনি একটা আখড়া দেন। আমরা আপনার নেতৃত্বে এই আখড়ায় গান গাইব, এখানে আপনার লিখা গানের চর্চা হবে। কিন্তু আমার মত একজন পাক্কা দুনিয়াদারের পক্ষে বাউল আলাউদ্দিনের স্বপ্নের সেই আখড়া নির্মাণ কোনদিন করা হয় নি।
পাঠশালার প্রিয় সহপাঠি ফলেন্দ্র কর পূর্বদাউদপুরের হিন্দুবাড়ির বালক। ছেলেরা তাকে বলত ফলেন। উজ্জ্বল শ্যামলা গোলমুখ ফলেন্দ্র। সুদর্শন ফলেন্দ্র আকাশে জমাটবদ্ধ মেঘের মত শান্তসৌম্য বালক। সে আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকতনা। বলত, ওবা চধরি, কিতা কররায়। ভালা আছনি। ফলেন্দ্রের বাবা চাউলের ব্যবসা করতেন। আমাদের ধান মাঝে মাঝে কিনে নিতেন। ফলেন্দ্র দীর্ঘকাল সৌদী আরবে কাটিতে এখন শিকড়ে ফিরে দাউদপুর গ্রামে সহজসরল জীবন যাপন করছেন।
পাঠশালায় আমরা সিনিয়র হিসাবে তুড়ুকখলার নাজিম উদ্দিন (এ এস পি), মনিরুল হক ইলিয়াসি মিনার (এস আই), মইন, মুতি, দুর্ঘটনায় নিহত ছমন হাজির পূত্র খজ্ঞর, লন্ডনপ্রবাসী যুবায়ের বিন ময়না মিয়া, আদল, মনি, জেসমিন ও দাউদপুরের চেরাগ আলী বিন সিকান্দর আলী, সমীরণ কর, গিয়াস উদ্দিন, অলঙ কর, নিহত রবীন্দ্র চন্দ্র বাবুল, মন্তই আলী, হাড়িয়ারচরের মঈন উদ্দিন, ভাদেশ্বরের তারেক আহমদ চৌধুরী প্রমুখের দেখা পাই। জুনিয়র ক্লাসের দাউদপুর পুর্বপাড়ার চেরাগ আলী বিন আঁতর আলী, মানিক আলী, পশ্চিমপাড়ার লটই মেম্বার, মাঝপাড়ার মরহুম বাবুল আলী, চড়া, গোলাপ আলী, হাসান আলী, তুরুকখলার হেলাল আহমদ, মাহমদ আলী, ইমরান আহমদ, নাছিম বিন খোকা মিয়া, টুটুল, মওদুদ বিন কালামিয়া, হাড়িয়ারচরের জালাল আহমদ বিন আব্দুন নুর, মইনউদ্দিন, সেলিম আহমদ প্রমুখের নাম মনে পড়ে।
পাঠশালার পিছনে বুড়িবরাকের পারে ছিল বালির মাঠ, গাঙ্গের কিনারা জুড়ে লজ্জাবতীর ঝোঁপে ফুলের সৌরভ। এই মাঠে নরম বালি খনন করে আমরা ছোট ছোট খাল বানাতাম। পাঠশালার চারপাশে ছিল জনহীন প্রান্তর এবং ধানক্ষেত। পাঠশালার আশপাশের এসব খোলা মাঠে আমরা দলবেঁধে খেলাধূলা করতাম।
বুড়িবরাক নদী দিয়ে বালু ইট ধান বুজাই বড় বড় নৌকা ডুবু ডুবু হয়ে বয়ে যেত। ছইওয়ালা পানসি নৌকা চড়ে যাত্রীরা তখনকার দিনে এই ছোটনদী দিয়ে চলাচল করতেন। গাংপারের ওপারের বাঁশবনে বকেরা উড়াউড়ি করত। বাদাবনের মাছরাঙা জলে ঝাঁপ দিত।
শৈশব ও কৈশরে আমাদের মনে খোঁজকরের দারুণ ভয় ছিল। খোঁজকরদের নানা ভীতিকর কাহিনি তখন ছেলেদের মুখে মুখে প্রচার হত। সেই কবে প্রাচীনকাল খোঁজকররা বালকদেরে ধরে নিয়ে খোজা বানিয়ে বিদেশে পাচার করত। একবার খোজা হলে রাজারাজড়ার হেরেমের দাস কিংবা পাহারাদার হয়ে চিরবন্দী জীবন কাটাতে হবে। জৈন্ত্যা রাজবাড়ির কালিমন্দিরে দেবীর উদ্দেশ্যে বলী দেওয়ার জন্য বালকদেরকে ধরে নিয়ে চড়াদামে রাজার কাছে নাকি বিক্রি করত। সেতু নির্মাণে নদীর দৈত্য মানুষের কাটামুন্ডু নাকি দাবী করত। কাটাকল্লা না পেয়ে সেতুর পায়া টেনে টেনে পাতালে নিয়ে যেত। সেতু নির্মাণে তাই সরকার বাধ্য হয়ে মানুষের কাটামুন্ডু খুঁজতে ছেলেধরা নিয়োগ করত। সে যুগের মানুষ এসব কল্পকাহিনি সরল মনে বিশ্বাস করত।
ছেলেধরা কিংবা খোঁজকর সন্দেহে অনেক সময় তাঁরা আজানা অচেনা নিরিহ লোকজনকে গণপিটুনী দিয়ে আহত কিংবা নিহত করত। এসব কল্পকাহিনি বালকেরাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। বাল্যকালে খোঁজকর ভীতি ও জ্বীনভূতের ভয় তাই সবার মনে তীব্র আতংক ছড়াত। দলবদ্ধ না হয়ে স্কুলের পিছনে নদীপারে যেতে আমরা ভয় পেতাম। কোন নৌকা আসতে দেখলে ভয়ে সটকে পড়তাম, নাজানি নৌকায় খোঁজকররা বালকধরার ফাঁদ পেতে বসে আছে।
এবার পাঠশালায় আমাদের খেলাধুলা নিয়া আলোচনা করব। সকালে পাঠশালায় এসে সামনের সুদীর্ঘ বারান্দায় তিনচার জনের দল বেঁধে বেঁধে ছোট ছোট নুড়িপাথর দুহাতে উড়িয়ে ফুলগোট্টি খেলা শুরু হত। কয়েকদল বালক বালিকা দড়িলাফে ব্যস্ত হত। কিছু খেলার বিচিত্র নাম ছিল, এক্কা দুক্কা তিক্কা খেলা। আরেক খেলা এলেডিং বেলেডিং। এই খেলার একটা ছড়াও ছিল 'এলেডিং বেলেডিং ছোঁইল/ রাজা মাসে এক বালিকা চাইল/ কোন বালিকা চাইল/ সেবী বালিকা চাইল'। বিচিত্র এক খেলার আরেক ছড়া 'আকাশ থেকে নেমে এলো ছোট্ট একটি প্লেন,/ প্লেন থেকে নেমে এল ছোট্ট একটি মেম/ মেমকে আমি জিজ্ঞেস করলাম হোয়াট ইজ ইয়র নেইম/ সে বলল টুনটুনিয়ে হেইম'। কবাডি ও গোল্লাচুটের আসল চাল ছিল এক নিঃশ্বাসে দীর্ঘ সময় 'চল কুত কুত কুত কুত' বলে যাওয়া। বল নিয়ে বলি বল, বাস্কেট বল, ফুটবলসহ নানান কিসিমের খেলাতো ছিলই। খেলতে খেলতে ঘেমে সিক্ত হয়ে গেলে একে একে স্যারদের শুভাগমন শুরু হত, তখন আমাদের মজার খেলা সাঙ্গ হত।
কিছু ইঞ্জিনিয়ার বালকের দল সকালে স্যাররা আসার আগেই স্কেল দিয়ে খুচিয়ে জানালা খুলে ফেলত। একটি জানালা খুলে গেলেই বন্যার পানির মত বালকেরা জানালা দিয়ে স্কুলে ঢুকে যেত। মুহূর্তে পুরো পাঠশালার সব দরজা-জানালা মেলে ঘর আলোয় ভরে যেত। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে মাঝে মাঝে ক্লাস হতনা, শ্রেণিকক্ষ শিক্ষকহীন হলেই আমরা দু'দলে ভাগ হয়ে বসে ব্রেঞ্চে শক্তিপরীক্ষা খেলায় অবতীর্ণ হতাম। বেশি ঠেলাঠেলি চেচামেচি শুরু হলে অন্য শ্রেণিকক্ষ হতে বিরক্ত কোন শিক্ষক রেগে এসে গণবেত বসাতেন।
মধ্যদিনের
বিরতি ঘন্টা বাজলে শিক্ষকরা নামাজে ও খেতে চলে যেতেন। স্যারদের ঘন্টাখানিকের বিদায়ে স্বাধীনতা পেয়ে ছেলেমেয়েরা উল্লাসে ফেঁটে পড়ত। তারা ঘটিগরম চানাচুর ও বাদাম খেয়ে, চকলেট ও আইসক্রিম চোষাচোষি করে খেলাধুলার আনন্দে মেতে উঠত।
স্কুলের চারপাশের খোলা মাঠগুলো বালক-বালিকাদের খেলাধুলার
হৈ হল্লায় সরগরম হত।
একদিকে ছেলেরা অন্যদিকে মেয়েরা আলাদা আলাদা মাঠে খেলা করত। মার্বেল, ফুটবল,
কবাডি, গোল্লাছুট, এলেডিং বেলেডিং, কানামাছিসহ নানান কিছিমের
খেলা।
খেলাধূলা, দৌড়াদৌড়ি ও ধাক্কাধাক্কি করে ঘর্মাক্ত হয়ে সবাই টিউবওয়েলের সামনে পানিপানের জন্য লাইন
ধরত, একজন হাতল চাপাত, আরেকজন কলের মুখ হাত
দিয়ে শক্তকরে চেপে ধরত, পানি পিচকারী দিয়ে বের হত, বালক বালিকারা ঠেলাঠেলি করে মহানন্দে এই পিচকারি দিয়ে বেরিয়ে আসা জল পান করত।
প্রতিবৎসর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একদিন সবাইকে হাতের কাজ জমা দিতে হত এবং
এই হাতের কাজে ভাল নম্বর প্রদান করা হত। ছাত্রছাত্রীরা তাদের অভিবাবকদের সহায়তায় নানা
ধরনের হস্তশিল্প তৈরি করে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে জমা দিত। সেইদিন স্কুলে উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করত। রঙ্গীন কাগজে তৈরি ফুলের তুড়া, বাঁশপাখা ও তালপাখা, সিগারেটের বাস্কে তৈরি পুষ্পঝাড়, দিয়াশলাই বাস্কে
নির্মিত ঘর, বাঁশের ছোট ছোট ডালা, কুলা, খলই, কাপড়ের উপর রেশমি সূতায় তৈরি ছবি ও বানী, এমনকি নানাধরনের ঝাড়ুও জমা হত। এত ঝাড়ু
জমা হত যে স্কুলের চাহিদা পূরণ হয়ে
স্যারদের বাড়িতেও চালান হত। রঙ্গিন কাগজের ফুলেরতুড়া ও সিগারেট
বাস্ক দিয়ে নির্মিত সুন্দর ফুলঝাড়গুলো সারাবছর শ্রেণিকক্ষের
ছাদে ও দেয়ালে ঝুলে শোভা বিলাত।
আমরা প্রায়ই পিছনের মাঝচৌধুরীবাড়ি যেতাম, এই বাড়ির সায়রা আপা, পান্না ও ফারেহা আমাদের শৈশবের সাথী। মাঝের বাড়ির উত্তর ঘরের চাচি (আবুদাউদ কুরেশি ভাইয়ের আম্মা) আমাদেরকে খুব আদর করতেন। এই চাচি শিল্পী প্রকৃতির মানবী ছিলেন। সর্বদা নানা ধরনের হস্তকর্ম তৈরি করতেন। তার হাতে তৈরি ছোট ছোট বাঁশের খলই, ধুছইন, ঢালা কুলা ইত্যাদি আমারা উপহার পেতাম। এগুলো ক্লাসে জমা দিয়ে আমাদের হাতের কাজের গুরুদায়িত্ব সহজেই সেরে নিতাম। ১৯৭৫ সালের শেষ ডিসেম্বরের এক হিমশীতল দিনে পাঠশালায় আমরা হৈ চৈ করে হাতের কাজ জমা দেই। ঠিক তারিখটি মনে নেই। তবে সেই দিনটিই ছিল তুড়ুকখলা পাঠশালায় আমাদের শেষ মধুঝরা দিন।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল বলে কিছু আমাদের কালে ছিলনা। কে জি- ওয়ান, কে জি- টু এর যন্ত্রণা আমরা পাইনি। তবে আমরা পেয়েছিলাম এক সুন্দর সুখী ও মানসিক পীড়নহীন শৈশব। আজিকার মত এত ভারী বইখাতার বোঝা ছিলনা। এ+ রেজাল্ট করার জন্য অভিভাবকদের অত্যাচার ছিলনা। ছিলনা প্রাইভেট পড়ার দৌড়াদৌড়ি। পরম করুনাময় আল্লাহপাকের প্রকৃতিরাজ্যে স্বাধীন রাজার মত এক চঞ্চল ভাবনাহীন সুখী শৈশব ও কৈশর পার করে এসেছি। দুঃখ হয় আজকের শিশুদের শৈশব ও কৈশর ছিনতাই হয়ে যায়, আমাদের মত উদ্দ্যম দুরন্ত বাল্যকৌশর তাদের নেই। আজিকার বন্দী শিশুরা বড় হয়ে আমার মত এত উচ্ছাস নিয়ে তাদের বাল্যকালের ছবি বলতে কিংবা লিখতে পারবেনা। কারণ ছোটবেলার মিষ্টিমধু আজ আর তেমনটি নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন