আমার জীবনের সেই স্বর্নালি ভোরবেলাঃ
মেয়াদকালঃ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ সাল
হতে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭০ সাল
ভোরবেলার
পরিব্যাপ্তিঃ প্রায় পাঁচ বৎসর আট দিন।
আমার শুভ জন্মদিন ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ হতে আরম্ভ করে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোরবেলাটি প্রসারিত। এই সময়ের পর পাঠশালায় যাই। পড়ালেখার চাপবিহীন সবার মায়ায় জড়ানো এক সুন্দর আলোকিত বাল্যবেলা, করেছি মহানন্দে কেবল হৈহল্লা আর খেলা। জন্মের দুই এক দিন যেতে
না যেতেই বেরিয়ে আসে এক দুঃসংবাদ। সে
দুঃসংবাদে নবজাতককে যতটুকু ভাগ্যবান ভাবা হয়েছিল তাতে ধূলা পড়ল। কে
একজন অবাক হয়ে বলে ওঠেন, এই কি দেখছি, নবজাতকের ডান পা যে একদম খোঁড়া। সবাই পা টা
ভালভাবে চেখে দেখে বললেন তাই তো দেখছি। ভাগ্যবানের সৌভাগ্য
উবে গেল, সবাই চিন্তিত, এই শিশুটি বড় হয়ে হাঁটতে পারবে তো।
চিকিৎসক দেখাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ফুফুর বাসায়,
সিলেট শহরের মুফতিবাড়ি, দরগামহল্লায়। চিকিৎসক পায়ে
একটা অস্ত্রোপচার করতে চাইলেন। তখনকার দিনে মানুষ অস্ত্রোপচারকে
যমের মত ভয় পেত। ফুফুর শ্বাশুড়ি আম্মাকে বললেন বাচ্চাটির পা কাটা হবে তা দেখে তুমি
কিভাবে সইবে, বরং তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর, দোয়া করি আল্লাহ এমনি এমনি বাচ্চাটার
পা ভাল করে দিবেন। মাও ভাবলেন তাইতো সত্য, বাচ্চাটার পা কাটা হলে সে চিৎকার দিবে।
নিজ প্রাণপ্রিয় শিশু সন্থানের কান্না সইব কেমন করে? তাই শেষপর্যন্ত মহান আল্লাহর
উপর ভরসা করে অপারেশন ছাড়াই বাড়ি ফিরে আসলেন।
আমার বয়স
যখন মাত্র দশ মাস, তখন আমার নানা আলেম ও পীর হজরত মৌলানা
দেওয়ান খলিলুর রহমান চৌধুরী(রঃ) ১৯৬৬ সালের
২৮ সেপ্টেম্বব পাতারিয়ায় দেহত্যাগ করেন।
অসুস্থ নানাকে দেখাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাতারিয়ায়। নানা
কিছুটা প্যারালাইজড ছিলেন, কথা বলতে কষ্ট হত। নানা মৌলানা খলিলুর
রহমান মাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় তিরস্কার করলেন- তুমি বড় বাদ,
তুমি বড় বাদ, তুমি কেন ওকে আপারেশন না করায়ে সিলেট হতে কেন ফিরে আসলে? মা বললেন, বাবা আমি মন্দ অবশ্যই ঠিক, আমি ফিরে এসে ভূল
করেছি, তাও ঠিক। তবে আপনি দোয়া করলে আমার ছেলের পা ভাল হয়ে যাবে। বিছানায়
শোয়া রুগ্ন নানা দুইহাত আকাশের দিকে তুলে খুব কষ্টে দোয়া করলেন, হে দয়াময়, হে
মহান আল্লাহ তুমি আমার নাতির খোঁড়া পা ভাল করে দাও।
তারপর ল্যাংড়া পা ভালভাবে ছুঁয়ে দিয়ে
বললেন, কোন চিন্তা কর না, ইনশাহ আল্লাহ আমার নাতির পা একদিন ভাল হয়ে যাবে।
শিশু আমি বড়
হচ্ছি, অন্য দশজন শিশু যে বয়সে হাঁটে আমার সেই
সময় পার হয়ে গেছে। আমি হাঁটতে
পারছি না। বড় বোন রেহা ও
সেহা আমার হাত ধরে ধরে হাঁটা শিখানোর প্রাণান্ত
চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু ফলাফল শুন্য। তাঁরা
হাত ছাড়লেই আমি মাটিতে পড়ে যাই। সবাই ধরে নেন এই শিশু কোনদিন হাঁটতে
পারবে না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদা আমার খালাতো বোন কলি ও এলি
এরা আমাদের বাড়িতে ছিলেন। হাত ধরে ধরে
তারা সবাই আমাকে হাঁটানোর চেষ্টা করছেন। আমি
তাদের হাত ছেড়ে দু’এক পা ফেলামাত্র তারা আনন্দে চিৎকার জুড়ে দেন, সেফাক
হেঁটেছে, সেফাক হেঁটেছে। তাঁদের
চিৎকারে আমার হাঁটা দেখতে বাড়ির সব লোকজন এসে জড়
হয়ে যান। ডান পা আতুর শিশুর দু’এক পা ফেলা তাঁরা মহানন্দে
উপভোগ করেন।
আমি হাঁটতে পেরেছি, তাই সবাই
খুশী, কিন্তু একজন খুশী
হতে পারেন নি, তিনি আমার মা আসমতুন্নেছা। কারণ আমি
পা ফেলেছি পায়ের উল্টানো পিঠদিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। মা
চোখে আন্ধকার দেখলেন, ভাবলেন আমি জীবনভর ল্যাংড়াই থাকব,
খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটব। তখনকার দিনে
সুর্যগ্রহণ নিয়ে কুসংস্কার ছিল। আমি
মাতৃগর্বে থাকাকালে একদিন সুর্যগ্রহণ হয়ে দুনিয়ায় ঘন অন্ধকার নেমে আসে।
আম্মা সূর্যগ্রহণের পুরো সময় নফল নামাজ পড়ে পার
করেন। কেউ কেউ বললেন, এই সূর্যগ্রহণের কারণে পা এমন খুড়া হয়েছে। মাও
তা কিছুটা বিশ্বাস করতেন গভীর অনুশোচনায়। ভাবতেন
সেদিন যদি খুড়া হয়ে বসে নামাজ না পড়তেন তবে হয়ত তাঁর প্রিয়পুত্রের পা টা এমন খুড়া
হত না। চিকিৎসকের পরামর্শে মা
সর্বদা ঘুমের মধ্যে আমার
পা টেনে শক্ত করে ম্যাসেজ করতেন। রাতের
পর রাত আমার খোড়া ডান পা ম্যাসেজ করা মায়ের অভ্যাসে পরিণত হয়।
শৈশবে আব্বা
উচ্চস্বরে কোরান তেলাওত করতেন, আমি ও ছোটবোন
মান্না তখন তার কোলে বসে চা মুড়ি খেয়ে খেয়ে জিকির করতাম। বোন
মান্নার অনবরত প্রার্থনা করতেন- হে আল্লাহ
আমার ছোটভাইয়ের আতুর পাখানটা ভাল করে দাও।
আমার
ল্যাংড়া ডানপায়ের আরেকটি গল্প আছে। গৃহকর্মী তসব্বির আলী
একদিন আমাকে কোলে করে সামনের ঠিকাদার বাড়িতে নিয়ে
একটি চেয়ারে বসায় ও পাশের চেয়ারে আমার বয়সী একজন মেয়ে শিশুকে বসানো হয়। বাড়ির লোকজন জমে গিয়ে আমরা দুই শিশুর পা পর্যবেক্ষণ করে
বেশ ফুর্তি করেন। দেখলাম আমি কেবল ডানপায়ের
উল্টো পিঠে ভরকরে হাঁটি, আর এই
মেয়েটি দুই পায়েই অনুরূপ হাঁটে।
মেয়েটির জন্য মনে মনে দুঃখ পাই, ভাবি আমার
এক পায়ে দোষ অথচ এই মেয়েটির যে দুই পা-ই তাই। তা দেখে
অবশ্য মনঃকষ্ট খানিকটা লাঘবও হয়। বড় হয়ে দুঃখের সাথে দেখলাম আমার ডান পাটি
আল্লার রহমতে পুরাপুরি ভাল হয়ে গেলেও নেহার বেগম নামের এই উচ্ছল সুন্দরী মেয়েটির দুপায়ের
একবিন্দুও উন্নতি হয় নি।
আর আমার চাচাত
ভাই ডাঃ এন এ চৌধুরী গোলামনবি বলতেন এই পা নিয়ে এত চিন্তা করার
কি আছে, মধ্যযুগের মধ্যএসিয়ার নৃশংস যুদ্ধা ও শাসক তৈমুর লঙ্গের পাও খুড়া ছিল।
লঙ শব্দের অর্থই হল ল্যাংড়া। এই ল্যাংড়া পা তার অগ্রযাত্রা কখনও ঠেকাতে পারে নি।
তবে তিনি যাই বলুন না কেন তৈমুর (লঙ) ল্যাংড়াকে তার নিষ্ঠুরতার
জন্য আমি কখনো ভাল মানুষ হিসাবে মেনে নিতে পারি নি। তিনি যেদিকে যেতেন
সেদিকে কেবল ধবংস ও মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়াতেন।
আল্লাহর
অপার মেহেরবানিতে বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার ল্যাংড়া পাটি ধীরে ধীরে ভাল হতে থাকে।
একসময় এই পা টি এমনই ভাল হয়ে গেল যে কারও বুঝার উপায়ই রলো না
আমার ডান পা ল্যাংড়া। এখন পৃথিবীর
কেউই জানে না ইসফাক কুরেশির ডান পা
একদা একদম খোঁড়া ছিল।
একদিন রাতে আমার চেয়ে তিন বছরে বড়বোন আনিছা কুরেশি মান্নার
প্রচন্ড জ্বর হয়। দিনে পশু ডাক্তার এসে আমাদের পোষা গরুদের চিকিৎসা করে যায়। চিকিৎসক লোহার পাত
গরম করে গরুর পচা চামড়ায় ও পায়ের খুরায় দাগা দেয়। বোনের রোগ সরাতে আমি রাতে
একটি চা চামচ বাতির আগুনে গরম করে এনে বোনের পিঠে অনুরূপ একটা
দাগা দেই। বেশ ক্ষত হয়, তিনি যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠেন। ঘা শুকাতে বেশ কিছুদিন লেগে যায় এবং এই ঘায়ের দাগ এখনও তার পিঠে রয়ে
গেছে।
তখনকার আমলে
বাজারে তেমন শিশুদুগ্ধ ছিল না, তাই মায়ের দুধই ছিল শিশুদের প্রধান ভরসা। খোড়া ডানপায়ের জন্য হাঁটতে
দেরি হওয়ায় মায়ের কোলে আমি অন্য শিশুদের তুলনায়
বেশি দিন অবস্থান করি। মাতৃদুগ্ধ
ছাড়ার স্মৃতি আপনাদের না থাকলেও আমার কিছুটা আছে। মনে
পড়ে মাতৃদুগ্ধ ছাড়ার বয়স পার হলেও আমি নাছুড়বান্দা।
মায়ের ধারনা, দুই বছর পার হওয়া বড়শিশুর মাতৃদুগ্ধ পানকরা হারাম। আমি কিছুতেই মাতৃদুগ্ধপান ছাড়তে
রাজী না হওয়ায় আমাকে দুগ্ধপান ছাড়াতে মা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিম ও ভাটফুলের পাতা পিষে লাগান। ভাটপাতার
তীব্র তিতা আমাকে মাতৃদুগ্ধ ছাড়তে বাধ্য করে।
মা সারাদিন নামাজ পড়তেন, তিনি সেজদায় গেলে তার পিঠে চড়ে বসে খুব আনন্দ পেতাম।
আমাদের প্রাচীন বাড়িটিকে সবাই একনামে ডাকে, পূর্বচৌধুরীবাড়ি। মূল বাড়িটি ছত্রিশ বিঘা, উত্তরের গড়েরমাঝসহ মোঠ আয়তন বিয়াল্লিশ বিঘা। আমার বড় দুই
চাচা তৈয়বুর রহমান এবং মুহিবুর রহমান সপরিবারে আমার জন্মের অনেক আগে আলাদা ঘরে চলে যান। এই বড় বাড়ির উত্তরদিকের দুই অংশ তাদের ভাগে পড়ে। আব্বাসহ
ছোট তিন ভাই খলিলুর রহমান ও মখলিসুর রহমান আমার জন্মের বছরে ১৯৬৫ সালে আলাদা হন। আব্বা
সবার ছোট, তাই পান তার পিতার ভিটা। বাড়িটার
ঠিক মাঝখানে আমাদের ভিটের অবস্থান ও আমাদের মালিকানায় বাড়িতে
জায়গার পরিমাণ গড়েরমাঝসহ নয় বিঘা।
আব্বার কাছে
শুনেছি আমাদের প্রাচীন জমিদারী আমলের বড় ঘরটিতে নাশকতাকারীরা এক অন্ধকার রাতে আগুন
ধরিয়ে দেয়। অমাবশ্যা রাতে দাউদাউ করে খড়ঘরসহ সারাবাড়ি
জ্বলে উঠে। তারপর নতুনভাবে আবার বাড়িঘর সাজাতে হয়। আমাদের বাড়িটার সামনা পূর্বমুখী,
বাড়ির সামনে ছিল জমিদারী আমলের বিরাট বাংলোঘর। ছনে ছাওয়া ছাদ। ছনের ছাদ ছিল
প্রাকৃতিক তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও আভিজাত্যের নিশানা। এই
বাংলোটা মাইলদেড়েক দূরের দড়াগ্রাম ও মদনগৌরি হতে দৃষ্টিগোচর হত।
আমার জন্মের
মাত্র আট নয় বৎসর আগে ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে তার নেতৃত্বে সামন্তযুগের
অবসান হয়। শেষ হয় বহুযুগের ভূমিপ্রভু ব্যবস্থা,
তাই এই বড় বাংলোঘরে এখন পাইক পেয়াদা
নেই, খাজনা অফিস নেই, নেই বহুযুগের ব্যস্ততা। আব্বার কাছে শুনেছি জমিদারী আমলের শেষ হিসাব কর্মকর্তা ছিলেন তুরুকখলা গ্রামের মছদ্দর মাস্টার সাহেব। সামন্তযুগের
শেষ চিহ্ন এই বাংলোটায় তখন অবস্থান করতেন আমার বিপত্নীক কালিমাটির
চাচা মখলিসুর রহমান চৌধুরী, যিনি মহাত্মা গান্ধির
বৃটিশ বিরোধী চাকুরি ছাড়ো আন্দোলনের ডাকে শরিক হয়ে চাকুরি ছেড়ে ভারতের কালিমাটি হতে বাড়ি ফিরেন। তার
সাথে বাড়ির বাংলোয় দু’চারজন
ছাত্র, হুজুর ও কয়েকজন চাচাতো ও ফুফুতো ভাই রাত্রে ঘুমাতেন। চাচাতো রেশাদ
ভাই ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিতেন এবং ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরে পায়চারী করে আবার বিছানায় শোয়ে পড়তেন। আন্যরা তাঁর এই ঘুমকান্ড দেখতে পেলেও তিনি ঘুম ভাঙ্গার পর কিছুই বলতে পারতেন না। অনেক তাবিজ কবচ
করার পর তিনি ভাল হন।
জমিদারী অফিস বন্ধ হলেও বড়বাংলোয় সারাদিন চলতো তাস, দাবা, পাশা ও ক্যারম খেলা। সামনের দিঘিতে ছিল ভাসমান ঘাসিয়ারা নৌকা। মাঝেমধ্যে
আমরা দলবেঁধে নৌকা চড়তাম। দিঘিতে
সারাদিন মানুষ গোসল করতো। সামনের দক্ষিণ দিকের
খালপারে ছিল হলুদবর্ণের পাকা ল্যাট্রিন,
যার ছিল না কোন ছাদ। এই বাড়িতে জমিদারী আমলে বেশ কয়েক ঘর মানুষের বসবাস ছিল, তারা গ্রামের পুর্বদিকে বাড়িঘর নির্মাণ করে খোলামেলা জায়গায় চলে যান। আম্মার কাছে শুনেছি, আমি
যে পাকা টিনের ঘরে জন্মগ্রহণ করে
বেড়ে উঠি, তা আমার জন্মের বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করা হয়।
বাড়ির
সামনের দিঘিপার জুড়ে ছিল বিরাট শনখিত্তা। এখানে এত ঘন শন হত যে লোকজন ভিতরে ঢুকতে পারত না। এই শনবনে বাস করত শিয়াল ও বনবিড়াল। পোষা হাঁস-মোরগ চুরি করে শিয়াল ও টলারা এখানে অনায়াসে লুকিয়ে
যেত। বসন্তের আগমনে বেগুনী শনফুলে দিঘিপার রঙ্গিন
হয়ে যেত। এই শনে বাড়ির বড়বাংলো, গোয়ালঘর ও পাকঘরের ছাদ ছাওয়া হত।
পরবর্তীকালে শনের চাহিদা কমে গেলে এই সুন্দর শনের বন কমে কমে
নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। সেইসাথে প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশন শনের ঘরও ধিরে ধিরে বাড়ি হতে বিদায় নেয়।
বাড়ির বাংলো
ও দিঘির মধ্যভাগের জমি শীতকালে রবিশস্যে ভরে যেত। সরিষা,
লাই, চুকাই, আলু, কপি, দেড়েশ কিছুই বাদ পড়ত না।
ঝিঙ্গা, ছিছিঙ্গা, শিম, কদু ও কুমড়াফুলে টঙ্গীর সামনের প্রান্তর অপরূপ হয়ে যেত। আমরা বড়পুকুরের পানি বালতি দিয়ে এনে শস্যক্ষেতে দিতাম। একাজে আমরা বেশ আনন্দ পেতাম। বাড়ির বাহির দিকে
গরুঘর ছিল, পাশে থাকত গোখাবার শুকনো খড়ের
ঘর। চাপাচাপি করে খড় খুব ঘনীভূত ও শক্তকারে রাখা হয়। আমাদের
সাত আটটা গাভী ও ষাড় ছিল। গোধনসেবা ও কৃষিকাজের
জন্য দুইতিন জন লোক সব সময় নিয়োজিত থাকতেন। বাড়ির বাচ্চাদের
সাথে খড়ের ঘরে ঢুকে লুকোচুরি খেলা আমাকে বাল্যকালে বেশ
আনন্দ দিত।
বহিরবাড়ির
বিবরণ দিলাম, এবার অন্দরের বর্ণনা
দেব। ভিতর বাড়িতে বিপত্নীক কালিমাটির চাচা মখলিসুর রহমানকে
বাদ দিয়ে বাপচাচারা পাঁচজনের
চার ঘরে চার পরিবার। প্রতি ঘরের বহিরে আলাদা পাকঘর। কেবল
আমাদের টিনের পাকা বড়ঘর, অন্য সবঘর সেমিপাকা টিনের। তখনকার যুগের তুলনায় ঘরগুলো ছিল অভিজাত। দাদাদাদিকে পাই নি, আমার
ভাইবোন কেউই তাঁদেরকে দেখেন নি।
তবে চাচা ও চাচি সবাইকে দেখার ও তাদের স্নেহমমতা পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়। রেশাদ
ভাই ও রেজা ভাই আমাকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াতেন। আজ তারা সবাই
পরজগতের বাসিন্দা, মহান আল্লাহপাক তাদেরকে জান্নাত দান করুন।
বাড়িতে লায়ন নামের একটি পোষা কুকুর
ছিল, কুকুরটিকে লায়ন, লায়ন নামে ডাক দিলে
পিছুপিছু দৌড়াতো। প্রতি পরিবারের মোরগ হাঁসের
ছোটঘর ও গরুঘর ছিল। কথ্যভাষায় মোরগের ঘরকে কুট্টি ও
গরুঘরকে গোশালা বলা হত। প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায়
আমরা হাঁস-মোরগদেরে ধানের ভিজে
তোষ, ভাতকূড়ে ইত্যাদি খাবার
দিতাম। বাড়িতে তখন তেলাপোকার উপদ্রপ ছিল। ডেগচিতে ধানের তুষ
বিজায়ে গোদামে রেখে দিলে রাতে প্রচুর তেলাপোকা পড়ে পানিতে আটকা পড়ত। মোরগরা এই
তেলাপোকা খুব মজা করে খেত। মোরগের কচি বাচ্চাদের আদর করতে গিয়ে
শিশু আমি অনেকদিন মোরগীর আক্রমণের
শিকার হয়ে আহত শরীরে কান্নাকাটি করে বাড়ি মাত করেছি।
মাতৃস্নেহে মা মোরগী অকুতভয়
সাহসিনী হয়ে যেত, দেখতাম বাচ্চাদের উপর
বিপদ এলে চিল, বেঁজী এমন কি শেয়ালের
উপরও মা মোরগী ঝাঁপিয়ে পড়ত।
মানবশিশু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া তো কোন ব্যাপারই না। আমি দেখে দুঃখ পেতাম, মুরগী অতি আদরে বাচ্চা পুষতো, বাচ্চাগুলো বড় হলে, আবার ডিম পাড়ার সময় এলে নিজ সন্থানদেরে নির্দয়ভাবে মারধর করে এই তাড়িয়ে দিত।
খুবভোরে মোরগা উচ্চস্বরে কুকুরুক্কু কুকুরুক্কু ডাক দিত, সেই ডাকে সবার ভোরে ঘুম ভাঙ্গতো। মোরগের ছোট্ট সুন্দর ঘরটাকে বলা হত কুট্টিঘর। সকালে মোরগ ঘরের দরজা খোলামাত্র একসাথে সব মোরগ বেরিয়ে আসত। বড় মোরগাটা কুট্টি হতে বের হয়েই মোরগীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমি ভাবতাম বড় মোরগাটা বড়দুষ্ট ও শয়তান, অযথাই মোরগীদের উপর চড়ে বসে, মারধর করে। মাঝে মধ্যে মোরগীর উপর হতে কামরত বড় মোরগাটাকে পাকড়াও করে ধরে এনে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে তার অপরাধের শাস্তি দিতাম।
আরও বড় হয়ে
যখন দেখলাম আমাদের পোষা গাভীটারও একই অসহায় অবস্থা, মোঠা
ষাড়রা তাড়া করে ওর উপরে উঠে অন্যায়ভাবে ধাক্কা মারছে, অত্যাচার
করছে। আমি গাভীকে বলদের কবল থেকে
বাঁচাতে বলদের গায়ে সজুরে বেত্রাঘাত করলে
আমাদের গরুর রাখাল তছব্বির আলী ইশারা দিলেন এটা পশুপাখির কোন অন্যায় আচরণ
নয়, এটা তাদের জৈবিক ব্যাপার স্যাপার মাত্র, আর বুঝালেন
একাজ না হলে তাদের বাচ্চা জন্মায় না। এভাবে ধীরে
ধীরে এই জটিল বিষয়টা বাল্যকালে আমার বোধগম্য
হয়, সেইসাথে পশুপাখির যৌন আচরণ
দেখে দেখে মানুষের যৌনজীবনের ধারণাও আমার চিন্তাজগতে অনুপ্রবেশ
করে।
বাড়ির ছাদে
জালালি পায়রা বাসা বাঁধতো,
সময়ে সময়ে বাকুম বাকুম সূরের লহরি তূলতো। প্রতি
ঘরের বারান্দায় ছিল ফুলবাগান। আমাদের বাগানে সব সময় নানাজাতের গেন্ডা, নয়নতারা,
মুরগার চুটি, জবা, গন্ধরাজ, বেলী, হাসনাহেনা, গোলাপ,
গাঁদা ইত্যাদি ফুল ফুটতো। আমার
কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল হেমন্তকাল, এসময় বেশ কয়েকজন
বুয়া ও কৃষিকর্মী আমাদের কাজে যোগদান করে বাড়ির আঙিনা ও পাকঘর
লেপে পরিস্কার করতেন। চার ঘরের চার আঙিনা ঘাসহীন করে মাটিলেপা করা হত।
চারপাশে বিরাজ করতো নয়নতারা, অফিসটাইম, গাদাফুলের
হলুদ আর মোরগারচুটি ফুলের লাল হাসি।
অগ্রাহায়ণের
প্রথমদিন ভোলাভোলির আনন্দ উৎসব হত। অচিরেই শুরু হবে শস্যতুলার কঠিন কর্মযজ্ঞ। তাই অলসতা সরায়ে গাঝাড়া দিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাই কলাপাতার লাটি, নরম ঝাড়ু, শনের কাটি ইত্যাদি
দিয়ে একে অন্যকে প্রহার করে আলসেমি বিতাড়ন করা হত। দেবর ভাবীকে, ভাবী দেবরকে,
বেয়াই বেয়াইনকে, শালী দোলাভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে, বান্ধবী বান্ধবীকে গোপনে কিংবা
প্রকাশ্যে আনন্দ আঘাত করতেন। বিকাল হতে রাত পর্যন্ত আলস্য নিধনের এই আনন্দ উৎসব
চলতো। সারা গ্রাম আনন্দ মেতে উঠতো। কলার
পাতার রসে কাপড় নষ্ট হত। আমরাও ভোলাভোলির নিস্পাপ আনন্দ উৎসবের এইদিন মহানন্দে পার
করতাম। কোন এক ভোলাভোলির দিনে আমাদের পাশের বাড়ির ফকির আলীর কন্যাকে রং ডং করে তার
এক বোকা দেবর শক্ত লাটি দিয়ে আঘাত করে বসে। মেয়েটি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে
বেশ কিছুদিন হাসপাতালে গড়াগড়ি করে অবশেষে মারা যায়।
হেমন্তকালে
ধান্যকাটা শুরু হলে বাড়িতে বেশকজন নারী ও পুরুষ কাজ করতেন। তাঁরা মাঠে গান গেয়ে গেয়ে ধান কাটতেন, আটি বেঁধে বেতের শিকায় ভরে শিকা বাংগে সারি বেঁধে বয়ে নিয়ে আসতেন। বাঁশের বাংগের দুইপ্রান্তে দুই শিকায় ধানের আটি ঝুলে থাকত। তারা দুপুরে এখানে খাবার
খেতেন এক ধরনের টিনের প্লেটে ও জলপান করতেন এল্যুমিনিয়ামের গ্লাসে। এধরণের বাসন এখন আর দেখা যায়না। ধান কেটে এনে
আঙ্গিনার কোনে কোনে আটি আটি করে
সাজানো হত, প্রতিটি ধান্যস্তূপকে আমরা বলতাম ধানের পারা। উঠোনে উচু উচু
অনেকগুলো ধানের পারা তৈরি হয়ে যেত।
বিকালে
ধানমাড়াই শুরু হত। ধানের আটি ভেঙ্গে এলোমেলো করে
স্তূপাকারে আঙ্গিনায় ফেলা হত। কয়েকটি গরু বৃত্তাকারে এই ধানের উপর হাঁটতো,
ফলে ধান বৃন্তচ্যুত হয়ে নিচে জামা হত। একজন লোক বাশের উকইন নামক আংটার সাহায্যে
ধান নড়াচাড়া করতেন। ধান মাড়াইয়ের গরু চরানো বাল্যকালে
আমার শখের কাজ ছিল। গোকর্মীদের সাথে আমিও
গরুদের পিছন পিছন হাঁটতাম। মাঝে মাঝে ক্লান্ত গরু আমাকে
লাতি মেরে দিত। আমি তখন রেগে গিয়ে গরুকে বেতের পিটুনী দিতাম। তখনকার যুগে গাঁয়ে বিদ্যুৎ ছিল না।
হ্যারিকেন ও মশাল জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত মাড়াইকাজ চলত।
প্রতিরাতে উঠোনে একসাথে তিন চারটি মাড়াইকর্ম অনুষ্ঠিত
হত।
মাড়াইকাজ
চলাকালে আমাদের পাশের বাড়ির ইস্রাইল আলী ভাই রজকিনী-চন্ডিদাস ও কাঞ্চনমালার গান গাইতেন। অনেক মানুষ
পান চিবিয়ে হুঁকা টেনেটেনে গানের মজলিশ
জমিয়ে রাখতেন, তাঁরা ইস্রায়েইল ভাইয়ের সাথে
গানে গলা মেলাতেন, সুর তুলতেন। ইস্রাইল ভাই ছিলেন খুব হাসিখুশি
লোক। তিনি ও সেফাক মিয়া, ওগো মান্না মাইঝি বলে আমরা ভাইবোনকে আদর করতেন, সেই ডাক
আজও কানে বাজে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুণ।
বাড়িতে এসময় ইদুরের উপদ্রপ হত। ধানের পারার নিচে ইদুর গর্ত করে ধানের শীষ টেনে মাটির নীচে নিয়ে যেত। নানাধরনের ফাঁদ বসিয়ে তাতে ইদুরের খাবার রাখা হত, ইদুররা খেতে এসে ধরা পড়তো। মাঝে মাঝে ইদুরের গর্তে বিষও ঢেলে দেয়া হত। ইদুরের গর্তে বালতি বালতি পানি ঢেলেও ইদুর মারা হত। বড়ফাঁদে বনবিড়াল, বেজী ঢুকে যেত এবং চিকাও ধরা পরতো। শীত ও বসন্তকালে ঘরের কোনের বাগানবিলাস ফুটে উঠোন রঙিন হয়ে যেত। এসময় কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পরিজাত, রাধাচূড়া ও যতসব মধুফলবৃক্ষে ফুল ফুটে সারা বাড়ি অপরূপ হয়ে যেত। প্রতিটি আম কাটাল লিচু বৃক্ষ হতে ভ্রমরের গুণগুণ গুঞ্জন বের হত। বসন্ত ফুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াতো।
শীতকালে হলুদগাদা, মোরগার চুটি, কলাফুল, অফিসটাইম ফুটে স্বর্গীয় শোভা বিতরণ করত। বারমাস বাগানে জবা, গন্ধরাজ, গোলাপ, হাসনাহেনা, রঙ্গন ইত্যাদি ফুল শোভা ছড়াত। শীতে রবিশস্যে বাড়ি ভরে যেত। রবিশস্যের ফল ও ফুলের মেলা ছিল অপরূপ। বাড়িতে প্রচুর বরই গাছ ছিল। আমরা কোল পেড়ে বাশের ঘুটনিতে পুরে বাখরপাতা, লবণ, মরিচ ও শর্সের তৈল মিশিয়ে ঘুটে খেতাম। সেই বরই চাটনীর স্বাদ মনে হলে এখন জীবে জল জমে যায়।
এসময় সুপারি তুলা হত। ছোট ছোট ছেলেরা সুপারি পাড়ত। অগ্রহায়ণ মাসে পাকা সুপারি পাড়তে আমিও খেলাচ্ছলে বেয়ে বেয়ে গাছের মাথায় উঠতাম, একগাছের সুপারি নিচে ফেলে একদিকে একটু দোল দিলে গাছটি বাকা হয়ে অন্যগাছের কাছে চলে যেত। তখন টারজানের মত লাফদিয়ে অন্যগাছে গিয়ে সুপারি কুড়াতাম। এভাবে একের পর এক গাছের সুপারি নিচে ফেলে ক্লান্ত হয়ে নেমে আসতাম। আমার মা ও গৃহকর্মীরা তখন নিচে এসে সুপারি কুড়িয়ে টুকরি ভরে ফেলতেন। গাঁয়ের মহিলারা এসে সুপারি কেটে বনলতায় মালার মত ছড়া গেঁথে গৃহছাদের টিনের চূড়ায় রেখে শুকানো হত। আমাদের এত বেশি সুপারি হত যে ঘরের ভিতর বাশের ছাদটি সুপারিতে পরিপুর্ণ হয়ে যেত। আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে এলে সুপারীবাগান আবহেলার শিকার হয়, নতুন চারা লাগানো হয়নি। আমাদের নিদানকালের বর সুপারীবাগান এখন পতনকাল পারি দিচ্ছে।
গাছে সুপারি পেঁকে লাল হলে রাতে চুরি হয়ে যেত। একবার অতীষ্ঠ হয়ে ফরহাদ ভাই সুপারিগাছে ধারালো ব্লেড গেঁথে দেন। রাতে চুরি করতে এসে পাশের বাড়ির এক যুবক আহত হয়ে সুপারিকাঁদি ফেলে পালিয়ে যায়। ফোটা ফোটা রক্ত অনুসরণ করে চোরের ঘরে পৌছা সম্ভব হয়। সে আজ নেই, তাই নামটা গোপনই থাক। গরিব মানুষ, তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে এসব করত। মহান আল্লাহ পাক তাঁদেরকে ক্ষমা করুন। একটি লিচুগাছে সুমিষ্ট লিচু ধরত। এই লিচুতে গোলাপের খুশবু ছিল। রাজশাহির লিচু অবশ্যই হার মানবে। কাকতাড়ুয়া টাঙ্গিয়ে জাল বেঁধে বাদুরের হাত থেকে খুব কষ্টে এই মজার লিচু রক্ষা করা হত। ২০১৩ সালে আম্মার মৃত্যুর পর তাঁর শখের এই লিচুগাছ মারা যায়। ময়নাতদন্ত করে দেখি মুলগুচ্ছের উপর প্রচুর মাটি ফেলার কারণে এই বুড়ো লিচুগাছ ও পাশের স্বর্ণফলা একটি কাটালগাছ অকালে প্রাণ হারায়।
মলিপুকুরের পারে ছিল দুইটি সুউচ্চ নারকেল গাছ। আব্বা সফিক চৌধুরী বলতেন আমার মাইয়ের হাতে লাগানো গাছ। ছোট্টকালে আব্বা তাঁর মাকে হারালেও দাদি নজিবা খাতুনের লাগানো এই দুই গাছের প্রতি তার বিশেষ মায়ামমতা ছিল। মাতৃস্মৃতি এই দুই নারকেল গাছের মূলে আব্বা সর্বদা কচুরিপানা ও গোবর দিতেন। গাছ দুইটিতে এত নারিকেল হত যে পাড়া হলে ঘরের চৌকি ও পালঙ্কের তলা ভরে যেত। ২০০৮ সালে আব্বার চিরবিদায়ের পর যত্নাভাবে শতায়ু এই দুই নারকেল গাছও ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে।
ভোরে দাউদপুর পূর্বচৌধুরীবাড়ির পশ্চিমবনে কোকিল, ঘুঘু, কাটঠোকরা, ময়না, চিল থেমে থেমে গান গাইতো। আমি পাখির গান শুনতে ভোরে মলিপুকুরের ঘাটে মৌন ধ্যানে বসে যেতাম। চড়ুই শনের ছাদের ভিতর খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধতো এবং সারাক্ষণ কিচির মিচির করতো। সারারাত লক্ষিপেচা একটানা ভুতুম ভুতুম করে ডেকে যেত। ছাদে বাসাবুনো জালালি কবুতর বাকুম বাকুম করে উড়োউড়ি করোট। শীতকালে পরিজাত পাখিরা দলবেঁধে বাড়ির উপর দিয়ে আকাশে দুই সরলরেখার অগ্রে কোন তৈরি করে দক্ষিণের হাকালুকি হাওরের পানে উড়ে যেত। শীতশেষে উত্তর দিকে আকাশছেয়ে তাঁদের উল্টো যাত্রাও দেখা যেত।
দোয়াং নামে পাখি ধরার একধরনের ফাঁদ ছিল। দোয়াঙ্গে আটা লাগিয়ে বাঁশের আগায় উঁইপোকা গ্যাথে পাখিবনে রাখা হত। নানা বর্ণের সুন্দর সুন্দর পাখি এই ফাঁদে ধরা পড়ত। আমি শৈশব হতে পশুপাখী প্রেমিক। লোকেরা এভাবে পাখি ধরলে আমি দুঃখ পেতাম। কেউ এয়ারগান নিয়ে এসে পাখি মারতে চাইলে তাড়িয়ে দিতাম। শৈশবে বড়পুকুরের পারে একবার জালের সাহায্যে শিখারীকে পাখি দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখি।
শীতের শেষে আমাদের জলা জমি সেচে টুকরি ভরে ভরে মাছ আসত। বেশি ধরা হত চিংড়ি, টাকি, চান্দু ও পুটি
মাছ। চান্দু পিষে কাবাব (বড়া) এবং টাকি মাছ
পুড়ে লাইপাতা কুচে ভর্তা তৈরি করা হত। উঠোন জুড়ে ডাম-ধাড়া
পেতে মাছ শুকানো হত। গ্রামের নারীরা দলবেঁধে মাছ বানাতো,
বাঁশের খলই ভরে ভরে তারা মাছ নিয়ে যেত। এত মাছ হত যে এসময়
আমরা ভাতের বদলে কেবল মাছই আহার করতাম। এখন আর
এসব জলায় এত মাছ হয় না, অথবা চুরি হয়ে যায়।
তিন চাচার বসতঘর পশ্চিম ভিটায়, কেবল আমরা ছিলাম পূর্বভিটায়। মাঝে বড় আঙ্গিনা পার হয়ে পশ্চিমভিটায় ছিল আমাদের পাকঘর। দুইটি মাটিলেপা লাকড়ির চুল্লি, মাটি ও পিতলের কলসি, একটি খাবার চৌকি, পিঠার হাড়ি, কাজের মানুষের জন্য কয়েকটি পিড়ি, বাশের খলই, ধূছইন, ধঝি, চুলোয় ফুঁ দেওয়ার চোঙ্গা, ধানচাল ভানার ঘাইল ছিয়া, মশলাবাটার পাটা পুতাইল, রূটি তৈরির ত্রিপায়া ও বেলাইন, ডালের ঘুটনি, কেরাসিন বাতি, বাঁশের ডেগধানী, দা, ছুরি, বটনি, খুরছইন, জ্বালানী কাটবাঁশের গোদাম এসব নিয়েই ছিল সেই পাকশালা, সিলেটী কথ্যভাষায় এই পাকশালাকে সবাই বলতেন ‘উন্ধাল’। সিলেটি অঞ্চলিক গানে পাকঘর এসেছে এভাবে- ‘কন্যার মায় কান্দন করইন উন্ধালে বসিয়া/ আমার এত মায়ার ফুড়িরে কেমনে দিতাম বিয়া’। বিয়াল্লিশ বিঘা আয়তনের বাড়িতে গাছের অভাব নেই। একবার লাকড়ি করা হলে তিন চার মাস চলে যেত। চুল্লিতে আগুন জ্বালানো কঠিন কাজ ছিল। তবে প্রায়ই কেরসিন ঢেলে দাদাম্যাচের কাটি মেরে আগুন জ্বালানো হত।
একবার
সন্ধ্যার অন্ধকারে বড়বোন রেহা এবং সেহা উন্ধাল ঘরে কাজ
করছিলেন। চাচাত মতিভাই অন্ধকারে ছাদে ডিল ছুড়ে তাদেরকে ভয় দেখান। তারা দুইবোন ভয়ে
জড়সড় হয়ে যান। এমন সময় আর ভয় দেখাতে মতিভাই উত্তরের দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে
কঞ্চি ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া
দেন। তারা ভুতের কান্ড মনে করে সে রাতে
চিৎকার দিয়ে বাড়ির লোকজন জড় করে
ফেলেন।
ধানের
গোদামঘরের নাম ছিল উগার, ইদুরের যন্ত্রণায় ফ্লোর লেবেলের
তিনচার ফুট উপরে মাচাং তৈরি করে
নির্মিত ধানের গোদামকে বলা হত ‘উগার’ ও
উগারের তলায় থাকত দরকারি মালামাল
রাখার স্থান। এঘরে থাকত বাঁশের ডাম, ধাড়া, টুকরি,
কুলা, ডালা, বাঁশের চালনি, কুদাল, কুড়াল, খুন্তি, কাচি, বরশি,
লাঙল, জোয়াল, কুচা, পাটবস্তা, মাছধরার ত্রিকোণ
জাল, বাঁশের ফলো, কাখরাইন, মই ইত্যাদি।
বাড়িতে
আসংখ্য আমগাছ ছিল। এই আমগাছদের প্রত্যেকের এক একটি নাম ছিল- মালদহি,
লাম্বু, কদু, ঝুফাইয়া, শরবতি, চারা ইত্যাদি। প্রতিটি গাছের
আমের আকৃতি ও স্বাদ ছিল আলাদা।
মধুমাসে এত আম, জাম, লিচু, পেয়ারা হত যে সারা গ্রামের লোক খেয়েও কমতি হতনা।
মধুমাসে যখন প্রচন্ড গরম পড়তো, তখন প্রবল ঝড়-তুফান
হত, সেইসাথে ঘূর্ণীবায়ু বৃষ্টিধারা ও বরফশিলা বর্ষণ
হত। বৃক্ষগুলো এপাশ ওপাশ প্রবল দোল খেত। সুপারি গাছ ঝড়ে এমনি হেলে যেত
যে মনে হত ভেঙ্গে পড়বে। ঝড় শেষ হলে প্রায়ই দেখা যেত দুই একটা সুপারী গাছ দ্বিখন্ড
হয়ে পল্লবযুক্ত আগা মাটি ছুঁয়ে আছে। এমন সব
ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর ধূম পড়ত, বৃষ্টিতে
ভিজে আমরা আম কুড়িয়ে টুকরির পর টুকরি ভরে ফেলতাম। ঝড়ের
ঝাঁপটায় ভ্যাপসা গরম চলে যেত এবং নেমে আসত প্রশান্তির শীতলতা।
গ্রীষ্ম ও
বর্ষায় ছাতিম ও কদম্ব ফুলের সুগন্ধে বাড়ি মৌ মৌ করত।
বর্ষায় বাড়ির চারপাশ জলে থৈ থৈ করত। সোনাব্যাঙ
পানিতে একে অন্যের কোমর জড়িয়ে ধরে পপ পপ, পপ পপ করে ডাকাডাকি করত। পানিতে
হলুদ কালো ডুরাকাটা ধুড়াসাপ সাঁতার কাটত। এই সাপ
ছিল নির্বিষ, তবে ব্যাঙ ও মাছ ধরে খেত। খালপারে দাঁড়িয়ে দেখতাম ব্যাঙরা
ধুড়াসাপের শিকারে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে
গলা ফুলিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফে ফে করে ভয়ার্ত চিৎকার
দিচ্ছে। বড় সোনাব্যাঙ কামড়ে ধরে মাঝে মাঝে সাপের বিপদ হত।
পেঠ ফুলায়ে সাপের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিত আক্রান্ত ব্যাঙ। সোনাব্যাঙের হাতে
ধুড়াসাপের এই নাস্থানাবুদ অবস্থার বিবরণ শুনি লোককবি কারি আমির উদ্দিনের গানে,
‘তোমরা শুনছনি খবর, ঘাড়ু ব্যাঙের পেঠের ভিতর থাকে অজগর’।
জলে আঘাত
দিলে যেমন ঝুপ ঝুপ শব্দ হয় অনুরূপ মধুর শব্দে গান গাইত বর্ষায়
ডাহুকেরা। সিলেটে ডাহুকের নাম কুড়াপাখি। আমাদের
স্ববংশীয় পশ্চিমবাড়ির আবুল হাসান চাচা তখন হাওরের জলে বড়নৌকা ভাসিয়ে
তার শিকারী পোষা কূড়াপাখি নিয়ে কয়েক দিনের জন্য সাঙ্গপাঙ্গসহ ডাহুক শিকারে উদাও হয়ে যেতেন।
আমাদের বাপ চাচারাও কুড়া শিকারে মাঝে মাঝে তার সাথি হতেন।
আমরা বাড়ির পাশে জলমগ্ন জমিতে কলার ভেলা বানিয়ে চড়তাম। জমির কোনে তৈরি করা খাঞ্জা (ছোট গর্ত) সেচে গরমের দুপুরে রোজ রোজ মাছ ধরতাম। তছব্বির আলী কাক্রাইন কিংবা ত্রিকোণজাল দিয়ে জলবহা নালা হতে প্রচুর মাছ ধরে নিয়ে আসতেন। বাংলাদেশে জন্মে এমন সব ফল যেমন আম কাঠাল লিচু তেতুল বেল বাতাবিলেবু আতাফল খইছড়া কাউ লুকলুকি পেয়ারা পেঁপে আনোয়ার কুল আমড়া ইত্যাদি ফলফলাদি বাড়িতে বারমাসই ফলত, একবার আমি বিদেশে অবস্থান কালে বিদেশীরা তাদের দেশে জন্মা ফল নিয়ে গর্ব করলে আমি বললাম বংলাদেশে আমার বাড়িতে এমন ফল হয় যাহা ঘর্ষণ করলে মিষ্টিস্বাদ বেড়ে যায়, যত ঘর্ষণ তত মিষ্টি। এমন ফল জন্মে যাহা মুখে দিলে প্রথমে টকস্বাদ ও পরে মিষ্টি স্বাদ বের হয়। আমাদের লুকলুকি, আমলকী ও কামরাঙ্গার এসব অদ্ভুদগুণ শোনে সেদিন বিদেশীরা অবাক হয়ে যান। আমি আরও বললাম তোমাদের ফুলে গন্ধ নেই। আমাদের দেশে ফুল ফুটলে মৌ মৌ খুসবুতে চারপাশ ভরে যায়। তখন সেই মার্কিনিরা বলল এজন্যই তো তোমাদের এই ছোট্ট দেশে মানুষের এত ভিড় জমেছে।
এখন চলে
যাবো পূর্বচৌধুরীবাড়ির পিছনের পশ্চিম এলাকায়। এই বড় বাড়ির ভিতর পাঁচটি মলি পুকুর। এসব পুকুরে মাছ খিলবিল করত এবং চৌধুরীবাড়ির মহিলাগণের পর্দার কারণে বড় পুকুরে না যেয়ে এসব পুকুরে স্নান ও ধোয়ামোছা করতেন। সামনের বড়পুকুরে গ্রামের মেয়েরা উদোম গায়ে সারাদিন গোসল করত। তাঁদের পর্দা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। বসতভিটা হতে মলিপুকুর পর্যন্ত জায়গা জুড়ে নারকেল ও সুপারি বাগান। পুকুরপারে কাটাযুক্ত লেবুবন, লেবুবনের ডালে জড়িয়ে থাকত চিকন লতার মত সবুজবরণ
পাতালতা সাপ। এই সাপ দেখতে খুবই সুন্দর,
লোকে বলত এই সবুজ সাপের বিষ আছে, কিন্তু আমি কোনদিন কাউকে এই সাপে কামড়াতে দেখিনি। উপকারী সাপ, ঘনবনের পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের উপকার করে। দাড়াস যে নির্বিষ ও উপকারী সাপ, তাও সেকালের লোকেরা জানতোনা। একটা দাড়াশ বছরে শতাধিক ইঁদুর খেয়ে কৃষকের সীমাহীন উপকার করে থাকে। অথচ লোকেরা দলবেঁধে হামলা করে বাঁশবনের দাড়াস মেরে ফেলত। শক্ত খনিজ শিলায় বাঁধানো পুকুরঘাটে বেশ বড়সড় টিকটিকির
মত ‘ইঞ্জাইল’ নামক এক ধরনের ছোট্ট সরীসৃপ সর্বদা হাঁটাহাঁটি করত।
মলিপুকুরগুলোর পশ্চিমপার বরাবর বাঁশবেত ও বৃক্ষলতার ঘন বনঝোঁপ। পাশের
ঝোঁপঝাড় হতে কিংবা পুকুরের মাঝে সাজানো কলমি শাকের ঝাড় হতে নীল
মাছরাঙ্গা উড়ে এসে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিত। বাড়ির
পশ্চিম সীমানা জুড়ে বনাবৃত গভীর খাল ও জলাবন। এই খালের পশ্চিমপার জুড়ে আমাদের স্ববংশীয় মাঝের বাড়ি, দক্ষিণ বাড়ি এবং হাফিজ বাড়ির সীমানা রয়েছে। এই বনে চাউর, কাউফল, তেতুল, কদম, ছাতিম, কেয়া, মূর্তা, মান্দার ইত্যাদি গাছের ছড়াছড়ি ছিল। পিছনের খালটি পার হলে আমাদের স্ববংশীয় দুইটি
চৌধুরীবাড়ির (মাঝের বাড়ি ও দক্ষিণের বাড়ি) দিঘিপারের ঘন ছনকিত্তা। এই বনে দিনে শিয়াল হুক্কাহুয়া ডাকতো,
সন্ধ্যায় বনবিড়াল বাউ বাউ করে হুঙ্কার দিত, এযেন ক্ষুদে বাঘের বজ্রনিনাদ।
গ্রামবাসী বলতো বাড়লের ডাক। শীতের নীরব সন্ধ্যায় বনের কাছে গিয়ে
হুক্কাহুয়া ডাক দিলে ভিতর থেকে শিয়ালেরা দলবেঁধে ডাক দিত হুক্কা হুয়া হুয়া।
এখানে বেঁজী,
দাড়াস, কেউটে, শঙ্কিনী সাপেরও দেখা মেলতো। মাঝে মাঝে সাপ মেরে কতহাত লম্বা তা মাপা হত। চাউর
গাছের চূড়ায় দুচারটা ভিন্নজাতের বৃক্ষচারী বনবিড়াল বাস
করত, লোকে এদেরে বলত টলা, লোকের মোরগ চুরি করে নিয়ে
চাউরগাছের চূড়ায় উঠে যেত। বাশবনের চাউর গাছ ছিল ওদের নিরাপদ আস্তানা। শিয়াল ও বাড়ল প্রভাত কিংবা সন্ধ্যায় মোরগহাঁস চুরি করে এই বনে ঢুকে গেলে আর খোঁজে
পাওয়া যেত না।
ভাবতে অবাক
লাগে তখনকার দিনে মানুষ দলবেঁধে আনন্দ উৎসব করে এইসব অবোধ প্রাণিগুলোকে
নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলত। এই ধরনের
হত্যাকান্ড যে অপরাধ তা মানুষের ধারণাতেই
ছিল না। তারা মনে করত যেহেতু এই প্রাণিগুলো
পোষা মোরগহাঁস চুরি করে খেয়ে ফেলে তাই ওদেরে মেরে
ফেলা উচিত। সাপবিচ্ছুর ভয়ে পিছনের বনের গভীরে কেউ ঢুকার সাহস পেতনা। এই সুযোগে পিছনের বনাবৃত খালে আস্থানা তৈরি করে জুয়াড়িরা দিনে দুপুরে নিরাপদে জুয়া খেলত। তবে মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে মারামারি
লেগে গেলে দেখা যেত মাঝপাড়ার তুতা ভাই, পুর্ব পাড়ার আলচন আলী, রফিক আলী ও চোর সমির
আলীরা লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
তুতা ভাই মাস্তান হলেও ছিলেন ভাল মানুষ। তিনি নিশাচর, তার কোমরে সব সময় প্রচুর টাকার ভান্ডিল গোঁজা থাকত।
পকেটে টাকার ভান্ডিল নিয়ে তিনি রাতে বেরাতে গ্রামেগঞ্জে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন।
তুতা ভাইয়ের কাছে চাইলেই টাকা মেলত। তার কাছ হতে আমি আগেকার নিদানের দিনে অনেক
টাকা চেয়ে আনতাম, ফিরিয়ে দিতাম বহুদিন পর। তুতা ভাই কোনদিন তার পাওনা টাকা ফেরত
চান নি, হয়ত স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে না দিলে
কোনদিন ফেরত চাইতেনও না। মনে হত চৌধুরী সাহেবকে টাকা দিয়ে তিনি যেন ধন্য হয়েছেন।
সারা তল্লাটে তুতা ভাইয়ের বন্ধু লোকজন ছিল
বেশুমার, বাজারে বন্দরে জুরে হুঙ্কার দিলেই তার পিছনে দশবার জন
লোক এসে দাঁড়াত, তাই প্রতিপক্ষ তার হুঙ্কারেই পালিয়ে যেত। আসলে তিনি আদৌ কোন
মারামারি করতেন না। বাজখাই গলায় এক হুঙ্কার মেরেই সব ঠান্ডা করে দিতেন। আল্লাহ
তুতা ভাইয়ের মঙ্গল করুণ।
বাড়ির দক্ষিণে
ছোট্টখালের উপর নির্মিত গোলাকার কালভার্ট পেরিয়ে ছিল আমাদের একটি খালিবাড়ি। ওখানে
ছিল কুকড়ানো মুকড়ানো গর্তকুঠরে ভরা একটি বিশাল বটবৃক্ষ। লোকে মনে করত এটি
দুষি বৃক্ষ, এই বৃক্ষ জ্বীনভূত
প্রেতের আস্থানা। গাছটিতে প্রচুর বটফল হত
ও ফল খেতে বুনো পাখিরা কিলবিল করত। দোয়েল ময়না শ্যামা শালিক কাটটুকরার কিচির মিচিরে বটবৃক্ষ সারাদিন মুখর থাকত। রাতে এই বটগাছে ভূতুমপ্যাচা ডাকত। একদিন
আমাদের গৃহকর্মী তসব্বির ভাই আমাকে কাঁধে বসিয়ে ঐ বটের নিচে
বসে একমনে বাশের বাঁশী বাজান। তার বাশীর সূরে মোহিত হয়ে একটি কালো দাড়াশ কাছে চলে
আসে। হঠাৎ টের পেয়ে তিনি চিৎকার দিলে মানুষ লাটি সড়কি নিয়ে সাপটিকে ঘিরে ফেলে।
মানুষের নির্মমতায় সাপটি যখন মারা যায় কয়েকজন অতি উৎসাহী
তখন মেপে দেখেন এর দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ হাত। কেউকেউ বললেন সাপটির সঙ্গী বটগাছে রয়ে গেছে, প্রতিশোধ নেবে। তাই ভয়ে মানুষ কয়েকদিন বটতলায় যায় নি।
এই খালিবাড়িতে একটি আমগাছ ছিল যে গাছে সব সময় অসংখ্য দাড়কাক থাকত, আমরা বলতাম
কাউয়ার গাছ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ও এই আমগাছে কাকেরা ঝাঁক বেঁধে
সারাদিন কা কা করত। জানিনা কাকেরা কেন এই গাছকে তাঁদের বসত হিসাবে বেছে নেয়। এই খালিবাড়িতে প্রচুর পেয়ারা, তেতুল, লেবু ও লেবইর গাছ ছিল। কিছু সৈয়দি পেয়ারাগাছ ছিল। এই পেয়ারার ভিতর লাল ও গোলাপের সুগন্ধযুক্ত।
এবার পূর্বচৌধুরীবাড়ির উত্তরদিকে ফেরার পালা। এই জায়গার নাম গড়েরমাঝ, সেই কোনকালে কবে দাদা বদিখার আমলে এখানে গড় তৈরি করে বাঘ শিকার করা হত, তাই জায়গাটির নাম হয় গড়েরমাঝ। আমাদের বাড়ির বাংলোতে আদিকালে সাইদ আহমদ নামে এইজন মজ্জুব পীর অবস্থান করতেন। গড়েরমাঝে আমাদের জায়গায় এক দৈত্যাকার বটবৃক্ষের তলায় তার মাজার। লোকে বলত এই মাজার এত গরম যে উপর দিয়ে পাখিও উড়ে যেতে পারে না। মাজারের বটগাছটি কাটা হলে নাকি গল গল করে রক্ত বের হত। যাক, এসব লোককাহিনি, যা মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করে। মানুষ যুগ যুগ ধরে অনেক কিছু বিশ্বাস করে, যার সত্যতার কোন প্রমাণ হাজির করা যায়না।
বয়স্কদের কাছে শুনেছি আমার দাদা মোফজ্জিল চৌধুরীর আমলে গড়েরমাঝের বনে ভীমরুলের হামলায় অনেক গরু ও তিনজন মানুষ মারা যান। গড়েরমাঝের মোকামের কাছের খালে সেকালে মানুষ মরা পশু ফেলে দিত। তীব্র দুর্গন্ধ বেরুত। গলা ছুলানো ভূড়িওয়ালা শকুনের ঝাঁক এসে পচা মাংস খেতে সাবাড় করত। এখন শকুন দেখা যায়না। আমি শকুন দেখতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শকুন সাহসী পাখি। ওদের ওজন বেশ, খুব কাছে না গেলে উড়াল দিতনা। মনে হত শকুন ধরে ফেলব, কিন্তু খুব কাছে যেতেই ভারী বডি নিয়ে কষ্টেমষ্টে ওরা উড়াল দিত, শকুন আর ধরা যেতনা। গড়েরমাঝ পার হয়েই আমাদের স্ববংশীয় হাফেজ বাড়ি। এখানে কুচাই ও রেঙ্গার মধ্যবর্তী সুবিশাল হাওর ও জলাভুমি। লোকে বলত উত্তরের হাওর। এখানে দাঁড়িয়ে উত্তর-পশ্চিম হাওরপার বরাবর পাঁচছয় মাইল দূরের শাহজালাল উপশহরের সুউচ্চ ভবনমালা দেখা যায়। বর্তমানে এদিকে তাকালে নবনির্মিত শ্রীরামপুর লালমাটিয়া বাইপাস সড়কে দেখা যায় অসংখ্য গাড়ি ও ট্রাকের সারি।
বড়চাচা তৈয়বুর রহমানকে আমি অতিবৃদ্ধ পাই। তাকে লাটিতে ভর দিয়ে হাঁটতে দেখি। তিনি সংসারী লোক ছিলেন। জমিদারী প্রথা রহিত হবার সময় তিনি বংশের শেষ জমিদারের দায়িত্ব পালন করেন। প্রজা আন্দোলনের ঠেলা তিনিই সামাল দেন। তার ছিল এক বড় পরিবার। তিনি মিষ্টিকদুর হলুদফুলের বড়া খেতে খুব পছন্দ করতেন। বড়চাচি সফিকুন্নেছা আব্বার মামাতো বোন। বড়চাচির কিছু অহেতুক ভয়ভীতি ছিল, আম্মার কাছে প্রায়ই তিনি জানতে চাইতেন, ওগো রেহার মা- খানেদাজ্জাল কবে বেরুবে? ইয়াজুজ মাজুজের দল এখন কোথায় আছে? কিয়ামতের আর কতদিন বাকি? তিনি সারাটা জীবনভর কিয়ামত ও খানেদাজ্জালের ভয়ে আতংকিত সময় কাটান। আমাদের হুজুররা যুগের পর যুগ সহজসরল মানুষকে এভাবে খানেদাজ্জাল আর ইয়াজুজ মাজুরের ভয়ের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেশ আনন্দ পান।
সিলেটে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হত। ভূমিকম্প হলেই বড়চাচি বলতেন, ওগো রেহার মা, আমিতো মনে করছি আজ কিয়ামতের বইছাল (ভূমিকম্প) লেগে গেছে। দুনিয়া বুঝি আজই শেষ হয়ে যাবে। মাটিলেপা উঠোনে রোদে ধান শুকানোর সময় মোরগহাঁস পড়লে বড়চাচি লম্বা বাঁশের খোটা দিয়ে তাড়াতেন। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে মোরগহাঁসদেরে বকুনি দিতেন, ও হায়জার বলা, ও মড়কির বলা। তাঁদের ছয় পুত্র শমসু, এহিয়া, খসরু, মছরু, ফখরু ও ফজলু। একমাত্র কন্যার বিয়ে হয় দরগামহল্লা সৈয়দবাড়ি। এই বোনকে আমি দেখিনি।
মেঝচাচা মুহিবুর রহমান ছিলেন অতি সহজ সরল আল্লাহভীরু লোক। তিনি কারো সাথেও নেই, পাছেও নাই। তিনি কলিকাতার ট্রামচালক ছিলেন। চাকুরিছাড় আন্দোলনে শরিক হয়ে তিনিও দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে বৃটিশ আমলে এই সরকারি চাকুরি ছেড়ে বাড়ি ফিরেন। বাড়ি ফিরে দাউদপুর প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি নেন। তিনি খুব হালকা পাতলা অবয়বের লোক ছিলেন। ছাত্ররা তাকে ডাকতো শুকনা স্যার। চাচি আজিমা খাতুনের বাপের বাড়ি ওসমানীনগরের করণসী গ্রামে, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী গুণবতী মহিলা। চাচার আয় অল্প, কিন্তু চাচী বাজেট করে চলতেন। চাচীর সময় কাটত ধর্মকর্মে, কোরান অজিফা পাঠ ও তসবি গণনায়। ছয় ছেলেমেয়ে মুরাদ, ফরহাদ, রেশাদ, সালেহা, সাদেকা ও ফলকাকে বেশ কষ্টমষ্ট করে তিনি মানুষ করেন।
বিপত্নীক সেজচাচা মখলিছুর রহমান জৈষ্ট্য ভ্রাতাকে অনুসরণ করে একই কারণে ভারতের কালিমাটির স্টিল কোম্পেনির চাকুরি ছেড়ে এসে বাড়ির বাংলোর বাসিন্দা হন। তিনি একজন ফিলোসফার ধরনের লোক ছিলেন। গ্রীষ্মের দুপুরে তীব্রগরমে মানুষের প্রাণ যখন তটস্থ, এই চাচা তখন তোষকে মুখমন্ডল ঢেকে বাংলোতে আরামে নিদ্রা যেতেন। মখলিছ চাচা ও আব্বা সফিক চৌধুরী তাদের ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগনা ও অন্যদের গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ফলকা আপা, মতি ভাই, ফুলবুবু রেহা, লালমনি সেহা, তাহমিদ ভাই বাংলোয় চাচার সন্ধ্যায় পড়তে বসতেন। মখলিছ চাচা ও আব্বার সিনিয়র ছাত্ররা ছিলেন রেজা ভাই, মুরাদ ভাই, আব্দুল্লাহ ভাই, হাদি ভাই, শাহাদাত ভাই, ফজলু ভাই, ফরহাদ ভাই প্রমুখ। রফিপুরের মলন চৌধুরী, ডাঃ সরফুদ্দিন চৌধুরী, রাখালগঞ্জের সৈয়দ আব্দুল মতিনসহ অনেক বহিরাগত তালবা ও ছাত্ররা এখানে জ্ঞান অর্জন করতেন। জমিদারী আমলের বাংলো অফিসটি তখন একটি অবৈতনিক ও ফ্রি ছাত্রাবাস ও বিদ্যানিকেতনে পরিনত হয়।
ছোটচাচা খলিলুর রহমান চৌধুরীর একমাত্র সন্থান মতি ভাই ভাল ছাত্র ছিলেন না, তিনি এই লেখাপড়ার জ্বালা হতে মুক্তি পেতে হ্যারিকেনের কেরসিনে গোপনে পানি মিশিয়ে দিতেন। কালিমাটির সেজচাচা তার কাঞ্চি দিয়ে হ্যারিকেনের ফিতা কাটা হতে শুরু করে নানাধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে লিপ্ত হতেন। মেঝচাচা ল্যান্টনের রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হতেন। দার্শনিক সেজচাচার ল্যান্ঠন মেরামত কাজে কাজে পড়ার সময় শেষ হয়ে যেত। রেজা ভাইয়ের ব্রেইন দুর্বল, তিনি পড়ছেন- এফ, ইউ, টি, ইউ, আর, ই, “ফিউচার”। কিছুক্ষণ পর তা “ফুটুরি”তে পরিণত হত। চাচা ধমক দিলে তা “ফাটুরি” হয়ে যেত। “ফিউচার” মনে রাখা রেজা ভাইয়ের জন্য ছিল খুব কঠিন একটা কাজ। অথচ এই রেজা ভাই ছিলেন বড়লেখার এম পি এবং মন্ত্রী এবাদুর রহমান চৌধুরীর আপন চাচাত ভাই।
পূর্বচৌধুরীবাড়ির এই বড় বাংলোয় জনকয়েক অস্থায়ী মেহমান আসতেন। একজনের কথা খুব মনে পড়ে, তিনি কোনারচৌধুরী বাড়ির তফুচাচা। আব্বার কাছে শুনেছি এক সময় আমাদের স্ববংশীয় এই বাড়ি খুব সম্পদশালী ও প্রভাবশালী ছিল। তাঁদের বাংলোয় একটি দশ নলের পিতলের হুক্কা ছিল। এই হুল্লার বিশেষভাবে নির্মিত বড় চিলিমে একসাথে অর্ধসের তামাক দিয়ে অঙ্গার জ্বলানো হত। গান বাজনা, আনন্দ ফূর্তি করে তাঁরা দিন কাটাতেন। সেইযুগে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে দাউদপুর জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। আমার দাদার ভাই আবুল বশর চৌধুরী এই বাড়িতে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী মেহের চান্দ খাতুন দাউদপুর মাদ্রাসায় ১৯২১ সালে বাইশ একর জায়গা ওয়াকফ দলিল বূলে দান করে যান। তফুচাচা লম্বা পাঞ্জাবি পরতেন। চুলদাড়ি খুব কমই কাটতেন। আউলা ঝাউলা প্রকৃতির তফুচাচা একটি দড়িতে এক হাজার গিট্টো দেন। তিনি এই গিট্টো টেনে টেনে আল্লাহু, আল্লাহু জিকির করতেন। আজ এখানে তো কাল আরেকখানে তিনি যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর একমাত্র কন্যা আঞ্জুমন আপাকে আমি শৈশবে দেখেছি। এই বাড়ির আরেক চাচাকে দেখেছি, তিনি তফুচাচার বড়ভাই তাহির চাচা। দাউদপুর জামে মসজিদের অবৈতনিক মুয়াজ্জিন। ছিলেন নিঃসন্থান। শেষবয়সে পাশের বাড়ির লতাই বিবিকে বিয়ে করেন। এই মহিলা তাঁর সেবিকা ও বউ হিসাবে সঙ্গিনী ছিলেন। একবার আমরা নানাবাড়ি যাত্রার ট্রেন ধরতে ঘন্টানৌকায় চড়ি। নৌকা হাড়িয়ারচরে আসতেই দাউদপুর মসজিদের চারতলা মিনার হতে এলান আসে তাহির মিয়া চৌধুরী মারা গেছেন। আব্বা নৌকা ফেরাতে চান। কিন্তু ট্রেন মিস হবার শঙ্কায় আর থামেন নি। তারপর থেকে এইবাড়ি জনশূন্য হয়ে যায়।
ছোটচাচা খলিলুর
রহমান ও আব্বা সফিকুর রহমান বয়সে কাছকাছি, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধান। চাচা বড়, আব্বা ছোট। চাচা একটু কালো ও আব্বা সেই তুলনায় ফর্সা, তাই আমার
দাদা মোফজ্জিল চৌধুরী ও দাদিমা ফজিরা খাতুন চাচাকে শৈশবে কালু ও আব্বাকে দলু নামে ডাকতেন। বড় হয়ে তারা দুইজন
এলাকায় হয়ে যান কালুমিয়া ও দলুমিয়া।
আব্বা খুব সৎ ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতেন, তাই গ্রামবাসী অনেকে তাকে পীরসাব নামেও ডাকতেন। আব্বা স্কাউট, শরীরচর্চা ও খেলাধুলা নিয়ে সদাব্যস্ত একজন উদাসীন প্রকৃতির লোক। কালু চাচা ছিলেন বিপরীত, তিনি বেশ দুনিয়াদার স্বল্প ধার্মিক লোক। তিনি সম্পদ ধরে রাখা ও ধনবৃদ্ধি করায় বেশ মনযোগী ছিলেন। আব্বা ও চাচা দুইজনই গ্রামের মানুষের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। বাড়ির সামনে ঘন্টাফুলের তলায় পাতা বেঞ্চে তাঁরা বসতেন, অনেক লোক এসে চারপাশে ভিড় জমাত। এখানে সবসময় জ্বলন্ত নারকেলি হুঁকা একমুখ হতে অন্যমুখে ঘুরে বেড়াত। কালুচাচা ডাক দিলে তখনো মানুষ লাটি নিয়ে বের হতে দ্বিধাবোধ করতনা।
ছোটচাচি সায়রা খাতুনের বাড়ি বিয়ানীবাজারের মাটিকাটা গ্রামে, তিনি একটি সুন্দর হলুদ বিড়াল পোষতেন। বিড়ালটি তাঁর কোলে বসে থাকত। ছোটচাচির হাতে লাগানো ঘরের পাশের সাতকরা গাছে প্রচুর সাতকরা ধরত। এই সুন্দর বিড়াল ছানাটি তিনি এই সাতকরার বিনিময়ে সংগ্রহ করেন, তাই বিড়ালটি নাম হয় সাতকরা। সাতকরা ডাক দিলেই সেই বিড়াল সাড়া দিত। রাতে বিড়ালছানা সাতকরা চাচির সাথে তার বিছানায় ঘুমাতো। আমি এই সুন্দর বিড়ালটাকে নিয়ে খেলা করতাম ও মাঝে মাঝে দক্ষিণের ঘরে চাচা ও চাচির বিছানায় ঘুমাতাম। ঘরের পাশে ছোটচাচির লাগানো ডালিমগাছে লাল লাল ডালিম ঝুলে থাকত। ডালিম ফেটে লাল বীজ বেরুলে বুলবুলিরা খেয়ে যেত। কালুচাচা চালাক, চাচি সহজ সরল। বড় চাচা চাচির বেলায়ও তাই। কেবল মুহিব চাচা এবং আজিমা চাচির বেলায় বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে চাচি চালাক, চাচা সরল।
আমার পিতামহ মোঃ মোফজ্জিল চৌধুরীর বিয়াল্লিশ বিঘা আয়তনের প্রাচীন জমিদার বাড়িটির সামনা পূর্বদিক খোলা এবং বাকি তিনদিক গভীর পরিখাবেষ্ঠিত। সামনার চেয়ে বাড়ির পিছনের দিকের বিস্তার প্রায় দ্বিগুন। মা-চাচিরা পশ্চিমের স্ববংশীয় চৌধুরীবাড়িগুলোতে যেতে হলে বাড়ির পশ্চিমের গভীর পরিখার উপর বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করে খালপার হতেন।
আব্বার ছিল লম্বা নলওয়ালা পিতলের হুঁকা। বাদাই পুতি ও লালই পুতি ছিলিমে তামাক ভরে তার উপর টিকি জ্বালিয়ে দিতেন। ফুলবাড়ি হতে একজন বারটা আঙুলধারী টিকি বিক্রেতা আসতেন। এই অতিরিক্ত আঙ্গুল দুটি আমরা অবাক হয়ে দেখতাম। চিলিমের অঙ্গারে তামাক পুড়ে হুঁক্কার জলে এসে গড়গড় আওয়াজ হত ও তামাকের মাধকতাময় গন্ধে চারপাশ ভরে যেত। বিড়ি ও হুঁকায় টানমারা বড়দের জন্য বৈধ হলেও ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। বড়দের সামনে ধূমপান করা সেকালে বেয়াদবী হিসাবে গণ্য হত। মজার ব্যাপার প্রৌঢ় কেউ কেউ আব্বা ও চাচার মজলিশে হুক্কা খেতেন তাঁদেরকে সম্মান জানাতে উল্টো দিকে মুখ ঘুরায়ে। আমি কোনদিন বিড়ি সিগারেট ছুঁইনি, কিন্তু আব্বার নলওয়ালা হুঁকাটার ছিলিমের আগুন নিভে গেলে অতি গোপনে দুএকটা সুখটান দিতাম, বেশ মজাই লাগত। বাড়ি ভরা সুপারী, আমগাছে পানের লতা। তাই বাল্যকালে মাঝমাঝে পানের সাথে কাচা সুপারি চিবাতাম। চূন ও সাদা খেলে গাইট্টে ধরে বেহাল অবস্থা হয়ে যেত। ব্যামো হবার উপক্রম হত, তখন চিনি, তেতুল, আচার ইত্যাদি খেয়ে কোনমতে গাইট হতে পরিত্রাণ পেতাম। গাইট্টের ভয়ে আমি তাই কখনও পানসুপারীর সাথে চূন-সাদা-জর্দা মুখে নিতাম না।
শৈশবে
আমাদের বাড়িতে নানা গৃহস্থলী কাজে সব সময় অবস্থান করতেন
এমন কয়েকজন মানুষের বিবরণ তুলে ধরব। তাদের
একজন নসিরমা ঝি। তার আসল
নাম জানা হয়নি, তাই বলতে পারব না। তিনি আমাকে নিজ
পুত্রের মত স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে কোলে নিয়ে
হাঁটতেন ও বলতেন, সেফাক মিয়া, তুমি আমার পুত, আমি তোমাকে এনে তোমার মাকে দান করে
দিয়েছি। কখনো বলতেন তুমি আমার গর্বজাত, কখনো বলতেন তোমাকে রাস্থা হতে কুড়িয়ে
এনেছি। আমার শিশুমনে কিছুটা বিশ্বাস হত, তাই রেগে যেতাম, একদিন হাতের লাটি দিয়ে
আঘাত করে তার কোমরের মাটির কলসি ভেঙ্গে ফেলি। পাকঘর জলে ভেসে যায়।
নসিরমা ঝি
আমাদের দুইবাড়ি উত্তরের বাসিন্দা। তার বাপের বাড়ি পাশের গ্রাম রফিপুরে। দাউদপুর
আর রফিপুরের মাঝখানে গহিন হাওর। বর্ষায় জল থৈ থৈ করে। নাসিরমা
ঝি তার জীবনের গল্প শুনান- যখন তার বিয়ে হয় তখন তিনি
নাবালিকা। স্বামী, শ্বশুড়বাড়ি, ঘরসংসার সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। বিয়ে হলে
পুতুল খেলা সাঙ্গ করে এলেন শ্বশুরবাড়ি
দাউদপুরের কোনারপাড়ায়। বিয়ের রাতেই তিনি ভীষণ
ভয় পেয়ে পালানোর চিন্তা করলেন। তখন ছিল ভরা বর্ষাকাল, খুবভোরে চুপে চুপে বাসরঘর হতে বের হয়ে বাড়ির পিছনে
পুকুরপারে যান। সেখানে রাখা ঘাসিয়ারা নৌকাটার গলুইয়ে বসে বৈঠা বেয়ে এই নরকপূরী ছেড়ে প্রায় দেড়মাইল
দূরে বাপের বাড়ি রফিপুরে চলে যান। সকালে নতুন বৌ লাপাত্তা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে
খোঁজে পাচ্ছে না। বাপের বাড়ির সবাই অবাক, এত ভোরে এতটুকুন মেয়ে দেড়মাইল নৌকা বেয়ে
আসলো কেমনে।
আমাদের
উন্ধালে গ্রামের অনেক নারীদের ভীড় লেগে থাকত। কেউ তরকারি
বানাতেন, কেউ মাছ কাটতেন, কেউ মসলা পিষাপিষি
করতেন। নফরেরমা ঝি, লাম্বু ঝি, হারিরমা ঝি, তসি ঝি, জমিরেরমা ঝি এবং
হেনারেরমা ঝি অন্যতম।
হেনারের মায়ের প্রতি বছর বাচ্চা হয়ে মারা যেত। একবার তার এক কিম্ভুতকিমাকার বাচ্চা হয়, যে বাচ্চার ঘাড় ও গলা নেই, আনেকটা ব্যাঙ্গের মত। জন্মের কিছুক্ষণ পর এই অদ্ভূদ বাচ্চাটি মারা যায়। সাথে সাথে তাকে গাংপার কবরগায় দাফন করা হয়। তখন গ্রামে ব্যাঙ ধরে বিক্রির প্রচলন ছিল, হেনারেরমা ঝির কর্তা কিছুদিন হতে রাতে ব্যাঙ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। লোকে বুয়াকে বললো, তোমার জামাই সারারাত নিরিহ ব্যাঙ মারে, তাই ব্যাঙের বদদোয়া লেগে পেটের বাচ্চাটা ব্যাঙ হয়ে গেছে। বিষয়টা ছিল প্রকৃতির এক আজব লীলাখেলা, এমন বিরল খেলা জগতে কদাচিৎ দুএকটা ঘটে থাকে। অথচ এই ঘটনার পর গ্রামের ব্যাঙ শিকারীরা ভয়ে কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ ধরায় বিরতি দেন।
আমার নানা আম্মাকে তার বিয়ের সময় একজন বেঁটে চওড়া মহিলা গৃহকর্মী সাথে দেন। আমরা ভাইবোনরা উনাকে কমলাবু নামে ডাকতাম। বহুবছর তিনি আমাদের সাথে বসবাস করে যুবতী হওয়ার পর কোন এক অচিন পুরুষের প্রেমের টানে হারিয়ে যান। অনেক অনুসন্ধান করেও তার আর কোন খোঁজখবর মেলে নি। আম্মা তাঁর বাপের দেওয়া প্রিয় কমলাবুকে হারিয়ে বহুদিন পর্যন্ত মানসিক যন্ত্রণায় হাহুতাশ করেন। বাদাই পুতি ও লালই পুতি সর্বক্ষণ ছায়ার মত আব্বার পিছু পিছু অবস্থান করতেন। চিলিমে তামাক ভরা, বৃক্ষরোপন, তরকারি বপন, গাভীর দুধদোহন ইত্যাদি সকল কাজে তাঁরা আব্বার সহকারী ছিলেন। আসলে তাদের তেমন কোন কাজ ছিল না। আমাদের জমিজামা দেখাশুনা করে যাহা পেতেন, তাই দিয়ে কোনমতে দিন গুজরান করতেন।
বাদাই পুতির
সাথে তার প্রতিবেশী ইসবর আলীর আজীবন শত্রুতা ছিল। বাদাই পুতির বউ ক্যান্সারে মারা গেলে তিন পুত্রবধু ঘরে রেখে তিনি দুসরা বিয়ে করেন আমাদের পাশের
বাড়ির ইস্রাইল আলী ভাইয়ের যুবতী মেয়েকে, যে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে ভাইয়ের বাড়িতে অনাকাঙ্কিত
আগন্তুক। মেয়ের বুড়ি মাকে হাত করে একসন্ধ্যায় বুড়ো বাদাই পুতি এই যুবতীকে বিয়ে
করেন। কিন্তু তিনচার দিন পর মেয়েটির আগের স্বামী এসে গ্রামের মুরব্বীদের কাছে
অভিযোগ করে এই মেয়ে এখনও তার বিবাহিত স্ত্রী, সে তাকে তালাক দেয় নি।
গ্রামে
বিচারসভা বসে, বিচারে বাদাই পুতি দুষি সাব্যস্থ হন এবং তাঁর পাছায় কয়েক ঘা
দুররা মারার ফতোয়া আসে। ইসবর আলী বিচারকদের মাধ্যমে তাঁর শত্রুর পিঠে দুররা মারার মহাসুযোগ পেয়ে যান।
ইসবর আলী তখন যক্কা রোগাক্রান্ত ও বয়সের ভারে জরজর। তিনি সজোরে বেত মেরে সারাজীবনের শত্রুতার শোধ নেন। কিন্তু
বাদাই পুতি বাঁচলেন, কারণ বৃদ্ধ ও রুগ্ন মূমুর্ষু ইসবর আলীর গায়ে তখন বেতমারার মত তেমন
শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না।
কিছুদিন পর
গায়ের মেরুউল্লাহ লন্ডনি এডওয়ার্ড আলেন নামক একজন বৃদ্ধ
ইংরেজকে লন্ডন হতে দেশে নিয়ে আসেন এবং বুড়ো বাদাই পুতির সাথে বিয়ে হওয়া তার ঐ
শালিকা যুবতীকে ঐ ইংরেজের সাথে বিয়ে দিয়ে লন্ডনে নিয়ে যান। যাক, গরীবের মেয়েটি ভাগ্যবান বটে। আজ বাদাই
পুতি, ইসবর আলী ও মেরু লন্ডনি তিনজনই পরজগতের বাসিন্দা।
প্রতি সাপ্তাহে বুড়ো নাপিত গদই ভাই এসে বাংলোর বারান্দায় আমাদের চুল কেটে দিতেন। তিনি মারা গেলে তার পুত্র কটন দা এই দায়িত্ব পালন করতেন। আমার চাচাতো ফজলু ভাই বিদেশ থেকে এনে তাকে চুলকাটার একটি মেশিন উপহার দেন। এই মেশিন তাঁর চুলকাটার কাজ বেশ সহজ করে।
তখনকার দিনে গ্রামে অধিক সংখ্যায় হিন্দু জনগোষ্ঠির লোকজন ছিলেন। প্রতিদিন দু’একবার সমস্বরে উচ্চারিত হত, হরি, হরি, হরিব্বল। সকাল ও সন্ধ্যায় হিন্দু নারীদের সমবেত কন্ঠে উচ্চারিত উলুধ্বনিও কানে আসত, যা এখন আর শুনা যায় না। উলুধ্বনি শুনতে আমার বেশ ভাল লাগত। আমি অনুকরণের চেষ্টা করতাম কিন্তু তাঁদের মত হতনা। হিন্দুবাড়ির মাটিলেপা উঠোনের কোনের তুলসী গাছ, দেবতা ঘরের প্রতিমা এখনও চোখে ভাসে।
ঘটাকরে পূজা ও বিয়ের কুঞ্জে সাতপাক, এমন সব অনুষ্ঠানের দিনে ঢোল করতালের নিনাদে আমাদের বাড়ির দক্ষিণপুর্ব প্রান্তর প্রকম্পিত হত। ঐ বাড়ির ফলেন্দ্র ছিলেন আমার সহপাঠি। মালাকার জনগন আদিকালে আমাদের বাড়ির ফুল ও ফলের বাগান দেখাশুনা করতেন। আমাদের এই প্রিয় হিন্দু প্রতিবেশীরা আচমকা উদাও হয়ে যেতেন, পরে জানা যেত তারা চিরতরে ভারতে চলে গেছেন। তখন এখানে তাদের প্রতিবেশী প্রিয়জনরা মনের দুঃখে গোপনে অশ্রু বিসর্জন করতেন।
একেতো হিন্দুদের বংশবৃদ্ধির হার কম, তদুপরি ইন্ডিয়া যেতে যেতে হিন্দু জনগণ সংখ্যায় কমে কমে আজ নিঃশেষিত প্রায়। এযেন ছোট্ট পুকুরের মাছ সুযোগ বুঝে পাশের বড়দিঘিতে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে যাওয়া। তাঁদের হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর, কারণ তাঁরা বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক, তাঁরা বাংলা সংস্কৃতির প্রাণ। বাংলাদেশের প্রায় সব আধুনিক শিক্ষার স্কুল-কলেজ তাঁরাই স্থাপন করেছেন। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের আদি শিক্ষাগুরুও ছিলেন তাঁরা। বড় হয়ে আমি রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়, মুরারি চাঁদ কলেজ ও মদন মোহন কলেজে অধ্যয়ন করি। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই হিন্দুদের স্থাপিত। দেশবাসী কতটুকু কৃতজ্ঞ জানিনা, তবে আমি মহান হিন্দুদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
শৈশবে খেলার সাথিরা ছিল দিপা, মাজেদা, বদরু, রেকি, রেজি, সাকের, রুবা, রিমা, রিপন, প্রমুখ ভাগ্নাভাগ্নি ও ভাতিজাভাতিজি। বোন মান্না ও সাকের, পাশের বাড়ির শওকত আলী, লিয়াকত আলী, পচা, জাকারিয়া, আনারা, সুনারা সবাই মিলে মার্বেল, ছরি, বন্ডি, কবাডি, বল, হাডুডু, চাকা ঘুরানো, সুপারীপাতার ছইচড়া এবং পুকুরে জলখেলা করে কিভাবে যে সময় চলে যেত টের পেতাম না। তখনকার যুগে এত খেলনা ছিলনা। কাটমিস্ত্রী বাড়িতে এলে বেয়ারিং চাকার গাড়ি বানিয়ে দিত। গাছের ডালে দড়ি দিয়ে পিড়ি ঝুলিয়ে দোলনা বানিয়ে আমরা দোল খেতাম। শীতে বারনির মেলা হলে চারপাশে বাঁশের বাঁশী বাজত, ফরফরি ও ঘুড়ি উড়ত, বাঁশের রঙ্গিন হাতপাখা ও নানাপদের নাড্ডু, খই, খেলনা ও মিষ্টান্নে সারাগ্রামে আনন্দের জোয়ার বইত।
হে পৃথিবী, তুমি আয়তনে অনেক বড়, অথচ আমার কাছে তোমার চেয়েও অনেক বড় দাউদপুরের বিয়াল্লিশ বিঘা পূর্বচৌধুরীবাড়ি, এ যে আমার জনমমাটি। এখানে আমার কয়েক প্রজন্মের শিকড় পুঁতা আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন