শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চাঁদকপাল আব্দুল হালিম চৌধুরী ও আমিঃ

 

চাঁদকপাল আব্দুল হালিম চৌধুরী ও আমিঃ

২৩ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল। সিলেট শাখার ব্যবস্থাপক হয়ে আসেন একজন রাজকপালী ভাগ্যবান লোক। তিনি পরর্তীকালে এই ব্যাংকের শীর্ষপদে আসীন হয়ে বেশ কয়েক বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আমার একজন ঘনিষ্ট আত্মীয় আব্দুল হালিম চৌধুরী। দীর্ঘ্যতনু ঈষৎ শ্যামলা গাত্রবর্ন, ঘন কালো কেশ, মেঘকাল সানগ্লাসে অভ্যস্থ স্মার্ট ও চৌকশ আব্দুল হালিম চৌধুরীর ছিল উন্নত কমিউনিকেটিং ও নেগোসিয়েইটিং ক্ষমতা। মানবশক্তি পরিচালনায়ও তিনি ছিলেন অসাধার। মোটর সাইকেল চড়ে তিনি সারাটা সিলেট শহর টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন

তাহার পত্নী আমার ফুফুত ভাইয়ের একমাত্র কন্যা রিপা, হ্যাঁ, সে আমার চেয়ে দুইতিন বছরে কনিষ্ট রুপবতী ও গুনবতী ভাতিজি রিপা। রিপা রূপে গুনে বর্ণে উচ্চতায় আমার ফুফুরই প্রতিবিম্ব। রিপার আব্বা কাইয়ুম ভাই তখন জীবিত। রিপাদের তিন ভাইবোন ও মাবাবা মিলে পাঁচজনের এক ছোট্ট পরিবার। হাজিপুরের বিশাল ওয়ালঘেরা প্রাচীন জমিদার বাড়ির মধ্যের টিনের বড় উচু ছাদের ঘরটিতে ছিল তাদের বসবাস। এই ঘরটির মালিক হাফিজ আহমদ মজুমদার এম পি ও মন্ত্র এবাদুর রহমান চৌধুরীর শ্বশুর যিনি আমার ফুফার আপন বড়ভাই। আমার ফুফার একমাত্র ভাতিজা পাকিস্থান আমলের এ ডি সি খুর্শেদ ভাই ধানমন্ডিতে ছয়তলা নিজস্ব বাসায় বসবাস করায় সুন্দর এই ঘরটি এতদিন জনশুন্যই ছিল। ফুফুত কাইয়ুম ভাই জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হতে অবসর নিয়ে এই পাকা টিনের ঘরে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসেন।

রিপা তখন বিএ সমাপনী বর্ষের ছাত্রী, একদা আমি কানিহাটি হাজিপুরে আমার ফুফুর বাড়িতে যাই। কাইয়ুম ভাই বললেন আমার মেয়ের দুইটি বিয়ের আলাপ আছে, কি করব কোন সিন্ধান্ত নিতে পারছিনা। প্রথম আলাপটি আমাদের দাউদপুর গ্রাম হতে এসেছে, এই বর আমার স্ববংশীয় চাচা ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরীর একমাত্র পুত্র এহসান আহমদ চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজতত্বে অনার্স সহ মাস্টার্স ও আধুনালুপ্ত আলবারাকা ব্যাংকের অফিসার। দ্বিতীয় সম্মন্ধটি পাঠিয়েছেন পুবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আব্দুল হালিম চৌধুরী যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে এমএসসি করেছেন।

ফুফুত ভাই আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী আমার অভিমত জানতে চাইলে আমি দুই নম্বারটিতে মতামত দিলাম। কেন এই অভিমত দিলাম নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছে হবে। আসলে এই দুই পানিপ্রার্থীকেই আমি আগ থেকেই ভাল করে চিনতাম। হালিম চৌধুরীর ছোটভাই ডি এম সি র কার্ডিওলজী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী এমসি কলেজে আমার এইচএসসি সহপাঠি ছিলেন। হেসে হেসে কথা বলতে অভ্যস্থ ডাঃ ওয়াদুদ ছিলেন এক সম্মোহনী ব্যাক্তিত্ব। তাদের সব কজন ভাইই সজ্জন, মেধাবী ও ব্যবহারে অমায়িক।

অন্যদিকে সহজ সরল চিকিৎসক বাপের একমাত্র পুত্র এহসান ভাই সোজাসাপ্টা লোকআমার চাচাত এহসান ভাই আজ আর নেই, গর্বিত পিতার পরলোক যাত্রার অল্প কিছুদিন পর এহসান ভাইও ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যানবাবা ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরীর একমাত্র আদরের পুত্র তিনি, আমার কেন যেন মনে হল তিনি বেশি বেশি লোড নিতে পারবেন না। এহসান ভাইয়ের কথা মনে হলে এখনও চোখে অশ্রু আসে। তারা বাপবেটা দুইজন পাশাপাশি দাউদপুর জামে মসজিদের পিছনে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। মহান আল্লাহপাক তাদেরকে জান্নাত দিন।

রিপার চাচি ছিলেন আমার মেঝবোন আজিজা চৌধুরী সেহা। মুক্তিযোদ্ধা দোলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন হাজিপুরের তিনবারের চেয়ারম্যান, সেইসাথে আটশত একর আয়তনের সিরাজনগর চাবাগানের ম্যানেজার।

আজ আমার মনে হয় রিপা সত্যিই ভাগ্যবান, ওদিকে সবার মতামত চলে গেলে তার নিশ্চিত ভাগ্য বিপর্যয়ই ঘটত। সৌভাগ্যই তাকে প্রহরা দিয়ে রক্ষা করেছে। আমার শ্রদ্ধেয় আম্মাজান আসমতুন্নেছা চৌধুরী তার অভিজ্ঞতা ঘেটে বলতেন কানিহাটি হাজিপুরের প্রায় মেয়েরাই কেমন যেন এক সৌভাগ্য নিয়েই জন্মায়, শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্যই হয় তাদের নিয়তির শ্বাসত সহচর

আব্দুল হালিম চৌধুরী, এই অপার সম্ভাবনাময় মানুষটি সিলেট শাখার চেম্বারে বসে আছেন। আমাকে একদিন ডেকে বললেন আপনার হাতে একসাথে অত্যাধিক টিটি আসলে টেস্ট বের করে আমার টেবিলে পাঠিয়ে দিবেন, আমি সাথে সাথে টেলিফোনে পাস করে দেব। তিনি দারুন পরিশ্রমী, তার উদ্দেশ্য মহৎ- গ্রাহককে দ্রুত সেবা দেওয়া, সেইসাথে চাচা শ্বশুরকেও সাহায্য করা

সিলেট অঞ্চলের পুবালী ব্যাংকে তখন ছিল তিনজনের প্রচন্ড দাপট, তারা হলেন  আব্দুল মান্নান, আব্দুল হালিম চৌধুরী ও ইলিয়াস উদ্দিন আহমদ। তিনজনের মধ্যে একটা মানসিক প্রতিযোগিতাও প্রচ্ছন্ন ছিল। তাদের পিছনে পিছনে এগিয়া আসছিলেন জকিগঞ্জের ফরিদ উদ্দিন, যিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন একজন ছাত্রলিগ নেতা

তবে কেবল আব্দুল হালিম চৌধুরীই ছিলেন কৃষিব্যাংকের সরাসরি শিক্ষানবিশ সিনিয়র অফিসার। এই ব্যাংকে সরাসরি প্রিন্সিপাল অফিসার করে তাকে নিয়ে আসেন তৎকালীন পুবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী তিনি জকিগঞ্জের উত্তরকুলের চৌধুরী বংশের লোক। তার বংশ মর্যাদাও অন্যদের উপরেই ছিল। তার ভাইরাও সবাই ছিলেন স্কলার। সেই সময়ের আমার দেখা আব্দুল হালিম চৌধুরীর সততা ও নিষ্টা ছিল প্রশ্নাতীত। ‘সেই সময়ের’ বললাম এই কারনে যে পরবর্তীকালের আব্দুল হালিম চৌধুরীর কোন খবর আমার তেমন জানা নেই।

সিলেট শাখার ক্যাশ ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ কঠিন কাজ। ইউনিয়নের নেতা কুমিল্লার আতাহার হোসেন ও চুনারুঘাটের মিজানুর রহমান ক্যাশের গাড়ী চড়ে সারাটা সিলেট অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন। এতে তাদের গণসংযোগ ও চাকুরী দুটো একসাথে হয়ে যেত। পুর্ববর্তী ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিনের দুর্বলতার সুযোগে ক্যাশের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দুজন ক্যাশিয়ারের একজন বেরিয়েই ফাঁকি দিয়ে বাসায় চলে যেত। এভাবে পর্যায়ক্রমে এই ক্যাশিয়ারদের একজন ডিউটি করত, অন্যজন ফাঁকি দিত। বিষয়টি  আব্দুল হালিম চৌধুরীর নজরে এলে তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাবান ক্যাশিয়ার ও ইউনিয়ন নেতা মিজানুর রহমানকে ডেকে বললেন আপনি কি ক্যাশের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে নেমে বাসায় চলে যান? মিজানুর রহমান আমতা আমতা করলে হালিম চৌধুরী শক্ত ঝাড়ি দেন, খবরদার, আর যদি শুনি আপনারা এমন কাজ করছেন তবে চিরদিনের তরে বাসায় পাঠিয়ে দেব।

জুমিয়র অফিসার(ক্যাশ) আতাহার হোসেন একজন জাতনেতা, তিনি নেতাগরি করতে গিয়ে বারবার প্রমোশন ফিরিয়ে দেন। তিনি হাতের সব টাকা বাতাসে উড়ায়ে দিতেনধারকর্জ্জ করে গরীব আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে টিভি, ফ্রিজ, সোফা ইত্যাদি উপহার দিতেন। ফলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কেনা মুল্যবান জমিটি বিক্রি করে দিতে হয়আমি ২০১৬ সালে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে যোগদানের পর একদিন আতাহার সাহেব আমাকে ফোন করেন। বললেন তিনি অসুস্থ্য, আমাকে মদন মোহন কলেজের বিপরীতদিকের গলীতে তার বাসায় গিয়ে একটিবার দেখা করতে বললেন। আমি বিদেশে যাবার ঝামেলায় ব্যস্ত থাকায় গিয়ে দেখা করতে পারিনি। বিদেশ হতে ফিরে এসে শুনলাম আতাহার সাহেব নেই। জানিনা, আমার প্রিয় আতাহার সাহেব আমাকে কি বলতে চেয়েছিল।  হয়ত তিনি আমাকে জীবনের শেষবারের দেখাটি দেখতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাই নিজেকে বেশ অপরাধীই মনে হল। তার মেয়েটি এখন পূবালী ব্যাংকে বাবার স্মৃতি বহন করছে।

ঘিলাছড়া গ্রামের সফিউল হাসান চৌধুরী এমবিএ করে শিক্ষানবিশ সিনিয়র অফিসার হিসাবে এসময় সিলেট শাখায় যোগদান করে। আমার পাশের চেয়ারে বসে সে কাজ করত। তাকে নিয়ে আমি খুব উচ্চ ধারনা পোষন করতাম। এম কম পাশ শামসুউদ্দিন ফারুক স্যারও ছিলেন সরাসরি সিনিয়র অফিসার। তিনি অতিশয় দয়ালু এবং সজ্জন লোক ছিলেন। প্রাইমারী শিক্ষকরা এসে বেতন হয়নি বলে মনঃক্ষুন্ন হয়ে ফিরে যেতে দেখলে তিনি তাদেরকে ডাক দিয়ে বলতেন আপনার চেকটি আমাকে দেন। চেকটি রেখে তিনি নিজ হিসাব হতে তাদেরকে সমপরিমান টাকা পরিশোধ করে দিতেন। শামসুউদ্দিন ফারুক স্যার বলতেন আমার বাবাও প্রাইমারি শিক্ষক ছিলেন, অতি কষ্টকরে আমাদেরকে লেখাপড়া করিয়েছেন। তাই প্রাইমারি শিক্ষকদের মনঃক্ষুন্ন চেহারা আমার বাবার স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অনেক বছর পর ২০১৭ সালে আমি ফারুক ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পাই। সরাসরি আমার কাছে টেলিফোন করে আমন্ত্রন জানান। আমার এই অতিপ্রিয় ও আদর্শ মানুষটির সাথে মালঞ্চ কমিউনিটি সেন্টারে আবার দেখা হল বহুবছর পর।  আজ সিলেট শাখায় আমাদের সময়ের কেউ নেই। কেবল সগৌরবে বহাল আছেন মাত্র দুইজন- ক্লিনার জয়নাল এবং টিবয় নাসির।     

জয়দেব চৌধুরী ও সুদেব চৌধুরী, এই দুই সহোদর রিকাবীবাজার সংলগ্ন সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটের হর্তাকর্তা। তারা নয়াসড়কের বিখ্যাত খাজান্সিবাড়ির অধস্থন পুরুষতাদের পিতামহ নির্মল চৌধুরী ছিলেন একাধিক চাবাগানের মালিক সেই আমলের সিলেটের সবচেয়ে ধনীলোক। তিনি সেকালের দামি সেভরোলেট গাড়ি চড়তেন। তাদের অর্থ প্রাচুর্য ছিল রূপকথার মত। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী নির্মল চৌধুরীকে হত্যা করলে এই পরিবারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সহায় সম্পত্তির মোহ ত্যাগকরে এই পরিবারের প্রায় সব লোকজন ভারতে পারি জমান। কালের স্বাক্ষী খাজান্সি জমিদার বাড়িটি আজ সরকারী দপ্তর ও সিলেট ইন্টানেশনাল স্কুল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে টিকে যাওয়া এইবাড়ির বংশধর জয়দেব চৌধুরী ও সুদেব চৌধুরী আমাকে সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে ভি আই পি কোঠা হতে বিনা লটারিতে একটি দোকান বরাদ্ধ পেতে সাহায্য করেন।

১৯৯৬ সালে এক লক্ষ টাকা জমা দেই। জয়দেব বাবুকে বললাম, দাদা, আমার হাতে টাকা নেই, বাকী একলক্ষ আপনি যতদিন সম্ভব আমাকে সময় দিন। তিনি ফাইল চেপে চেপে যান। জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক সভায় জেলা প্রশাসকের নজরে পড়ে এই দোকানের অর্ধেক মূল্য এক বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসক সময় দেন মাত্র এক সাপ্তাহএই সময়ের মধ্যে মুল্য পরিশোধ না হলে বরাদ্ধ বাতিলের আদেশ দেন। অনেক চেষ্টায় সত্তুর হাজার টাকা জোগাড় হল, আর মাত্র একদিন বাকী।

চিন্তিত আমি আব্দুল হালিম চৌধুরীর চেম্বারে ঢুকে বিষয়টি জানালে তিনি বললেন, চাচা, কোন চিন্তা করবেন না, শেষদিনে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পরদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি।আমি ছুটলাম বোনের বাড়ি রনকেলী দক্ষিনভাগ। ভাগ্যক্রমে ঐ দিন তাদের বড় মৎস্যখামারের মাছ বিক্রি করা হয়, এই টাকা হতে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে সিলেট ফিরলাম। শুন্য হাতে ফিরলে পরদিন অবশ্যই আব্দুল হালিম চৌধুরী  আমারে উদ্ধার করতেন।

১৯৮১ সালে এসএসসি পাশ করার পর হতে এই সিলেট শহরে আমার নিত্যদিনের বিচরন শুরু হয়, রাতের ঘুমটা দাউদপুর গ্রামে হলেও দিন কাটত এই সিলেট শহরের অলিগলিতে। ছুটির দিনগুলোর বিশ্রাম কেবল  গ্রামের জন্য বরাদ্ধ থাকে, নইলে এখন আমি পুরাপূরি একজন শশব্যস্ত নগরবাসীএই শহরে এতদিন পর্যন্ত আমার নিজের বলতে কোন সম্পদ ছিলনাসিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে ভি আই পি কোঠায় বিনা লটারীতে  বরাদ্ধ পাওয়া দোকানটিতে ডুকে ভাবলাম এই পুন্যশহরে এটিই সর্বহারা ইসফাক কুরেশীর একমাত্র সম্পদ- সবেধন নীলমণি। এই সম্পদে তাই পা রেখেই আল্লাহের প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতায় চোখ জলে ভিজে গেল।    

একদিন হালিম চৌধুরীর সামনের টেবিলে বসিচারখাইয়ের একটি লোক সোলতান আহমদ চৌধুরী তিনচার বছর আগে আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের কাছ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ধার নেয়। সে এই টাকা কোনমতেই ফেরত দিচ্ছে না। তার কাছে নিজের পাওনা টাকা রেখে আমি স্টেডিয়ামের দোকান ক্রয়ের টাকা সংগ্রহের জন্য হন্য হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিমনে হল একবার ফোন করে দেখি লোকটা কিছু ফেরত দেয় কিনা। আমি তাকে টেলিফোনে আমার পরিচয় দিয়ে উক্ত টাকা ফেরত দেবার জন্য তাগদা দেই, ওমনি ভদ্রবেশী বদমায়েশটা রেগে যায় ও সে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। আমার মনে হল জানোয়ারটা ফোনের ওপ্রান্তে যেন একটা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ঘেউঘেউ করছে

ইবলিশটার চিৎকারে হতচকিত আমি টেলিফোনটা ঘটকরে রেখে দিয়ে বিষন্ন মনে বসে থাকলে হালিম চৌধুরী আমার এই হঠাৎ মন খারাপের কারন জানতে চান আমি বিষয়টি অবগত করলে হালিম চৌধুরী বললেন, এই লোকটাকে চিনি সে একটা আস্ত ডাকাত পরে জানলাম সে ডাকাতটা চারখাই এলাকার অনেক ধনী গরীব লোকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। চুনিয়াবিলের দখলদারী নিয়ে খুনখারাবীও করেছে। সেখানে এই ইতরটা একবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ভোটে প্রার্থি হয়ে মাত্র আটদশটা ভোট পায়।

আব্দুল হালিম চৌধুরীর বাসার সামনের রাস্থা দিয়ে একটু অগ্রসর হলে আমার খালা মরিয়মুন্নেছা চৌধুরীর বাসা। নিঃসন্তান খালু আখলাকুস সামাদ চৌধুরী নিজবাসায় একটি সুরম্য মসজিদ নির্মান করেন। তারা আড়াই কোটি টাকা দামের ২৫ ডেসিমেল বাসাটি মসজিদে দান করে দেন। পাড়ার মুরব্বিরা খালুকে বললেন  আপনার নামের সাথে মিলিয়ে মসজিদটির নাম আমরা রাখলাম ‘বায়তুস সামাদ মসজিদ’কিন্তু খালু একটু ভেবেচিন্তে ভিন্নমত প্রকাশ করে বললেন, না আমার নিজনামে মসজিদটির নাম রাখলে আমার মনে তাকাব্বুরি আসতে পারে। এই তাকাব্বুরি একবার আসলে আমার সব সওয়াব ও উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মসজিদটি আমার নাম ফাটানোর জন্য নির্মান করিনি, করেছি ফিসাবিলিল্লাহ আল্লাহ ও তার রসুলের সন্তুষ্টির জন্য। তার বদলে বরং আমি একটি নাম দেই। আপনারা মসজিদটির নাম রাখেন ‘বায়তুন নূর মসজিদ’

একদিন এই খালার বাসায় যাবার পথে কার থামিয়ে কয়েকজন আত্মীয়সহ উঠলাম হালিম চৌধুরীর বাসায়। এম প্যাটার্নের টিনের লম্বা বাসার ডান দিকের সিটিংরোমের সাদামাঠা সোফায় আমরা বসলাম। রিপা তার উচ্চমধ্য বয়সী শ্বাশুড়িকে নিয়ে এসে সোফায় বসল। হস্থকর্ম সমৃদ্ধ একটি সাদা শাড়ি পরে এলেন শ্যামলা বেয়াইন ও সেইসাথে তিনি আমার সহপাঠি ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর আম্মা, কথাবার্তায় তাকে একজন পাক্কা বুদ্ধিমতী ও ঞ্জানপিপাসু রমণীই মনে হল আমার            

আব্দুল হালিম চৌধুরী ছিলেন সিলেট ব্যাংক অফিসার্স ক্লাবের সভাপতি, তিনি রোটারি ক্লাব, সিলেট স্টেশন ক্লাব, এই ক্লাব সেই ক্লাব সহ নানা কর্মযঞ্জে সদাব্যস্ত একজন করিতকর্মা মানুষতিনি খুবভাল তোষামুদি করতেও জানতেন, ব্যাংকের পরিচালকদের পঠাতেও তার জুড়ি ছিলনা ইলিয়াস উদ্দিন, আব্দুল মান্নান, মোসাদ্দেক চৌধুরী গং স্যাররা যেখানে কেবল ব্যাংকের পরিচালক ও এমডিকে তুষামুদি করতেন, সেখানে হালিম সাহেব আর কয়েক ধাপ এগিয়ে তাদের গাড়িচালক, বাবুর্চি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারদেরকেও তুষামুদি করে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য তারা যেন পরিচালকদের কাছে তাঁর সুনাম গায়  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন