মিথ্যা
ষড়যন্ত্র ও চৌধুরীবাজার শাখা হতে বিদায়
চৌধুরীবাজার শাখায় আমি শখ করে
আসিনি, আবার ইচ্ছে করেও উঠে যাইনি। একদিন উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান আমাকে বললেন
আপনি মহাব্যবস্থাপক আবু হাবিব খায়রুল কবির স্যারকে একটা ফোন করায়ে শহরে চলে আসেন।
সবকিছু আল্লাহের ইচ্ছেয় হয় এবং বান্দার ভালর জন্য হয়- এমন একটি দর্শন আমাকে শতকষ্ট
সত্বেও চৌধুরীবাজারে রেখে দিল। বিগবস সিরাজ সাহেব রাগবেন ভেবেও আমি ঘোড়া ডিঙ্গায়ে ঘাস
খেতে যাইনি। অতি তেলবাজ লোকটা অচিরেই সিলেটের মহাব্যবস্থাপক হলে আমার সমূহ ক্ষতি
করে বসতে পারে ভেবে কিছু করতে গেলাম না। অথচ ক্ষতি আমার পিছু ছাড়লনা। মানসম্মান সব
বিসর্জন দিয়ে চৌধুরীবাজারে পড়ে রইলাম।
ম্যানেজারীতে যেমন পেইন আছে তেমন
আছে চার্ম ও গেইন। বড় শাখা চালিয়ে ছোট শাখা এযে বড়মাছ খেয়ে এসে পোনামাছে গ্রাস
বসানো, একটি বড়ঘর হতে বের হয়ে কুঁড়েঘরে প্রবেশ। ম্যানেজারী করে দুধরনের লোক, একদল
যারা ধর্য্যধরে টেবিলকাজ করতে অপারগ। ব্যবস্থাপক হলে নিজে চেম্বারে বসে বসে
গল্পগোজব করে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। আরেকদল যারা কতৃত্বপরায়ন, সর্দারি পছন্দ
করে। সর্বদা নিজের স্বেচ্ছাচার ফলায়। এখানে পেইনের সাথে এই দুইদল প্রচুর সম্মান ও গেইন
নেয়। এখানে পেইন হল নানান কিছিমের মানুষ ব্যবস্থাপনা, ঋন আদায় ও খেলাফি ঋন। চার্ম
হল কতৃত্ব ও মর্যাদা। সেইসাথে আছে কিছু উপরি সুযোগ সুবিধা, ব্যবস্থাপক ভাতা, ঋন ইন্সুরেন্সের
কমিশন, গাড়িঋন, বাৎসরিক স্যুটকোট পেয়ে কক্সবাজার ভ্রমন ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার।
বরইকান্দি শাখার চার বছরের সফল
ব্যবস্থাপনা হতে সিলেট পুর্বাঞ্চলিক অফিসে তুলে এনে সুকৌশলে আমাকে পচানোর
প্রক্রিয়া শুরু হয়। সিলেটে বলে সুপারী পচানো। হাড়ির ভিতর লাল সুপারি পানিতে ভিজিয়ে
হাড়িমুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। আমার এই পচনকাজ সফলভাবে সমাপ্তকরার আয়োজন চলে গোপনে
অন্তরালে। আমাকে চৌধুরীবাজারের পচনহাড়িতে ভরে হাড়িমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমার শহরে
চারতলা বাসা, লালকার, নর্থইস্টের মালিকানা, স্কয়ারফার্মার বিশাল মালিকানা, চিকিৎসক
পত্নী, তিনচার কোটি টাকার এফডিআর ও বিনিয়োগ, সিলেট শহরের কাছেই গ্রামে ষাটসত্তুর
বিঘা জমি ও খামার বাড়ি, বিদেশ ভ্রমন, চৌধুরীবাজার ও সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে
দোকান, পত্রিকায় লেখালেখি, সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার, বংশ মর্যাদা, দুইটি
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রি ইত্যাদি দুই একজন ছোটমনা মানুষের ঈর্ষার কারণ
হয়ে দাঁড়ায়।
আগের সব ভাল লোকজনও এখন আর ব্যাংকে
নেই। সবাই একে একে অবসরে চলে গেছেন। তাদের বিদায়ের পর ঈর্ষাপরায়নতার এক অশুভ খেলা
ব্যাংকের পরিবেশ দুষিত করে তুলে। ব্যাংকে শ্রেষ্ট ব্যবস্থাপক পদক পাই দুইবার। কেবল
ব্যাংক নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
প্রতিটি কাজে কমবেশি সফল আমাকে একজন অক্ষম অথর্ব লোক হিসাবে খুব সুন্দরভাবে
উপস্থাপনের কাজ শুরু হল পুবালী ব্যাংক পাড়ায়। নেতৃত্বে থেকে নিখুতভাবে কাজ চালিয়ে
যান পুবালী ব্যাংকের লন্ডন শাখায় ছয় কোটি টাকা খুইয়ে অফিসটি বন্ধ করে আসা ডিগ্রি পাস মহাব্যবস্থাপক সিরাজুল হক চৌধুরী।
আমি একজন পূবালীয়ান, তাই লন্ডনে সফরে
গিয়ে বিখ্যাত হেরল্ড মার্কেট হতে বেরিয়ে ধারে পুবালী ব্যাংকের গুটিয়ে আসা সেই
অফিসে গেলাম। প্রাইম ব্যাংক এখন সেই অফিস ভাড়া নিয়ে দেদারসে ব্যবসা করছে। আমি
অফিসে ঢুকে শাখাপ্রধানকে বললাম ব্যবসা কেমন হচ্ছে। জবাব পেলাম ভাল। প্রফিট কেমন
বলতেই আবার জবাব পেলাম ভাল। এবার আমি বললাম পূবালী ব্যাংক এখানে এসে তিন বছরে ছয়
কোটি টাকা খুইয়ে পলায়ন করে, আর আপনি বলছেন ভাল। এবার প্রাইম ব্যাংক লন্ডন শাখাপ্রধান
বললেন, ব্যবসার লাভালাভ নির্ভর করে কে ব্যবসা চালায় তার যোগ্যতার ওপর। নিশ্চয়ই
এখানে পুবালীর কোন ঘাটতি ছিল। নতুবা লস হবে কেন।
এক সময় পুবালী ছেড়ে ইবিএল
ব্যাংকে হিজরত করে সেখানেও সিরাজুল হক চৌধুরী টিকতে পারেননি। অভিমান করে পুবালী নামক
নরক ছেড়ে ইবিএল চৌহাট্টা শাখায় গিয়ে বহুবছর গড়াগড়ি খেয়ে আবার ফিরে আসেন পুরানো নরকে
পূবালী ব্যাংকে। সিলেটি ব্যাংক, তাই এখানে সিলেটি হিসাবে শনৈ শনৈ করে তার উন্নতি
হয়। তিনি আগে ছিলেন অঞ্চল প্রধান, এখন পদোন্নতি পেয়ে হন সিলেটের চার জেলার বিভাগীয়
প্রধান। তার পরশ্রীকাতরতা ও ক্ষমতার দাপট পুবালী ব্যাংকে আমার এতদিনের উন্নতির
ধারাকে থামিয়ে দেয় এবং পতনকে তুরান্বিত করে তুলে। চাকুরী ক্ষেত্রে আমি পরিনত হই এক
বদ্ধ জলাশয়ে।
অথচ ব্যাংকে আমার উন্নতির ধারা
অব্যাহত রাখতে ইতিমধ্যে প্রৌড় বয়সে আমি এমবিএ করেছি, জেএআইবিবি করেছি। আই টি দক্ষতা
আমার সব সময়ই ছিল।
আমার আত্মীয় এম ডি হালিম সাহেব
হয়ে যান স্টাচু অফ লিবার্টি। তিনি বৃক্ষ বিষয়ে লেখাপড়া করে হন পূবালী ব্যাংকের এম ডি।
সীমিত ঞ্জান নিয়ে বড় প্রতিষ্টান চালাতে গেলে যা হবার তাই হল। তিনি অতিদক্ষ আইটি
বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলীর উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সাবেক এম ডি খোন্দকার
ইব্রাহিম খালেদ ও হেলাল আহমদ চৌধুরীর মত মহাঞ্জানীরা ঞ্জানের মর্যাদা বুঝতেন,
কিন্তু হালিম সাহেবের কাছে এসবের কোন কানাকড়ি মূল্য ছিলনা। বর্বর মোঙ্গররা বাগদাদ
এবং সমরখন্দের সমৃদ্ধ পাঠাগার আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। কারন তাদের কাছে এসব বইপত্র
মূল্যহীন জঞ্জাল। ফলে মানব সভ্যতা পাচশত বছর পিছিয়ে পড়ে। আব্দুল হালিম চৌধুরীর
কাছে তার সামনে গিয়ে স্তুতিকারী অলস ঞ্জানহীন ও ঞ্জানপাপী ধাপ্পাবাজরা কাজের লোক,
অন্তরালে থাকা পরিশ্রমী দক্ষ লোকেরা টন টন ভারি হলেও মূল্যহীন। যারা নিরবে নিভৃতে
ব্যাংকের জন্য অবিরাম কাজ করে, তাদেরকে দেখার মত চোখ আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেই।
আমার পাশের গ্রাম তুরুকখলা
নিবাসী ও শহরের প্রতিবেশী পূবালী ব্যাংক পরিচালক মনির আহমদ চৌধুরীবাজার শাখায়
প্রবেশ করে প্রথমদিন আমাকে দেখে অবাক হন, একটি বিষ্ময়সূচক প্রশ্ন ছুড়ে দেন আপনি
এখানে! আমি জবাব দিলাম, আপনাদের অঞ্চল প্রধান সিরাজ সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন তাই আমি
এখানে। তার ধারনা আমি হয়ত ধরাধরি করে বাড়িতে আরাম করতে এসেছি। একসময় ঢাকার একজন
বয়স্ক সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হুসেনকে ঢাকার মালীবাগ শাখা হতে এশাখায় শাস্তিমুলক
বদলী করা হয়েছিল। পরিচালক মনির সাহেব মনে করলেন আমারও এই বদলী হয়ত শাস্তিমুলক অথবা
কেঊ হয়ত তাকে বলেছে শাস্তিমুলক। অথচ আমার চাকুরীর সার্ভিস ফাইল একদম পরিস্কার; এই
ফাইলে কেঊ একটিও লাল দাগ দেখাতে পারবেনা। এত বছর ম্যানেজারী করেছি অথচ আমার চাকুরী
ফাইলে ইনশাহআল্লাহ কোন মেমোরেন্ডাম, সতর্কবার্তা, অডিট হুশিয়ারী ইত্যাদি কিছুই
বর্ষিত হবার কোন সুযোগ হয় নি।
চাকুরী জীবনে আমি নীরবে
নিস্থব্দে একমনে আমার দায়িত্ব পালন করে গেছি। ব্যাংকের নুন নিমক যেটুকু খেয়েছি, সব
সময় তারচেয়ে বেশী ফিরিয়ে দেবার আপ্রান চেষ্টা করেছি, দিয়েছিও তাই। যেসব স্বনামধন্য
ব্যবস্থাপকদের অধীনে পনের বছর চাকুরী করেছি, তারাও আমাকে তাদের আপন ছোটভাইয়ের মত
ভালবাসতেন। আমার প্রতি তাদের সন্তুষ্টি ছিল শতভাগ। আমার কোন বস ব্যবস্থাপক স্যারই আমার
প্রতি কখনও রুষ্ট কিংবা বিরক্ত হননি কিংবা দায়িত্বে এমন কোন অবহেলা পাননি যে ফাইলে
বর্শা নিক্ষেপ করবেন। এমন কি আমাকে কোন ‘মেমো’ দেওয়ার সৌভাগ্য আমার বিরল প্রজাতির
বস সিরাজুল হক চৌধুরীর কপালেও জুটে নি।
একদিন অফিসে গিয়ে বসতেই আদনান
কুরেশী বলল, স্যার আপনি তাড়াতাড়ি মনির মিয়ার বাসায় যান। আমি বললাম কেন? সে জবাব
দিল আমার একজন সিসি ঋনগ্রাহক দৌলতপুরবাসী আব্দুল মালেক তাকে বলেছে সে মনির আহমদ
একাডেমিতে গিয়ে নিজকানে শুনে এসেছে কিছুলোক পরিচালক স্যারের কাছে আমার বিরুদ্ধে মৌখিক
ভূয়া অভিযোগ করছে ও তুষামুদি করে উসখানি দিচ্ছে। এই গ্রাহকই আদনানকে বলেছে, স্যার
একজন পরোপকারী ফেরেশতা মানুষ, এই লোকগুলো ডাহা মিথ্যা কথাবার্তা বলে একজন ভাললোকের
গুরুতর ক্ষতিকরে ফেলতে পারে, কুরেশী স্যারকে বলুন তিনি এক্ষুনি পরিচালক মনির সাহেবের
কাছে গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলে আসেন।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত
কোন ঘটনা কারও সাথে আমার ঘটে নি। গ্রাহক সেবায়ও আমাদের কোন গাফলতি নেই। আমি জানিনা
তাকে কে কি অভিযোগ করেছে। আমি আদনানকে বললাম মনির সাহেব আমাকে ডাকলে যাব এবং সব
বুঝিয়ে বলব। আমি যে বিষয়ে কিছুই জানিনা যেচে কেন তার কাছে গিয়ে জানতে চাইব আমার
বিরুদ্ধে কে বা কারা কি অভিযোগ করেছে। সাগরদিঘীরপার আমার বাসার পাশেই মনির আহমদের
বাসা ‘আহমদ ভিলা’, তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হলেও এবিষয়ে আলাপে বিরত রইলাম।
আমি ইসফাক কুরেশীর কাছে কেউ কারও
বিরুদ্ধে নালিশ জানালে আমি দুই পক্ষের কথা না শুনে তড়িৎ কোন সিন্ধান্ত নেই না,
একপক্ষের কথায় কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করিনা। আমি বাদী ও বিবাদীর দু’পক্ষের কথা
শুনে দশজনের সাথে আলাপ করে প্রকৃত সত্য বের করার চেষ্টা করি। সত্য বের হলে তারপর
রায় নির্ধারন করি। আসামীকে বুঝিয়ে দেই তার কাজটি কেন অন্যায় হয়েছে। তারপর সঠিক রায়
তাকে মেনে নিতে প্রথমে উদ্ভুদ্ধ করি ও পরে চাপ দেই। আমার ধারনা ছিল আমার শুনা
অভিযোগের বিষয়টি সঠিক হলে মনির আহমদ এভাবেই অগ্রসর হবেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যেহেতু
পরিচালক মনির আহমদ আমার প্রতিবেশী ও কাছের লোক, বিপদে আপদে আমরা একে অন্যের পাশে
দাড়াই, তিনি অসুস্থ হলেই আমার চিকিৎসক পত্নী যখন তখন দৌড়ে দেখতে যান। তিনি অসুস্থ
হলে আমি ও ডাঃ নুরজাহান মনে পড়ে দুইদিন আমার গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে
ভর্তি করি। তাই ভাবি তিনি নিশ্চয় আমার কাছে অভিযোগের বিষয়টি জানবেন ও প্রকৃত সত্য
অনুধাবন করে যা করার করবেন।
এসব অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করার
জন্য ব্যাংকের অডিট বিভাগ রয়েছে। কেউ এসে কিছু দাবি করলেই ব্যাংকের ম্যানেজার দিতে
পারেননা। এখানে এসে সবাই যে সবকিছু চাওয়ামাত্র পেয়ে যাবে এমন নয়। তাই কেউ মিথ্যা
অভিযোগ দিতেই পারে। দুষ্টলোকদের অনেক অভিযোগই তদন্তে ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হয় এবং
এসব অভিযোগ শেষে নাকচ হয়ে যায়। মনির আহমদ অভিযোগকারীদের লিখিত অভিযোগ নিয়ে আঞ্চলিক
অফিসে জমা দিলে তারা সুষ্ট তদন্ত করে সত্যমিথ্যা বের করে দিত।
পরিচালক মনির আহমদ লন্ডনে গিয়ে
প্রচুর ভিত্তশালী হলেও তেমন শিক্ষিত লোক নন। তিনি সাধারন কিছু বাজে দুষ্টলোকের
অভিযোগ কোন ধরনের যাচাই বাছাই না করেই আমাকে দোষী সাব্যস্থ করলেন এবং ঢাকায় ব্যাংকের
বোর্ডসভায় বসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরীকে বললেন, কুরেশীর বিরুদ্ধে
লোকেরা অভিযোগ করছে তাকে রংপুর বদলী করে দেন। কমিটিতে বসা আমার আত্মীয়দের কাছ থেকে
এই বিষয়টি জানতে পেরে আমি যারপরনাই হতবাক হই।
আমার লেখা ‘ইসফাক কুরায়শী
রচনাসমগ্র’ মনির আহমদকে আমি বাসায় গিয়ে উপহার দেই। আমার ধারনা ছিল তিনি এই উপহার
পেয়ে দারুন খুশী হবেন কিন্তু তিনি খুশী হবার বদলে মনঃক্ষুন্ন হন বইটিতে তার
সম্পর্কে কিছুই লেখা না দেখে। আসলে প্রতিটি বইয়ের একটি বিষয়বস্তু থাকে। এই
বিষয়বস্তুর আওতায় না এলে কিছুই নিজের ইচ্ছেমত ঢুকিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
আব্দুল হালিম চৌধুরী আমার একটি
উপকার করলেন তিনি সিলেট পূর্বাঞ্চল প্রধান আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের পরামর্শে আমাকে রংপুর
কিংবা ঢাকা না পাঠিয়ে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে বদলি করলেন। সিলেটে অনেক এজিএম
চেয়ার বছরের পর বছর একই ব্যক্তিদের দখলে থাকলেও আমার জন্য সিলেটে কোন জায়গা হলনা,
আমাকে পাঠান হল নির্বাসনে ঢাকায়।
পরিচালক মনির আহমদকে দিয়ে
টেলিফোন করিয়ে ইতিপূর্বে আব্দুল মুমিত চৌধুরী, খলিলুর রহমান প্রমুখ অনেক এইচ এস সি
পাশেরা ব্যাংকের এজিএম হন। মনির আহমদের সুপারিশে তুরুকখলার একজন তরুণ আতিকুর রহমান
পূবালী ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পদে চাকুরি পান। পাঁচ বছর চাকুরি করার পর ধরা পড়ে
তার একাডেমিক সার্টিফিকেট জাল। ফলে তিনি বরখাস্ত হন। এসব ঘটনায় মনির আহমদের
ভাবমুর্তি যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়, তাই তিনি হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারের সুযোগ খোঁজছিলেন।
এবার তিনি তার ঘনিষ্ট প্রতিবেশী ও স্বীয় শিক্ষকপুত্র আমি ইসফাক কুরেশীকে তার ভাবমূর্তি
উদ্ধারের এক মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করলেন। সিলেট বিভাগ প্রধান সিরাজ সাহেব
বলছে- ইসফাক কুরেশী লোকটা কাজের না, চৌধুরীবাজার পাঠিয়ে তাকে শাস্তি দিলাম। আমার
কুটুম্ব এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরী সিরাজ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাতে পরিপূর্ণ সায়
দিচ্ছেন। ফলে পরিচালক মনির আহমদ ধরে নেন আমি ইসফাক কুরেশী একটা শিক্ষাদীক্ষাহীন অপদার্থ।
এই অপদার্থকে রংপুরে পাঠিয়ে দিলে উনার খুব সুনাম হবে, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, সেইসাথে
গাঁয়ে শতভাগ ক্ষমতার দাপটও দেখানো হয়ে যাবে- দাউদপুর চৌধুরী পরিবারের লোককে ধাক্কা
মেরে সুদূর রংপুরে বদলী করে দিয়েছি।
আমি লেখক ও কবি ইসফাক কুরেশী চেষ্টা
করি জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড সবার সাথে ভালকরে কাটাতে, কারন আমি সারাজীবন বেচে
থাকবনা কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো মানুষের মধ্যে সারাজীবন বেচে থাকবে। ইতিপূর্বে আমি
পচিশ বছরের চাকুরী জীবন পার করেছি, আমি হলফ করে বলতে পারি একজন গ্রাহকও কোনদিন আমার
বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে পারেনি। এমনকি আমার মনে পড়েনা আমি কোনদিন কোন গ্রাহকের
সাথে কোন ধরনের খারাপ অশুভ আচরন করেছি। যেখানেই গিয়েছি সেখানকার গ্রাহকরা আমাকে
মনেপ্রাণে ভাল পেয়েছে। চৌধুরীবাজার আমার বাড়ি, এখানে বসার পর যারাই এসেছে আমার
এলাকার লোক হিসাবে আইনের ভিতর যতটুকু সম্ভব আমি তাদের উপকার করেছি, মনে পড়ে না কাউকে
অকারনে কখনও ফিরিয়ে দিয়েছি।
আসলে ব্যবস্থাপক হওয়ামাত্রই
ব্যাংকের স্বার্থ ও আইনের জালে আমাদের হাত-পা শক্তভাবে বাধা পড়ে যায়। জেনেশুনে ব্যাংকের
ক্ষতিকরে কিংবা ব্যাংকের আইন ভঙ্গকরে দিতে হবে, এমন কিছু কেউ পাবার আবদার জানালে
আমার পক্ষে করার কিছু নেই। ব্যাংকের নুন খেয়ে নিমকহারামি করা আমি ইসফাক কুরেশীর
পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। এখানে আমি তাই সর্বদা আপোষহীন ছিলাম। যদিও আমি ব্যাংকের
কেউকেটা কেউ ছিলাম না কখনো। ব্যাংক হতে আমি খুব পেয়েছি এমনটি নয়, তাবে সামান্য যা
কিছু পেয়েছি তাই নিয়ে আমি ছিলাম চিরকৃতজ্ঞ।
এবার আমি আমার বিপক্ষে কয়েকটি অভিযোগের
বিষয় খানিকটা আলোচনা করব। আমি এখানে এসে ‘আদনান এন্টারপ্রাইজ’ নামে পয়ত্রিশ লক্ষ
টাকা লিমিটের একটি সিসি ঋন পাই। ঋণগ্রহীতা আদনান আহমদের বাড়ি দৌলতপুর। রাখালগঞ্জে
তার রড সিমেন্টের ব্যবসা খুব একটা ভাল যাচ্ছেনা। গত দুই বছর ধরে তিনি ঋনের সুদ দিতে
পারছেন না। তাছাড়া তার এই হিসাবে পর্যাপ্ত লেনদেন হয়না। দুইবছর আগে একটি দুইলক্ষ
টাকার ক্রেতাঋন দিয়ে ঔ টাকায় সিসিঋনের সুদ পরিশোধ করে স্থিতি লিমিটের ভিতর এনে সিসি
ঋণটি রিনিউয়েল করা হয়। পরের বছর এই ক্রেতা ও সিসি দুইঋণই মন্দঋনে পরিনত হয়। তখন
একটি পাঁচলক্ষ টাকার এসএমই ঋন দিয়ে মন্দ ক্রেতাঋনটি বন্ধকরা হয় ও সিসিঋনের সুদ
নতুন ঋনের টাকায় জমা দিয়ে লিমিটে এনে আবার রিনিউয়েল করা হয়। চৌধুরীবাজার শাখায়
বসেই আমার পর্যবেক্ষনে ধরা পড়ে মেসার্স আদনান এন্টারপ্রিজের নামে এসএমই ঋনের
কিস্তি আদায় হচ্ছেনা এবং সিসিঋনে লেনদেন নেই, ত্রৈমাসিক সুদ এসে এসে সিসিতে সীমাতিরিক্ত
স্থিতি বেড়েই চলছে। এসএমই ঋনের কিস্তির জন্য চাপ দিলে এবার আদনান আহমদ আমার কাছে
এসে আবদার জানালেন, আপনি আমাদের এলাকার লোক, আমাকে দশলক্ষ টাকার একটি এসএমই ঋন
দিলে গত দুই বৎসরের মত তিনি আগের এসএমই বন্ধ করবেন এবং সিসিঋনের মাত্রাতিরিক্ত সুদ
পরিশোধ করে সিসিঋনটি আর এক বছরের জন্য রিনিউয়েল করবেন, সেইসাথে পূর্বের ছোট মন্দ
এসএমই ঋণও বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি রাজি হলাম না, কারন এখানে ঋন
আর বাড়ালে পুরো টাকাই একসময় খেলাফি হয়ে যাবে। ফলে ব্যাংকের ক্ষতি আর বেড়ে যাবে।
এবার তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন উপমহাব্যবস্থাপক সিরাজুল হক চৌধুরী আমার চাচা তারেক
আহমদ চৌধুরীর কলেজ সহপাঠী, আগের ব্যবস্থাপক আব্দুল জব্বার সাহেব ময়মনসিংহের লোক হয়েও
আমাকে সহায়তা করলেন, আর আপনি দেশের মানুষ হয়েও আমাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। এই দুইঋনের
প্রায় বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা খেলাফি হবার পথে ছিল। তাই তাকে আমি বললাম আপনাকে কোন
নতুন ঋন দিতে না পারলেও একটা উপকার করে দিতে পারি, অন্য কোন ব্যাংক বা আর্থিক
প্রতিষ্টান হতে ঋন পেতে সাহায্য করতে পারি। দরগাগেটে মুসলিম সাহিত্য সংসদের চার
তলায় প্রাইম ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপক আমার পরিচিত, তার মাধ্যমে একটি বড় ঋন পাশ করে
আপনার এখানকার ঋনগুলো বন্ধ করে দিতে পারি। প্রাইম ফাইন্যান্স আমাদের সাথে আলাপ করে
ষাট লক্ষ টাকা কিস্তিঋন দিতে রাজি হয়ে গেল। আমার বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা আদায় করি যা শ্রেনীকৃত
হবার হাত হতে রক্ষা পেল এবং ঋন দিয়ে প্রাইম ফিন্যান্স প্রথম কিস্তি আদায়েই বিপদে
পড়ল।
আদনান এন্টারপ্রাইজের এই দুইঋন
আদায়ে অচিরেই আমাকে অর্থঋন আদালতে যেতে হত। আমি তাই আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায়
করি তিনি আমাকে কোর্ট কাচারির ঝক্কি ঝামেলা হতে বাঁচিয়ে দিলেন।
একদিন আদনান আহমদ সিলেট পুর্বাঞ্চলিক
অফিসে গিয়ে উপমহাব্যবস্থাপক সিরাজুল হক চৌধুরীকে বললেন, আমি ব্যাংকের অনেক পুরাতন
গ্রাহক অথচ চৌধুরীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক কুরেশী সাহেব এত অনুরোধ সত্বেও আমাকে ঋন
না দিয়ে তাড়িয়ে দেন। অন্য ব্যাংক চাওয়ামাত্রই আমাকে ষাটলক্ষ টাকা ঋন দিয়েছে। এবার সিলেট
পূর্বাঞ্চলিক অফিস হতে কারন দর্শাও নোটিশ পেলাম, আমি কেন অঞ্চলিক অফিসকে অবগত না
করে ব্যাংকের পুরানো ঋন গ্রাহক মেসার্স আদনান এন্টারপ্রাইজকে বিদায় করে দিলাম। আমি
তথ্য প্রমান সহ জবাব দিলে সিলেট পূর্বাঞ্চলিক অফিস শান্ত হয়ে যায়।
এই আদনান মনির আহমদ একাডেমিতে
গিয়ে পরিচালক মনির আহমদকে এই একই গাজির গীত শুনালেন। ঋন আদায়ে প্রাইম ফিন্যান্সের
আইনি চাপে পড়ে নাস্তানাবুদ আদনান আহমদ তার দুরাবস্তার জন্য আমাকে আসামি সাব্যস্ত
করলেন। আমার পূর্বের ব্যবস্থাপক আব্দুল জব্বার সাহেব ক্যাশের লোক ছিলেন। ঋন কিংবা
জেনারেল ব্যাংকিং সম্পর্কে তার তেমন ধারনা ছিলনা। তাই তার আমলে আদনান সাহেব পূবালী
ব্যাংকে ধানাই ফানাই করে দুই বছর বেশ আরামে পার করলেন। কিন্তু আমার হাতে তিনি আটকা
পড়লেন। প্রাইম ফিন্যান্সে গিয়ে তিনি ষাটলক্ষ টাকা ঋন পেলেও বিপদে পড়লেন। তাই
পুবালী ব্যাংকের পরিচালক মনির আহমদকে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে আমার বিরুদ্ধে নানা
কথাবার্তা বলে তার মনের জাল মেঠালেন।
দ্বিতীয় অভিযোগকারী এম আহমদ। পরিচালক
মনির আহমদের কাছে তার অভিযোগ তিনি ঋন পাচ্ছেন না। আমি তাকে ঋন পেতে সহযোগিতা
করছিনা। ইতিপুর্বে তার দুইটি এসএমই কিস্তিঋন আদায়ে আমরা বিপদে ছিলাম। আব্দুল
জব্বারের দেওয়া এই দুইটি ঋন কোনমতে আদায় হচ্ছেনা। তিনি একজন ধনীলোক অথচ ঋনের
কিস্তি দিতে অসম্মত। একদিন আমাকে বললেন হোসেনপুর গ্রামে তার বিশাল মৎস্য ও
পোল্ট্রি খামার রয়েছে। তিনি আমাকে তার খামার দেখাতে চাইলে আমি সময় দিতে পারিনি। শীতের
কোন একদিন আমি একাকি হেঁটে হেটে তুরুকখলা দক্ষিনপাড়া মসজিদে গিয়ে আসরের নামাজ পড়ি।
দক্ষিনের হাওরের ওপারে হোসেনপুর গ্রাম। ধান্যবিহীন মাঠ, কেবল মরা ধান্যনেড়া আকাশ
পানে তাকিয়ে আছে। হাওরের আল বরাবর লম্বা হাটা দিলাম। জনহীন মাঠে কিছু দৌড়ও দিলাম।
হাওরের অপারের গ্রাম যত কাছে দেখা যায়, আসলে তত কাছে হয়না। গলদঘর্ম আমি গোধূলী বেলার
সামান্য আগে হোসেনপুর গ্রামে এম আহমদের খামারে পৌছলাম। বড় বড় তিনটি পুকুর,
পুকুরপারে মোরগখামার ও পাহারাদারের টংঘর। তার পাহারাদার পরিবার আমাকে চা দিতে
চাইলে আমি ডায়বেটিস রোগী বলে পার পাই।
এম আহমদ আমার কাছে বড় অঙ্কের
সিসি ঋণ চাইলেন। আমি তাকে বললাম, সি সি ঋণের জন্য জমি বন্ধক রাখতে হয় এবং পুরানো
ব্যবসা লাগে। তিনি হোসেনপুরের খামারের জমি বন্ধক রাখতে রাজি হন। কিন্তু মৎস্যখামার
দিয়ে সিসি ঋন হয়না। সিসি ঋন দিতে হলে দোকান লাগে, দোকানের স্টক লাগে, দোকানের
ব্যবসার নামে চলতি হিসাব থাকতে হয়। এই ব্যবসার অন্ততঃ এক বছরের লেনদেন ও তিন বছরের
লাভক্ষতির ব্যালেন্স সিট দেখাতে হয়। এম আহমদের যে কোন দোকান ব্যবসাই নেই। তাকে আমি
সিসিঋন দেই কেমন করে।
একদিন এম আহমদ প্রস্থাব দেন তিনি
সাইনবোর্ড লাগিয়ে একটি ভূয়া দোকান তৈরি করবেন। ভূয়া স্টক, ভূয়া ব্যবসা সাজাবেন।
আমি যেন তাকে এসব দেখায়ে ঋন দেই। আমাকে আর শোনালেন অঞ্চলপ্রধান সিরাজুল হক চৌধুরী
তার খাতিরের লোক, তিনি নাকি দুইদিন হোসেনপুর গিয়ে তার খামার দেখে এসেছেন। শোনালেন দরকার
হলে এই সিসি ঋনের জন্য তিনি পরিচালক মনির আহমদকে ধরবেন।
তিন নম্বর অভিযোগ ছিল বেশ
বৈচিত্রময়। একদিন দেখি শাখার বাহিরে লোকজনের ব্যাপক হৈ চৈ। খবর পেলাম আমাদের সিসি
গ্রাহক এ উদ্দিনকে সিরাজপুরের লোকজন ধরে আটকে রেখেছে। এ উদ্দিনের গ্রাম তুরুকখলা ও
সিরাজপুরবাসীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মনির আহমদ একাডেমির মাটিকাটার ঠিকাদারি এবং
ব্যাংকের সিসিঋনের টাকা তুলে উচ্চসুদে গরীবদের মধ্যে খাটান এ উদ্দিন। ব্লাঙ্ক চেকে
ঋণগ্রহীতাকে দস্তখত করিয়ে এনআই এক্টে মামলা করে ইচ্ছেমত সুদ আদায় করে এ উদ্দিন ধনী
হন। এ উদ্দিনের অন্য ব্যবসা হল এলাকার সব ভেজাল জমি কেনাবেচা। তিনি প্রচুর টাকা
খরচ করে ব্যাংকের কাছে ধানক্ষেতে একটি রঙ্গীন চারতলা ভবন নির্মান করেন।
সিরাজপুরের এই মারামারির ঘটনার
তিনচার দিন আগে এ উদ্দিন সিরাজপুরে তার বন্ধক রাখা জমিতে ‘এই জায়গার মালিক পূবালী
ব্যাংক’ লিখে একটা সাইনবোর্ড শীঘ্রই টাঙ্গিয়ে দিতে আমাকে অনুরোধ জানান। আমি বললাম
সাইনবোর্ড আবশ্যই টাঙ্গাবো, তবে লিখব ‘এই জমি পূবালী ব্যাংক লিঃ চৌধুরীবাজার শাখায়
দ্বায়বদ্ধ’।
কোন ঋণগ্রহীতাই এধরনের সাইনবোর্ড
বন্ধকি জমিতে লাগাতে চায়না, এটা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে। ব্যাংকও কেবল বাধ্য
হলে এমন সাইনবোর্ড টাঙ্গায়।
এবার এ উদ্দিনের অনুরোধের অর্থ
খোঁজে পেলাম। নথি খোঁজে দেখি সিসি ঋণটির পর্যাপ্ত জমি বন্ধক থাকা সত্বেও
সিরাজপুরের ভেজাল জমি এই কিছুদিন আগে সংযুক্ত করা হয়। ভেজাল জমি ব্যবস্থাপকরা কখনও
গ্রহন করেনা। কারন ঋণটি খেলাফি হলে কিংবা নিরীক্ষায় ধরা পড়লে এই ভেজাল জমি
সিকিউরিটি হিসাবে রাখার জন্য সেই ব্যবস্থাপক নির্ঘাত বিপদে পড়বে। এখানেও এ উদ্দিন
পরিচালক মনির আহমদকে দিয়ে ফোন করিয়ে ব্যবস্থাপককে এই ভেজাল জমি বন্ধক নিতে বাধ্য
করেন।
এই জায়গার মালিক তিন ভাই, কিন্তু
এ উদ্দিন দুই ভাইয়ের দস্তখতে জমিটি কমদামে কিনে ফেলে। এবার তৃতীয় ভাইয়ের পুত্ররা তাদের
বাবার অংশ দাবী করে জমিটি দখল করে নেয়। এখানে এ উদ্দিন প্রচুর গাছ লাগান। আমি একদিন
বাটিয়ার চরের রাস্থা দিয়ে হেঁটে সরজমিনে গিয়ে দেখি জমির সব গাছ দখলকারীরা কেটে
ফেলেছে। তাদের নামে জমির মালিকানা সাইনবোর্ড লাগানো আছে।
এ উদ্দিন তার পুত্র, শালা এবং
মাটিকাটার ট্রাক্টরে কয়েকজন ভাড়াটিয়া লাটিয়াল নিয়ে জমি উদ্ধারে যান। তিনি সিরাজপুর
গ্রামে ঢুকে পড়লে এই গ্রামবাসীর ইজ্জতে আঘাত লাগে। সিরাজপুরবাসী একজোট হয়ে আক্রমন
করে বসে, ট্রাক্টরের লাটিয়ালরা ভয়ে পলায়ন করে। কেবল বাপ বেটা ও শালাকে ধরে
সিরাজপুরবাসী চোরপেঠা করে। এই গ্রামের আতর আলীর পুত্ররা তাদেরকে প্রাণে মারার হাত
থেকে বাচায় এবং পরে পুলিশ এসে আহত বাপ বেঠা ও শালাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
‘এই জমি পূবালী ব্যাংকের কাছে
দায়বদ্ধ’ সাইনবোর্ড লিখা হয়ে গেছে কিন্তু টাঙ্গানোর আগেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যেই সিলেট পূর্বাঞ্চলিক প্রধান আহমদ এনায়েত
মনজুর উপযুপরি কয়েকবার ফোন করেন এখনই যেন সাইনবোর্ড টাঙ্গাই। এ উদ্দিন সাইনবোর্ড
টাঙ্গানোর এই সামান্য ব্যাপারে পরিচালক মনির আহমদকে দিয়ে অঞ্চলপ্রধানকে ফোন
করিয়েছে। আমি এই সাইনবোর্ড বসাতে সময় নেই, কারন যদি আমার কর্মিদের উপর প্রতিপক্ষ
হামলা করে বসে। এই হামলা হবে আমার উপর এবং আমার মানসম্মান যাবে। আমি সিরাজপুর
গ্রামের মুরব্বীদেরকে ডাকি, বিষয়টি বুঝিয়ে বলি, তারপর তাদের সম্মতি নিয়ে এই
সাইনবোর্ড আমাদের গার্ড পাঠিয়ে স্থাপন করে দেই। কিন্তু আমি চৌধুরীবাজার শাখা হতে
বদলী হয়ে চলে আসামাত্রই প্রতিপক্ষ এই সাইনবোর্ডটি উপড়ে ফেলে দেয়।
এ উদ্দিন চেয়েছিলেন ব্যাংককে
লড়াইয়ে পাঠিয়ে তার ভেজাল জমি উদ্ধার করাবেন। পরিচালক মনির আহমদকে ব্যবহার করে
ব্যাংকের লাটি বন্দুক তার জমি উদ্ধারে নিয়ে যাবেন। এই সাইনবোর্ড টাঙ্গাতে সঙ্গত
কারনে যে দুইচার দিন দেরি হয়েছে এই অপরাধে এ উদ্দিন সম্ভবত পরিচালক মনির আহমদকে
অভিযোগ করেন আমি খারাপ লোক, আমার কাছে এসে তিনি কোন সহযোগিতা পাননা।
আসলে এই এ উদ্দিনের মত মানুষগুলো
এমন যে এরা স্বার্থের জন্য যে কাউকে যেমন লাত্থি মারতে পারে, তেমনই স্বার্থ আদায়ে যে
কারও পায়ে ধরতেও জানে।
এই এত মানুষগুলোকে কে বা কাহারা
একজোট করে পরিচালক মনির আহমদের দরবারে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা নালিশ দিতে পাঠালো সেই
রহস্য আজও আমার অজানা রয়ে গেল। পরিচালক মনির আহমদও কেন সত্যমিথ্যা পরখ না করে
একান্ত আপনজন হয়েও আমার চাকুরী জীবনের সমাপনী পর্বে চাকুরিটাকে বরবাদ করে
দিলেন।
পরিচালক মনির আহমদ একদিন শাখায়
আসেন। ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক শাহানা আক্তার এসে তাকে সালাম দিল। একটু পরেই আমাকে
বললেম- ভাই, মছব্বিরের এই মেয়েটাকে এখানে রাখছ কেন, তাকে শহরে পাঠিয়ে দাও। বাড়ির
কাছে এদেরে এত আরামে থাকতে দেয়া ঠিক নয়। পরিচালক মনির আহমদ হয়ত জানেন না এই শাখার
কাউকে বদলী করার ক্ষমতা আমার নেই, এই ক্ষমতার মালিক অঞ্চলপ্রধান।
শাহানা আক্তার আমার একজন নিরীহ ও
ভাল কর্মি। এখনও তার বিয়ে হয়নি। তরুণী মেয়েটিকে আমি কেন সিলেটে পাঠিয়ে ঝামেলায়
ফেলব। শাহানাকে কেবল বলে দিলাম পরিচালক স্যার আসলে সে যেন তার সামনে না পড়ে এবং সম্ভব হলে লুকিয়ে থাকে।
মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে আমার বদলির
আদেশ শাখায় আসতেই আমার সহকর্মীরা আদেশপত্র নিয়ে আমার চেম্বারে প্রবেশ করল। বিষন্ন
মনে তারা আমাকে বলল, এটা দারুণ অন্যায়, সিলেট শহরের অনেক চেয়ারে একই এসপিও/
এজিএমগন বছরের পর বছর পার করছেন, আর এত এত চেয়ার থাকতে আপনাকে পাঠানো হল
মৌলভীবাজার। তাও আবার এখানে আসার মাত্র পনের মাসও হয়নি। স্যার আপনি এর বিহিত কিছু
একটা করুন, নইলে আগামীতে চাকুরী করতে পারবেন না। আপনাকে ওরা ফুটবল খেলার বল বানিয়ে
ফেলবে।
মনে মনে বলি, তোমরা জাননা রে
বাচ্চারা, পূবালী ব্যাংকে আমার প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ট লোকদের সৌজন্যে আমি
খেলার বল ইতিমধ্যে হয়েই গেছি। আমার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রের সামান্য গন্ধ পেলেও তখনও
জানতাম না কে বা কাহারা? কেন? আমাকে বদলী করেছে।
মনির আহমদ আমাকে না জানিয়ে বদলী
করবেন এমনটা আমার বিশ্বাসও হচ্ছিল না। এবার এই বদলির কান্ডারী পরিচালক মনির আহমদকে
ফোন করি- স্যার, আমি আপনার লোক, আপনাকে না জানিয়ে আমাকে মৌলভীবাজার বদলী করা হয়েছে,
তা কি আপনি জানেন। তিনি জবাব দেন ব্যাংক যে কাউকে বদলি করতে পারে, এতে আমার জানা নাজানার
কি আছে। তার কথাবার্তা হতে বুঝি এতে তার সায় আছে।
এবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল
হালিম চৌধুরীকে ফোন করি। তিনি জবাব দেন আপনি মৌলভীবাজার যোগ দিন নইলে ঢাকা আসতে
হবে। বলেই তিনি লাইন কেটে দেন। বুঝে ফেলি এখানেও কথাবলা অর্থহীন। তারপর চাচাত ভাই
শফি আহমদ চৌধুরীকে ফোন করি। তিনি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। তিনি কি করলেন আমি আর
খবর নেইনি। খুবসম্ভব তিনি আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের সাথে এনিয়ে আলাপ করেছিলেন।
এইসব অন্যায় অপমানে একবার মনে হল
তারচেয়ে চাকুরি হতে ইস্তোফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাই। পূবালী ব্যাংকে যাদের কেউ
নেই তারা সিলেটে আরামে চাকুরী করছে, পদোন্নতি নিচ্ছে, আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে
শুরু করে পরিচালকরা সবাই আত্মীয়স্বজন হওয়া সত্বেও আমি জেআইবিবি সনদধারী ও ডাবল
মাস্টার্স ইসফাক কুরেশী এখানে মানসম্মান নিয়ে একটু শান্তিতে চাকুরী করতে পারছিনা।
একদিন আমার সুহৃদ মশিউর রহমান
খান বললেন, সিরাজ-হালিম সাহেবচক্র আপনাকে এতই বিনষ্ট করে ফেলেছেন যে, সত্বর চাকুরী
ছেড়ে মানসম্মান বাঁচান। সিলেটে ও ঢাকায় পরিকল্পিতভাবে আপনাকে এরা পচিয়ে ফেলেছে।
এমনকি তারা আপনাকে ব্যাংক হতে তাড়াতে এমন কিছু করে বসতে পারে যাতে আপনি চাকুরী
ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এম আর খান আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বললেন,
আপনার মত সামর্থ্য থাকলে আমি সেই কোনদিন যে এই চাকুরী হতে ইস্তোফা দিতাম। আমার
অন্য কোন উপায় না থাকায় নিতান্ত ঠেকায় পড়ে এখানে আছি। তার এই বক্তব্যগুলো হতাশাভরা
হলেও যে একশত ভাগ সত্য তা পরে পদে পদে টের পাই। সময়ের আবর্তনে চাকুরীক্ষেত্রে একটির
পর একটি ঘটনা আমার সামনে ঘটে যা তার এই মূল্যবান কথামালার সত্যতার একেকটা অকাঠ্য প্রমাণ
হয়ে হাজির হয়। মশিউর রহমান খানকে তখন আমার একজন ভবিষ্যতদর্শী ষষ্ট ইন্দ্রীয়ের লোকই
মনে হল।
এবার আমার সামনে দুটি পথ খোলা
থাকে- হয় মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে যোগদান, নয়ত চাকুরী হতে ইস্তোফা দিয়ে এই
বেইজ্জতখানা হতে সরে পড়া। যেখানে দাম নেই, সম্মান নেই, পদে পদে কেবল লাঞ্ছনা;
মগডালে বসা ঘনিষ্ঠদের আচরণে নেই কোন ন্যায়নীতি কিংবা বিবেকবোধ। তারা পুবালী ব্যাংকে
কায়েম করেছেন এক মৎস্যন্যায়ের শাসন। মনে হল এখানে থাকার চেয়ে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে
ভিক্ষে করে খাওয়াও হয়ত উত্তম।
১১ এপ্রিল ২০১৫ সাল। দিনটি
চৌধুরীবাজার শাখায় আমার শেষদিন। এখানে আমার আগমন যেমন সম্মানের ছিলনা, বিদায়ও সসম্মানে
হলনা। মাত্র পনের মাস ছিলাম। জীবনের অর্ধশততম বর্ষটি আমার প্রিয় জনমমাটিতে পার
করলাম। এখানকার ধুলামাটিতে বড় হওয়া আমি ছূটে গেলাম পৈত্রিক বাড়ি। পুকুরঘাট, পিছনের
বাশঝাড়, মাবাবার স্মৃতিগৃহ, উত্তরের গড়ের মাঝ, সবকটি ঘর একে একে দেখে এলাম। কাল থেকে
আর কবে আসব তার কোন ঠিকানা নেই। তারপর এলাম হজরত শাহজালালের(রঃ) ৩৬০ আউলিয়ার
অন্যতম হজরত শাহদাউদ কুরেশীর(রঃ) পবিত্র মাজার জেয়ারতে। কাছেই দাউদপুর মাদ্রাসায়
গিয়ে হুজুরদেরকে নিয়ে সামনের পারিবারিক গোরস্থানে মাবাবার মাজার জেয়ারত করি দীর্ঘ সময়
নিয়ে। একে একে জীবিত অজীবিত সবাইকে এভাবে শ্রদ্ধা ও বিদায় জানিয়ে ব্যাংকে ফেরে
এলাম।
বিকেলে আমার অনেক প্রিয়জন,
মছব্বির ভাই, সুহৃদ গ্রাহক, বাজারের লোকজন এসে শাখায় ভীড় জমান। একটি ছোট্ট সভা হল।
সভায় অনেকের স্মৃতিকথা শুনলাম, চোখ মুছলাম। আমি কিছুই নেবনা শুন্যহাতে চলে যেতে
চাই, বলা সত্বেও দিনে আদনান ও কাশেম মোটরসাইকেলে সিলেট ছুটে গেল। একটি প্যান্ট ও
শার্ট পিস তারা আমার হাতে তুলে দিল। সবাই আমার সাথে অনেক ফটো তুলে। রাতে আমি গাড়ি
স্টার্ট দিলাম। গাড়িতে পাশে বসলেন পিজূস বাবু। পিছনে সিটে বসেন গার্ড আব্দুন নুর,
আব্দুল কাশেম, মাজেদা আক্তার এবং শাহানা। তারা আমাকে বিদায় জানাতে সিলেট পর্যন্ত
চলে আসে।
ব্যাংকে প্রবেশের অনেক আগে যে
শাখার জন্ম দেখেছি। ব্যাংকের চেয়ারম্যান চাচাতো ভাই ই এ চৌধুরী ও ঘনিষ্ঠজন পরিচালক
মনির আহমদকে এসে শাখাটি উদ্বোধন করতে দেখেছি। যে শাখার প্রথম ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদের
হাত ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি হিসাব খোলাতে। যেখানে গিয়ে অনেকবার অস্থায়ী ব্যবস্থাপকের
দায়িত্ব পালন করেছি, যে চৌধুরীবাজার শাখায় মিশে আছে আমার এমন অনেক অনেক স্মৃতিমালা,
সেই চৌধুরীবাজার শাখা আজ আমার জীবন থেকে ভাসী হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন