মাইগ্রেশন ভিসা লাভ এবং যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রথম অভিযাত্রা- নিউইয়র্ক,
ওয়াশিংটন, রালী, কলম্বিয়া, আটলান্টা হয়ে আটলান্টিক উপকুল সফরঃ
যাত্রার তারিখঃ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সাল, ফেরার তারিখঃ ১৮ অক্টোবর ২০১৫ সাল, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানঃ
৩৩ দিন
আমি এমন একটি রাষ্ট্রের ভ্রমনকাহিনী
লিখতে বসেছি, যাকে বলা হয় স্বপ্নের দেশ, অমিত সম্ভাবনার দেশ। কেউবা বলেন- একমুখো
সড়ক (One way root), যেখানে কেউ একবার কোনমতে ডুকে গেলে আর ফিরে
আসেনা। এক অদৃশ্য আকর্ষন তাকে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়। তার মাইন্ড সেটিং পরিবর্তন করে
ফেলে। ধনী গরীব যিনিই দেশটিতে প্রবেশ করেন, তিনিই নিজের অজান্তে দেশটির মায়াজালে
আবদ্ধ হয়ে যান। এই দেশটি আধুনিক সভ্যতার ধারক, বাহক ও কেন্দ্র মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর ইতিহাসে এক এক যুগে এক একটি রাষ্ট্রের হাতে পৃথিবীর
জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধন-ঐশ্যর্য, ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয়। প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রে
ছিল চীন, আসিরিয়া, মিশর ও ব্যাবিলন। তারপর আসে গ্রীক ও পারসিকরা। গ্রীকদের পর
রোমানরা বিশ্বসভ্যতার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। মধ্যযুগে কিছুকাল মুসলমানরা
সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রন করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর বারোক যুগে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর বিশ্বসভ্যতার
নিয়ন্ত্রন চলে যায় পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
উপনিবেশিক শক্তি বৃটেন, ফরাসী ও পর্তুগীজদের হাত হতে বিশ্বশক্তির নিয়ন্ত্রন ধীরে
ধীরে পেয়ে যায় রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯০ সালের পর রুশ প্রেসিডেন্ট
গর্বাসেভের পেরেস্ট্রাইকা ও গ্লাসনষ্টের প্রভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর একক পরাশক্তি এবং একছত্র নিয়ন্ত্রকে পরিনত হয়।
দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,
যাহা ৫০টি আলাদা আলাদা পতাকা, সরকার, আইনসভা, রাজধানী বিশিষ্ট রাষ্ট্রের সম্মিলিত
মহাদেশ। দেশটির আয়তন ৩৭, ৯৬, ৭৪২ বর্গমাইল। এই পঞ্চাশটি রাজ্য ছাড়াও একটি
কেন্দ্রশাসিত ডিস্ট্রিক কলম্বিয়া ও পাঁচটি টেরিটরী রয়েছে। মূল ভূখন্ড হতে শত শত
মাইল দূরে রয়েছে হাওয়াই, আলাস্কা এবং গোয়াম দ্বীপ। দেশটি এত বড় যে পাশাপাশি বিছানো
৬৮টি বাংলাদেশ কিংবা ৪০টি বৃটেনের আয়তনের সমান। আয়তনে রাশিয়া ও কানাডার পরই
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ক্যানাডা ও রাশিয়া বরফে ঢাকা হলেও ভাগ্যবান
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে সীমাহীন শস্য শ্যামল ভূমি ও মূল্যবান খনি।
বৈচিত্রময় দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
এখানে প্রতিটি স্টেইটে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্মারক চিহ্ন, আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতি,
বৃক্ষলতা ও জীবন বৈচিত্র। প্রতিটি স্টেইটে রয়েছে পর্যটকদের দেখার জন্য স্পেশাল
কিছু না কিছু চমক। উত্তরের স্টেইটগুলো শীতল, দক্ষিনের উষ্ণ এবং মধ্যভাগ
নাতিশীতুষ্ণ। আলাস্কা বরফে আবৃত আবার নেভাদা মরুময়। কার্লিফোনিয়ায় বিরাজ করে
চিরবসন্ত। প্রশান্ত মহাসাগরের অথৈ জলরাশিতে ভেসে আছে হাওয়াই। ফ্লোরিডায় রয়েছে
একেবারেই বাংলাদেশের আবহাওয়া ও বৃক্ষলতা। আমাদের ঘরের কাছে এশিয়ায় তাদের গোয়াম
টেরিটিরী।
প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পাঁচটি সাম্রাজ্যেরও একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলো হল
চীনের তাং সাম্রাজ্য, মোঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ সাম্রাজ্য ও মার্কিন সাম্রাজ্য। দেশটি
প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বসেরা। মহাকাশ গবেষনা ও অভিযান, পারমানবিক ও
জেনেটিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও তথ্য প্রযুক্তিতে দেশটির শ্রেষ্টত্ব রয়েছে।
১৯৭৪ সালে আমার মেঝমামা ফজলুর
রহমান চৌধুরী মামী কোহিনূর চৌধুরীর হাত ধরে আমেরিকায় পাড়ি জমান। আমি যৌবনে আমেরিকা
যাবার স্বপ্ন দেখতাম। ১৯৮৬ সালে নিউজার্সির আটলান্টিক কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হই।
মেঝমামা স্পন্সর (Affidebit in financial support) করেন। কলেজ
হতে আই-২০ হাতে আসে। মতিঝিল আদমজি কোর্টে ছিল ইউ এস ভিসা ইন্টারভিউ অফিস। শেষরাতে
এসে এখানে লাইনে দাড়িয়ে স্টুডেন্টস ভিসা ইন্টারভিউ দেই। লাল ড্রেস পরা একজন
শ্বেতাঙ্গিনী আমার ইন্টারভিউ নেন। কিন্তু ভিসা পাইনি। দুইদিন পর আবার আবেদন করলে
তেমন কোন ইন্টারভিউ না নিয়েই পাসপোর্টে রিলিজ সিল মেরে ফেরত দেয়। সেদিন প্রতিজ্ঞা
করি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর কখনও ভিসা চাইবোনা। পরবর্তীকালে অনেক দেশ সফর করেছি
কিন্তু আমেরিকান এম্বেসীতে ভিসার জন্য যাইনি। তবে আমি আল্লাহ পাকের কাছে যাহা চাই,
একটা সময় তা পেয়ে যাই। হয়ত মহান আল্লাহ ঐ সময় ছাত্র ভিসা পাওয়া আমার জন্য সঙ্গত
মনে করেন নি, অথচ সেই ছাত্রভিসা আবেদনের উনত্রিশ বছর পর আমার সমনদিক জামিল আহমদ
চৌধুরীর আবেদনে ইউ এস এম্বেসি আমাদেরকে ডেকে নিয়ে মাইগ্রেশন ভিসা প্রদান করে। আমি,
আমার বেগম ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী এবং একমাত্র পুত্র জেফার রহমান যুক্তরাষ্ট্রের
অভিবাসী ভিসা পেয়ে মহান আল্লাহ পাকের প্রতি হাজার শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল রোজ
মঙ্গলবার। ইতিহাদ এয়ারলাইনের একটি বিমানে রাত সাড়ে নয় ঘটিকায় ঢাকা ছাড়ি। রাত
আড়াইটায় আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। এখানে ইউ এস হোমল্যান্ড
সিকিউরিটি আমাদের যাবতীয় ইমিগ্রেশন কাজ সম্পন্ন করে। রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে বিশাল
আকারের একটি উড়োজাহাজ পাঁচশত যাত্রি নিয়ে আকাশে ডানা মেলে। প্রায় চৌদ্দঘন্টা উড়ে
নিউইয়র্ক সময় ১০ টা ৩০ মিনিটে আমাদেরকে নিয়ে জন এফ কেনেডি অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
অবতরণ করে। ঢাকা হতে নিউইয়র্ক পৌছতে সময় লাগে মোঠ ২০/২১ ঘন্টা। অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য
প্রায় বার হাজার মাইলের কম নয়।
ঢাকা হতে ম্যাপের সরলরেখায় বিমান
আবুধাবী যায়। কিন্তু আবুধাবী হতে নিউইয়র্ক যাত্রাপথ পশ্চিম বরাবর সরলরেখা ছিলনা।
আবুধাবি হতে বিমানটি উত্তরদিকে পারশ্য উপসাগর পার হয়ে ইরানে প্রবেশ করে। ইরানের
উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী ভূভাগ দিয়ে আমরা রাশিয়ায় প্রবেশ
করি। তারপর জার্মানী ও বাল্টিক সাগর অতিক্রম করে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ভূভাগের
উপর দিয়ে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের বিশাল জলরাশির উপর চলে আসি। ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে
পড়ি। যথাসময়ে এয়ার হোস্টেসগন খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে যান। চার পাঁচ ঘন্টা পর ঘুম
হতে জেগে মনিটরে দেখি বিমানটি গ্রীনল্যান্ড দ্বীপের উপর চলে এসেছে। মেরু অঞ্চলের
এই দ্বীপের কাহিনী আমি যৌবনে পড়েছি। তাই গ্রীনল্যান্ড দেখতে জানালা দিয়ে নিচে
তাকাই।
এই সেই বরফাচ্ছন্ন গ্রিনল্যান্ড
যার আয়তন আট লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গমাইল। এখানে এক্সিমো নামের এক অদ্ভুদ জাতি
রয়েছে, যারা ইগলু নামের সম্পূর্ন বরফে তৈরি ঘরে বসবাস করে। এখানে ছয়মাস দিন ও
ছয়মাস রাত থাকে। গ্রীষ্মের ছয়মাস এক্সিমোরা তাদের কুকুরের স্লেজগাড়ি চড়ে সিল মাছ ও
শ্বেত হরিন শিকার করে। গ্রীষ্মকালে শিকার করা মাংস নিয়ে ইগলুতে ঢুকে তারা কাটিয়ে
দেয় শীতের ছয় মাস। বিমানের নিচ দিয়ে তুষার ঝড় বইছে। সৈকতের কাছে সাগর জলে বরফের
অজস্র শিলাখন্ড ভাসছে। প্যাঙ্গুইন পাখি ও সিল মাছ দেখার প্রানান্ত চেষ্টা করি।
কিন্তু এত উপর হতে এসব প্রানী দেখা আদৌ সম্ভব নয়। গ্রীনল্যান্ড হতে আবার সাগরে
পড়ি।
আটলান্টিক পার হয়ে কানাডার
আকাশসীমা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঈশান কোনের স্টেইট মাইন, ম্যাসাসুটেট ও রডআইল্যান্ড
হয়ে নিউইয়র্ক জেএফকে বিমানবন্দরে অবতরণ করি। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা আবুধাবিতে সমাপ্ত
হয়ে যাওয়ায় জেএফকে দ্রুত বেরিয়ে আসি। বেল্ট হতে ছয়টি ব্যাগ ও তিনটি হ্যান্ডব্যাগ
দুইটি ট্রলীতে তুলে তিনজন বাহিরে এসেই মামাতো বোন রিপা চৌধুরীকে পেয়ে যাই। বেশ বড়সড়
একটি গাড়ি ড্রাইভ করে তিনি এসেছেন। পিছনের বড় বেনেটে সব মালামাল সহজে জায়গা হলো।
অনেক বছর পর মামাতো বোনকে দেখি।
মনে সংশয় ছিল এত বছরে খানিকটা দূর হয়ে গেলাম নাকি? তার মুখের দিকে তাকিয়ে অতীতের
স্মৃতি মনে হল এবং একটা দুঃখবোধও হল ওরা আত্মীয় স্বজন দেশখেস ছেড়ে সুদূর বিদেশ
বিভূইয়ে পড়ে আছে। গাড়িতে চড়ে বসলাম। রিপা গাড়ি চালিয়ে ৩০/৩৫ মিনিটে কুইন্সে তাদের
বাসায় পৌঁছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে টের পেলাম
সে-তো ঐ আগের রিপাই রয়ে গেছে। ১৯৯৪ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর আগের ছোট্ট রিপন।
বড়লেখার দক্ষিনভাগ গ্রামের ফ্রকপরা সেই বালিকা রিপন এখন দুইকন্যার জননী।
জৈষ্ট্যাকন্যা বারতম ক্লাশের ছাত্রি মুনিয়াত চৌধুরী জিন্সপ্যান্ট ও ট্রাউজার পরা
আমেরিকান কিশোরী। কনিষ্টা কন্যা নিয়ামা ছয় বছরের শিশু। সারাদিন ইংলিশে বকবক করে
বেড়ায়। সে স্কুলে যায়। আমেরিকায় স্কুলে বাচ্চাদের খাবার দাবার, খেলাধূলা, পড়ালেখা
সব দায় দায়িত্ব স্কুল কতৃপক্ষের উপর বর্তায়। তাই স্কুলে বাচ্চা পাঠিয়ে মা-বাবার
দায়িত্ব শেষ। বাচ্চাকে স্কুলবাসে তুলে দেয়া এবং কাছে নামিয়ে দিলে কেউ নিয়ে আসলেই
হলো। শিশুরাও স্কুলে যেতে খুব উদগ্রীব। আমেরিকান শিশুদের এক অতিপ্রিয় জায়গা হল
স্কুল।
বলা যায় আমেরিকা দেখা আমার
জীবনের একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নরাজ্যে আমি এখন হাজির। JFK
International Airport হতে বের হয়েই আমার স্বপ্নের দেশ আমেরিকার
রাস্থায় চোখ মেলি। শুনে এসেছি নিউইয়র্ক খুব ব্যস্ত নগরী। তাই ভাবনায় ছিল এখানে জাম
থাকবে, তাড়াহুড়া থাকবে, মানুষের হৈ চৈ থাকবে। কিন্তু দেখলাম উল্টো চিত্র। এক
প্রচ্ছন্ন শান্তি ও নীরবতা যেন শহরটাকে জড়িয়ে আছে। ঝকঝকে সুন্দর সুন্দর গাড়ি
দেখছি, সবগুলো শব্দহীন। রাস্থায় লোকজন তেমন নেই, যে দুইচার জন লোক দেখছি তাদেরকে
বেশ সুখী ও প্রশান্ত লাগছে। মানুষগুলো বাংলাদেশের লোকজনের চেয়ে অনেক সুঠাম ও তরতাজা।
মেঘহীন গাড় নীল আকাশ, উত্তাপহীন
ঝরঝরে রোদ, আমাদের অগ্রাহায়নের মত মিষ্টিশীতল আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। কারটি বড় বড়
রাস্থা দিয়ে যাচ্ছে, কোথায়ও সুড়ঙ্গ পথ, কোথায়ও মাথার উপর দিয়ে গড়গড় করে ট্রেন
যাচ্ছে। রাস্থার দুইপাশে বৃক্ষসারি ও বনভূমি।
দু‘তলা, ত্রিতলা, ওভারব্রিজ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌছি। এবার ব্যাগেজ
নামানোর পালা। রিপা হয়ত ভাবছে আমরা ব্যাগ টানতে অভ্যস্ত নই। ব্যানেট খোলে সে
টানাটানি শুরু করলে আমি ও জেফার গিয়ে শরীক হই। এদেশে নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে
হয়। ব্যাগগুলো এক এক করে বাসার সামনের রাস্থায় রাখি। এবার রিপার হ্যাজবেন্ড আরিফ
চৌধুরীর সাথে পরিচয় হয়। তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকেলী গ্রামের জাতক। তার চাচা
আওয়ামী লিগ নেতা সদ্যপ্রয়াত সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী।
অন্যচাচা ওলী হাউজিংয়ের স্বত্তাধিকারী শাহীন চৌধুরী। আরাফ চৌধুরীর সাথে মেলামেশা
হল। নিঃসন্দেহে তিনি একজন সজ্জন লোক। বিনয় ও ভদ্রতায় তিনি তুলনাবিহীন।
রিপার বাসা সুন্দর এবং
সুপরিকল্পিত। বাসার সামনে বাগান ও ড্রাইভ ওয়ে। অর্ধমাটির নিচে বেসমেন্টে একটি
ছোট্ট বাসা ভাড়া দেয়া আছে। ড্রাইভওয়ে গাড়িটির বাসস্থান। মাটি লেবেল হতে ছোট্ট সিড়ি
বেয়ে ৪/৫ ফুট নিচে নেমে বেসমেন্ট এবং ৪/৫ ফুট উপরে উঠলেই দুতলার বারান্দা। সামনে
হলুদ গাঁদা, লাল মরিচ ও সুন্দর ফুলবাগান। বাগানে প্রতিদিন খাদ্যকনা ছিটিয়ে দেয়া
হয়, পাখির ঝাঁক এসে খেয়ে যায়। বারান্দার দরজা দিয়ে ঢুকে একটি করিডোর, জুতা ও কাপড়
রাখার আলমিরা। একটি বড় ড্রয়িং রোম, ছয় ইঞ্চি উপরে ডাইনিং, কিচের ও বাথরোম।
ডাইনিংয়ের পিছনে বড় বারান্দা। এই বারান্দা হতে লোহার সিড়ি নেমে গেছে পিছনের বাগান
চত্বরে। এই বাগানে সাদা মরিচ, নাগা মরিচ, লেবু, কদু, শিম এবং নামনাজানা নানা
বিদেশী ফুল ফুটে আছে। এই বাগানে একটি ছোট্ট প্যান্ডেল, এই প্যান্ডেলে গায়েহলুদ,
জন্মদিন, পারিবারিক পার্টি ইত্যাদি অনুষ্টান করা হয়। বাগান চত্বরের চারদিকে চিকন
রডের জালি বেড়া। বেড়ায় লতাফুল ঝুলে আছে। ২য় তলার ড্রয়িং হতে একটি কাটের সিড়ি
তিনতলায় চলে গেছে। এই ত্রিতলায় তিনটি বড় বেডরোম ও দুইটি বাথরোম, একটি বড় ও অন্যটি
ছোট। সারাটা বাসা দামী কার্পেট মুড়ানো। অত্যাধুনিক বাড়িতে রয়েছে সেন্ট্রাল এসি ও
হিটার। গরম ও ঠান্ডা পানি লাইন। সবকিছু যান্ত্রিক, বাসাটি মার্ভেলাস।
মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ও
মামীর সাথে এবাসায় দেখা হল বহু বছর পর। মামামামি তাদের বড় কক্ষ আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে
ড্রয়িংরোমে রাতে ঘুমান। আমেরিকান বাসায় বেড ও ড্রয়িং কক্ষ সবই সমান। এখানে মশামাছি
না থাকায় মানুষ মশারী নামক জিনিসটা চেনেনা। বাসার তাপমাত্রা সবসময় একই থাকায় গায়ে
কম্বল জড়ালেও চলে, না জড়ালেও কিছু যায় আসেনা। একটু গরম কাপড় গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেই
স্বপ্নীল ঘুমে রাত পার হয়।
আমাদের সৌভাগ্য রিপা এখন কোন জবে
নেই। আমেরিকার দিন বাংলাদেশের রাত। তাই দিনে তন্দ্রাভাব কাটেনা এবং দিনের বেলা আমাদের
রাতের মত ঘুম হয়। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে জাগার পর রিপা আমাদেরকে নিউইয়র্কের আকর্ষন টাইমস্কয়ারে
নিয়ে যায়। টাইমস্কয়ার আমেরিকান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রচারনা ও বিজ্ঞাপন
এলাকা। রাতের টাইমস্কয়ার কোম্পানীগুলোর বিজ্ঞাপন বাতির নানারঙ্গের বিচিত্র আলোর
নাচনে ঝলমল করে। সড়কের আশপাশে বিশাল বিশাল নিয়ন বাতি ও মনিটরে একের পর এক বিজ্ঞাপন
আলোর বন্যা বয়ে যায়। প্রচারনার এই রংখেলা উপভোগ করতে অসংখ্য নরনারী আলোসাগরে ঘুর
ঘুর করছেন, যেন প্রদীপের পাশে পতঙ্গের উড়াউড়ি। পাবলিসিটি উপভোগ করার জন্য টাইমস্কয়ারে
গ্যালারীও রয়েছে। ম্যাচখেলার স্টেডিয়ামের মত সাজানো গ্যালারীতে নানা ধর্ম বর্ন ও
জাতির শত শত মানুষ বসে আছে। তাদের পোষাক-পরিচ্ছেদ, ভাষা ও সংস্কৃতি সবই বিচিত্র।
তারপর আসি হার্ডসন নদীর তীরে এস্টোরিয়া পার্কে যেখানে আমার মামা ফজলুর রহমান
চৌধুরী তার প্রবাস জীবন কাটান। এখানে মামার তিনপুত্র মুর্শেদ, ফরহাদ ও জাহেদ বড়
হয়। নদীপারে পার্ক এবং এই পার্কের কিনারায় মামার বাসা। উপভোগ করার মত সুন্দর একটি
জায়গা এই এস্টোরিয়া পার্ক। হার্ডসন নদীতীর সুন্দর করে বাঁধানো। সেতু টেনে নদীর
বুকে সাজানো অনেক বৈঠকখানা। টলমলে জল ও শীতল বাতাসে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায়।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রোজ
বৃহস্পতিবার। আমেরিকার বৃহৎ ও শ্রেষ্ট নগরী নিউইয়র্কে আমার প্রথম ভোর দর্শন। নামাজ
পড়ে প্রাতঃভ্রমনে বের হই। রিপার বাসার ঠিকানাঃ ৩১-০৬-৮২ জ্যাকসনহাইট, ইস্ট
এলমাস্ট। ৩১ নং এভিনিউয়ের ৮২ নং সড়কের ৬ নং বাসা।
প্রতিটি এভিনিউতে সবগুলো বাসার ডিজাইন প্রায় একই। আমেরিকায় নিজের ইচ্ছেমত
বাসার ডিজাইন করা যায় না। সরকার যে এলাকায় যে ডিজাইন নির্ধারন করে দেয় সে ডিজাইনে
বাসা নির্মিত হয়। বাসার বহির্ডিজাইন চুল পরিমান কমবেশ করতে হলে কতৃপক্ষের অনুমোদন
নিতে হয়। এদেশে ধনী ও গরীবের তারতম্য খুব একটা বুঝা যায়না। এক এলাকার ধনী গরীব
সবাই একই ধরনের বাসার বসবাস করেন। সারিবদ্ধ বাসাগুলোর সামনে ফুল ও পাতাবাহারের
বাগান। তাতে মা-ম্যারী, যীশু, বিড়াল, হাঁস, পাখির ভাস্কর্য্য। ফুটপাত মসৃন কোথায়ও
কোন উঁচুনিচু নেই। তাই চোখমুদে এসব ফুটপাথে হাঁটা যায়। আমাদের ফুটপাথের মত আচাড়
খাবার সম্ভাবনা নেই। বেবীসিটার, ট্রলী, পঙ্গুচেয়ারে বসে মানুষ এই মসৃন ফুটপাথে
আরামছে ঘুরে বেড়ায়। কিংবা এশহরের
ফুটপাতগুলো আমাদের দেশের রাস্থার মত সুপ্রশস্থ, ফুটপাতে লাগানো সবুজ বৃক্ষগুলো
পথচলার পথে কোন বিঘ্ন তৈরী করেনা। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় মনে হয় কোন বাগানে
হাঁটছি। রাস্থা পারাপারে এখানে লাইট সংক্ষেত অনুসরন করতে হয়।
লান্সের পর রিপা আমাদেরকে ম্যানহাটান
ও সেন্ট্রাল পার্ক দেখতে নিয়ে যায়। কারপার্কিং সমস্যা এড়াতে আমরা ভূতল ট্রেনে
ম্যানহাটান যাই। আমাদের দেশে ভুতল ট্রেন চড়ার সুযোগ নেই, তাই আমাদের জন্য ভূতল
ট্রেন চড়ার আনন্দই আলাদা। বাসার কাছেই রাস্থার কিনারায় একটি ঘরে ডুকে চলন্ত সিড়ি
বেয়ে অনেক নিচে ভূতল স্টেশনে নেমে যাই। আমি সিঙ্গাপুরে ভুতল ট্রেন চড়লেও জেফার ও
ডাঃ নুরজাহান বেগমের এটাই জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা।
ভুতল ট্রেন আমাদেরকে সেন্ট্রাল
পার্কে নিয়ে যায়। লং আইল্যান্ড হল হার্ডসন নদীর মোহনার একটি সুদীর্ঘ্য উপদ্বীপ। এই
উপদ্বীপের শুরুটায় সাড়ে তিন বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিশাল সেন্ট্রাল পার্ক। এই
পার্কের কাছেই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিখ্যাত ম্যানহাটান টাউন। সেন্ট্রাল
পার্ক মানব সৃষ্ট, অথচ মনে হয় প্রাকৃতিক বাগান। এখানে আছে মানুষের হাতে গড়া,
পাহাড়, টিলা, হ্রদ ও বনভূমি। ঘোড়ার গাড়িতে বসে মানুষ ঘুরে বেড়ায় সারাটা সেন্ট্রাল
পার্ক। ঘোড়ার মলমূত্র কখনও মাটিতে পরেনা, কৃত্রিমভাবে বসানো ব্যাগে ডুকে, তাই সড়ক
দুষিত হয়না।
সেন্টার পার্কে আমাদের রিকশারও
দেখা পেলাম। নানা চিত্রকর্মে সাজানো একদম ঢাকাইয়া রিকশা। রিকশা আমেরিকানদের কাছে বিরল
প্রজাতির অদ্ভুদ ত্রিচক্র যান। ব্যাটারি চালিত এসব রিকশা চালিয়ে অনেকে কম কষ্টে
বেশী রুজি করছেন। এসব রিক্সারোহী অনেক পর্যটক হয়ত আদৌ জানেনা বাংলাদেশে ব্যাটারী
নয়, মানুষ প্যাডেল মেরে রিকশা চালায়। গায়ের জুর খাটিয়ে মানুষ রিকশা চালায় শুনলে
তারা অবাক হত, সেই সাথে দুঃখও পেত।
পর্যটকদেরকে সামনে বসায়ে মূহুর্তের
মধ্যে অবিকল ছবি একে দিচ্ছে দক্ষ শিল্পীরা, ছোট্ট পরিচ্ছন্ন দোকানে বসে পানীয় ও
বিস্কুট বিক্রি করছে দোকানীরা। শর্মা, বার্গার, চা ও কফির দোকানও সরগরম। ডান্স করে
ও গান গেয়ে টু পয়সা কামাই করছেন আফ্রিকান কালো নর্তক ও গায়কের দল। সেন্ট্রাল পার্ক
এত বড় যে সারাদিন হেঁটেও সারাটা পার্ক দেখা সম্ভব হবেনা। লেকের নীল জলে পাখি ও
বুনো হাঁস সাঁতার কাটছে।
পার্কের অপুর্ব সুন্দর ফোয়ারায়
আসেন দুইজন সুসজ্জিত চীনা বরকনে। কনের দুঘধবল ড্রেস এত লম্বা যে মাটি ঝাড়ু দিচ্ছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে আরেক জোড়া বরকনে সেজেগুজে এসে হাজির হন। তাদের সাথে আসেন একদল
ফেন। এই কনের পোষাক হালকা গোলাপী এবং ঘাসের গালিচা ছুঁয়ে আছে। এই পার্কে বসে কেউবা
একমনে গিটার বাজাচ্ছে, কেউবা পিয়ানো।
সেন্ট্রাল পার্কের রাস্থার
কিনারায় অবক্ষমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমেরিকার সব বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, লেখক,
বিজ্ঞানী, আইনবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সেন্ট্রাল পার্কে আছে জাদুঘর, দাবা ও পাশা
খেলার মঞ্চ, ব্যায়ামাগার। আমি বৃক্ষলতাবিদ নই। তাই এসব অজানা বৃক্ষলতা ও ফলফুলের
বিবরন দেবার সাধ্য আমার নেই। এই পার্কের মাটির নিচ দিয়ে জালের মত বিস্তৃত রয়েছে
ট্রেন ও ট্যানেল। এখানে মাটির নিচে যে এক ব্যস্ত জগত, তা উপরের প্রাকৃতিক পরিবেশে
বসে বুঝার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে উচুউচু আসমান ছোঁয়া ভবনমালার ম্যানহাটানের
সব দুষন চুষে নিচ্ছে এই সেন্টার পার্ক এবং আশপাশের নদী ও সাগর। আশপাশের ব্যস্ত
ভবনের মানুষগুলো কাজের ফাঁকে এখানে এসে নিজেদেরকে সতেজ করে নেয়।
সেন্ট্রাল পার্কের কিনারায় বসে
আমরা জনপ্রিয় আরবি খাবার জায়রা কিনে খাই। জায়রা হল চিকেন, কারি, সালাদ ও সসের
মিশ্রণ যা বড় রুটির মধ্যে আমাদের পানের খিলির মত করে গরম গরম পরিবেশন করা হয়।
জায়রা এত বড় যে খেতে বেশ সুস্বাধু হলেও পুরোটা খাওয়া আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল।
শুক্রবার। আজ রাতে আমেরিকান স্নেপার ফিস (Snaper fish) খাই। রিপা
খুব মজা করে মাছটি রান্না করেছে, খেতে একদম আমাদের ইলিশের স্বাদ। ভোর হলে আরেক
এভিনিউতে হাঁটি। অনেক বাসা বাগানে বক, পাখি, বাঘ ও সিংহ মূর্তি। কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে
বসা খরগোস মূর্তির ঝুড়িতে ফোটে আছে প্রাকৃতিক ফুল। বাগানে ছেয়ে আছে গাঁদা, গোলাপ,
টিউলিপ, কলা ও তারাফুল।
কিছু লোকজন কুকুর নিয়ে হাঁটছে। কুকুরের
মলত্যাগের সময় দেখা গেল একজন লোক কুকুরের পায়ুর নিচে টিস্যু পেপার ধরে মল হাতে
তুলে নেন। তারপর পকেট হয়ে ব্যাগ বের করে এই মল বহন করে যথাস্থানে ফেলতে নিয়ে যান।
জেফার অবাক কুকুরের মল লোকটা মাটিতে পরতে দেয়নি। কোথায়ও কুকুরের মল পড়লে খবর আছে।
কুকুরের মালিকের ঠিকানার টিকেট যাবে, জরিমানা হবে। আমেরিকানরা তাই তাদের প্রিয়
কুকুরের মল নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নেয়। একটা কুকুর পোষতে তারা একজন মানুষ পোষার খরচ
বহন করে।
মামা আমি ও জেফার জুমুয়ার নামাজ
পড়তে কুইন্সের মসজিদে যাই। আমেরিকা নিরব নিস্থব্ধ দেশ। যে কোন ধরনের শব্দ দুষন
এদেশে নিষিদ্ধ। তারা গীর্জায় ঘন্টি, মন্দিরে ঢোলক কিংবা মসজিদে মাইকে আজান বাজাতে
দেয়না। এদেশে ধর্মপালন যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাংলাদেশীদের পরিচালিত এই
মসজিদের ইমাম একজন বাংলাদেশী। তিনি ইংরেজীতে খুতবা পাঠ করেন। দুতলা এই মসজিদে কোন
গম্বুজ কিংবা মিনার নেই। সেই জুমুয়ার জামাতে প্রায় শতাধিক মুসল্লি শরীক হন।
বের হয়ে মসজিদের বাহিরে
স্থুপাকারে রাখা বেশ কিছু বাংলা পত্রিকা পাই। পত্রিকাগুলোর নাম ‘সাপ্তাহিক
প্রবাসী’ ‘সাপ্তাহিক বাঙ্গালি’ ইত্যাদি। বাংলাদেশীদের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এসব
পত্রিকা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। হাসিনা, খালেদা, এরশাদ হতে শুরু করে দেশের সব
খবরই এসব পত্রিকায় রয়েছে। এমন কি নিউইয়র্ক হোটেলে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী
ও আওয়ামী লিগ নেতা সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর শোকসভার বিবরণ পাঠক হিসাবে পেয়ে যাই। আসলে
নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করার একটা তীব্র বাসনা সবস্থানেই মানুষের মধ্যে রয়েছে।
তা দেশ হউক, নতুবা বিদেশ হউক। আমাদের প্রবাসীরাও এই বাসনার বাহিরে নন। তারা এসব
ক্ষুদে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোতে নিজেদের খবর, অবস্থান, ব্যবসাপাতির প্রচারণা
সব চালিয়ে যান।
রাতে আমার বেগম ডাঃ নুরজাহানের
রনকেলী গ্রামের মামাতো বোন হোসনা আপা- মুনিম ভাই দম্পতির ত্রিতলা বাসায় যাই। তারা
বেসমেন্ট ও দুতলায় থাকেন এবং উপরে ভাড়াটিয়া আছেন। এখানে আমরা নানাপদের খাবার খাই ও
এক শত ডলার উপহার পাই। এবাসার কাছেই আমার মামাতো বোন আরফার বাসা। সে বাসায় আরফা ও
তার স্বামী সাদিক চৌধুরীকে পাই। সাদিক চৌধুরীর বাড়ি ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া গ্রামে।
তাদের দুই কন্যা রাইসা ও রিমা, একমাত্র পুত্র আয়মনকে নিয়ে তাদের সুখী পরিবার।
এখানেও বর্ননাতীত খাবার খেয়ে আর একশত ডলার গিফট মানিব্যাগে ঢুকাই। রাতে আমাদের
ঘাটি রিপার বাসায় ফিরে আসি।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫, শনিবার।
রিপা আমাদেরকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে নিয়ে যায়। চারতলা ভবনের বিশাল যাদুগর। চৌদ্দ
পনের মিলিয়ন বছর আগের ডায়নুসারের সুবিশাল দেহকঙ্কাল দেখি। ডায়নুসারের এই কঙ্কালের
উচ্চতা দেড়তলা ভবনের সমান হবে, যা দৈর্ঘ্যে ৩৫/৪০ ফুটের কম হবেনা। এখনে ডায়নুসার,
মামথ, নীলতিমি ইত্যাদি প্রানীর ফসিল দেখে অন্য হলে যাই। সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের
ব্যবহৃত পন্য, শিকার ও যুদ্ধাস্ত্র, ঘরবাড়ির নমুনা দেখি। এখানে মিনিয়েচার করে রাখা
রেড ইন্ডিয়ান গ্রাম, গ্রামের সর্দার সভা, রেড ইন্ডিয়ানদের পশু শিকার, মাছধরা ও
কৃষি জীবন গ্লাসের ভিতর সাজানো আছে। কাঁচের প্রকুষ্টে রয়েছে বনে বিচরণরত অবস্থায়
নানা প্রজাতির পশু, পাখি, সর্প ইত্যাদি। নুরজাহান বেগম পা ব্যথায় হাঁটতে অক্ষম,
তাকে বসায়ে রেখে আমরা হেঁটে হেঁটে দেখে আসি। প্রায় তিনঘন্টা হেঁটে চারতলা জাদুঘরের
কেবল নিচতলার একটি অংশ দেখা হয়, যা পুরো জাদুঘরের বড়জুর ১০-১৫% এর বেশী হবেনা।
এবার যে ভবনে ঢুকি, সেখানে নানা
তথ্য উপাথ্য সহকারে ডারউইনের পূর্ণ বিবর্তণবাদ সাজানো আছে। চারপায়ে ভর করে চলা বানর(এসস)
হতে দুইপায়ে ভর করে বানর(প্রাইমেটর) এবং এই বানর(প্রাইমেটর) হতে আদি হোমসেপিয়ান্স
ও নিয়ানথান্ডাল মানব প্রজাতির উদ্ভব ও বিকাশ এখানে প্রদর্শন করা আছে।
আমেরিকার এক একটা জাদুঘর,
মুক্তজ্ঞানের এক একটা বিশাল ভান্ডার। খাতা কলম নিয়ে এই সব জাদুঘরে ঢুকে কয়েকদিন
সময় নিয়ে এক একটা গ্যালারী পর্যবেক্ষন করতে হবে। ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী,
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এসব জাদুঘরকে তাদের গবেষনা মাধ্যম হিসাবে
ব্যবহার করেন। লন্ডন জাদুঘরে সমাজ বিজ্ঞানী কার্লমার্ক্স সামাজিক দন্দ্ববাদের
উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন।
এবার আমরা Rope way
vehicle চড়ে তারপথে হার্ডসন নদী পার হয়ে ম্যানহাটন প্রবেশ করি। এই
ম্যানহাটন বিশ্বের বানিজ্যিক রাজধানী, পৃথিবীর সব বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানীর প্রধান
কিংবা উপপ্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। এখানে সুউচ্চ দুইটি টাওইয়ার নিয়ে আকাশ
ছুঁয়ে দাড়িয়ে ছিল World Trade Centre. আজ থেকে প্রায়
চৌদ্দ বছর আগে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে মাত্র আটারো মিনিটের ব্যবধানে
এই দুইটি টাওয়ারের উপর সন্ত্রাসীদের ছিনতাই করা দুইটি বিমান আচড়ে পড়ে। আগুন জ্বলে
ওঠে দুইটি টাওয়ারে, তারপর ধ্বসে পড়ে মাটির সাথে মিশে যায় যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব World
Trade Centre. চারশত ফায়ার সার্বিস কর্মীসহ নিহত হন সাড়ে চার হাজার
মানুষ। এই সন্ত্রাসী হামলার বদলা নিতে আফগানিস্থান ও ইরাক মার্কিন হামলায় বিদ্ধস্থ
হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে এখানে এক গোপন বৈঠকে বসেন বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন,
বৈজ্ঞানিক ওপেন হেইমার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। সেদিন তাদের গৃহীত
ম্যানহাটন প্রজেক্ট বিশ্বে পারমানবিক যুগের সূচনা করে এবং তা জাপানের হিরোশিমা ও
নাগাসাকি নগরী পারমানবিক বোমায় বিধ্বস্থ হবার পথ রচনা করে। ম্যানহাটনের সড়কগুলো
ঢাকার তুলনায় অনেক বড়। বিশাল বিশাল রাস্থা ও ফুটপাথের কিনার ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে
আকাশচুম্বী ভবনের সারি। এই ভবনমালার চূড়া দেখতে হলে ঘাড় পিছনের দিকে ৪৫ ডিগ্রি বাকাতে হবে। রাতে আমরা হার্ডসন নদীর ওপারের এস্টোরিয়া পার্ক হতে
ম্যানহাটনের দিকে তাকিয়ে আলো ঝলমলে অপরূপ ম্যানহ্যাটন দেখে বিমুগ্ধ হই। সেদিন
বেশকিছু বিদেশী ফল প্লাম, চেরি ও পিচের স্বাদ নেই। সাপ্তাহের নিদৃষ্ট দিনে রাস্থার
গার্বেজে ফেলা ভাল ভাল মেট্রেস, কাপড়, কাট ও ইলেকট্রিক পন্য দেখি যা আমাদের দেশের
লোকেরা পেলে খুশী হয়ে বাড়ি নিয়ে যেত।
ঐদিন আমরা হার্ডসন নদীর মাঝে
ভাসমান সুন্দর দ্বীপ রোজভেল্ট আইল্যান্ড সফর করি। ছোট্ট এই দ্বীপের চারপাশের
জলসীমা ঘেষে রয়েছে সড়ক ও ফুলবাগ। বাগান, গ্যালারি, খেলার মাট, বসার স্থান,
শিশুপার্ক এবং সুরম্য ভবনমালায় সজ্জিত রূজভেল্ট আইল্যান্ড। এই আবাসিক দ্বীপে
মানুষের উপভোগের সব ব্যবস্থা রয়েছে। এই দ্বীপে ফ্ল্যাটের দাম আকাশছুঁয়া এবং
আমেরিকার ধনীরা এখানে বসবাস করেন। এই দ্বীপের ঝিরঝিরে বাতাস ও মিঠে মিঠে রোদ
মনটাকে কবি করে দেয়। বিদেশি বৃক্ষচ্ছায়ে লন টেনিস মাটের ছোট্ট গ্যালারীতে বসি।
পার্কের সুন্দর ব্রেঞ্চিতে বসে মনে হল এগুলোতে ঘুমিয়ে রাত কাটানো যাবে। এখানে
মশামাছি নেই, নেই ধূলা বালি ময়লা। তাই বাংলাদেশের মত এখানে পরা কাপড় সহজে ময়লা
হয়না। রোজভেল্ট আইল্যান্ড আয়তনে বড়জুর আমাদের সাগরদিঘীরপার এলাকা হবে। সড়ক ও
ফুটপাথ প্রশস্ত। এক অদ্ভুদ স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য ও নিরবতা এই আবাসিক দ্বীপটিকে
প্রশান্তি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, রবিবার।
আজ আমরা মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি যাবার আয়োজন করি। রিপা লেপটপে বসে অনলাইনে
মেঘাবাস ডট কমের তিনটি টিকেট কাটে। ক্রেডিট কার্ডে সে বিল পরিশোধ করে। সাথে সাথে
ম্যাসেজ আসে। এই ম্যাসেজই বাসের টিকেট। আমি রিপাকে টিকেটের দাম দিতে চাইলে সে
নেয়নি। আমাদের দেশে টিকেট করতে কাউন্টারে দৌড়াতে হয়। হাইটেক আমেরিকায় এসব ঝক্কি
ঝামেলা নেই। এদিন আরাফ ভাই আমাদেরকে স্টাচু আফ লিবার্টি দেখাতে নিয়ে যান। পথে তিনি
গাড়ি থামিয়ে হার্ডসন নদীতে নোঙ্গর করা কলম্বাসের পালতোলা তিনটি জাহাজ নিনা, পিন্টা
ও সান্তামেরিয়া দেখান। এই ধরনের তিনটি জাহাজে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে
ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেন।
একসময় আমরা হার্ডসন নদীতীরের
একটি জেটিতে আসি। আটলান্টিক উপকূলের কয়েকটি পর্যটন দ্বীপে যাবার টিকেট কিনতে লাইনে
দাড়াই। আমেরিকানরা সুশৃংখল, যে কোন ব্যাপারে তারা লাইন ধরেন। নিরাপত্তা পরীক্ষা
করার পর আমরা একে একে সবাই এইটি তিনতলা ব্যাসেলে আরোহন করি। এবার ব্যাসেলটি
হার্ডসন নদীর ভাটি পূর্বদিকে আটলান্টিক মহাসাগর পানে যাত্রা শুরু করে। নিউইয়র্ক
মহানগর এমন একটি শহর যা হার্ডসন নদী, কিছু দীপাঞ্চল ও আটলান্টিক উপকূলকে কেন্দ্র
করে গড়ে উঠেছে। এই নদী আমাদের পদ্মা মেঘনা যমুনার মত বিশাল, যাহা বেশকিছু রাজ্য ও
সাগরসম লেকের পানি আটলান্টিক মহাসাগরে নীল জলরাশিতে হয়ে নিয়ে যায়।
নিউইয়র্ক শহর নদী ও সাগরের মাঝে
প্রসারিত কয়েকটি দ্বীপ-উপদ্বীপ যেমন এলিস আইল্যান্ড, রোজভেল্ট আইল্যান্ড, লিবার্টি
আইল্যান্ড, লঙআইল্যান্ড উপদ্বীপ এবং নদী-সাগরের উপকূল নিয়ে গড়ে উঠেছে।
আমাদের পর্যটন জাহাজ নানা জাতি
ভাষার লোকে পূর্ন। তারা জাহাজের কিনারায় দাড়িয়ে ছবি তুলছে, জাহাজের দোকান হতে
চকলেট, পানীয়, বিস্কিট কিনে খাচ্ছে। নদী দিয়ে স্টিমার ও স্পিডবোট সা সা করে ছুটে
ছলছে। হঠাৎ চোখের সামনে স্টাচু অব লিবার্টি দেখা গেল। জাহাজ এসে স্টাচু অব
লিবার্টি দ্বীপের জেটিতে নোঙর করে। স্টাচু আফ লিবার্টি দ্বীপটির আয়তন তিন একর, যা আমাদের এমসি কলেজমাটের মত হবে। এই দ্বীপ হার্ডসন
নদীর মোহনায় আটলান্টিক মহাসাগরের কূল ঘেষে অবস্থিত। আমেরিকার অন্য দ্বীপগুলোর মত
এই দ্বীপে আছে সান বাঁধানো তীর, তীরের সীমানা বরাবর সড়ক ও বাউন্ডারী। রাস্থার নিচে
এসে আচড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। আমরা জেটি হতে নেমেই হেঁটে হেঁটে একবার পুরো দ্বীপটি
প্রদক্ষিন করে আসি। স্টাচু আফ লিবার্টি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্মারক-স্মরনী।
এই মহিলা স্টাচুটির বগলে বই এবং হাতে জ্বলন্ত মশাল। এই স্টাচুর ফেস ইমা নামীয় একজন
বিখ্যাত মহিলা কবির। একটি কয়েক তলা ভবনের উপর এই বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
বৃটিশদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ফরাসীরা মার্কিনীদেরে সাহায্য করে।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হলে ফরাসীরা এই মূর্তি তৈরী করে জাহাজে যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়ে
দেয়। পর্যটকগণ সিড়ি বেয়ে বেয়ে নারী মূর্তির মশাল পর্যন্ত পৌঁছে যান। স্টাচু আফ
লিবার্টির সামনে বাজার আছে। এখানে স্টাচু আফ লিবার্টির মিনিয়েচার, চা, কফি,
বিস্কিট ইত্যাদি রমরমা ব্যবসা চলে। এবারে জাহাজে উঠার ডাক পড়ে। স্টাচু আফ লিবার্টি
দেখা শেষ, আমরা আবার লাইন ধরে জাহাজে আরোহন করি।
জাহাজ আমাদেরকে এবার আরেকটি
দ্বীপে নিয়ে যায়। এই দ্বীপটির নাম এলিস আইল্যান্ড। এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষন
বিখ্যাত ইমিগ্রেন্ড মিউজিয়াম। এই দ্বীপে নেমে অধিকাংশ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা
নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। আমেরিকায় আগত আদিম ইমিগ্রেন্টদের বিস্তারিত ইতিহাস,
সচিত্র তথ্য ও নিদর্শন সহকারে এই জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এই জাদুঘরে আছে প্রাচীন
ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ জনগুষ্টির পোশাক পরিচ্ছেদ, ব্যবহার্য্য পন্য, লাটি, ছড়ি,
তরবারি,হ্যাট ইত্যাদি। আফ্রিকা হতে হাত-পা বেঁধে ধরে আনা উলঙ্গ- অর্ধ উলঙ্গ কালো
কৃত দাস-দাসীদের প্রামান্য চিত্রাবলী। দড়ি ও জিঞ্জির পরানো নিগ্রো নরনারী বিক্রয়ের
জন্য এই এলিস দ্বীপে নামানোর সন ও তারিখ সহ বিবরন। সেযুগে শিল্পীদের আঁকা কিংবা
ক্যামেরায় তুলা দলবদ্ধ কৃতদাসের সারি। হাত-পা বাঁধা উলঙ্গ মানব সন্থানদের পণ্য
হিসাবে বাজারে বিক্রয়ের ছবি দেখে গা শিউরে উঠে। আরব ও ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা
অসংখ্য বালকদেরে ধরে বেঁধে জুরপূর্বক জাহাজে তুলে আফ্রিকা হতে এলিস দ্বীপে নিয়ে
আসে। এই দুর্ভাগা বালকেরা চিরদিনের জন্য পরিবার পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। শ্বেতকায় জমিদাররা তাদের শত শত একর জমি
চাষে এসব কৃতদাসদের নায্য পারিশ্রমিক ছাড়াই ব্যবহার করে। তাদের শ্রমে ও ঘামে
যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক কৃষি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিনত হয়। কালো নিগ্রো জাতির মত মজলুম
জাতি পৃথিবীতে বোঢ হয় খুব কমই আছে। নুতন দুনিয়া আমেরিকা আবিস্কার হলো। ইউরোপ হতে
শ্বেতাঙ্গ ভাগ্যান্বেষীরা দলে দলে জাহাজ ভর্তি হয়ে ছুটলো আমেরিকায়। আদিবাসী রেড
ইন্ডিয়ানদেরে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিজামা দখল করা হলো। নতুন দেশ ও
ক্ষেত-খামার গড়তে হলে প্রচুর মজুর চাই। এই সস্তা মজুরের চাহিদা পুরনে শিকলে বেঁধে
বড় বড় জাহাজ বুজাই করে নিয়ে আসা হল আফ্রিকান নিগ্রোদেরে। বর্তমান যুগে গরু-ছাগল যেভাবে
চালান দেয়া হয় ঠিক সেভাবেই। এই ক্ষুধার্ত উলঙ্গ কালো মানুষগুলোর কত লাশ যে জাহাজ
হতে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে তার হিসাব কে রাখে। এসব কালো দাসদের পরিশ্রম এবং
শ্বেতাঙ্গদের ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট উন্নত দেশরূপে গড়ে উঠেছে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র।
সেই বিচিত্র ইতিহাসের স্বাক্ষি
এই এলিস দ্বীপ এবং এই অভিবাসী জাদুঘর। এই জাদুঘর এত বড় ও সমৃদ্ধ যে এটি কয়েক তলা
ভবন নিয়ে গঠিত। এই জাদুঘর বিশাল জ্ঞানসাগর। এই জাদুঘর অধ্যয়ন করতে হলে কয়েকদিনের
প্রয়োজন। তিন চার ঘন্টার সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রথম তলার মাত্র ২০-২৫% দেখা হল, যা পুরো
জাদুঘরের মাত্র ৪-৫% এর বেশী নয়। এই সামান্য দর্শনেই আমেরিকায় মানবসভ্যতার বিশাল
বিবর্তন চোখের সামনে ফুটে উঠে।
জাদুঘর হতে বের হয়ে এলিস দ্বীপের
একটি পার্কের চেয়ারে বসি। পার্কের কিনারায় আমেরিকায় আগত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার
প্রথম অভিবাসী ব্যাক্তির নাম স্টিলবোর্ডে লেখা আছে। এই হাজার হাজার মানুষের
তালিকায় আছেন প্রথম বাংলাদেশী অভিবাসী ইব্রাহিম চৌধুরী, যিনি এই শতকের প্রথম দিকে
জাহাজে চড়ে কোলকাতা হতে নিউইয়র্ক আসেন। তাকে বলা হয় বাংলাদেশীদের ক্রিস্টোফার
কলম্বাস। তিনি বৃটিশ আমলে সিলেট বিভাগের নবীগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামে
জন্মগ্রহন করেন। নিউইয়র্কে তিনি অনেক মসজিদ প্রতিস্টায় জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশী
কমিউনিটি সেবায় সদা নিবেদিতপ্রাণ সদ্যপ্রয়াত এই বাংলাদেশী নেতা তার কাজের জন্য
বাংলাদেশীদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
এলিস দ্বীপ দেখা শেষ হলে আবার
জাহাজে চড়ি। হার্ডসন নদীর যে জেটি থেকে সকালে আমরা যাত্রা শুরু করি, সেই জেঠিতে
এসে যাত্রা শেষ হয়। জেঠির বাহিরে এসে আরাফ ভাইকে পাই। তিনি কার নিয়ে আমাদের
অপেক্ষায় আছেন।
তিনি আমাদেরকে নিয়ে পাশেই Ground-“0” তে নিয়ে যান। এই Ground-“0” এক সময় ছিল বিশ্ববিখ্যাত
World Trade Center. সন্ত্রাসী হামলায় World Trade Center
ধ্বংস হয়ে যাবার পর এখন এখানে আছে কেবল স্মৃতিকাঠামো। এই কাঠামোর সামনে বিশাল
স্মৃতিপুকুর। পুকুরপারে চতুর্দিক পরিবেষ্টন করে আছে স্মৃতিফলক। এই স্মৃতিফলকে
টুইন-টাওয়ার হামলায় নিহত সাড়ে চার হাজার মানুষের সবকটি নাম ক্ষুধাই করা রয়েছে। পুকুরের
ঈষৎ ঢালু পার ঘেষে নিচে গড়িয়ে নামছে ফোঁটা ফোঁটা কান্নার জল। চারপারের ঢালু বেয়ে
একদম কান্নার গতিতে গড়িয়ে পড়া সব জল একটি চতুষ্কোন চৌবাচ্চায় জমে হারিয়ে যায়।
কাছেই টুইন টাওয়ার এলাকায় গড়ে উঠেছে ৭০/৮০ তলা ভবন। সময় নেই, তাই এই ভবনে যাওয়া
হলনা।
সন্ধ্যায় ভাগ্নি বিভার বাসায়
খেতে যাই। আমার খালাতো বোন এলি আপার তিন মেয়ে বিভা, সুমি ও ইপা সপরিবারে এসে
জমায়েত হল এই বাসায়। তিন ভাগ্নিই নানাপদের খাবার তৈরী করে নিয়ে আসেন। একটি বড়
টেবিল খাবারে খাবারে ভরে যায়। দেশী ও বিদেশী খাবার। সবাই কষ্ট করে সযতনে এত খাবার
নিয়ে এসেছে আমাদেরকে খাওয়াতে, তাই নাখেলে তাদের মনঃকষ্ট হবে ভেবে একটু একটু করে সব
খাবারের স্বাদ নেই। খানিক পরে এবাসায় আসে ভাগনা বাবু ও ইপক। ডিনার শেষে রাতের
নিউইয়র্ক দেখাতে তারা আমাদেরকে নিয়ে বের হয়। এস্টোরিয়া পার্কের ধারে হার্ডসন নদীর
মধ্যভাগে সেতুপথ দিয়ে দৌড়ে যাই। সেতুগুলো মাঝনদীর ভাসমান বৈঠকখানায় গিয়ে শেষ হয়।
শীত শীত লাগে তাই শীত তাড়াতে এই দৌড়া দৌড়ি। ওপারে আলো ঝলমলে বহুতল ভবনের সারিমালা-
বিশ্বের শ্রেষ্ট বানিজ্যকেন্দ্র ম্যানহাটন। ওইখানে দূর হতে চেয়ে দেখি জাতিসংঘের
সদরদপ্তর।
নিউইয়র্ক স্টেইটের আয়তন ৪৭,২২৪ বর্গমাইল
এবং লোকসংখ্যা এক কোটি বিরাশী লক্ষ। নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজধানী কিন্তু নিউইয়র্ক
সিটি নয়। নিউইয়র্ক হতে অনেক দূরে আলবেনী নামক ছোট্ট শহরে। নিউইয়র্ক শহরের একটি বড়
অংশ নিউজার্সি স্টেটে ঢুকে আছে। রড আইল্যান্ড, নিউজার্সি ও কানেক্টিকাট স্টেইটের খুব
কাছে নিউইয়র্ক শহরের অবস্থান। নিউইয়র্ক স্টেট যুক্তরাষ্ট্রের প্রানকেন্দ্র, তাই এই
স্টেটকে বলা হয় এম্পায়ার স্টেট।
ম্যানহ্যাটনের ফুটপাতে দুইজন কালো লোককে
ভিক্ষে করতে দেখি। ধন ঐশ্বর্য্যে ভরা যুক্তরাষ্ট্রে এই ভিক্ষুক দেখা আমার কাছে
বেমানান মনে হল। আমি ভিক্ষা দিতে চাইলে রিপা বাধা দিয়ে বলল, ওরা অলস ও নেশাগ্রস্ত,
নেশার জন্য ভিক্ষা করছে। দানের টাকায় ওরা নেশা টানবে। তাই পুন্যের বদলে পাপই হবে।
সরকারী সাহায্যের টাকায় নেশার খরচ হয়না, তাই নাকি এই ভিক্ষাবৃত্তি। কেবল কালো নয়,
একজন সাদা বৃদ্ধকেও আমি ম্যানহাটনের ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করতে দেখেছি। তার সামনে
একটি ছোট সাইনবোর্ডে লিখা- “Please give me a dollar, God will bless you.”
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, সোমবার। আজ
মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি যাবো। অন লাইনে টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আমার মোবাইলে
Megabus.com এর প্রেরিত ম্যাসেজই টিকেট। রিপা গাড়ি চালিয়ে নিউইয়র্কের বারো রাস্থা
তেরো গলী পেরিয়ে মেগাবাস ডট কমের আস্থানায় আমাদেরকে নেয়ে আসে। এখানে প্রাইভেট
কারের পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় তাকে দ্রুত চলে যেতে হল। মেঘাবাসে উঠার জন্য
মানুষ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এবার মেঘবাস সামনে আসে। বাসটি আমাদের গ্রিনলাইনের বড়
বাসের চেয়ে দেড়গুন লম্বা এবং দুতলা। দুইজন কালো লোক মাল উঠান। কোন সিটে বসব জানতে
চাইলে হেল্পার বললেন, যেখানে খুশি বসতে পারেন। আমরা দুতলার একদম সামনের সিটে গিয়ে
বসি এবং প্রিয় আমেরিকা এবার নয়নভরে দেখবো তোমাকে। আমেরিকার জাতীয় মহাসড়ক অতি
উন্নত। নিউইয়র্ক হতে ওয়াশিংটন ডিসির দূরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল। মহাসড়কের লেন সংখ্যা
২৪টি। প্রতিলেন আমাদের প্রায় দুইলেনের সমান। এই ২৪ লেন ছাড়াও পুলিশ ও
এম্বুল্যান্সের জন্য আলাদা লেন রয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উন্নত কার, ক্যারাভান গাড়ি,
বাস, লরি শা শা করে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির লাইটের আলো জ্বলজ্বল করছে। তৈল ও পন্যবাহী
বাইশ চাকার নীল লরিগুলো আমাদের দেশের ২৪/২৫ টি ট্রাকের সমান
মালামাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়ও আমাদের রাস্থার উপর দিয়ে কোথায়ও নিচ দিয়ে ১৫/২০
লেনের মহাসড়ক ওভারব্রিজ বা আন্ডারব্রিজ হয়ে চলে গেছে। মহাসড়কে চলার পথে কোথায়ও কোন
বাধা নেই। সর্বত্র সাইনবোর্ডে পথ নির্দেশনা রয়েছে। সড়কের দুপাশে পাইন, ম্যাপল ও
বির্চের বন। বাংলাদেশের মত অনেক নদী ও জলাবন চোখে পড়ে। দুপাশে ঘন সবুজের হাতছানি।
বাংলাদেশে যত গাড়ি আছে, যেন এই মহাসড়কের ৪০/৫০ মাইলে তার চেয়ে বেশি গাড়ি আছে।
সড়কের দুপাশে পাতাঝরা বৃক্ষের বন।
শীতকালে সব পত্র ঝরে পরে ও শাখা-প্রশাখা নিয়ে বৃক্ষরাজি মৃতবৎ দাঁড়িয়ে থাকে।
আমাদের সৌভাগ্য শীতের আগে শরতকালে আমেরিকা এসেছি। শীত হানা দেবার আগে বৃক্ষপাতা
প্রথমে হলুদ ও পরে লালে লাল হয়ে যায়। মাইলের পর মাইল সড়কের দুইপাশ রক্তিম ডালিমের
রঙ ধারন করে। আমেরিকানরা তখন অরন্যের এই সৌন্দর্য্য অবগাহন করতে গাড়ি চালিয়ে
মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়ান।
নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন মহাসড়কে একধরনের গাড়ি
দেখি। এই গাড়ি বাসার মত সুসজ্জিত। এই গাড়িতে কিচেন, ডাইনিং, ওয়াসরুম, বাথরুম,
স্লিপিং বেড সব রয়েছে। পরিবার পরিজন ও কুকুর নিয়ে আমেরিকানরা এধরনের গাড়ি চড়ে
দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়ান। গাড়িটি একই সাথে বাহন ও বাসস্থানের অভাব পুরন করে। এই
গাড়ি নিয়ে বের হলে হোটেলবাসের কোন দরকার নেই। নিরাপদ জায়গায় থামিয়ে রাত পার করে
দিলেই হল। আমেরিকার মত দৈত্যাকার মহাদেশে ঘুরে বেড়াতে গাড়িটি খুবই কার্যকর। হ্যাঁ,
গাড়িটির নাম ক্যারাভান।
আমেরিকার সড়কের দুপাশে অদ্ভুদ নিরবতা।
মানুষের ছায়া দেখা ভার। বাংলাদেশের মত যেখানে সেখানে লোকালয় নেই। পথে বাল্টিমোরে
৫/৭ মিনিট বাস থামে। সামান্য বিস্কুট ও কলা খেয়ে আবার বাসে উঠি। ওয়াশিংটন ডিসি
আসার আগেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। নিউইয়র্ক হতে বিকেল ২টায় যাত্রা করে নির্ধারিত
সময়ের ৫মিনিট আগে ৭টা ৫৫মিনিটে মেঘাবাস ওয়াশিংটন ইউনিয়ন স্টেশন টার্মিনালে এসে
থামে। এই ওয়াশিংটন ইউনিয়ন স্টেশন টার্মিনাল বহুতল ভবন। উপরে দ্বিতল বাস টার্মিনাল
এবং ভূতলে কয়েকতলা ট্রেন স্টেশন। এক্সেলেটরে দুইবার নিচে নেমে এক্সিট দিয়ে বের হয়ে
একটি সুসজ্জিত মাটের দেখা পাই। গেটের সামনে তিনটি মার্কিন পতাকা বাতাসে উড়ছে।
প্রতিটি পতাকা এত বড় যে তা দৈর্ঘ্যে ৫০ হাতের কম হবেনা।
মাটের চারপাশে রাস্থা, এই মাটে এসে মেঝমামা ও মামিকে সামনে পেয়ে যাই। মামা গাড়ি
চালিয়ে আমাদেরকে তাদের ভার্জিনিয়ার বাসায়
নিয়ে যান। গাড়িতে বসে মামা আমাদেরকে কিশমিশ, কাজুবাদাম ও শুকনো ফল খেতে দেন। বাসার
দূরত্ব ২৫ মাইল। বড় বড় সড়ক দিয়ে এসে গাড়ি একটি পরিপাঠি সুন্দর আবাসিক এলাকায় প্রবেশ
করে। সড়কের একপাশে বিখ্যাত Adam’s Mosque এবং অন্যপাশে এই আবাসিক এলাকা। এই আবাসিক
এলাকার ডিজাইন এমন যে, তিনতলা বিশিষ্ট ১৫/১৬ টি ভবন প্রচুর খালি জায়গা রেখে রেখে
একটি সুন্দর পার্কের মধ্যে নির্মান করা হয়েছে। এই আবাসিকে যতজন লোক থাকেন ততটি
গাড়ি পার্কিং স্পেশ চিহ্নিত আছে। তাছাড়াও ভিজিটার গেস্টের গাড়ি রাখার স্থান
নিদৃষ্ট করা আছে।
আমেরিকার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা কত
যে সুন্দর হতে পারে তা না দেখে বুঝার উপায় নেই। এই আবাসিক এলাকার ভিতর আছে সুন্দর
সুন্দর বাগান, যেখানে ফুটে আছে কলাফুল, কাশফুল, ডালিয়া, গাঁদা ছাড়াও নাম নাজানা
অনেক জাতের ফুল। আছে শিশুপার্ক, লন টেনিস, বাস্কেট বল, সকার বল ইত্যাদি খেলার মাট।
আর আছে সুইমিংপুল ও ব্যায়ামাগার। ব্যায়ামাগারে আট/দশ ধরনের মজাদার ব্যায়াম মেশিন।
সবুজ ঘাসের লন, পাশে টিলা ও বন। এধরনের একটি আবাসিক এলাকায় বসবাস করাটাই সৌভাগ্যের
বিষয়। মেঝমামার বাসা একটি ভবনের ২য় তলায়। কাটের সিড়ি বেয়ে সেই বাসায় যাই। বাসার
সিড়িঘর ও মেঝে সব কাটের তৈরী। অত্যাধুনিক নির্মান সামগ্রীতে তৈরী এই বাসার প্রতিটি
কক্ষে উচ্চ প্রযুক্তির সমন্নয় ঘটেছে। বাসাটি দামী পর্দা ও উন্নত কার্পেটে মুড়ানো। দামি
সোফা ও আসবাবে সুসজ্জিত বাসাটি আমাদের শ্রীমঙ্গলের হোটেল গ্রেন্ড সুলতানের কক্ষ ও
লবির মত হবে। তখন ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ছিল আমাদের দেশের শেষ হেমন্তের মত মধুময়।
বাংলাদেশে বেড়াতে এসে আমাদের বাসা
বাড়িতে থাকতে মামির কেন যে অসুবিধা হত তা বুঝতে পারলাম, যদিও মামি তা কখনো প্রকাশ
হতে দিতেন না। বাথটবে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে নানাপদের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার তিন মামা ও দুই খালা সবাই জীবিত, কেবল আমার মা নেই। ২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি
তিনি আল্লাহ পাকের সাহ্নিধ্যে চলে যান। বুঝতে পারি মাতৃহারা ভাগনাকে পেয়ে মামা ও
মামি আনন্দে আত্মহারা।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। ঘুম হতে জেগে
নামাজ পড়ি। বাসার বাহিরের পার্কে হাঁটি। বাসায় এসে খাবার টেবিলে নানা আমেরিকান ফল
সাজানো পাই। গাড় গোলাপী ড্রাগন ফলের সাদা টুকরো কালিজিরায় ভরা। হালকা মিস্টি
ফিরনীর মত এই ফলে আছে কালিজিরের স্বাদ। সেদিন ড্রাগন ফল আমি প্রথম খাই ও
স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলি শোকর আলহামদুলিল্লাহ। কিউই (Kiwy) নামক
আরেকটি বিদেশী ফল প্রথম খাই। ফলটি গোলাকার লম্বাটে ক্ষীরার মত। বর্ন ও স্বাদে যেন
আমাদের কামরাঙা। তবে কামরাঙ্গার চেয়ে অনেক সুস্বাধু।
আমেরিকার ব্যবসা এখন বড় বড় মার্কেটিং
কোম্পানিদের দখলে। এসব কোম্পানীগুলো বড় বড় সপিংমল তৈরী করে
ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করে। নিউইয়র্কে বড় বড় মার্কেটিং কোম্পানিদের ব্যবসা করার অনুমতি নেই। তাই এই মহানগরে ছোট ও
মধ্যম ব্যবসা এখনো টিকে আছে। আমেরিকার অন্য স্টেটে ব্যবসা বহুজাতিক মার্কিন
কোম্পানীগুলো দখল করে নিয়েছে। আমরা ওয়াশিংটন ডিসিতে ওয়ালমার্টের (Walmart) মল
পরিদর্শন করি। একটি মলেই আমাদের পুরো বন্দর বাজার কিংবা আম্বরখানা ঢুকে যাবে।
লাইনে লাইনে পন্য সাজানো। মলের বোর্ডে লিখা আছে কোথায় গার্মেন্টস, কোথায় ঔষধ,
কোথায় ট্র্যলেটিজ, কোথায় ফুড-ব্যাভারেজ। একটি মলে মানুষের ব্যবহার্য্য সধরনের পন্য
রয়েছে। এমন কি রয়েছে ফুলের টব, সারযুক্ত মাটি, হ্যালোইন ও ঘর সাজানোর সামগ্রী।
সামস ক্লাব (Sams Club) আরেক মার্কেটিং কোম্পানী, যেখানে পন্য কিনতে হলে তাদের সদস্য হতে হয়।
বাৎসরিক সদস্য ফি ১৫০ ডলার। এখানে পন্য অনেক সস্তা কিন্তু বেশি পন্য কিনতে হয়।
মামাতো ভাই মুর্শেদ ওদের সদস্য। মুর্শেদের কার্ড ব্যবহার করে তার অপর দুই ভাই ও
মামা বেশ সস্তায় সামস ক্লাবে বাজার করেন। সামসের মল আমাদের জিন্দাবাজারের চেয়ে বড়
হবে। এই মলে পন্যের প্রকার, ধরন ও পরিমান জিন্দাবাজারকে পেরিয়ে যাবে। ঐদিন বিকেলে
হোমডিপো (Home Depo) মলে আমরা মাল কিনি। মাছ মাংস, ফল মূল, শাক সবজি সহ এত
পন্যের সমাবেশ দেখে হতবাক হই।
রাতে আমরা বাসায় খুশগল্প করে কাটাই।
মামা একজন সফিক মামুর গল্প শুনান। জুড়ির সফিক মামা ভাগ্যগুনে হঠাৎ নিউইয়র্কে পাড়ি
জমান। জেএফকে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুলসিরাতের পুল পার হয়েই
খুশিতে আটকানা হয়ে মামাকে ফোন করেন, আমি নিজের যোগ্যতা বলে এদ্দুর এসে গেছি, এখন
তুমি আমারে সামলাও। মামা সামাল দিতে তাকে নিয়ে আসেন এস্টোরিয়ার বাসায়। পরদিন ঘুম
থেকে জেগে সফিক মামু বললেন, এই বরফের দেশে তোমরা এত ঠান্ডা পানিতে কেমনে গোসল কর?
গতরাতে এই ঠান্ডা পানিতে গোসল করে আমার জ্বর হয়ে গেছে। মেঝমামা জবাব দেন, সফিক রে,
তর কপালটা বড় ভাল, শরীরটা যে পুড়াস নি। ভাগ্য ভাল, তর সামান্য জ্বর হয়েছে, উলটো টা
ঘটলে তুই এখন হাসপাতালে থাকতি।
আমেরিকা এসে সফিক মামু এই প্রথম দেখলেন
বাসার পাইপ লাইন দিয়ে কেবল ঠাণ্ডা নয়, গরম পানিও বেরিয়ে আসে। আমেরিকায় আদিযুগে আসা
বাঙ্গালী হিসাবে মামার একটি কাজ ছিল দেশ হতে আমেরিকায় আসা বৈধ ও অবৈধ
বাংলাদেশীদেরে আমেরিকায় লাইন ধরিয়ে দেওয়া। একবার একজন সদ্য দেশাগতকে বাসার
গেস্টরুমে ঘুমাতে দেন। শীতের রাতে হিটারের পট পট শব্দে তার ঘুম হয়নি। রাতে হিটার
হতে গরম বেরুতে দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। ঘরে আগুন লেগে যাবে ভেবে ভদ্রলোক শেষরাতে
দরজা ঠুকে মামার ঘুম ভাঙ্গান। আসলে শীতপ্রধান দেশের হিটার সম্পর্কে এই ভদ্রলোকের
আদৌ কোন ধারনাই ছিলনা।
এবার মামা-মামির কাছে আমেরিকায় একটি
মসজিদ নির্মানের কাহিনি শুনি। আমেরিকায় মুসলমানরা বলা যায় নবাগত। সব জাতি ধর্মের
লোকজন আমেরিকায় আসার পর মুসলমানদের শুভাগমন ঘটে। উপাসনার জন্য নবাগত মুসলমানদের
মসজিদ চাই। একবার কয়েকজন অভিবাসী মুসলিম সবাই মিলে একটা মসজিদ নির্মানের সিন্ধান্ত
নেন। একটা জায়গা সবার পছন্দ হয়। জায়গার মালিক একজন শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান, নাম জন।
মসজিদের জন্য পছন্দের এই জায়গাটা কিনতে সবাই জনের বাসায় যান। কিন্তু জন তাদেরকে
কোন পাত্তাই দেন নি। দরজা হতে বিদায় করে দেন। মুমিনের দল হাল ছাড়লেন না, তারা নানা
উপহার নিয়ে বৃদ্ধ জনের বাসায় বারবার ধর্না দেন। জন মনে মনে ভাবেন, কোন পাত্তা না
দেয়া সত্বেও এই লোকেরা নত হয়ে বার বার আসছে ও জায়গাটা তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার
জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করছে। মুমিনদের ব্যবহারে বিমুগ্ধ জন এবার বললেন, আমার
পৈত্রিক জায়গা তোমাদের মসজিদ নির্মানের জন্য আমি দিতে পারি, তবে কোন মূল্য গ্রহন
করবনা। কারন তোমরা কোন ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আমার কাছে এসো নাই। এসেছো তোমাদের
সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিস্টান মসজিদ বানাতে।
শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান জনের দানের জায়গায়
একদিন মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হল। এক জুমুয়ার জামাতে মসজিদের ভূমিদাতা জনকে মসজিদে আসার
আমন্ত্রন করা হল। মুসল্লিরা ভুমিদানের জন্য জনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
মুসল্লীদের অমায়িক ব্যবহারে জন অভিভূত হন। জন প্রতি শুক্রবারে মসজিদে আসেন এবং
ঈমাম সাহেবের খুতবা শুনেন। কিছুদিন পর জন ঈমামকে বললেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করব। জনের
ইসলাম গ্রহনের জন্য এক শুক্রবার ধার্য্য করা হল। মুসল্লিরা সকলেই জনের জন্য কিছু
না কিছু উপহার নিয়ে আসেন। জন ইসলাম গ্রহন করলেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এক
শুক্রবারে মারা গেলেন। সেই শুক্রবারে জনের মসজিদে মুসল্লিরা তার জানাজায় শরিক হন।
জনের জানাজা শেষ, গল্পও শেষ। এবার
ভার্জিনিয়ার একটি মসজিদের বর্ননা দেবো। এই মসজিদটি মেঝমামার এই বাসার সন্নিকটে এবং
মসজিদের আকর্ষনে মামা-মামি এই আবাসনে বাসা নেন। এই মসজিদের নাম আদমের মসজিদ
(Adam’s Mosque) অতি উচ্চশিক্ষিতরা এই মসজিদ ব্যবস্থাপনা করেন। এই মসজিদের পরিচালনা
কমিটিতে সাতজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী মহিলা রয়েছেন। সিলেটের ফুলবাড়ির একজন
উচ্চশিক্ষিত প্রকৌশলী এই মসজিদ কমিটির সদস্য।
আদমের মসজিদ বিশাল এলাকা জুড়ে একটি
বহুতল কমপ্লেক্স। দুতলায় দুইটি বড় হল। একদিকের সিড়ি পুরুষরা পুরুষ-হলে ও অন্য সিড়ি
দিয়ে হিজাবপরা নারীরা নারী-হলে গিয়ে জামাতে শরিক হন। এই মসজিদে নামাজ পড়ে আন্দাজ
করি পুরুষ-কক্ষের তুলনায় নারী-কক্ষে মুসল্লির সংখ্যা অনেক বেশি। আসলে শিশুরা
মায়েদের সাথে এসে মহিলা-কক্ষে মুসল্লিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ইমাম মাথায় কোন
টুপি ছাড়াই নামাজ পড়ান। জুমুয়ার জামাতে ওয়াজ ও খুতবা পাঠকারী একজন স্যুট-কোট-টাই
পরা স্মার্ট লোক। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই, তিনি একজন ধর্মীয় হুজুর। খুতবার ভাষা
ইংরেজি, তবে আরবির প্রচুর মিশ্রন রয়েছে। মসজিদের বহিরাঙ্গনে বিশাল কালো পিচ ডাকা
মাট। মাটে সাদা তুলিতে টানা গাড়ি পার্কিং মানচিত্র। এই বড় মাটে সাত শত গাড়ি
পার্কিং ও আগমন- নির্গমন ব্যবস্থা রয়েছে। ভার্জিনিয়া ধনী এলাকা। এখানে যত মুসল্লী,
ততো গাড়ি। শুক্রবারে এই বিশাল পার্কিং অপ্রতুল হয়ে যায়। তাই আমরা গাড়ি ছাড়া বাসা
হতে পায়ে হেটে আদমের মসজিদে যাই।
আমেরিকার মসজিদ ঠিক আমাদের মসজিদ
নয়। আমেরিকার মসজিদ শুধু পুরুষের নয়, সমভাবে মহিলাদেরও জামাতে নামাজের স্থান।
আমেরিকার মসজিদ সাদা-কালো-মিশ্র,
নর-নারী-শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতা মুসলমানদের ধর্মীয় এবং সামাজিক
মিলনকেন্দ্র। আদম মসজিদের গ্রাউন্ড লেবেলে যে জায়গায় জুমুয়ার খুতবা হয়, তা একটি বাস্কেট
বল খেলার মাট। জামাত শেষে কিশোরেরা এই মাটে বাস্কেট বল খেলেন। মসজিদে আছে উন্নত
পাঠাগার, চেয়ার টেবিল সজ্জিত বৈঠকখানা ও পাঠকক্ষ, মুসল্লিদের মেলাঘর। নারী
মুসল্লিরা মেলাঘরে নিজেদের হাতে তৈরি নানা পদের খাবার নিয়ে আসেন। সবাই মিলে খান।
যুক্তরাষ্ট্র এমন এক দেশ যেখানে খাবারের প্রাচুর্য্য, এখানে কার খাবার কে খায়?
তারপরও এই খাদ্য সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করে দেয়।
প্রতি ঈদে মসজিদ চত্বরে ঈদমেলা
বসে। শিশুদের জন্য নানা প্রকার খেলাধুলা, হৈ চৈ, আনন্দ উল্লাসের ব্যবস্থা থাকে।
মেঝমামা বললেন, মুসলিম উম্মার
অর্ধেক মানুষ মহিলা, অথচ আমাদের দেশে এই অর্ধেক মানুষকে ধর্মগুরুরা মসজিদের মত
পবিত্র ও পূন্যময় জায়গা হতে বঞ্চিত করে রাখেন।
সে রাতে ৩০/৩৫ মিনিট কার চালিয়ে
মামা-মামি আমার বড় সমনদিক কবির আহমদ চৌধুরীর বাসায় আমাদেরকে পৌঁছে দেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, বুধবার।
কবির চৌধুরীর বাসা ভার্জিনিয়ার ওয়েলিংটন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। আবহাওয়া আমাদের
দেশের শীতকালের মত ঠান্ডা। বড়ভাই আমাদেরকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমনে বের হন। বড় বড় রাস্থা
এবং রাস্থার দুপাশে নানান জাতের ফুলের মেলা। ঠান্ডায় হাঁটতে বেশ ভালই লাগে। টিলার
উপর একটি সুন্দর পার্কে এলাম। পার্কটির নাম টাইরল হিল পার্ক। সমতল টিলা প্রান্তরের
একদিকে শিশুপার্ক ও অন্যদিকে বড় খেলার মাট। প্রান্তরের চারপাশ আবর্তন করে আছে
হাঁটা-দৌড়ার পিচ ঢাকা মসৃন রাস্থা। ঐ ডিম্বাকার রাস্থায় আমি জগিং করি। এই পার্কের
পাশ দিয়ে একটি সড়ক গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ছোট্ট সাইনবোর্ড লিখা Nature Park.
ঐদিন এই নেচার পার্কে গেলাম না। ফিরে এলাম বাসায়।
সকাল ১১টায় ভাতিজী ইমা ও তার হাজব্যান্ড
জাহিদ আমাদেরকে আমেরিকান সিভিল ওয়ার মিউজিয়ামে নিয়ে যায়। এই জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা
আছে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের অজস্র স্মারক। জাদুঘর
তত্ত্ববধায়ক আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে আমার সাথে বেশ আলোচনা করেন। এই জাদুঘর একটি বড়
পার্কের মধ্যে অবস্থিত। প্রাঙ্গণে লিখা- Fort Musium Park and Historic Site. পার্কের বহিঃ প্রাঙ্গণে আমেরিকার সিভিল ওয়ারে
ব্যবহৃত কামান ও যুদ্ধাস্ত্র ঘুরে দেখি। পার্কের একটি গাছ তলায় প্রচুর পাকা পিচফল
পড়ে আছে। কিছু পিচ কুড়িয়ে বাসায় এনে ধুয়ে খাই। ফলগুলো খুব সুমিষ্ট। আমেরিকার লোকজন
গাছের নিচের ফল কুড়িয়ে খায়না। ওসব কাটবিড়ালী ও পাখিরা খায়।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, বৃহস্পতিবার।
আজ ঈদুল আজহার দিন। আমরা ওয়াশিংটন ডিসির দারূল হিজরা মসজিদে ঈদ জামাতে নামাজ পড়ি।
কবির ভাইয়ের ছোট মেয়ে শ্যামা গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদেরকে মসজিদে নিয়ে যায়। সে লম্বা
ফর্সা ও স্বাস্থ্যবান। হিজাবপরা শ্যামাকে এরাবিক মেয়ে মনে হয়। পাঁচ ছয় মাইল পথ
পেরিয়ে আমরা মসজিদে আসি। এখানে পার্কিং স্পেসের কোন অভাব নেই। পাশের গীর্জা
মুসলমানদের ঈদ জামাতের জন্য তাদের পার্কিং স্পেস সৌজন্যস্বরূপ ছেড়ে দিয়েছে।
আমেরিকায় বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্ক বিদ্যমান দেখে বেশ ভালই
লাগে। আরবীদের পরিচালিত এই মসজিদে নামাজ পড়ে আমরা আবার মক্কা-মদীনায় নামাজ পড়ার
অনুভূতি পেলাম। কালো, সাদা ও মিশ্র বর্নের নানা জাতির উম্মতে মোহাম্মদীর সাথে ঈদ
জামাতের পর এখানে কুলাকুলি করে বাপ-পুতে বিশ্ব ভাতৃত্বের স্বাদ গ্রহন করি।
বড়ভাবী সাল্লার শ্রীয়াইয়ের জমিদার
কন্যে। তিনি একজন রন্ধন বিশারদ। দেশে রন্ধন শিল্প নিয়ে তিনি বেশ তৎপর ছিলেন। সবার
কাছে তার রান্নার বেশ সুনাম ছিল। তিনি ও ভাতিজিরা রাতজেগে তৈরী করেন সন্দেশ, পিঠা,
চটপটি, খেজুরী ইত্যাদি বাঙ্গালী খাবার। বাসায় ফিরে বেশ সাধনায় তৈরি সব খাবারই একটু
একটু করে চেখে নেই। ডায়েট সেমাই ছিল দারূন মজাদার।
মুয়িদ চৌধুরী বড়ভাবীর ফুফুতো ভাই। রাতে
তার বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ পাই। তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন। তবে তার বেগম সাহেবা
সায়েদা মেহের চৌধুরী মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসে চাকুরী করেন। তাদের
বাড়ি মৌলিভীবাজারের চাউতলি এলাকায়। তার খুব সুন্দর বিলাসবহুল ত্রিতল বাসা। পাশে
অনুরূপ আর দুইটি বাসা ভাড়া দেওয়া আছে। এই দম্পতির দুইজন সুদর্শনা দুইকন্যা ফ্লোরা
ও তানিয়া। দুই বোনই উচ্চশিক্ষিতা এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে ভাল জবে আছেন।
মুয়িদ ভাইয়ের বাসায় ভাটিপাড়া, হাজিপুর, ঘিলাছড়া ও চাউতলীর চৌধুরীবংশের অনেকের সাথে
দেখা হয়, যারা আমাদের দুরসম্পর্কীয় আত্মীয়। বড় বড় গামলায় সাজিয়ে রাখা খাবার আর
খাবার। আমার সামান্য ডায়বেটিস। কতইবা আর খাওয়া যায়।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল,
শুক্রবার। ভোরে নাস্তা সেরে Tyrol Hill Park আসি। পার্ক হতে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে
নেচার সেন্টারে প্রবেশ করি। এই পাহাড়ি এলাকায় সারি সারি পাইন, মেপল, উইলো, অক
বৃক্ষের ঘন বন। নেচার সেন্টারের নিম্নভূমি বরাবর একটি পরিস্কার পানির ঝর্না বহমান।
ঝরনার ওপারে পাহাড়ের ধাপে কেটে সুন্দর রাস্থা। নানাজাতের বুনো ফল ফুল লতা গ্লুগ্ন রাস্থার ঢালু বেয়ে নিচের ঝরনা পর্যন্ত নেমে বাতাসে দোল খাচ্ছে।
এখানে রয়েছে সুরম্য জলাভূমিতে ফোটে আছে শাপলা, পেনা ও জলজ ফুল। বনের ফাঁকে ফাঁকে
বসে আছে লাল, নীল ও খয়েরি রঙের বাহারী পাখি। জলাভূমিতে সাতার কাটছে বুনো পাখি ও
হাঁস। জলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা পায়ের বক।
পাহাড়ি এই সুন্দর নিরব সড়কে জগিং ও
সাইক্লিং করছেন কিশোর কিশোরী হতে শুরু করে নব্বই বয়সী বুড়োবুড়িরা। যথেষ্ট ঠান্ডা
থাকা সত্বেয় সবার গায়ে হাফপ্যান্ট ও গ্যাঞ্জি, পিঠে ঝুলছে পানির বোতল। শিশুদেরে
সিটারে বসিয়ে কেউবা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকের সাথে আছে তাদের প্রিয় কুকুর।
নেচারপার্কের অরন্যে আছে বনভোজন
স্থাপনা, এমনকি রেস্টরোমও রয়েছে। লোকেরা ছড়ায় বল ছুড়ছে, তাদের কুকুর জলে ঝাঁপ দিয়ে
বল নিয়ে আসছে। এভাবেই তারা কুকুরের গোসল ও ব্যায়াম সম্পাদন করছে। নেচারপার্কে আমি
ও জেফার অনেক হাঁটি ও দৌড়ি। একদিন এই পার্কে হেঁটে আমার বেগম সাহেবা বেশ ক্লান্ত
হয়ে যান। বাসায় ফিরতে তার বেশ কষ্ট হয়। আমেরিকার এই নেচারপার্ক এত বড় যে এটি
সিলেটি শহরের অর্ধেক হয়ে যাবে। এই গভীর জঙ্গল হতে বের হবার প্রতিটি রাস্থার মুখে
এক একটি সুন্দর শিশুপার্ক ও খেলার মাট রয়েছে। শিশুপার্কগুলোতে পুতুলের মত তুলতুলে
সুন্দর শিশুরা প্রশান্ত মনে দুলছে, খেলছে। এই বিদেশী শিশুরা কারো কোল চড়েনা,
কান্নাকাটি করেনা। তারা শান্ত ও সুবোধ। মানুষ শিশুদেরে কখনো স্পর্শ করেনা। হাত
নেড়ে কেবল ইশারায় স্নেহ জানায়। সাদা শিশুদেরকে দেখে মনে হয় তারা মোমের তৈরী ও চোখ মার্বেল পাতরে
বাঁধানো। কালো বাচ্চারাও সুন্দর, তাদের কুকড়ানো বিছাকার কালো চুল যেন কেউ যতনে
সাজিয়ে দিয়েছে।
আমার মেজমামার তিনজন পুত্ররত্ন
মুর্শেদ, ফরহাদ ও জায়েদ। কেবল মুর্শেদের জন্ম বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে। শিশু বয়সে সে
আমেরিকা চলে যায়, তাই বাংলাদেশের কোন স্মৃতি তার নেই। তার শিক্ষা ও বেড়ে উঠা
নিউইয়র্কে। মাস্টার্স করে যুক্তরাষ্ট্রে সে বড় চাকুরী করছে। ভার্জিনিয়ায় মুর্শেদের
খুব হাইফাই বাগান বাড়ি আছে। সে এডভান্স মডেলের দামী গাড়ি চালায়। মুর্শেদের দামী
সাদা জিপ নিয়ে আমরা সারাটা ওয়াশিংটন শহর ঘুরে বেড়াই। তখন ২০১৫ সাল কিন্তু গাড়িটির
মডেল ছিল ২০১৬ সাল। আমাদের সাথে ছিল মুর্শেদের তের বছরের একমাত্র পুত্র হামিদ।
হামিদ আমার মেঝমামার তিনছেলের একমাত্র পুত্র সন্থান। ডালিমের মত উজ্জল
গাত্রবর্নের হামিদ খুবই সুদর্শন। এত
সুন্দর বালক আমেরিকায়ও বিরল। মামা-মামির একমাত্র নাতী হিসাবে এই পরিবারের সবার প্রিয়পাত্র সে। হামিদের আম্মা রাবিয়া খানম একজন পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের
কন্যা। মুর্শেদের দুই মিষ্টিকন্যা মরিয়ম, আয়শা, হামিদ এবং আমরা মুর্শেদের পাজেরো
কিংবা নিশান পেট্রোলের মত দামী জীপটিতে উঠি। মুর্শেদ চালক, আমি সামনের ডান সিটে
তার পাশে বসি। সিট গরম হয়ে শীত তাড়ায়। সিটে কম্পন হয় ও সিট কোমর ম্যাসাজ করে দেয়।
জিপিএস (Global positioning system) গাড়ির পথ নির্দেশ করে
দেয়।
আমরা পটোমাক নদীর উপর নির্মিত একটি
দীর্ঘ্য সেতু পার হয়ে রাস্থার বামদিকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদরদপ্তর পেন্টাগন
দর্শন করি। ছবিতে দেখা সেই পেন্টাগন যা পঞ্চভূজাকৃতির বিশাল স্থাপনা। চারপাশে ঘিরে
আছে নিরাপত্তা প্রাঙ্গন। কিছুক্ষন পরই আমাদের জিপ এসে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের সামনে
পার্কিং করে। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট
জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতিসৌধ। মুসলিম বিজয়স্মরনী দিল্লীর কুতুবমিনার
বৃত্তাকার হলেও ওয়াশিংটন মনুমেন্ট একটি বর্গাকার আকাশছোঁয়া
মিনার। হয়ত কুতুবমিনার দেখেই আমেরিকানরা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট নির্মানে অনুপ্রানিত
হয়। এই মনুমেন্টের চারপাশে বিশাল চত্বর। স্মৃতিমিনারটি এতই উচু যে এই চত্বরে
স্থাপিত মার্বেল পাতরের বেঞ্চে শুয়ে আকাশে তাকালে মনুমেন্টের চুড়া দেখা যায়।
ওয়াশিংটন মনুমেন্টের চারপাশে
যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। এই মনুমেন্ট চত্বর হতে
হেঁটে হেঁটে আমরা সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ার মেমোরিয়ালে যাই। হামিদ পিঠে পানির পট নিয়ে
সামনে দৌড়াতে থাকে। আমরা তাকে অনুসরন করি। সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ার মেমোরিয়ালে
আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের ধারাবাহিক পতাকা ও নাম খুদিত রয়েছে। আরেক হাঁটায় আমরা পৌঁছে
যাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন মেমোরিয়ালে। এই মেমোরিয়াল প্রাঙ্গনের সামনে
একটি স্বচ্ছজলের লেক। সিড়ি বেয়ে অনেক নিচে নেমে লেকপার। জেফারসন মেমোরিয়াল একটি বড়
ভবনের মত স্থাপনা। এই স্থাপনার মাঝখানে একটি স্টেজে প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের
বিশাল কালো ব্রুঞ্চের মূর্তি। এখানে এই মূর্তির সামনে আমরা অনেক ছবি উঠাই। ভবনের
ওয়ালে ওয়ালে জেফারসনের বেশ কিছু বানী উৎকীর্ন রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জেফারসন ছিলেন
একজন আইনজ্ঞ। ইংলিশ হরফে লেখা তার বানী পড়ে মনে হল তিনি একজন একেশ্বরবাদী ধার্মিক
লোক ছিলেন।
আমরা হামিদের পিছু পিছু দৌড়ে
হাফিয়ে উঠি। এবার হামিদ যেখানে গিয়ে থামল তা আব্রাহাম লিঙ্কন
মেমোরিয়াল। তিনি আমেরিকার ষোলতম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, আমেরিকা হতে অমানবিক
দাসপ্রথা উচ্ছেদকারী প্রেসিডেন্ট, গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্য
রক্ষাকারী প্রেসিডেন্ট, যিনি গেটিসবার্গ এড্রেসে গনতন্ত্রের শ্রেষ্ট সংজ্ঞাদাতা (Government
of the people, by the people, for the people) প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন।
পৃথিবী হতে বর্বর দাসপ্রথা উচ্ছেদে তিনি আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন।
রাতের বিদ্যুতের আলোয় আমরা বাগানঘেরা
হোয়াইট হাউসের সামনে আসি। গাড়ি পার্ক করা বেশ কঠিন কাজ। দূরে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে
হেঁটে আসি। ভিতরে ঢুকা যাবেনা। বাহির হতে দেখতে হবে। গতকাল হোয়াইট হাউসে আসেন
ক্যাথলিক ধর্মপ্রধান ভেটিকানের পোপ বেনেডিক্ট। আজ এসেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিন
পিং। কয়েকজন অনিন্দসুন্দরী সুসজ্জিত এশিয়ান তরুনীকে চীনের বিচিত্র পোষাকে সজ্জিত
হয়ে একটি নতুন পতাকা নিয়ে হোয়াইট হাউসের সামনে এগিয়ে যেতে দেখি। মামি একটি মেয়েকে
পরিচয় জানতে চাইল জানালো তারা তিব্বতী মেয়ে, তিব্বতের পতাকা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জি
জিন পিং এর সামনে তিব্বতে চীনের আগ্রাসনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ
জানাতে যাচ্ছে। আমরা তাদের সাথে এগিয়ে যাই। হোয়াইট হাউসের সামনে গিয়ে নিরাপত্তা
রক্ষীদের বাধা পেয়ে থেমে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে হোয়াইট হাউস দেখে নেই। নয়-এগারোর আগে
হোয়াইট হাউস চত্বরে ঢুকা যেত। এখন কড়াকড়ি থাকায় ভিতরে প্রবেশ সম্ভব হয়না। এইখানে
যে কোন সাধারন মানুষ প্লেকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যে
কোন ব্যাপারে যে কোন ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে পারে, দাবী দাওয়া জানাতে পারে। এমন কি
যুক্তিপূর্ণ ভাষায় প্রেসিডন্টের যে কোন কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করতে পারে।
মার্কিন গনতন্ত্র মানুষকে এই অধিকার দিয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে অসংখ্য জাদুঘর রয়েছে।
বিজ্ঞান জাদুঘর, মহাকাশ জাদুঘর, ইমিগ্রেন্ট জাদুঘর, সমরাস্ত্র জাদুঘর সতর্ক নজরে
সংক্ষেপে দেখে নেই। এসব জাদুঘর আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের এক একটা মহাসাগর।
রাতে মুর্শেদের সৌজন্যে আমরা ও
মামা-মামি একটি আফগান হোটেলে ডিনার করি। সুস্বাধু আফগান নানরুটি, কাবুলি মোঠাদানার
বুট, পোলাও, কবাব, সালাদ, সস ও ডায়েট কোক। এত খাবার সামনে এগিয়ে দেয় যার অর্ধেকও
খাওয়া সম্ভব হয়নি। আমেরিকানরা হাফ খায়, হাফ ফেলে দেয়। ধনী দেশের মানুষের এযেন এক
নিষ্টুর অপচয়।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল, শনিবার।
আমেরিকায় নার্সিং সম্মানজনক পেশা। শাম্মি যুক্তরাষ্ট্রে নার্সিং পড়ছে। সে যে হাসপাতালে জড়িত একদিন সেই ভার্জিনিয়া গবর্নমেন্ট হসপিটাল সে
আমাদেরকে দেখাতে নিয়ে যায়। তিনশত বেডের হাসপাতাল। ঢাকায় আমি এপোলো হাসপাতাল,
স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল দেখেছি। ভার্জিনিয়া সরকারী হাসপাতাল এত উন্নত
ও সুসজ্জিত যে আমাদের এসব হাসপাতাল সে তুলনায় কিছুই না। ভার্জিনিয়া হাসপাতালে
লোকজনের ভীড় নেই, রোগী দেখা যায়না। সারাটা হাসপাতালে এক ধ্যানময় অরন্যের নিরবতা।
হাসপাতালের বাগানের ফাঁকে ফাঁকে পানির ফোয়ারা, আলোকসজ্জা ও সোফাসেট পাতা।
হাসপাতালের পরিবেশ এতই মনোরম ও পরিপাটি যে রোগী এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে।
আমেরিকায় চিকিৎসক হওয়া সহজ নয়।
কেবল অতি মেধাবীরাই ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পান। ডাক্তারদেরকে অতি সাবধানে কাজ করতে
হয়। প্রতি দশ বৎসর পর পর প্র্যাকটিস বহাল রাখার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। পাশ না হলে
চিকিৎসা করার অনুমতি বাতিল হয়ে যায়। তাই আমেরিকায় ডাক্তারদের সারা জীবনই পড়তে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসকদের ভূল
করার কোন সুযোগ নেই। রোগী মামলায় জিতে গেলে মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়। একটি
ভূলের মাসুল জরিমানার খাতায় গিয়ে জীবনের সব উপার্জন শূন্য হয়ে যেতে পারে। তাই
এধরনের বিপদ হতে বাঁচতে এখানে ডাক্তাররা ইনস্যুরেন্স করেন যাতে বিপদ হলে কোম্পানি
রক্ষা করে।
ভার্জিনিয়া একটি ছোট্ট স্টেট। আয়তন
৩৯,৫৯৮ বর্গমাইল। রাজধানী শহর রিচমন্ড, তবে এই স্টেটের প্রধান শহর ভার্জিনিয়া বিচ।
এই স্টেটের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির সীমান্ত রয়েছে এবং এই
মহানগরের পশ্চাৎভূমি এই ভার্জিনিয়া স্টেইট। ভার্জিন শব্দের অর্থ কুমারী।
ইংল্যান্ডের চিরকুমারী রানি ভিক্টোরিয়ার সম্মানে এই স্টেইটের নাম রাখা হয়
ভার্জিনিয়া। এই মার্কিন স্টেটটি দি ওল্ড ডমিনিওন স্টেট নামেও পরিচিত। আসলে সিলেটের
মত ভূপ্রকৃতি বিশিষ্ট ভার্জিনিয়া স্টেট ইংল্যান্ডের কুমারী রানির মতই সুন্দরী।
নামটি নিশ্চয়ই সার্থক বলা যায়।
ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ড এই দুই
স্টেটের মাঝখানে ৬১ বর্গমাইল জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি
অবস্থিত। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফেডারেল গভর্নমেন্টের (কেন্দ্র সরকার) হাতে। এখানে
সুপরিকল্পিতভাবে ফেডারেল গভর্নমেন্টের সব অফিস আদালত, জাদুঘর, স্থাপনা, স্মৃতিসৌধ,
পার্ক ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন ডিসির জনসংখ্যা মাত্র পাচ লক্ষ পচিশ হাজার।
ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত বিশাল জনতার সিংহভাগই কেন্দ্রশাসিত ডিসির বাহিরে
ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড স্টেটে বসবাস করেন। তারা দিনে
ওয়াশিংটনে অফিস ও ব্যবসা করেন, রাতে ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডে ঘুমান। তাই সারাটা ওয়াশিংটন ডিসি বড় বড় সড়ক, বাগান, পার্কিং,
নদী ও জলাবেষ্টিত।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সাল, রবিবার। সে
দিন আমাদেরকে দেখতে আসে মামাতো বোন সোফা ও তার স্বামী আলম। সাথে আসে মামাতো ভাই
তাওহিদ ও তার বেগম ছাতকের মেয়ে সুমাইয়া। তারা মিশিগানে বসবাসকারী আমার ছোটমামা শহীদ
চৌধুরীর সন্থান।
তারা বিদায়ের পর ইমা আমাদেরকে বালস্টন
মলে (Ballston Mol) নিয়ে যায়। বিশাল মার্কেটিং মল ভবনের সাথে সংযুক্ত একটি সাততলা
পার্কিং। প্রতিতলায় তিনচার হাজার করে সাততলা পার্কিং জুড়ে প্রায় পচিশ-ত্রিশ হাজার
গাড়ি রাখা যাবে। গাড়ি রেখে পার্কিং স্থান ভূলে গেলে গাড়ি খুঁজে বের করা দুরুহ হবে।
পার্কিং ফি ১ডলার। ৩ ঘণ্টা পর ৪ ডলার। কার্ডে ফি পরিশোধ করেই পার্কিং স্থানে ঢুকা
সম্ভব হয়। পার্কিং ব্যবহারের জন্য চারপাশ প্যাচিয়ে অনেক রাস্থা
রয়েছে। এই পার্কিং স্পেসের একতলায়ই সিলেট শহরের সবগুলো গাড়ি রাখার
জায়গা হয়ে যাবে। ভার্জিনিয়া ও ওয়াশিংটন ডিসিতে এমন অনেক মল ও পার্কিং রয়েছে।
বিকেলে তাওহীদ এসে আমাদেরকে
মেরিল্যান্ডে তুর্কি মসজিদ দেখাতে নিয়ে যায়। মসজিদটি তুরস্কের ওসমানীয় মসজিদের
নির্মানশৈলীতে নির্মিত। বড় এক গম্বুজ
মসজিদটি দুতলা, দুতলার অর্ধেক স্থান সিনেমাহলের মত খোলা। রয়েছে উন্নত কার্পেট ও
ঝাড়বাতি। সামনে আধুনিক অজুখানা ও সুউচ্চ মিনার। বিশাল মসজিদ কমপ্লেক্সে আছে
কমিউনিটি সেন্টার, মাদ্রাসা, পাঠাগার ও পার্কিং মাট। অপরূপ সুন্দর এই মসজিদে
নরনারীরা স্বস্ব স্থানে উপাসনা ও নামাজ আদায় করছেন। এখানেও লক্ষ্য করি পুরুষের
চেয়ে নারী মুসল্লীরাই সংখ্যায় অনেক বেশী। এই মসজিদের ভূগর্বেও কয়েক শত গাড়ি রাখার
ব্যবস্থা রয়েছে।
টার্কি মসজিদ হতে বের হয়ে আমরা
মেরিল্যান্ডের ন্যাশনাল হারবারে যাই। ডিসির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আমেরিকার একটি
ঐতিহাসিক নদী পটোমাক। একটি ছোট্ট সেতু দিয়ে আমরা নদীর মাঝে স্থাপিত ক্যাপিটেল
হুইলে (Capital Wheel) যাই। তাওহীদ ৭৫ ডলারে পাঁচটি টিকেট কেটে আমাদেরকে
নিয়ে ক্যাপিটেল হুইলে আরোহন করে। তাওহীদের স্ত্রীর উচ্চতা ভীতি থাকায় হুইলে ঊঠেই
ভয় পান ও নেমে যান। হুইল অনেক উপরে উঠলে নদীর ওপারে আলো ঝলমলে ওয়াশিংটন ডিসি চোখের
সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
পটোমাক আমাদের মেঘনার মত এই
বিশাল নদী। এই নদীপারে স্বল্প জলে ও কাদায় ভাসমান মানুষের লাশ প্রত্যক্ষ করি।
লাশের গায়ে নদীর ঢেউ এসে পড়ছে। লাশটি যেন কাদাজলে ভাসছে। কাছে গিয়ে
দেখি এটি মানুষের সত্যিকারের লাশ নয়, শিল্পীর গড়া একটি ভাস্কর্য্য
মাত্র।
ন্যাশনেল হারবার হতে ফেরার সময় ছিল ভরা
পূর্নিমা। আকাশে ঝলমল করছে পূর্ন চাঁদ। আচমকা চন্দ্রগ্রহন শুরু হয়। একটি কালো মেঘ
চাঁদকে ডেকে দেয়। রাত ১০ টায় ফিরে আসি ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন, সমনদিক কবির চৌধুরীর
বাসায়।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালঃ ঠান্ডা সকালে
আমরা সবাই নেচারপার্কে প্রাতঃভ্রমন করি। বিকেল ৪টায় মামামামি আসেন। আমাদেরকে নিয়ে
যান তাদের বাসায়।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালঃ ফজরের নামাজ
পড়ি আদম মসজিদে। সার্টপ্যান্ট পরিহিত নিগ্রো ঈমাম সাহেব টুপিবিহীন অবস্থায় নামাজ
পড়ান। নামাজ শেষে এখানেও কোন মোনাজাত করা হয়না।
বাসায় ফিরে চা-নাস্তা করে গল্পকথায় ডুবে
যাই। মেঝমামার কাছে তাদের নিউইয়র্ক জীবনের প্রিয় চিকিৎসক ডাঃ এম এন রায়ের
স্মৃতিচারন শুনি। ডাঃ রায় কোলকাতার অধিবাসী। তিনি ভারতের এমবিবিএস এবং লন্ডনের
এফআর সিএস। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি হন নিউইয়র্ক হাসপাতালের একজন স্বনামধন্য
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। মামার দুই পুত্র জাহেদ ও ফরহাদের জন্ম হয় ডাঃ রায়ের হাতে।
মামির সিজারিয়ান অপারেশন করার আগে ও টি হতে বের হয়ে মামাকে বললেন, আমি কহিনুরের
পেটে ছুরি চালাই কেমনে, ও যে আমার মেয়ের মত। তারপর চোখমুছে অপারেশন থিয়েটারে
ঢুকেন। একজন বাঙ্গালী বলে মামি ডাঃ এম এন রায়ের কাছে কেবল একজন নিছক রোগী নন,
তারচেয়েও অনেক বড় কিছু। বাঙ্গালী-বাঙ্গালী এক আত্মীক সম্পর্ক।
ডাঃ রায়ের সব ছিল। ধনদৌলত, গাড়ি-বাড়ি,
বিদ্যা-বুদ্ধি, চাকুরী-প্রতিষ্ঠা সব। কিন্তু তিনি ছিলেন
নিঃসন্থান। সন্থানহীনতা দুঃখ দিলেও উচ্চশিক্ষিতা বৌদিকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার।
কলকাতা হতে ভ্রাতুষ্পুত্রকে দত্তক নেন। কিন্তু ছেলেটি আমেরিকার জীবনব্যবস্থায়
খাপ খাওয়াতে পারে নি। বড়লোক বাবার এই সন্থানটি দুইতিন বছর পর ফিরে যায় কলকাতায়। আর
আসেনি আমেরিকায়।
ডাঃ রায় নিমন্ত্রন পেলেই আসতেন মামার বাসায়। আধুনিক এই মানুষটি গোমাংস হতে শুরু করে
সবকিছু খেয়ে সাবাড় করতেন। বৌদি কখনো গোমাংস খেতেন না। স্বামী গোমাংসের আবদার
জানালে বৌদি বলতেন, ওর কথায় তোমরা কান দেবেনা। এসব ওর সামনে
নিয়ে এসোনা- দেশে গিয়ে ওকে এজন্য প্রায়চিত্ত করতে হবে।
বুড়ো হয়ে বৌদি মারা যান। প্রিয় পত্নীকে
হারিয়ে ডাঃ এম এন রায় একদম একা হয়ে যান। বৌদির মরদেহের ছাইয়ের কৌটা সযতনে এনে
রাখেন বাসায়। ডাঃ রায়ের সম্পদের অভাব ছিলনা। বৌদির চিরবিদায়ের পর একজন আইরিশ মহিলা
তার জীবন পার্টনার হন। ডাঃ রায় আমেরিকায় প্রচুর উপার্জন করেন। তার ছিল কয়েকটি দামী
বাড়ি, গাড়ি ও প্রচুর সম্পদ। বৃদ্ধ বয়সে তিনি শয্যাশায়ী হলে সম্পদের লোভে
কিছুলোক তার সেবাযত্নে সচেষ্ট হয়। তাদের উদ্দেশ্য মৃত্যুর আগে যদি কিছু ধনসম্পদ
লিখে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে কেউ তার সম্পদ লিখে না দিয়ে মারা গেলে
রাষ্ট্র এই সম্পদের মালিক হয়ে যায়। ডাক্তার মহাশয়ের অতি দরদি লোকেরা সাদা
স্ট্যাম্পে তার দস্তখত নিতে তৎপর হয়। কিন্তু ডাঃ রায় তার বিশাল সম্পদের কোন উইল না
করেই একদিন মারা যান।
ডাঃ রায়ের যুক্তরাষ্ট্রে কোন
আত্মীয়স্বজন নেই। তিনি নিউইয়র্কের বাঙ্গালীদের প্রাণের চিকিৎসক। হিন্দু লোকজন না
থাকায় বাঙ্গালী মুসলমানরা ডাঃ রায়ের মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি
নিয়ন্ত্রনে গ্যাসের আগুনে শবদাহ করা হয়। শবদাহের সুইচে চাপ দিতে হিন্দু লোকজন খোজা
হয়। কিন্তু কোন হিন্দুলোক পাওয়া গেল না। কোন মন্ত্র পড়ে শেষকৃত্য করা হয়, কেউ জানে
না। তাই ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ বলে একজন বিয়ানীবাজারী মর্দে মুমিন সুইচে চাপ দেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশীদের সুখ দুঃখের সাথী ডাঃ এম এন রায়ের মরদেহ ছাইয়ে
পরিনত হয়। এই ছাই একটি কৌটায় করে নিয়ে এসে তার শেষ জীবনের স্পাউস শ্বেতাঙ্গিনী
আইরিশ মহিলার হাতে সবাই তুলে দেন।
এবার প্রয়াত ডাঃ রায়ের সম্পদলোভীরা তার
শ্বেতাঙ্গিনী পত্নীর সেবাযত্নে আত্মনিয়োগ করে। তারা এই মহিলার শোক সরাতে তাকে দামী
মদ পান করিয়ে মাতাল করে রাখে। যদি এই শ্বেতাঙ্গিনীকে হাত করে ডাঃ রায়ের ফেলে যাওয়া
সম্পদে কিছুটা ভাগ বসানো যায়।
এমন সময় আয়ারল্যান্ড হতে এই
শ্বেতাঙ্গিনীর দুই ব্যারিস্টার ভাইপো এসে হাজির হন। ফুফুকে তারা নিয়ে যায় এবং ডাঃ
এম এন রায়ের সব সম্পদ এই আইরিশ মহিলার মালিকানায় চলে যায়। সারাজীবন নিউইয়র্কে
ডাক্তারী করে মিঃ রায় প্রচুর সম্পদ জমান। দারূন হিসেবী ডাঃ রায় তার সম্পদ
জীবিতাবস্থায় কোন ভাল কাজে দান করে যাননি। কোলকাতার কোন আত্মীয়ও এসব নিতে আসেনি।
নিঃসন্থান ডাঃ রায়ের বিশাল ধনসম্পদ শেষমেশ
বুড়ো বয়সের স্পাউস আইরিশ মহিলা ও তার দুই ভাইপোর অধিকারে চলে যায়। মামা বললেন, ভাগ্যবতী এই আইরিশ রমনী, একেই বলে ভাগ্যের লীলাখেলা।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। ঐদিন
রাতে মামামামি ও আমরা মুর্শেদের বাসায় দাওয়াত খাই। মুর্শেদপত্নী রাবেয়া নানাপদের
পাকিস্তানী খাবার রান্না করেন। রাবেয়া মধ্যম উচ্চতার চিকন ফর্সা নারী। মনে হয় তিনি
দারূন সংসারী। মুর্শেদ ভাল চাকুরী করায় তাকে কোন কাজ করতে হয়না। তিনি দুইকন্যা
মরিয়ম ও আয়শা, পুত্র হামিদকে সযতনে লালন পালন করছেন। তাই রাবেয়া সংসারের হাল শক্ত
মুঠোয় ধরে আছেন। তাদের আলিশান বাড়ি, বাচ্চাদের ভূতল খেলাঘর, আলাদা পড়াঘর, ঘরের
অনেক কক্ষ অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
এই ডিনারে শরিক হন, মামাতো ভাই
ফরহাদ এবং তার বৃটিশ বাঙ্গালী পত্নী জেনী। জেনীর বডি স্লিম এবং তার মিষ্টি
বাঙ্গালী চেহারা। তাদের দুই কন্যা জান্নাহ ও আলিনা। ফরহাদ আই টি ইঞ্জিনিয়ার।
ওয়াশিংটন ডিসির এক বানিজ্যিক ভবনে তার আই টি ফার্ম। তার আইটি ফার্মে আমরা যাই।
হাফপ্যান্ট ও ফ্রক পরা একজন আফগান তরুনি আমাদেরকে রিসিভ করেন। ১৯৭৮ সালে নিউইয়র্কে
জন্মগ্রহনকারী ফরহাদ অল্প বয়সে সুপ্রতিষ্টিত। সে ধার্মিক ও বাগ্মী। মুসলিম
কমিউনিটির বিভিন্ন সভায় সুন্দর ভাষন দেয় সে।
এই ডিনারে আসে ছোট মামাতো ভাই জাহেদ। অতি সুদর্শন জাহেদের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯৮০ সালে। তার পরমাসুন্দরী স্প্যানিশ পত্নী
আমিনাও সাথে আসেন। আমিনার বডি স্লিম, দুধে আলতা রঙ, দীঘল গঠন, চুল ও চোখের মনী গাড়
কালো। স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহনকারী আমিনা খুব ধার্মিক। জিন্সের প্যান্ট ও ট্রাউজারের
সাথে মাথায় হিজাব পরেন। জাহেদ দম্পতির তিন কন্যা নাসিহা, জাহরা এবং আরিয়ানা।
রাবেয়া ও আমিনা বাংলা খুব একটা বুঝেন না। কেবল চেয়ে থাকেন। জেনী সিলেটি ভাষায় বক
বক করে মজলিশ গরম রাখেন। আমিনা দুই চারটা বাংলা শব্দ বলেন, তারপর শেষ। সে রাতে
মুর্শেদের অত্যাধুনিক আলিশান বাসা ঘুরে ঘুরে দেখি। এমন সুন্দর বাসা সিলেটে কেন,
গোলশানেও বিরল।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। মামির
কর্মক্ষেত্র সপার্স সপে (Shoppers Shop) যাই। এখানে মামি
পার্ট টাইম কাজ করেন। বলা যায় প্রয়োজনে নয়, সময় কাটাতেই চারঘন্টা কাজ করা। বিশাল
মল, এটি সপার্স সপের সারাটা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়ানো অনেকগুলো মলের
একটি। এবার গাড়ি একটি ব্যাংকের সামনে যায়। মামা গাড়ি হতে না নেমেই কারের জানালা
দিয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করেন। দুপুরে মামামামি আমাদেরকে নিয়ে
ম্যাকডুনাল্ড বারে যান। এখানে আমরা চিপস, চিকেন, সস, সালাদ, বার্গার খাই। সাথে ছিল
সুমিষ্ট চকলেট, কফি ও কুক।
ম্যাকডুনাল্ড হতে বেরিয়ে বার্লিংটন কোট
ফেক্টরী ঘুরে দেখি। বাসায় ফিরে খানিক ঘুমাই। ঘুম হতে উঠে তিন চার ঘন্টা মামার কাছে
রক্ষিত আট/দশ হাজার ফটো দর্শন করি। আমার বালকবেলা ও কৈশরের বেশ কিছু দুর্লভ ফটো
পেয়ে যাই। পৃথিবী হতে অনেক আগে বিদায় নেয়া অনেক আত্মীয় স্বজন যেমন বড়মামা, নানি
এবং আমার মরহুমা মায়ের অনেক পুরাতন ছবি দেখে খানিকের জন্য মোহাবিষ্ট হয়ে যাই।
মেঝমামা এলবামে তার ভাইবোনদের প্রত্যেক পরিবারের সদস্যগনের ফটো আলাদা আলাদা
পৃষ্টায় সাজিয়ে রেখেছেন। আমেরিকার আবহাওয়া অনার্দ্র হওয়ায় ফটো নষ্ট হয়না। তাই
হাইটেক দেশে তৈরী ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের ফটোগুলো এখনো সতেজ রয়েছে। এই ফটোগুলো
সুদূর অতীতের কথা নিবৃতে বলে যায়। ফটোগুলোর সযতনে সংরক্ষণ দেখে ভাবলাম, আমাদের
প্রবাসীরা দেশ ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করলেও তারা কখনো তাদের ভাই-বোন,
ভাগ্না-ভাগ্নি-ভাতিজী, নিকটাত্মীদেরকে মূহূর্তের জন্য ভূলতে পারেন না। তাইতো দেশের
সবার স্মৃতি ধরে রাখার এই সকরুণ কাতরতা।
মেঝমামা এখন আমাকে আমেরিকায় তার জীবন
সংগ্রামের কাহিনী শোনান। সুখ ও দুঃখের স্মৃতিভরা অনেক কেচ্ছা। কিছু কৌতুকও শুনি
মামার কাছে। আমার নানাবাড়ি বড়লেখার দক্ষিনভাগ একটি চাবাগান ঘেরা এলাকা। গ্রামের
কিছু লোক পাশের চাবাগানে গিয়ে দেশী মদ খেয়ে মাতাল হত। একবার একজন লোক মধ্যরাতে
মাতাল হয়ে এসে শোবার ঘর মনে করে গরু ঘরে ডুকে পড়ে। তারপর গরুর লেজে বিলি কেটে বলে-
আমার ময়নার মা গো, তুমি সব সময় চুলের দু’টি বেনী বাধো, আজ বেঁধেছ মাত্র একটি। বলেই
আদর করে লেজে ঠুট লাগাতেই গরুর পিছন পায়ের লাত্থি খেয়ে ছিটকে পড়ে।
দক্ষিণভাগ হিন্দু জন অধ্যুষিত অঞ্চল।
একবার কয়েকজন ব্রাক্ষ্মণের মধ্যে দারূন বিতর্ক সৃষ্টি হয়- বিতর্কের বিষয় হল মুসলমানরা স্বর্গে যেতে পারবে কিনা। বেশির ভাগ
পুরোহিত মত দেন, এরা গরু খায়, দেবদেবী মানে না,
তাই তারা
আদৌ স্বর্গে যেতে পারবে না। তবে একজন
ব্রাক্ষন কেবল ভিন্নমত প্রকাশ করে বললেন যবনরা স্বর্গে যেতেও
পারে। অন্য সবাই প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, তা কেমন করে হয়? তিনি জবাব দেন মুসলমানরা
‘হারাম’ শব্দ বলার সময় ‘হা-রাম’ বলে ভগবান রামকে স্মরন করে থাকে। যারা রামকে স্মরণ
করে তারা হয়ত ভগবানের দয়ায় স্বর্গে যেতেও পারে। (ইহা নিছক এ
এবার মেঝমামা ফজলুর রহমান একটি
চীনা উপাখ্যান শোনান। তার চীনা-আমেরিকান বন্ধুদের কাছে তিনি এই গল্পটি শুনেছেন।
একজন চীনা বৃদ্ধ বয়সে পুত্রের সংসারে বসবাস করতেন। পুত্রবধু বৃদ্ধকে সহ্য করতে
পারেন না। বউয়ের জ্বলায় বাধ্য হয়ে পুত্র তার বুড়ো বাপকে বাহিরে একটি কুড়েঘর তৈরী
করে সেখানে রাখেন। বয়স আর বেড়ে গেলে বুড়োর চেঁচামেচির অভ্যাস আর বেড়ে যায়। অতীষ্ট
পুত্রবধু এবার নির্দেশ দেন বুড়োকে বাহিরের কুড়েঘরেও রাখা যাবে না, তাকে দূরে
কোথায়ও পাঠিয়ে দিতে হবে। অনেক খুজাখুজি করে দুরের কোন এক গ্রামে অর্থের বিনিময়ে
একটি দরিদ্র পরিবার বুড়োকে রাখতে সম্মত হল। বৃদ্ধের একজন নাতি ছিল, সে দাদাকে খুব
ভালবাসতো। বৃদ্ধকে দূরের গ্রামে নির্বাসন দেওয়ার জন্য একটি কাটের বাহন তৈরী করা হল।
দাদুর বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে। নাতি মনমরা হয়ে চোখের জল ফেলছে। দাদুকে নিয়ে যাওয়ার
জন্য বাহনে তুলা হচ্ছে। এসময় নাতি তার বাপকে বলল, আমার একটা অনুরোধ আছে, রাখবে
বাবা। কেন রাখবনা, তুমি আমার একমাত্র সন্থান। তোমার অনুরোধ কি না রেখে পারি বাবা।
এবার নাতি তার বাপকে বলল, তুমি দাদুকে দূর গ্রামে রেখে আসার সময় এই বাহনটা সাথে
নিয়ে আসবে, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনের সময় আমি এটা বহন করতে পারি। বাবা, তুমি যখন
দাদুর মত বুড়ো হবে তখন তোমাকে ফেলে আসতে টাকা খরচ করে আমার যেন বাহনটা তৈরী করতে না হয়। একই বাহনে দুজনের কাজ
সেরে যাবে।
রাতে মেঝমামা আমাকে একটি ছবি
দেখান। আমাদের সিলেটি পরিচালক শাকুর মজিদ নির্মিত ছবি ‘বৈরাতী’, যা বিয়ানীবাজার সহ
সিলেট অঞ্চলে অভিনীত হয়েছে। ছবির ভাষা খাস সিলেটি। এই ছবিতে সিলেটের দুইজন প্রিয়
মানুষকে অভিনয় করতে দেখি। তারা পুবালী ব্যাংকের পরিচালক শেখ ওয়াহিদুর রহমান এবং
লোকসঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস। এই ছবিতে আমাদের ছেলেবেলার (প্রাক ১৯৮৫ সাল)
বিয়ে বাড়ি, দজগন, পান-চিনি, গায়ে হলুদ, পালকি চড়া নববধু, বিয়ের গান, শ্লোক (ফই)
প্রতিযোগিতা, নানাবিধ লোকাচার ও রীতিনীতি দেখি। এযেন ওয়াশিংটনে বসে সিলেট ও সিলেটি
জীবনে খানিকক্ষন ডুব সাঁতার কাটা। বাল্যকালের সিলেটের লোকজীবন ফিরে দেখা। সেদিন
বেশ রাতে মেঝমামার বাসায় গভীর ঘুমে ডুবে যাই।
কলম্বিয়া, সাউথ ক্যারোলিনা সফরঃ
১লা অক্টোবর ২০১৫ সাল। শেষরাতে
মামা-মামি আমাদেরকে ব্রেকফাস্ট করান। মামাতো ভাই জাহেদ এসে ড্রাইভ করে আমাদেরকে
ওয়াশিংটন ডিসির ইউনিয়ন স্টেশনে নিয়ে যায়। মামা আমাদেরকে মেঘাবাস ডট কমের কাউন্টারে
নিয়ে যান। সকাল ৬টায় সাউথ ক্যারোলিনা স্টেটের রাজধানী কলম্বিয়ার উদ্দেশ্যে দুতলা
মেঘাবাস যাত্রা শুরু করে। আমরা বাসে উপর তলার সামনের সিটে বসি। পথে ভার্জিনিয়া
স্টেটের রাজধানী রিচমন্ড, তারপর ডারহাম এবং নর্থ ক্যারোলিনার রাজধানী রালি অতিক্রম
করি। টিকেটে নির্ধারিত সময়ের (৪টা ৫৫মি) ২০ মিনিট আগে গন্তব্যনগরী কলম্বিয়ায় বাস
থামে। বাস থেকে নেমেই মেঝভাই জামিল চৌধুরীকে সামনে পেয়ে যাই। তিনি গাড়ি চালিয়ে
আমাদেরকে ডাউন টাউন, নিউ টাউন দেখিয়ে বাসায় পৌছান।
তিনি আমার মেঝ সমনদিক জামিল
চৌধুরী, তার ডাকনাম শাহজাহান। তিনি মেরিন প্রকৌশলী। তার পত্নী হাসনাত জাহান চৌধুরী
(বিউটি) সিলেটের কানিশাইল গ্রামের কর কর্মকর্তা আফতাব চৌধুরীর কন্যা। হাসনাত জাহান
চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজতত্ত্বে অনার্স সহ মাস্টার্স। তাদের দুই সন্থান-
তাইবা চৌধুরী ও আতিফ চৌধুরী। জামিল চৌধুরী একজন বুদ্ধিমান ও দায়িত্ববান
ব্যাক্তিত্ব। ২০০২ সালে তিনি আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র নিতে আবেদন করেন এবং তের বছর
পর ২০১৫ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ভিসা পাই।
কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ
ক্যারোলিনা রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ও স্টেইট রাজধানী। নিরিবিলি পরিচ্ছন্ন শহর।
বৃক্ষের শহর, ফুলের শহর। আমেরিকা আবিস্কারক কলম্বাসের নামে এই শহরের নাম কলম্বিয়া।
সাউথ ক্যারোলিনা ছোট্ট স্টেইট, আয়তন ৩০,৩১১ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা মাত্র ৩৭,৪২,০০০
জন। এই স্টেইটের নিক নেইম পলমেট্রো স্টেইট। পলমেট্রো এক ধরনের দামী বৃক্ষ যা এত
স্টেটে প্রচুর জন্মে।
মেঝভাই জামিল চৌধুরীর বাসার
সামনে গাড়ি থামল। খুব সুন্দর ঢালু ছাদের ত্রিপ্লেক্স বাসা। রিমুটে চাপ দিতেই গাড়ি
ঘরের দরজা দুদিকে সরে গিয়ে ওপেন হল। উঁচুনিচু টিলাময় সুন্দর নেচার এলাকায় এই
বাগানবাড়ি। সামনের বাগানে নানান জাতের ফুলের সমারোহ। বাসার অন্য তিন দিকে খালি
সবুজ চত্বর। সযতনে রুপন করা আছে সাদা মরিচ, নাগা মরিচ, কদু, শিম ইত্যাদি। দেশটি
আমাদের মত বৃষ্টিবহুল ও খানিক গরম। তাই আমাদের দেশের সব ধরনের ফল, ফুল, শস্য এখানে
হয়।
বাসার সামনে ঠিকানা লিখা
চিটি-বাস্ক এবং পিছনে একটি কাটের মঞ্চ। মঞ্চের কাছেই গার্বেজ ফেলার প্লাস্টিক
আধার। সাপ্তাহে একদিন গাড়ি এসে গার্বেজ নিয়ে যায়। বাসার পিছনে পুকুরের মত একটি
জলাধার। জলাধারের পাশের বনে মাঝে মাঝে হরিন চরে বেড়ায়। জনপদটি আমাদের চা-বাগানের
মত সুন্দর। নয়ন ভূলানো সব সুরম্য বিদেশী বৃক্ষমালার পরিকল্পিত সমারোহ। বাসার
নিচতলায় দুইটি ড্রয়িং কক্ষ, বড় ডাইনিং ও কিচেন। গাড়ি ঘরেও চুলা আছে। ধুয়াযুক্ত
রান্না এখানে করা হয় যাতে ঘরে দুষন না হয়। উপরতলায় চারটি বড় বেড রোম ও দুইটি
অত্যাধুনিক বাথ রোম। নিচেতলায়ও একটি বাথরুম আছে। বেড রোমের সাথে শত হ্যাঙ্গারযুক্ত
ড্রেস রোম, যেখানে প্রচুর জুতা ও হ্যাঙ্গারে পোষাক সাজিয়ে রাখা যায়। থাইগ্লাসের
বাথরোম তিন কক্ষ বিশিষ্ট, এককক্ষে হাইকমোড, একটি অজু গোসলের এবং তৃতীয়টি ড্রয়িং
টেবিল ও আয়নাযুক্ত ড্রেসিং রোম। বাথরোমের ড্রেসিং কক্ষ কার্পেট মোড়ানো। সারাটা
বাসা হাইটেক যন্ত্রপাতি সজ্জিত। এখানে বাসায় এত হাইটেক সুবিধা রয়েছে যে কাজের
লোকের কোন দরকার নেই। বাসার চারজনের চারটি গাড়ি গ্যারেজের সামনের ড্রাইভওয়েতে পড়ে
থাকে। পরিবারের সব সদস্যের শিল্পীর আঁকা ছবি, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ছবি দেয়ালে
শোভা পেতে দেখি। নিচের ড্রয়িং রোমে আমার চাচাত ভাই শিল্পী সেলিম কুরেশীর আঁকা একটি
চিত্রকর্মে গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখে বিমুগ্ধ হই।
২রা অক্টোরর, ২০১৫ সাল,
শুক্রবার। কলম্বিয়া একটি গ্রাম শহর, একটি অরন্য শহর। ভোর হতে এশহরে বৃষ্টি হচ্ছে।
বাসার ভিতর নাতিশীতুষ্ণ অথচ দরজার বাহিরে পা রাখলেই ঠান্ডা। অন্যধরনের বৃষ্টি যা
বাংলাদেশ হতে খানিক ভিন্ন। এযেন এমন এক অদ্ভুদ বৃষ্টি- যা না তুষারপাত, না
বৃষ্টিপাত। একজন পোস্টম্যান গাড়ি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকবাস্কে চিটি, বিল ও
পত্রিকা রেখে চলে যান।
আমরা উষ্ণ পানিতে শুক্রবারের
সুন্নতি গোসল করি। তারপর জুমুয়ার জামাতে শরিক হতে মেঝভাবী কার চালিয়ে আমাদেরকে সাত
আট মাইল দূরের এক মসজিদে নিয়ে যান। নিচতলায় পুরূষ ও দুতলায় নারীরা মিলে একটি
সম্মিলিত জুমুয়ার জামাত হয়। আরবের মত এখানেও কাউকে সুন্নত, নফল নামাজ পড়তে দেখিনি।
কোন সমবেত মোনাজাতও নেই। মসজিদের বাহিরে দুইটি বেড়াহীন ঘর। নামাজ শেষে একটি ঘরে নারী
এবং অন্যটিতে পুরুষরা জমায়েত হয়ে আড্ডা দেন। এখানে আট দশ জন বাংলাদেশী ছাত্রের
দেখা পাই। তারা বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছে। ঐদিন
বিকেলে আমাদের আবাসিক এলাকায় রাস্থা ধরে হাঁটি। সুন্দর সুন্দর ডুপ্লেক্স
ট্রিপ্লেক্স বাগানবাড়ি, ছিমছাম পরিপাঠি। স্বর্গীয় নিরবতার মাঝে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন
পরিবেশ। লোকজনের আনাগুনা বিরল। দু’একটা গাড়ি এসে বাসার সামনে রিমুট টিপছে, অটো
খোলে যাচ্ছে গ্যারেজ। উদাও গাড়ি সহ মানুষ। এই হল সাউথ ক্যারোলিনা স্টেটের রাজধানী
কলম্বিয়ার একটি জনপদের চালচিত্র। এই জনপদটির নাম South Well Subdivision.
৩রা অক্টোবর ২০১৫ সাল, শনিবার। আমাদেরকে
কলম্বিয়া শহর ঘুরে দেখাতে মেঝভাবী ছুটি নিয়েছেন। তিনি কলম্বিয়া আরমো স্কুলের
টিচার। আমাদের আপ্যায়নে সকালে তিনি নানাপদের খাদ্য প্রস্তুতে সচেষ্ট হন। তৈরি করেন
ইংলিশ মাফিন, যা চাল গম ভূট্টা যব এধরনের দশটি কণাশস্যের
ময়দায় বানানো পাউরুটির সাথে সস, সবজি ও ডিম। ইংলিশ মাফিনে সুগার তেমন নেই, তাই
ডায়বেটিস রোগীদের আদর্শ খাবার। সবুজ, সাদা ও বেগুনী তিন ধরনের ফুলকপির হাফ ভাজি
সবজি খাই, যাকে বলা হয় ব্রকলি।
দুপুরে ডিম, মাছ, টমেটো, সস, ধনচে পাতা
ও মরিচ সমৃদ্ধ থাইস্যুপ খাই। মনে হল এমন পুষ্টিকর খাবার রোজ রোজ উদরে গেলে রোগ
হবেনা, আয়ু অনেক বেড়ে যাবে। বিকেলে মেঝভাবী পিজ্জা(Pizza) তৈরী করেন।
গোলাকার চেপটা পাউরুটির উপর যতনে মাখানো হয় চিজ, ডিম, টমেটো, সস ও মাখন মেশানো
পুষ্টিকর পেইস্ট।
এবাসায় প্রায়ই ডনেট পরিবেশন করা হয়।
ডনেট হল সুমিষ্ট ক্রিম মাখানো মজাদার বনরুটি।
৪ঠা অক্টোবর ২০১৫ সাল, রবিবার। গত
দুইদিনের অবিরাম বর্ষনে সাউথ কলম্বিয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বাসার পিছনের
পাহাড়ের মাঝে ঢালু জমিতে পানি জমে পুকুর হয়ে যায়। প্রবল বর্ষনের জন্য সেইদিন ঘর
হতে বের হওয়া যায়নি। বন্যাজনিত কারনে টেলিভিশনে এক ভাষনে স্টেইট গবর্নর কলম্বিয়ার
সব অফিস, আদালত, বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করেন। মেঝভাই জামিল চৌধুরী স্টেট গবমেন্ট
অফিসে একাউন্ট বিভাগে চাকুরী করেন। তিনি বন্যার কবলে পড়ে বাসা ফিরতে পারেন নি।
অফিসের কাছে একটি হোটেলে তিনি রাত কাটান।
৫ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, সোমবার।
বন্যায় ঘরে বসে দেশী বিদেশী চ্যানেলের অনুষ্টান ও খবর দেখে পার করি। মেঝভাবী
আমেরিকান খাবার তৈরি করেন। বন্যায় সবকিছু বন্ধ, তাই মেঝভাই বাসায় ফিরতে পারছেন না।
সাউথ ক্যারোলিনার বন্যা খুব উপভোগ করি। ভাবলাম, এমন বন্যা বাংলাদেশে প্রায়ই হয়।
কিন্তু আমেরিকানরা বন্যা নিয়ে যেভাবে মাথা ঘামায় আমরা তেমন করিনা। কারন
আমেরিকানদের মত আমাদের কোথায়ও জবাবদিহীতা করতে হয়না। বন্যায় কে মরল, কে বাঁচল। কে
ভাসল, কে ডুবল, তানিয়ে বাংলাদেশে কাউকে দ্বায়বদ্ধ হতে হয়না। অথচ কলম্বিয়ার বন্যা
সাউথ ক্যারোলিনার কর্তা ব্যক্তিদের ঘুম হারাম করে দেয়।
৬ষ্ট অক্টোবর ২০১৫ সাল,
মঙ্গলবার। সকাল থেকে মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলা চলে। মেঝভাই আমাদেরকে Social
Security card এর জন্য আবেদন করতে কলম্বিয়া ফেডারেল ভবনে নিয়ে যান।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক বন্যার জন্য ফেডারেল অফিস বন্ধ। এবার আমরা ফিনলে পার্ক (Finley Park) দেখতে যাই।
এই পার্কে মানবসৃষ্ট অপুর্ব সুন্দর কৃত্রিম জলপ্রপাত ও ঝর্নাধারা রয়েছে। ঝর্না
সশব্দে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে আসছে। একটি জলাভুমিতে জলপ্রপাতের জলধারা পড়ে
শীতল বাতাস বইছে। জলের ছলছল শব্দের সুর বাজছে। সামনের লেকে একটি দ্বীপ, সেতু দিয়ে
যেতে হয়। এই ফিনলে পার্কে পাহাড়ের ধাপ কেটে সিড়ি পর সিড়ি নির্মান করে গ্যালারী
বানানো হয়েছে। সারাটা গ্যালারী বর্নীল ফুলগাছে আবৃত। কুসুমের ফাঁকে বসে অনেক ছবি
তুলি। এটাই আমার দেখা মানুষের তৈরি শ্রেষ্ট জলপ্রপাত। নিঃসন্দেহে ফিনলে পার্ক
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেরা পার্ক।
এইদিন বিকেলে আমরা সুপ্রসিদ্ধ লেইক মারি
(Lake Mari) দেখতে যাই। অপূর্ব সুন্দর এই লেকের আয়তন ২৬ বর্গমাইল। যেন
জলভরা কূলহীন হাকালুকি। লেকের পাশে রয়েছে একটি সুন্দর পার্ক। লেকে ডুকে কিছু সেতু
ঝুলে আছে। লেকপারে বাঁধের উপর দিয়ে প্রায় দুইতিন মাইল দীর্ঘ্য পাকারাস্থা চলে গেছে।
এই রাস্থার লেকপারে রেলিং রয়েছে। এই সুন্দর রাস্থায় মানুষ হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে। বাতাস
বেশ ঠান্ডা তাই আমি ও জেফার মনের আনন্দে দৌড়াই এবং সূর্যাস্তের আগেই মাইল দেড়েক
ঘুরে আসি। লেকের জলে পড়ন্ত বিকেলের রঙিলা সূর্যকে আপন মনে ডুবতে দেখি। কলম্বিয়ার
অনেক বাসায় তিনচারটি গাড়িতো থাকেই, সেইসাথে সাথে থাকে স্পিডবোট।
চাকাযুক্ত স্পিডবোট তারা গাড়ি দিয়ে টেনে নেয় লেকে এবং পারের লোহার রেলে চাকা তুলে
নামিয়ে দেয় লেকের জলে। স্পিডবোটগুলো আকারে মাঝারী, পাঁচসাত জন লোক
বোটে আনন্দ ভ্রমন করে সুন্দর বিকেল লেকের জলে আনন্দবিহারে কাটিয়ে দেয়। ফেরার পথে
কলম্বিয়ার দুইটি ছোটনদী কনগেরী-রিভার এবং বুশ-রিভারের দেখা পাই। দুই নদীর জল লাল।
হ্যাঁ, নদী দু’টি হবে বড়জুর আমাদের মনু কিংবা খোয়াই এবং তারা বয়ে নিচ্ছে সাউথ
ক্যারোলিনার লাল পাহাড় ধুঁয়া জল।
৭ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, বুধবার। আমরা
সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি দেখতে যাই। তাইবা এই ইউনিভার্সিটির ছাত্রি। আমরা এই
ইউনিভার্সিটির বহুতল ভবনের উপর স্থাপিত কালোগ্লাস ঘেরা গোলাকার ক্যাফটেরিয়ায় যাই।
এই ক্যাফটেরিয়া ঘুর্নায়মান। এই হোটেলে বসে চা-নাস্তা করে করে ঘুর্নায়মান অবস্থায়
সারা কলম্বিয়া শহর দেখা যায়। মেঝভাই একটি গ্যাসস্টেশন হতে গাড়ির পেট্রোল কিনেন।
কার্ডে তেলের দাম পরিশোধ করে নিজেই গাড়িতে পেট্রোল ভরে নেন। যত টাকা পরিশোধ হয়েছে,
ততো টাকার তেল ঢুকামাত্র মেশিন অটো বন্ধ হয়ে যায়। এই গ্যাস স্টেশনের কার-ওয়াস
ব্যবসা রয়েছে। মেঝভাই এখানে কার ওয়াস করেন। কার্ডে ১১ ডলার পরিশোধ করামাত্র সামনের
সুড়ং পথে কার ডুকানোর সংক্ষেত আসে। গ্লাসবদ্ধ কারে বসা অবস্থায় প্রথমে সাবান পানি,
তারপর পরিস্কার পানি, তারপর এন্টি স্পট ক্রীম এসে ধাপে ধাপে চোখের পলকে গাড়ি ধুয়ে
পরিস্কার দেয়। এবার তীব্র বায়ুপ্রবাহ এসে গাড়িকে শুকিয়ে দেয়। এবার গাড়ি ওয়াসিং
টিউব হতে বেরিয়া আসে। কোন মানুষের হাতের ছোঁয়া ছাড়াই ১০/১২ মিনিটে গাড়ির স্নান ও
তৈল মাখা সমাপ্ত হয়।
আজ বাসার সামনের ডাকবাস্ক খুলতেই
একটি বড় খাম পাওয়া যায়। খাম খূলতেই বেরিয়ে আসে আমাদের তিনজনের গ্রীনকার্ড। অনেকে
১০/১২ বছরেও গ্রীনকার্ড পান না। আমরা বিশ বাইশ দিনের মধ্যে গ্রীনকার্ড পেয়ে যাওয়ায়
হাতে নিয়েই মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাই।
কলম্বিয়ার আবহাওয়া শীতল ও
আরামদায়ক। রাস্থায় কেবল হাঁটতে ইচ্ছে হয়। দুপুরে খেয়ে একাকি হাঁটতে বের হই। বড়
সড়কের পাশে একটি পুকুরপারে যাই। একজন কালো আফ্রিকান মধ্যবয়সী লোক পুকুরে বরশি ফেলে
মাছ ধরছেন। আমি গুড ইভিনিং বলতেই তিনি হাই হ্যালো বলে আমাকে সম্ভাষন জানান। তিনি
জলভরা পাত্র আমার দিকে বাড়িয়ে তাতে তার বরশিতে ধরা দশবারটি তেলাপিয়া জাতীয় মাছ
দেখান। ভদ্রলোক আমার পরিচয় জেনে নেন। আমার দেশ বাংলাদেশ বললে তিনি চিনতে পারেননি।
আমি নিয়ার ইন্ডিয়া বলতেই জবাব দেন, ও কে এশিয়া। আমার দেশ ভ্রমন নিয়ে তিনি জানতে
চাইলে আমি একটা বিবরন বলে যাই। আমি এবার তার ইতিকথা জানতে চাই। জানান তার জন্ম
সাউথ ক্যারোলিনায়। তিনি জীবনে একবার মাত্র পাশের নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্য সফর
করেছেন। আমেরিকার অন্য কোন রাজ্যে তিনি কখনো যান নি। আমি বেশ অবাকই হলাম। আবার
ভাবি এতে অবাক হবার কি আছে। একবার ভাগ্না জিন্নুন তার কারের যাত্রি একজন সাদা তরুনীকে অবাক হয়ে ১৪৭২ ফুট উচু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের দিকে
বিষ্মিত চোখে তাকাতে দেখে প্রশ্ন করেছিল, কি দেখছেন। মেয়েটি জবাব দেয় তার বাড়ি
পেন্সিলবানিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে, কোনদিন নিউইয়র্ক আসেনি, তাই এত উচু ভবন জীবনে কখনও
দেখিনি। আসলে আমেরিকায় অনেক অনেক মানুষ আছে যাদের ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর
হতে বাইরে দু’পা ফেলিয়া’।
৮ম অক্টোবর ২০১৫ সাল,
বৃহস্পতিবার। আজ সসিয়াল সিকিউরিটি কার্ড আবেদনের জন্য মেঝভাবী আমাদেরকে কলম্বিয়ার ফেডারেল
ভবনে নিয়ে যান। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আমাদেরকে পরীক্ষা করে অফিসের ভিতর প্রবেশ
করায়। আমরা একটি কম্পিটারে আমাদের সিরিয়াল ও কেন এসেছি লিখে দেই। কিছুক্ষন
অপেক্ষার পর লাউড স্পিকারে আমাদের ডাক আসে। একজন কালো মহিলা হাসিমুখে আমাদের
বায়োডাটা কম্পিউটারে এন্ট্রি করেন। মেঝভাবী দুভাষীর কাজ করেন। আল্লাহের অপার
মেহেরবানীতে সহজেই সবকাজ সমাধা হয়ে যায়। বেশ ক্ষিধা পায়, বাসায় ফিরে বাফেলো ফিস ও
কলম্বিয়ার হিলশা ফিস সহকারে মজার খাবার হয়।
সাউথ ক্যারোলিনার নদীপথে আমাদের পদ্মা-মেঘনার মত উজান বেয়ে আটলান্টিকের হিলশা আসে।
৯ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, শুক্রবার।
সকালে আমরা সবাই সাউথ উয়েল নেইবারহোড আবাসিক এখাকায় ঘুরে বেড়াই। একটি দামী গাড়ি
এসে পাশে থামে। ভাবি নিশ্চয় ভিআইপি কেউ হবেন। জিন্সের প্যান্ট ও দামী গ্যাঞ্জি পরা
একজন স্মার্ট ভদ্রলোক গাড়িতে হতে নামলেন। এবার এই স্মার্টম্যান গাড়ির পিছন খোলে
একটি ছোট ঘাসকাটার মেশিন নামালেন। এই গাড়িতে বসে তিনি ঘাস কাটতে শুরু করলেন।
আশপাশের ঘাস কাটার পর মাট সবুজ গালিচায় রূপ নেয়। এবার বুঝলাম এই ভিআইপি একজন
গ্রাসস-কাটার। ঘাস কাটা তার পেশা।
জর্জিয়া স্টেটের রাজধানী
আটলান্টা সফরঃ
১০ম অক্টোবর ২০১৫ সাল, শনিবার। সকালে
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আজ ভাই ভাবী আমাদেরকে নিয়ে তাদের গাড়ি ড্রাইভ করে আরেক
স্টেট জর্জিয়ার রাজধানী আটলান্টা নিয়ে যাবেন। আটলান্টা আমেরিকার একটি শ্রেষ্ট শহর।
তাদের উচ্চশিক্ষিতা কন্যা তাইবা চৌধুরী আটলান্টায় চাকুরী করে। সাউথ ক্যারলিনার
রাজধানী কলম্বিয়া হতে আটলান্টার দূরত্ব ২৫০ মাইল। সকাল ১০টা ২০মিনিটে রওয়ানা হই।
জর্জিয়া স্টেটের সীমায় আসামাত্র এই রাজ্য সরকারের নির্মিত সুবিশাল রেস্ট হাউসে
প্রবেশ করি। সুন্দর প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত স্থানে এই রেস্ট হাউসের অবস্থান। এখানে
আছে অত্যাধুনিক ওয়াশরোম, বাথরুম, বসার লবী, ছায়াময় বাগান। এখান থেকে জর্জিয়ার
পরিচিতি গাইডবুক ফ্রি নেই। এই বইয়ে জর্জিয়ার সচিত্র সবকিছুর বিবরন রয়েছে।
দুপুর ১টা ২০ মিনিটে আমরা
আটলান্টার হিমালয়া ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। এই হোটেলের নাম ইন্ডিয়ান
রেস্টুরেন্ট হলেও এর মালিক একজন বাংলাদেশী। হোটেল মালিকের বাড়ি বড়লেখায় এবং হোটেল
কর্মিরা সবাই সিলেটি। চিকেন, বিফ, খাসির মাংস, তরকারী, রুটি, পোলাও, বুট ইত্যাদি
আলাদা আলাদা কাচের জারে সাজিয়ে রাখা। অন্য
টেবিলে ফিরনি, ফল, আইসক্রিম, চা-কফি ইত্যাদি। বুফে খাবার, যার যা খুশি খাবে, বিল
নিদৃষ্ট। তাইবা বিল পরিশোধ করলে হোটেল মালিক পাশেই তার গ্রোসারী সপ দেখাতে নিয়ে
যান। তাইবা আমরা থাকার জন্য আটলান্টায় আবাসিক হোটেল ভাড়া করেছে। হোটেলের নাম Hampton Inn
Hotel Atlanta. দুইজনের স্যুট ১৫০ ডলার প্রতিদিনের ভাড়া। সুসজ্জিত হাইফাই
এই হোটেল আমাদের শ্রীমঙ্গল গ্রেন্ড সুলতান হোটেলের অনুরূপ। হোটেল স্যুটের অটো ডোর
ও টাচ চাবী। স্যুটে আছে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, এসি, বেড সোফা, বাথ টব, আলনা, ওয়ান
টাইম গ্লাস, গার্বেজ বিন, ফোন ইত্যাদি। হোটেলে উঠার আগে তাইবা আমাদেরকে তার বাসা
দেখাতে নিয়ে যায়। সুন্দর ছিমছাম বাসা দেখে তার ফুফু নুরজাহান বললেন, ডলার নষ্ট করে
হোটেল ভাড়া করার কি দরকার ছিল, এখানেইতো থাকা যেত। ফুফু আপনারা আরামে ঘুমানোর জন্য
ভাড়া করেছি। আটলান্টায় কি আর কখনও আপনাদের আসা হবে।
স্টোন মাউন্টেইনে পৃথিবীর সেরা লেজার-সো
দেখতে যাওয়াঃ
এইদিন তাইবা আমাদেরকে Stone Mountain
Park নিয়ে যায়। আমাদেরকে লেজার-সো দেখাতে সে
১২০ ডলারে ৬টি টিকেট কিনে। আমাদের গাড়ি পার্কিং এলাকায় রেখে সামনে
এগিয়ে যাই। একটি গ্রানাইট পাতরের পাহাড় খাড়াভাবে মাইল খানেক উচ্চতা নিয়ে সামনে
দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের মাথায় মেঘ লেগে আছে। এক মাইল উচ্চতা ও কয়েক মাইল বিস্তারের
একটি পাতর যেন কেউ মাটিতে পুতে রেখেছে। এই পুতে রাখা কাল পাতরই হল স্টোন
মাউন্টেইন। স্টোন মাউন্টেইনের গা মসৃন উল্লম্ব মাটের মত। পাহাড়ের উপর পর্যটন
কেন্দ্র। শুন্য গ্লাসের কামরায় চড়ে রজ্জিপথে
মানুষ পাহাড়ের উপরে উঠছে।
স্টোন মাউন্টেইন পর্বতগাত্রে
পাতর কেটে তিনজন অশ্বারোহীর ভাস্কর্য্য নির্মাণ করা হয়েছে কয়েক যুগ
আগে। পাহাড়ের গা খাড়া ও সমতল। কোন বৃক্ষলতা নেই। এই পাহাড়ের সমতল গায়ে রাতে আলো ও
লেজারভিম মিলে এক সুবিশাল প্রাকৃতিক টিভিস্কিন তৈরি করে। পাহাড়ের এই প্রাকৃতিক
দেয়ালে অনুষ্টিত হয় পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ লেজার-সো। দলে দলে মানুষ আসছে। শত শত মানুষ।
পার্কিং জুড়ে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু গাড়ি আর গাড়ি।
ধাপে ধাপে সাজানো পাহাড়ের ভাঁজে
ভাঁজে বানের মত আসা সাদা মানুষের স্রোত হারিয়ে যাচ্ছে। স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের
পাদদেশে জলাভূমি ও চরাচর। বিচরন করছে বুনোহাঁস ও জলচর পাখি। এই জলাভূমি ও সামনের
সমতলে রাতের আঁধারে অনুষ্টিত হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ট Lezer Show. সেদিন রাত ৮
টায় লেজার সো শুরু হয়। দশ বার হাজার মানুষ এই লেজার সো দেখতে সমবেত হয়েছেন। বেশি
মানুষই শ্বেতাঙ্গ নরনারী। এই নরনারীরা প্রায় সবাই প্যান্ট সার্ট ট্রাউজার পরা এবং
তাদের গাত্র থেকে বাতাসে পারফিউমের সুগন্ধ আসছে। তাদের সোনালী চুল ও ডালিম রসে দুধ
মাখানো রঙ। তারা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, উপত্যকার মাটে, ঢালু সবুজে মাদুর পেতে বসে
যান। জেফারের বয়সী একজন সাদা কিশোরের সাথে তার ভাব জমে ঊঠে। এই কিশোর ফ্লোরিডা হতে
পরিবারের সাথে লেজার সো দেখতে এসেছে। এই অতি সুন্দর জনগোষ্টিকে দেখে মনে দুঃখ পাই
এই ভেবে যে এদের জন্মহার কমে যাবার কারনে এই অপরূপ নৃগোষ্টির মানুষের সংখ্যা দিন
দিন কমে যাচ্ছে এবং অসুন্দর নৃগোষ্টির মানুষ দ্রুত বাড়ছে। আহা, এই স্বর্গের হুর
গেলমানরা কি এক সময় পৃথিবী হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সামনের মাট একটা প্রাকৃতিক গ্যালারীর
মত। প্রথমে উচু উপত্যকা, তার নিচে আরেক উপত্যকা, তার নিচে ঢালু সবুজ মাট যেন
প্রকৃতি আপন খেয়ালে স্থানটাকে উৎসব করার জন্য মঞ্চ ও দর্শক গ্যালারি বানিয়ে
রেখেছে। রাতের অন্ধকারে মানুষ দলে দলে ঘাসের গালিচায় বসে আছে। আচমকা খানিক বৃষ্টি
এসে সবাইকে ভিজিয়ে দেয়। একটু শীত শীত লেগে আমরা কাঁপছি। সময়ানুবর্তিতা আমেরিকার এক
অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখানে কোন কিছুতেই সময়ের কোন হেরফের হয়না। বাস, ট্রেন, অফিস, সভা
কিংবা অনুষ্টান। আমেরিকায় ঘোষিত সময়ে সব কাজ ঘড়ির কাটায় কাটায় সম্পন্ন হয়।
ঘড়ির কাটায় ঠিক রাত ৮টা বেজে গেছে। লেজার সো শুরু হল। স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের সামনের মাট হতে কয়েকটি বিশাল
আগুনের হলকা বের হয়ে আঁধার রাতকে দিনের মত আলোকিত করে মাইল খানেক উচু পাহাড়ের
চূড়ায় গিয়ে নিভে। এই আগুন হয়তো মেঘের রাজ্য ছোঁয়ে বাতাসে মিশে। কালো ধুয়ায় আকাশ আর
কালো হয়ে যায়। এই আগুনের লেলিহান শিখাগুলো এতই বিশাল ছিল যে গরম এসে আমাদের মেঘে
ভেজা শীত খানিকের জন্য তাড়িয়ে দেয়। একটার পর একটা আগুনের হলকা আকাশে উড়ার সময় গরমে
কি যে আরাম লাগে ও অন্ধকার রাতে যেন উজ্জ্বল দিন নেমে আসে। হ্যাঁ আমরা বাংলাদেশে
ছেলেবেলায় শীতকালে শুকনো পাতা ও খড়ে আগুন লাগিয়ে শীত তাড়াতাম। ছেলে মেয়ে বুড়ো
বুড়ি সবাই মিলে আগুন পোহাতাম।
স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ের সমতল
গায়ে লেজারের বিচিত্র আলোয় অনুমানিক (৫০০ফুট*৩০০ফুট) এক বিশাল পর্দায় ফুটে উঠে
সারাটা জর্জিয়া স্টেট। এই রাজ্যের বন-বনানী, নদী, পাহাড়, জলাভূমি কিছুই বাদ গেলনা।
তখন বেজে উঠে জর্জিয়া রাজ্যের রাজ্যসঙ্গীত, সেইসাথে পর্দায় দেখা যায় জর্জিয়ার রাজ্য
পতাকা, রাজ্য মানচিত্র, রাজ্য-প্রতীক পিচ (Peach). জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের
দক্ষিনের একটি অসমতল সুন্দর রাজ্য। আয়তনে বাংলাদেশ হতে খানিক বড়, ৫৭,৯১৯ বর্গমাইল।
লোকসংখ্যা মাত্র ৭৫,৬২,০০০ জন। এই রাজ্যের বড় শহর ও রাজধানী আটলান্টা। ১৮৬১ সালে
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় জর্জিয়া দক্ষিনের অন্য দশটি রাজ্যের মত দাসপ্রথার সমর্থক
ছিল এবং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৮৬১-৬৫ সালের সেই
গৃহযুদ্ধে আব্রাহাম লিঙ্কন হেরে গেলে আজকের এই প্রবল প্রতাপশালী বিশ্বশক্তি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব হয়ত পৃথিবী দেখতে পেতনা। আমেরিকার সেই গৃহযুদ্ধ
আমরা লেজার সো তে দেখে ইতিহাসকে চোখের সামনে পেয়ে যাই।
স্টোন মাউন্টেন পাহাড় পৃষ্টে যে তিনজন
ঘোড় সওয়ারের ভাস্কর্য্য রয়েছে, তারা দাসপ্রথার সমর্থনে গৃহযুদ্ধে যোগ দেন।
আব্রাহাম লিঙ্কনের বিরূদ্ধে যুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে তারা পরাজিত হন এবং পরাজিত
হবার পর তরবারী ছুঁড়ে ফেলে আমেরিকায় ঐক্য মেনে নেন। লেজার সো তে আমি লক্ষ্য করি
জর্জিয়াবাসী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের সাথে তাদের পরাজিত এই তিন সাম্প্রদায়িক
নেতাকেও সম্মান প্রদর্শন করে। বিষয়টা আমার কাছে পরস্পর বিরোধী আচরণই মনে হয়।
স্টোন মাউন্টেইন পাহাড়ে গ্রানাইট
খোদাই করে জর্জিয়ানরা গৃহযুদ্ধে পরাজিত তিন নেতার ঘোড় সওয়ার ভাস্কর্য্য তৈরী করে। তারা
মনে করে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এই নেতারা সঠিক ছিলেন এবং পরবর্তীতে পরাজিত হয়ে
যুগের বাস্তবতা বুঝতে পেরে তা মেনে নেন।
লেজার সো তে দেখা যায় বজ্রপাতের মত কড়মড়
শব্দ করে হঠাৎ বিশাল স্টোন মাউন্টেইন পাহাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। পূরো সুবিশাল পাহাড় যেন
প্রবল ভূমিকম্পে চোখের সামনে ধ্বসে পড়ে উদাও হয়ে যায়। মনে হয় চোখের সামনে যেন এক
কিয়ামতের প্রলয় হয়ে গেছে। কিয়ামতের এই ধ্বংসস্থূপ হতে পাহাড়ের গা কেটে নির্মিত তিন
ঘোড় সওয়ার মুর্তি জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই তিনজন অশ্বারোহী হাতে তরবারী নিয়ে ঘোড়ায় পায়ে
আগুনের ফুলকি তুলে দ্রুতবেগে দৌড়াতে থাকে। এক সময় এই তিন বীর অশ্বারোহী যুদ্ধার
তরবারী ভেঙ্গে যায়, ফলে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন জয়ী হন। অনুষ্টানের ফাঁকে
ফাঁকে চলে আতশবাজি উৎসব। আতশবাজির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সশব্দে এক মাইল উচু স্টোন
মাউন্টেইন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে অজস্র শাখা প্রশাখায় ভাগ হয়ে সারাটা আকাশে ছড়িয়ে
যায়। আঁধার রাত আলোক পুষ্পে রঙ্গীন হয়ে যায়। আগুনের লেলিহান হলকা ও আতশবাজি মাঝে
মাঝে রাতটাকে দিনের মত আলোকিত করে দেয়। এই সুতীব্র শীতের মধ্যেও সামনের জনতা বসার
কয়েক একর জায়গা উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে আরামে ভরে যায়।
সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা ভেসে
ওঠে। শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত। দেশপ্রেমিক দশ-বার হাজার জনতা দাঁড়িয়ে যান। প্রচন্ড
নিনাদে গল্লা ফুটে। আকাশ আতশবাজির আলোয় ঝলসে ওঠে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড
ধারী, বলা যায় হাফ মার্কিন সিটিজেন। ভোট অধিকার ছাড়া বাকি সব অধিকার ও সুযোগ
সুবিধা আমাদের রয়েছে। তাই বুকে গর্ব নিয়েই দাড়াই এবং মার্কিন পতাকা ও জাতীয়
সঙ্গীতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হয় ঠিক ১০টায়। সেই সাথে
লেজার সোর সমাপ্তি ঘটে।
একটানা দুই ঘন্টার এই লেজার সো এতই
মনোমুগ্ধকর যে এক চরম উত্তেজনার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে দুই ঘন্টা পার হয়ে যায়।
আমেরিকানরা লেজার টেকনোলজী ব্যবহার করে এত জীবন্ত ও বাস্তব ছবি বানাতে পারে তা
নিজে না দেখলে বিশ্বাস হতনা। এই সোতে জর্জিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাক্তিজীবন,
ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের অনুষ্টানের মত এখানে কোন হৈ চৈ
নেই। এক অখন্ড পিনপতন নিরবতার মধ্য সারাটা অনুষ্টান সমাপ্ত হয়। এমন একটি শিক্ষনীয়
অনুষ্টান দেখানোর জন্য মহান আল্লাহ পাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সেই সাথে আমাদের
প্রিয় ভাতিজী তাইবাকে জানাই হৃদয় উৎসরিত ধন্যবাদ। আমরা যে তার সৌজন্যে ও উৎসাহে
এমন একটি অসাধারন অনুষ্টান উপভোগ করার সুযোগ পাই।
১১ অক্টোবর ২০১৫ সাল, রবিবার। ঘুম হতে
জেগে হাম্পটন হোটেল ইনের নরম বিছানা ছেড়ে নামাজ পড়ি। তারপর ব্রেকফাস্ট সারতে
ডাইনিং হলে যাই। আমাদের ফ্রেকফাস্ট স্যুট ভাড়ায় সংযুক্ত। এখানে ৫০/৬০ ব্যঞ্জনের
জানা-অজানা আমেরিকান খাবার ধারাবাহিক সাজিয়ে রাখা। সব খাবারই গরম, না হয় যথাযত
মেশিনে খাবার তৈরী কিংবা গরম করে নিতে হয়। আমরা আমরা একটি টেবিলে বসি। আমাদের
জ্ঞান নেই, ধারনা নেই, কিভাবে আমেরিকান খাবার প্রস্তুত করতে হয়। মেজভাবী ও তাইবা
মেশিনে মেশিনে গিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরী করে এনে আমাদেরকে পরিবেশন করেন। বিচিত্র
বিচিত্র আমেরিকান খাবার খেয়ে মনের অজান্তে বলে উঠি ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ’।
কফি খেয়ে আমরা দুটি কারে চড়ে সারাটা
আটলান্টা মহানগর ঘুরে বেড়াই। আটলান্টা বেশ বড় শহর। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসির চেয়ে
ছোট হলেও শহরটি কলম্বিয়ার চেয়ে অনেক বড়। আটলান্টার ডাউন টাউন ও নিউ টাউন ঘুরে আমরা
অলিম্পিক পল্লীতে যাই। এখানে ১৯৯৬ সালে বিশ্ব অলিম্পিক অনুষ্টিত হয়। আমরা ‘মশাল
প্রজ্জলন স্থম্ব অলিম্পিক-১৯৯৬’ দেখি। আটলান্টা আলিম্পিক পল্লীতে তখন জাতীয় ক্রীড়া
প্রতিযোগিতা ছিল। আমরা তাই সেখানে প্রচন্ড ভীড় লক্ষ্য করি। আটলান্টায় আমরা বিখ্যাত
বিশ্বসংবাদ মিডিয়া সিএনএনের প্রধান কার্যালয় এক নজর দেখে নেই। সুরম্য নগরী
আটলান্টা, উচু নিচু টিলায় টিলায় সুসজ্জিত বাড়ি ঘর, অফিস আদালত। এবার চালক মেঝভাই
কলম্বিয়ার দিকে কারের নিশানা করেন।
তাইবাকে আটলান্টায় বিদায় জানিয়ে আমরা
ছুটলাম। আটলান্টাতে আমাদের দুইদিন ও একরাত বেশ মজায় কেটে যায়। হোটেল ভাড়া ৩০০
ডলার, লেজার শো ১২০ ডলার, ইন্ডিয়ান হোটেলে খাবার বিল ২০০ ডলার এবং গিফট ও বাজে খরচ
মিলে প্রায় ১০০০ ডলার= ৮৫,০০০/= বাংলাদেশী টাকা খরচ হয়। পুরোটাই পরিশোধ করে তাইবা।
আমেরিকার কোন এক প্রসিদ্ধ শহরে মাত্র একদিন সপরিবারে অবস্থানে যে পরিমান অর্থ খরচ
হয়, তা বাংলাদেশ হতে গিয়ে বহন করা খুব কঠিন কাজ। তাই আমেরিকা ভ্রমন অর্থের জুর
ছাড়া সম্ভব নয়।
আমাদের কার জর্জিয়া রাজ্যের সীমান্ত
অতিক্রম করা মাত্রই ‘Welcome to South Carolina’ লিখা গেট পার হয়ে সাউথ
ক্যারোলিনা রাজ্যের স্বাগত পর্যটন সেন্টারে প্রবেশ করি। সুন্দর পরিপাটি রেস্ট ও
ওয়াশ রূম সজ্জিত এই পর্যটন সেন্টার মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। সেন্টারকে ঘিরে আছে
সুরম্য বৃক্ষশোভিত পাহাড় ও মনোরম লেক। বিতরনের জন্য থাকিয়ায় পড়ে আছে প্রচুর সাউথ
ক্যারোলিনা গাইড। ছোট বড় নানা ধরনের এসব পর্যটন গাইড দামী কাগজে ছাপানো। কিছু গাইড
ব্যাগে নেই। সামনের বাগানে ফটো তুলি ও সাথে আনা খাবার এখানে খেয়ে নেই। এই সেন্টারে
সাউথ ক্যারোলিনার স্মারক চিহ্ন পলমেট্রো ট্রি, রাজ্য পতাকা, রাজ্য মানচিত্র, বড়
আকারে প্রদর্শন করা হয়েছে। এই সেন্টারে নাতিশীতুষ্ণ বিকেল
পার হয়। রাতের আঁধারে আমরা কলম্বিয়ার বাসায় ফিরে আসি।
১২ অক্টোবর, ২০১৫ সাল, সোমবার।
সকাল ১০টায় সাউথ-উয়েল নেইভারহোড ঘুরে দেখি। নেইভারহোড বলতে এখানে আবাসিক জনপদ
বুঝানো হয়। সকাল ১০/১১ টায় রাস্থায় লোকজনের কোন সাড়াশব্দ নেই, যেন বাংলাদেশের
শেষরাতের নিরবতা। বাংলাদেশের জনপদ শেষরাতে জনশূন্য হলেও পাহারাদার দেখা যায়, এখানে
তাও নেই। পাখির কলরবে মুখরিত সুরম্য বৃক্ষঘেরা এই জনপদের রাস্থায় কাটবিড়ালী দিনে
দুপুরে লাফিয়ে বেড়ায়। একটার পর একটা বাউন্ডারী দেয়ালহীন ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স
বাগানবাড়ি। নাম না জানা নানান ফল ও ফুলে নুয়ে আছে বৃক্ষের ডালপালা। বাগানে বাগানে
আছে খরগোস, মা মেরি ও যিশুর মূর্তি। হ্যালোইন উৎসবের ভূতের বিকট ছবি ও মূর্তি
ঝুলছে কোন কোন বাসার গাছের ডালে। প্রতিটি বাসায় যতজন লোক ততোটি গাড়ি পড়ে আছে বাসার
সামনে। উঁচুনিচু ভূমির রাজ্যে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের সাথে বাড়িগুলো আপন
মহিমায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কোথায়ও মাশা-মাছি নেই, ভাঙ্গাচুরা নেই, নেই ময়লা
ড্রেণ। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে ভূতল ড্রেন দিয়ে উদাও হয় বৃষ্টির জল। এখানে নেই কোন চোর
ডাকাত কিংবা চাঁদাবাজের উৎপাত। নেই কোন ভিক্ষুক কিংবা ঋনপ্রার্থীর যন্ত্রনা। মানুষ
ঘরের হালকা দরজাটা বন্ধ করে খালি ঘর রেখে বেরিয়ে যায়, কাজ শেষে ফিরে আসে রাতে।
জামিল ভাইয়ের নির্জন বাসা এমনি থাকে অথচ বিগত পনের বছরে কখনো চুরি হয়নি। প্রতিটি
বাসা যেন আমাদের জেমস ফিনলে কোম্পানীর চা-বাগানের এক একটি বাংলো বাড়ি। প্রতিটি
ডুপ্লেক্স ট্রিপ্লেক্স বাগানবাড়িতে ৪/৫ টি বেডরোম, ডাবল ড্রয়িংরোম, বড় বড় কিচেন,
ডাইনিং ও বাথরোম। সামনে ফুলের বাগান, পিছনে সবুজ লন, রিম্যুট কন্ট্রোল গ্যারেজ,
২/৩ টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। গ্যারেজের সামনের পাকারাস্থা নাম ড্রাইভওয়ে, যেখানে
প্রতি বাসার ৩/৪ টি দামি দামি গাড়ি খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। আমেরিকানরা এত ধনী
যে তাদের বাসার প্রতি কক্ষে থাকে ওয়াল টিভি, ওভেন, ওয়াসিং মেশিন, ডিসক্লিনার
মেশিন, কার্পেট ক্লিনিং মেশিন, কফি-শরবত মেশিন, ঘাস-কাটার মেশিন ও চার পাচটা
অত্যাধুনিক ফ্রিজ। সাউথ ক্যারোলিনার প্রকৃতি মনোরম। বাসা, দোকান, রাস্থা সর্বত্রই
আছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রতিটি বাসা এসি ও হিটার মেশিনে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে
সারাক্ষন।
বাসায় আলাদা কাপড়কক্ষ ও সাজঘর
দেখি। এই কক্ষে শত শত হাঙ্গারে ড্রেস ও জুতাধারে জুতা সাজিয়ে রাখা আছে। আমেরিকানরা
এক কাপড় বেশিদিন পরেনা। একটু পুরানো হলেই ফেলে দেয় এবং নতুন নতুন জামা কাপড়ে
ক্লথরোম পূর্ন করে রাখে। এদেশে এত জমি ও সম্পদ পড়ে আছে যে এসব
নিয়ে কোন কাড়াকাড়ি মারামারি নেই। সবকিছু আসমানের নিচে কাজে অকাজে পড়ে আছে। পুরুষ, নারী, ছাত্র, ছাত্রী সবাই এত ব্যস্ত যে কেউ কারো দিকে
তাকানোর খুব একটা সময় নেই।
১৩ অক্টোবর ২০১৫ সাল,
মঙ্গলবার। এইদিন Best Bye Moll যাই এবং অনেক
দেখেশুনে ৩৫০ ডলার দামে একটি Lanovo Laptop ক্রয় করি। এই ল্যাপটপ এতই ভাল যে বিগত
পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করছি অথচ কখনও কোন ডিস্টার্ব করেনি। আমরা কলম্বিয়ায় কিছু
মার্কিন বহুজাতিক মার্কেটিং কোম্পানী যেমন ওয়ালমার্ট, বেড এন্ড বাথ, স্যামস,
টিজেমাজ এর বড় বড় মল ঘুরে অনেক মালামাল ক্রয় করে বাসায় ফিরি।
শেষ হেমন্তের মত মজার আবহাওয়া, এই দিন
আমরা মেঝভাবীর আরমো স্কুল মাটে আমরা ব্যায়াম করতে যাই। আমেরিকার এই স্থানীয় স্কুল
মাট দেখে বিষ্মিত হই। এখানে আছে ফুটবল মাট, তিনটি বাস্কেটবল মাট, লন টেনিস মাট,
সকারবল মাট, তাছাড়া রেখাটানা বিশাল দৌড়মাট। প্রতিটি মাটে রয়েছে দর্শক গ্যালারী ও
ফ্লাড লাইট। এখানে স্কুল বলতে ১২তম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্টান বুঝায়।
দেখলাম এখানে একটি সামান্য স্কুলের যে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে, আমাদের দেশের জেলা
ক্রীড়াসংস্থার হাতেও ততোটুকু সুযোগ সুবিধা নেই। সেদিন বুঝলাম বিশ্ব অলিম্পিকে
যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রতিবার প্রথম হয়।
‘আরমো’ হলো
কলম্বিয়া শহরের একটি অঞ্চল। আমাদের সাউথউয়েল নেইভারহোড এই অঞ্চলের একটি অংশ।
পাঠাগারের প্রতি আকর্ষন আমার আজন্ম। পাঠাগারে আমি দিনরাত কাটিয়ে দিতে পারি। একটা
পশ্চিমা পাঠাগারের ছুরতহাল করতে আমি এবার ‘আরমো পাবলিক লাইব্রেরী’ পরিদর্শন করি।
এখানে এত বিপুল বইয়ের সমাহার দেখে বিষ্মিত হই। উচু ছাদের
বিশাল পাঠাগার, চারপাশে সবুজ চত্বর। যথেষ্ট অন্তর অন্তর জায়গা খালি রেখে বইয়ের রেক
বসানো। ফাঁকে ফাঁকে বসে পড়ার ব্যবস্থা আছে। এই অনলাইন ইবুকের যুগেও এখানে পাঠকের
কোন অভাব নেই।
একটি বই হাতে নেই, এই বইয়ের নাম- ‘The six phases
of Universe’ এই বইয়ে বিগব্যাং হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিশ্বসৃষ্টির বাখ্যা আছে। এই
মহাবিশ্বের বিবর্তন একে একে ৬টি ধাপে সম্পন্ন হবার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন ও সচিত্র
বিবরন রয়েছে। আমেরিকানরা ধ্যানী এবং জ্ঞানী জাতি। তারা কথায় নিরব
কিন্তু কর্মে সরব জাতি। তারা যে যেখানে যে কাজটি করে সে তা পূর্ন দায়িত্ব নিয়েই
করে। আরমো পাঠাগারে দায়িত্বরতদের কর্ম-তৎপরতা দেখে আমার তাই মনে হল। জেফারের
আমেরিকায় এডমিশন টেস্টের সহায়ক একটি বড় বই আমরা হাতে নাই। আমেরিকার এই আঞ্চলিক
পাঠাগার আমাদের কেমুসাস পাঠাগার, এমন কি সিলেট বিভাগীয় পাঠাগারের চেয়েও অনেক উচ্চ
প্রযুক্তি সম্পন্ন ও উন্নত। একটা সামান্য পাঠাগার দেখেই বুঝে নেই কেন আমেরিকায় এত
জ্ঞানী-গুনী মানুষের সৃষ্টি হয়।
১৪ অক্টোবর ২০১৫ সাল, বুধবার। আজ
এই সুন্দর নিরব শহর কলম্বিয়াকে বিদায় জানাতে হবে। বিউটি ভাবী আমাদেরকে ডাইভ করে
কলম্বিয়ার মেট্রো ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট (Metro Domestic Airport) নিয়ে যান। US Airline এর বিমান ছাড়ে
সকাল ১০ টায় এবং ওয়াশংটন ডিসির Rosevelt Domestic Airport এসে পৌঁছে
দুপুর ১ টায়। পরবর্তী যাত্রায় ৭২ জন যাত্রি নিয়ে বিমানটি নিউইয়র্ক লেগোডিয়ার
ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট অবতরন করে বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দর দুই
ধরনের, আন্তর্জাতিক ও ডমেস্টিক। ডমেস্টিক এয়ারপোর্টে কেবল যুক্তরাষ্ট্রির ভিতরের
৫০টি রাজ্য ও কয়েকটি টেরিটোরির বিমান চলাচল করে। লেগোডিয়ার বিমানবন্দরে আমাদেরকে
নিতে এসেছেন বাড়মামা আব্দুর রহমান চৌধুরী ও তার মেয়ে রিপা চৌধুরী। এই বিমানবন্দরের
কাছেই বাসা। মাত্র ১৫/২০ মিনিটে বাসায় পৌঁছে যাই। Colombia to Wasington DC to
Newyork প্লেন ভাড়া দেই ৯০*৩= ২৭০ ডলার।
আমরা বাসায় ফিরলাম, আর সেইরাত ৮টায় মামা
ও মামি দুইমাসের জন্য লন্ডন চলে যান। তাদের দুই সন্থান আফজল ও নিপা লন্ডনে বসবাস
করেন। এই রাতে আমাদেরকে নিতে আসেন সেলিম চৌধুরী। তিনি ডাঃ নুরজাহানের খালাতো বোন
রেবু আপার মেয়ে দীপার স্বামী। তিনি গাড়ি চালিয়ে ম্যানহাটনে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান।
১৫ অক্টোবর ঘুম হতে জেগে দীপার ভবনের
জিমখানায় যাই। এই জিমখানা এই ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ব্যবহার করেন।
প্রতি ফ্ল্যাটে একটি করে জিমখানার চাবী রয়েছে। দারূন মজাদার ৬/৭ পদের ব্যায়াম করি।
যন্ত্রগুলো নিজের ইচ্ছেমত হার্ড-সফট করা যায়। ব্যায়াম মেশিনে হাঁটা, দৌড়া, সাইকেল
চালানো, নৌকা বাওয়া, রোমান জাহাজে বৈঠা মারা, সর্বাঙ্গ চালনা সব রয়েছে। খেলার মাঝে
সব ব্যায়াম। ব্যায়ামে বেশ আনন্দ লাগে।
ভবনে রয়েছে একটি উৎসব হল। এবার সেই
উৎসব-হলে যাই। এই হলের সামনে একটি সবুজ ছাদবাগানে যাই। এই ভবনবাসীর ব্যবহারের জন্য
নিচে কাপড় ধূয়া ও শুকানোর মেশিন রয়েছে। দীপার একমাত্র পুত্র ওয়াসিম চৌধুরী খুব
শান্তশিষ্ট। সে হাইস্কুলের ছাত্র। একমাত্র কন্যা মহিলা হোস্টেলে থেকে উচ্চশিক্ষা
নিচ্ছে।
১৬ অক্টোবর ২০১৫ সাল, শুক্রবার। রিপার
বাসায় ফিরে কুইন্সের বাংলাদেশী মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়ি। ঈমাম সাহেব একজন
বাংলাদেশী। তিনি লেখাপড়া করেছেন মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজীতে খুব
সুন্দর খুতবা দেন। ঈমামের কেরাত শুনতে সুমধুর।
১৭ অক্টোবর ২০১৫ সাল, শনিবার। আমেরিকায় একমাস একদিন ভ্রমনের শেষপ্রান্তে আমরা। মেঝমামা ও মামি ওয়াশিংটন
ডিসি হতে আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছেন। রিপার বাসার কাছেই বাংলাদেশী এলাকা
জ্যাকসনহাইট। জ্যাকসনহাইট ঘুরে ঘুরে মান্নান সুপার মার্কেট, বাংলাদেশী
রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি, গাড়ি মেরামত কারখানা ইত্যাদি দেখে নেই। অনেক দোকানের
সাইনবোর্ড ইংরেজীর সাথে বাংলায় লিখা আছে। এখানে অনেক বাংলাদেশী লোকজন অবাধে বিচরন
করছেন। জ্যাকসনহাইট যেন নিউইয়র্কের মধ্যে এক টুকরো বাংলাদেশ। ঐ দিন মেঝমামা তার
প্রবাস জীবনের স্মৃতিবিজড়িত হার্ডসন নদীপারে এস্টোরিয়া পার্কে নিয়ে যান। এখানে তার
দীর্ঘ্য জীবন কাটানোর বাসায় যাই।
বিয়ানীবাজারী একটি পরিবার এখানে ভাড়াটিয়া আছেন। দারূন শীতের রাতে হার্ডসন
নদীর পারে পারে ঝলমল করছে আলোর বন্যায় ভাসা আকাশ ছোঁয়া অজস্র বর্নিল কাচের
ভবনমালা।
১৮ অক্টোবর ২০১৫ সাল, রবিবার। রিপা ও
মেঝমামার দু’টি কারে চড়ে আমরা জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করি।
বড় ছয়টি ব্যাগেজের সাথে হাতের তিনটি ছোট ব্যাগও ইতিহাদ এয়ারফ্লাইটের ক্যারিয়ারে
পাঠিয়ে দেই। যথা সময়ে ইতিহাদের ফ্লাইট শুরু হয়। অবুধাবী এয়ারপোর্টে নেমে
অপেক্ষাকৃত ছোট আরেক বিমানে চড়ে সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরন
করি। ধানমন্ডিতে রাত্রিযাপন করে পরদিন একটি ভাড়াকরা মাইক্রোবাসে সিলেট আসি। সেদিন
পাঁচ সাপ্তাহের এক আনন্দভরা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
জীবনের প্রথম এই যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা আমার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার হলেও আমার গিন্নীর
জন্য তা ছিল খুব চিন্তার বিষয়। চারপাচ বছর আগে একবার তার শরীরে কঠিন রোগ ধরা পড়লে তিনি খুব মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। ঢাকার স্কয়ার
হাসপাতালে অপারেশন করে একই দিনে ফাইব্রয়েড ও পিত্তপাতর
অপসারন করে তিনি এই দুশ্চিন্তা হতে রেহাই পান। তারপর ধীরে
ধীরে সেই মানসিক অস্থিরতা হতে মুক্ত হয়ে সুখ ও প্রশান্তির জীবনে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্র
সফরের প্রস্তুতি নিতেই সেই মানসিক অস্থিরতা তাকে আবার চেপে ধরে। মিরেরময়দান নতুন
চেম্বারে প্রচুর রোগী দেখেন। জেফার এইচ এস সি প্রথমবর্ষে পড়ছে। এমনই এক সময়ে মাইগ্রেশন
ভিসায় যুক্তরাষ্ট্র গমন ডাক্তারী প্র্যাকটিস, ডায়াগনেষ্টিকের কাজ, আমার চাকুরী ও একমাত্র
পুত্রের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী এক মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।
তিনি বলতেন এত কষ্ট করে, এত পরিশ্রম করে, দেশে এতকিছু করলাম এখন বিদেশে গিয়ে আবার
শূন্য হতে যাত্রা শুরু করব, তাও আবার পড়ন্ত বয়সে। তার ধারনা ছিল আমি আমেরিকা গেলে
আর ফিরবনা। তাদেরকেও ভূলিয়ে ভালিয়ে আমেরিকায় রেখে দেবো। তাই তিনি ভাবতেন দেশের এত কষ্ট
ও সাধনায় গড়া সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। সেইসাথে মধ্য বয়সের পর বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজন,
প্রিয়জন সবাইকে ফেলে আরেক পরবাসী জীবনযুদ্ধে নামার বিড়ম্বনাও কম নয়।
ছোটবেলা হতে বিশ্ব ঘুরে দেখার
আমার একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরণে একধাপ এগিয়ে যাওয়ায় সামান্য দুচিন্তা আমার
মনে আছর করলেও সে তুলনায় আনন্দটা ছিল অনেক বেশী। আমার চাকুরীটা তখনও পচে যায়নি,
অতীতের সবগুলো পদোন্নতি ছিল নিয়মিত। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম চাকুরিতে ফিরে আসব।
এবার অন্ততঃ আমেরিকা পর্যবেক্ষন করে পরে চাকুরী ও প্র্যাকটিস ছাড়া কিংবা রাখার
সিদ্ধান্ত নেবো। ডাঃ নুরজাহানকে সান্তনা দেই মনে
কর আমরা স্রেফ একটি বিদেশ সফরে যাচ্ছি, বিশ্বের শ্রেষ্ট এই দেশটিকে পরখ করে মাসখানেক
পরই ফিরে আসব। তিনি তার চেম্বারে আমার ভাগ্নাবউ ডাঃ রেবেকা সুলতানা রিপাকে বসালেন।
তাকে হিস্টারোপ্যাথলজী শিখায়ে বিভিন্ন প্যাথল্যাবে এইসব কাজও দিয়ে যান।
আমি সাধারন ছুটি নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্র যাই ও ছুটি শেষ হবার আগেই এসে চৌধুরীবাজার শাখায় যোগদান করি। ফিরে
এসে কাজে যোগ দিলে ডাঃ নুরজাহান চৌধুরীর মানসিক অস্থিরতা কিছুদিনের মধ্যে দূর হয়।
তবে একটি দুশ্চিন্তা রয়ে গেল। জেফার ২০১৬ সালে এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে। তার পরীক্ষার
আগেই যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে ফিরে আসতে হবে। এইচ এস সি জীবনের ভিত্তি স্থাপনকারী একটি
কঠিন পরীক্ষা, সেখানে দুইবর্ষে সে প্রায় আড়াইমাস বাংলাদেশে নেই। তাহলে কেমন হবে
তার এই পরীক্ষার ফলাফল?
এবার আমার সচক্ষে দেখা আমেরিকার
সমাজব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে আলোচনা করবো। আমেরিকা হল অবাধ স্বাধীনতার
দেশ, অন্যভাবে বলা যায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের দেশ। এখানে আগে ব্যক্তি, তারপর
রাষ্ট্র। পরিবার হল রাষ্ট্র ও ব্যক্তির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্টান। আমাদের
দেশে সন্থানের উপর মাবাবার শাসন থাকে তাদের মৃত্যুর আগ মূহূর্ত পর্যন্ত কিন্তু
যুক্তরাষ্ট্রে বয়স আটারো পার হলে ব্যক্তির উপর পরিবার বা মাবাবার আর কোন কতৃত্ব
চলে না। ব্যক্তি মাবাবার পরিবার হতে বের হয়ে জোড় বেঁধে নতুন বাসা বাধে। বয়স আটারোর
আগেও ব্যাক্তির উপর পরিবারের শাসন আমাদের মত এত শক্ত নয়, বলা যায় অনেক শিথিল।
আমেরিকাবাসী মনে করেনা
যুক্তরাষ্ট্র ঐশ্বরিক প্রতিষ্টান। মানুষের ঐক্য ও চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র
সৃষ্টি হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র মানবসৃষ্ট সাম্রাজ্য। দেশটির সংবিধান তৈরী করেছে
মানুষ। এই সংবিধান মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রয়োগের ফসল। মানুষের
চিন্তাভাবনায় তৈরী বুদ্ধিদীপ্ত আইন কানুনের মাধ্যমেই এই দেশটি পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীন ও সার্বভৌম। রাজ্যে রাজ্যে বিরোধ, জটিল
রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীন বিচার বিভাগের রায়ই চুড়ান্ত সমাধান
হিসাবে বিবেচিত হয়।
আমাদের দেশে পুলিশ ও বিচার বিভাগকে
প্রভাবশালী দুষ্টলোকেরা ছলে বলে কৌশলে নিজস্বার্থে ব্যবহার করে। গরীব ও অসহায়
মানুষ এসব প্রতিষ্টানে যেতে ভয় পায়। কিন্তু আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা মজলুমের
অনুকূলে। গরীব লোকের মামালা খরচ সরকার বহন করে। শিশু ও নারীরা প্রকৃতিগতভাবে
পুরুষের চেয়ে দুর্বল, তাই এখানকার আইন শিশু ও নারীকে আলাদাভাবে সুরক্ষা দেয়।
আমেরিকায় শাসনের নামে শিশুদেরকে কোন ধরনের কষ্ট দেয়া ও নির্যাতন করা নিষিদ্ধ। এমন
কি পিতামাতা কিংবা শিক্ষক শিশুদের গায়ে হাত উঠালে কিংবা গালাগালী করলে বিপদ আছে।
নিদৃষ্ট ফোন নম্বারে শিশুরা ফোন করলে মাবাবাকে জেলে যেতে হবে। এমন কি বাচ্চাকে
কেড়ে সরকারের তত্বাবধায়নে নিয়ে যেতে পারে। এবং নারীরা ফোনে অভিযোগ করলে মধ্যরাতে
পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে পুরুষ সঙ্গী কিংবা স্বামীকে পাকড়াও করে নিয়ে যায়। বিউটি
ভাবী আরমো স্কুলের টিচার। একবার ক্লাসে একটি বালক বারবার হৈ চৈ করলে তাকে বললেন, তোমার
জন্য অন্যদের ডিস্টার্ব হচ্ছে। তুমি ইচ্ছে হলে বেরিয়ে যেতে পারো। বালকটি তার
অভিভাবকদের কাছে বিষয়টি জানালে তারা অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করে। অধ্যক্ষ
স্কুলটিচার ভাবীকে ডেকে নিয়ে যা থ্রেড দিলেন তা হলো- শিশুরা মানসিক আঘাত পাবে এমন
কিছু ক্লাসে বলা বা করা যাবেনা।
সাদা পুলিশের বিরুদ্ধে কালোদের
প্রতি বিরুপ আচরনের অভিযোগ প্রায়ই শুনা গেলেও আমেরিকার পুলিশকে আমার বেশ সাহায্য
প্রবনই মনে হয়েছে। আমেরিকার কালোরা দরিদ্র জনগোষ্টি এবং শিক্ষা দীক্ষা কম হওয়ায়
তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবনতা একটু বেশী। একসময় কালোরা ছিল দাস ও সাদারা প্রভূ। আজ
সবাই স্বাধীন হলেও সাদা ও কালোদের মধ্যে একটা মানসিক দূরত্ব রয়েই গেছে। কালোদের
প্রতি সাদা পুলিশের কঠোর আচরন মাঝে মধ্যে আমেরিকার কোন কোন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক
অচলাবস্থা ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।
আমেরিকাবাসী মামলা ও পুলিশের
টিকেট খাবার ভয়ে সব সময় ভীত সন্তস্ত্র থাকে। আমেরিকার বিচারালয়ে দ্রুত বিচার
সম্পন্ন ও সাজা কার্যকর হয়। মামলা (Suit) লাগা ও টিকেট
খাওয়ার ভয়ে মানুষ অপকর্ম হতে দূরে থাকে। আমেরিকায় ন্যায়বিচার থাকার কারনে কেউ আইন
নিজহাতে তুলে নেয়নাও গনপিঠুনির মত ঘটনা আদৌ ঘটেনা। দুর্ঘটনা ঘটলে চালকরা পালিয়ে যায়না।
আমেরিকার আদালতে বাঘে মহিষে একঘাটে জলপান করে।
এখন আমেরিকার জীবন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু
কথা বলবো। আমেরিকায় মানুষের জীবনকাল তিন পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব হল নন-এডাল্ট
জীবন। এজীবন পর্বের ব্যাপ্তি জন্ম থেকে আটারো বছর পর্যন্ত প্রসারিত। মাবাবা
শিশুদেরে সযতনে প্রতিপালন করে। পরিবারের সাথে হেসে খেলে বাল্য কৌশর পার হয়।
দ্বিতীয় পর্ব হল এডাল্ট জীবন। আটার বছর বয়স শেষ হলে এই পর্ব শুরু হয়। তখন ছেলে
মেয়েরা আর মাবাবার সাথে বসবাস করেনা। তারা কলেজ হোস্টেল কিংবা সিঙ্গুল ফ্ল্যাটে
চলে যায়। আমেরিকানদের যৌনজীবন অবাধ ও স্বাধীন। পারস্পারিক সম্মতিতে যে কোন নরনারী
বিবাহ ছাড়াও একত্রে বসবাস করতে পারে। এই সম্মতিপূর্ন একত্রবাস সমাজ অন্যায় কিছু
মনে করেনা। দুই জন নর ও নারীর বিবাহ বহির্ভূত এই একত্র বাসকে তারা বলে লিভ
টুগেদার। যে কোন নর নারী সঙ্গী নিয়ে একত্রে বসবাস করলে কেউ জানতে চাইবেনা তারা বিবাহিত
কিনা। বরং এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার জানার চেষ্টা
করাটা অসভ্যতা। কে কারে নিয়ে রাতে ঘুমায় এসব বিষয় নিয়ে কোন
মার্কিনি মাথা ঘামায় না।
এপর্বে আমেরিকানরা যৌবনকালকে যথেচ্ছভাবে
উপভোগ করে বয়স ত্রিশ হলে বিয়ে শাদি করে সন্থান গ্রহনে সচেষ্ট হয়। অনেক দম্পতি
তাদের সন্থানরা বড় হবার পর বিয়ে করেন এবং সেই বিয়ে অনুষ্টানে সন্থানরা শরিক হন।
আমেরিকার মুসলিম জনগোষ্টি ছাড়া অন্যদের
বিবাহ বহির্ভুত অবাধ যৌনাচারে কোন পাপবোধ নেই। তবে এই যৌনাচার হতে হবে সম্পূর্ন
স্বেচ্ছায় ও পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে।
অবাধ যৌনাচার আমাদের ধর্মে গোনাহ ই
কবিরা (গুরুতর পাপ)। শাস্তি এক শত দুররা হতে পাতর ছুঁড়ে প্রাণদণ্ড। অথচ ভিন্ন
জাতির কাছে ইহা গোনাহে সগীরাও নয়। আমেরিকা এমন একটি দেশ, যেখানে সমকামিতাও বৈধ। আমেরিকার
সমকামী গে পুরুষরা একে অন্যকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীর মত
বসবাস করে। সমকামী লেসবিয়ান নারীরা নিজেদের মধ্যে অনুরূপ দাম্পত্য জীবন পরিচালিনা
করে থাকে। এই অদ্ভুদ রীতিনীতির দেশটির ৯৬% মানুষ খৃস্টান ও বাকী ৪% মানুষ ইহুদি,
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি। তবে মুসলিম জনগোষ্টি ছাড়া ধর্ম-বিশ্বাসী লোকজন
এখানে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।
আমেরিকা জনসংখ্যায় পৃথিবীর
সর্ববৃহৎ খৃস্টান দেশ। এখানকার ধর্মীয় জীবন এমন যে ধর্ম এখানে নিজ নিজ ব্যক্তিগত
বিশ্বাসের ব্যাপার। তারা আমাদের মত ধর্ম নিয়ে এত মাথা ঘামায় না। ধর্মকে খুব একটা
গুরুত্ব দেয়না। অন্যের ডিস্টার্ব হবার ভয়ে গীর্জা ও মন্দিরে ঘন্টা বাজায় না। তারা
মসজিদে উচ্চশব্দে আজান দেয়না। ধর্মকে মার্কিনিরা কেবল আধ্যাত্মিক ও পরলৌকিক বিষয়
মনে করে। তারা জাগতিক কাজে, রাজনীতিতে, জ্ঞানচর্চায় ধর্মকে খুব একটা টেনে আনেনা।
এখানে কালো, মিশ্র ও শ্বেতদের মধ্যে বর্ন নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হলেও ধর্ম নিয়ে তেমন
কোন সাম্প্রদায়িকতা নেই। আমেরিকানরা মনে করে ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়, বিশ্বাসের জিনিস
নিয়ে এত হৈ চৈ মারামারির কিবা প্রয়োজন।
আমেরিকার খৃস্টানদের মধ্যে অনেক
সম্প্রদায় রয়েছে। যেমন ক্যাথলিক, প্রটেস্টেন্ট ইত্যাদি। ক্যাথলিকদের একটি
সম্প্রদায় আমিশ পেন্সিলবানিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। তারা কোন পরিবর্তন বা
আধুনিকতা গ্রহন করেনা। তারা যিশুর যুগকে সর্বোত্তম মনে করে। আমেরিকার মত
অত্যাধুনিক দেশে বসবাস করেও তারা ইঞ্জিনের গাড়ি চড়েনা, যিশুর যুগের ঘোড়া ও ঘোড়ার
গাড়ি ব্যবহার করে। তাদের গ্রামের রাস্থা পাকা করে না, মেঠোপথ ব্যবহার করে। তাদের
জনপদে বিদ্যুৎ নেই, নেই কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি। তাদের গ্রামগুলো যেন দুইহাজার বছর
আগের যিশুর জন্মস্থান বেথেলহেম। আমিশরা প্রতিপক্ষের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে
নেদারল্যান্ড হতে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। তারা বিগত তিনচার শত বছর ধরে নিজেদের
স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আমেরিকায় টিকে আছে। এখানে যুগের পর যুগ তারা সম্পূর্ন
প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন করে যাচ্ছে।
আমেরিকানরা যৌবন রঙ্গে রসে
কাটালেও বার্ধক্যে একাকিত্বের শিকার হন। ব্যস্ত ছেলে মেয়েরা জীবন জীবিকার টানে
বিশাল আমেরিকার দুরদূরান্তে পাড়ি জমায়। যৌবনের উম্মাদনায় বাপমাকে ভূলে যায়। তারা
খুব একটা পিতামাতার কাছে আসেনা। তাই এখানে বুড়োদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব সরকারের।
অসুস্থ হলে সন্থানদের দায়িত্ব বড়জুর হাসপাতালে ভর্তি করে আসা। সরকারী নার্সরা
দেখাশুনা করে, সরকারি চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেন। চিকিৎসা বিল ইনস্যুরেন্স কোম্পানী
অথবা সরকার বহন করে।
বুড়োরা বয়স বাষট্টির পর বার্ধক্য
ভাতা পান। চিকিৎসা ফ্রি, সরকারী বাসায় অল্প কিংবা ফ্রি ভাড়ায় থাকার সুযোগ পান।
অক্ষম মানুষ এদেশে খুব বেশী রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পান। প্রতিটি পার্কিং এলাকায়
ডিজেবলদের গাড়ি রাখায় কোঠা আছে। তাদের পার্কিং এলাকা খালি থাকলেও কেউ গাড়ি রাখেনা।
এখানে গাড়ি রাখলেই ৫০ ডলার জরিমানার টিকেট আসে। অক্ষম বা পঙ্গু মানুষের থাকা খাওয়া
চিকিৎসা সবই সরকার বহন করে। অক্ষম মানুষের দেখাশুনা করে পরিবারের সদস্যরা বেতনও
পেয়ে থাকেন। আমেরিকায় অক্ষম লোকদেরে সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশের মত
তাদেরকে নিয়ে কেউ হাসি মশকরা করেনা।
আমেরিকানরা মুক্তচিন্তায়
বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাসের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, চিন্তার
স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কোন বাঁধা বিপত্তি নেই। আমেরিকায় নারী ও
পুরুষকে আলাদা করা যাবেনা। এখানে নারী ও পুরুষ একই কোল, একই প্রজাতি। সর্বত্র
উভয়ের সমান বিচরন। আমাদের দেশে নারীদের উপর পুরুষ জাতির একটা অদৃশ্য ও অলিখিত
কতৃত্ব থাকে কিন্তু আমেরিকা নারীরা এতই স্বাধীন যে তাদের উপর পুরুষদের কোন
দৃশ্যমান বা অদৃশ্য কতৃত্ব নেই। দুইজনের মধ্যে সমস্যা হলে যে যার পথে চলে যাবে,
বাচ্চারা বাবা কিংবা মা যেখানে চাইবে সেখানে থাকবে। বাবা-মা দায়িত্ব না নিলে এসব
বাচ্চাদের দায়িত্ব সরকার গ্রহন করে।
আমেরিকা এমন একটি দেশ যেখানে
নারী কিংবা পুরুষ, জীবন ও জীবিকার জন্য কেউই কারো উপর নির্ভরশীল নয়। সবাই রোজগার
করে, কেউ কারো খায় না, পরে না, তাই কেউ কারো ধার ধারে না। কোন চাপে নয়, কেবলমাত্র
পারস্পারিক ভালবাসা ও সম্মতির মধ্যমেই এখানে দাম্পত্য জীবন টিকে রয়। এখানে অনেক
নরনারী আছেন যারা পোষাক বদলের মত সঙ্গী পরিবর্তন করে থাকেন।
আমেরিকার সমাজব্যবস্থা
গনতান্ত্রিক। এখানে পরমতকে সম্মান করা হয়। তাই তাদের রাজনীতিতে আমাদের মত কোন্দল ও
স্বেচ্ছাচার নেই। গনতন্ত্র ও আইনের মাধ্যমে তাদের রাজনীতি চলে। তাই তাদের
রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র নেই, মারামারি নেই, নেই পেশীশক্তির ব্যবহার। যুক্তরাষ্ট্রের
ইতিহাসে কখনও সামরিক শাসন কিংবা একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়নি, হবার সম্ভাবনাও তেমনটি
নেই। শত শত বছরের সাংবিধানিক নিয়মের বাইরে এখানে ক্ষমতার জবরদখলের কোন রাস্থা নেই।
আমেরিকার আয়তন মুসলিম বিশ্বের
মোঠ আয়তনের অর্ধেকের চেয়েও বেশী। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের রাজনীতি সুন্দর একটি
নীতমালা ও শৃংখলার মধ্যে পরিচালিত হয়। দেশটি গনতান্ত্রিক পন্থায় সময়ের সহিত
পরিবর্তন হচ্ছে, আধুনিক ও যুগপোযুগী হচ্ছে। আমেরিকা জ্ঞানে বিজ্ঞানে সম্পদে দিনে
দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
দেশটির ইহুদিরা অত্যন্ত সংঘটিত
ক্ষুদে সম্প্রদায়। তারা আমারিকার সবচেয়ে শিক্ষিত ও ধনবান জনগোষ্টি। ইহুদিরা খুব
কুটকৌশলী ও ধূর্ত। আমেরিকার সব বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্টান, কর্পোরেশন, মিডিয়া, প্রেস,
পত্রিকা, ভবন তাদের দখলে রয়েছে। ইহুদি জনসংখ্যা বাড়াতে তারা অধিক বাচ্চা নেয়।
আমেরিকায় মুসলিম ও ইহুদি জাতির মধ্যে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়। ছোট্ট টুপি মাথায়
দিয়ে ইহুদি পুরুষ ও মাথায় রুমাল বেঁধে ইহুদি নারীদেরকে নিউইয়র্কে চলাফেরা করতে
দেখি। তাদের প্রায় পুরুষদের গালে দাড়ি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানরা
বেশ সংঘটিত। তারা একই নেইভারহোডে বসবাস করা পছন্দ করেন এবং মসজিদ কমপ্লেক্স
কেন্দ্রিক মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। তারা ইসলামকে মার্কিন সমাজের সহিত
মানিয়ে নিতে এক উত্তম ও আধুনিক ব্যবস্থায় ধর্মকে সাজিয়ে নেন। নর, নারী ও শিশু সবাই
একসাথে মসজিদে যান। আসলে মসজিদ এখানে তাদের সম্মিলন কেন্দ্র। এখানে তারা ইসলাম
ধর্মকে সব ধরনের রাজনীতি ও উগ্রবাদ হতে মুক্ত রাখেন। তারা ইসলামকে শান্তি ও
মানবতার ধর্ম হিসাবে উপস্থাপনে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। মসজিদে খেলাধূলা, মেলা,
অনুষ্টান, পাঠাগার ও সম্মিলন কেন্দ্র গড়ে তুলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা কেবল
নারী নয়, বিধর্মী লোকজনকেও মসজিদে আমন্ত্রন করেন। তাদেরকে মসজিদে মুসলিম জীবন
পর্যবেক্ষন করার সুযোগ করে দেন। বিধর্মীদের জন্য মসজিদে কিছু জায়গা বরাদ্ধ রাখা
হয়। তারা এখানে বসে স্কলারদের ভাষন শুনেন ও মুসলিম সমাজের ভাতৃত্ব, সাম্য ও
ন্যায়নিষ্টতা প্রত্যক্ষ করেন। ফলে অনেকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহন করে থাকেন। অথচ
বাংলাদেশে নারী ও বিধর্মীদেরকে মসজিদে ঢুকতে দেয়া হয় না।
মুসলিম ছেলেমেয়েরা বিধর্মীদের
প্রেমের খপ্পরে যাতে না পড়ে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম যুবক ও যুবতীদের মধ্যে
শরিয়া সম্মত প্রেম করার বৈধতা রয়েছে। শরিয়া সম্মত প্রেম হল বিয়েপূর্ব নরনারীর
পারস্পারিক বুঝাপড়ার জন্য শরিয়ত সম্মত মেলামেশা। একজন কুমারী হিজাবপরা মেয়ের সাথে অবিবাহিত
মুসলিম তরুনের বিবাহপূর্ব ভালবাসা। আমেরিকার রাস্থাঘাটে, হাটে-বাজারে বাঙ্গালী
মুসলিম নারীদেরে আমি হিজাব পরে হাঁটাচলা করতে দেখি। এতে সহজেই চেনা যায় তাঁরা
মুসলমান। আমার আমেরিকান আত্মীয় স্বজনদের পরিবারের সকল বালিকা, কিশোরী, যুবতী, পৌঢ়
সবাইকে হিজাব পরে চলাফেরা করতে দেখি।
আমেরিকার আইন শতভাগ নারী বান্ধব,
তাই বাঙ্গালী নারীরাও কুরুক্ষত্রের যুদ্ধে বেকায়দায় পড়লে সময়ে অসময়ে ৯১১ কলের
ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠছেন। অনেক বাঙ্গালী নারী পশ্চিমা ধাঁচের পোষাক পরছেন, তাদেরকে
অনেক সময় স্প্যানিশদের থেকে আলাদা করা যায়না। চেহারার এত মিল দেখে কিছু আমেরিকান
জানতে চান বাঙ্গালীর আদি পুরুষ কি স্প্যানিশ ছিলেন। বাঙ্গালীরা
দীর্ঘ্যদিন আমেরিকার অভিবাসী হলেও ঘরে তাঁরা বাঙ্গালিত্ব ধরে রাখেন। খাওয়া দাওয়া,
আড্ডা, অতিথি আপ্যায়নে বাঙ্গালীরা তাদের স্বভাবে অটুট।
আমেরিকার বিশালাকৃতির লোকজন দেখে আমি
বিষ্মিত হই। স্থুলাকৃতি মানুষের দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে ১ নম্বর। এদেশের
৩৩% লোকই স্থূলতায় ভূগছে। স্থূলত্ব যেমন মোঠা মানুষের নিজের জন্য মারাত্বক সমস্যা,
তেমনি এটি বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যার একটি। জরিপে
জানা যায় রকমারী খাবারের প্রাচুর্য্য, আর্থিক সচ্ছলতা, ব্যায়ামহীন ও কায়িক শ্রমহীন
জীবনই নাকি এর কারণ।
মার্কিন মুল্লুকে আমি দৃশ্যমান
নারী-পুরুষ পর্যবেক্ষন করি। কোন দেশের অধিবাসীদের চালচলন আচার-আচরন লক্ষ্য করা
আমার এক ধরনের নেশা। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও বৃটেনে যে জিনিসটা আমাকে বার বার
অস্বস্তি দেয় তা হল ‘পাবলিক ডিসপ্লে অব এফেকশন’ বা সংক্ষেপে পিডিএ। পশ্চিমারা
ব্যক্তিস্বাধীনতা ইচ্ছেমত উপভোগ করেন। পিডিএ যেন তাদের এক ধরনের মানবাধিকার। ট্রেনে, বাসে, রাস্থায় যুবক-যুবতীদের কেউ কেউ আলিঙ্গনাবদ্ধ ও চুম্বনরত
দেখা যায়। এমন কি সমলিঙ্গের জুটিদেরকেও এধরনের আচরন করতে দেখা যায়। আমরা প্রাচ্যের
লোকজন এসব না দেখার ভান করে আড়চোখে দেখে নেই। সাধারনত কেউ তাদের দিকে তাকায়না।
আমার পুত্র জেফারকে নিয়ে বের হয়ে বাসে ও প্রমোদ জাহাজে এই কারনে অনেক অস্বস্তিকর
অবস্থায় পড়ি। জানিনা ওসব দেশের শিশুরা এসব দেখে কিভাবে নেয়। আমাদের দেশের গ্রামের
শিশুরা পশুপাখির আচরন হতে প্রথম যৌন ধারনা পায়। আমার মনে হল পশ্চিমা শিশুরা যেখানে
সেখানে আলিঙ্গনাবদ্ধ ও চুম্বনরত যুবক-যুবতীদের দেখে প্রথম যৌন শিক্ষা পেয়ে যায়।
শিশুদের মধ্যে এর বিরুপ প্রভাব পড়ে নিশ্চিত। নইলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর এক
মিলিয়ন করে অনভিপ্রেত কিশোরী গর্ভধারনের ঘটনা সংঘটিত হতনা। আমেরিকায় ২০% মানুষ পিডিএ
নিষিদ্ধের পক্ষে হলেও ৮০% সমর্থক মনে করেন তা একটি মর্জিত নীতির মধ্যে থাকা উচিত।
আমেরিকার সমাজ শহুরে সমাজ। এখানে
খুব অল্প লোকই গ্রামে বসবাস করেন। তবে আমেরিকার শহরগুলো গ্রামের মত নিরিবিলি ও
খোলামেলা। বাংলাদেশের শহর গাদাগাদি ঘনবসতি, ময়লা ও অপরিচ্ছন্ন, হিজিবিজি বস্তি।
আমেরিকার শহরে এসব নেই। ব্যবসা, সেবা ও শিল্প আমেরিকানদের আসল জীবিকা। তবে কৃষিতেও
আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গম, তুলা, আলু, দুধ, মাছ ও
মাংস আমেরিকায় উৎপাদন হয়। খনিজ সম্পদেও দেশটি সেরা। তৈল, কয়লা ও লোহা উৎপাদনে
আমেরিকা বিশ্বের প্রথম সারির দেশ।
এখানে জমি ছোট ছোট টুকরো নয়। সব
ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় বড় যান্ত্রিক খামার। এদেশে সব পেশাই সম্মানজনক। কোন কাজকেই
তারা ছোট বা হীন গন্য করে না।
আমেরিকানদের পোষাক সংস্কৃতিও
বৈচিত্রময়। তারা বিচিত্র বিচিত্র ধরনের পোষাক পরে চলাফেরা করে। যে যাই পরুক না কেন
কেউ কারো পানে ফিরে থাকায় না। কারো লম্বা চুল, কারো ছোট ছোট চুল, কারো বেনী বাঁধা,
কারো খোলা, কারো ছেড়া প্যান্ট, কেউবা উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ, কেউবা ভিক্ষুকের থলী নিয়ে
চলাফেরা করে। কালোরা প্রায়ই রাস্থা ঘাটে ড্যান্স করে, গান গায়, নিগ্রো মেয়েরা বিছার
মত ঝুলানো পচিশ ত্রিশটি চুলের বেনী নিয়ে গর্বভরে হাঁটে, যেন তারা রূপে রুপে
অপরূপা।
আমাদের দেশের লোকজন একটা সামান্য
ব্রিফকেস নিয়ে শূন্য হাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। শূন্য হতেই তাদের যাত্রা শুরু
হয়। তাই প্রথম প্রজন্মের জীবন হয় কষ্টকর ও অস্থির। তারা যুক্তরাষ্ট্রের হাইটেক
ফাস্ট সমাজে হয় বেমানান। আমেরিকার সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে
নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। তাই স্বদেশীদের ভীড়ে ভীড়ে তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে।
নিউইয়র্কে প্রতিমাসে আড়াই-তিন
হাজার ডলার রুজি করে দেড় হাজার ডলার বাসা ভাড়ায় চলে যায়। খাবার ও ইউটিলিটি বিল
পরিশোধ করে একজনের আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই নবাগতদের স্বামী-স্ত্রী
দুজনকেই কাজ করতে হয়। এভাবেই সংগ্রাম করে করে এক প্রজন্ম পার হয়। তবে তাদের
সন্থানরা আমেরিকান হয়ে উঠে। আমেরিকায় উচ্চ কিংবা অর্ধ শিক্ষিত হলেই চাকুরীর অভাব
নেই। চাকুরি মরগেজ করে ঋন নিয়ে তারা সহজেই হাইফাই বাড়ি ও গাড়ির মালিক হয়। এই
প্রজন্মের জীবন হয় সুখ শান্তি ও প্রাচুর্য্যময়।
আমেরিকায় সন্থানদেরে শিক্ষিত করে
দিলেই হলো, বাংলাদেশের মত তাদের জন্য ধন সম্পদ সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজন নেই। এখানে
সন্থানরাও মাবাবার সম্পদের জন্য লালায়িত নয়। তারা জীবনটাকে সাগরের উচ্ছল ঢেউয়ের মত
উপভোগ করে। আমাদের মত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য চিন্তা করে তাদের মরতে হয়না। এখানে
আমিই আমার আরম্ভ, আমিই আমার শেষ।
আমেরিকা নিরবতার দেশ। রাস্থায়
গাড়ি বেপু বাজায়না, শব্দ করে না। মানুষ উচ্চস্বরে কথা বলেনা, অনুষ্টানে হৈ চৈ
করেনা। হাজার হাজার মানুষ কোথায়ও জমায়েত হলে নিরব বসে থাকে, টু শব্দ করেনা। মানুষ
ভদ্র ও সুশৃংখল। সর্বত্র লাইন ধরে কাজ করে। কোন কাজে কোন অফিসে গেলেই কম্পিটারে
নাম ও আসার কারন এন্ট্রি দিতে হয়। সিরিয়াল অনুযায়ী লাউড স্পিকারে ডাক আসে।
আমাদের দেশে ধনী লোকেরা একটু
বেশী মর্যাদা পান। যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কারো সাহায্যের জন্য লালায়িত নয়। গরীবের
চাওয়া পাওয়া সব রাষ্ট্রের কাছে, কোন ধনী কিংবা প্রভাবশালীর কাছে নয়। তাই এখানে
ধনী, গরীব, প্রভাবশালী সবাই একই মর্যাদা ভোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে
ধনী গরীব সবাই নিজস্ব গাড়ি বাড়ি নিয়ে উন্নত জীবন যাপন করে, এখানে সবাই রাজা, নিজের
রাজত্বে। এখানে ধনী ও গরীবের জীবনমানের বৈষম্য খুব একটা বুঝা যায়না।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্টত্বকে আমি
সম্মান জানাই। বিশ্ব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় তাদের অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি দেশটির
আর উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন