আমার জৈষ্ট্য ভগ্নিপতি মুফতি মোহাম্মদ খালেদের ইন্তেকাল
৩০ মার্চ ২০১৬ সাল। দিনটি শোকাবহ
কারন দিনটিতে আম্মা ও আব্বার পরলোকগমনের পর আমাদের পরবর্তী গুরুজন বড় দোলাভাই
মুফতি মোহাম্মদ খালেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে আমার বড়বোন আনিকা কুরেশী
রেহার সাথে বিয়ের পর হতে তিনি আমাদের একজন অভিভাবক। তিনি একজন যান্ত্রিক ডিপ্লোমা
প্রকৌশলী ছিলেন। চাকুরী জীবনের প্রথমভাগে কাজ করেন ঢাকায় রাষ্ট্রয়াত্ব কোহিনুর
ক্যামিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে, থাকতেন মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার এক ভাড়া বাসায়। পরে বদলী
হয়ে চলে আসেন ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানায়। এখানে তিনি জীবনের সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত
করেন। এই কারখানার আবাসিক এলাকায় আমার ভাগ্না ভাগ্নিদের শৈশব কৈশোর অতিবাহিত হয়।
তারা এন জি এফ এফ স্কুলে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষার জন্য সিলেটে বেরিয়ে আসে। এমন কি
আমার বড় ভাগ্না লবিদ এবং ভাগ্নি পপীর বিয়েও এই ফেন্সুগঞ্জ সারকারখানায় অনুষ্টিত
হয়। আমি সিলেট পলিটেকনিক্যালে অধ্যয়নকালে তিনি বলতেন আমাদের তৎকালীন সিলেট পলিটেকনিকের
প্রিন্সিপাল নেছওয়ার আহমদ তার টেকনিক্যালের সহপাঠি। মুফতি মোঃ খালেদ সাহেবের
গাত্রবর্ণ শ্বেতাংদের মত দুধসাদা কিন্তু চুলদড়ি ও চক্ষুমনী ছিল একদম কাজল কাল।
সুদীর্ঘ্য সুগঠিত দেহায়ব, না ছিল মোঠা না চিকন। আসলে তিনি ছিলেন খুব সুদর্শন
সুপুরুষ।
শাহজালালের(রঃ) দরগাহের উত্তরের
মাদ্রাসা সংলগ্ন মুফতিবাড়ির মুফতি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ছিলেন তার জনক। মুফতি
আলাউদ্দিন ছিলেন আমার ফুফার আপন ভাই। এই মুফতি পরিবারটি হজরত শাহজালালের(রঃ)
দরগাহের একটি খাদেম পরিবার। মুফতি মোঃ খালেদ দোলাভাইয়ের মাতাও ছিলেন দরগাহের
পুর্বগেটের মুফতি বাড়ির কন্যা মুফতি সায়রা খানম, তিনি মুফতি মোজাফফরের বোন। তার
মামাবাড়ি ও নিজবাড়ি কাছাকাছি দুইটি মুফতিবাড়ি। একটি শাহজালালের দরগাহের পূর্ব সীমানা
ও অন্যটি উত্তর সীমানা ঘেষে রয়েছে। শাহজালালের পবিত্র দরগার আশপাশে বেড়ে ওঠা মুফতি
খালিদ, মুফতি অলিদ ও মুফতি যোবায়ের এই তিন পুত্রধনকে অল্প বয়সে রেখে তাদের মাতা মুফতি
সারা খাতুন অপরিণত বয়সে মারা যান। অলিদ পাকিস্থানে ও যোবায়ের লন্ডনে চলে গেলে কেবল
খালিদই বাংলাদেশে জীবনযুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। তার পিতা মুফতি আলাউদ্দিন একসময়
জগন্নাথপুরের সৈয়দপুরে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এখানে তার আর চার ভাই মুফতি ওয়েস, মুফতি
কয়েছ, মুফতি উবায়েদ, মুফতি হুজায়ের ও এক বোন মুফতি ফাহিমা জন্মলাভ করেন। তারা
পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস করতেন। স্থানস্বল্পতা ও বিবিধ কারণে দরগামহল্লার পৈত্রিক বাড়িতে মুফতি মোঃ খালেদের বড় পরিবারের জায়গা হয়নি। তাই
চাকুরী হতে অবসর নিয়ে সিলেটে এসে আমার বাসার কাছে সাগরদিঘিরপারে বাসা ভাড়া নেন। এই
সাগরদিঘিপাড়ায় জীবনের শেষ বছরগুলো তিনি অতিবাহিত করেন।
মুফতি মোঃ খালেদ ছিলেন খুব
পরহেজগার লোক, সারাক্ষণ ধর্মেকর্মে, জিকিরে, তেলাওতে মশগুল থাকতেন। তার জায়নামাজ সবসময়
একই ভাজ করে রাখতেন, টুপির ভাজও বদলাত না। কেউ এগুলো ছুইলে তিনি বুঝে ফেলতেন ও
আগের মত ভাজে ভাজ করে একই স্থানে সাজিয়ে রাখতেন। পড়তেন ঈমাম গাজ্জালির বই ‘কিমিয়ায়ে
সাদাকাত’ এবং কিছু কিছু ধর্মীয় বই। যত শীত হোক না কেন ঘুম হতে জেগে গোসল করা তার
ছিল চির অভ্যাস। তিনি ছিলেন সহজ সরল লোক- কারো কাছেও না, দূরেও না। বন্ধু
বান্ধবরাও ছিলেন তার মত সাদাসিদা ও পরহেজগার। তার মনের মিল আছে এমন কয়েকজন পরিচিতকে
নিয়ে তার মনোজগত ছিল সীমায়িত। ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার ফারুক, ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত চৌধুরী
কুটি ভাই প্রমুখ ছিলেন তার কাছের মানুষ। সারকারখানায় থাকাকালে একবার তার উপর
পাহাড়ি মৌমাছি ঝাপিয়ে পড়ে। ভাগ্যবলে কয়েকদিন শয্যাশায়ী থেকে বেচে যান। পাবলিক বলল
এত এত লোক থাকতে মৌমাছিরা আপনার মত ভাল মানুষকে তাদের মধুচোর সন্দেহ করে আক্রমণ করল।
আপনি কি বলতে পারলেন না আমি চোর নই ভাল মানুষ, আমাকে ছেড়ে দাও। কেউ কেউ বলল মুফতি
সাহেব ফুলের মত সুন্দর মানুষ, তাই তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছিরা তাকে এই আক্রমণ করেছে।
মুফতি দোলাভাই একটি গল্প বলতেন? আবদার
করামাত্র তিনি আমাদেরকে কৈশোরে গল্প শুনাতেন-‘ওইড়ার ঘরের গইড়ারে তেতুল তলায় ঘর/
সাবু ঠাকুর বলে দিছেন এমনে এমনে কর?’ বলেই তিনি নাপিতের ক্ষুর ধার দেওয়ার মত দুহাত
ঘষাঘষির অভিনয় ও অঙ্গভঙ্গি করতেন। একগ্রামে ওইড়া নামে একজন নাপিত ছিল, তার পুত্র
গইড়া সুদুর অচিন দেশে গিয়ে একজন ব্রাহ্মন সাধুবাবা সেজে বসে। তার শত শত শিষ্য তাকে
ঘিরে আছে, ব্রাহ্মন সাধুবাবাকে তারা প্রনাম করছে, সম্মান দিচ্ছে, বিপুল পরিমান টাকা
কড়ি ঢেলে দিচ্ছে। সাবু ঠাকুর ভীড় ঠেলে এই বিখ্যাত সাধুবাবাকে দেখে অবাক হন, এ যে
তার গ্রামের গইড়া নাপিত। তিনি অভাবগ্রস্ত তাই তার কাছে গিয়ে বললেন বাবা বিদেশে এসে
আমার হাতের অর্থ শেষ হয়ে গেছে, আপনি দয়া করে আমাকে কিছু টাকা ধার দেন? কিন্তু কৃপন
সাধু ব্রাহ্মন একটি টাকাও দিতে রাজি হল না। সে শিষ্যদের খায়, তাদের পালঙ্গে ঘুমায়।
কাউকে কোন সাহায্য করেনা। এবার সাবু ঠাকুর শিষ্যদের ভীড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষুর ধারানোর
অভিনয় করে উপরের লাইন দুটি উচ্চারন করলেন। এবার কাজ হল। সাধুবাবা তাকে আদর করে
কাছে বসিয়ে কানেকানে বললেন তোমার যা প্রয়োজন আমার কাছ হতে নিয়ে যাবে ঐ লাইন দুটি
আর কখনো আমার শাগরেদদের সামনে উচ্চারণ করবেনা। সাবু ঠাকুরের যখনই টাকার প্রয়োজন হত
তিনি সাধুবাবার কাছে গিয়ে টাকা চাইতেন। কাজ নাহলে মন্দিরের পূজারীদের ভীড় ঠেলে
সাধুবাবার সামনে গিয়ে এই দুইলাইন মন্ত্র উচ্চারণ করতেন।
সাবুঠাকুরের মন্ত্রপড়া শুনামাত্র সাধুবাবা তাকে প্রচুর টাকা এনাম দিয়ে বিদায়
করতেন।
তিনি প্রায়ই আমাদের প্রতি একটি
ধাঁধাও ছুড়ে দিতেন- ‘মোমে লালি, চিলমে কালি, ধুমছে পানি পরতা হ্যায়।‘ যার উত্তর তিনি
বলে দিতেন-তেলের প্রদীপ।
চাকুরির সীমিত আয়ে তাকে চলতে
হয়েছে। দুইকন্যা ও ছয়পুত্রের বড় সংসার চালাতে গিয়ে তাকে বাজেট করে চলতে হত। টাকা
রোজগারের কোন দুইতিন নম্বরি রাস্থা ধরা বা খোজার কোন অপজ্ঞান তার ছিলনা। হালাল
ছাড়া হারাম কিছু চিন্তা করার মত লোক তিনি ছিলেন না। তার এত কুটবুদ্ধিও ছিলনা
যাদিয়ে দুনম্বরি কাজকাম করা যায়।
তার ডায়বেটিস ছিলনা, কিন্তু
ব্লাডপ্রেসার ছিল। তিনি ছিলেন ভোজনবিলাসী। প্রেসারের জন্য চিকিৎসক তাকে লালমাংশ,
ডিম, ঘি, পনীর ইত্যাদি খেতে বারন করলেও তিনি তা আদৌ মানতেন না। তাজা খাসী কিনে
জবাই করে ফ্রিজ ভরতেন। গরুমাংশ, ডিম ও পনীর খাওয়া কখনো বাদ দিতেন না। ওষধও ঠিকমত
খান কিনা কেউ বলতে পারেনা। মনে হলে খাবেন, মন না চাইলে কেউ তাকে খাওয়াতে পারবে না।
কিছুটা একগুঁয়েমির অভ্যাস ছিল জীবনভর।
আমার
পত্নী ডাঃ নুরজাহান মাঝে মাঝে দোলাভাইয়ের প্রেসার মেপে অবাক হতেন তাকে স্বাভাবিক চলাফেরা
করতে দেখে, আর অবাক হতেন এত প্রেসারে তার কিছুই হচ্ছেনা দেখে। একদিন তিনি আমাকে
বললেন খাবারদাবারের ধরন বদল না করলে কিংবা ঠিকমত ঔষদ না খেলে দোলাভাই হঠাৎ বড়
ধরনের ধাক্কা খাবেন। এত ব্লাডপ্রেসার অথচ তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। তিনি
আল্লাহের সমীপে সব ছেড়ে দিয়ে বেশ নিঃশঙ্কচিত্ত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ তাকে
হাইপ্রুটিন খাবার থেকে বিরত হবার উপদেশ দিলে বলতেন- আমার কিছুই হবেনা, বিসমিল্লাহ
বলে সারাজীবন খেয়েছি কিছুই ঘটেনি।
কিন্তু
বিপদ ঘটতে সময় লাগেনা। একদিন ফোন পেলাম মুফতি খালেদ দোলাভাইয়ের স্টোক করেছে। তার
পুত্র ডাঃ মুফতি মোঃ শামস সিলেট মহিলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকুরী করত। রোগীকে
আমরা তাই এই হাসপাতালে ভর্তি করে দেই। মস্তিস্কে প্রচুর রক্তক্ষরন হয়, বেশ কিছুদিন
চেতনাহীন ছিলেন। লন্ডন হতে পুত্র লবিদ এসে তাকে দেখে যায়।
চেতনা
ফিরে আসলে তিনি বাসা ফিরেন কিন্তু তার বুদ্ধি অনেকটা লোপ পায়। তিনি পাঁচ ছয় বছরের
শিশুর মত হয়ে যান। লম্বা বাসার ভিতর একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে কেবল নিঃশব্দে
হাঁটতেন। মানুষ কখনো চিনতেন, কখনও চিনতেন না। কেউ কিছু প্রশ্ন করলে বাচ্চাদের মত
হাসতেন। শিশুদের মত সঠিক বেঠিক জবাব দিতেন।
বছর
দিন এভাবে কেটে যায়, তারপর একদিন আবার স্টোক করে। আবার হাসপাতালে যান। বাচামরার
সন্ধিক্ষণে চলে গেলে দুইপুত্র লবিদ হুদহুদ এবং কন্যা পপি লন্ডন হতে এসে দেখে যান।
খানিক ভাল হয়ে বাসায় তিনি ফিরলেন কিন্তু বিছানাবন্দি হয়ে যান। এদিকে আপার শরীরও ভাল
ছিলনা। তাকে কিডনি ডাইলাইসিস করে বাচতে হচ্ছে। এই বিপদের দিনে তাঞ্জির, তানভির ও
হিমু খুব কষ্ট করে মাবাবার সেবা করে যায়।
দোলাভাই
বেশ কয়েকমাস বিছানায় পড়ে রইলেন। রোগীর বেডসুর হবার ভয়ে ইলেকট্রিক বিছানা আনা হয়।
শেষদিকে তার পয়ঃকাজ করাতে তাঞ্জির ও তানভীরকে খুব পরিশ্রম করতে হত। তাকে বহন করে
চেয়ারে বসায়ে পয়ঃকাজ করাতে হত। এমন কি শেষদিকে তাকে বিছানায় মলমূত্রত্যাগ করাতে হত। কাজের মহিলা সেনুরা তার
ময়লা বিছানা কাপড় ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিত।
৩০ মার্চ
২০১৬ সাল, বাদ আসর তিনি মারা যান। আমি যখন তার মৃত্যুসংবাদ পেলাম তখন আমার মনে খুব
একটা প্রতিক্রিয়া হলনা। কেবল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। তার যে শারীরিক অবস্থা তাই
জানতাম তিনি চলে যাবেন। তাছাড়া এভাবে অচল হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বেচে থাকারও কোন
অর্থ হয়না। নিজে কষ্ট করছেন, সেইসাথে রাত জেগে জেগে কি দারূন কষ্ট না করছে তার
পুত্ররা।
আমার
সামনের বাসা নুরজাহান মঞ্জিলে গিয়ে পালঙ্গে সাদা চাদরে ঢাকা তার লাশ দেখলাম। পাশে
সবাই কাদছেন। তার বৃদ্ধা মাতা ও মামিকে পেলাম। তার ভাইবোনেরা সবাই ছুটে এসে সোফায়
বসে আছেন। বাসায় স্বজনদের ভীড় জমে আছে।
মৃত্যুকালে
তার বয়স হয়েছিল প্রায় বাহাত্তুর বছর। দরগাহের সব ইস্টিকুটুম এসে তাকে গোসল করান
এবং শেষযাত্রার সবকাজ এন্তেজাম করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন