সিলেট শাখার কিছু বিচ্ছিন্ন কাহিনি
টেকনিক্যাল
শাখায় কোন এক ভুইয়া ক্যাশিয়ার বিদ্যুৎবিলে বসে বেশ নয়ছয় করে চাকুরী হারায়। এই
ঘটনার জেরে এবার কঠোর নির্দেশ আসে বিদ্যুৎ বিলে ক্যাশিয়ারের সাথে একজন অফিসারের
যৌথ স্বাক্ষর লাগবে। আমাকে অফিসার স্বাক্ষর দিতে বিদ্যুৎবিল কাউন্টারে পাঠানো হল।
বিদ্যুৎবিল গ্রহন করেন সিনিয়র ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক শফিউল্লাহ। শফিউল্লাহ
কঠোর পরিশ্রম করে তিন সন্থানকে সরকারী মেডিকেলে পড়িয়ে ডাক্তার করেন। শফিউল্লার
কন্ঠে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার রম্য মিষ্টিরস লেগেই থাকত। শফিউল্লাহ হেসে হেসে
নোয়াখালী অঞ্চলের মজার মজার গল্প শুনাতেন, তার গল্প শুনে হাসতে হাসতে আমাদের গলে
ব্যাথা হয়ে যেত। তার বলা নোয়াখালীর বাপবেটার একটি গল্প আপনাদেরকে শুনানোর ইচ্ছে
আমি আটকিয়ে রাখতে পারলামনা।
বাপ- কি রে মোফজ্জিল্যা, তুই নাকি পরীক্ষায় হেল (ফেল)
কইচ্ছস? বেটা- হ’বাবা।
বাপ- তো কিয়ে কিয়ে হেল কইচ্ছস?
বেটা- ইংরেজি,
ইতিহাস আর হিডি (পিটি)।
বাপ-
ইংরেজিতে হেল কইচ্ছস কিল্লাই?
বেটা-
বাজান, স্যার আরে অশালীন প্রশ্ন কইচ্ছে, স্যার আরে কয় ইংরেজি কর- ‘তোমার মা রহিম
মিয়ার লগে ঘুরতে যায়’। আই কইছি আর মা অত খারাপ
ন, যে পরপুরুষের সাথে ঘুইত্যে যাইব। তাই কইছি এর উত্তর আই দিতে পাইত্তাম ন।
বাপ-
ইতিহাসে হেল কইচ্ছস কিল্লাই?
বেটা- বাবা,
স্যার আরে প্রশ্ন কইচ্ছে, হানিপথের (পানিপথ) যুদ্ধ কিল্লাই হইছে? আই কইছি স্থলপথে
সুবিধা কইত্তে হারে (পারে) ন, এইল্লাই হানিপথের যুদ্ধ হইছে। স্যার আরে কোন নম্বর
দেয় ন।
বাপ- হিডিতে
(পিটি) হেল কইচ্ছস কিল্লাই, হিডি তে তো হাত পাও নাড়া-চাড়া দিলেই হাশ (পাশ) করন
যায়।
বেটা- স্যার
আরে কয় ডান হাত তূল। আই তুলছি। এরহর কয় বাম হাত তূল। আই তুলছি। এরহর কয় ডান পা তূল। আই তুলছি। এরহর কয় বাম পা
তূল। আই কইলাম স্যার চাইর হাত পা তুলি দি আই কি আর সোনার (লিঙ্গ) উপর খারাইতামনি।
স্যার আরে একখান থাপ্পড় দি ক্লাস থন বাইর করি দিল।
বাপ- আইচ্ছা
বুইজ্জি, আর কিসে কিসে হেল কইচ্ছস?
বেটা- অংক
আর বাংলা।
বাপ- অংকে
আবার হেল কইচ্ছস কিল্লাই?
বেটা- বাবা
আরে অসাধু ব্যবসার অংক প্রশ্ন কইচ্ছে। স্যার আরে কয় ২০টাকা দরে ১০ লিটার দুধ কিনে
৩লিটার পানি মিশিয়ে আবার ২০ টাকা দরে বিক্রি করলে কত লাভ অইব, আই কইছি এই ব্যবসা
আর বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্টির কেউ করে ন। আই ও চুরিবিদ্যার অংক কইত্তাম ন।
বাপ- বাংলায়
আবার হেল কইচ্ছিস কিল্লাই? বাংলা তো আংগো মাতৃভাষা। বেটা- বাবা, পাঁজি স্যারে আরে
বাংলা নয়, ডাক্তারী প্রশ্ন কইচ্ছে। স্যারে কয়, লিঙ্গ পরিবর্তন কর? বললাম আরে
আল্লাহ একটামাত্র দিছে, আই হারি (পারি) ন। আন্নেরটা পরিবইত্তন কইত্তে হাইরবেন
(পারবেন) নি? স্যার আর জওয়াব শুনে আরে পাছায় একটা লাথি দি
বাইর করি দেয়।
বাপ- আরে
মোফজ্জিল্যা, আই তরে আর এই ফাজিল্যা স্যারদের স্কুলে রাইকতাম ন। নতুন একখান ইস্কুল
দেইখ্যা ল।
গল্প শুনে
আমি শফিউল্লাহকে বললাম, তোমাদের নোয়াখালী মুল্লুকে যেমন বাপ তেমন বেটা তেমনি
স্কুলের স্যার। সবাই সমানে সমান, একই সমতল।
শফিউল্লাহ চাকুরি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বিপদে পড়েন। একটি বিদ্যুৎ বিলের টাকা বিলকপিসহ বছর
দেড়েক আগে উদাও হয়ে গিয়েছিল। শফিউল্লাহর
চাকুরি যায় যায় অবস্থা। তখন তার
তিনটি সন্থান সরকারী মেডিকেলে পড়ছে। তিনি এই ছোট চাকুরি দিয়ে পরিবার চালানোর সাথে
মেধাবী বাচ্ছাদের পড়ার খরচ জুগাতে হিমহিস খাচ্ছিলেন। আমি তখন বরইকান্দি শাখার
ব্যবস্থাপক। আমার পিছু নিলেন তিনি, আমি এই তিনজন মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্রের কথা
বিবেচনা করে তখনকার ডি এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর পত্নী ভাতিজি রিপাকে এক
বাদসন্ধ্যার ফোন করলাম। যে করনেই হোক শক্ত মানুষ আব্দুল হালিম সাহেবের মনে দয়া হয়। সামান্য
শাস্থি পেয়েই শফিউল্লাহ পারপেয়ে
যান। আসলে তার তিন মেধাবী সন্থানই এই বিপদে তার মুক্তির কারণ হল।
সিলেট শাখার
প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন কানাইঘাটের নজরুল ইসলাম। তার পূত্র অস্ট্রেলিয়ার একটি
কলেজে ভর্তি হয়। পুত্রকে স্পন্সর করতে তার হিসাবে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। নজরুল
সাহেবের মশিউর রহমান খানের সাথে আমার চেয়েও বেশী ঘনিষ্টতা ছিল। তিনি মশিউর সাহেবকে
সুপারিশ ধরলেন। এবার মশিউর সাহেব আমাকে তার টেবিলে ডেকে নিয়ে বললেন, কুরেশী সাহেব,
নজরুল সাহেবের পুত্র মানে আমাদের পুত্র, সে বিদেশে ভর্তি হয়ে গেছে। আপনি নজরুল
সাহেবের হিসাবে যা পারেন টাকা রাখেন। ছেলেটা ভিসা পেয়ে গেলে ফিরিয়ে নিবেন। আমি প্রায়
সাতলক্ষের মত টাকা তখনই নজরুল সাহেবের হিসাবে স্থানান্তর করে দেই। একদিন নজরুল
সাহেব এসে বললেন, কুরেশী সাহেব আমার ছেলে ঢাকা হতে ফোন করে বলেছে তার ভিসা হয়ে
গেছে, আপনার টাকাটা ফিরিয়ে নিন। আমি বললাম আপনি এত তাড়াহুড়া কেন করছেন। আর কিছুদিন
দেখে সবকাজ শেষ হলে ফেরত দিবেন। তিনচার
দিন যেতে না যেতেই অস্ট্রেলিয়ান এম্বেসির একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার হিসাবটি পরীক্ষা
করতে ব্যাংকে এসে হাজির হয়। লোকটা চলে গেলে আমি নজরুল সাহেবকে বললাম, আপনার কথামত
আমি টাকাটা সরিয়ে নিলে কি অঘটন না ঘটে যেত।
২০০৩ সালের
এক কালোসন্ধ্যায় আমার অফিস সিলেট শাখার রিমিটেন্স গাড়ি কদমতলী শাখা হতে টাকা নিয়ে
ফেরার পথে ডাকাতির শিকার হয়। ডাকাতরা শাহজালাল সেতুর সামনে তাদের গাড়ি থামিয়ে
ব্যাংকের জিপের গতিরোধ করে। সরল ড্রাইভার মজনুমিয়া হতচকিত হয়ে গাড়ি ব্রেক করে।
গাড়িতে দায়িত্বরত বুড়ো তালপাতার সিপাই গার্ড মুজম্মিল আলী ও আমানত আলী কিছু বুঝে
উঠার আগেই ডাকাতরা তাদের বন্ধুক কেড়ে নেয়। এই রিমিটেন্স টিমের নেতৃত্বে ছিলেন
কর্মচারি ইউনিয়নের নেতা ক্যাশিয়ার জি এম আতাহার হোসেন। নগদ প্রায় সাড়ে তেইশ লক্ষ
টাকা ডাকাতরা কেড়ে নিয়ে কারে করে পালিয়ে যায়। পুলিশ সাথে সাথে তৎপর হয়ে তেতলি ইউনিয়নের
চেয়ারম্যান উসমান মিয়ার বাড়ি হতে পাঁচ লাখ টাকা উদ্ধার করে। পরদিন ডাকাতির কাজে
ব্যবহৃত কদমতলীর কমিশনার আশিক মিয়ার গাড়ি ওসমানীনগর উপজেলার একটি গ্রাম হতে পুলিশ
উদ্ধার করে। বাকী সাড়ে সতের লক্ষ টাকার কোন হদিস পুলিশ বের করতে পারেনি।
কদমতলী
শাখার ক্যাশিয়ার ছিলেন সৈয়দ ফয়জুর রহমান, সেইদিন তিনি সুরমা নদী পার হয়ে বাসায়
আসতে গিয়ে রিমিটেন্স গাড়িতে উঠে ভীষন বিপদে পড়েন। পুলিশ তাকে সন্দেহের তালিকায়
ফেলে জেলে প্রেরন করে। তিনি অযথা অনেকদিন জেল খাটেন। অবশেষে আমরা সবাই চাঁদা তুলে
প্রচুর টাকা খরচ করে তাকে জেল হতে মুক্ত করি। আমি তাকে মুক্ত করার ফান্ডে পাঁচ
হাজার টাকা প্রদান করি।
আমার বাসার
তিনবাসা পিছনে এম এ মান্নান স্যার আমার সাথে একই সময়ে বাসা নির্মান করেন।
অকালমৃত্যুর শিকার তার ছোট্ট প্রানপ্রিয় কন্যাটির নামে বাসাটির নাম রাখেন তাবাসসুম
ভিলা। মান্নান স্যার বাসাটির নির্মানকাজ সমাধা করে নতুন বাসায় ডুকামাত্রই ঢাকার
নয়াপল্টন শাখায় তার বদলির আদেশ আসে। অনেক কাটখড় পুড়িয়ে বাসাটি নির্মান করে একমাসও
এখানে তার থাকা হলনা। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে তিনি সিলেট শাখা হতে রিলিজ হন।
সিলেটের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মিরা তাকে এক জমকালো বিদায় সম্বর্ধনা দিলেন। নুতন
ব্যবস্থাপক হয়ে আসেন আমার মহিলা কলেজ শাখার সাবেক বস ফরিদ উদ্দিন। ফরিদ স্যারের
সাথে সিলেট শাখায় আমি এবার মাত্র এক সাপ্তাহ অবস্থান করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন