শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, দরগাগেইট শাখা, সিলেটঃ

 

পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, দরগাগেইট শাখা, সিলেটঃ

অবস্থান কালঃ ৮ মার্চ ২০০৪ সাল হতে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সাল।

অবস্থানঃ ১ বৎসর ১১ মাস ২০দিন

 

কিছুদিন আগে সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান আইনুল হক ভূইয়া আমাকে তার অফিসে তলব করেন। আমি একই ভবনের চারতলায় তার চেম্বারে গেলে তিনি আমাকে তার সামনে বসান। তিনি আমার কাছে জানতে চান আমি কতদিন যাবত সিলেট শাখায় আছি। আমি হিসাব করে যখন বললাম প্রায় সাড়ে আট বছর, তখন তিনি জিহবায় কামড় বসিয়ে বললেন এত দীর্ঘ্যদিন একই শাখায় আপনি কেমন করে আছেন? আমি বললাম কেমন করে আছি তাতো আমার জানা নেই। তবে আমাকে এতদিন বদলি করা হয় নাই বলেই সম্ভবতঃ এখানে পড়ে আছি।

এবার আইনুল হক ভূইয়া স্যার বললেন আপনাকে এখন অফিস বদলাতে হবে। বলুন তো আপনাকে কোথায় দেব? স্টেডিয়াম, মহিলা কলেজ, নাকি দরগা গেইট শাখায়জবাবে বললাম মহিলা কলেজ শাখায় আমি ইতিপুর্বে কাজ করেছি, কাজেই অন্য যে কোন একটি শাখায় আমাকে পাঠিয়ে দিলে ভাল হয়আসলে সুদীর্ঘ্যকাল একই অফিসে কাজ করে করে  আমার কেমন যেন একঘেয়ে লাগছিল। আচমকা এই পরিবর্তনের আভাস পেয়ে তাই আমি বেশ উৎফুল্লই হলাম।

বদলীর আদেশ আসতে তেমন দেরী হলনা। আমার দীর্ঘ্যদিনের প্রিয় বস এম এ মান্নান স্যার সাপ্তাহখানেক আগে বিদায় নিয়েছেন। এবার আমার বিদায়ের পালা। সাড়ে আট বছর কাজ করে কোন আনুষ্টানিকতা ছাড়াই ৭মার্চ ২০০৪ তারিখে সিলেট শাখা ছাড়লাম। সিলেট শাখার মত একটা মস্তবড় শাখায় একজন সিনিয়র অফিসারের গুরুত্বইবা কতটুকু তদুপরি আমার বিগবস মান্নান স্যারও সদ্য চলে গেছেন। নতুন বস ফরিদ স্যার নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।

মনে হল আমি এতদিন সিলেট শাখা নামক একটি হাতির পিঠে একজন মাছি হয়ে উড়াউড়ি করেছি। এই মাছি হাতিটার গাঁয়ে বসলে কিংবা উড়ে গেলে হাতির কিছুই যায় আসেনা। তাই আমার বিদায়ে এখানে তেমন কোন সাড়াশব্দ হলনা, আমাকে নিয়ে এককাঁপ চা পানেও কেউ বসল না। ভাবটা এমন দীর্ঘ্যদিনের ছাপোষা ইসফাক কুরেশী এখানে থাকলেই কি, গেলেই কি। সাড়ে আট বছর আগে একদিন এই শাখায় নিরবে এসেছিলাম, আবার নিরবেই চলে গেলাম।

বিদায়ের শেষদিনে এই শাখার একে একে সবকটি টেবিলের সামনে গিয়ে  বসলাম। প্রতিটি ব্যস্ত সহকর্মি বিদায়ের ব্যথা বুকে নিয়ে আমাকে শুভ কামনা জানালেন। সবার সাথে বিদায়ের হাত মিলানোর আবর্তন করে বিকেলে ধীর পদক্ষেপে একটা সালাম দিয়ে ব্যবস্থাপক ফরিদ উদ্দিন স্যারের চেম্বারে ডুকলাম। স্যারের মনটা ভাল, তিনি আমাকে কিছু উপদেশ দিলেনবললেন, কুরেশী সাহেব এই ব্যাংকের পরিচালকরা অনেকে আপনার আত্মীয়স্বজন। আপনি এমন কোন আচরন করবেন না যাতে কেউ মনে করে আপনি অযথা প্রভাব খাটাচ্ছেন। তাকে বললাম, আমি এই ব্যাংকে আমার ব্যক্তিগত কাজে কোনদিন কোন আত্মীয়ের ধারকাছে যাইনি, কাউকে বলিনি ব্যাংকের মালিকরা আমার কাছের কোন লোক হন। ফরিদ স্যার বললেন দেখেন আমরা পরিচালকদের কাছের লোক, কাজেই আমাদেরকে অন্যদের চেয়ে বেশি কাজ করতে হবে। তিনি আমার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করে হাত মিলায়ে বিদায় জানান।

মার্চ ২০০৪ সাল। সকাল ৯টা হবার খানিক আগে আমার সাদা কার নিয়ে দরগাগেইট শাখায় হাজির হলাম। এখানে সামনে কার পার্কিংয়ের জায়গা আছে, এই সুবিধা গ্রহনের সুযোগ ট্রাফিক জ্যামের জনাকীর্ন সিলেট শাখায় ছিলনা। সেখানে বন্দরবাজারে খুব দরকার ছাড়া কখনও কার নিয়ে ঢুকতাম না। এখানে আম্বরখানা ও চৌহাট্টার তীব্র ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে মাঝে মাঝে সাগরদিঘীরপার হতে এসে গাড়ী দরগার মিনারের কাছে লককরে রেখে একটু হেটে অফিসে হাজির হতাম।

এখানে শাখা প্রধান সহকারী মহাব্যবস্থাপক নিশীত চৌধুরীর কাছে যোগদান পত্র দাখিল করলাম। শীর্ণকায়া নিশীত স্যার একজন দক্ষ ঋন বিশারদ। তার সাথে ইতিপূর্বে সিলেট শাখায় কাজ করেছি। তিনি বেশ কয়েক বছর সিলেট শাখার অগ্রীম বিভাগের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। দুইনম্বর টেবিলে ছিলেন চৌধুরীবাজার শাখার প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াহিদ যার অনুপ্রেরণায় আমি একজন পুবালীয়ান হই তিনি মৌলভীবাজার শহরের শান্তিবাগের লোক। তিননম্বর টেবিলে বসে আছেন ইতিপূর্বে সিলেট শাখার বৈদেশিক বিনিময় বিভাগের সহকর্মি খলিল ভাই

ঋন বিভাগে পাই আব্দুল ওয়াহাবকে যিনি পরিশ্রমী লোক কিন্তু কথায় কথায় রেগে যান। তার সাথে অনেকে কথা বলতে ভয় পেত। তার হৃদরোগ ছিল ও কিছুদিন আগে ওপেনহার্ট সার্জারি হয়। তাই আমরা ধরে নিতাম এই রোগই তার এই গরম আচরনের আসল কারন। তাই আমরা তাকে কখনও রাগাতে চাইতাম না

আমাকে চেকপাস ও চেকিংয়ের টেবিলে বসানো হয়। এখানে এসে আবার রীনা দিদিকে ডানপাশের চেয়ারে প্রতিবেশী হিসাবে পাই। তিনি ডিডি, টিটি, এমটি, পিও এসব করতেন। আমার বামপাশে ছিল ক্যাশ কাউন্টার, সেখানে ক্যাশপ্রধান ছিলেন আব্দুল হাকিম। তিনি বগুড়ার লোক ও কট্টর আওয়ামী লিগার। নিঃসন্তান হাকিম সাহেব বেঁটে ও সৎ লোক। তিনি চোখে চশমা দিতেন এবং পাজামা পাঞ্জাবী পরে অফিস করতেন।

দরগাগেইট শাখায়ও কাজের যথেষ্ট চাপ ছিল। এখানে যোগদানের কিছুদিন পর আমি অফিস চলাকালে প্রায়ই পেঠে বেশ ব্যথা অনুভব করতাম। দুপুরে সামনের বনফুল হতে কিছু একটা ফাস্টফুড খেয়ে নিতাম। তাও আবার বিকেল সাড়ে তিনটার আগে খাওয়া সম্ভব হতনা। সিলেট শাখার ফেলে আসা চেয়ারেও ছিল প্রচন্ড চাপ। সেখানেও কাস্টমারের চাপে অনেক দেরীতে দুপুরের খাবার খেয়ে জোহর ও আসরের নামাজ  একত্রে পড়তামতখন প্রতিদিন বিকেলে ঘাড়ব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরতাম। বিগত কয়েক বছরের অফিসের কাজের চাপ, টেনশন ও খাবারের বিশৃংখলায় আমার পরিপাকযন্ত্রে গোপনে গ্যাস্ট্রিক রোগ সৃষ্টি করে

কোন এক শুক্রবার আমার সমন্দি আজিজ ভাই ও ভাবী সিলেট আসেন। তারা মিরাবাজারের সুপ্রীম হোটেলে উঠেন। আমি দুইদিন তাদের সাথে অবস্থান করি। তাদের পাজেরো গাড়িতে এই দুইদিন সিলেটের নানাস্থানে ঘুরাফেরা করি। আমরা হোটেলে খাই ও প্রতিরাতে চাইনিজে যাই। তারা ঢাকায় ফেরার পরদিন হতে আমার কালো মল হতে থাকে। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান হাইকমোডে এই কালো মল পর্য্যবেক্ষণ করে নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাঃ আব্দাল মিয়ার সাথে আলোচনা করলে তিনি অতিসত্বর বিশেষঞ্জ চিকিৎসক দেখাতে পরামর্শ দেন।

এবার আমাদের সাঘরদীঘিরপারের অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলাম ভাইয়ের কাছে ছুটে যাই। তিনি এন্ডসস্কপি করার নির্দেশ দেন। আমি সিলেট ডায়গনেষ্টিকে এই প্রথম এন্ডসস্কপি করতে যাই। চিকিৎসক যখন ক্যামেরা লাগানো লম্বানল মুখগহ্বর দিয়ে পরিপাকতন্ত্রে ঠেলে ঠেলে ঢুকান তখন ভীষন কাশী আসে ও দুইচোখ দিয়ে অনবরতঃ জল ঝরতে থাকে। তিনচার ফুট পরিমান নল আমার পরিপাকতন্ত্রে ঢুকে যায়। মনে হল রোগ আমাকে যতটা কষ্ট দিয়াছে তারচেয়ে বেশী কষ্ট দিচ্ছে এই পরীক্ষা দশ পনের মিনিটের এই অসহ্য পরীক্ষা শেষ হলে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। ডাঃ নাজমুল ভাই আমাকে গ্যাষ্টিকের কোর্স করান এবং তরল খাবার গ্রহনের পরামর্শ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমি সম্পুর্ন ভাল হয়ে যাই, তারপর আজ পর্যন্ত আর কোনদিন আমার গ্যাষ্টিক সমস্যা হয়নি।     

কবির আহমদ চৌধুরী ক্যাশে কাজ করত। সে একদিন পঞ্চাশ হাজার টাকা সর্ট খায়। সেদিন অনেক খোজাখোজি করেও এই টাকার কোন খবর বেরুলনা। মনে হল এই টাকা ভুলবশতঃ কাউকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়ে গেছে। অথচ ভাউচার ও খাতাপত্র পরীক্ষা করে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কোন লোকটার হাতে টাকাটা গেছে। কবিরের ব্যাংক হিসাবেও কোন টাকা নেই। আমি সেদিন দরগাগেইট শাখার ক্যাশ মিলাতে বিপদগ্রস্ত কবিরকে এই সম পরিমান টাকা ধার দিলাম। পরদিন অফিসে এসে কাজের মহিলা ঝাড়ু দেওয়ার সময় দুই টেবিলের চিকন ফাঁকে এই পঞ্চাশ হাজার টাকার ভান্ডিলটির সন্ধান পেয়ে যায়। কবির ছিল তৎকালীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরীর ফুফুত ভাই, পরদিন এম ডি স্যার ফোন করে তাকে ক্যাশ কাউন্টার হতে অব্যাহতি দেন। এই কবির বেশ কয়েক বছর পর আমার পত্নীর মামাতো বোন এলিন আপার মেয়েকে বিয়ে করে সংসার হয়

এই শাখায় এসে ফখরুল ইসলামকে সহকর্ম হিসাবে পাই। সে এই ব্যাংকের সাবেক ডি জি এম আব্দুল মজিদ স্যারের একমাত্র পুত্র, তার বাসা আমার বাসার পাশে সুবিধবাজার। বিনয়ে বৈষ্ণব ফখরুল আমাকে বলল, কুরেশী স্যার একটি ব্যবসা আছে করবেন? বললাম কিসের ব্যবসা? সে বলল সি এন জি ব্যবসা। বললাম, প্রফিট কেমন? সে বলল আমিও করছি, লাভ বেশ ভাল।

অল্পবয়সী হাজী ফখরুল ইসলাম কিছুদিন আগে আমাদের চৌকিদেখি শাখা হতে বদলি হয়ে এখানে আসে। ফখরুলের পরামর্শে এবার তাকে নিয়ে চৌকিদেখি শাখার নিচে উত্তরা মটরস অফিসে গিয়ে আমি দুইটি সি এন জি বেবিটেক্সি বুকিং দেই। এই বুকিংয়ে একলক্ষ করে দুটি দুইলক্ষ টাকার পে-অর্ডার জমা দেই। তিনচার মাসের মধ্যে একজন লোক আমাকে ফোন করে জানালো আপনার গাড়ি দুটি এসে গেছে। ফখরুলকে জানালে সে আখতার নামের একজন সি এন জি দালালকে ডেকে আনে। গাড়ি দুটি একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে বিক্রি করি, এই দুইটি গাড়ি বিক্রিতে লাভ হয় বাহাত্তুর হাজার টাকা। হিসাব করে দেখলাম একটি গাড়িতে প্রতিলক্ষ টাকা তিনচার মাস খাটায়ে লাভ হয় ছত্রিশ হাজার টাকা।

প্রতি মাসে একবার মাত্র তিনচার দিন সি এন জি বুকিং হত। এবার উত্তরা মটরসের কর্মিদের সাথে বন্ধুত্ব করে প্রতিবার একসাথে চারটি করে গাড়ি বুকিং দিতাম। আমি এইসব কোন গাড়িই কোনদিন চোখে দেখিনি, কেবল সিলেটে পৌছামাত্রই দালাল মারফত কাগজে সই দিয়ে বিক্রি করে দিতাম। একবার প্রচন্ড চাহিদা তৈরী হলে প্রতিটি গাড়িতে পয়ষট্টি হাজার টাকা করেও লাভ করিপ্রায় দুই বৎসর এই ব্যবসা পরিচালনা করে  প্রচুর মুনাফা আমার হাতে আসে

১১ জানুয়ারি ২০০৭ সাল। সেনাবাহিনীর সমর্থনে ফখরুদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেন। ১-১১ এর পর সি এন জি ব্যবসা আইন পরিবর্তন হয়ে যায়, মাসের সবদিন উত্তরা মটরসে গাড়ি বুকিং আরম্ভ হয় এবং সিলেট অঞ্চলে নুতন গাড়ির লাইসেন্স প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। এসব কারণে এই ব্যবসায় লাভ তখন একদম তলানীতে নেমে যায়। এমতাবস্থায় আমি শেষমেশ এই ব্যবসা হতে  নিজেকে দ্রুত গুটিয়ে নেই।       

সে সময় আমার আম্মা এবং আব্বা প্রায়ই সাগরদিঘিরপার আমার বাসায় অবস্থান করতেন। আমি তাদের কক্ষে এয়ারকন্ডিশন মেশিন লাগিয়ে দেই। তারা শহরে ও গ্রামে পর্যায়ক্রমে দুইস্থানেই বসবাস করতেন। আম্মার ছিল তখন নানা প্রকার রোগ ইনসুলিন নির্ভর ডায়বেটিস তো ছিলই, সেইসাথে পায়ে ব্যথা, গাঁয়ে গরম লাগা, খাদ্যে অরুচি, পা ফোলা, বমির ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি। কিছুদিন পরপর তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করতে হত। তবে দুই তিন দিনের মধ্যে ভাল হয়ে ফিরে আসতেন।

একবার তার এক দারুন সমস্যা হয়, তিনি কিছু খাইলেই বমি হয়ে বেরিয়ে আসে। সে সাথে তীব্র কাশীর যন্ত্রনায় গলে ব্যথা হয়ে যায়। খাদ্য পেটে না থাকায় তিনি ভীষন দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি অসুস্থ হলেই আমরা ফোন করে আমার অগ্রজা মান্নাকে রনকেলী হতে ডেকে আনতাম। এই ছোটবোন  কাছে থাকলে আম্মাও বেশ স্বাচ্ছন্ধবোধ করতেন। এইবার সেফওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করার পর আমার পত্নীর স্যার অধ্যাপক আব্দুর রকিব  তার চিকিৎসা করেন। এন্টিবায়টিক গ্রহনের পরও তার রোগ আর জটিল আকার ধারন করে। এমন কি বমি হয়ে ঔষধও বেরিয়ে আসে। এবার তার জীবন সংশয় দেখা দেয়। রাতে বাসায় ফিরে আমার ঘুম হলনা। সারারাত ঘরে পায়চারি করে ভোর রাতে চোখে ঘুম আসে। ডাঃ নুরজাহান ও আমি  সিন্ধান্ত নিলাম, তাকে আর সিলেটে রাখা যাবেনা।

রোগীকে নিয়ে ঢাকা যাবার জন্য বিমানের চারটি টিকেট করি। সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ নুরজাহানের ফুফুতো ভাই ডাঃ আহমেদুর রেজা চৌধুরী  সিলেট বিমানবন্দরের রানওয়েতে তার বিশেষ এম্বুলেন্স যোগে রূগীকে বিমানে তুলে দেন। রোগীর সাথে ছুটলাম আমি, অগ্রজা মান্না ও ডাঃ নুরজাহান। বিমানে আরোহণ করেই আমাদের পুবালী ব্যাংকের দুইজন পরিচালককে সামনের সিটে বসা পাই। তাদের একজন তুড়ুকখলার মনির আহমদ এবং অন্যজন ভাদেশ্বরের মনির আহমদ। আজিজ ভাই একটি এম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা বিমানবন্দর হতে আমাদেরকে বারডেম হাসপাতালে পৌছে দেন। তারা সাথে সাথে রুগিকে ভর্তি করে দেয়। সব ধরনের টেস্ট করে চিকিৎসা শুরু হওয়ামাত্র তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু হয়। সিলেটে তার ঔষধে রিএকশন হয়, ঢাকায় ঔষধ বদলে দেয়। চিকিৎসা সমাপ্ত হলে তিনি পুরাপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠেন এবং আমরা তাকে নিয়ে সিলেট ফেরে আসি।

পরদিন অফিসে ডুকে আমার সিটে বসামাত্র এক অভাবনীয় কান্ড ঘটে। ব্যবস্থাপক নিশীত চৌধুরী খুব রেগেমেগে এসে আমার সামনে দাঁড়ান। আমার দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি ছুটি ছাটা না নিয়ে এতদিন কোথায় ছিলেন? জানেন আমি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। আমারও ভীষণ রাগ হল, বললাম, আপনি জানেন আমার মা মরনাপন্ন, আমি তাকে নিয়ে ঢাকা গেছি। আমার বস হিসাবে আপনার উচিত ছিল প্রথমে আমার মা কেমন আছেন খবর নেয়া। তার বদলে আপনি আমাকে চার্জ করতে আসছেন। আপনি যা খুশি করে ফেলেন। হালিম সাহেব, মান্নান সাহেবের মত বড়মাপের লোকদের সাথে আমি কাজ করেছি, তারা কেউ কোনদিন আমাকে কিছু বলেননি, আর আপনি আমাকে ভয় দেখাতে আসছেন। তারপর আর কোন কথা না বলে নিশীত স্যার সোজা তার চেম্বারে গিয়ে আরাম কেদারায় বসে পড়েন।

পরদিন হতে বুঝতে পারলাম নিশীত স্যার আমাকে খুশি করতে যেন আপ্রা চেষ্টা করছেন। একদিন আমাকে স্যার বললেন, কুরেশী সাহেব আপনার কার নিয়ে একবার কালিবাড়ি চলেন। আমি তাকে নিয়ে কালিবাড়ির পাহাড়ে নির্মিত একটি নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় যাই। সেখানে তার কেনা সুন্দর প্লটটি দেখে আসি। এই প্লটগুলোতে স্থাপিত মালিকানা সাইনবোর্ড পড়ে দেখলাম সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। নিশীত স্যার এখানে বাসা নির্মা করেন। অবসর গ্রহণের পর এই বাসায় তিনি সুখের বসতি গড়ে তুলেন। তার একমাত্র মেধাবী পুত্রটি বুয়েট পাশ করে স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।

জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির অনেক হিসাব ছিল এই দরগাগেইট শাখায়। এখানে তাদের চাকুরিজীবিদের বেতন হিসাবও ছিল। নিশীত স্যারের সাথে ডিপোজিট সংগ্রহ করতে একবার আমি উপশহরের সম্মুখে তাদের প্রধান কার্যালয়ে যাই। আমরা জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আতিকুর রহমানের সাথে তার অফিসে গিয়ে দেখা করি। আমি ব্যাংকের বিভিন্ন কাজে বেশ কয়েকবার ইঞ্জিনিয়ার আতিকুর রহমান সাহেবের কাছে যাইতার সাথে ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলে একদিন আমি তাকে আমার ছোট ভাই নিশাত কুরেশীকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করি। তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চাইলে বললাম, অর্থনীতিতে বি এস এস (অনার্স), এম এস এস। একটি ফাস্ট ক্লাস, বাকী সব সেকেন্ড ক্লাস। নিশাত তখন মদ মোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগে সামান্য বেতনে অস্থায়ী লেকচারার হিসাবে চাকুরি করত। আমি এম ডি কে বললাম আমার ভাই বেকার থেকে থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তিনি বললেন তার মাথায় কি কোন পাগলামি সমস্যা আছে। আমি বললাম না, না, সমস্যা তেমনটি নেই, এটা দীর্ঘদিন বেকার থাকার অসহনীয় দুশ্চিন্তার ফল, বেকারত্বের হতাশা হতে এমনটি হচ্ছে।

একদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিক সাহেব আমাকে ফোন করে বললেন আমরা ছয়জন কো-অর্ডিনেইটিং অফিসার (সি ও) নেবো। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে আপনার ছোটভাইকে আবেদন করতে বলুন। সিলেট প্রধান ডাকঘরে একটি আবেদন বক্স বসানো হয়, সেখানে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হল পরে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্টিত হয়। এই পরীক্ষায় নিশাত সকল প্রার্থির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে সি ও পদে নিয়োগপত্র লাভ করে।

তবে এজন্য অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে এই চুড়ান্ত নিয়োগ ১-১১ সংঘটিত হবার পুর্বক্ষনে ৪ জানুয়ারী ২০০৭ সালে সম্পন্ন হয়। আমি তখন রনকেলী গ্রামের বোনের বাড়ি হতে গাড়ি চালিয়ে সিলেটে ফিরছিলামএমন সময় মোবাইল ফোনটি বেজে ঊঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম জালালাবাদ গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুর রহমান সাহেবের কল। তিনি আমাকে শুভ সংবাদ জানিয়ে বললেন আপনার ছোটভাই নিশাত কুরেশীর চাকুরী হয়ে গেছে, আগামীকল্যই জালালাবাদ গ্যাসের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে নিয়োগপত্র সংগ্রহ করুন। আমি কৃতঞ্জতা প্রকাশ করে আনন্দের অতিশয্যে কয়েকবার ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ স্যার, বলে ফোন রেখে দিলাম।

মনে মনে ভাবলাম কোথাকার রংপুরের লোক আতিকুর রহমান সাহেব, ইনি না আমার খেস কুটুম, না দেশ কুটুম, আসলে কিছুই না। অথচ মহান আল্লাহতায়ালা তার মনে আমার প্রতি এক অকৃত্রিম ভাতৃত্ব ভাব জাগিয়ে দেন এবং তার মাধ্যমেই আমার বেকার ভাইয়ের একটি প্রথমশ্রেণীর চাকুরীর সুবন্দোবস্ত করে দেন।               

নিশীত স্যার ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত সাবধানী আদমি। তিনি ব্যাংকিং আইন কানুন খুব শক্তভাবে পরিপালনের চেষ্টা করতেন। এন্টিমানী লন্ডারিং আইন প্রয়োগের অতি কড়াকড়ি সহ্য করতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ডিপোজিট ও এডভান্স কমে আসে। মুনাফায় ভাটা পড়ে। উপরের মহলে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। ফলে দায়িত্ব গ্রহনের এক বৎসর পুর্নহবার পনের দিন আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ তারিখে  এই মর্যাদাপূর্ন বড় শাখা হতে তাকে বিদায় নিতে হয়।

নিশীত চৌধুরীর বিদায়ের পাচ সাত দিন আগে এই শাখায় এসে যোগদান করেন কর্মপাগল নিষ্টাবান আরেকজন চৌধুরী- তিনি মোহাম্মদ মোছাদ্দিক চৌধুরী। সে যুগের নির্বাহীদের কম্পিউটার জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু জেনারেল ম্যানেজার এম মোছাদ্দিক স্যার,  জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল করিম স্যার ছিলেন এর ব্যতিক্রমতাদের আইটি জ্ঞান ছিল অসাধারন। তাদের সময়ের নির্বাহীরা যখন কিবোর্ডে হাত রাখতে ভয় পেতেন সে সময়ে তারা সুদক্ষ বিশেষজ্ঞের মত সারাদিন কম্পিউটার চালাতেন। তাদের ব্যাংকিং নলেজ ছিল আপ টু ডেট।

মোছাদ্দিক স্যার বেশ স্থূলকায়া স্বল্পভাষী বুদ্ধিমান লোক। তাকে আমি কখনও রাগতে দেখিনি। তিনি সুন্নতি জীবন যাপন করতেন। তার দাড়িভর্তি গোলাকার চেহারায় সর্বদা হালকা একটা হাসির ঝলক লেগেই থাকততিনি আজানের সাথে সাথে জামাতে ছুটতেন ও সবার শেষে মসজিদ হতে বের হয়ে আসতেন। মোছাদ্দিক স্যারের আদি পরিচয় তিনি কুলাউড়া শহর সংলগ্ন মনসুর গ্রামের অধিবাসীতার আর এক পরিচয়, তিনি সিলেটের জনপ্রিয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আপন দোলাভাই, তবে তাকে কখনও কাউকে এই পরিচয় দিতে দেখিনি। মোছাদ্দিক স্যার ব্যাংকের সিলেটি চেয়ারম্যান ও পরিচালকদেরকে সুন্দরভাবে ম্যানেইজ করে অফিসের ও নিজের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিতে পারতেন।

কেউ ফাকিবাজি করে তাকে জ্বালাতন করলে বলতেন, অমুখ সাহেব, আপনার কোন কাজ করার দরকার নেই। যা কাজ আছে আমার টেবিলে ফেলে দিবেন, আমি সামাল দেবো। হ্যাঁ, তিনি সত্যিই সামাল দিতেন।  তিনি শাখা ব্যবস্থাপনার সহিত একাই অগ্রিম প্রদান ও আদায়সহ  প্রায় দুই তিন টেবিলের কাজ নিদ্বিধায় সামলাতেন। তিনি তার চেম্বার হতে বেরিয়ে ফাঁকিবাজদের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করতেন। নিচুস্বরে বলতেন আপনি আরাম করুন, আমি সবকাজ করে ফেলব। কঠিন কঠিন কাজ মোছাদ্দিক স্যারের কাছে ছিল ডাল ভাত। ব্যাংকের কোন কাজকেই তিনি ভয় পেতেন না। ফলে বড়স্যারের কাছে লজ্জা পেয়ে ফাঁকিবাজরাও ভাল হয়ে যেত। মোছাদ্দিক স্যারের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, এতবড় শাখার সব বিষয় তার মুখস্ত থাকত। শাখার সব লোকজনকে তিনি তার পরিবারের সদস্যের মত স্নেহ করতেন।

এই শাখায় আমি প্রথম টেক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টি আই এন) সংগ্রহ করি এবং এই প্রথমবারের মত ২০০৪-২০০৫ বর্ষের আয়কর প্রদান করি। তখন নুন্যতম টেক্স ছিল মাত্র ১৫০০/= টাকা। সে সময় আমি ছিলাম সিনিয়র অফিসার এবং ১৪সেপ্টেম্বর ২০০৪ তারিখে এই নুন্যতম টেক্স ১৫০০/= টাকা পরিশোধ করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করি এবং সরকারের আয়করদাতার তালিকায় প্রথম আমার নাম লিখি। এতদিন এই রাষ্ট্র হতে একতরফা আমি সীমাহীন সীমাহীন পেয়েছি। এবার এই সামান্য ১৫০০/= টাকা আয়কর পরিশোধ করে তাই মনে হল, “শৈবাল দিঘীরে বলে উচ্চ করে শির, লিখে রাখো একফোটা দিলাম শিশির”

তাই প্রথমবার দেশের একজন টেক্সদাতা হয়ে দেশের ফান্ডে সামান্য কিছু টাকা আয়কর দিতে পেরে আমি আসলেই মনে মনে বেশ আনন্দই অনুভব করলাম। এযেন এতযুগ ধরে আমাকে বিলিয়ে দেওয়া এই গরীব দেশটির একসমুদ্র দানের বিপরীতে একফোঁটা শিশির বিন্দু, যা প্রতিদান করে আজ আমি ধন্য হলাম

এই শাখায় হালিম মিয়া নামে জৈন্তার একজন বয়স্ক গার্ড ছিলেন। তিনি এখান থেকে অবসর গ্রহন করেন। হালিম মিয়া বলতেন, সিলেটের বিখ্যাত চা বাগান মালিক সুন্নত চৌধুরী মাফ না করলে তার গ্রামের একটি লোকও বেহেশতে যেতে পারবেনা। আমি তাকে বললাম কেন? সে বলল, আমাদের গ্রামের চারপাশে সুন্নত চৌধুরীর চাবাগান। আমরা তার অনুমতি ছাড়াই এসব বাগান হতে কাট, বাশ, লাকড়ি,  ঘাস, কাঠাল ইত্যাদি গোপনে নিয়ে আসি। হালিম মিয়া চাকুরী হতে অবসর গ্রহনের দিন আমাকে বললেন, স্যার আমি সাহেবের বাসায় যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন সাহেব? সে বলল- সুন্নত চৌধুরী। বললাম- কেন? বলল- ক্ষমা চাইতে। কাল থেকে আর তেমন সিলেটে আসা হবেনা। হায়াত মউতের কথাও বলা যায়না। তাই এই অতি জরুরি তওবার কাজটা আজকেই সেরে আসি। সুন্নত চৌধুরী তখন অতিশীপর বৃদ্ধবস্থায় ছিলেন। সে ফিরে আসলে বললাম, জমিদার সাহেব তোমাকে মাফ করেছেন কি? বলল, হ্যাঁ তিনি খুব ভাল মানুষ, আমার পিঠে হাত রেখে আমার সারা জীবনের সব উম্মরকাজা কবুল করে নিয়েছেন। বললাম তুমি খুশী, বলল- এবার আমি পুরাপুরি ভারমুক্ত হলাম।

আমরা তাকে তামাশা করে বললাম, ভবিষ্যত প্রয়োজনে  তোমাকে হয়ত আরও তার বাগানে ঘাস কাট সংগ্রহে ডুকতে হবে। তখন কি করবে? এবার বলল, আমি তাকে আজ বলে এসেছি- সাহেব, আমি যদি আপনার বাগানে ভবিষ্যতে কোনকিছু খুব দরকারে নেই, তাও ক্ষমা করে দিবেন। আমরা বললাম- হালিম ভাই, তুমি বড় চালাক আদমি, অনুমতিটা বুদ্ধিবলে অগ্রীম আদায় করে নিয়েছ। এবার অবসরে গিয়ে সুন্নত চৌধুরীর বাগানে অবাধে চুরি করতে তোমার আর কোন বাঁধা রইলনা এতে মরনের পর জান্নাত পেতেও কোন সমস্যা তৈরি হবেনা। সবাই বললেন- হালিম ভাই, মাথা খাটিয়ে বড় বুদ্ধিমানের কাজটি করে এসেছ তুমি। তোমাকে ধন্যবাদ।

দরগাগেইট শাখায় গার্ড হালিম মিয়ার এলাকার একজন ঋ খেলাফি গ্রাহক ছিল, যার নাম মইনুল। হালিম মিয়া বলতেন মইনুল তার এলাকার একজন সন্ত্রাসী মন্দলোক, তিনি জৈন্তা এলাকায় ময়নুলের নানা অপকর্মের কাহিনি শুনাতেন। একদিন মইনুল কিভাবে যেন বিষয়টা বুঝে ফেলে। ব্যাংকে এসেই মইনুল আগুন হয়ে হালিম মিয়াকে অশ্লীল ভাষায় আক্রম করে। এবার দানবটার ভয়ে হালিম মিয়া থমকে যান এবং সেদিন হতে মইনুলের কোন অপকীর্তি বলার সাহস তিনি সম্পুর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেন।               

৩০ ডিসেম্বর ২০০৫, দিনটি ২০০৫ সালের বাৎসরিক ব্যাংক সমাপনী দিবস। আবার এই দিনটি ছিল আমার প্রিয় সহকর্মী আব্দুল ওয়াহিদ সাহেবের চাকুরি জীবনের শেষদিন। এই অতিকঠিন কর্মব্যস্ত দিনটিতে তাঁর সহকর্মী খলিলুর রহমান ভাইয়ের খবর নেই, তিনি নাকি অসুস্থসারাদিন দুই টেবিলের কাজ একহাতে করতে করতে ক্লান্ত ওয়াহিদ সাহেব রাত ১ঘটিকার সময় বললেন, সারাজীবন পুবালী ব্যাংকের জন্য কলুর বলদের মত খাটলাম, আর আজ চাকুরি জীবনের এই শেষ দিনটিতেও সেই অমানুষিক খাটুনি দিয়েই বিদায় নিলাম। এই কর্মব্যস্ত বিদায় গৌরবের বিদায়, শেষপর্যন্ত এই গৌরব অর্জন করতে পেরে আমি সত্যিই ধন্য হলাম আমি বললাম আপনি ব্যাংকে সারাজীবন কেবল কাজের জিকির করলেন এবং এই কাজ করে করেই আজ রাত ১ঘটিকার খানিক পর শেষ কলেমা পাঠ করে করে চাকুরি জীবনের মৃত্যু ঘটালেন। জীবনে অনেক অবসান আছে, ছাত্রজীবনের অবসান, কলেজ জীবনের অবসান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অবসান, চাকুরি জীবনের অবসান, দাম্পত্য জীবনের অবসান, ঢাকা জীবনের অবসান। এভাবে একটার পর একটা অবসান বেয়ে বেয়ে একসময় এসে ঘটে যায় মানুষের জীবনাবসান। 

একজন বেঈমানের নির্লজ্জ মিথ্যাচারঃ

এক বিকেলে ক্যাশ ইন চার্জ আব্দুল হাকিম হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখেন ২০,০০০/= টাকা নেই। এবার ভাউচার খুজে পাওয়া গেল একজন গ্রাহককে তিনি ৩০০০/= টাকার স্থলে ২৩,০০০/= টাকা পরিশোধ করে ফেলছেনলোকটি চেকে অংকে লেখা ৩০০০/= এর আগে এমনভাবে ‘=’ দিয়েছে যা দেখলে মনে হয় ‘২’ফলে হাকিম সাহেব ২৩,০০০/= টাকা পরিশোধ করে দেন। চেকের পিছনে পরিশোধিত টাকার হিসাবে ৪৬টি ৫০০/= টাকার নোট অংকে ও কথায় দুভাবেই স্পষ্ট করে লিখা আছে।

এই শাখায় কর্মরত আমার ফুলবাড়ির ফুফুত বোনের ছেলে আব্দুর রব চৌধুরী সিগনেচার কার্ড এনে লোকটার ছবি দেখালে আমি তাকে ভালভাবে চিনে ফেলি। দাড়িওয়ালা মুরব্বী লোকটির বয়স ৬৫ বৎসরের কম হবেনা। তার মাথায় সব সময় টুপি থাকে এবং টেবিলে টেবিলে গিয়ে সবার সাথে গল্পকরে ভাব জমায়। এই বুড়া বৃটিশ সিটিজেন। প্রতি মাসে বৃটিশ সরকার তার হিসাবে ৫০০০/= টাকা ভাতা প্রদান করে এবং সে এসে সাথে সাথে সব টাকা তুলে নেয়। তার হিসাবটির স্থিতি সব সময়ই শূন্য থাকে।

আমি আব্দুল হাকিম সাহেবকে বললাম, স্যার একজন লম্বা দাড়িওয়ালা ফরহেজগার মুরব্বীর হাতে টাকা গেছে, ভয়ের কোন কারন নেই। টাকাটা অবশ্যই ফেরত আসবে। বললাম মনে হয় লোকটা হয়ত টাকাটা গুনে দেখে নাই, তাই ফেরত নিয়ে আসতে এত দেরী হচ্ছে

বিকেলের মধ্যে এই টাকাটা ফেরত না আসলে ক্যাশ মেলাতে সমস্যা হবে। তাই মনে হ্ল, একবার টেলিফোনে ভদ্রলোককে বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দেই, তাহলে টাকাগুলো নিয়ে মুরব্বী সাহেব ছুটে আসবেন এবার লোকটার মোবাইলে ফোন দিয়ে বললাম, সকালে আপনি যে টাকা তুলে নিয়েছেন তা কি গুণে দেখছেন। লোকটা জবাব দিল- হ্যাঁ। আমি বললাম কত টাকা নিয়েছেন? লোকটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল- কেন? আমিতো তিন হাজার টাকা নিয়েছি। সে অতিরিক্ত ২০০০০/= টাকা নিয়ে যাবার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে বসলআমরা ১০০% নিশ্চিত লোকটা ২৩,০০০/= টাকাই নিয়ে গেছে। ফোনে লোকটা খুব ব্যস্থতা দেখাতে শুরু করে। এই এত বয়সে একজন টুপিপরা দাড়িওয়ালা লন্ডনি লোক সামান্য ২০,০০০/= টাকার জন্য এইভাবে মিথ্যাচার করতে দেখে ব্যাংকের সবাই হতভম্ব হয়ে ছিঃ ছিঃ করে উঠেন, কার লোকটা যে সবার সুপরিচিত এবং তাকে একজন ভাল মানুষ হিসাবে সবাই সুধারনা পোষন করতেন  

এবার আমরা লোকটার স্থায়ী ঠিকানা বের করলাম, সে বাদাঘাটের কাছে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার কালারুকার লোক। আমাদের সামনে বসা কিছু কাস্টমার বললেন, এই এলাকার লোকজন খুব বাজে প্রকৃতির হয়। আমি বললাম, কোন একটি জায়গার সব লোকজন যে খারাপ প্রকৃতির হবে এই ধারনায় আমি বিশ্বাসী নই। সব জায়গায়ই যেমন ভাল লোক আছে, তেমনি দুইচার জন দুষ্ট প্রকৃতির লোকজনও থাকে। তারা জবাব দিল, না স্যার, এই জায়গায় একজনও ভাল লোক মেলা ভার।

এবার আবার ফোনকরে লোকটাকে এখনই ব্যাংকে আসতে বললাম। সে জবাব দিল জরুরী কাজে তার বোনের বাড়ি চলে যাচ্ছে। আমি বললাম, আপনি আসবেন কিনা বলুন, নতুবা আমরা আপনাকে পুলিশ দিয়ে ধরে আনতে বাধ্য হব। এবার সে আসতে রাজী হয় এবং ব্যাংকে ঢুকেই বেঈমানটা অতিরিক্ত ২০০০০/= টাকা নিয়ে যাবার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে বসে। আমরা ভাউচার দেখাই, হাতে নাতে দেখিয়ে দেই সে এই টাকা নিয়ে গেছে। এবার লোকটাকে নিয়ে ওয়াহাব সাহেব ও খলিল ভাই ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোছাদ্দিক চৌধুরী স্যারের চেম্বারে আলোচনায় বসলেন।

মোছাদ্দিক স্যার বললেন, দেখেন আপনার অনেক বয়স হয়ে গেছে, দুদিন পর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেনএই সামান্য টাকা খেয়ে আপনার কিছুই হবেনা। এই ক্যাশিয়ার সামান্য বেতনের চাকুরি করেন, এই টাকা দিতে তিনি আদৌ সক্ষম নন এবং কেন দিবেন। আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনিই টাকাটা নিয়ে গেছেন।

এইবার মিথ্যাবাদী এই ইতরটা বলল, খোদার কসম, আমি টাকা নেইনি। ওয়াহাব সাহেব বললেন, চাচা আল্লার নামে কসম করবেন না, আল্লাহ আপনাকে ধবংস করে দিতে পারেন। তারচেয়ে টাকাটা কিভাবে ফেরত দিবেন তাই বলুন। এইবার লোকটা বলল, আমি ব্যাংকের লাপাত্তা টাকা নেই নাই, তারপরও যেহেতু আপনারা বলছেন ক্যাশিয়ার গরিব মানুষ তাই আমি অর্ধেক দশ হাজার টাকা তাকে সাহায্য করব, বাকি অর্ধেক দশ হাজার টাকা ক্যাশিয়ার সাহেব বহন করবেন। খলিল ভাই বললেন, আচ্ছা এই দশ হাজার টাকাই এখন দেন। বাকি টাকা পরে কিভাবে দিবেন বলুন। এবার বেঈমানটা বলল আমার সাথে এখন একটাও টাকা নেই।

আমাদের ফাদে পড়ে বুড়ো ছোটলোকটা রাজী হল- প্রতিমাসে তার হিসাবে লন্ডন হতে যে পাচ হাজার টাকা জমা হয়, সেই টাকা হতে মাসে মাসে কেটে  চারমাসে ফেরত দেবেআমরা বললাম তাহলে ৫০০০/- টাকার চারটি চেক দেন। দুষ্টটা বলল, আমার সাথে চেকবহি নেই। বুড়ো দুর্জনটা পালানোর মতলবে আছে বুঝতে পেরে আমরা তার হিসাবে তখনই নুতন চেকবহি ইস্যুকরে ৫০০০/= টাকা অঙ্কের চারটি চেক আদায় করে বেঈমানটাকে বিদায় জানাই।

এইবারও সদাশয় দয়ালু আমি ইসফাক কুরেশী ক্যাশ প্রধান আব্দুল হাকিম সাহেবের বদলে ২০,০০০/= টাকা ক্যাশে জমা দিয়ে ব্যাংকের ক্যাশ সমন্বয় করে দিলাম। পরবর্তী মাসে লোকটার হিসাবে লন্ডনের ভাতা জমা হলে ৫০০০/= টাকা আদায় করলাম। বুড়া বেঈমানটার বেঈমানির কাহিনী  এখনও শেষ হয়নি। আর কাহিনী রয়ে গেছে। পরের মাসে আমরা অপেক্ষা করছি লন্ডনি ভাতা জমা হলে উঠাব কিন্তু তার হিসাবে কোন টাকা জমা হলনা। খবর নিয়ে জানলাম শয়তানটা অন্য একটি ব্যাংকে হিসাব খোলে সেখানে লন্ডনি ভাতা জমা করিয়ে তুলে নিয়েছে

এবার ফখরুলের মোটর সাইকেলে আমরা দুজন সুরমা আবাসিক এলাকায় ছুটলাম বেঈমানটার বাসায়। একটি ভাঙ্গা টিনের ভাড়া বাসায় দুই নম্বর নৌজোয়ান পত্নীকে নিয়ে বুড়োটার সংসারচা বক্সের পাতলা কাটের এক পালঙ্কে সে ঘুমায়। একটা কাটের চেয়ার সে আমাকে বসতে দিল, যেখানে বসামাত্রই চেয়ারটি ম্যাচম্যাচ করে উঠলএবারও সে আল্লার কসম দিয়ে শীঘ্রই টাকা ফেরত দেবার ওয়াদা করে আমাদেরকে বিদায় দিল।

বেশ কিছুদিন পর ফখরুলকে নিয়ে আবার লোকটার বাসায় গিয়ে দেখি দুর্জনটা নেই। বাসার মালিক বলল তারও বেশকিছু ভাড়া মেরে দিয়ে বদমায়েশটা তার যুবত বউসহ উদাও হয়ে গেছে। বাদাঘাট কালারুকা এলাকার এই ইয়া দাড়িওয়ালা লম্বা পাঞ্জাবী বেঈমান লুচ্ছা বুড়োটার নামটা আজ ভূলে গেছি কিন্তু তার নুরানী চেহারা আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। আল্লাহ যেন এই বেঈমানটার উপযুক্ত বিচার করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন