শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সিলেট শহরে বাসা নির্মান, বাকী অর্ধেক স্বপ্নপুরণ

 সিলেট শহরে বাসা নির্মান, বাকী অর্ধেক স্বপ্নপুর                                  

আট মাইল দূরের দাউদপুর গ্রাম হতে এই শহরে মা বাবার কোলে বসে আসি সেই নবজাতক আমি ল্যাংড়া ডানপায়ের চিকিৎসায়। অনেক আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এই সারাটা শহরজুড়ে। শৈশব ও কৌশরে মাবাবার সাথে এই শহরে কত যে এসেছি তার কোন পরিসংখ্যান নেই আমার হিসাবের খাতায়। এই আগমন কখনও কেনাকাটায়, কখনও চিকিৎসায়, কখনও বিয়েসাদীতে, কখনও স্বজনদর্শনে, কখনও জেয়ারতে শাহজালালের(রঃ) দরগায়। ১৯৮১ সালে এস এস সি পাশের পর হতে রাতে দাউদপুরে ঘুমালেও দিন কাটতো এই প্রিয় শহরের কর্মক্ষেত্রে কিংবা অলিগলীতে। এই শহরে আমি দিনের বেলা গ্রাম হতে আসা একজন ভাসমান প্রলেতারিয়েত ছিলাম বছরের পর বছরএখানে স্টেডিয়াম মার্কেটে একটি দোকান ছাড়া উল্লেখকরার মত কোন ব্যক্তিসম্পদ এতদিন ছিলনা আমার তাই আমার একটা আজন্ম স্বপ্ন ছিল এই স্মৃতির শহরে আমার একটি বাড়ি হবে। ইতিমধ্যে সাগরদিঘীর পারে জমি কিনে সেই স্বপ্নের অর্ধেক পুরন হল। এবার বাকী অর্ধেক স্বপ্নপুরনে একমনে বাসা নির্মানের তোড়জোড় আরম্ভ করি। 

২০০২ সালের প্রারম্ভে সাগরদিঘীরপারে বাসা নির্মানের জন্য আমি পুবালী ব্যাংকের কাছে স্টাফ গৃহনির্মান ঋন আবেদন করি। প্রধান কার্য্যালয় হতে ৬% সরল সুদে ছয় লক্ষ টাকার গৃহনির্মান ঋন পাস হয়। হাতে জমা ছিল ডাঃ নুরজাহানের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত আড়াই লক্ষ টাকা। মোঠ সাড়ে আট লক্ষ টাকা নিয়ে ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাকী অর্ধেক স্বপ্নপুরনে কাজে নেমে পড়ি।

আমি সিবিল টেকনোলজিতে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, আমার প্রজেক্ট ছিল গৃহনির্মাণ। আমি খুব সুন্দর একটি ডুপ্লেক্স বাসার ডিজাইন করি। আমার সহপাঠিদেরকে বাসার এই ডিজাইন দেখালে তারা বলল, তুমি এত বড় দুতলাব্যাপী ডুপ্লেক্স দিয়ে কি করবে। তোমার পরিবারে লোক মাত্র তিনজন, সারাটা বাসায় এতকক্ষ জনশূন্য পড়ে থাকবে। কেবল দুতলাতেই ২১৫০ বর্গফুটের চার বেডরুমের বড় বাসা হয়তারা উপদেশ দিল দুতলার বড়বাসাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে, অন্যদিকে নিচতলা ভাড়া দিয়ে কিছুটা বোনাস পাবারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এবার ডুপ্লেক্স বাসার চিন্তা বাদ দিয়ে চারতলা বাসার ডিজাইন করতে বসি। কয়েকদিনের ধ্যানে ও প্রচেষ্টায় বর্তমান বাসাটির একটি প্লেন ও ডিজাইন আমি তৈরী করে ফেলি। দুতলায় চার বেডরোমের প্রতিটিতে একটি করে বাথরুম ও বারান্ধা রাখলাম। ড্রয়িং ও ডাইনিং রোমদুটি সামনা সামনি সাজিয়ে বড় স্পেস রাখলাম। বাহিরের ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা, চন্দ্রিমা ও সবুজ প্রকৃতি উপভোগ করতে উত্তরপশ্চিন কোনে দুইদিলে কাঁচের গ্লাসঘেরা একটি বড় খোলাকক্ষ রেখে ভবনটি ডিজাইন করলাম।

এবার আমি জমিটির সয়েলটেস্ট করি। তিনটি বোরিং করতে প্রায় ১৫,০০০/- টাকা খরচ হয়। সয়েলটেস্টের রিজাল্ট ভাল হলনা। মাটির পজিশন খারাপ, এখানে পাইলিং করে বাসা নির্মাণ করতে হবে। 

এবার ভবনটির লোড ডিস্ট্রিবিউশন ও পিলারের স্ট্রাকচার ডিজাইনের জন্য আমার বুয়েট পাশ ভাদেশ্বরের নালীউরি গ্রামের ভাগনা ইঞ্জিনিয়ার খোকনকে খোজ করি। তিনি একটু অসুস্থ্য হওয়ায় তাকে ধরা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। একদিন তার খোঁজে ভাদেশ্বর যাই, কিন্তু তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে থাকায় ফিরে আসি। অনেক অপেক্ষার পর তাকে ধরলাম, তিনি কাজটি করে দিতে সম্মত হন। তিনি কাজটি করতে এত দীর্ঘ্যসুত্রতা শুরু করলেন যে আমার মনে হল আত্মীয়ের কাজ করে কোন লাভ হবেনা ভেবে  এমনটি করছেন। কাজটি দ্রুত করে দেওয়ার জন্য একদিন তাকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রীম পরিশোধ করলাম। অর্ধেক কাজ ভবন প্লেনিং আমার নিজহাতে করাই ছিল। শাহজালাল উপশহরে তার বাসায় দৌড়াতে দৌড়াতে আমি অবশেষে ধর্য্য হারিয়ে ফেললাম।

তখনকার সিলেট পৌরসভার সার্ভেয়ার অরবিন্দ বাবু আমার সিনিয়র ব্যাচে সিলেট পলিটেকনিক হতে সিবিল টেকনোলোজিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। এবার তিনি বাসাটির ডিজাইন তৈরী করে দিতে আমার পিছু নেন। তিনি আমাকে এমন ভাবসাব দেখালেন যে তিনি সবজান্তা। তিনি ইঞ্জিনিয়ার অলক বাবুর সাথে কাজ শিখার ও রাস্থার দুপাশের অনেক ভবন দেখিয়ে এইগুলোর ডিজাইন করার গল্প শুনাতেন। তিনি পৌরসভার জরিপবিদ তাই আমার মনে হল ভবন প্লেনটা সহজেই সেখান হতে পাস করে দিতে পারবেন। তাই প্রথমে নারাজি হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে স্ট্রাকচার ডিজাইনের সম্মতি প্রদান করি। তিনি বারবার চেয়ে চেয়ে প্রচুর পারিশ্রমিকও নেন।

তার পরামর্শে আমি প্রায় দুইলক্ষ টাকা খরচ করে পূরো প্লটে চারফুট পর পর বুরিং করে বালু পাইলিং করি। ভাগনা সেলিম পাশে বসে সেন্ড পাইলিং কাজ দেখাশুনা করেন। এই অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী, অনভিজ্ঞ ও অনাড়ি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার অরবিন্দ বাবুকে দিয়ে স্ট্রাকচার ডিজাইন করিয়ে আমি পরবর্তীকালে অবর্ণনীয় ক্ষতি ও অমানষিক টেনশনের শিকার হই। এই ক্ষতির পরিমান কোটি টাকার কম হবেনা, আমি পরে এই কোটি টাকার  হিসাব দেব। তিনি কলাম (খুটি) দেন কম ও প্রতি কলামের নিচে ছোট ছোট মাপের ভিত্তি প্লেট বসান। চারতলা ভবনের ডিজাইন পৌরসভা হতে পাশ করে এনে অরবিন্দ বাবু বললেন চাইলে এখানে পাচতলাও করা যাবে। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনচার তলা সম্পন্ন করার সময় বুঝলাম কেন আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী বলতেন, শূন্য কলসী বাজে ঝনঝন।

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার খোকনের কাছে ৫০০০/- টাকা খুইয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার অরবিন্দ বাবুর খপ্পরে পড়লাম। অনেক কাটখড় পুড়িয়ে ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে অরবিন্দ বাবু এসে লে আঊট করলেন। লে আউট শেষ হলে ঈশানকোনে খুটির ভিত্তির মাটিকেটে প্যায়ার ঢালাই দিয়ে একদিন নির্মানকাজের সুচনা করা হল। এইদিন বাসায় কিছু শিন্নী তৈরী করে আল্লাহের সন্তুষ্টির জন্য বিতরণ করা হল।

একজন ঠিকাদারকে এগিয়ে দিলেন আমার আরেক পলিটেকনিক সহপাঠি নিতাই পাল। এই ঠিকাদারের বাড়ি গাইবান্ধা, নাম লিটন মিয়াকালো হালকা পাতলা লোকটা ভীষন তুষামুদে ধরনের মাথানিচু করে কথায় কথায় স্যার স্যার বলে কান ঝালাপালা করে ফেলত। সে কখনও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতনা। লিটন মিয়া একদিন আমার বাসায় আসলে ডাঃ নুরজাহান তাকে দেখে বললেন এই কি একটা লিকলিকে লোককে কাজ দিয়েছে তাকে দেখেই আমার ইয়াকিন আসছেনা। এই তৈলবাজ লোকটা- কথায় সে বড় ছিল, তবে কাজে তত নয়হয়ত এই ভবনের ঠিকাদারীই ছিল তার জীবনের প্রথম নির্মান কাজ। সাগরদিঘীরপারে একদিন একজন বয়স্ক লোক এই ঠিকাদারকে দেখে মারমুখী হয়ে তেড়ে এসে বললেন এই লোকটা আমার অর্ধেক কাজ করে অনেক টাকা অগ্রীম নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তিনি আমাকে সাবধান করে বললেন, আপনি একজন ভদ্রলোক নিশ্চয় এই লোকটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না, আপনি চুক্তির বাহিরে এই লোকটাকে একটা টাকাও অগ্রীম দিবেন না। অগ্রীম টাকা পকেটে নিয়ে যেতে পারলেই সে কাজ ফেলে পালিয়ে যাবে।

আমার গ্রামের ঠিকাদার রবুল মিয়া আমার ফুফুত ভাইদের অনেক ভবন নির্মাণ করেন। তিনি আমাদের গ্রামের শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাবেনতাদেরকে ভালমন্দ কিছু বলা যাবেনা ভেবে আমি এই অভিঞ্জ ও দক্ষ ঠিকাদারকে বাতিল করে দেই। পরবর্তীকালে বুঝলাম আমার এই সিন্ধান্ত আসলে আদৌ ঠিক হয়নি।

নির্মান কাজের সুচনালগ্নে নজরুলকে প্রহরী নিয়োগ করি। সে সাচান গ্রামের লোক। একদিন রাতে সামনের বাসার একজন ড্রাইভার তার উপর হাত উঠায়। তার মোবাইল কল পেয়ে আমি ও নিশাত হাজির হলে ছাত্রলিগ নেতা সেলিম বিষয়টি নিস্পত্তি করে দেন। ড্রাইভারটি এসে দোষ স্বীকার করে আমাদের কাছে ক্ষমা চায়। তবে একটি কথা বলতেই হয় এই অন্যায়কারী ড্রাইভারের প্রভূ তজম্মুল আলী এই দুষ্ট ড্রাইভারেরই পক্ষাবলম্বন  করেন।

২০০৩ সাল প্রথম ঢালাইয়ের দিন আমার শ্বাশুড়িমা জীবিত ছিলেন। তিনি জরি ও সেনরাকে নিয়ে ঢালাই কাজের শ্রমিকদের জন্য আখনি পোলাও রান্না করেন। দ্বিতীয় তলা ঢালাইয়ের আগেই তিনি মারা যান। কন্যা ডাঃ নুরজাহানের বাসা খুব দ্রুতই নির্মিত হল কিন্তু সামান্য কয়েকটি দিনের জন্য তার বাবামা কেউই দেখে যেতে পারলেন না।

দ্বিতীয় তলা ঢালাইয়ের রড বসানোর সময় একদিন বিকেলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে কাজ পর্যবেক্ষন করছি। হঠাৎ চিৎকার শুনে সিড়িঘর হতে চেয়ে দেখি শ্রমিকেরা রড টানাটানির সময় একটি রড সামনের ৩৩০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ লাইনে লাগিয়ে দেনতিনজন শ্রমিক ভীষণভাবে আহত হনতবে ভাগ্য ভাল রডটি সাথে সাথে ছুটে আসে, নইলে উপরের রডের জালে কর্মরত অনেক শ্রমিক বিদ্যুতে জড়িয়ে মারা পড়তেন। আমি এই তিনজন শ্রমিককে আমার কারে তুলে নিয়ে পাশের ওসমানী মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাই। তারা চিকিৎসা করে প্রচুর ঔষধ লিখে দেয়। আমি ওদের ট্রিটমেন্ট সহ কয়েকদিনের সমুদয় খরচ বহন করি।

একদিন দ্বিতীয় তলা ঢালাই হল। এবার লিটন মিয়া ভীষণ উৎপাত শুরু করল। দুইতলার ইটের গাঁথুনী দেওয়ার সাথে সাথে চুক্তির সব টাকা সে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় বললে ভূল হবে দিয়ে দিতে বাধ্য করেআমি শ্রমিকদেরকে প্রদানের জন্য টাকা দেই, কিন্তু সে শ্রমিকদেরকে পরিশোধ না করে নিয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে শ্রমিকরা কাজে আসেনা, প্রায়ই কাজ বন্ধ থাকে। তাকে বললে আর টাকা চেয়ে বসেলোকটা এমন যে তাকে বকাবকি করলেও মাথা নিচু করে হাসে। চুক্তির অতিরিক্ত অনেক টাকা নিয়ে যায়, অথচ তাকে দিয়ে আস্তরের কাজ করানো অসম্ভব হয়ে পড়েএবার দেখলাম লোকটা পালানো শুরু করেছে। আমি তাকে ডাকি, সে পালায়। তার বাসা পর্যন্ত যাই, কিন্তু আসছি আসছি করে আসেনা। দেখলাম কাজ শুরুলগ্নের সেই মারমুখী মুরব্বির কথাই সত্যে পরিত হল।

এবার আমি চাপাইনওয়াবগঞ্জের কয়েকজন মিস্ত্রিকে রোজদরে কাজে নিয়োগ করিতারা কাজ করতে থাকেন। আমাকে নির্মানকাজে সহায়তা করার মত কোন স্বজন ছিলেন না। ব্যাংকের পরিশ্রমের কাজ করে সাথে এইকাজ তদারকি করা বেশ কঠিনই ছিল। মান্নান স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে অফিসে একটু আগে ছুটি দিতেন। বিকেলে শেষবেলা এসে আমি প্রতিদিন নির্মাণকাজ তদারকি করতাম। এভাবে বেশ কষ্ট করে নিচতলা পুরো খোলা রেখেই কেবল দ্বিতীয় তলার ব্রিকওয়াল ও আস্তরের কাজ করি।

ঢালাইকাজে মাচাং নির্মাণে যে বাশ ও কাট ভাড়া করা হয় তাকে বলা হয় সাটারিং। সুবিদবাজারের সুরমা সাটারিং হতে প্রতি বর্গফুট ১০টাকা দরে কাট বাশ ভাড়া করি। সুরমা সাটারিংয়ের আসনে বসা টোকেরবাজারের মৎস্যজীবী শ্রেণির বেঁটে লোকটা ছিল বেশ গুন্ডা প্রকৃতির। সে আমার পুর্বে ভাড়া করা অন্য একজন ননসিলেটি লোকের সাটারিংয়ের সব মালামাল জুরে কেড়ে নিয়ে যায়। এই আচরনে অতীষ্ঠ হয়ে আমি নিচতলা তার মালামাল দিয়ে ঢালাই করে উপরের তলায় তার মাল ব্যবহার করিনি। এই লোকটা একসময় শহরে কাঁধে ভার বয়ে ডিম বিক্রি করত। লোকে বলে এখন সাটারিং ব্যবসা করে একটু আধটু টাকা পয়সা হয়ে এই ছিন্নমূলটার গোপনাঙ্গে চুল গজিয়েছে। তিনচার মাস পরই এই লোকটা অন্য একটি বাসায় এধরনের আচরণ করে পিটুনি খায় ও জেলে যায়।

অবশেষে আম্বরখানার অন্য একটি দোকান আমাকে ৮ টাকা ফুটদরে দুতলা ঢালাইয়ের জন্য সাটারিং সরবরাহ করে, ফলে প্রতি বর্গফুটে আমার ২টাকা করে লাভ হয়।

একটি ভবন নির্মাণে নানা ধরনের মানুষের দেখা মেলে। সবাই আসে যত সম্ভব ঠকাতে। এখানে নিজেকে খুব কৌশলে আত্মরক্ষা করে কাজ সেরে নিতে হয়। এখানে খুব বেতমিজ লোকও মিঠামুখে এসে কাজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পরে খুব ঝামেলা তৈরি করে। আমার টালি বসানোর কাজে চুক্তিবদ্ধ হয় এমনই একটা দুষ্টলোক। সে আওয়ামী লীগ নেতা মিছবাহ উদ্দিন সিরাজের ছোটভাই। ছোটখাট ফর্সা লোকটা কয়েকদিন আমার পিছুপিছু হেটে অনেক মিষ্টি মধুর কথা বলে টালির কাজের ঠিকাদারী নেয়। কাজ শেষ হওয়ামাত্রই সে তার আসল বিশ্রী চেহারাটা প্রকাশ করে। এই চক্ষুপুড়াটা কাজ মাপতে এসে আমার সামনে ফিতা টেনে খাতায় ইচ্ছেমত ১০ ফুটকে  ১৪ ফুট, ১৫ ফুটকে ২০ ফুট লিখে হিসাবের খাতায় কাজের ক্ষেত্রফল দেড়গু্ণ পার করে দেয়। এই বজ্জাতটা প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা দরে কাজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ শেষে ১৩ টাকা দরে বিল তৈরী করে পেমেন্ট নিতে আসে। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের দাপট দেখিয়ে সে মাস্তানী আরম্ভ করে। তার এই গুন্ডামী আচার আচরণে শেষ পর্যন্ত আমি একটি বিচার সভা ডাকতে বাধ্য হই

সাক্ষি প্রমাণ সবই আমার অনুকুলে, তারপরও সবাই আমাকে কানে কানে বলল, আপনি ভূলক্রমে মানবমলে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখন যতই নাড়াচাড়া করবেন ততই গাঁয়ে পচামল লাগবে ও দুর্গন্ধ বেরুবেতাই এই শয়তানটাকে লামসাম কিছু একটা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করে দিন

খুব দ্রুতই আমার হাতের সমুদয় টাকা নিঃশেষ হয়ে আসে। কয়েকটি দোকানে ও লোকের কাছে বেশ ঋণ হয়। এবার টাকার অভাবে নির্মাণকাজ বন্ধ হবার উপক্রম হলে জিন্দাবাজার ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে গিয়ে দুরাত্মীয় রনকেলী বড়বাড়ির ইমানী চৌধুরীর স্মরণাপন্ন হই। ব্যবস্থাপক ইমানী চৌধুরী আমার পরিচয় জানতে পেরে সাথে সাথে ৩৬ কিস্থিতে ১,৫৫,০০০/- টাকার একটি ক্রেতাঋ্ণ বরাদ্ধ করে দেন। আজ অবধি আমি জীবনে কোনদিন পুবালী ব্যাংকের স্টাফ ঋণ ছাড়া আর কোন ঋণ গ্রহণ করিনি। এম এ মান্নান স্যারকে ঋণটির জামিনদার হতে অনুরোধ করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন, তবে আমি বলামাত্রই জামিনদার হয়ে যান সহকর্মী ভাগনা মশিউর রহমান খান, যিনি বর্তমানে ডিজিএম, পুবালী ব্যাংক লিমিটেড।

এই ক্রেতাঋণটি গ্রহণকালে আমার মরযাত্রী শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরীর মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি যে দুইলক্ষ টাকা জমি বিক্রি করে তার স্নেহের কন্যাকে দান করেছিলেন। সেই দুইলক্ষ টাকা ফেরত দিতে না হলে আজ আমার এই ব্যাংক ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হতনা।

আমার চিকিৎসক বেগম সাহেবা বলতেন মানুষ গৃহ নির্মা্ণ করলে তার ব্লাডপ্রেসার হয়ে যায়। তিনি বাসা নির্মাণকাজে লিপ্ত অনেক লোককে অসুস্থ্য হয়ে যেতে দেখেছেন। আমার ব্লাডপ্রেসার কিংবা ডায়বেটিস কিছু একটা না হলেও বাসা নির্মাণের নানা ধরনের কাজের আলাদা আলাদা টিম ওয়ার্কের চাপ এসে একাকী আমার ঘাঢ়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক কাজ, গ্রীলের কাজ, কাটের কাজ, সেনিটেশন কাজ, টালির কাজ, রঙ্গের কাজ, গ্যাসের কাজ- এসব কাজে নিযুক্তদের একটিমাত্র উদ্দেশ্য থাকে কিভাবে ঠকিয়ে পকেট ভারী করা যায়, নিম্নমানের মালামাল দিয়ে নিম্নমানের কাজ করে যতবেশী সম্ভব টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়। এসব লোটেরার দল ভাল ও নিরীহ মানুষ পেলে কখনো তুষামুদি করে, কখনও মাস্তানি করে, আবার কখনও চুরিচুট্টামি ধান্ধাবাজি করেও তাদের স্বার্থ হাসিল করে নিতে তৎপর থাকে।

এই সব ধরনের প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে প্রায় নয় মাসে দুতলার নির্মাকাজ সমাপ্ত হয়, যদিও নিচতলা খোলা ছিল। নুতন বাসায় উঠতে ২০০৩ সালের ২৯ আগস্ট আমার সাত বছরের বসতি ৪৬, কাজলশাহের বাসা ছাড়লাম। সিভিল সার্জন ডাঃ আহমদুর রেজা চৌধুরী তাঁর অফিসের একটি ছোট্ট ট্রাক ও লোকজন পাঠিয়ে নতুন বাসায় মালামাল পরিবহনে সাহায্য করলেন। 

বাসা উদ্ভোধনের দিন বাড়ি হতে আসেন আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী। আমার লন্ডনফেরত ভাগ্নী পপি আসুস্থ্য থাকায় আমার মাতা আসমতুন্নেছা আসতে পারেননি, পপিকে দেখতে ফেঞ্ছুগঞ্জ সার কারখানায় চলে যান। পালঙ্গ ফিটিং শেষ না হওয়ায় আমরা নুতন বাসার মেঝেতে বিছানা পেতে একসাথে ঘুমাই। কাজের মেয়ে জরি ও সেনরা আমাদের সাথে নতুন বাসায় আসে। আল্লাহর অমূল্য দান, আমার একমাত্র সন্থান জেফারের নামে বাসাটির নাম রাখলাম ‘জেফার ভবন’আমার মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী তার নাতির নামে বাসার এই নামকরণ মহানন্দে সমর্থন করলেন। 

বাদ মাগরিব মেঝে কাপড় বিছিয়ে এক মিলাদ মাহফিল করি। সামনের অনেক লোকজন ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন যোগদেন। আমাদের মনে তখন এক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। নুতন বাসার সুচনাসন্ধ্যায় ডাঃ আহমেদুর রেজা ভাইয়ের বউ রুবি ভারী একটি বড় রজনীগন্ধার তূড়া উপহার পাঠান। এই রজনীগন্ধা বাসায় সারারাত মৌ মৌ সুগন্ধ ছড়ায়। ২৯ আগস্ট ২০০৩, সিলেট শহরে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিজবাসায় শুয়ে বারবার বিরামহীনভাবে কেবল জপলাম- শোকর আলহামদুলিল্লাহ্‌, শোকর আলহামদুলিল্লাহ্‌।

এই বাসা নির্মাণকালে পাশে আমার চাচাত আঞ্জীর ভাইয়ের বাসা কুরেশী ভবনে উঠে প্রায়ই চানাস্তা করতাম। নিকটে থাকা কানিহাটির ফুফুত অহিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে গল্প করতাম। অহিদ ভাই বলতেন তোমার বাসাটি হয়ে গেলে ছোটমামুর সাথে এসে দারুন আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্ত বাসাটি নির্মান হবার আগেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি চিরবিদায় গ্রহন করেন। আমার ফুলবাড়ির আরেক ফুফুত ভাই মেজর ডাঃ রুকন উদ্দিন চৌধুরী সারুফ ভাই তার কর্মক্ষেত্র রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে আসা যাবার পথে গাড়ি থামিয়ে প্রায়ই আলাপ করতেন। তিনি এখানে আমার পাশে জমিও কিনতে চেয়েছিলেন। তাকে নিয়ে আমি শামিম সাহেবের বাসায়ও গিয়েছিলাম।

২০০৪ সালে খালেদা জিয়া সরকারের অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে তিনি প্রচুর টাকাসহ তাঁর এক সময়ের সহকর্মী প্রধানমন্ত্রীর ভাই মেজর সাইদ ইস্কান্দরের সাথে ঢাকায় দেখা করতে যান। সেখান থেকে তিনি চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান। খুবসম্ভব এই সহজ সরল নিরাপরাধ ভাল মানুষটি সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্ট নামক অপকর্মের একজন অন্যায় শিকারে পরিত হন। যে সেনাবাহিনীতে তিনি সারাজীবন কাজ করেন, সম্ভবতঃ সেই বাহিনীর হাতেই তিনি নাই হন। জানিনা বাংলাদেশে বিভিন্ন বাহিনি কতৃক বিনা বিচারে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা আর কতদিন চলবে। তার বিধবাপত্নী ও দুই চিকিৎসক কন্যা আজও তাঁর খোঁজে পথপানে চেয়ে আছেন। আমার বৃদ্ধ ফুফু সফিয়া খাতুন তখন জীবিত ছিলেন না তাই পুত্রশোকে হাহুতাশ করে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে জীবন থেকে বিদায় নিতে হয়নি তাকে তার বড়ভাই ডঃ সদরউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন শা বি প্রি বি এর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেন্সেলার।         

তিন বছর আগে পিরেরবাজারে কেনা একটি জমি ২০০৪ সালে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশী দামে বিক্রি করি। এই লাভের টাকা দিয়ে বাসার নিচতলার কাজ সমাপ্ত করি। তিন বেড তিন বাথের ফ্লাটটি প্রথম ভাড়া দিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ি, ভাড়া নিয়ে ভাড়াটিয়ারা এখানে মাদকাশক্তি নিরামিয়কেন্দ্র খোলে বসে, যাহা আমাদের জন্য ছিল খুবই বিরক্তকর। তবে মহান আল্লাহ আমাকে উদ্ধার করেন। মাসদেড়েক পর তারা পাড়ার ছেলেদের সাথে মারদাঙ্গা করে বসে। এবার আমার অনুমতি ও সহায়তা নিয়ে পাড়াবাসী তাদেরকে তাড়িয়ে দেন।

পরবর্তী ভাড়াটিয়া হয়ে ঢুকেন এক লন্ডনি নবদম্পতি। ভাড়া চাইলে একদিন আমাদেরকে রাতের ডিনারে দাওয়াত দেয়। দাওয়াত খেয়ে আমি বেগম সাহেবাকে বললাম, এই নিমন্ত্রণের মানেটা কি? এরচেয়ে অনেক ঢের ভাল খাবার আমরা বাসায় খাই। পরদিন মানেটা টাহর করলাম, তারা দুইমাসের ভাড়া পরিশোধ না করেই লন্ডনযাত্রা করতে সিলেট বিমানবন্দরে চলে যান লন্ডনি দম্পতিকে তাদের যে আত্মীয় দোলাভাই বাসাটি ভাড়া করে দেন, তাকে ডেকে আনিতিনি এসে তার শালী দম্পতির দুইমাসের ভাড়া পরিশোধ করেন। তারপর আমার সহপাঠি পুবালী ব্যাংকের ডি জি এম মাহবুব আহমদকে ভাড়া দেই। তিনি পরবর্তী কয়েক বছর ধরে সপরিবারে এখানে অবস্থান করছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন