কনিষ্ঠভ্রাতা চিরঞ্জীব চৌধুরী মিল্লাতুর রহমান
কুরেশির অকালপ্রয়াণ
১৯৭৭ সাল
আমার জীবনের এক ঘটনাবহুল বছর। সেই বছরের
৭ই জানুয়ারি আমার ছোটভাই মিল্লাতুর রহমান চৌধুরীর জন্ম হয়। দুধসাদা ছিল
তার গায়ের রঙ এবং মুখটা গোলাকার। সময়ের সাথে সাথে সুন্দর এক বেহেশতি চেহারা ফুটে
উঠে তার আবয়বে। সময়ের আগে আগেই সে হাঁটাখেলা ও দু চারটা
বাক্যবলা শিখে ফেলে। সে ভাঙা ভাঙা গলায় আম্মা, আব্বা, ভাই ইত্যাদি কিছু
শব্দ উচ্চারণ করত। সবাই ভাবতেন বড় হয়ে সে সুন্দর হবে, খুব বুদ্ধিমান হবে।
কিন্তু সবার আশায় গুড়ে বালি, সে খুব একটা
বেশিদিন বাঁচেনি, এযেন
সকালের অফিসটাইম ফুল, ফুটলো, জয় করল, সৌরভ বিলায়ে জীবনকে
উপভোগ না করেই অবেলায় রিক্তহাতে ঝরে গেল। মৃত্যুকালে কোন উন্নত চিকিৎসা
তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। তাঁর অকাল বিদায়ের ঘটনাটি খুবই করুণ,
মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক।
আমার
জন্মের পর আমাদের পরিবারের ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ঘটনা মিল্লাতের অকাল মৃত্যু। ১৯৭৮ সালের
২রা জুলাই সকাল ১১ ঘটিকায়
আমার ছোটভাই মিল্লাত মাত্র দেড় বছর পৃথিবীতে তার ছোট্ট জীবনকাল কাটিয়ে আল্লাহর
সান্নিধ্যে চলে যায়। ১৯৭৭ সালের ৭ম জানুয়ারি এই শিশুটি আমাদের এক তীব্র আর্থিক
সংকটকালে জন্মগ্রহণ
করে। জন্মের পরক্ষণে
চেয়ারম্যান ভোটের ঝামেলা শুরু হয়। আম্মা সারাদিন ব্যস্ত ভোটের চানাস্তায়। তাই
জন্মের পর বোন সেহা ও মান্নার কোলে তার দিন কাটে। এর মধ্যে সেহার বিয়ে হয়ে গেলে সে
তার আদর হারায়। আমরা আজীবন আমাদের পোষা গাইয়ের দুধ খেয়েছি, অথচ ভোটের খরচ বহনে দশ
বারটি গরুই বিক্রি হয়ে যায়। তারপর বোন সেহার বিয়ের খরচ এসে পড়ে, এযেন মরার উপর
খড়ার ঘা। জমি বিক্রি করাও বেশ কঠিন কাজ, কারণ
আমাদের সব জমি ভোগদখলে থাকলেও যৌথসম্পত্তি, বাপচাচাদের মধ্যে কোন রেজিস্টার্ড বাটুয়ারানামা নেই। কেউ একজন আপত্তি দিলেই ক্রেতা পালায়। দড়ারবন্দের ধুপাকোনায় বাড়ি
বানাতে মাঝপাড়ার পঙ্কি আলী আমাদের জমি কিনতে গিয়ে কয়েক হাজার টাকা আব্বাকে অগ্রিম দেয়। বাড়ির কেউ তাকে ভয় দেখালে পরদিন এসে এই টাকা
ফেরত নেওয়ার জন্য আব্বার দুই পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। মুরব্বীর কান্নায়
বিরক্ত হয়ে আব্বা ছাদের টিনে রাখা সব টাকা এনে ফেরত দেন। এমন এক
কষ্টকর অভাবের দিনে জন্ম নেওয়া মিল্লাতকে মায়ের দুধ
খেয়েই বাঁচতে হয়। আম্মা মুখে আলু কিংবা কদু পুরে দিলে চপচপ করে খেয়ে নিত। তখন অভাবের এক তীব্র দহনে সব
পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। তবে চাল ডাল
তরিতরকারির অভাব ছিল না। সব আমাদের ক্ষেতে ও বাড়িতে পর্যাপ্ত উৎপাদন হত। সামনের বড়পুকুর ও পিছনের ছোট পুকুরে প্রচুর মাছ হত।
কিন্তু নগদ টাকার তীব্র টানপোড়ন
ছিল।
ছোটমামা শহিদ চৌধুরী আমাকে একটি
সাইকেল উপহার দেন। লাতুর ট্রেনে বেশ কষ্টে সাইকেলটি পাতারিয়া হতে দাউদপুর নিয়ে
আসি। আমি নতুন সাইকেল চালান শিখেছি, বাড়ির উঠোনে এই সাইকেল চালাতে গেলে পিছনে ধরে নতুন হাঁটতে শেখা মিল্লাত লটকে যেত, ধমক দিলে কান্না জুড়ে
দিত। আমি তার কান্না থামাতে কোলে তোলে
বুকে জড়িয়ে নিতাম, সাথে সাথে তার কান্না থেমে যেত। এই গোলমুখ গোলাপ বরণ শিশুটি ছিল যেমন সুন্দর তেমনি বুদ্ধিমান। ছোট আপা
মান্না আলনা, বিছানা সাজিয়ে রাখলে
সে কাপড় এলোমেলো করে এসে তার সামনে হাসতো, আপা
রাগ করলে সে আনন্দ পেত ও হাসাহাসি করতো।
পাশের ঘরের ভাবীর সাথে তামাসা করা যায়, তাও সে এতটুকুন বয়সে বুঝতে পারত। তারা আসলে
সে দরজা বন্ধ করে উড়কা লাগিয়ে দিত।
ভাবী জানালা দিয়ে বলতেন- চাচি, আপনার মিল্লাত দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, দরজাটা খোলে দিন। সে তখন
খিলখিল করে হাসতো।
এই অতি বুদ্ধিমান শিশুটির
একদিন জ্বর হয়। তিনচার দিন পর হৃদকম্পন দেখা দেয়। আব্বা তাগাপড়া এনে গলে বেঁধে
দেন। তার চিন্তায় আম্মার ঘুম নেই। চাচাত ভাই ডাঃ এন এ
চৌধুরী গোলাম নবি চিকিৎসা দেন, কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আসলে নিউমুনিয়া ধীরে ধীরে বিপদজনক অবস্থায় চলে
যায়। তার বুকে এত হৃদকম্পন হয় যে সে কাঁদতেও পারছিল না। সে অবিরাম ঘামছিল।
তার মৃত্যুর আগের দিন দুপুরে ছাতক পেপারমিল হতে মেজবোন সেহা আসেন। তার সামনে আমি মুখফসকে বলে ফেলি- মিল্লাত মনে হয় আর বাঁচবে না।
আমার এই অলক্ষি কথা শুনে আপা আমাকে একটা শক্ত ধমক দেন। সারারাত মিল্লাত তীব্র মৃত্যুযন্ত্রনায় ভোগে। পরদিন সকালে তার বুকটা উপরের
দিকে বারবার ফোলে ফোলে উঠানামা করতে থাকে।
সকালে আম্মা একবার বললেন, আমার মিলাদ মনে হয় আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। সকাল ১১ ঘটিকায় তাঁর
শ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে ধীরে থেমে
আসে, দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তাঁর লালফর্সা কপালে জমেছিল বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা। সেই
ছোট্ট লাশ দেখে ভাবি এতো শিশু নয়, পুরো পৃথিবীটা যেন আমার সমুখে বরফ হয়ে ঘুমিয়ে
আছে। এ যেন স্বর্গশিশু, এই অভাব অনটন যন্ত্রণার পৃথিবী তাঁর বাড়ি হতে পারেনা। তাই
এই অনিশ্চিত অশান্ত দুনিয়া হতে মুক্ত হয়ে সে তাঁর আপন ঠিকানা স্বর্গালোকে পারি
দিয়েছে।
আম্মা মাটিতে বসে এতই কান্নাকাটি করছিলেন যে কেউই তাকে সান্তনা দিতে
পারছিল না। চাচি আজিমা খাতুন এসে বললেন, ওগো রেহার মা, এত কাঁদছ কেন? অল্প বয়সে মারা যাওয়া শিশুরা মা-বাবার জন্য নাজাতের উছিলা হয়। এই একটামাত্র ছেলেকে আল্লাহর কাছে রেখেছ, সে আখেরাতে তুমার নাজাতের উছিলা হবে। চাচির এই ভবিষ্যৎবানী আম্মা
মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলেন এবং এই ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁকে পুত্রশোকে ধর্য্যধারণ করতে
বেশ সহায়তা করে।
আমার অগ্রজা মান্নার ক্রন্দনে
বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে উঠে। তার আবদার আমার গোলমুখী ভাইরে এনে দাও, আমার চান্দমুখী
ভাইরে এনে দাও। আমার আব্বা একজন অতি ধর্য্যশীল মহামানব। তাকে আমি জীবনে কখনো
ধর্য্য হারাতে দেখিনি। কঠিন বিপদেও তিনি পাহাড়ের মত অটল থাকতেন। তিনি নিজহাতে
পুত্রকে গোসল দেন, কাফন পরান। কাফন জড়ান পুত্রকে কোলে
করে মসজিদে নিয়ে যান ও জানাজা শেষে
নিজহাতে তাঁকে আমাদের পারিবারিক কবরগাহের ছোট্ট কবরে ঘুম পাড়িয়ে দেন। মিল্লাতের অকালমৃত্যুর
পর বহুদিন পর্যন্ত আম্মা
তার ছোট ছোট কাপড়-চোপড়, খেলনা জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। আমরা এই বাচ্চাটির ছোট কবরে একটি জবাফুল গাছ লাগাই। ঐ গাছে বহুদিন প্রচুর লালজবা ফুটতো। আমরা ওদিক দিয়ে গেলে আম্মা এই ফুলগাছের দিকে তাকিয়ে বলতেন এখানে আমার মিলাদ
ঘুমিয়ে আছে।
আসলে মিল্লাতের যথাযত চিকিৎসা হয়নি। সেকালে এত ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিলনা। প্রথমে জ্বর হয় এবং পরে এই জ্বর নিমুনিয়ায় পরিণত হয়। নিম্যুনিয়া বেশ
কয়েকদিনে ধীরে ধীরে তাঁকে মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে
যায়। যথাসময়ে সিলেটে নিয়ে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা দিলে হয়ত সেরে
যেত। কিন্তু সেই সময়ের আর্থিক দূরাবস্থা ও সমাজে বিদ্যমান অমোঘ নিয়তিবাদের প্রভাব
তাকে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ দেয়নি। প্রথমে হুজুরদের তাগাপড়া, তারপর
চৌধুরীবাজারের হোমিওপ্যাথি পুরিয়া এবং সবশেষে চাচাতো ভাই ডাঃ গোলাম নবি ভাইয়ের
এলোপ্যাথিক চিকিৎসা। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফুসফুসে তীব্র সংক্রমণ
শ্বাসকষ্টে রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে সে একটু আধটু কান্নাকাটি করলেও পরে প্রবল বুকমারের
কারণে কাঁদতেও পারেনি। চোখের সামনে আজও তাঁর এই রোগকষ্ট ও অকালমৃত্যুর ছবি ভেসে
উঠলে বুকটা হাহাকার করে উঠে। আমি তখন অস্টম শ্রেণিতে পড়োয়া একজন বার-তের বছরের বালক
মাত্র, দুই চার বার বলেছি মিল্লাতকে সিলেটে নেওয়া উচিত কিন্তু বড়রা তেমন মনে করেন
নি। তাই যা হবার তা ঘটেই গেল। এক অপার সম্ভাবনাময় জীবন বিকশিত না হয়েই কলিকালে
ঝরে গেল। হয়ত এযুগে জন্ম নিলে তাঁকে এভাবে অকালে বিনে চিকিৎসায় মরতে
হতনা।
অস্টম শ্রেণিতে তখন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্ন মুকুল’ শিরোনামে একটি
কবিতা ছিল। আমি বারবার এই কবিতা পড়তাম এবং মিল্লাতের মৃত্যুর পর অনুভব করি এই
কবিতার বানী আমাদের ঘর ও সংসারে যেন একদম বাস্তব হয়ে গেছে। এই দুঃখের হাহাকার
প্রায় বছর দিন জারি ছিল সরবে নীরবে। কবিতাটি আমি এখানে উদ্ধৃত করলাম।
ছিন্ন মুকুল
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।
সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সবচেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।
হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা
সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
মিল্লাতের অকালমৃত্যুর পর সবার
স্নেহ এসে পড়ে অনুজ নিশাতের উপর। শৈশবে নিশাতের একটি সমস্যা দেখা দেয়। হঠাৎ মাটিতে পড়ে বেহুশ হয়ে যেত। একদিন আমাদের পশ্চিম ভিটের পাকঘরে পিড়েতে বসা ছিল, আচমকা পড়ে গিয়ে বেহুশ
হয়ে যায়। বাড়ির সবাই জমে যান। অনেকক্ষণ
মাথায় পানি ঢালার পর তাঁর
হুশ ফিরে আসে। যাক বড় হবার সাথে সাথে এই রোগের পরিসমাপ্তি ঘটে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন