স্মৃতির পালে দেয় দোলা, আমার সেই হাইস্কুলের হিরন্ময়
বেলা
বিদ্যালয়ের
নামঃ রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়, মোগলাবাজার, রেঙ্গা, দক্ষিণসুরমা, সিলেট।
অবস্থানঃ
জানুয়ারি ১৯৭৬ হতে মার্চ ১৯৮১ সাল
যষ্ট শ্রেণি ১৯৭৬ সালঃ
সেই অপরূপ সুন্দর সকালটির কথা আজও আমার মনে আছে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতের সকাল। সেদিন সূর্যটা কুয়াশার বুকচুরে মুখ মেলে নরম আলো ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বাড়ির সুপারি গাছের মসৃণ পাতাগুলো থেকে পিছলে পড়ছিল রোদের সোনারঙ। আম কাটাল লিচু নারকেলের পত্রগুলো শীতের কোয়াশা ঝরা রোদে ঝিকিমিকি করছিল। সামনের রবিশস্যের মাঠে হাসছিল সরিষা মুলা টমেটো হলিফা ও বাখরের ফুল। শত শত সুপারির গাছের আগায় ঝুলছিল থোকা থোকা পরিপক্ষ সুপারীর ছড়ি। তখন কাছাকাছি বয়সের আমরা দুই ভাইবোনের মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে যাবার আয়োজন চলে। সকাল হতে মা ব্যস্ত তার দুই আদরের সন্তান আজ দেড় মাইল দুরের বড় স্কুলে যাবে। দুই বছর আগে এই পরিবারের আমার খালাতো ভাই তারেক এই স্কুলে ভর্তি হন। তারও আগে আমার বড় দুই বোন রেহা, সেহা ও ভাই তাহমিদ এই স্কুল পার হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে আমার অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরী যখন এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে এইস্কুল ছাড়েন, তখন আমি ও আমার অগ্রজা আনিছা মৌলা বেগম মান্না গিয়ে ভর্তি হই।
শৈশবে আব্বার
কর্মক্ষেত্র এই স্কুলটিতে বহুবার গিয়েছি। কখনো বোনদের
সাথে বিশেষ বিশেষ দিবসে, কখনো নানাবাড়ির ট্রেন ধরতে আসা যাওয়ার পথে এখানে যাত্রাবিরতি
দিয়ে ক্লান্ত আমরা বিশ্রাম নিয়েছি। বড়বোন রেহার বান্ধবী
তাপসী দিদি, শারিকোন আপাসহ অনেকের কোলে উঠে দুষ্টামি করেছি।
স্কুলটির ইংরেজি শিক্ষক আমার আব্বা সফিকুর রহমান
চৌধুরী। লোকে তাকে বলত দলুমিয়া স্যার। প্রাইমারি স্কুলের
স্যারদের শিক্ষক, অনেকের বাবার শিক্ষক, কারো দাদার শিক্ষক, তাই তাঁর সন্তান হিসাবে পাঠশালায় আমরা আলাদা একটা বিশেষ সম্মান পেয়েছি। আজ উক্ত হাইস্কুলের
ইংরেজি স্যারের সন্তান হিসাবে ভর্তি হয়েছি, সর্বক্ষেত্রে একটা
বাড়তি সম্মানতো থাকবেই।
স্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। তারেক ভাই, আমি ও ছোটবোন মান্না আব্বার পিছু পিছু ছুটলাম। আব্বার হাতে ছাতি ও পায়ে বল। তাঁর সাথে তালমিলিয়ে হাঁটা ভার। পথে পথে আর ছাত্ররা যোগ হয়ে হয়ে এক বড় দল তৈরি হয়। এই ছাত্রদলটি যেন নীরব মিছিল নিয়ে আব্বাকে অনুসরণ করে প্রথমে চৌধুরীবাজার, তারপর বল্ডার বিছানো মাইলখানেক পথ পার হয়ে বরইতলায় এসে নেগালের সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করে। গভীর অরণ্যময় ছায়াঘেরা নেগালের মেটোপথ, বাঁশের সেঁকো ও কিছু পাকা লন্ডনি বাড়ি পার হয়ে ভটেরবাজারের কাছ দিয়ে আমরা হাইস্কুলে প্রবেশ করি। স্কুলটির নাম রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলটির শুভ জন্মদিন ১লা জানুয়ারি ১৯০৮ সাল। নেগালের প্রখ্যাত জমিদার রায়বাহাদুর রামেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য তাঁর পিতা রেবতী রমন ভট্টাচার্য্যের নামে মোগলাবাজারের গা ঘেঁষে কেশরখালী নদীর পারে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। রামেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য এলাকায় রামভট নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের ভুমির পরিমান ২৩৯ ডেসিমেল।
স্কুলের
দক্ষিণচত্বর জুড়ে সুন্দর বসার ঘাটসহ
বড় পুকুর। এই পুকুরপারের এই পাকাঘাটে একসাথে বিশ পঁচিশ জন ছাত্র বসে আড্ডা জমাতো।
দেশের নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকা, নেতা পাতিনেতা হতে গ্রাম্য রাজনীতি পর্যন্ত সব
বিষয়ে আলাপচারিতা হত। শীত ও বসন্তে এই ঘাটের দুইদিকে কটনদার লাগানো নানা প্রজাতির
শতশত গাদাফুল হলুদসোনা ছড়িয়ে দিত। পুকুরপারে
এল পেটার্নের সুদীর্ঘ্য টিনের বড় বারান্দার ভবনে অফিস, টিচার রূম, ছাত্রী মিলনায়তন,
বিজ্ঞানাগার ও সবগুলো শ্রেণিকক্ষ
সাজানো ছিল।
১৯৭৬ সালের
জানুয়ারি মাসে রেঙ্গা পরগনার পাঁচ ছয়টি
পাঠশালার ছাত্র এসে জমায়েত হই মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে। ভর্তি হওয়া মোঠ
ছাত্রছাত্রীসংখ্যা ছিল তেষট্টি জন। প্রথমদিকে
বিভিন্ন এলাকা ও পাঠশালার ছেলেরা আলাদা আলাদা জোটবদ্ধ থাকলেও কিছুদিনের মধ্যে আমরা
মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই।
পাঠশালার
সহপাঠি ছয়ফুল এসে ভর্তি হল। গত বার্ষিক পরীক্ষায় যষ্ট শ্রেণিতে ফেল মেরে আটকে পড়া ছাত্র আমার পাড়ার সিকন্দর আলী লন্ডনির ছেলে চেরাগ আলী কুটিকে এখানে পেলাম। এই চেরাগ আলী ছিল স্বল্পভাষী একগুয়ে প্রকৃতির
ও কিছুটা বোধশক্তিহীন। লন্ডনির
পুত্র হিসাবে সে ধনসম্পদের অহঙ্কারে ভুগতো।
বয়স্ক চেরাগ আলী বিড়ি ফুকতো, আমি একদিন তাকে বিড়ি ছেড়ে
দেবার উপদেশ দিলে সে বলল- আমি সিগারেট খাই কিংবা না খাই
তাতে তোমার কি, আমাকে তোমার উপদেশের দরকার নেই।
সে দুইটি বিয়ে করে ও বিড়ি টানতে টানতে গলায় ক্যান্সার হয়ে জোয়ান
বয়সে মারা যায়। এই চেরাগ আলী ভদ্র সমাজে চলার মত লোক ছিল না,
সে চৌধুরী বাজারে দোকান দিত, তার এক সার্বক্ষণিক
সহচর দুবৃত্ত তাজুল আলী ধর্ষণ মামলার রায়ে বাইশ বছরের জেল খাটে। আরেক সহচর ছিল বারবার জেলখাটা কুখ্যাত চোর, তাঁরই
ফুফুতো ভাই ছমির আলী।
চেরাগ আলী দুপুর এক ঘটিকার বিরিতির সুযোগে প্রায়ই স্কুল পালাতো। হতদরিদ্র থেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া চেরাগ আলী পরদিন স্কুল পালানোর পাপ তার অশিক্ষিত চাষা লন্ডনি বাবা সিকন্দর আলীর উপর চাপাতো, বলতো, বিকালে ক্ষেতের কাজ না করলে তার বাবা মারধর করে। চেরাগ আলীর ক্লাস পরীক্ষা পাসের মগজ ছিলনা। তাই দুইএক বছরের মধ্যে সে ঝরে পড়ে। নেগালের রাঘবপুর নিবাসী আজিজ আহমদ ছিল সেখানকার পীর বংশের ছেলে। সে দেখতে লম্বা ও ফর্সা। ভদ্র কিশোর। সে কুয়েতে আছে। হাইস্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি।
রাঘবপুরের
হাজি গরীব উল্লাহের সন্তান মোহাম্মদ বেলাল আহমদ আমার আজীবনের বন্ধুজন। বিখ্যাত জমিদার ও
পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী বসন্ত কুমার দাসের বংশধরগণ
ভারতে চলে গেলে তাদের দিঘিওয়ালা
বড়বাড়ির মালিকানা বেলালদের হাতে চলে আসে। বেলাল শ্যামলা ও যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিল।
বাচাল বেলাল খুব সৎ ও ধার্মিক। তাঁর নেতৃত্বদানের উচ্চাকাংখা ছিল। উচ্চশিক্ষিত বেলাল দীর্ঘকাল কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করেন।
কুয়েতে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। দেশে এলেই
তাঁর লামাবাজারের বাসায় সপরিবারে দাওয়াত খেতে যেতেই হত। বেলালের সুন্দরী
গিন্নী সাহিদা বেগম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজ বিজ্ঞানে গ্রেজুয়েট,
তিনি একজন সুগৃহিনী ও লেখিকা। সাহেদা বেগমের লেখা কিছু কবিতা কুয়েতের
একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আমি এই ম্যাগাজিন উপহার পাই। বেলাল-সাহেদা
দম্পতির একমাত্র পুত্র
ফারাবি আহমদ ও একজন কন্যা সন্তান রয়েছেন।
১৭ মার্চ ২০২২ দুপুরে দাওয়াত খেতে যাই ভাগনা মুফতি তানজিরের বাসায়। এমন সময় ভাইপত্নী ফাহমিদা লোমার ফোন পাই, কোন খবর পেয়েছেন? বললাম কিসের খবর? ফেসবুকে জানলাম আপনার বন্ধু বেলাল আহমদ দুইদিন আগে হার্টএটাক হয়ে কুয়েতে মারা গেছেন। বেলাল আমার ফেসবুক বন্ধুও। মাসখানেক আগে ধানমন্ডি বাসা হতে তার সাথে দীর্ঘক্ষণ ভিডিও চ্যাট করি। এই শোকসংবাদে টেবিলে সাজানো মজার মজার সব খাবার যেন বিস্বাদ হয়ে গেল। হাইস্কুলে হাফপ্যান্টপরা সেই হাসিমুখ বালক বেলাল হতে আজকের পৌড় বয়সের বেলালের অনেক স্মৃতি মনকে বিষন্ন করে দেয়। ফেসবুকে ঢুকে দেখি ঢাকার খবর চ্যানেলের প্রবাসী সংবাদে বেলালের মৃত্যুর সংবাদ বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করছে। মনে খুব অস্বস্তি লাগে। খবর পাই কুয়েতে একবার নামাজে জানাজা হয়ে গেছে, আজ বাদ মাগরিব রাঘবপুর ঈদগায় বেলালের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে বেলালের বাড়ি পানে গাড়ি ছুটাই। মোগলাবাজার আসতেই মাগরেব পার হয়ে যায়। মোগলাবাজারের অবিশ্বাস্য ভীড় ঠেলে কেশরখালি সেতু পার হয়ে অতিকষ্টে কার চালিয়ে নেগালের শেষসীমায় বেলালদের বাড়ি পৌঁছি। বাড়ির উঠোনে চেয়ারে চেয়ারে বসে আছেন অনেক লোকজন, তাঁরা জানালেন লাশ সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের জামে পড়ে যথাসময়ে আসেনি, তাই জানাজা হবে রাত সাড়ে ১০টায়। বাসায় ফিরে রাত সাড়ে ৯টায় বেলালের লামাবাজারের বাসায় যাই। গেটে গিয়ে দেখি লাশ এম্বুল্যান্সে উঠানো হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি গাড়ি লাশের এম্বুল্যান্স অনুসরণ করে মোগলাবাজারের পানে যাত্রা করে। আমি বুকের ব্যথা বুকে নিয়ে তাকে শেষদেখা না দেখেই বাসায় ফিরে আসি। মহান আল্লাহপাক আমার এই প্রিয় বাল্যবন্ধুকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন, আমিন।
নেগালের কবিরাজ শ্রী দয়াময় চক্রবর্তীর কনিষ্ঠ পুত্র পুলকের সাথে আমার খুব ভাব ছিল। সে হাফপেন্ট পরে স্কুলে আসত। তার আসল নাম শ্রী শশাঙ্ক শেখর চক্রবর্তী। সে তোতলাত, কথা বলতে বেশ সমস্যা হত। কিন্তু সে সুন্দর গান গাইত, আশ্চর্য্য ব্যাপার হল, গান করার সময় তার তোতলামি চলে যেত। আজও তার গান কানে বাজে- “সব সখিরে পার করিতে নিবো আনা আনা, তোমার বেলায় নিবো সখি তোমার কানের সোনা। সখি গো তুমি প্রেমের ঘাটের মাঝি, তোমার কাছে পয়সা নেবো না”। পুলক আজ ইন্নাতআলিপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
বয়সে গুরু মইজউদ্দিন নেগালের ধনী লন্ডনি বাড়ির একজন ভদ্র ছেলে। সে ফ্রান্সে প্রবাসজীবনে থাকাকালে অল্প বয়সে পরলোকগমন করে। আমার তুড়ুকখলা পাঠশালা হতে রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে আসা কামাল, মুক্তার, সেলিম, দুলু, দিপা ও শাহানার কথা ইতিমধ্যে বলা হয়ে গেছে। দক্ষিণ তুড়ুকখলার তৌহিদুল ইসলাম টিপুকে আমি এখানে এসে পাই। ফর্সা কুকড়ানো চুলের অতি সুদর্শন টিপু ছিল মেধাবী ও সদা হাসিখুশী বালক। সে হাসত আর গান গাইত- "মা গো মা, ও গো মা, আমারে বানাইলে তুই দেওয়ানা"/ “লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মিঠেনা”। কিংবা “তাই বলে কি থেমে ছিল কদমতলার বাঁশী।“ এই কদমতলায় বংশীবাদক টিপুর কাছে আমি বার্ষিক পরীক্ষায় সামান্য কটি নম্বরের জন্য হেরে যাই এবং ক্লাস সেভেনে ফাস্টবয় হবার গৌরবটি টিপুর দখলে চলে যায়। প্রথম বারের মত সেকেন্ড বয় হয়ে কি যে দুঃখ পাই তা ভাবলে আজ হাসি পায়। আসলে সময় পেরিয়ে গেলে অনেক বিষয় তাঁর গুরুত্ব হারায়। ভাদেশ্বর পশ্চিমভাগ গ্রামে মামাবাড়ি উচাবাড়িতে থেকে পশ্চিমভাগ পাঠশালায় পাঠ সেরে তৌহিদুল ইসলাম টিপু এখানে আসে।
পুর্বতুড়ুকখলার
গোলাকার চেহারার তরতাজা বালক
মইন আহমদকে এখানে এসে পাই। সে বেঞ্চে আঙ্গুল টুকিয়ে
টুকিয়ে “লাল কুর্তাওয়ালা, নীল শাড়িওয়ালা, দিলে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা”
গেয়ে গেয়ে সময় কাটাতো। লাল কুর্তাওয়ালা মইন আজ লন্ডনের অধিবাসী। কুনারচরের
হিন্দু ছেলে মদন মামাবাড়ি থেকে পড়ত,
মনে পড়ে হেডস্যার রামেশ ভট্টাচার্য্য একদিন রেগে গিয়ে তাকে হাঁটুভেঙ্গে বসায়ে দুইগালে
কশে থাপড় দেন। সে নবম শ্রেণিতে এসে
একদিন হারিয়ে যায়, পরে জানলাম সে ভারতে
চলে গেছে। মদন ও পুলকের সাথে আমার খুব অন্তরঙ্গতা ছিল।
দাউদপুর ইউনিয়নের সর্ব পশ্চিমের গ্রাম উছমানপুরের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন জোয়ার্দার আজ জেলাপরিষদে কর্মকর্তা। ১৯৮৬ সালের
সংসদ নির্বাচনকালে শফি চৌধুরীর ভোটের মিছিল শেষে গভীর রাতে সিলেটে আশ্রয় পেলাম না, বাড়ি ফেরার গাড়িও নেই, সেদিন আমি ও দেলোয়ার একটানা দুই তিন ঘন্টা পায়ে হেঁটে উসমানপুর চলে আসি ও দেলোয়ারের ঘরে
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হই, এই ঘুম ভাঙ্গে পরদিন দুপুর বারটায়। দেলোয়ার হোসেন জোয়ার্দার দিলদরিয়া লোক।
সে বাড়ির পাশের স্থানীয় লতিফা শফি চৌধুরী কলেজে ভূমিদান করে ও বাড়ির সামনে একটি সুন্দর মসজিদ
নির্মাণ করে।
আমার পাঠশালার
সহপাঠী তিরাশীগাঁও নিবাসী সুব্রত সিংহ
বাবলার কথা বলা হয়ে গেছে। মুখে একটু দাগযুক্ত সুবোধ ছেলে ছত্তিঘরের মখলিসুর রহমান এখন
সিলেট কোর্টে কাজ করে। মখলিছ ভদ্রলোক। ভাগ্যক্রমে পথে প্রান্তে বেশ কবার তাঁর সাথে দেখা হয়। এই গ্রামে বোনের বাড়িতে থেকে পড়ত বুদ্ধিমান বালক সালেহ আহমদ। তার চেহারা ছিল মায়াবী। সে এখন ক্যানাডা প্রবাসী।
এই গ্রামের ওদুদটার কথা মনে পড়ে, সে ছিল বড় ভাল ছেলে। সে অল্প বয়সে ডায়রিয়া হয়ে মারা যায়, এই সামান্য রোগ তাকে পরপারে নিয়ে যায়। খালেরমুখের
ধলা ফারুক দারুণ ছেলে। সব সময় আমার পক্ষ নিত। কেউ
আমাকে কিছু বললে সে জবাব দিত। একবার এক ছেলে অন্যায়ভাবে আমার সাথে মারামারি করলে
ফারুক আহমদ আমার পক্ষে লড়াইয়ে নেমে যায়। ফারুকের কোন খবর আর পাই নি,
সে কেমন আছে কোথায় আছে জানি না, আল্লাহ
তাকে ভাল রাখুন।
বিনয়ে
বৈষ্ণব আব্দুল আহাদ ধবধবে সাদা বালক, সে ছিল আমার নামাজের
সাথি। স্কুলের মধ্যাহ্ন ছুটিতে সবাই ছুটত খেলার মাঠে কিংবা বাজারে, আমি ও আব্দুল
আহাদ মাথায় টুপি পরে তখন ছুটতাম স্কুলের আশপাশের কোন এক মসজিদে। আজ আহাদ কোথায় আছে
জানি না, স্কুল ছেড়ে আসার পর আর কোনদিন
আহাদের হাসিমুখ দেখি নি।
খালেরমুখের
ছোট ওদুদ মোঠা ও বেঁটে বালক। এই এলাকার মকবুল আহমদ হাসিখুশী বয়স্ক
বালক, সে লুঙ্গি পরে ক্লাস করত। মকবুলও ছিল
গায়ক কিন্তু গানকে প্যারোডি করে
হাস্যরস ঢুকাত, এমনকি অশ্লীল শব্দ যোগ করে গান
গাইত। যেমন তাঁর একটি গান- “ইতা কিতা কর রে তোমরা ছাত্তি আওড় দিয়া, আমারে না
করলে শরিক কইমু বাড়িত গিয়া”।
পাঠশালার
সহপাঠি আমার অগ্রজা আনিছা মৌলা বেগম মান্না ও সুয়ারা, মোগলাবাজারের ইসমতারা, সুপ্রা, হেডস্যার রামেশ ভট্টাচার্য্যের
ফর্সা গোলবদনা কন্যা কৃষ্ণা ভট্টাচার্য্য এই ক্লাসে
ভর্তি হয়। খালেরমুখের সরিশপুরের একজন লন্ডনির
পুত্র সোনাহর, সে স্থূলকায় বালক, সোনাহরের টাট্টা ছিল “গাট্টা বেটির হাই, ভাত দেয়না, কাপড় দেয়না, ঘরে
দেয়না ঠাঁই।“ গাট্টা বেটির হাই, বললেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো। দুষ্ট সহপাঠিরা
তাকে খুব জ্বালাতন করত। সত্যিই সে কোন স্থুলতনু রমণীর
পতি হয়েছে কিনা জানিনা, তবে সোনাহর এখন যুক্তরাজ্যের হারিয়ে গেছে। তাঁর
সাথে আর কোনদিন আমার দেখা হয়নি।
ভদ্রলোকের ভদ্রছেলে মুরাদ আহমদ, তার বাড়ি রেঙ্গা হাজিগজ্ঞের মাহমুদাবাদ গ্রামে। তার বাবা হাজি খবির উদ্দিন সমাজসেবী। এলাকার উন্নয়নকর্মে তিনি এতই বিভোর থাকতেন যে ঘর সংসার ভূলে যেতেন। হাজিগজ্ঞের বাজার, স্কুল, হাসপাতাল তার পরিশ্রমের ফসল। তিনি ছিলেন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক। নেগালের আরেক বাউন্ডুলে কিশোর সহপাঠি সানায়র আলী শুনেছি মারা গেছে। সে বলত, মেয়েদের দিকে তাকানোর কি দরকার, বিয়ে করলে তো পার্মানেন্ট একজন পেয়ে যাব।
মোগলাবাজার রেলস্টেশনের পশ্চিমের বাড়ির মামুনুর ছিল হালকা পাতলা গঠনের মধুকন্ঠ বালক। মামুনুরের মুখে হাসি, কন্ঠে গান লেগেই রইত। এখানে আমার বড়বোন রেহার বান্ধবী শারিকোন আপার বাড়িতে শৈশবে বহুদিন আমরা সপরিবারে অতিথি হয়েছিলাম। নানাবাড়ি যাবার জন্য মোগলাবাজার স্টেশনে আসার পর ট্রেন আসতে দেরি হলেই পিছনের ডিএসপি বাড়িতে গিয়ে আমরা চানাস্তা করতাম। শৈশবে অনেকবার এই বাড়িতে যাবার স্মৃতি আমার আজ মনে পড়ে। শারিকোন আপার বাবা ছিলেন পুলিশের ডি এস পি বজলুর রহমান। তার নামে মোগলাবাজার রেলস্টেশনের পাশে এখন একটি পাঠশালা রয়েছে। তার ভাই আতিকূর রহমান একজন রাজনীতিবিদ। শিশু বিশেষজ্ঞ শারিকুন আপা এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তাঁর চিকিৎসক স্বামী ফুলবাড়ি গ্রামের আমাদের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়।
বিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ছাত্রসংখ্যা যষ্ঠশ্রেণিতে থাকায় ক্লাস হত উত্তরের ঢালাই করা বড় পাকা ভবনে। এই ভবনের এক তৃতীয়াংশে আমাদের ক্লাস হত, বাকি দুইভাগ ছিল শুন্য। এই খালিস্থানে স্যারদের অনুপস্থিতিতে চলত খেলাধুলা হৈ চৈ। বার তের বয়সের বালকদের চঞ্চলতায় ভবনটি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হত। স্যারের আগমনবার্তা দেখামাত্র ছেলেরা লাফিয়ে এসে যার যার সিটে সুবোধ বালক হয়ে বসে পড়ত। মেয়েরা ছাত্রীমিলনায়তন হতে স্যারদের পিছু পিছু এসে শূন্য বেঞ্চে বসত। স্যাররা যখন তার চেয়ারে বসতেন তখন নেমে আসতো পিনপতন নীরবতা। স্যাররা চলে গেলেই আবার সেই ঠেলাঠেলি চিৎকার।
এই ভবনের
সামনের দেয়ালে স্কুলের শিল্পী চৌকিদার কটন আলী সিমেন্ট সুরকি দিয়ে নির্মাণ
করেন হলুদ কালো ডোরাকাটা এক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দর ভাস্কর্য্য। এই স্কুলে
প্রতি শ্রেণির প্রথম ক্লাসের স্যারকে বলা হত ক্লাস টিচার। তিনি
ক্লাসে ঢুকেই রোলকল করতেন। আমাদের ক্লাস টিচারের নাম ছিল
দেবব্রত চক্রবর্তী দেবু। আমরা তাকে দেবুস্যার নামে ডাকতাম। তার বাড়ি পুর্বতুড়ুকখলার
নয়াগাঁও। দেবু স্যারের পিতা ছিলেন একজন দলিল
লেখক, তিনি এলাকায় দিনেশ ঠাকুর নামে পরিচিত। দেবু স্যার কালো ও মধ্যমাকৃতির শান্ত ও সহজ প্রকৃতির একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি একিসাথে স্কুলের করনিকের দায়িত্বও পালন করতেন। তিনি
ছিলেন নরম স্বভাবের ও পড়া আদায়ে কোন জবরদস্তি করতেন না। তিনি কৃষিকথা, পৌরনীতি এধরনের
সহজ বিষয় পড়াতেন। পাঞ্জাবির সাথে প্যান্ট অথবা মালকুচা দেওয়া
ধুতি পরে স্কুলে আসতেন। আমি ২০১৫ সালে পূবালী ব্যাংক চৌধুরীবাজার শাখায় গিয়ে একদিন শোকসংবাদ পাই
আমাদের প্রিয় দেবুস্যার চলে গেছেন নাফেরার দেশে।
এই ক্লাসে
আমরা কিছুদিনের জন্য ধর্মশিক্ষার শিক্ষক হিসাবে মৌলানা হিলাল উদ্দিন স্যারকে পাই।
তার ছেলে দুলু পাঠশালা হতে আমার সহপাঠি ছিল। মৌলানা স্যার তখন ছিলেন বৃদ্ধ, তার
চোখ ও কান তেমন কাজ করত না। ফলে তার
ক্লাসে ছেলেদের দুষ্টামী ও হৈ চৈ বন্ধ হতনা। তিনি সোজা সাপ্টা হুজুর মানূষ। একদিন
তিনি ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। একটি ছেলে মোঠ একশত নম্বরের মধ্যে একশত পাঁচ নম্বর পেয়ে যায়। হিলাল উদ্দিন স্যার সহশিক্ষক আব্বাকে বললেন এত ভাল ছাত্র তিনি
জীবনে কখনও পান নাই, যে শত নম্বরের মধ্যে পরীক্ষায় একশত পাঁচ নম্বর
পেয়ে গেছে। আব্বা বললেন এমনটি হবার কথা নয়। তিনি পেপারটি হাতে নিয়ে দেখলেন, যে কোন
পাঁচটি প্রশ্নের উত্তরের স্থলে ছাত্রটি সবকটি প্রশ্নের উত্তর লিখে দিয়েছে। ফলে যা
ঘটার তা ঘটেছে, ছেলেটি ধর্মশিক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০৫ পেয়ে গেছে। তবে ছেলেটির
কপাল খারাপ, তার প্রাপ্ত নম্বর যদি একশতের ভিতর থেকে যেত তাহলে সে ধরাই পড়ত না।
এই বৎসর স্কুল থেকে অবসর নিয়ে হিলাল উদ্দিন স্যার কিছুদিনের মধ্যে মহান আল্লাহর
সান্নিধ্যে চলে যান।
এই শ্রেণিকক্ষের পশ্চিম দিকে স্কুলে ঢুকার সদর রাস্তা, রাস্তার অন্যপাশে বয়ে যাচ্ছে ছোটনদী কেশরখালী। ওপারে মোগলাবাজারের দোকান, চালকল, ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। পাশের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখতাম কেশরখালীর বুকচিরে বয়ে যাচ্ছে পালতোলা যাত্রিবাহী ছইঢাকা ডিঙ্গিনৌকা, জালসহ জেলে নৌকা, বালি ও পাথরবাহী বড় খোলা নৌকা। বর্ষার ভাসান জলে কেশরখালি দিয়ে বয়ে যেত দীর্ঘ বাঁশের বড় বড় ভেলার সারি। বালকেরা বলত, বাঁশের ছাইল যাচ্ছে। হাকালুকি হাওরপারের বনাঞ্চলের বাঁশ কেটে কেটে বড়ভেলা বানিয়ে অসংখ্য ভেলাকে দড়ি বেঁধে ট্রেনের বগির মত যুক্ত করে মাঝিরা লগি ঠেলে ঠেলে জলপথে নিয়ে যেত ছাতক পেপার মিলে। কোন কোন ভেলায় তাবুর মত ঢাকনা ছিল। সেখানে মাঝিরা ঘুমাত ও রান্নাবান্না করত।
ঔ যেন চোখের সামনে দেখছি স্কুলের সামনের সেতু হতে দুষ্ট বালকেরা ঝাঁপ দিচ্ছে কেশরখালীর ভরাজলে। নদীতে নৌকায় পাতা জেলেদের জালে রূপালী মাছ লাফালাফি করছে।
একদিন আমার
পাড়ার মুরব্বী আঁতর আলী ভাইয়ের কাছে দাউদপুর ও তুড়ুকখলার সীমান্ত নদী
বুড়িবরাকের উপাখ্যান শুনলাম। এই নদীটি এককালে ছিল অনেক বড় ও গভীর। তখন
তার নাম ছিল বরাক। উত্তাল জলে ঢেউ তুলে বড়বড় জলযান চলতো, ধরা পড়ত
অনেক বড়বড় মাছ। তখন এই বড়নদীর ছিল ভরা যৌবন। তিনি মহানন্দে ছুটলেন সুরমাকে বিয়ে
করতে। পথে দেখা হল কেশরখালীর সাথে। কেশরখালী বলল, ভাই আপনি বরসেজে কোথায় ছুটছেন।
বরাক জবাব দিল- যাচ্ছি সুরমাকে বিয়ে করতে। সাথে সাথে কেশরখালী ফতোয়া দিল এই বিয়ে
হবেনা। কারণ বিয়ের আগেই আপনি সুরমাকে “মা” বলে
ফেলছেন। এবার যাওয়া হল পাশের কুশিয়ারার কাছে। কুশিয়ারা বলল ফতোয়া সঠিক, এর বরখেলাফ
করা যাবেনা। তাই উদ্বাহ ক্রিয়ার বিরতি টেনে এখানেই কেশরখালীর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন
তিনি। সুরমাকে বিয়ে করতে না পেরে মনের দুঃখে তিনি চুপসে যান এবং যৌবন হারিয়ে
নারী-হিজড়া নাম ধারণ করে হয়ে যান বুড়িবরাক।
স্কুলের পাশে মোগলাবাজারের উত্তরপুর্ব কোণে এই দুই নদীর ঘটেছে মহামিলন। ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখা যায় একটু দূরে আমার তুড়ুকখলা পাঠশালার পাশদিয়ে বয়ে আসা বুড়িবরাক এসে মিশেছে এই কেশরখালীর সাথে। আজও চোখে ভাসে দুইনদীর এই মিলনস্থলে তিন চারটি নৌকায় নীরবে বসে জেলে ভাইরা বাঁশের প্রশস্ত ত্রিকোণ করাজাল ফেলে মাছ ধরছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের এক ঘনবর্ষায় মোগলাবাজার হাইস্কুলের সামনের সেতুটিতে দাঁড়িয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ, দখলবাজরা দুইতীরে নদীটিকে এমনভাবে গলাটিপে ধরেছে যে, নদীটির প্রাণবায়ু প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে। নদীর সেই স্বতঃস্ফুর্ত প্রবাহধারা আজ আর নেই, নেই সেই নৌকার ছড়াছড়ি। আমার পুত্র জেফার বলল- আব্বা তোমার বলা গল্পের সেই নদীটি কই? এ তো দেখছি একটি খাল। মোগলাবাজারের দক্ষিণের নদীঘাটে গিয়ে দেখি সেইকালের যাত্রিবাহী সেই ছইনৌকার সারি নেই। আপন মনে ভাবলাম- “কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল। / কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশ্বথতল”। আসলে পাকা সড়কের বিস্তৃত জাল আজ রেঙ্গা পরগনার নদীপথকে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলেছে। নদীঘাটের সেই ব্যস্ততা আজ আর নেই।
তিননদীর প্রেমকাহিনির কথক আতর আলী ভাইকে নিয়েও একটা মজার গল্প রয়েছে। সেযুগে নারীরা স্বামীকে খুব
ভয় পেত ও অতিমাত্রায় সম্মান করত। স্বামীকে আপনি আপনি করে কথা বলত, পতির নাম মুখে উচ্চারণ
করাকে গায়ের বধুরা বেয়াদবি ও পাপকাজ মনে করত।
আঁতর আলী ভাইয়ের বাড়িতে একদিন মিলাদ শরিফ হচ্ছে
কিন্তু আতর আনা হয় নাই। আতর আলী ভাইয়ের গিন্নী পুত্রকে ডেকে বললেন- সব আছে কেবল
“আতর” উচ্চারণ না করে
বললেন “মিলাদ শরিফের তেল” নেই। আশপাশের কিছুলোক শুনে ফেলে
ও কৌতুক করে তারা আতর আলী ভাইয়ের আরেকটি নাম রেখে দেয় “মিলাদ শরিফের
তেল”।
যষ্ট শ্রেণিতে
একদিন ক্লাসলিডার নির্বাচন হয়। ক্লাস লিডারকে বলা হত ক্লাশ-ক্যাপ্টেন। দাউদপুর ইউনিয়নের ছাত্ররা আমাকে প্রার্থী করে। অন্য
দুইজন প্রার্থী সালেহ আহমদ ও বেলাল আহমদ। খালেরমুখের
ছাত্ররা সালেহ ও মোগলাবাজারের ছেলেরা বেলালকে ভোট দেয়। স্যারের ছেলে হিসাবে আমি
বাহিরেরও ভোট পাই। ক্লাস-টিচার দেবুস্যার ইসফাকের সমর্থকরা কারা, সবাই দাড়াও, বলতেই অনেক ছাত্র দাঁড়িয়ে
যায়। এভাবে একেএকে তিনজন প্রার্থীর সমর্থকরা দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। খুবসম্ভব বেলাল
দ্বিতীয় ও সালেহ তৃতীয় হয়। যাক ভাগ্য ভাল, জীবনের প্রথম ভোটে প্রার্থী হয়ে
জয়ী হলাম। আমি ক্লাসের প্রথম ক্যাপ্টেন ও বেলাল দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়।
ক্যাপ্টেন হবার পর সমস্যা হল আমার বয়স কম, আমি ছোটখাট বালক। বড়সড় গেঁয়ো সহপাঠিদেরে
সামলানো বেশ কঠিন কাজ, তবে যথেষ্ট বড় ও বয়েসী ফর্সা
ফারুক আহমদ আমার পাশে দাঁড়ায়, তাঁর শক্তি ও বীরত্ব সব সমস্যার সমাধান করত।
আমার বড়বোন ফুলবুবুর পতি ইজ্ঞিনিয়ার মুফতি মোঃ খালেদ ঢাকায় কহিনুর কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। বিয়ের পর তারা ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ভাগনা লবিদের জন্মের বেশ আগে ফুলবুবু তাঁর বাপের বাড়ি দাউদপুর চলে আসেন। আমার মা চাচি ও ভাবীরা সবাই এসে ফুলবুবুকে নিয়ে উত্তরের কক্ষে মাটিতে শীতলপাটিতে ঘিরে বসেন। ফুলবুবু তীব্র প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছেন এমন সময় হঠাৎ বাচ্চার কান্নায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ১৯৭৬ সালের কোন একদিনে ধবধবে সাদা এক ছেলেশিশু পৃথিবীতে শুভাগমন করে। সে শিশুটি আমাদের এই প্রজন্মে স্রষ্টা প্রদত্ত প্রথম মানব প্রতিনিধি প্রিয় ভাগনা মুফতি মোহাম্মদ লবিদ। সেকালে রিকশা ছিলনা, আমরা প্রায়ই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতাম। রাস্তার পাশে কয়েকটি বরইগাছ ছাড়া তেমন কোন ছায়াবৃক্ষ ছিলনা। প্রচন্ড গরমদিনে বরইগাছের ছায়ায় থেমে থেমে ক্লান্তি মুছে অগ্রসর হতাম। মুড়ির টিনমার্কা দুচারটি বাস ঘন্টাখনিক পরপর পাহাড় লাইনের বল্ডার বিছানো মেটে ও পাথুরে সড়কে চলাচল করত। গাড়ির পিছনে ধূলা উড়ত, ধূলা হতে রক্ষা পেতে আমরা দূরে চলে যেতাম। চলন্ত গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হেল্পার বালতি দিয়ে ইজ্ঞিনে পানি ঢালত। গাড়ির সামনে ইজ্ঞিনে একটি হ্যান্ডেল সজুরে ঘুরালে গাড়ি স্টাট হত। প্রায়ই যাত্রিরা গাড়ি হতে নেমে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করতেন। গাড়ি চালাতে ড্রাইভারের এত কষ্ট হত যে সে বারবার সহযোগীকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালী করত। মনে হত ইজ্ঞিন নয় যেন এই দুইজন লোক তাদের গায়ের শক্তিতে গাড়ি চালাচ্ছে। বাসের সামনের দিক ছিল আপার ও পিছনের দিক লোয়ার। আপারে বসলে ভাড়া বেশি গুণতে হত। আমরা মাঝে মাঝে দলবেঁধে মোগলাবাজার তিমুখা হতে বাসে চৌধুরীবাজার আসতাম, ছাত্রদের ভাড়া ছিল ফ্রি। গাড়ির ভিতর যাত্রিপূর্ণ হয়ে গেলে ছাদেও লোক উঠত। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে একদিন তিমুখায় আমরা সদলবলে বাসে উঠি। বাসটি নেগাল সড়কের খানেক আগে দুর্ঘটনায় পড়ে। হঠাৎ যাত্রিরা চিৎকার দেন লাইলাহা ইল্লাল্লাহ। আমি ছিলাম পিছনের সিটে বসা। মনে হল গাড়িটি উলটে খাদে পড়ে যাচ্ছে। তারপর কিছুই মনে নেই।
একটুপর
খালাত ভাই তারেক, হাড়িয়ারচরের মইনুদ্দিন ও সিনিয়র ক্লাসের পঙ্কি ভাই এসে আমাকে
গাড়ির ভিতর হতে বের করেন ও কোলে করে আমাকে
বাড়ি নিয়ে যান। পঙ্কি ভাই পূর্ব দাউদপুরের গাংপারে আত্মীয়বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন কপালের ডানদিক ফেটে গাল ভিজে
রক্ত ঝরে ও রক্তে সারা সার্ট ভিজে লাল হয়ে যায়।
তখন গাড়ির চারটি চাকা আকাশের দিকে তাকানো ছিল। আম্মা
আমাকে রক্তাক্ত দেখে কেঁদে
উঠেন। আম্মাকে তখন বললাম আমার তো কিছুই হয়
নাই, অনেক লোক গাড়ির নিচে পড়ে মরে আছে। তখন গাড়ির ছাদে অনেক লোক উঠত,
আমার মনে হল এসব লোক গাড়ির তলায় পড়ে সব মারা গেছে। আসলে কেঊ মারা যায়নি কিংবা আমার
মত এত জখম আর কেউ হয়নি, গাড়ি ধীরে ধীরে উল্টে যাবার আগেই সবাই ছাদ থেকে নিরাপদে নেমে যায়।
সেদিন ছিল মোগলাবাজারের হাটবার। লাইন ধরে শতশত লোক মালামাল নিয়ে হাটে যাচ্ছেন। এইদিন রাতে চাচাত ভাই ডাঃ এন এ চৌধুরী গোলাম নবি এসে হাইড্রজেন পার অক্সাইড দিয়ে ক্ষত মুছেন এবং আমাকে চিকিৎসা দেন। পরদিন অসংখ্য মানুষ আমাকে দেখতে আসেন। এইদিন বাড়িতে আরেকটি নাটক সংঘটিত হয়। দিনে আমাদের বাড়ির সামনের দিঘিতে মাছ ধরার জন্য দশজন জেলে নামানো হয়। এরা মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, এদেরকে ধরে পাকা কোঠায় আটক করা হয়। ঠিক সেই সময় আমার এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমার মা তখন খুব অশান্তি করছিলেন ও জেলেদেরে মারধর না করে ছেড়ে দিতে সবাইকে মিনতি করেন।
আমার মা একজন
আলেম ও পীরের কন্যা, তার দিন ও রাত কাটত জায়নামাজে। আমার
পিরানী আম্মা তার অতিন্দ্রীয় শক্তিবলে সন্তানের এই বিপদ
টের পেয়ে যান। তিনি মারমুখী জনতাকে বললেন, এরা লোভ করে বিপদে পড়ে গেছে, এধরনের বিপদ আমাদেরও ঘটতে পারে। তার
অনুরোধে এই জেলেদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরদিন পুকুর হতে কাদায় পুতা
প্রচুর মরা মাছ ভেসে উঠে। অনেক রুই, বাউশ, মৃগেল লুঙ্গিতে ভরে দুইমুখ বন্ধ করে বাঁশের খোটা দিয়ে গভীর দিঘির
মধ্যভাগে এসব চোর জেলেরা পুতে রাখে। লোকের ধারণা
এরা রাতে এসে এই মাছ নিয়ে যেত কিন্তু ধরা পড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে আর আসেনি।
আমাকে দেখতে
বাড়িতে লোকের ভীড় লেগে যায় ও অনেকে আমার জন্য পেপে আনারাস
ইত্যাদি ফল নিয়ে আসেন। ডান কপালের
সংক্রমণ বেশ কিছুদিন আমাকে তীব্রযন্ত্রণা
দেয়। আমার ডান ভ্রুর প্রান্তসীমায় ১৯৭৬ সালের জখমের দাগ এখনও সেই সড়ক দুর্ঘটনার স্মৃতি বহন করছে। এই দুর্ঘটনার পর বেশ কিছুদিন গাড়ি দেখলেই
ভয় পেতাম। গাড়ি থেকে দৌঁড়ে অনেক দূরে সরে যেতাম।
ছিয়াত্তুরের এই সড়ক দুর্ঘটনার কিছুদিন পর সিলেটে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। ঘরের টিনের চালায় ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে থাকে। কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টিপাতে দেশ বন্যায় সয়লাব হয়ে যায়। বন্যায় পাহাড় লাইন ডুবে যায়। খালেরমুখের পাশের বাস ও রেলসড়ক পানির নিচে চলে যায়। রাস্তার দুদিকে খুঁটি গেঁড়ে চিহ্ন তৈরি করে বাসগুলো ঝুঁকি নিয়ে জলে সাঁতার কেটে চলাচল করে। একদিন নৌকা চড়ে বাস লাইনের উপর দিয়ে মোগলাবাজার যাই। নেগালের রাস্তায় তখন সাঁতার পানি, স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্যাগ্রস্তরা এসে স্কুলঘরে আশ্রয় নেন। আমাদের বড় পুকুরের পার, সামনের মাটির সড়ক ডুবে জলে একাকার হয়ে যায়। জলে ভাসমান পূর্ব চৌধুরীবাড়ি যেন এক দ্বীপের রূপধারণ করে। এত বড় বন্যা আমি আর কোনদিন দেখিনি।
এই বন্যা বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়। তখন
ভাসান বন্যার জলে পলো বাওয়া, কুঁচো দিয়ে রাতে
আলোশিকার, জালদিয়ে মাছধরার ধুম পড়ে। আলোশিকার হল অন্ধকার রাতে মশাল জ্বেলে
রাতভর কুচোর সাহায্যে মাছ ধরা। এই বন্যায় গৃহবন্দি হয়ে বাড়ির সবাই
বাংলোঘরে ক্যারম খেলায় মেতে উঠেন। এরারোট নামক একধরনের সাদা পাউডার
ক্যারম বোর্ড নরম করে দিত। গ্রামের বাদল আলী, আলাউদ্দিন মেম্বার, ফারুক আলী, পাশের বাড়ির করিম ভাইরাও এই ক্যারম খেলায় এসে যোগ দিতেন। এই বর্ষণসিক্ত দিনে
বাড়ির মেয়েরা শিমবিচি, কাটাল বিচি, মিষ্টিকদু বিচি, ছোলা ইত্যাদি ভাজতেন। আমরা
সবাই দাঁতে কটকট করে এই ভাজাবিচি চিবিয়ে এবং পানসুপারিতে জাবর কেটে সময়
কাটাতাম।
১৯৭৬ সালে
আমি প্রথম মাধবকুন্ড যাই। মাধবকুন্ড গমনের সেই স্মৃতি এখনও মনে আছে। নানাবাড়ির
পিছনের বাগানের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন অনেক পর্যটক বাস মাইকে গান বাজিয়ে
আনন্দস্ফূর্তি করে মাধবকুন্ড যেত। হাসমতি ঝির এক ছেলের নাম ছবিল। সে ছিল
হাবাগোবা, কথা বলতে পারতনা। তবে বাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে মাইকে গান বাজিয়ে পর্যটন গাড়ি
গেলেই সে পুন্ড পুন্ড বলে চিৎকার করত। কুন্ড শব্দটি সে বিকৃত করে উচ্চারণ করত
পুন্ড। মাধবকুন্ডের দিকে মানুষের আনন্দযাত্রা দেখে
মাধবকূন্ড ভ্রমণের জন্য মন আনচান করত। আমার নানাবাড়ি
পাতারিয়ার দক্ষিণভাগ গ্রামে। নানাবাড়ির আশপাশে ধামাই,
সোনারোপা, রশিদাবাদ ইত্যাদি চাবাগান ঘিরে আছে।
নানাবাড়ির তিনচার মাইল পুর্বদিকে পাতারিয়া পাহাড়ে মাধবকুন্ডের অবস্থান। একদিন
খুবভোরে ছোটমামা শহিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে তার বন্ধু বিধান বাবু, নমির
আলী, কানেখাটো সিবই ভাই, খালাত ভাই তারেক
ও আমার বড়ভাই তাহমিদ নানাবাড়ি হতে পূর্বদিকে পদযাত্রা শুরু করি।
আমি এই দলের
সবচেয়ে কচি সদস্য, বয়স তখন মাত্র দশ এগার। নানাবাড়ির আধাটিলা এলাকা পার হয়ে চাবাগানের
পাহাড়ি মেটো সড়কে যাত্রা শুরু হয়। চাবাগানের বুকচিরে বূনোপথে হাঁটার
অভিজ্ঞতা এই প্রথম, দুদিকের চাবাগানের সবুজ শ্যামল গালিচা, মাথার উপর চিরল পাতার
ছায়াবৃক্ষ বেদকরে রোদের ঝিলিমিলি মনটাকে কবি করে তুলে। সময়টা হবে শীতের শেষ কিংবা
বসন্তের শুরু, তেজহীন মায়াবী রোদ। সবুজ টিয়ের দল
ডালে ডালে উড়াঊড়ি করে পাতার সাথে মিতালী করছে। কোকিল
ও বউ কথা কও আবিরাম গান গেয়ে নির্জন প্রান্তরকে সুসরব করে দেয়।
রঙিন কাটবিড়ালী মহাশয়রা ডালে ডালে লাফালাফি করে
বর্ণালী লেজগুচ্ছ ঝুলিয়ে কট কটর, কট কটর ধ্বনী তুলে।
এতদূর পদব্রজে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই প্রথম, তাই পায়ের
ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হলে ছোট মামা শহিদ চৌধুরী ও বিধান
কাকা কোলে তুলে নিতেন। কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ তাদের কোল চড়ে
মহানন্দে চা বাগানপথ পার হই। সাথে ছিল দুপুরের
খাবার ও গোসলের কাপড়ের বেশ বড় একটা গাট্টি বা পুটলি। সবাই পালাক্রমে মুঠো
বয়ে নিয়ে যান।
মাধবকূন্ডে
প্রবেশের বেশ আগে এক খাসিয়াপল্লীর দেখা পাই। পরিস্কার জলের এক ঝরনাধারার পারে
পাহাড়ের ঢালুতে বেশকিছু বাঁশ ও কাস্টনির্মিত মাচাংবাড়ি। খসিয়া লোকজন ঝরনার পরিস্কার জলে
গোসল করছে, কাপড় ধূইছে ও গৃহস্থলী কাজকর্ম সেরে
নিচ্ছে। ক্যালেন্ডারের ছবির মত সুন্দর নিসর্গ এই উপজাতি পল্লী আমার এতই মনোরম ও
শান্তিময় লাগে যে, মনে হল ভাল হত যদি এইখানে একটা বাড়ি নির্মাণ করে সারাজীবন থেকে যেতাম।
ঝরনার তীর
দিয়ে আর অগ্রসর হলে জলপ্রপাতের মৃদুমন্দ কলকল ধ্বনি কানের
পর্দায় সুমধুর সুরের লহরী তোলে।
এক বিশাল শক্ত শিলার পাহাড়ের ভিতরে প্রবেশ করে জীবনের বহুদিনের প্রতীক্ষার ফসল
মাধবকুন্ডের সামনে দাড়াই। তিনশত ফুট উপর হতে মাঝারি জলের তুড় সবেগে নেমে আসছে
নিচের এক সুরম্য জল সরোবরে। চারপাশে ঠান্ডা জলকণা
ও ঝড়হাওয়া বইছে। সরোবরের জল যেন উদম নৃত্য করছে। সরোবরের জলে নেমে সাঁতার কেটে
আনন্দে আনন্দে মন ভরে যায়। এখানে এসে অনেক লোক দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যাবার কাহিনি প্রায়ই শুনতাম, তাই জলের তুড়ের নিকট সাঁতার কেটে যাইনি আমরা
কেঊ।
পানি
ছিটাছিটি খেলা শেষে উঠে পাথরখন্ডে
বসেবসে খাবার খাই। পাথরের গায়ে লোকেরা কিছুনাম লিখে গেছে, প্রায়ই নিজনাম যোগ প্রেমিকার নাম।
উপরের প্রাচীন মন্দির দেখে পাহাড় বেয়ে বেয়ে তিনশত ফুট উপরে ঊঠি। মাত্র এগার বছর বয়সে এযেন
এক দুঃসাহসী আডভেঞ্চার। সেখানে আরোহন করে দেখলাম উচ্চভূমি হতে
একটি পাহাড়ি ছোট্ট ছড়া (ঝরনা)
এসে সামনে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই লাফিয়ে পড়া জলরাশির নাম মাধবকুন্ড। এই ছড়াটি শেওলাঢাকা
পিচ্ছিল। এখানে পা পিছলে গেলে খবর আছে, সোজা চলে যেতে হবে জলের সাথে তিনশত ফুট
নিচের স্বর্গ সরোবরে। এখান থেকে নিচে পড়ে অনেক লোকের সলিলসমাধি হয়েছে বারবার, তাই ছিলাম সাবধান। সেইদিন সাত আট মাইল পায়ে হেঁটে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফিরে এসে রাতে ডুবে যাই
গভীর নিদ্রায়।
রেলগাড়ি চড়ে সেকালে নানাবাড়ি দক্ষিণভাগ (পাতারিয়া) আসা যাওয়া ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সিলেট হতে শাহবাজপুরগামী ট্রেনটার নাম ছিল লাতুর ট্রেন। দাউদপুর (রেঙ্গা) হতে বর্ষায় বুড়িবরাকের বুকচুরে নৌকায় এবং অবর্ষায় দুই মাইল পায়ে হেঁটে মোগলাবাজার রেলস্টেশনে পৌঁছে লাতুর ট্রেন ধরতে হত। মনে পড়ে শৈশবে কখনো হেঁটে, কখনো আব্বার কোলে চড়ে এই দীর্ঘ হাঁটাপথ পার হতাম। ট্রেন ধরতে প্রায়ই শেষরাতে বাড়ি হতে আমরা বের হতাম। আমাদের বাড়ির পোষা কুকুরটি সাথে যেত, সে রাস্তার দুইপাশে ঘাসগুচ্ছে প্রস্রাব করে করে আমাদেরকে সুদুর মোগলাবাজার রেলস্টেশন পৌঁছে দিয়ে ট্রেন ছেড়ে যাবার পর বাড়ি ফিরে আসত। কুকুরের প্রভূভক্তি ও কৃতজ্ঞতার কোন তুলনা এই দুনিয়ায় নেই।
স্টেশনমাস্টার সজুরে চিৎকার করে করে রেলের স্পেশাল ফোনে সিলেট ও ফেঞ্ছুগঞ্জ রেলস্টেশনের সাথে যোগাযোগ করতেন। তার হ্যালো হ্যালো আওয়াজ স্টেশনের সবপ্রান্ত হতে শুনা যেত, এযেন সশব্দে হুঙ্কার দিয়ে সিলেট ও ফেঞ্ছুগঞ্জের কানেখাটো স্টেশন মাস্টারকে বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। রেলস্টেশনের সামনে ঝুলানো ঘন্টায় টং টং শব্দ বাজলে টিকেট কিনতে লোক লাইন ধরত। স্টেশনের পিছনে স্বচ্ছ জলের এক পুকুরসহ স্টেশন মাস্টারের লোহা ও টিনের বাসা। স্টেশন মাস্টার নন্দবাবুর মেয়ে এই খোলা পুকুরে ডুবে মারা যায়। ঢাকার লালবাগের কেল্লায় বাংলার সুবাদার নওয়াব শায়েস্তা খান কন্যাস্নেহে পরিবিবির কবরে নির্মাণ করেন এক সুরম্য সমাধিভবন, আর এখানে মোগলাবাজার রেলস্টেশনের পুকুরপারে দিনহীন স্টেশনমাস্টার নন্দবাবু এক ছোট্ট স্মৃতিমন্দির নির্মাণ করে নিজের আদরের মেয়েটির দেহভস্ম রেখে দেন। মন্দিরের গায়ে কাচাহাতে ক্ষুধাই করে লিখে দেন- “নন্দবাবুর ছোট্ট মেয়ে চন্দনা, আর কোনদিন আসবেনা, খিলখিলিয়ে হাসবে না।“
দুরের সিগন্যাল খোটার আগায় বসানো হাতটি নিচের দিকে নেমে গেলে মানুষ বুঝে গেল ট্রেন মহাশয় ধারে কাছে এসে গেছেন। তীব্র আলোর সার্চলাইট জ্বালিয়ে বিকটশব্দে ভেপু বাজিয়ে রণহুঙ্কার দিয়ে রাজার মত হেলেদোলে ট্রেনবাহাদুর এসে ধীরে ধীরে স্টেশনে দাড়াতেন। তার হাতে তেমন সময় নেই। তাড়াহুড়া করে যাত্রিরা যে যেদিকে পারেন গাড়িতে ঢুকে যেতেন। ভাগ্যবানরা সিটপান, ভাগ্যহীনরা সুযোগ খোঁজেন পরের স্টেশনে বসার। তবে সে যুগের মানুষজন ছিলেন বেশ উদার, তাঁরা মহিলাদের জন্য নিজসিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন।
রেলগাড়ি চলা শুরু হলে এগিয়ে আসেন
মোগলাবাজারের লোককবি আয়ুব আলী। ছড়ার ছন্দে তিনি বলে যান- “বাড়ি
আমার রেঙ্গা, যেখানে যাই সেখানে করি ব্যঙ্গা। থানা আমার সদর, সবাই করেন কদর। আয়ুব
আলীর গল্প, দানদক্ষিণা অল্প”।
নাকের ভিতর আঙ্গুলের নক দিয়ে নাক খুচানো ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে ছন্দ
ছাড়েন “সাহেবের আঙ্গুল নাকে, দুই চার আনা বেরুবে এই ফাঁকে”।
সিটে বসে ঝিমানো যাত্রীর সামনে আয়ুব আলীর কবিতা- “সাহেব এখন সিটে কাঁইথ, ঘুম হইছেনা
গত রাইত/ সাহেব আমার বড় ভালা, একটু দানে যাইব জ্বালা”।
প্রতিটি যাত্রীর দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণিক ছড়া তৈরি করে যাত্রীদের সমীপে পেশ করতেন তিনি।
আয়ুব আলীর এসব ছড়া শুনে যাত্রীগণ
পকেটে হাত ঢুকাতে বাধ্য হতেন।
এবার আসেন
বেতার বাংলাদেশের একজন খবর পাঠক, তিনি অবিকল নকল করে রেডিও বাংলাদেশের সকাল ৯টার
খবর পড়ে যান। আবহাওয়াবার্তা ”সারাদেশে ঝড়ো হাওয়া বইতে পারে, বজ্রসহ বৃষ্টি কিংবা
শিলাবৃষ্টি হতে পারে” পর্যন্ত পাঠকরে তিনি হাত পাতেন। এবার দুতারা হাতে নিয়ে আসেন
একজন বয়াতি, সাথে ডোলক বাদক, তার কন্ঠে সুর- “তুমি
রহমতের দরিয়া, দোয়া কর মোরে হজরত শাহজালাল আউলিয়া”। “বাবায়
আজান দিয়াছে, সেই আজানে পাথর গইলা পানি
হইয়াছে”। “জায়নামাজ বিছাইয়া বাবা নদী দিলায়
পাড়ি, শুনিয়া রাজা গৌড়গোবিন্দের দিশা গেল উড়ি”। “লোকে
বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার,
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাজার”। গান শেষে
চলে দান।
এবার আসেন বুড়ো
কানা ভিক্ষুক, সাথে হাতধরা জোয়ান বউ, কানার বউ জায়গা বুঝে সুবিধামত মিষ্টগলায় বানী
ছাড়েন- “আল্লায় কোলে দিবা সোনার চান্দ” কানা
সুরকরে জবাব দেন- “আমার আল্লা ও রসুলের নাম”।
কানা বউয়ের গান- “দুই এক টাকা করলে দান, হইব মস্কিল
আসান” কানা পুনরুক্তি ছুড়ে দেন- “আমার আল্লা
ও রসুলের নাম”। এভাবে কানা ও কানাবউয়ের গানে গানে
ভিক্ষা চলে।
এখন সেকালের
ট্রেনে ফেরিওয়ালা ও স্বপ্নে পাওয়া ঔষধের কবিরাজদের যন্ত্রণার
কাহিনি বলব। গলে ঝুলানো ঝুড়ি নিয়ে একের পর
এক আসেন পান সিকারেট, বাদাম, ঘটিগরম চানাচুর বিক্রেতারা। ক্রেতা
আকর্ষণে বিচিত্র ভঙ্গিমায়
বিচিত্র সব শব্দমালা ছুড়ে দেন তারা।
লাল, হলুদ, সবুজ রঙের সরবতের গ্লাসদানী নিয়ে কেউ হাঁটেন, ইসুবগুলের
ভুষির সাথে দুচারটা সাদা তুকমা
গ্লাসের জলে সাঁতার কাটছে।
কবিরাজরা
ছিল ভন্ড, চলন্ত ট্রেনে দাঁড়িয়ে এরা আল্লানবির
নাম নিয়ে অনবরত মিথ্যাভাষণ দিত। তারা বানিয়ে বানিয়ে ভাওয়ালের
রাজার একমাত্র পুত্রের বারংবার বিয়ের পর একেএকে সব রাজবধুদের পালিয়ে যাবার রসাল
গল্প বলত। রাজপুত্রের সর্বশেষ বিয়ে করা হস্তিনী বউ
বাসররাতে যুবরাজকে দুতলা হতে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। যুবরাজ কোনমতে
বেঁচে যান ও নববধুর নামে মামলা করেন। মামলার রায়ের দিন নববধূ বিচারককে বললেন,
মহামান্য আদালত, আজ যে কলম দিয়ে আপনি রায় লিখবেন, যদি সেই কলমে কালি না থাকে তবে
আপনি কি আমার বিরুদ্ধে রায় লিখতে পারবেন? বিচারক বললেন “না”।
এবার রাজবধু
আবার প্রশ্ন করলেন তাহলে এই কলমটিকে আপনি কি করবেন মাননীয় আদালত? এবার বিচারক জবাব
দেন, এই জানালা দিয়ে অকেজো কলমটিকে আমি দূরে ছুড়ে দেব।
এবার নববধু
বললেন মহামান্য আদালত আমি এইরকম একটা কালিহীন নষ্টকলম জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলেছি
মাত্র। এটাই আমার অপরাধ, এবার আপনার রায় দিন।
আশ্চর্যের ব্যাপার
বিচারক রায় দিলেন নববধু নির্দোষ, খালাস।
এই নামরদ
রাজপুত্রকে তার স্বপ্লে পাওয়া ঔষধ দিয়ে ভাল করতে গেলে ভাওয়ালের
রাজা বললেন সারা দুনিয়ার যত ডাক্তার কবিরাজ সব ফেল।
কবিরাজ বলেন, মহারাজ আমি গ্যারান্টি দিলাম ঔষধে কাজ না হলে
সব টাকা ফেরত, আপনি যে শাস্তি দিবেন মাথাপেতে নেব। রাজা রাজি হন, মাত্র এক সাপ্তাহের চিকিৎসায় সব ঠিক। খুশীতে আত্মহারা রাজপুত্র ও তার হস্তিনী
রাজবধু তাকে প্রচুর এনাম উপহার দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানান।
আল্লার নবি স্বপ্নে তাদেরকে ঔষধ তৈরি শিখানোর বিচিত্র কাহিনি তারা বলত। কেউকেউ কাবাশরিফে হজ্ব করতে গিয়ে আল্লার ঘরে গায়বি ঔষধ পাওয়ার কাহিনি পেশ করত। তারা ঔষধে কাজ না হলে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার ওয়াদা করত। বোকা জনতাকে বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে এভাবে এরা প্রচুর আজেবাজে ঔষধ বিক্রি করে পকেট গরম করত। একদিন হাজি দাবিদার একজন ডাক্তারের ভাষণের জ্বালায় সুবিধা করতে না পেরে পরবর্তী স্টেশনে নেমে অন্য স্বঘোষিত ডাক্তার তাকে রেগে বলছে, হেই বেইমানের ঘরের বেইমান, তুই কোনদিন রে হজ্বে গেছিছ, তোর চৌদ্দসিঁড়ির কে রে মক্কার মাটি দেখছে। ভাওয়ালের রাজবাড়ি কোনদিকে, বলতে পারবি। ফাঁকা বুলি মারার জায়গা পাছ না।
ভন্ডহাজি কবিরাজ তখন বলছে, চুপ, চুপ, গাড়ির লোকজন শুনে ফেলবে।
বড় ডাব্বা মেরেই ফেলসিছ, এখন লোকে জেনে গেলে আর কি।
কুলাউড়া
জংশনে এসে ইঞ্জিন বদল হত। স্টেশনের সবকটি দেয়ালে পানের পিক ফেলে এক বিশ্রি অবস্থা তৈরি করত সেকালের বিবেকহীন লোকজন। এখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকত অনেকক্ষণ। এই জংশনের পাশেই ছিল আমার মায়ের মামাতো ভাই তাহের মামুর বাসা। এই বাসায় সমবয়সী মামাতো ভাইবোনদের সাথে অনেকক্ষণ খোশগল্প
করে মজার মজার নাস্তা সাবাড় করে আবার এসে উঠতাম লাতুর ট্রেনে। এবার ট্রেন
উল্টোযাত্রা করে জুড়ি স্টেশনে থামত। জুড়ি
ছাড়লেই গন্তব্যস্টেশন দক্ষিণভাগ এসে যেত। এই দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার প্রারম্ভে শান্তনদী রত্না ও কুশিয়ারা এবং পরে পাহাড়িয়া খড়স্রোতা জুড়ি নদীর দেখা পেতাম।
গাড়ি সেকেলে, রাস্তা নাজুক, স্টেশনে স্টেশনে লম্বা সময় থেমে থেমে বিড়ম্বনা। ভীড়ের যন্ত্রণায় ছারপোকার কামড় খেয়ে খেয়ে মোগলাবাজার হতে ট্রেনে দক্ষিণভাগ যেতে তিনচার ঘন্টা সময় পেরিয়ে যেত।
ফেঞ্ছুগঞ্জ
ও জুড়িতে হাকালুকি হাওয়রের কুলকিনারাহীন জলরাশি কিংবা দিগন্ত প্রসারিত
সবুজ ময়দান সিলেটের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আমার নয়নের সামনে সাজিয়ে
দিত। পথে পথে অসংখ্য চাবাগান,
টিলার পর টিলা জুড়ে ঘন বনবনানি,
লতাগ্লুগ্ন, রাবার বাগান, আনারাস টিলা, ছায়াবৃক্ষ চলমান ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখে দেখে আমি কবি হয়ে
যেতাম। মোগলাবাজার হতে দক্ষিণভাগ পর্যন্ত প্রসারিত রেলসড়কের দুইপাশের আপরূপ
সৌন্দর্যের স্বর্ণখনিটি ছিল আমার অনেক অনেক
কবিতার উৎসভূমি। এই অতি সুন্দর অঞ্চলটি আমার কবিমনের চারণভূমিতে
পরিণত হয়।
১৯৭৬ সালে আমার মৌলানা মামু মাহমুদুর রহমান চৌধুরী প্রায় সত্তুর বছর বয়সে পাতারিয়ার নানাবাড়িতে আলসার হয়ে মারা যান। সম্ভবত তাঁর ক্রনিক আলসার একদা ক্যান্সারে পরিনত হয়। সিলেট মেডিকেল কলেজে বর্তমান ডাঃ শামসুদ্দিন সদর হাসপাতালে চিকিৎসা করে কাজ হয়নি। নিরাশ হয়ে তাঁকে জন্মভূমি পাতারিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার প্রয়াণে ভাইবোনরা সবাই কান্নাকাটি করলে পূর্ববাড়ির মামা তুতুউর রহমান এসে সান্তনা দিয়ে বললেন, তার সাথে আমার দিবারাতি উঠাবসা, আমি ধর্য্য ধরেছি, তোমরাও আমার মত ধর্য্য ধর। বাড়ির দিঘির পুর্বপারের মাঠে তার নামাজে জানাজা হয়। তিনি চিরকুমার হলেও তাঁর জানাজায় বিভিন্ন মাদ্রাসার শতশত আলেম ওলামারা দলবেঁধে এসে যোগদান করেন। বাড়ির সামনের ইশানকোনে হাওরের মাঝে অনুচ্চ টিলাময় জায়গায় নানাবাড়ির পারিবারিক গুরুস্থান। এখানে তাকে আসরের নামাজের আগেই বাপদাদার পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর ইন্তেকালের পর অনেকদিন ধরে হুজুররা দলবেঁধে নানাবাড়ির মসজিদে এসে দোয়াদুরুদ পড়ে তাঁদের প্রিয় মৌলানা সাহেবের জন্য কান্নাকাটি করে লম্বা মুনাজাত করতেন। বাড়ির নর-নারী-শিশু সবাই একত্রে হাত তোলে সেই দোয়ায় শরিক হয়ে আমিন আমিন বলতেন। মহান আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাত দান করুন।
সপ্তম শ্রেণি
১৯৭৭ সালঃ
১৯৭৭ সালের দিনগুলো সেভেনে কাটে, এবার ক্লাস সেভেনের গল্প শুনাব। বিগত বার্ষিক পরীক্ষায় তেষট্টি জন ছাত্র অংশগ্রহণ করে। আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন তারপর একজন সম্মানিত শিক্ষকের পূত্র অথচ সামান্য নম্বারের জন্য তৌহিদুল ইসলাম টিপুর কাছে পরাজিত হলাম। হাওরের মাঝে শেয়ালরাজার এতদিনের রাজাসনটি আচমকা হাতছাড়া হয়ে গেল। ফাস্টবয় ও সেকেন্ডবয়ের সবার কাছে বাড়তি সম্মান থাকে ও স্যারদের কাছেও তাদের সমাদরের কমতি হয়না। পরীক্ষায় তৃতীয় হয় শরিসপুরের সালেহ আহমদ।
এই শ্রেণিতে এসে মুরব্বি ছাত্র খলিলুর রহমান ভাইকে পাই। তিনি দারুণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তার চর্মটা কালো ও বয়সটা একটু বেশি, মুখে সব সময় লেগে থাকত মিষ্টি হাসি। তিনি সুন্দর ভাষণ দিতেন। তার ছিল অসাধারণ নেতৃত্বগুণ। বয়সে অনেক প্রবীণ তাকেই আমরা ক্লাস লিডার নির্বাচন করি। আমি হই দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন। এখানেও আমার পদাবনতী ঘটে। খলিল ভাইয়ের পাকাবাড়ি স্কুলমাঠের দক্ষিণ সীমানায়, পিতা ডাঃ কালা গনী। বাসার একদিকে বসত ও অন্যদিকে ডাক্তার চেম্বার ও ল্যাব্রেটরি। তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল, তবে ছোটভাইটি ছিল মানসিক রোগী। বহুবছর আগে খলিলুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আর কোনদিন ফিরে আসেন নি। দেখা হয়নি বহু যুগ ধরে।
কিছুদিন পর এসে ভর্তি হয় দড়ার সদাহাস্য সদালাপী আব্দুস সালাম। আমরা তাকে সলিম নামে ডাকতাম। সলিমের পিছনে বসে অনেকবার হোন্ডা চড়ি। একদিন তার ফিফটি হোন্ডা চালিয়ে একাকী কিনব্রিজের মুখে চলে যাই। হোন্ডা চালানোর এই প্রথমদিনে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় একটি রিকশায় সামান্য ধাক্কা খেয়ে যাত্রাবিরতি দিয়ে মোগলাবাজার ফিরে আসি। সলিম তার লন্ডনি চাচাতো বোনের পানিগ্রহণ করে একদা বৃটেনে চলে যায়। সলিম এখন লন্ডনে কিডনি ডাইলাইসিস করে বেঁচে আছে। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
এই ক্লাসে নেগালের বিধুপালের পুত্র বিশ্বপাল আমার সহপাঠি হয়। মোগলাবাজারে নদীপারে তাদের চালকল ও ব্যবসা ছিল। বিশ্বপাল ক্লাসের দেয়ালে কাটপেন্সিল দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বেশ সুন্দর একটি বড় সাইজের পোট্রেট অঙ্কন করে। এখানে পেয়ে যাই আমার পরম বন্ধু শ্রীতমাল কান্তি ভট্টাচার্য্যকে। জমিদার বংশের তমাল মনন ও ব্যাক্তিত্বে জমিদারই ছিল। এই পরিবারের সবাই আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শ্রদ্ধাভাজন শ্রীতপন কান্তি ভট্টাচার্য্য ছিলেন আমার স্যার। তাছাড়াও এডভোকেট তাপস ভট্টাচার্য্য আমার ভাই তাহমিদের, লেখক কল্যাণ ভট্টাচার্য্য আমার বোন সেহার এবং তাপসি ভট্টাচার্য্য দিদি বড়বোন রেহার হাইস্কুল সহপাঠি ছিলেন। এই স্কুলকমিটির সভাপতি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কংগ্রেসি নেতা শ্রীকৃপেশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন সহপাঠি তমালের গর্বিত বাবা। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক হয়ে সাতবার জেল খাটেন। মহাত্মা গান্ধিজির ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বিলাতি কাপড় বৃটিশ আমলে বর্জন করেন এবং দেশীয় তাতের তৈরি খদ্দর পরে সারাটা জীবন কাটান। তিনি তেজস্বী বাগ্মী, স্কুলের নানা অনুষ্ঠানে তার জ্ঞানগর্ব ভাষণ শুনে আমরা মুগ্ধ হতাম। আব্বা বলতেন ভট মহাশয় তার জ্যাঠার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিকে নিজ সন্তানের মত আগলে আছেন। তমাল লম্বা ও উজ্জ্বল শ্যামলা। একমাত্র পুত্রের জনক তমাল ভট্টাচার্য্য এখন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক।
তুড়ুকখলার
স্মার্ট মেয়ে সামিয়ানা আকতার দিপা ঠুটে লিপস্টিক দিয়ে খুব সেজেগুজে স্কুলে আসত।
তার এত সাজগুজ দেখে এক সহপাঠি কানের কাছে ছোট করে বলে উঠে হাউছের ঘটি। এই শব্দটি
তার কানে পৌঁছা মাত্র সে রেজিল, ফাজিল, বেতমিজ বলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এই
রেগে যাওয়াটা তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। যদি সে হেসে উড়িয়ে দিত তবে কেউ তাকে আর রাগাতো না।
এবার কিছু দুষ্ট ছেলেরা তার পিছু নিল, তারা তাকে একাকী দেখলেই হাউছের ঘটি বলে
জ্বালাতন করত। সিলেটি ভাষায় “হাউছের ঘটি” বলতে মাত্রাতিরিক্ত সৌখিন বা
আবেদনময়ী এমনটি বুঝায়। একদিন এর
প্রতিকারে সে তার চাচাতো ভাই নবম শ্রেণির
ছাত্র জসিমউদ্দিনকে নিয়ে আসে। তিনি এসে বিষয়টা
নিয়ে হৈ চৈ করছেন, এমন সময় ধর্মীয় টিচার বজলুর রহমান এসে ক্লাসে
ঢুকেন। হুজুর স্যারকে নালিশ দিয়ে জসিমউদ্দিন
চলে যান। ঘটনা সত্য হলেও দিপার অভিযোগের
কোন স্বাক্ষী প্রমাণ পাওয়া গেলনা,
তাই স্বাক্ষীর অভাবে মামলাটি সত্য
হলেও মাঠে মারা যায় ও আসামিরা সবাই
পার পেয়ে যায়। তবে হুজুর বজলুর রহমান স্যারের কড়া
হুঁশিয়ারী দুষ্টদেরকে একাজে চিরতরে বিরত করে।
এই বছর
মোগলাবাজারের দক্ষিণের সরকারি পুকুরটি স্কুলমাঠের জন্য বরাদ্ধ হয়। দখলদাররা হুমকি দিল কয়েকটি মস্তক ছিন্ন না করে তারা দখল ছাড়বেনা। পুকুরপারে প্রচুর রবিশস্য ছিল। আলোচনায়
বসলে সে এই রবিশস্য তোলার
সুযোগটা পেয়ে যেত কিন্তু তাদের হটকারিতায় সেই সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল।
একদিন আমরা ছাত্ররা গিয়ে ক্ষেতের ফসল উপড়ে তার টিনের ঘর ভেঙ্গে মাঠটি
স্কুলের দখলে নেই।
এই বছর আরেক নাটক জমে উঠে, ভিলেজ পলিটিকস নাটক। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ভোট প্রার্থী হন। আম্মা আসমতুন্নেছা তীব্র অমত প্রকাশ করলেও শেষমেশ বাধ্য হয়ে মেনে নেন। এই নির্বাচনে অন্য দুইজন প্রার্থীর একজন আব্বার প্রাক্তণ ছাত্র পুর্বতুড়ুকখলার মাহমুদুর রহমান আবুল মিয়া ও দৌলতপুর গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মতাহির আলী। আবুল মিয়া আওয়ামি লিগ করতেন এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি কিছুদিন সরকার নিযুক্ত বিনাভোটের চেয়ারম্যান ছিলেন, লোকে বলত রিলিফ চেয়ারম্যান।
আমাদের
মার্কা ছিল দাঁড়িপাল্লা। এই নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লার ব্যানার লাগানো একটা জিপ
গাড়িতে চড়ে আমি খালেরমুখ হতে রাখালগঞ্জ পর্যন্ত অবিরাম ছুটে বেড়াই।
কুনারচরের তিমুখা,
চৌধুরীবাজার, হিলাইগঞ্জ, রাখালগঞ্জ ও ইন্নাতআলীপুরে মোঠ পাঁচটি অস্থায়ী নির্বাচনী
অফিস বসানো হয়। কিছু অফিস আব্বার খাঁটি
ও একনিষ্ঠ সমর্থকগণ
নিজেরা চাঁদা তুলে চালাতেন। অফিসগুলো পোস্টার
দিয়ে সাজানো হয়। চা বিস্কুটের সুব্যবস্তা ছিল ও লোকে সরগরম থাকত।
তুড়ুকখলায় কালামিয়া, মাওলানা ফরমুজুল্লাহ সায়দা সাহেবের পুত্রগণ, আমার বংশের আবুলেইছ ভাই, আবুদাউদ ভাই, জহিরউদ্দিন কুরেশী রেজোয়ান ভাই, আবুল হাসান চৌধুরী চাচা, হাসিবুর রাজা চৌধুরী চাচা ও গ্রামে গ্রামে আব্বার অনেক প্রাক্তন ছাত্র ও সমর্থক আব্বাকে জেতাতে প্রাণ সপে দেন। তাঁরা দিনরাত প্রচার চালান। নোয়াখালীর একজন হুজুর এখানে চাকুরী করতেন। তিনি আব্বার সার্বক্ষণিক অবৈতনিক সঙ্গী হয়ে যান।
হাকালুকি
হাওরের কিনারঘেষা ইন্নাতালীপুর,
মানিকপুর, মির্জানগর, সিকান্দরপুর, পানিগাঁও ইত্যাদি গ্রামে সেকালে যাবার ভাল রাস্তা ছিলনা।
বর্ষায় গ্রামবাসীরা নৌকায় চলাচল করত ও শীতে জল হতে ভেসে উঠা কাঁচা এবড়ো তেবড়ো মেঠো রাস্তা। এই মেঠো পথে
তিনচার মাইল হেঁটে ভাটির লোকজন রাখালগঞ্জ ও হিলাইগঞ্জ বাজারে আসত।
এই ভোটের
সময় ছিল শুকনো মৌসুম। আমরা হেঁটে হেঁটে
এসব গ্রামে যাই। আব্বার সাথে প্রতিটি জনসভায় চৌধুরীবাজার হতে সত্তুর আশী জন তেজী
সমর্থক শ্লোগান দিয়ে দিয়ে অগ্রসর হতেন। সাথে জিপগাড়িতে করে ভোটের মাইকে বাজত- ‘সামনে আসবে শুভদিন,
পাল্লা মার্কায় ভোট দিন। ‘সবার
সেরা সফিক ভাই, দাঁড়িপাল্লায় ভোট চাই’। ‘সৎ
ও যোগ্য ব্যক্তি সফিক ভাই, সবার কাছে দোয়া চাই’।
প্রতিটি গ্রামে জমজমাট জনসভা হত। তখন বিদ্যুৎ ছিল না,
তাই রাতে মশাল ও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সভা হত। গ্রামের মাতব্বর ধরনের মুরব্বিরা হতেন
সভাপতি। খাস সিলেটি ভাষায় মজার মজার রসাল বক্তব্য
রাখতেন সে আমলের গণ্যমান্যরা।
সিরাজপুরের জনসভায়
মুরব্বী আঁতর আলী বললেন- ‘ভোট দিত দিত
করে বান্দায় দেয় তো না,
তবে বান্দার একটা গুণ না তো
করেনা’। একথা বলার কারণ যারা ভোট চাইতেছে,
ভোটাররা সবাইকে হ্যাঁ বলছে। কাউকে মনে দুঃখ দিচ্ছেনা। ঝাপা
গ্রামের এক মুরব্বী বললেন- মুনাফেক ও বেঈমান চেনার সবচেয়ে
উপযুক্ত সময় হল ভোট। কিছুলোক
প্রার্থীদের টাকা আত্মসাত করার ধান্ধায় থাকে। এরা কার খাবে আর কাকে ভোট দিবে বুঝা
বড় কঠিন। ইন্নাতআলীপুরের একবাড়ির আঙ্গিনায় সভা হয়। কেউ কেউ
অন্য দুই প্রার্থীর বদনাম করলে আব্বা নিষেধ করেন। এখানে আমি জীবনের প্রথম মহিষের
দুধ পান করি। জলারধারে উচু ডিবিতে নির্মিত মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ি। উচু মাটির
ডিবিতে নির্মিত কুড়েঘরের সারি, নিচে করচ ও মুর্তাবনের তলায় জলায় ভাসমান ও ডুবানো
অনেক নৌকার দেখা পাই। হোসেনপুর, বিন্নাকান্দি, রাউতকান্দি্, পানিগাঁও, আবুয়াইল,
ডেরাডেমা, তিরাশীগাঁও, কুনারচর ইত্যাদি গ্রামে গিয়ে আমরা জনসভা
করি। সর্বত্র জনগণের প্রচন্ড সাড়া পাই।
তিনজন প্রার্থীর মধ্যে কেবল আব্বাই ছিলেন গ্রেজুয়েট, প্রবীণ ও উচ্চবংশীয়, অন্যরা ছিল আন্ডারমেট্রিক। আবুল
মিয়ার মার্কা ছিল দোয়াত কলম এবং মোতাহির আলীর হ্যারিকেন বা ল্যান্ঠন।
আবুল মিয়া এবং তাঁর লোকেরা ছিল কূটকৌশলী, তারা জেতায় জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা ভাড়া করল আমাদের বাড়ির উত্তরের কোনারপাড়ার আত্মমর্যাদাহীন লোক ছিতুল আলীকে। সে আবুল মিয়ার বিভিন্ন জনসভায় গিয়ে মাইকে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে- চৌধুরী সাহেব প্রতাপশালী লোক, আমি গরিব মানুষ, তাকে ভোট দিবনা বলায় আমাকে ধরে নিয়ে আচ্চাকরে জুতাপেঠা করেছেন। ছিতুল আলীর কান্নায় ঢাকঢোল বাজিয়ে সাক্ষী হিসাবে শরিক হন আমাদের পাড়ার কালই চৌকিদার, সুরুজ আলী ও ইসকন্দর আলীরা। সভায় অপপ্রচার করে চৌধুরী সাহেব চেয়ারম্যান হলে সাক্ষাতে গেলে তিনচার ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বসার জন্য পিড়িও পাবেনা।
এই ভোটে মিথ্যাচারের কোন সীমা পরিসীমা ছিল না।
অথচ আব্বা ছিলেন সৎ ও ধার্মিক মানুষ। তিনি কাদামাটির মত নরম স্বভাবের লোক, কারও সাথে বিন্দুমাত্র দুর্ব্যবহার করার মত এত নিচ মনমেজাজ তাঁর ছিল না। তাঁর নরম ও পুত স্বভাবের জন্য দাউদপুর গ্রামের অনেক লোকজন তাকে পীরসাব নামে ডাকত।
মিথ্যুকরা মানুষকে বুঝায় চৌধুরী সাহেবকে ভোট দিলে আবার আগের জমিদারী আমল ফিরে আসবে। অথচ সিলেটে সামন্তযুগ একুশ বছর আগে ১৯৫৬ সালে বিলুপ্ত হয়। জমিদারি আমলে কালই উল্লাহ চৌকিদারের ঘর ছিল আমাদের বাড়ির ভিতর, পুত্র সিকন্দর আলী আমাদের সহায়তায় ভাউচারে লন্ডন গেলে হতদরিদ্র কালই চৌকিদার কঞ্চি ফোলে বটগাছ হন ও গ্রামের পুর্বদিকে দড়ার সড়কের ধারে ধানক্ষেতে বাড়ি নির্মাণ করে চলে যান। আমি লক্ষ্য করি আমাদের বাড়ি হতে বেরিয়ে পূর্ব হাওরে বাড়ি করে চলে যাওয়া সদ্য ধনী কিছু লোকজনই এসব অপপ্রচারে শরিক হচ্ছে। গরীব গ্রামবাসী সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের পাশে আছে।
ভোটের
দুইদিন আগে শেষ মিছিল হয়, এই মিছিলে এত লোক ছিল যে, মিছিলের পিছন চৌধুরীবাজারে ও
অগ্রভাগ পুর্ব তুড়ুকখলার সুদুর জোয়াল্লিন মসজিদ পার
হয়ে যায়। মিছিলের অগ্রভাগে ঝাফাগ্রামের একদল
লোক লাটিখেলা প্রদর্শন করে চৌধুরীবাজার হতে রাখালগঞ্জ পর্যন্ত এগিয়ে যান। মানুষের
ধারণা মিছিলকারীর সংখ্যা দুইতিন হাজারের কম হবে না।
মিছিলে সমগ্র রেঙ্গা পরগনা হতে আব্বার অজস্র ছাত্ররা এসে
যোগ দেন। শেষ মিছিলের এত লোক দেখে ভীত বিরোধীরা শ্লোগান তুলে “নাচিনা রে
নাচি না, টাকা খাইয়া নাচি না”
অথচ কোন লোকই কোন কানাকড়ি পেয়ে এই মিছিলে যায়নি।
মিছিল শেষে রাখালগঞ্জ পাঠশালার সামনে শেষ বিরাট জনসভাটি অনুষ্ঠিত
হয়।
মনে পড়ে ১৯৭৭
সালে দাউদপুর ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের সম্মিলিত ভোটসংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজার।
ভোটের দিন ১নং ওয়ার্ড দাউদপুরের ইউনিয়ন অফিসের ভোটকেন্দ্রে গণনা শেষে আমরা বিজয়ী হই। সমর্থকগণ বিজয় মিছিল করেন। ৩নং রাখালগঞ্জ কেন্দ্রে আমরা সামান্য এগিয়ে থাকি। ইউনিয়নের সবচেয়ে শিক্ষিত গ্রাম তুড়ুকখলার জনগণ
ছিলেন আব্বার সমর্থক। সর্বাধিক
ভোটসংখ্যার ২নং ওয়ার্ডে ছিল তুড়ুকখলার অবস্থান। এই
ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র ছিল হিলাইগঞ্জ পাঠশালায়। এখানে প্রতিপক্ষ তাদের ইলেকশন
ইঞ্জিনিয়ারিং পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে। তারা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে
হাত করে গুন্ডাপান্ডা দিয়ে গণনার আগেই তিনটি ব্যালেট বাস্ক ছিনতাই করে নিয়ে যায়। আব্বার সমর্থকরা ভোট বাস্ক উদ্ধারে মারামারি
করতে প্রস্তুত হলে এখানেও তিনি বাঁধা দেন। আব্বা চাইলেন না তাঁর জন্য দাঙ্গা হয়ে
মানুষের রক্ত ঝরূক। পরদিন ভোটের বাস্ক দুটি একটি পুকুর হতে উদ্ধার করা হয়, অন্য বাস্কের সন্ধান মেলেনি।
তুড়ুকখলার একজন যুবক লেইস মিয়া আব্বার বিপক্ষে জালভোট দিতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে যায়। আব্বার ভাগনা
ই এ চৌধুরী তখন পুলিশের ক্ষমতাবান ডিআইজি, লোকে বলল তাকে বলে ওকে লম্বা ডিটেনশনে
পাঠান। কিন্তু তিনচার দিন পার হতে না হতেই
লোকটার বাপচাচারা এসে আব্বার পায়ে পড়ে। আব্বা তাদের ক্রন্দনে গলে যান ও তাকে জেল
হতে বের হবার পথ করে দেন।
চোখের সামনে দেখলাম বিপুল ভোটে বিজয়ী একজন সুযোগ্য প্রার্থীকে কিভাবে ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং করে ত্রিশ চল্লিশটা ভোটে হারিয়ে দেওয়া হল। যদি ভোটের তিনটি বাস্ক ছিনতাই না হত তবে আমরা হাজার ভোটে বিজয়ী হতাম। আজ এতবছর পর যখন সেই নির্বাচনকে মূল্যায়ন করি তখন মনে হয় বাংলাদেশের ভোটের বাজারে অপকৌশলই বড় খেলা, এখানে সততা ও ভালমানুষীর কোন দাম নেই। নেই যোগ্যতা ও শিক্ষাদীক্ষার কোন কানাকড়ি মূল্য। এখানে মানুষ জয়ী হয় ষড়যন্ত্র ও শঠতায়। এখানে অঞ্চলিকতা, বংশবিবেদ, ধর্ম বিরোধ, গোষ্ঠিদ্বন্দ, মিথ্যা ভাষণ, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, জাতপাত, ভোটক্রয়, ঘুষ, গডফাদার ইত্যাদি অপকৌশল কাজে লাগিয়ে সুকৌশলে অযোগ্য দুষ্ট লোকেরাই সর্বদা ভোটে জয়ী হয়। তাইতো দেশের এই দুরাবস্থা।
হুজ্জা নাসিরউদ্দিনের গল্প মনে পড়ে গেল। তিনি তাঁর গাধাকে বাড়ির সুউচ্চ ছাদে নিয়ে যান। উপরের মজা পেয়ে গাধা আর নামতে চায়না। হুজ্জা বাধ্য হয়ে গাধাকে ছাদে রেখে নিচে নেমে আসেন। গাধা ছাদে ভীষণ লাফালাফি শুরু করে এবং ছাদ ভেঙ্গে হুজ্জার মাথায় এসে পড়ে। হুজ্জা এবং তাঁর গাধা মারাত্মক আহত হন, সেইসাথে বাড়িটাও ভেঙ্গে চুরমার হয়। উপরে উঠার সুযোগ পেয়ে গাধা তাঁর নিজ-পর-ঘর সবার সর্বনাশ করে ছাদ ভেঙ্গে তবে নিচে পড়ে। হায়রে বাংলাদেশ, এখানে হুজ্জা নাসিরুদ্দিনের গাধারা ছাদে উঠে, আর দেশ ও জনতার সর্বনাশ ঘটিয়ে তবে ভূলুন্ঠিত হয়।
ইসলামের
ইতিহাস অধ্যয়নকালে যখন হজরত আলী(রঃ) ও মুয়াবিয়ার মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই নিয়ে স্টাডি
করি, তখন দেখলাম হজরত আলী(রঃ) সততা ও ধর্মের মধ্যে থেকে সবকিছুর
সমাধান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি প্রতিপক্ষ মুয়াবিয়ার
অপকৌশলের কাছে বারবার মার খান। সিফফিনের যুদ্ধে হজরত আলীর নিশ্চিত বিজয় ঠেকাতে
বল্লমের আগায় কোরানের আয়াত লটকিয়ে প্রতারণা করা হয়।
জাম্মাতুল জুন্দলের শালিসে ষড়যন্ত্র করে ইসলামি
সাম্রাজ্যের একজন বিদ্রোহী শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে খেলাফতের
দাবীদারে পরিণত করে ফেলা হয়।
১৯৭৭ সালে
বালক বয়সে দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোটে তাঁরি এক ক্ষুদ্রকায় নাটক অভিনয় হতে দেখি। এখানে খলনায়কদের বিজয় হয়, টিপু সুলতান ও সিরাজুদৌলারা অন্তরালে চলে যান।
নির্বাচন মানুষ চেনার জায়গা, ভোটে প্রার্থী হলে কে আসলে আপনার, আর কে নয়, তা সহজে ধরা পড়ে। বাহিরের এমন লোক দেখেছি যাদের সাথে আমাদের কোন পরিচয় নেই, তারা আহার নিদ্রা পরিহার করে প্রাণপনে খেটে গেছে, আবার আমাদের দিঘিতে প্রতিদিন গোসল করে, জমিচাষ করে অন্নসংস্থান করে, সব সময় সাহায্য সহায়তা পায়, এমন সব লোকদেরকেও দেখেছি চক্ষুলজ্জার মাথাখেয়ে প্রতিপক্ষের দলে ভীড়ে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অপপ্রচার করছে।
প্রতিটি গ্রামে পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ থাকে। একদল হাতে এলে অন্যদল ছুটে যায়। তাই দলমত নির্বিশেষে কোন জনপদের ভোট পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। লোকেরা বলত, কোন এলাকার ভোট একমত হলেও ভোটকেন্দ্র আঁধার ঘর, কে কারে ভোট দেয় তা কি দেখা সম্ভব। তাদের মতে ধানের মধ্যে যেমন তুষ থাকে, তেমনি আঁধার ঘরে কিছু ভোট তুষাকারে চলে যাবেই। তাই কোন জনপদে ষোল আনা ভোট পাবার আশা করা ভূল ছাড়া কিছু নয়। আমার বেশ মজা লাগত যখন দেখতাম মুরব্বিরা চার আনা, আট আনা, বার আনা করে কোন গ্রামে কার কত আনা ভোট আছে গুনে গুনে নিজপ্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে দিত।
কাপের পর
কাপ চা ও বাস্ক বাস্ক নাবিস্ক বিস্কুট বাংলোয় পাঠাতে পাঠাতে গলদঘর্ম মা ভোটের
পর হেরেও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভোট
গেল কিন্তু এই ভোটযুদ্ধ সংসারে অভাবের এক চিতা জ্বালিয়ে
গেল। জমি বিক্রির টাকা গেল, বার তেরটা গরু বিক্রি হয়ে ভোটে গেল। যে ঘরে কোনদিন
ধারকর্জ্জ ছিলনা, সেইঘরে এই প্রথম ঋণের
বুজা চাপল, প্রচ্ছন্ন দারিদ্রতা চেপে বসল।
সেকালে নির্বাচন নিয়ে গ্রামের মানুষ বেশ হাস্যরস তৈরি করত। একদা ক্লাসে বসতেই আব্দুস শুকুর বলল, সে শুনে এসেছে লোকে বলাবলি করছে, দলুমিয়ার পাল্লা, কালামিয়ার সাল্লা, মার কলমদি বাল্লা। উল্লেখ্য যে মধ্য তুড়ুকখলার কালামিয়া আব্বার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলেন। একদিন বাড়ির
বড়পুকুরের ঘাটে বসে আছি, কাছে বসেন পাশের বাড়ির বায়াত্তুর সালের বিনাভোটের রিলিফ
মেম্বার মনির আলী। পুকুরপারের রাস্তায় কিছু বালক দলবেঁধে মিছিল করছে-“সুরুজ আলীর
হাতি, মনির আলীর কইলা, হাতির পায়ু ধূইলা”। গতভোটে
সুরুজ আলী ‘হাতি’ ও মনির আলী ‘কলস’ মার্কা নিয়ে মেম্বারি
ভোট খেলেন। মনির আলী হেরে যান
ও সুরুজ আলীর জয়ী হন।
বালকদের চিৎকার শুনে পরাজিত মনির আলীর কাটাগায়ে নুনের ছিটা লাগে। তিনি রেগেমেগে
বললেন, গাঁয়ের মানুষ এই বাউটাটারে ভোট দিল।
আমি জানতে
চাইলাম ‘বাউটা’
আবার কি? মনির আলীর জবাব দেন যারা বাপদাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনগাঁয়ে ঘর বাঁধে
তারা হল ‘বাউটা’। সুরুজ আলী রাখালগঞ্জের আবুয়াইলের
লোক, তাই দাউদপুরে সে একজন ‘বাউটা’।
তিনি আর বললেন, এই বাঊটাদের পরের প্রজন্ম- ‘বাউটার
বাউটা’।
মনির আলী
আবার বললেন এই সুরুজ কেবল বাউটা না, একজন বৈতলও। আমি বললাম মনির ভাই ‘বাউটা’
বুঝলাম, কিন্তু ‘বৈতল’
জিনিসটা কি আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মনির
ভাই বললেন, বাউটারা নিজের টাকায় ভিনগাঁয়ে ঘর বাঁধে,
নিজের গাঁটের পয়সায় খায়। আর বৈতলরা হচ্ছে অলস ও
লোভী, তারা আন্যের কাঁধে চেপে বসে।
মনির আলী
এবার বৈতলের শ্লোক বলেন- ‘বৈতল বৈতল
তিন বৈতল, মামুর বাড়ি ভাগনা বৈতল, শ্বশুরবাড়ি দামান বৈতল, বোনের বাড়ি ভাই বৈতল’।
মনির আলী এবার আর দীর্ঘ গবেষণায় নামেন। এবার তিনি আবিস্কার করলেন-
সুরুজ আলী ডাবল বৈতল। সে মামুর বাড়ি ভাগনা বৈতল, তার উপর মামাতো বোন পুতুল বিবিকে
বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি দামান্দ বৈতল।
সিলেট
অঞ্চলে একটা কথা চালু আছে, স্থান
ছাড়লে মান যায়। বাউটারা সব সময় বহিরাগত হিসাবে
সম্মানহারা, কিন্তু কিছু কিছু বাউটারা স্থানীয়দেরে উৎরে যায় ও শাসন করে। আমি
মনির পুঁতীকে বললাম, আমরা বাউটা বলি আর বৈতল
বলি, সুরুজ আলী এমনই
এক উৎরে যাওয়া ভাগ্যবান যে দাউদপুরে এসে সবার উপর ছড়ি
ঘুরায় অথচ সে আসলে আপনার ভাষায় একজন, সিঙ্গুল বাউটা + ডাবল বৈতল।
মনির
মেম্বার অভিমত দেন লোভী খান্নাছ সুরুজ আলী ধান্দামান্দা করে স্থানীয় লোকজনের
জমিজামা মেরে, বারবার মেম্বার হয়ে সরকারি গমআটা ও রিলিফের মালামাল আত্মসাৎ করে
প্রতিষ্ঠিত, আজ এই বৈতল বাউটায় গৃহী খেদায়। এত এত
কেচ্ছা কাহিনি বলে এই ভোটের হারুপার্টির সদস্য মনির আলী তার মনের জাল মেঠান।
১৯৭৭ সালে
আমি ক্লাস সেভেনে অধ্যয়নকালে বিজ্ঞনের শিক্ষক বামেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য সোনালী
ব্যাংকে যোগদান করেন। এই স্যার ছিলেন ছাত্রপ্রিয় ও সবার কাছে হারান স্যার নামে
পরিচিত। আমরা তাকে তেমন পাইনি, কিন্তু
তার বিদায়সভায় সিনিয়র ক্লাসের অনেক ছেলেকে চোখ মুছতে
দেখি। এবছর স্কুলে যোগদান করেন ধর্মশিক্ষার স্যার মৌলানা বজলুর রহমান। নয়াহুজুর
স্যার তাঁর ক্লাসে সুন্নাত টুপি পরাতেন ও জোহরের
নামাজ সবাই পড়ছে কিনা নজর রাখতেন। আমরা মোগলাবাজার মসজিদ অথবা স্কুলের আশপাশের
গ্রামের মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তাম। হাইস্কুল জীবনে আমি অতিধার্মিক ছিলাম, তাই
জামাতে নামাজ কখনো কাজা হত না।
পাঁচ
ক্লাসের ছাত্রীরা ছাত্রী-মিলনায়তনে
অবস্থান করতেন। প্রতি ক্লাসে ছাত্রীদের ব্রেঞ্চ
আলাদা খালি থাকত। ছাত্রীরা স্যারের সাথে ক্লাসে ঢুকতেন
ও স্যারের পড়ান শেষ হলে একিসাথে বেরিয়ে যেতেন। হুজুরের ক্লাসে মেয়েদেরকে ওড়না দিয়ে
মাথা ঢেকে রাখতে হত। মৌলভী বজলুর রহমান স্যার সিলেট
আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে মৌলানা দেলওয়ার হোসেন সাইদির
জলসায় ওয়াজ শুনতে যান। সাইদির ওয়াজ শুনে
শুনে তার ভাবান্তর হয়। তিনি আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী
পীরের দল হতে বেরিয়ে এসে জামাতে ইসলামে ঢুকে এই দলের একজন স্বনিষ্ঠ কর্মী হয়ে যান। তিনি কানে একটু খাটো
ছিলেন ও একতরফা কথাবার্তা বলেই যেতেন, অন্যের কথা খুব একটা
শুনতেন না।
এইক্লাসে
বাংলা পড়াতেন শ্রী তপন কান্তি ভট্টাচার্য্য। তিনি আমার জমিদার সহপাঠি তমাল ভটের
বড়দাদা। তপন স্যার দীর্ঘাঙ্গ ফর্সা সুদর্শন ও সুপুরুষ। তিনি
পরতেন খয়েরি প্যান্ট ও সাদা হাফসার্ট। হাতে থাকত
ঘড়ি। সেকালে সব লোকের হাতেই ঘড়ি থাকত। ঘড়ি মানুষের স্মার্টনেসের প্রতীক ছিল। তপন
স্যারকে আমরা তফু স্যারও ডাকতাম। তফুস্যার লম্বা
লম্বা পদক্ষেপে হাঁটতেন। তিনি পাঠদানে ছিলেন কঠোর। প্রতিদিন পড়া শিখে তাঁর ক্লাসে আসতে হত, নতুবা রক্ষা হত না।
ক্লাস সেভেনে এসে প্রথম এলজাব্রা নামক অঙ্কের সাক্ষাৎ পাই। আরব বৈঞ্জানিক আল জাবিরের অবিস্কার এই এলজাবরা অঙ্ক শিখতে আমরা অমেলেন্দু স্যারের কাছে টিউশনি পড়তে আসি। ছাত্র আমরা পাঁচজন- টিপু, সালেহ, বেলাল, পুলক ও আমি। স্যার স্কুলের একটি কোঠায় বসবাস করতেন। একটি কেরসিনের চুল্লিতে স্যার নিজে রান্না করতেন। ডিমভাজা ও কেরশিন পোড়ার গন্ধ নাকে আসত। অমেলেন্দু স্যারের গায়ের রঙ গোলাপী, ঘন কালো চুল চীনাদের মত। দেখতে খুব সুদর্শন অমেলেন্দু স্যারকে টিপু দুষ্টামী করে বলত ববিতা স্যার। তাঁকে নাকি স্ত্রীলিঙ্গে রূপান্তর করলে অবিকল হয়ে যাবেন সেকালের অতি জনপ্রিয় নায়িকা ববিতা। এলজাবরা টিপু সবচেয়ে ভাল বুঝতো, তারপর আমি, তবে একবার বুঝে ফেললে মনে হত ডালভাত। অন্য তিনজনের হালত তব্দুল। এলজাবরাকে তাঁরা বলত, জাবড়া অঙ্ক। এলজাবরার মাথা মুন্ডু কিছুই তাঁদের মগজে ঢুকত না।
অমেলেন্দু স্যার ছিলেন স্কুলের অস্থায়ী প্রধানশিক্ষক। আমরা অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকাল শেষে ১৯৭৯ সালের প্রারম্ভে অমেলেন্দু স্যার হঠাৎ ফেঞ্ছুগঞ্জ সার কারখানা স্কুলে সুযোগ পেয়ে যান। সিলেট জেলার এই সেরা স্কুলটি স্যারের জন্য ছিল অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। বিদায় সম্বর্ধণা অনুষ্ঠানে অমেলেন্দু স্যার নিজে কাঁদলেন ও সবাইকে কাঁদালেন। আব্বার সহকর্মী হিসাবে স্যারের কাছে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে কোন টিউশন ফি ছাড়াই আমি বীজগণিত, পাটিগণিত ও জ্যামিতি প্রাইভেট পড়ি। আমাদের সেই অসচ্ছল সময়ে অমেলেন্দু চক্রবর্তী স্যারের সেই সৌজন্যতা আমাকে চিরতরে তার কৃতঞ্জতাপাশে আবদ্ধ করে। ফেঞ্ছুগঞ্জের এন জি এফ এফ স্কুলে আমার বড়বোনের ছেলেমেয়েরা অমেলেন্দু স্যারের কাছে লেখাপড়া করে। আব্বা সেখানে গেলে অমেলেন্দু স্যার তার বাসায় নিয়ে যেতেন। তাদের মায়ার এই বন্ধন বহুদিন বহাল ছিল। অমেলেন্দু স্যার এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন, জানিনা, তবে সারা জীবনভর স্যারকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব, আল্লাহ তাকে সব ধরনের মঙ্গল ও কৃপাদান করুন।
এবছর
নানাবাড়ি হতে ছোট মামা শহিদ চৌধুরীর সাইকেলটি উপহার পেয়ে লাতুর ট্রেনে দাউদপুর নিয়ে আসি। সাইকেলের সিটে বসে প্যাডেল
নাগাল পেতাম না, তাই প্রথমে বগলি চালানো শিখি। বগলি চালাতে গিয়ে চেনের
ঘষা খেয়ে ডান পায়ের চর্ম বারবার জখম হয়। এখানে আর ক্লাস ক্যাপ্টেন হবার
চেষ্টা করি নি, বরং মুরব্বী ছাত্র খলিল ভাইকে
স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেই।
বাড়ির পুর্বভিটার
সামনে একটি সুন্দর জবাফুলের গাছ হয়। গাছটির নিম্নদিক চাগাছের মত সমতল করে কাটা ছিল
ও উপরে কান্ডটা বের হয়ে ডালপালা মেলে একটি ঝোঁপ তৈরি করে। দেখলে মনে হত এযেন একটি বড় ফুলদানীতে সজ্জিত জবা গাছ। আব্বার সেবাযত্নে জবাগাছটি বড় হয়ে একদিন প্রথম একটি লাল জবাফুল ফুটে।
আব্বা ডেকে এনে নতুন ফোটা জবাফুলটি সবাইকে
দেখান। সবাই এই ফুল দেখে আনন্দ করছেন, এমন সময় আসেন আমার অগ্রজা মান্না। তিনি
ফুলটির পানে তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার শুরু করেন, ফুলটির উপর এক ব্যাটা নাকি নাচতেছে
দেখতে পান। মেঝবোন সেহা সাথে সাথে ফুলটি ছিড়ে
ফেলে দেন। এই ঘটনার পর ছোট আপা মান্নার একটি রহস্যময় রোগ আছর করে। সামনে ভূত দেখা,
সবার মাঝে থেকেও ভয় পাওয়া, আবোল তাবুল বকা, বাকহীন ঘুমিয়ে থাকা, মূর্ছা যাওয়া
ইত্যাদি। অনেক তাবিজটুকা করেও তেমন ফল হচ্ছিল না।
তার এই রোগ আমাদের পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট করে ফেলে। তাকে নিয়ে আম্মা ও আব্বার
দুচিন্তার কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। আল্লাহ রাব্বিল আলামিনের অপার মহিমা ও করুণায়
১৯৮৪ সালে তার বিয়ের পর রোগটি চিরতরে বিদায় নেয়।
এবছর আমাদের পরিবারের সবার
সম্মতিতে মেঝবোন সেহার বিয়ে ঠিক হয়। বর
ছিলেন আমার কানিহাটি হাজিপুরের ফুফুতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী।
বিয়ের দিনটি ছিল ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সাল। কোন এক
ঘনবর্ষণমুখর দিনে সুনামগঞ্জ শহরে সেহার জন্ম হয়। জলেভাসা দিনে জন্মের পর সেখানে তার
লকব ছিল জলপরী। এই জলপরীর বিয়ের তিনচার দিন আগ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। চারপাশ
জলে একাকার হয়ে যায়। বাড়ির বাংলোর সামনে বৃষ্টি নিরোধক ছাদসহ সুন্দর প্যান্ডাল
তৈরী করা হয়। বাশের মনোরম গেটও বসানো হয়। বাকপটু বর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী শিল্পনগরী
ছাতকের শ্রমিকনেতা। বিয়েতে
প্রচুর গাড়ি ও বরযাত্রী আসেন। তখনকার মেঠোপথে গাড়িগুলো জলকাদায় আটকা পড়ে। অতিবৃষ্টি সবকিছু
এলোমেলো করে দেয়। ঝম ঝম বৃষ্টিতে খাবার সময় ছাদচুষে পানি পড়ে।
এই বিয়েতে আসেন আব্বার এম সি
কলেজের চার বছরের সহপাঠি ও মেসমেট
সর্বশ্রদ্ধেয় পাকিস্তান আমলের এডিসি হাজিপুরের খুর্শেদ ভাই। তিনি বরের চাচাতো ভাই
কিন্তু আব্বার সমবয়েসী ভাগনা অথচ অন্তরঙ বন্ধুজন। তাদের এই বন্ধুত্ব জীবনের
শেষবেলা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ঢাকার কোন কাজ কিংবা মসকিল আহসান আব্বা তাঁর ভাগনা খুর্শেদ ভাইকে দিয়ে সেরে নিতেন।
আমার চাচাতো মছরু ভাই সিলেট ডিসি অফিসের রেভিনিউ স্ট্যাম্প শাখায় চাকুরি করতেন। একবার তিনি দস্তখত দিয়ে ঢাকা হতে আসা এককোটি
টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প গ্রহণ
করেন। পরে পার্সেল খোলে গুণে
দেখেন দুই লক্ষ টাকার স্ট্যাম্প কম রয়েছে। ঢাকার হেডঅফিসের চোরেরা এই দুই লক্ষ টাকার দায়দায়িত্ব আব্দুস সোবহান কুরেশি মছরু ভাইয়ের ঘাড়ে
চাপিয়ে দেয়।
আব্বা তাঁর ভাগনা হাজিপুরের এডিসি খোরশেদ ভাইকে ফোন করলে তার বদন্যতায় মছরু ভাই রক্ষা পান। আমার এই খোরশেদ ভাই এম পি হাফিজ মজুমদার এবং মন্ত্রী এবাদুর রহমান চৌধুরীর একমাত্র শমনদি ছিলেন। তিনি আজ নেই, আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন।
অষ্টম শ্রেণি ১৯৭৮ সালঃ
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে বাৎসরিক
পরীক্ষায় আমার চিরন্তন একনম্বর স্থানটি টিপুর কাছ থেকে ফেরত পাই। আসলে শহরের ভাল
স্কুলগুলোর মত এখানে এত শিক্ষিত লোকের সন্তানরা লেখাপড়া করত না। এসব ছাত্রছাত্রীদের ধীশক্তিও যে খুব বেশি ছিল তা বলা যাবেনা। এখানে একনম্বর হয়ে আমি যে খুব একটা করে ফেলেছি এমনটি
ভাবার কোন অবকাশ নেই। তারপরও শোকরিয়া
আল্লাহর তিনি আমার সম্মানটা বৃদ্ধি করলেন।
অষ্টম শ্রেণির ক্লাসটিচার
ছিলেন শ্রী সমরেন্দ্র কুমার ধর, তাকে আমরা আই এস সি স্যার নামে ডাকতাম। তিনি ছিলেন
ছোটখাট ও বেঁটে কিন্তু শক্ত ঝাড়ি দেতেন, তাই ছাত্ররা তাকে ভয় পেত ও সমীহ করত। তার
বাড়ি হাজিগঞ্জের সেজদাবাদ গ্রামে। স্যার এই
ক্লাসের গণিত ও বিঞ্জান পড়াতেন। পাঠদানে তিনি ছিলেন কৌশলী এবং পরিশ্রমী।
এই ক্লাসে বাংলা পড়াতেন নিতু
স্যার, তার প্রকৃত নাম নিত্যানন্দ চক্রবর্তী। তিনি আমার সহপাঠি পুলকের বড়দা। স্যার
অতিভদ্র ও শান্তশিষ্ট লোক। সময়নিষ্ঠ
এই স্যার হাঁটতেন ধীরপদে।
এখানে আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী
পড়াতেন ইংরেজি, ভূগোল ও ইতিহাস। ছাত্ররা
বলত দলুমিয়া স্যার। বৃটিশ আমলের গ্রেজুয়েট আব্বা ছিলেন একজন জীবন্ত ইংলিশ
ডিকশনারি। যে কোন ইংলিশ শব্দের অর্থ তিনি মুহুর্তে বলে দিতে পারতেন। পড়া না পেরে
অনেকে তার কানমলা খেত। ১৯৭৯ সালের সূচনালগ্নে অমেলেন্দু স্যার চলে গেলে তার
স্থলাভিষিক্ত হন শ্রীগুণেন্দ্র
চক্রবর্তী।
হেডস্যার রামেশ চন্দ্র
ভট্টাচার্য্য ছিলেন অতিবৃদ্ধ লোক। ধূতি ও পাঞ্জাবি পরে ক্লিনসেভ করে স্কুলে আসতেন। জমিদার ঘরের এই হেডস্যার শেষবয়সে একটু
সর্বাত্মকবাদী নেতৃত্বে ঝোঁকে
পড়েন। কিন্তু সদ্য গণতন্ত্রের আগমনে সেই আগের কতৃত্ববাদী জমিদারী ব্যবস্থাপনার যুগ খতম হয়ে যায়। আমার মনে হয় সেই কারণেই
বিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে ছাত্র শিক্ষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। মোগলাবাজারে তার বিরুদ্ধে পোস্টারিং হয় ও তার অফিসকক্ষ একদিন বিদ্রোহীরা তালামেরে
বন্ধ করে দেয়। হেডস্যার বাধ্য হয়ে
বিদায় নেন, কিন্তু পরে উপযুক্ত
বিদায় সম্বর্ধণা দিয়ে হেডস্যারকে যথাযত সম্মান প্রদর্শন
করা হয়।
অমেলেন্দু স্যার এক বছর অস্থায়ী প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পর ফেঞ্ছগঞ্জ সারকারখানা স্কুলে চলে গেলে নিত্যানন্দ চক্রবর্তী নিতাই স্যার কিছুদিনের জন্য এই দায়িত্বপালন করেন। ১৯৭৯ সালে সবার সম্মতিক্রমে শ্রীগুণেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তী স্যার প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পান। মধ্যম আকৃতির শ্যামলা গুণেন্দ্র স্যারের মাথার তালু একটু টাকপড়া ছিল। গণিত নিয়ে বি এস সি গুণেন্দ্র স্যারের গুণের কোন শেষ নেই। নেতৃত্বগুণ, উচ্চ মেধাশক্তি, মহানুভবতা, ব্যবস্থাপনা সবগুণই স্যারের ছিল। তিনি সুদীর্ঘকাল স্কুলটির প্রধানশিক্ষকের পদে থাকাকালে স্কুলের বেশ উন্নয়ন হয়। এই স্যারের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। নবম ও দশম এই দুই শ্রেণিতে আমি অন্য ছাত্রদের সাথে স্যারের বাসায় গণিত ও বিঞ্জান টিউশনি পড়ি। অথচ আব্বার কাছ হতে তিনি একটি টাকাও গ্রহণ করেন নি। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। এই নিদানকালে তার এই বদন্যতা আমার শিক্ষা জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে সীমাহীন অবদান রাখে। স্যার তখন ছিলেন কুমার, একাকী থাকতেন। একদিকে রাঁধতেন, অন্যদিকে পড়াতেন। স্যারের রান্না করা খাবারের খুসবু বাতাসে উড়ে বেড়াত। গুনেন্দ্র স্যার আমাকে ভালবাসতেন তার নিজ সন্থানের মত।
২০১৯ সালে রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে শ্রীগুনেন্দ্র রঞ্জন চক্রবর্তীসহ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা সম্বর্ধণা দেন। আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া হয় মরণোত্তর সম্বর্ধণা। অনুজ নিশাত কুরেশি ও আমি এই অনুষ্ঠানে যোগদান করি। মোগলাবাজারে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। স্কুলপ্রাঙ্গণ জুড়ে বিশাল প্যান্ডেল এবং সারাটা স্কুলে লম্বা লম্বা সাইনবোর্ডে বিদায়ী শিক্ষকগণের ছবি ও জীবনী ঝুলে আছে। স্কুলে অগেকার শিক্ষকরা কেউ নেই। দুইএক জন ছাড়া আমাদেরকে তেমন কেউ চেনেনা, আমাদের সময়ে কোন মহিলা শিক্ষিকা ছিলেন না, এখন শিক্ষিকাদের ছড়াছড়ি। পাশে টিনের ভবন ভেঙ্গে নির্মিত হয়েছে বিশাল চারতলা ভবন। জনতা ব্যাংকের জি এম রিয়াজ আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণসহ আমাদেরকে প্যান্ডেলে ডাকা হলো। পাশে বসা গুনেন্দ্র স্যারকে বেশ বিমর্ষ মনে হল, গলায় অপারেশনের ক্ষতচিহ্ন দেখে স্যারকে প্রশ্ন করি কি হয়েছে? জবাব শুনে বেশ দুঃখানুভব করি, তুমি কি জাননা আমার গলায় ক্যান্সার হয়েছে। আমার ছাত্ররা কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ভারতে পাঠিয়ে অপারেশন করিয়েছে। রাতে আমার কারে গুনেন্দ্র স্যারকে মিরাবাজারের বাসায় পৌঁছে দেই। তিনচার দিন পর চিকিৎসার সহায়তার জন্য আমি গুনেন্দ্র স্যারের হাতে তিরিশ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেই। তিনি নিতে চাননি, বেশ জুরাজুরি করেই দিতে হলো। পরবর্তীকালে চিকিৎসার জন্য আবার ভারতে যেতে হলে আমি পূবালী ব্যাংকের সিএসআর ফান্ড থেকে তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বরাদ্ধ করে দেই।
এইক্লাসে এসে কুনারচর গ্রামের মুশাহিদ আলী ভাইয়ের দেখা পাই। এই আদুভাই
মুশাহিদ আলী দুই বৎসর আগে এই ক্লাসে আমার খালাতো ভাই তারেক আহমদ চৌধুরীর সহপাঠি ছিলেন। নিয়মিত সেভ করা মুশাহিদ ভাইয়ের এখনই বিয়ে করার
মত উপযুক্ত বয়স হয়ে গেছে। তার সহপাঠিরা অনেকে কলেজে অধ্যয়ন করছেন। ক্লাস সেভেনে
পাওয়া খলিল ভাইয়ের মত তিনিও স্কুলের সবার মুশাহিদ ভাই। তারা সবার বড়ভাই, কেউ তাদেরকে নাম ধরে
ডাকেনা।
এই বৎসর খালেরমুখের ভাঙ্গিস্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এই স্কুলের বেশ
কয়েকজন ছাত্র এসে এখানে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে উলালমহলের আব্দুল আহাদের কথা মনে
পড়ে। অন্যদের নাম মনে নেই। আহাদ সজ্জন ও সুদর্শন, ধীর স্থির বাচনভঙ্গিতে সে কথা বলত। সে এখন ঢাকাদক্ষিণ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এই বছর আমার প্রথম সিনেমা
দেখায় সৌভাগ্য হয়। খালাতো ভাই সাহেদ আহমদ ও আমি নানাবাড়িতে ছিলাম। একদিন বিকেলবেলা টিকেট ছাড়াই লাতুর ট্রেনে
কুলাঊড়া আসি। সিনেমা হলের নাম মনে নেই। সন্ধ্যা পেরুলে দুইটি টিকেট করে আমরা
সিনেমা হলে ঢুকি। দর্শক গ্যালারি ও স্কীনের মধ্যবর্তী জায়গায়
প্রচুর ইদুরের জমানো মাটির স্থুপ। ‘জীবন থেকে নেওয়া’
এধরনের কি একটা নাম ছিল সেই ছবির। তবে ছবিটির গানের দুটি লাইন স্পষ্ট মনে আছে।
নায়িকার কোলে মাথা রেখে আধশোয়া নায়কের মাথার চুলে আঙ্গুলের বিলি কেটে কেটে নায়িকা
গাইছে- ‘মাটির কোলে মাথা রাইখ্যা আসমানের
চান্দ ঘুমাইছে, আমার কেনে ঘুম আইছেনা’। দেড় দুই ঘন্টার সিনেমা দেখা শেষে বেরিয়ে এসে বয়সে আমার চেয়ে একটু ছোট সাহেদ
বলল, সিনেমা যে এত সুন্দর, এত মজার তা আগে জানতাম না, জানলে অনেক আগ থেকে নিয়মিত সিনেমা হলে ঢুকতাম।
তখনকার দিনে টেলিভিশন ছিলনা,
তাই সিনেমা হলে ঢুকা
ছাড়া ছায়াছবি দেখার আর কোন সুযোগ ছিলনা। এখানেও ছিল মুরব্বীদের উৎপাত, তাদের ধারণা সিনেমা দেখা মানে নষ্ট হয়ে একেবারে উচ্ছন্নে যাওয়া এবং
শক্ত গোনাহ করে নিশ্চিত দোযখে যাওয়া। এই দোযখের
হাত হতে মানুষকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে ধর্মীয় রক্ষণশীলেরা সিনেমা হলে হামলা ও ভাংচুর করতেন।
এমন কি এসব ধর্ম সুরক্ষাকারীরা অনেক সময় আগুন ধরিয়ে লাখ লাখ টাকায় সিনেমা হল
পুড়িয়ে ছারখার করে দিতেন।
আমরা দুইজন অভাবী বেকার কিশোর কুলাউড়া জংশনে এসে রাতে আবার টিকেট
ছাড়াই দক্ষিণভাগের ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনভর্তি
অসংখ্য টিকেটবিহীন যাত্রী,
একজন বিপুলবপু সাদা ইউনিফর্ম
পরা টিকেটচেকার আসেন। তিনি দাঁড়ানো লোকদের টিকেট চেক করছেন।
টিকেটবিহীন যাত্রীরা একটাকা দুইটাকা করে তাকে ঘুষ দিচ্ছে। কিছু
ঘুষদাতা যাত্রী টিটি সাহেবের সাদাপ্যান্টের বেল্টের উপর
বেরিয়ে আসা মোঠাপেটে আঙ্গুল দিয়ে খুচা
মেরে মেরে বলছে, আর কত খাইবা এই গাট্টা পেটটা ফোলতে ফোলতে
শেষে ফটাস
করে ফাইট্টা যাবে। মনে হল এই টিটি মহাশয় এসব লোকজনের সুপরিচিত এবং তাকে ঘুষ দিয়েই এই ট্রেনে তাঁরা নিয়মিত বিনা টিকেটে যাতায়াত করেন।
আমাদের পকেটে কোন টিকেট নেই, ঘুষের টাকাও নেই, তদুপরি জনাকীর্ণ গাড়িতে টিকেট ছাড়াই সাহেবের মত সঠান বসে আছি সিটে। এই আসন্ন বিপদে আমাদের বুক ধুকফুক করছে, ভয়ে আল্লাহকে ডাকছি, আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচাও। মহান আল্লাহ পাক আমাদের ডাকে সাড়া দেন। এই টিটি সাহেব সিটেবসা আমাদের টিকেট চেক না করেই সামনা দিয়ে হনহন করে চলে যান, আমরা দুজন প্রাণে সেদিন বাঁচলাম।
বিপদ হতে রক্ষা পেয়ে ট্রেনের সিটে বসে
সাহেদকে বললাম, এই বিপদ শেষ নয়, আর বড় বিপদ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যে সিনেমা দেখেছি একথা কাউকে বলা যাবেনা, কেউ শুনে গেলে দারুণ বদনাম হবে। এমনকি
মোল্লা মামুর কানে এই খবর পৌঁছে গেলে তার হাতে নিশ্চিত পিটুনী খেতে হবে। আমরা দুইজন জীবনের প্রথম সিনেমা দেখে এমন মনোভাব নিয়ে ফেরলাম যেন খুব একটা বড়
অপকর্ম করে মাতুলালয়ে
ফিরছি। আমার এই খালাতো ভাই সাহেদ আহমদ চৌধুরী এখন নিউইয়র্কের বাসিন্দা।
নবম শ্রেণি ১৯৭৯ সালঃ
নবম শ্রেণিতেও আমি ফাস্টবয় হই। এখানে আমরা ক্লাসটিচার হিসাবে টাঙ্গাইল জেলার কাজী রিয়াজ উদ্দিন স্যারকে পাই। বি এ পাশ এই শিক্ষককে আমরা কাজি স্যার নামে ডাকতাম। তিনি ধীরে ধীরে হাঁটতেন, ছেলেরা বলত স্যারের পায়ের তলায় পিপড়ে পরলেও মরবে না। স্যার ইংলিশ গ্রামার পড়াতেন। তিনি এমন মনযোগ সহকারে টেন্স পড়াতেন যে, আমরা ট্রেন্সলেশনে দক্ষ হয়ে উঠি। এই ক্লাসে এসে বিঞ্জান টিচার জলধীর রঞ্জন চৌধুরীকে পাই, তিনি কিছুদিন আগে এসে যোগদান করেন। সিলেট শহরের আদি বাসিন্দা এই স্যার ছিলেন পদার্থ বিঞ্জানে বিএসসি (অনার্স) ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। ঈষৎ মাঝারি আবয়ব ফর্সা এই স্যারের ছিল কালো লম্বাচুল ও ধারাল নাক। তিনি বেশ মেধাবী ও আধুনিক। তিনি আমাদেরকে গণিত ও বিঞ্জান পড়াতেন। একদিন ক্লাসের দেয়ালে কে বা কারা আলকাতরা দিয়ে লিখে রাখে “কুচ কুচ”।
জলধীর স্যার ধরে নিলেন কেউ তাকে মশকরা করে একাজটি করেছে। তিনি আসামী হিসাবে মোগলাবাজারের ব্যবসায়ী চানমিয়ার পুত্র জামালকে সন্দেহ করলেন। তিনি জামালকে এনে বেত মারেন, কিন্তু কয়েকদিন পর বেরিয়ে আসে কাজটা করেছে আরেকটা দুষ্ট কিশোর। এঘটনার পর ছাত্ররা স্যারকে বলত কুচকুচ স্যার। সুদর্শন জামাল আমাদের নিম্নক্লাসে পড়ত ও হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে আসত। জামাল যৌবনে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় এবং একদা দেশে ফিরে এসে বিষপানে আত্মহত্যা করে। আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম, কৌশরের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শুনে তাঁকে শেষবার দেখতে যাই। কুনারচর মসজিদে গিয়ে তার লাশ দেখি, বিষের ক্রিয়ায় লাশ কালো হয়ে গেছে। পরে নামাজে জানাজা ছাড়াই মোগলাবাজার ত্রিমুখার ধারে বুড়িবরাকের পারে তাকে দাফন করে ফিরে আসি। জামালের দুইজন যুবক চাচাও আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। জামালের পিতা চান মিয়া সম্পর্কে এলাকায় প্রচলিত ধারণা ছিল তিনি জুলুমবাজি করে অনেক অসহায় হিন্দুদের প্রচুর জমিজামা কেড়ে নেন। মানুষের ধারণা এসব মজলুম হিন্দুদের অভিশাপে প্রচুর ধনজন থাকাসত্বেও চানমিয়ার পরিবারে অজানা এক আশান্তির আগুন জ্বলত। মানসিক যন্ত্রণার এক অদৃশ্য আগুনে পুড়ে এই পরিবারের একে একে অনেকেই তরুণ বয়সে আত্মহনন করে মারা যান।
এই ক্লাসে সহপাঠি হয় দক্ষিণ তুড়ুকখলার মনিরুল হক ইলিয়াসি মিনার। আমার একক্লাস সিনিয়র মিনার যে কারণেই হোক নবম শ্রেণিতে ড্রপ দেয়। সে কথা বলত বেশি ও নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করত। অন্য ছাত্রদের নিয়ে একটু আধটু হাসিমশকরা করা ছিল তার অভ্যাস। কালো ও দীর্ঘাঙ্গ মিনার পুলিশের সাব ইন্সপেক্টার পদে যোগ দেয় কিন্তু পরে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার চাকুরি চলে যায়।
সাবধান- শুধু বয়স্করা পড়বেন, অবয়স্কদের বারণঃ
নবম ও দশম শ্রেণি ছিল আমাদের মজার মজার গল্পগোজবের বছর। এসব বেশির ভাগই ছিল নারী সম্পর্কীয় রসাত্মক গল্প। ষোল সতের বছরের নব যৌবনে পড়া ছেলেদের মনে এসব গল্পশুনার আকর্ষণ ছিল সুতীব্র। দুজনের কথাবার্তার বড় একটা অংশ দখল করে নিত এসব যৌনতার অলিক কাহিনি ও হাস্যরসে। আমি অলস ক্লাশের গল্পের আসরে বসে শুনা এমন কিছু গল্প বড়দেরকে শুনাতে চাই। যারা আমার মত বয়স্কজন কেবল তাদেরকেই এই রসগল্পগুলো পড়ার অনুমতি দিলাম এবং অন্যদেরকে এই লেখা পড়তে বারণ করি।
এই গল্পের কথক আমার প্রাণপ্রিয় সহপাঠি দক্ষিণ তুড়ুকখলার তৌহিদুল ইসলাম টিপু। একদিন কোন এক ক্লাশের স্যার স্কুলে আসেননি। এই স্যারের ক্লাশে আমরা কয়েকজন কিশোর গোলাকার হয়ে মুখোমুখী বসলাম। টিপু গল্প শুরু করল- শহরের ভবনে একজন সুন্দরী যুবতী একদিন তার শয়নকক্ষের আয়নার সামনে ব্লেড দিয়ে বগলের কেশ সেভ করতে বসেন। তিনি সাবান লাগিয়ে বগল সেইভিং করছেন, এমন সময় ঘরে ঢুকেন এই সুন্দরীর স্বামী। হঠাৎ কক্ষে অনাহুত লোকের আগমন মনে করে হতচকিত হয়ে এই সুন্দরী অসাবধানতা বসতঃ খুবজুরে ব্লেড চালিয়ে দেন।
এবার এই সুন্দরী উফ উফ চিৎকার দিয়ে তার বুক শক্ত করে চেপে ধরে বাহিরে দৌড় দেন। পিছন পিছন কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে তার সাহেবও দৌড়ান। মহিলা পাশের হাসপাতালে গিয়ে সার্জারির ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়েন। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন আপনার স্তনের বোটা নেই, ওটা কোথায়? ওটা নিয়ে আসলে আমরা একটা হালকা অপারেশন করে এখনই জায়গামত লাগিয়ে দেব। মহিলা তার সাহেবকে ভিতরে ডেকে বললেন- এক্ষুনি বাসায় যাও, আমার আয়নার সামনে তুমি একটা ছোট টুকরো পাবে, এটা নিয়ে আস।
সাহেব বাসায় ফিরে আয়নার সামনে গিয়ে কিছমিছের মত কি একটা দেখতে পান। তিনি কিছমিছ মনে করে মুখেপুরে টপকরে গিলে ফেলেন। অনেক খোঁজা খোজি করে কোন মাংশের টুকরা না পেয়ে এবার ভদ্রলোক খালিহাতে হাসপাতাল ফিরে আসেন।
যুবতী ফিরে আসা স্বামীকে পেয়েই বললেন মাংশের টুকরাটি তাড়াতাড়ি ডাক্তার সাহেবের হাতে দাও। ভদ্রলোক বললেন কিসের টুকরা, আমি কিছুই পাইনি। কেবল একটা কিছমিছ পেয়েছি, যা মুখে পুরে খেয়ে ফেলেছি। রসিক ডাক্তার তখন সুন্দরীকে বললেন, ম্যাডাম উনি আপনার কিছমিছটা চিরদিনের জন্য খেয়ে ফেলছেন, আপনি বাঁচলেন, উনি রোজ রোজ আর আপনাকে কিসমিস খেতে জ্বালাতন করবে না। টিপুর এই গল্প শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে বালকেরা।
আবার তাকে আরেকটি গল্প বলতে সবাই চেপে ধরে। এবার টিপু বলল একজন প্রবাসী ভদ্রলোক ও তার বউয়ের কাহিনি। প্রবাসী নতুন বিয়ে করে দেশে রেখে যান যুবতী বউ, বছর দেড়বছর পার করে তিনি দেশে আসেন মাত্র একবার। টগবগে যৌবনা নারী বড় কষ্টে একাকিনী সময় কাটান। বহির্ঘরে জায়গীর থেকে বাড়ির বাচ্চাদেরে আরবি পড়ান একজন তাগড়া জোয়ান মোল্লা মিয়া। প্রবাসীর বেগমের সাথে গড়ে উঠে তার গোপন সম্পর্ক। বাড়ির লোকজনের চোখে ধূলো দিতে বেগমের ঘরের কাটের ওয়ালে মোল্লা মিয়া একটি ছিদ্র তৈরি করেন। গভীর রাতে এই ছিদ্র দিয়ে প্রবাসীর বেগমের সাথে চলে মোল্লা মিয়ার গোপন লীলাখেলা।
একদিন প্রবাসী দেশে ফিরলেন। বাহিরে নানা কাজ সেরে কোন এক গভীর রাতে তিনি ঘরে ঢুকেন। এসে দেখেন তার বউ ঘরের কাটের দেয়ালের পাশে দাড়িয়ে কি যেন করছে। স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন এখানে কি করছ? আচমকা সামনে স্বামীকে দেখে হতচকিত বেগম জবাব দেন, ঘরে হ্যাঙ্গার নেই, তাই আপনার সার্ট রাখার জন্য একটি হ্যাঙ্গার তৈরি করছি। এবার প্রবাসী তার গায়ের সার্ট খোলে হ্যাঙ্গারে রাখতে যান। হাঙ্গারে সার্টটি রাখামাত্র কেমন যেন নড়েচড়ে উঠে হ্যাঙ্গার। প্রবাসী দুইতিন বার সার্ট রাখলেন কিন্তু ঈষৎ নাড়াদিয়ে সার্ট পড়ে যায়। এবার প্রবাসী বউকে বললেন হাঙ্গারটা স্পন্সের মত নরম, ওটা ওয়ালের সাথে সঠিকভাবে ফিট হয় নাই, তাই সার্ট রাখলেই পড়ে যায়। বউ, হাতুড়ি ও পেরেকটা এক্ষুণি নিয়ে এস, আমি হ্যাঙ্গারটাকে দেয়ালের সাথে শক্ত করে গেঁথে দেই।
প্রবাসী হাঙ্গারে পেরেক বসিয়ে হাতুড়ি মেরে হ্যাঙ্গারটাকে দেয়ালের সাথে শক্ত করে গেঁথে দিতেই ঘরের বাহিরে শুরু হয় মোল্লা মিয়ার গগনবিদারী আর্থচিৎকার বাঁচাও, বাঁচাও। তার আর্তনাদে ছুটে আসে চারপাশের লোকজন। এসে দেখেন অর্ধনগ্ন মোল্লামিয়া জট লেগে আটকে আছেন বাড়ির শক্ত কাটের দেয়ালে, মোল্লার ক্রোশবিদ্ধ গর্বের ধন থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত এসে ভিজে গেছে সেই অভিশপ্ত কাটের দেয়াল। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ক্লাস রূমে কিশোরের দল।
তুড়ুকখলার বড়বাড়ির ছেলে কামাল ক্লাসে নতুন এক গল্প বলা শুরু করে। হাসির জ্বালায় কামাল তার গল্প বলতেই পারছে না। কোন এক দম্পতির পাশের কক্ষে ঘুমাত তাদের কিশোরী কন্যা। একদিন রাতে মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে, মাগো ডাইলে পাড়ায়। কিশোরীর মা তার কক্ষ হতে জবাব দেন তুই রাতে বেশি বেশি ডাল খেয়েছিস তাই ডাইলে পাড়ায়, একটু ধৈর্য্য ধর কিছুক্ষণের মধ্যে ভাল হয়ে যাবে।
পরদিন পাশের কক্ষে হতে আবার মেয়েটি মাকে বলল, আম্মা ডাইলে পাড়ায়। মা জবাব দেন ডাল খেয়ে হয়ত গ্যাষ্টিক হয়েছে, তর টেবিলে এন্টাসিড টেবলেট রাখা আছে। একটা চুষেচুষে খেয়ে নে, তাহলে ডাইলে পাড়াবেনা।
তৃতীয় দিন মধ্যরাতে আবার মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে মাগো আজকেও ডাইলে পাড়ায়। এবার মা জবাব দেন, আগামীকাল হতে তুই রাতে আর ডাল খাইবিনা, তাহলে আর ডাইলে পাড়াবে না।
কিছুদিন যেতে না যেতেই মা টের পান তার কিশোরী কন্যা গর্ভবতী। এবার মেয়েকে বকুনি দিলে কন্যা বলল, আমি রোজ রাতেই জানিয়েছি আমাকে ডাইলে পাড়ায়। তোমরা আসনি, ডাইলকে পাকড়াও করনি, কোন প্রতিকার করনি। আজ কেন আমাকে অযথা বকাবকি করছ।
মা বললেন সর্বনাশ, তাহলে অপকর্মটি করেছে আমাদের পাঁজি কাজের পোলা ডাইল মিয়া। হায়রে পোড়াকপাল, নাবালক ফেরেশতা ছাওয়াল ভেবে তাকে আমরা মেয়ের কোঠার মেঝে রাতে ঘুমাতে দিয়েছিলাম। আর সে কিনা আমাদের কচি মেয়েটার বারটা বাজিয়ে দিল।
এবার বালকেরা চিৎকার দিয়ে উঠে- খাইয়া ডাইল লও, খাইয়া ডাইল লও। তখনকার দিনে কাষ্টমার আকর্ষণ করতে সিলেট শহরের বেশকিছু খাবার হোটেল ডাল ফ্রি অফার করে। কিন্তু এই ফ্রিডালের ছিল করুণ দশা, বাটির তলায় দুইচারটি ডালের কণা, উপরে পাতলা পানি। সৌজন্য উপহার এই মাগনা ডাল হতেই ‘খাইয়া ডাইল লও’ শব্দকটি ব্যাপকভাবে সিলেট অঞ্চলের লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। জনতা একে অন্যকে কথার ফাঁকে ফাঁকে মশকরা করে বলত ‘খাইয়া ডাইল লও’।
এবার বালকেরা সবাই পাঁচ সাত মিনিট দিলখোলা হাসি হেসে মোস্তফা কামালকে আবার চেপে ধরে। কামাল বলে তাঁর থলীতে আরেকটা গল্প সঞ্চিত আছে। দেবর ভাবী ও শ্বাশুড়ির হাসির গল্প। প্রবাসী ভদ্রলোক বিয়ে করে সুন্দরী নববধু ঘরে রেখে বিদেশে চলে যায়। তিনি বিদেশ যাবার সময় মাকে বললেন, মাগো, তোমার নুতন বউকে দেখে শুনে রাখবেন, তাঁকে আমানত রেখে গেলাম, যেন কোন খেয়ানত না হয়। মা বললেন, চিন্তা করিস নে বাবা, এটা আমার দায়িত্ব, আমি দেখে রাখব। কিছুদিন পেরিয়ে গেলে শ্বাশুড়ি টের পান নতুন বউয়ের সাথে দেবরের ফস্টিনস্টি হচ্ছে। এবার নিরাপত্তা জোরদার করতে তিনি পুত্রবধুকে বললেন আজ থেকে বৌমা তুমি আমার সাথে রাতে ঘুমাবে।
রাতে পুত্রবধুকে ছটফট করতে দেখে শ্বাশুড়ির সন্দেহ হল। এবার তিনি ঘুমানোর সময় একটি হাত বউয়ের গায়ে চেপে রাখতেন, যাতে কোন অঘটন না ঘটে। এদিকে বুড়ো শ্বাশুড়িমা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলে তার হাতটি ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে চুপেচুপে অন্ধকারে পাশে আসা দেবরের সাথে চলে ভাবীর অভিসার। একদিন হঠাৎ শ্বাশুড়িমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে টের পান বৌমা পাশে নেই। বৌমা তুমি কোথায়? ডাক দিতেই হেস্তন্যস্ত হয়ে ছুটে এসে পুত্রবধু কাছে শুয়ে পড়েন যেন এইমাত্র বাথরুম সেরে এসেছেন। আর দেবর তার কক্ষে পালাতে গিয়ে সশব্দে দরজায় হুচট খায়। শ্বাশুড়ি এ কিসের আওয়াজ, জানতে চাইলে বৌমা বললেন, ঘরের ছাদে বনবিড়াল পড়েছে মা। শ্বাশুড়ি বললেন, না তো, এটা টিনের শব্দ নয়, কাটে ধাক্কা লাগার আওয়াজ। শাশুড়ি তার বউয়ের কোমরের উপর হাত রাখতেই শাড়ি হতে কি একটা পিচ্ছিল জিনিস তার হাতে লেগে যায়। এবার তিনি বউমাকে বললেন, বউমা তোমার শাড়িতে এই পিচ্ছিল জিনিসটা কি? বউ উত্তর দিলেন, এটা তেমন কিছুনা মা, আজ রাতে পাঙ্গাস মাছ বানানোর সময় খুবসম্ভব শাড়িতে পাঙ্গাসের তেল লেগে গেছে। আর যায় কোথায়, ‘পাঙ্গাসের তেল” বলেই হোঃ হোঃ করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে সব সহপাঠি কিশোরের দল।
আমি এবার আমার লন্ডনপ্রবাসী কৌশরের বন্ধু টিপুর শেষরাতের পীরের গল্পের আসরে আপনাদেরকে নিয়ে যাব। অবসর ক্লাশে টিপু বলছে, আর আমি, সালেহ, মিনার, পুলক, বেলাল, মখলিস, তমাল, ওদুদ, ফারুক প্রমুখরা তাকে ঘিরে বসে শুনে যাচ্ছি তার অমৃত রসাল লোককাহিনি। এই গল্পের নায়ক একজন ইয়া দাড়িওয়ালা বুড়ো মুরব্বী মানুষ। বেশ কয়েক বছর আগে যার প্রিয়তমা বুড়িপত্নী জীবন থেকে বিদায় নিয়েছেন।
বিপত্নীক বৃদ্ধ মুরব্বী সৌদি প্রবাসী পূত্রকে বিয়ে দিয়ে পূত্রবধুকে নিয়ে নবনির্মিত দালান বাড়িতে বসবাস করছেন। বুড়ো মুরব্বী একসময় নিজের অজান্তে পুত্রবধুর প্রতি আকৃষ্ঠ হয়ে যান। এক অব্যক্ত বক্ষজ্বালায় বুড়োর রাতে ঘুম হয়না। তাঁর মনে দিনরাত কেবল একটিই ভাবনা ঘুরপাক খায়- কেমন করে পূত্রবধুকে বগলদাবা করা যায়। কেউ ঘুণাক্ষরে জানলেও রক্ষা নেই, মানসম্মান কিছুই অবশেষ থাকবেনা। পুতের বঊ আমাদের সমাজে নিজ কন্যাসম। বৃদ্ধশ্বশুর ভাবেন, কেমনে পুতের বউরে বুঝাই, তার অবৈধ দহনে আমি বুড়ো শ্বশুরবাবা জ্বলেপূড়ে হয়ে যাচ্ছি ছাই।
এবার দুষ্ট শয়তাম বুড়ার পিছু নেয়। শয়তানের কুমন্ত্রনায় পড়ে হঠাৎ বুড়ার মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি এলো। এইবার তিনি এই দুষ্টবুদ্ধিটা বাস্থবায়নে নামলেন। তিনি একদিন পুত্রবধুকে ডেকে নিয়ে বললেন, বউমা আমরা একজন কামেল পীর সাহেবের মুরিদ। তিন প্রজন্ম হয় আমরা তার পরামর্শ নিয়ে চলি। তুমি আজও আমাদের পীরের কাছে যাও নাই, তার উপদেশ বাক্য এখনও গ্রহণ কর নাই। দুষটা তোমার নয়, আমাদের। আমরা তোমাকে তার কাছে না পাঠালে তুমি তার খানকা শরীফ যাবে কেমনে।
এবার পুত্রবধু শ্বশুরবাপের কাছে পীরের ঠিকানা চাইলে তিনি বললেন, এই কামেল দরবেশ বাড়ির পিছনের বনে নদীপারে অশ্বত্থবৃক্ষ তলায় বসে শুক্রবার সারারাত জেগে আল্লাহর ধ্যান করেন। তোমাকে শেষরাতে সেখানে একাকী গিয়ে তার উপদেশ গ্রহণ করতে হবে। শ্বশুরবাপের পরামর্শে এক শুক্রবার শেষরাতে বউমা ছুটলেন পীরের দরবারে, বটতলায় গিয়ে সত্যি একজন ইয়া লম্বা দাড়িওয়ালা জুব্বাদারী কামেল ওলিকে তিনি সেখানে “ইয়া আল্লাহু, ইয়া আল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” জিকির করতে দেখলেন।
দরবেশ একজন নারীর পদশব্দ শুনে ফিসফিস করে বললেন, মা তুমি এতরাতে এখানে কেন এসেছ? কোন বিপদ হয়নি তো? আগুন্তক নারী জবাব দেন আমার শ্বশুরবাপ আপনার উপদেশ নিতে আমাকে পাঠিয়েছেন। এবার দরবেশ বললেন এসো মা, তোমাকে কিছু উপদেশ দিব। নুতন মুরিদাকে পীরসাহেব অনেক ভাল ভাল উপদেশ দেন কিন্তু সব ভাল উপদেশ শেষে একটা মারাত্মক উপদেশও দেন- তোমার অতিশীপর বৃদ্ধ শ্বশুরের সাথে রাতে একই বিছানায় ঘুমাতে হবে, নইলে তোমার উপর ভয়ঙ্কর বিপদ আসবে। তাকে একাকি পালঙ্কে রাতে ফেলে রেখে তুমি খুব অন্যায় করতেছ। এটা বেয়াদবী ও শক্ত গুনাহের কাজ। তুমি তার কাছে শুইবে, নিজহাতে তাঁর সেবাযত্ন করবে, মুরব্বী শ্বশুরবাবা যা বলবেন, তাই করবে। তার কথামত কাজ না করলে মরণের পর আল্লাহপাক তোমাকে নির্ঘাত দোযখের আগুনে পুড়াবেন। তুমি বেহেশতের খুশবুই পাবেনা।
পরদিন ঘুম হতে উঠে বুড়ো তার সুন্দরী পুত্রবধুকে বললেন, বউমা পীরসাহেব তোমাকে গতরাতে কি উপদেশ দিলেন। পুত্রবধু বললেন, সবগুলোই খুব ভাল উপদেশ দিয়েছেন, কেবল একটি উপদেশের কথা আপনাকে বলতে আমার ভীষণ শরম লাগতেছে। তা আবার আপনার কাছে না বলেও কোন উপায় নেই।
অস্থির গলায় শ্বশুর বলেন, কি সেই উপদেশ।
ছেলেবউ বললেন, সেই উপদেশ হল, স্বামী বিদেশ থাকাকালে তুমি গুরুজন শ্বশুরবাবার বিছানায় ঘুমাবে, তিনি যা বলবেন তা বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করবে। গুরুজনের সবকথা মানতে হয়, নইলে তোমাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।
কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে মুরব্বী বললেন, পীরসাহেব যখন বলেছেন তুমি তাই করবে। আগামীকাল রাতে আমার কক্ষে ঘুমাবে।
সেই কালো রাতে শ্বশুরবাবাজী খুব আগুয়ান খেয়ে তার শোবার কক্ষে চলে যান। বৃদ্ধ অস্থির হয়ে ভাবেন, বুড়ি মরে যাবার পর কয়েক বছর ধরে তিনি একটানা উপবাসেই আছেন। বুড়ো শরীরে এখন আগের সেই তাকত নেই। যুবতী পুত্রবধুর কাছে হেরে যাওয়া চলবে না, তার আগে নিজেকে নুতন করে ঝালাই করে নিই।
বুড়ো গায়ে জোয়ানকি আনতে কামশক্তি আরক খান। বুড়োর বিছানায় ছিল একটা ছিদ্র, যা পালঙ্কের ছাওনি বেদকরে নিচে চলে গেছে। তিনি জীবনের পড়ন্ত বেলায় বিছানার এই ছিদ্রপথে যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ শুরু করলেন।
পালঙ্গ তলায় ওৎপেতে বসে থাকা শিকারি হুলো বিড়ালটি দেখল একটা ইদুর ছিদ্রপথে বারবার মাথা বের করে তাকে দেখে ভয়ে আবার ভিতরে লুকিয়ে যাচ্ছে। এবার হুলোটি তার সর্বশক্তি নিয়ে ইঁদুরটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এমন সময় গতরাতের বটতলার পীরের নির্দেশে বুড়োর কক্ষে ঘুমাতে আসেন তার যুবতী পূত্রবধু। ঢুকেই তার কানে আসে শ্বশুরবাবার ঘুঙ্গানোর আওয়াজ। গিয়ে দেখেন সাদা বিছানার চাদরে তাজা রক্তের লাল লাল দাগ। কোঠার এককোনে বসে শিকারি হুলো বিড়ালটি বেগুনের মত লম্বা কি যেন একটা ইঁদুর নিয়ে খেলা করছে।
বৌমা বললেন, বাবা হুলোটা একটি ইদুর মেরেছে, তাই হয়ত চাদরে এত রক্ত লেগেছে। বুড়ো জবাব দেন, এটা ইদুর না বউমা, এটা আমার পাপ। পাপী আমি ভন্ডপীর সেজে তোমাকে বটতলায় নিয়ে গিয়ে কবিরা গোনাহ করেছি। আল্লাহ পাক আমাকে পাপের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন, এবার আমাকে চটজলদি হাসপাতালে নিয়ে যাও।
আমার কিশোর সহপাঠিদের কাছে গল্পের কোন অভাব ছিলনা। তাদের কাছে হাসির গল্প ছিল, কান্নার গল্প ছিল। গল্প শুনতে বসে দিন শেষ হয়ে যেত। আজকাল সমাজে অশ্লীলতার ধারণা বদলে গেছে। হাতের মোবাইলে একটা চাপ দিলেই এমন কোন নগ্নতা নেই যা মুহুর্তের মাঝে চলে আসে না। তাহলে আমার কিশোরবেলার এমন মধুর স্মৃতি বিজড়িত লোকগল্পগুলো আমি কেন লুকাতে যাবো। অনেক ভেবেচিন্তে এই গল্পগুলো শেষপর্যন্ত বয়স্ক পাঠকদের জন্য আমার এই আত্মজীবনীতে সংযুক্ত করে দিলাম।
সেকালে টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেট ছিলনা। রেডিওতে গান আর কত শোনা যায়। তাই সেকালের কিশোরেরা এইসব রসগল্প করে কিংবা খোলামাঠে নানা ধরনের খেলাধুলা করে বিনোদনের কাজটা সেরে নিত। ক্যারম, লুডু, দাবা এবং তাস খেলেও কেউ কেউ সময় পার করত।
কেউ কেউ অশ্লীল বই পড়ত। সেইসব বইয়ে নানা ধরনের কামকেলীর আসনের স্বচিত্র বিবরণ থাকত। তারা এসব বই ঘরে লুকিয়ে রেখে পড়ত। এইসব বইয়ের বাজার ছিল সিলেট শহরের ফুটপাত। আমার এক সহপাঠি কিশোর আমাকে এধরনের একটি বই উপহার দেয়। বইটির নাম ছিল ‘নরম মাংশের স্বাধ’ যা এখনও আমার মনে আছে। বইয়ের এই নাম থেকেই সহজে অনুমান করা যায় বইটির ভিতরে কি ধরনের ময়লা মালমসলা থাকতে পারে। আমি উপহার পাওয়া বইটি বাড়িতে এনে মহাবিপদে পড়লাম, এই বইটি কেমনে পড়ি, কোথায় রাখি। কারও নজরে পড়লে শোনতে হবে কটু কথা, খেতে হবে নির্ঘাত পিটুনী। এখন মোবাইলের যুগ, মোবাইলের কল্যাণে আজকালকার পোলাপাইন, কি যে সর্বনাশ, গোঁফ গজানোর আগেই তাঁরা পেঁকে ঠাসঠাস। শেষমেশ এই বইটি আরেক দুষ্ট ছেলেকে উপহার দিয়ে পুলিশের হাতে আসামী ধরা খাওয়ার আশঙ্কা হতে নিজের প্রাণটা বাঁচাই।
দশম শ্রেণি ১৯৮০ সাল। দশম শ্রেণির দিনগুলো বেশ আনন্দে পার হয়। এবছর আমরা সারাটা স্কুলের সবার বড়ভাই। তাই আমাদের মনে সর্বদা নেতা নেতা ভাব বিরাজ করত। নবম ও দশম এই দুই শ্রেণি মিলে এসএসসির সিলেবাস। তখন ক্লাস করার চেয়ে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত ছিল। জলধীর রঞ্জন স্যার পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি (অনার্স) কিন্তু তার মাথায় সব সময় বিরাজ করত মার্ক্সবাদ। আমাদের সমাজে কালমার্ক্সের তত্বের ব্যবহারিক উপস্থিতি সুন্দর করে বুঝাতেন। জলধীর স্যার সিলেট শহরের উচ্চশিক্ষিত লোক কিন্তু তিনি বুঝতে পারতেন না এই অঁজপাড়াগায়ের সাধারণ জনতার সন্তান, কম ধীশক্তিসম্পন্ন ছেলেরা এসব জটিল ফিলোসফি বুঝতে অক্ষম কিংবা এতে তাদের না আছে কোন আগ্রহ। আমার ছিল তীব্র জ্ঞানস্পৃহা, তাই ভালই লাগত, বারবার প্রশ্ন করে ও আগ্রহ নিয়ে নবতত্ব জানার চেষ্টা করতাম। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নকালে স্যারের প্রদত্ত এই জ্ঞান আমার বেশ কাজে লাগে।
ধর্মশিক্ষার হুজুর বজলুর রহমান বিয়ে করেন স্কুলের পাশের বাড়িতে। এই শ্বশুর বাড়িতে সপরিবারে থেকে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে দেলোয়ার হোসেন সাইদির মাহফিলে গিয়ে গিয়ে মওদুদীবাদের কড়া ঔষধ খেয়ে আসতেন। তার মগজে সর্বদা বাজত দেলোয়ার হোসেন সাইদির ওয়াজের ক্যাসেট। মাথায় ঘুরপাক খেত আল্লার জমিনে আল্লার দ্বীন প্রতিষ্ঠার ধান্ধা। তিনি মওদুদিবাদের শরবত ছেলেদেরকে একটু একটু করে পান করান। আল্লাহ ও তার নবির(সঃ) নাম নিয়ে মওদুদিবাদের শরবত খাওয়ান যত সহজ, কার্ল মার্কসের সাম্যবাদের টেবলেট গেলানো তত সহজ নয়। বরং কিছু ছেলেরা মনে করত কমিউনিস্ট জলধীর স্যার ধর্মবিরোধী লোক এবং তারাই স্যারকে “কুচকুচ” লকব উপহার দেয়। হাইস্কুল ছাড়ার তেত্রিশ বছর পর একদিন রাজা জি সি হাইস্কুলের পাঠাগারে আমার রচিত “ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র” উপহার দিতে যাই। জলধীর রঞ্জন চৌধুরী স্যারকে তখন দেখতে পাই এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আসনে সমাহীন। বইটি হাতে নিয়ে জলধীর স্যার খুব খুশিমনে পাতা উল্টান।
দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসে বেশ মজা হত। গুণেন্দ্র স্যার জারে অক্সিজেন ও হাইড্রজেন তৈরি করা শিখাতেন। আর শিখাতেন জবাফুলের ব্যবচ্ছেদ, ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্র বের করে পরীক্ষা করা ইত্যাদি। একদিন আমার সহপাঠিরা আমাকে ফেলে রেখে ব্যঙের পরিপাকতন্ত্র শিখে নেয়। আমার রাগ হল, আমি ঠিক করলাম বন্ধের দিনে তাদেরকে ফেলে রেখে আমি একাকী ব্যঙের পরিপাকতন্ত্র বিবচ্ছেদ করে শিখব।
প্রধানশিক্ষক গুনেন্দ্র চক্রবর্তী স্যারের অনুমতি নিয়ে বাড়ি হতে একটা বড় ব্যাঙ ধরে আনি। একটি কাচের জারে ব্যাঙটিকে রেখে ওটাকে মারতে গিয়ে এসিডের বোতল হাতে নেই। বোতলটির ছিপি খোলে ব্যঙের উপর সামান্য এসিড ঢালতে যাব তখনি ঘটল দুর্ঘটনা, এসিড এসে পড়ল আমার কাপড়ে। আমি সর্বদা প্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম, ভাগ্য ভাল ঐ ছুটির দিনে পরনে ছিল লুঙ্গি। এসিড এসে পড়ে ডানহাতে ও পরনের লুঙ্গিতে। বিনে আগুনে ধূয়া উড়ে উড়ে লুঙ্গি পুড়তে শুরু করে। পাশে একটা জানালার পর্দা ছিল, লুঙ্গি খোলে ফেলে পর্দাটা কোমরে জড়িয়ে নিলাম। গুনেন্দ্র স্যার দৌঁড়ে এসে হাতে লাগা এসিড ডিস্টিল্ড ওয়াটার দিয়ে মুছে দেন। উরুতে সামান্য ও ডানহাতের চামড়ায় বড় ক্ষত সৃষ্টি হল। ডানহাতের চামড়ায় এই ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে। যদি সেদিন পাশের পুকুরের জলে এসিড সাথে সাথে ধুয়ে নিতাম, তাহলে এই ক্ষত তৈরি হতনা।
প্রতিটি বিষয়ের ব্যবহারিক খাতায় ছবি আঁকাও ছিল বেশ আনন্দের কাজ।
বর্তমান কালে সবাই পাস। কিন্তু সেকালে এসএসসি পরীক্ষায় সবছাত্র পাশ করা সম্ভব হত না। মাত্র ত্রিশ পয়ত্রিশ শতাংশ ছাত্র উত্তীর্ণ হত ও বাকিরা ফেল মেরে ঝরে যেত। ফেলের হার বেশি হলে স্কুলের বদনাম হত এবং সরকারি অনুদান বাঁধাগ্রস্থ হত। তাই টেস্ট এবং প্রিটেস্ট নামে দুটি বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি পাশের অযোগ্য ছাত্রদেরকে বাদ দেওয়া হত এবং সেইসাথে ভাল ছাত্রদের জন্য এসএসসি ফাইন্যাল পরীক্ষার দুইটি রিহার্সেল হয়ে যেত। টেষ্ট পরীক্ষায় আচমকা আমি টিপুর কাছে হেরে যাই। এই হারাটা আমার জন্য ভাল হয়, আমি সাবধান হয়ে যাই। তাই এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষায় আমি টিপুর চেয়ে বিপুল বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হই।
অতি শৈশব হতে আট মাইল দূরের শহর সিলেটে মা বাবার সাথে কতবার যে আসাযাওয়া করি তার কোন হিসেব নেই। আমার এসএসসি পরীক্ষার সিট পড়ে সিলেট শহরের রাজা জি সি হাইস্কুলে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে উঠি দরগামহল্লার মুফতি বাড়ি, ফুফুর বাসায়। বইখাতা ও কাপড়চোপড় নিয়ে উঠি এবাড়িতে বিয়ে হওয়া বড়বোন রেহার ঘরের এক নীরব কক্ষে, যেখানে আছে বড় পালং ও পড়ার চেয়ার টেবিল। প্রতিদিন এসে এসে খাই পাশে ফুফুর বাসায়, আর বসে বসে পড়ি বড়বোনের নির্জন কোঠায়। নামাজের ইকামাত শুনে লাফ মেরে উঠে ত্রিশচল্লিশ হাত দূরে হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগা মসজিদে গিয়ে প্রতিটি জামাত ধরি। শ্রদ্ধাভরে মাজারের কাছে দাঁড়িয়ে জেয়ারত করে ভাল ফলাফলের জন্য প্রার্থনা করি। ফুফুর বাসায় রাখা শাহজালালের(রঃ) পবিত্র খড়মজোড় ও সুদীর্ঘ্য দ্বিফলা তরবারি পরীক্ষা করি। সাতশত বছর আগের এই ওলিআল্লার পায়ের পবিত্র চিহ্ন এখনও অঙ্কিত আছে। আর আছে সেই যুগের মানুষের আঁকা খড়মের পাতলা লালচে রঙ ও সুন্দর কারুকাজ করা বর্ডার। সাতশত বছর ধরে মুফতি পরিবারের প্রতি সিঁড়ির বড়পুত্রের হাত ধরে ধরে এই খড়ম ও তরবারি এসে এখন আশ্রয় নিয়েছে সিলেটের বিয়ের প্রধান কাজি আমার ফুফুত ভাই মুফতি নজমুদ্দিন ওরফে মামুন ভাইয়ের হাতে। সেইদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি বড় হয়ে একদিন আমি এই মহান ওলিআল্লার এক বিশাল জীবনী লিখে ধন্য হব।
এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে। এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা শুরুর বেশ আগে আব্বা রিকশায় করে আমাকে রাজা জি সি হাইস্কুল কেন্দ্রে নিয়ে যান। দুতলার একটি কক্ষে বসে পরীক্ষা দেই। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি পিছনে বিশাল লালদিঘি জুড়ে কচুরীপনার নীল-ধোয়াটে ফুলের বর্ণীল সমারোহ। ঐদিনের বাংলা পরীক্ষা বেশ ভাল হয়। একে একে দশ বিষয়ের পরীক্ষা সমাপন করে একদিন গ্রামের বাড়ি ফিরে আসি।
বিশপঁচিশ দিন পর সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ব্যবহারিক পরীক্ষার ডাক পড়ে। এইখানেও আব্বার একজন ছাত্রের বদান্যতা পাই। তিনি উক্ত স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক তুড়ুকখলার মইনুল হোসেন স্যার। পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত এই মইনুল স্যারের ছিল গালভরা দাড়ি ও পিঙল চোখ। তার অপার মহানুভবতায় পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা, প্রতিটি ব্যবহারিক বিষয়ে পচিশের মধ্যে তেইশ চব্বিশ করে নম্বার পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম স্কুলের পিছনের বিশাল গম্ভীর লালদিঘির ওপারে আমার এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র রাজা জি সি স্কুল দেখা যাচ্ছে। হায়রে সিলেট, দুঃখ হয় এই সিলেটের বিবেকহীন অর্থলোলুপ নগরপিতারা আমার কৌশরে দেখা এই সুন্দর লালদিঘিটাকে গলাটিপে হত্যা করে অসংখ্য অপরিকল্পিত ঘিঞ্জি এলমেলো দোকানপাঠ বানিয়ে ভাগবাটুরা করে নিয়েছে। অথচ জনাকীর্ণ বন্দরবাজারের কাছে লালদিঘিকে কেন্দ্র করে একটি লেকগার্ডেন হলে ব্যস্ত লোকজন এখানে এসে আরামে নিঃশ্বাস নিতে পারত, জায়গাটা হত পর্যটন কেন্দ্র।
পিতা সফিক চৌধুরী বলতেন, তাঁর শৈশবে রাজা জি সি স্কুলের সামনে গোবিন্দ পার্ক ছিল। সেখানে ফুল ফুটত, মানুষ বসে বসে বিশ্রাম নিত, গানবাজনা হত, জনসভা হত। আজ রাস্থা বন্ধ করে জনতাকে ভোগান্তিতে ফেলে জনসভা হয় কুদরতউল্লা মসজিদের পাশে বড় রাস্থায়। সিলেটের সেকালের অবিবেচক জেলাপ্রশাসক হাসান সাহেব পার্কটিকে হত্যা করে জনগনের টাকায় পরের জায়গায় দাতার নাম উচ্ছেদ করে নিজের নামে তৈরি করেন হাসান মার্কেট। একেই বলে ক্ষমতার দাপট। পিতা সফিক চৌধুরীকে আমি সেই সুন্দর গোবিন্দপার্কের জন্য অনেকবার পস্তাতে দেখেছি। আজ সিলেটের লালদিঘি নেই, গোবিন্দপার্কও নেই, হরিলুট হয়ে গেছে। এইখানে বইছে দুই ভিন্ন সময়ের, দুই ভিন্ন প্রজন্মের বিষ নিঃশ্বাস। সেলুইকাস। সেলুইকাস বাংলাদেশ, তুমি আর বসে থেকো না, পরিবেশ বাঁচাতে রুখে দাঁড়াও।
সেকালে এস এস সি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করা ছিল খুব কঠিন কাজ। তখন দশ বিষয়ে মোঠ ৬০০ নম্বর পেলে প্রথম বিভাগ ও কোন বিষয়ে ৮০ নম্বর পেলে তাঁকে লেটার মার্ক ধরা হত। একদিন রেজাল্ট বেরুল, এসএসসি পরীক্ষার মার্কসিট হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সামান্য চার নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ এবং মাত্র দুই নম্বরের জন্য রসায়ন বিজ্ঞানে লেটারমার্ক গেল। কেউ কিছু বলল না, ঘরের সবাই নিরূত্তাপ, যাক ছেলেটা দ্বিতীয় বিভাগতো পেয়েছে। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি, আমার কি যে মনস্তাপ, কি আর করি মনের দুঃখে সারাটা রাতভর কাঁদলাম। দুষ দিলাম নিজেকে, অলস আমি খুব একটা মন দিয়ে পড়িনি, তাও যা পড়েছি সবই আউটবুক। মা আসমতুন্নেসা যদিও বারবার সাবধান করে বলতেন, অলসের ঘর, শূন্য শহর, থাকে বরাবর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন