কালু চাচা খলিলুর রহমান চৌধুরীর অকাল প্রয়াণ
এই বছর ১৯৭৫
সালের ৩০ ডিসেম্বর আমার আব্বার ইমিডিয়েট অগ্রজ কালু চাচা
মারা যান। আমার জন্মের পর বাড়িতে দুসরা মৃত্যু
দেখলাম। গতবছর বড়চাচা, এই বছর কালুচাচা। কালু চাচার
রোগ তীব্র হলে সিলেটে বর্তমান সদর হাসপাতালে তথা আগেকার
সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হাসপাতালে থাকাকালে আমি কয়েক রাত
চাচির কাছে ঘুমাই। কালু চাচা ছিলেন টিবি রোগী। তখনকার দিনে
যক্কা রোগের তেমন চিকিৎসা ছিলনা। বলা হত- যক্কা হলে রক্ষা নাই। এই
রোগ তাকে দীর্ঘদিন ক্ষুরে ক্ষুরে
খেয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। বিখ্যাত
মেডিসিন বিশেষঞ্জ অধ্যাপক আব্দুল খালেক তার চিকিৎসা করেন।
আমার আব্বার অন্য ভাইরা সবাই আশীউর্দ্ধ আয়ু পান, কেবল কালুচাচাই
মাত্র পঞ্চন্ন বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান। তিনি আমাদেরকে খুব স্নেহ করতেন আবার
শাসনও করতেন। নতুন সাঁতার শিখে সারাদিন পুকুরে সাঁতার কাটা আমাদের বদ অভ্যাসে
পরিণত হয়। চাচা কড়াঝাড়ি দিলে আমরা যেদিকে সম্ভব উঠে বাড়িতে
পালিয়ে যেতাম। বড়ভাই তাহমিদ একদিন আঙ্গিনার ধান নষ্ট করে খেলা করলে চাচা ঝড়ি দেন।
চাচার ঝাড়ি খেয়ে তিনি কেঁদে উঠলে চাচা মুড়ি নিয়ে এসে
তাকে আদর করে খাওয়ান। ভাই তাহমিদ এসে আম্মাকে বল্লেন- ছানলাম
ধান, আর চাচায় দিলা খই। গ্রামের মানুষ তাকে খুব ভাল পেত। বাড়ির সামনে ঘন্টাফুলের
তলে তার পাকাব্রেঞ্চি পাতা ছিল। লোকজন এসে হুঁকা টেনে টেনে
দুনিয়ার সব গল্পগোজব করত। অন্তিম সময়ে যখন বাড়ি ফেরেন তখন তাঁর
শরীর মাংশবিহীন কঙ্কালে পরিণত হয়ে যায়। বাড়িফেরার
রাতেই তিনি মৃত্যুযন্ত্রণার অশান্তি করে করে শেষনিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। মধ্যরাতে তার একমাত্র পুত্র মতিভাইয়ের কান্না চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে
যায়। দক্ষিণের ঘরে গিয়ে দেখি চাচার লাশ চাদরে
মুড়ে দেওয়া হয়েছে ও পাশে সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
মাদ্রাসার সেক্রেটারি তখন আমার কালিমাটির চাচা,
আমাদের মসজিদ-মাদ্রাসার হুজুররা সবাই
ছুটে আসেন। সেযুগে ফোন বা মোবাইল ছিলনা, মৃত্যুর খবর
পাঠানো ছিল এক কঠিন কাজ। তাই দূরের
বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে মৃত্যুর
খবর দিতে কয়েকজন জন লোক
পাঠানো হয়। সবাই মৃত্যুখবর শূনামাত্র দ্রুত ছুটে আসেন। বাদ জোহর
জানাজায় প্রচুর লোকজন শরিক হন। চাচার গ্রামের ভক্তরা খুব সযতনে
কবর খনন করেন। সবাই কবরটির সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেন। বাদ
আছর চাচা আমাদের পারিবারিক গোরস্থানের এই মসৃন কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
কিছুদিন পর চাচার পোষা বড় ষাড় গরু জবাই করে তার চল্লিশা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের মাদ্রাসার
হুজুর ও তালবারা আসেন। খতম, জিকির ও
কিয়াম সহকারে দোয়া-দুরুদ হয়। চাচার মৃত্যুর এই
দোয়া মাহফিলে বড়মসজিদের ইমাম তুতামিয়া সাহেব এসে কাঁদো কাঁদো
গলায় আল্লাহকে তুইতুকার করে সুদীর্ঘ মোনাজাত করেন। তুই
রেবা আল্লাহ যদি তর এই গোলামরে মাফ না করস, জান্নাতুল ফেরদাউসে না দেছ, তাহলে আমরা
কেউ উঠবনা, এই হাত নামাব না। মনে হল হুজুরের কান্নায়
আল্লার আরশ কাঁপছে এবং কালুচাচাকে ক্ষমা করে বেহেশতে না পাঠিয়ে আল্লাহপাকের
আর কোন গতি নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন