শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ফুলসাইন্দ পল্লী হাসপাতালের সুচনাকারী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীঃ

 

ফুলসাইন্দ পল্লী হাসপাতালের সুচনাকারী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীঃ

একদিন বাসায় এসে দেখা করেন এক ভদ্রলোক, তিনি ওয়ালী খান। তার বাড়ি পাহাড়ি গ্রাম ফুলসাইন্দ। আমার বাড়ি হতে পাহাড় লাইনে প্রায় তিনচার মাইল পুর্বদিকে অগ্রসর হলেই লালমাটির এই পার্বত্য গ্রামটির অবস্থান। তার গ্রামের প্রবাসীরা একটি হাসপাতাল করবেন। আপাততঃ শুক্রবারে নারী ও শিশুদের চিকিৎসা চলবে, পরে বড় হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। এই হাসপাতালে প্রতি শুক্রবার রোগী দেখার তার অনুরোধে আমরা প্রথমে রাজী নাহলেও পরে মনে হল একটি নতুন প্রতিষ্টানের জন্মদাতা চিকিৎসক হওয়া কম কথা নয়।

প্রথম শুক্রবার দাউদপুর হতে আমরা সেখানে গিয়ে প্রচুর রোগীর ঢল দেখে অবাকই হলাম। এই প্রত্যন্ত জায়গায় অগনিত রোগীরা কোথা হতে এসে এত ভীড় জমাল যেন গরুসিন্নী খাবার ঠেলাঠেলি। ডাঃ নুরজাহান বললেন এত এত রোগী একজন চিকিৎসকের পক্ষে যথাযতভাবে দেখা সম্ভব নয়। ওয়ালী খান বললেন, ভালভাবে দেখার দরকার নেই, কেবল কলমটা ভিজালেই চলবে। তারপরও ডাঃ নুরজাহান যত্নের সাথে রোগী দেখলেন। রোগীদেরকে ঔষধ বিনামূল্যে বিতরন করা হল

জুমুয়ার নামাজ পড়ে ওয়ালী খানের টিলাবাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সামনেই একটি কবরে চিরশায়িত আছেন আমার পাঠশালার প্রিয় শিক্ষক মইন উদ্দিন খান, যিনি ওয়ালী খানের ভাতিজা। পাঠশালা জীবনের নানা স্মৃতি উকি দিল হৃদয়ের কোনে, প্রানভরে স্যারের জন্য দোয়া করে জেয়ারত শেষ করলাম।

ফুলসাইন্দ পল্লী হাসপাতাল নির্মানের জন্য একটি টিলা ক্রয় করেছেন প্রবাসীরা, ওয়ালী খান সেই জায়গাটিও ঘুরে দেখালেন। একদিন হাসপাতালের কার্যক্রম দেখতে আসেন একজন ইংরেজ ভদ্রলোক, যার এই খাতে প্রচুর অনুদান রয়েছে। এই শ্বেতাঙ্গ সাহেব এই এতএত নিরক্ষর ময়লা পুষ্টিহীন নারীশিশুদের চিকিৎসা নিতে দেখে মনে করলেন এদের জীবন প্রনালী উন্নত করতে পারলে অনেক রোগ ঠেকানো যাবে।  ফান্ডদাতা এই বিদেশী চাইলেন পরবর্তী শুক্রবার লোকজনকে স্বাস্থ্যকর জীবন ও রোগ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে একটি গনসেমিনার করা হউকএবার ওয়ালী খান পরবর্তী শুক্রবার এসব রোগীদেরকে নিয়ে রোগ ও পুষ্টি বিষয়ক একটি গনশিক্ষা সভার আয়োজন করলেন।

ওয়ালী খান এই সেমিনারে এবিষয়ে ইংরেজিতে একটি ভাষন দিতে আমাকে অনুরোধ করেন, সেইসাথে এই হাসপাতালের পরিচালক করার ইশারা দেন। পর শুক্রবার রোগী দেখা ও গণস্বাস্থ্য সেমিনার দুটোই হল। বড় একটি ঘরের মেঝে পঙ্গপালের মত ভিড় জমানো সব মা ও শিশু রোগীদের বসানো হল। একটি হোয়াইট বোর্ডে ছবি আকে আঁকে লাউড স্পিকারে ইংরেজ শ্বেতসাহেব এসব লোকজনকে অনেক অনেক পরিচ্ছন্নতা ও পুষ্টিজ্ঞান বিতরন করেন। কৃমি, ডায়রিয়া, জ্বর, কলেরা ইত্যাদি রোগের কারন ও এসব রোগ হতে বাঁচার উপায় বাতলে দেন। এইসব উম্মি লোকজন লালসাহেবের ইংরেজি কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে বলে মনে হলনা, অথচ এমন আচরন করা হল যেন এই সেমিনারের মাধ্যমে রোগীদের মহাউপকার হয়ে গেছে।

ডাঃ নুরজাহানও এই সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। আমি এই বিষয়ে ইংরেজিতে সুদীর্ঘ্য বক্তব্য রাখি। এই বক্তব্যই মনে হয় আমার জীবনের প্রথম ইংরেজি ভাষ। তাই এই ভাষণটি আমার কাছে স্মরণীয় এক ঐতিহাসিক ভাষণই বটেআমার এই ভাষন শ্রব করে বৃটিশ ভদ্রলোক ভাল বেতনে আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের ডায়রেক্টার হবার প্রস্তাব দেন। এতএত রোগী প্রতি শুক্রবারে গিয়ে দেখা বেশ কষ্টকর বিষয়, তাই হবিগঞ্জী অল্পবয়স্কা নতুন চিকিৎসক ডাঃ শিরিন আক্তারকে ফুলসাইন্দ পাঠিয়ে আমরা কোনমতে সরে এলাম।

আমাদের সূচনাকরা ফুলসাইন্দ পল্লী হাসপাতাল এখন একটি টিলায় সাজানো তিনতলা বড় হাসপাতাল, যে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনায় আছে আমাদের মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ এন্ড সার্বিসেস লিমিটেড।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন