আমার
অর্থঋণ
আদালতের কাটগড়ায় দাড়ানোর অভিজ্ঞতা
প্রথমেই বলি
আমি কোনদিনই আইন আদালত উকিল মোক্তারের ধার কাছে যাই নি।
এমন কি যাবার কোন প্রয়োজনও হয়নি। আমাদের পরিবার জন্ম হতেই দেখেছি শান্তিপ্রিয়।
মানুষের সাথে কোন ঝগড়াঝাটিতে আমরা নেই। কারও অপকর্মের আমরা সাথেও নেই পাছেও নেই।
যতটুকু সম্ভব আমরা মানুষের উপকার করেছি, সম্ভব নাহলে নিরব থেকেছি। দুষ্ট লোকজনের
কাছে ক্ষতিগ্রস্থ হইনি তা নয়, তবে আমরা নীরবে সব সহে
গেছি, আইন আদালত পর্যন্ত কাম্মিনকালেও দৌড়াতে যাইনি। হামলা মামলা অশান্তি আমরা সব
সময় উপেক্ষা করে গেছি। তাই একসময় আমরা অস্বচ্ছল হয়ে গেলেও আমাদের পরিবারে মুলতঃ
শান্তির কোন অভাব ছিলনা।
এবার
আদালতের কাটগড়ায় গিয়ে হাজির হলাম, তবে নিজের ব্যক্তিগত কোন প্রয়োজনে নয়।
ব্যাংকে চাকুরি করার সুবাদে আমাকে অর্থঋণ
আদালতের বিচারকের সামনে গিয়ে হাজির হতে হল একবার দুইবার নয়, বারবার বহুবার। তবে
আমার এই কাটগড়ায় দাঁড়ানো কোন আসামী হয়ে নয়, বরং বাদীপক্ষ পুবালী ব্যাংকের
প্রতিনিধি হয়ে। আমি ইদগাহ শাখায় যোগদান করে দেখলাম এখানে
বিগত দিনে প্রদত্ত সমুদয় ঋণের অর্ধেক ঋণই
শ্রেণিকৃত কুঋণ হয়ে আছে। অতীতে
এই শাখায় দিলদার আহমদ নামে একজন ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন পুলিশ
অফিসার। তার আমলে বিতরণ করা অনেক কুঋণই আদায়ে আদালতে
ম্যানিসুট করা হয়েছে এবং ব্যাংক এসব পাওনা আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে ঋণগুলোকে রাইট অফ
করে রেখেছে।
আমি চেয়ারে
বসেই সিন্ধান্ত নিলাম যেমন করেই হউক আমি শাখা মামলা ও কুঋণ
মুক্তকরে পরিষ্কার করে ফেলব। আমাদের ব্যাংকের
প্যানেল উকিল এডভোকেট মশিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে বসে কেসগুলো সম্পর্কে ভালভাবে জেনে
নিলাম। এবার জুরছে মামলা চালাতে তাকে চাপ দিলাম। মুহুরি
দিলশাদ আহমদের সাথেও আমি যোগাযোগ রাখলাম।
একদিন
এডভোকেট মশিউদ্দিন বললেন, ম্যানেজার সাহেব আপনাকে আদালতে মেসার্স আর কে এম ব্রিক্সের মামলায় হাজিরা দিতে হবে। তিনি আমাকে
কিছুটা নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। বললেন প্রতিপক্ষ উকিলের প্রতিটি প্রশ্নের খুব সংক্ষিপ্ত
উত্তর দিতে হবে। সম্ভব হলে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে কেবল ‘হ্যাঁ’
কিংবা ‘না’
বলে সেরে ফেলবেন। ইতিপূর্বে এই মামলাটির ডিগ্রি
আমাদের পক্ষে হয়ে গেছে। বন্ধককৃত জমি বিক্রির এক্সিকিউটিভ মামলা চলাকালে বন্ধকি
জমির উপর মালিকানা দাবি করে বন্ধকদাতার দুই বোন স্বত্ত মামলা করে দেন। এখানে ঋণগ্রহীতা
হলেন ইদগাহ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদের আত্মীয়
সুইট মিয়া কিন্তু জমি বন্ধকদাতা সুইট মিয়া নন, ব্যবসার
বাহিরের একজন তৃতীয়পক্ষ আব্দুল লতিফ।
আমরা আদালতে
ঢুকে আইনজীবী আসনে এডভোকেট মশিউদ্দিন চৌধুরীর পাশে বসলাম।
এবার আমাকে কাটগড়ায় ডাকা হল। প্রতিপক্ষের উকিল ছিলেন আমার একজন সুপরিচিত ও
আত্মীয় ইয়া দাড়িওয়ালা ফরহেজগার উকিল রফিক মজুমদার। এই উকিল
সাহেবকে দেখে আমি বেশ সাহস পেলাম। আসামী পক্ষের উকিল রফিক মজুমদার
আমাকে এই শাখায় কবে জয়েন করেছেন? এই কেইস সম্পর্কে কতটুকু ধারনা রাখেন? এই ধরনের
কিছু মামুলি প্রশ্ন করলেন। এবার
বাদী ব্যাংকপক্ষের আমার উকিল এডভোকেট মশিউদ্দিন চৌধুরীও আমাকে
দুইচারটি প্রশ্ন করলেন। তার শিখিয়ে দেওয়া মুখস্ত বুলি আমি আওড়ে গেলাম। আমার জেরা
শেষ হলে কাটগড়া হতে নেমে এসে আবার সামনের উকিল আসনে গিয়ে বসলাম।
এবার আসামির
কাটগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান আব্দুল লতিফ। লোকটাকে দেখে
আমার খুব চেনা চেনা
মনে হল। তিনি কাটগড়ায় দাড়িয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, আমি একজন বোকা সোকা মানুষ।
ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ এবং তাঁর আত্মীয় ঋণগ্রহীতা
সুইট মিয়া আমার বাসায় গিয়ে ফুসলিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে আমার একমাত্র সম্পদ বাড়িটি
ব্যাংকে বন্ধক করে ফেলেছে। কিসে দস্তখত করেছেন কিছুই তিনি জানতেন না। পরে ব্যাংকের
নোটিশ পেয়ে বুঝতে পারলেন সুইট মিয়া প্রতারনা করে তার এই দস্তখত নিয়ে ভুয়া ইটভাটার
নামে ঋণটি তুলে বিদেশে পালিয়ে গেছে।
আব্দুল লতিফ
আর বললেন সেই ইটভাটায় তার কোন মালিকানাই নেই। তিনি সুইট মিয়া ও দিলদার সাহেবের
প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনের শেষসম্বল ভিটে
মাটি হারাতে বসেছেন। আমার উকিল মশিউদ্দিন বললেন, মাননীয়
আদালত তিনি অলিখিতভাবে এই ইটভাটির মালিকানায় শরিক ছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ
বিনাস্বার্থে কখনও নিজ ভিটেমাটি অন্যকে ঋণ তুলে নিতে
বন্ধক দিতেন না। তিনিও ব্যাংকের এই টাকা
আত্মস্যাতে সুইট মিয়ার সাথে জড়িত রয়েছেন। এই ঋণের
দ্বায় হতে নিজেকে বাঁচাতে এখন তিনি কাটগড়ায় দাড়িয়ে একেবারে আউয়া সিদা লোক
বনে গেছেন এবং মিথ্যা সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন।
হঠাৎ মনে
পড়ে গেল এই আব্দুল লতিফ লোকটি যে খরাদিপাড়ার এক সময়ের আমার প্রতিবেশী ‘টুয়েন্টি
ভাই’। আমি যে বাসায় থেকে এমসি কলেজে পড়তাম সেই
বাসার সাথেই ছিল তার বাসা। সাথে আসা তার ভাগনাকে হাত মিলায়ে বললাম, উনি কি
খরাদিপাড়ার টুয়েন্টি ভাই। ভাগনা বলল হ্যাঁ, আবার বললাম, বন্ধক কি খরাদিপাড়ার সেই
বাসা। ভাগনা বলল, জী স্যার। আমি জানতাম টুয়েন্টি ভাই শিক্ষিত লোক নন, তিনি একদম
সহজ সরল মানুষ, নিশ্চয়ই তিনি প্রতারণার শিকার হয়ে
সর্বস্বহারা হয়ে গেছেন। আর মনে পড়ে গেল আমার সহপাঠীরা একদা তার এই বন্ধকি বাসার
সামনের টিনের ঘরে সারারাত দলবেঁধে পর্নছবি
দেখেছিল।
ব্যবস্থাপক
দিলদার আহমদ প্রদত্ত এই অলক্ষি ঋণটি পরবর্তীকালে একজন কুমিল্লাই ব্যবস্থাপক এনায়েত
উল্লার চাকুরিও খতম করে দেয়। এই ব্যবস্থাপক একদিন কেঁদে
কেঁদে আমাকে বললেন, দিলদার সাহেব কতৃক সৃষ্ট প্রচন্ড চাপে পড়ে
১৫ লক্ষ টাকা সিসি সীমার ঋণটিতে আমি
অতিরিক্ত আর সাড়ে সাত লক্ষ টাকা পেমেন্ট দিতে বাধ্য হই। সিসি ঋণটি
অতিরিক্ত দশলক্ষ টাকা বর্ধিত করার প্রস্থাব সাবেক ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদের
মাধ্যমে তখন হেডঅফিসে পাঠানো ছিল। এনায়েত উল্লা ঠেলায় পড়ে
অতিরিক্ত সাড়ে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করে দেন অথচ
দিলদার আহমদ তার প্রভাব খাটিয়ে হেডঅফিস থেকে ঋণটির লিমিট এক টাকাও বর্ধিত করে আনতে
পারেন নি। উক্ত টাকা পকেটে
নিয়েই দুষ্ট বরোয়ার সুইট মিয়া লন্ডনে পালিয়ে যায়।
এখানে দুইজন
লোককে সুইট মিয়া বিপদে ফেলে যায়, একজন
শাখা ব্যবস্থাপক এনায়েত উল্লা যিনি সীমাতিরিক্ত সাড়ে সাত লাখ টাকা
প্রদান করে এই টাকার দ্বায় নিজের কাঁধে নেন এবং অন্যজন
তৃতীয়পক্ষ জামিনদার ও ভূমি বন্ধকদাতা
আব্দুল লতিফ।
আমি অফিসে
গিয়ে আব্দুল লতিফ টুয়েন্টি ভাইয়ের ভাগনাকে ডেকে আনলাম। তিনি আগাগুড়া
একজন স্মার্ট ভদ্রলোক। এসেই আমাকে মামু বলে ডাকলেন।
তিনি বেশ শান্তশিষ্ট এবং বুঝদার। টুয়েন্টি ভাই নিঃস্ব কিন্তু
তার দুইবোন স্বচ্ছল। আমি তাকে বললাম আমি টুয়েন্টি ভাইয়ের একসময়ের প্রতিবেশী ছিলাম,
তাই সবকিছু ছাড় দিয়ে হলেও এই ঋণটি সমাপ্ত করে দেব।
আপনারা যেহেতু কোন টাকা নেন নাই, অথচ ঋণটি দুষ্টলোকের ফাঁদে পড়ে ভর্তুকি দিচ্ছেন
তাই ব্যাংক আপনাদেরকে যথাসম্ভব
ছাড় দেবে। বন্ধকি ১৬ ডেসিমেল জায়গার ৮ ডেসিমেল আপনার আম্মা ও খালাকে দিয়ে ক্রয়
করিয়ে বাকী ৮ ডেসিমেল ভিটের জায়গা আপনার মামাকে মুক্ত করে দেন। ভাগনা তার লন্ডনী
খালা ও মায়ের সাথে আলাপ করে পজেটিভ রিজাল্ট নিয়ে ফিরে আসে।
এভাবে আমি শাখার লেজার স্থিতি ১৫লক্ষ এবং রাইট অফ ৭লক্ষ ৫৫হাজার সর্বমোঠ
২২,৫৫,০০০/- টাকা একসাথে পরিশোধের বিনিময়ে বিষয়টির নিস্পত্তি করে দিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন