আমার
দেখা একটি জটিল চরিত্র- লুতফুর রহমানঃ
তিনি লুতফুর
রহমান, শাহী ঈদগাহের শাহ মিয়াজির(রঃ) মাজারের বিপরীত দিকের রাস্থা দিয়ে একটু ডুকেই
তার বাসা। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘A man is every
thing, he is nothing. আমার দেখা এই লুতফুর রহমান ছিলেন A
man is every thing. তিনি ঠিকাদার, তিনি আওয়ামী লিগ নেতা, কোন এক
নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লিগের এম পি প্রার্থিও
ছিলেন। তিনি সাংবাদিক, দৈনিক মানচিত্র নামক একটি অনিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা তার
বাসা হতে বের করতেন দেড়দুই শত কপি। কেউ পয়সা দিয়ে কিনে কখনও
তার পত্রিকা পড়ত না, তিনি এই পত্রিকা বিনামূল্যে বিতরণ
করে দিতেন। তবে তিনি বর্তমান কালের এই শতশত এইট পাস সাংবাদিকদের দলে ছিলেন না, তার
শিক্ষাগত যোগ্যতা হয়ত খানিকটা উপরেই ছিল, খুব সম্ভব এস এস সি। তার স্বার্থপরতা ও
সীমাহীন লোভলালসা আশপাশের লোকজনকে বিষিয়ে তুলে। ইদগাহের
অনেক লোকের সাথে তার সৃষ্টি হয় বিবাদ ও প্রকাশ্য শত্রুতা। আমার টেবিলের সামনে বসে
অনেক লোক তাকে বিষেদাগার করত। শাহ মিয়াজির (রঃ) মাজারের
খাদেমি, মসজিদ মাদ্রাসায় মাতব্বরি ও ইদগাহের
সবখানে লুতফুর রহমান সরদারি করে দাপিয়ে বেড়াতেন।
ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদের আমলে একটি
টিলার ধারে তার বস্তি বন্ধক দিয়ে তিনি পূবালী ব্যাংক হতে ঠিকাদারীর কার্য্যাদেশের
বিপরীতে কয়েক লক্ষ টাকা ধার নেন। ব্যাংকের টাকা ধার নিয়ে যে ফেরত দিতে হবে এই ধারণা
তার ছিল না। কয়েক লক্ষ টাকা তার হাতে আটকে গেলে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে ম্যানিস্যুট
করে। তার এই ঋণের দশ লক্ষ টাকা ব্যাংকের লেজারে
স্থিতি রেখে আর পনের লক্ষ টাকা হেডঅফিসে রাইট অফ করা হয়।
দাড়িওয়ালা
বেঁটে ধুর্ত লুতফুর রহমান ঢাকার উচ্চ আদালতে রিট করে করে শুনানি আটকে দিয়ে মামলা
দীর্ঘায়িত করে ইতিমধ্যে
বেশ কয়েক বছর পার করে দেন। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। দৃঢ়
সিন্ধান্ত নিলাম এই ধুর্ত শেয়ালটাকে
আমি হার মানতে বাধ্য করব। কিন্তু তাকে ধাক্কা মারতে গিয়ে আমি তার উল্টো ধাক্কার
কবলে পড়লাম। আমার ডিলের বদলে আসল পাল্টা পাটকেল। আমি মামলাটি আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তির
চেষ্টায় নামামাত্রই লুতফুর রহমানের এক রিটের আবেদনের প্রেক্ষাপটে একদিন উচ্চ আদালত
হতে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে আমার প্রতি আদেশ হলো
আগামী একমাসের মধ্যে আসামীপক্ষকে তিনি যতটি চেক এবং পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা তুলে
নিয়েছেন, সেগুলো ফটোস্ট্যাট কপি সরবরাহ করে দিতে হবে। ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে প্রদত্ত
এতএত চেক ও পে-অর্ডার এত বছর আগের বিভিন্ন দিনের ভাউচার হতে বের করে আনা ছিল এক
কঠিন কাজ। আমার উকিল মশিউদ্দিন চৌধুরীকে বললাম কাজটিত ভীষণ কঠিন, একাজ হতে রেহাই
পাবার কি কোন রাস্থা নেই। তিনি জবাব দিলেন উচ্চ আদালতের নির্দেশ, করার কিছু নেই।
যেমন করেই হউক যথাসময়ে কাজটি করে দিতে হবে।
এই শাখার ঋণ
প্রদান, আদায়, মামলা আমি নিজহাতে একাকী করতাম। তখন ছিল রমজান মাস। আমি কয়েক
শুক্রবার রোজা রেখে রেখে ছুটির দিনে অফিসে এসে টিবয় শাহনাজকে নিয়ে লুতফুর রহমানের
চলতি ওডি হিসাবের সবকটি চেক এবং পে-অর্ডার বিভিন্ন দিনের বাঁধাই করে
রাখা ভাউচার হতে একটি একটি
করে খোঁজে বের করলাম। লোকটা আমাকে এই রমজানে যে অমানুষিক কষ্ট দিলো
ম্যাসেঞ্জার শাহনাজ এবং এক আল্লাহ তার স্বাক্ষী হয়ে আছেন।
তারপর একদিন
এই মামলার শুনানির তারিখে আমার ডাক পড়ল। আদালতে গিয়ে দেখলাম লুতফুর রহমানের উকিল
এডভোকেট মোঃ রফিক মজুমদার বসে আছেন। ইয়া দাড়িওয়ালা তাবলিগি পরহেজগার এই উকিল সাহেব
আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগমের আত্মীয়। এবার আমি দরগাহের বাসায়
গিয়ে আসামির উকিল সাহেবকে ধরলাম। তিনিও জানেন তার মক্কেল যতই চালাকি করুক না কেন
এক সময় আদালতের রায়ে হারবে। তারপরও কেবল সমক্ষেপণ
করে কিভাবে ব্যাংকের পাওনাটা মেরে পার পাওয়া যায় সেই তালে আছেন। এডভোকেট রফিক
মজুমদারকে বললাম, আপনি দয়া করে আমাকে বাঁচান, মামলাটা আমার পানে চেয়ে শেষ করে দেন।
একদিন অফিসে বসে শুনলাম লুতফুর রহমানের
স্কলার্সহোমের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি ফুটফুটে পুত্র হঠাৎ
মারা গেছে। এবার কাজ হল, একদিন লুতফুর সাহেবের ফোন করলেন, ভাই আমি ডায়বেটিসে
অসুস্থ, পুত্রটাও অকালে চলে গেছে, আমি আর ব্যাংকের ঋণ
রেখে মরতে চাই না। ভাই আপনি একটিবার আমার বাসায়
আসলে খুশী হব।
আমি বাসায়
গিয়ে তার পূত্রের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করলাম। লুতফর রহমান রহমানের
পুত্রের চল্লিশার সিন্নীতে তার বাসায় মৃতছেলের দোয়া মাহফিলে আবার গিয়ে শরিক হলাম।
লুতফুর
সাহেবের কথাবার্তা খুব চমৎকার। তিনি বারবার কেবল ছোটভাই, ছোটভাই বলে এতই ডাকহাঁক
দিতেন যে মনে হত আমি তার সহোদর অনুজ। আমি একদিনও
তার বাসা হতে চানাস্তা নাখেয়ে বেরিয়ে আসতে পারি নি।
খুবসম্ভব তার উকিল এবং আমার আত্মীয় রফিক মজুমদারের পরামর্শে তিনি মামলাটি সমাপ্ত
করার সিন্ধান্ত গ্রহন করেন। হয়ত তার উকিল রফিক মজুমদার তাকে বলে দিয়েছেন আপনি
মামালায় হেরে বিপদে পড়বেন, তাই ভালয় ভালয় রায় হবার আগেই
ব্যাংকের সাথে সংলাপের মাধ্যমে নিস্পত্তি করুন। কিন্তু তারপরও দেখলাম তিনি যতটুকু
পারা যায় ব্যাংককে ঠকাবেনই। আমি খাতা ঘেটে এত বছরের
অ্যানচার্জ সুদ বাদ দিয়ে আমার ব্যাংক লেজারে দশলাখ, হেডঅফিসে রাইট অফ পনের লাখ,
মামলা ও বিজ্ঞাপন খরচ দেড়লাখ টাকা ব্যাংকের কাছে পাওনা দেখলাম। ব্যাংকের
এই সাড়ে ছাব্বিশ লাখ টাকার সাথে বিগত দশবার বছরের অ্যানচার্জ সুদ যোগ হলে অঙ্কটি
এক কোটি টাকার ঘর ছুয়ে ফেলবে।
তিনি আমাকে
বললেন ছোটভাই ব্যাংক আমার কাছে মাত্র ছয়সাত লাখ টাকা পাবে। এই টাকাই আমি ধারকর্জ
করে এনে ফেরত দেবো, এই টাকার মধ্যে বিষয়টি নিস্পত্তি করে দিন। আমি এই সামান্য
অঙ্কের টাকায় নিষ্পত্তির কোনপথই খোঁজে পেলাম না।
আমার পরামর্শে তিনি আওয়ামি লিগের লোকজন এবং লোকমান উদ্দিন চৌধুরীর মাধ্যমে আওয়ামি
লীগ এমপি এবং পুবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ মজুমদারকে শক্ত করে ধরলেন। আমি
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম এই ধুরন্ধর মানুষটি মাত্র আটলক্ষ টাকা ব্যাংকে পরিশোধ
করে খুব সহজেই আসামী খালাস হয়ে গেলেন। আমাদের হেডঅফিস হতে দুইলক্ষ টাকা ভর্তুকি ঋণহিসাবে
এসে জমা হয়ে মেসার্স লুতফুর রহমানের লেজারের স্থিতি চিরদিনের জন্য ‘শূন্য’ করে
দিল। সে যাই হউক, আমি এই মামলার সুদীর্ঘ অপযন্ত্রনা হতে রক্ষা পেয়ে মনে মনে
স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেললাম।
আমি ইদগাহে
ব্যবস্থাপক থাকাকালেই একদিন অফিসে গিয়ে শুনি এই লুতফুর
রহমান মারা গেছেন। জীবনভর কেবল
খাই খাই করা এই দুনিয়াদার
মানুষটি মাত্র ঊনপঞ্চাশ বৎসর বয়সে দুনিয়া ছেড়ে
চলে গেলেন।। ব্যাংকের সামনে ইদগায়
তার নামাজে জানাজায় প্রচুর লোক সমাগম হল। আমরাও জানাজায় শরিক হলাম। জানাজা শেষে
তার পুত্র মাইকে কেবল এই কথাটি বলল, আমার মরহুম বাবার কাছে আপনাদের কোন পাওনা
থাকলে সকলে ক্ষমা করে দিবেন। আমি জানাজা শেষে এসে টেবিলে বসামাত্রই লুৎফুর রহমানের
একজন পাওনাদার আমার সামনে এসে বসে বললেন, তার ছেলেটি দেখছি বাবাকে
কয়েক ডিগ্রি উৎরে যাবে। আমি জিঞ্জেস করলাম কেন?
তিনি উত্তরে বললেন, আমি মনে করেছিলাম সে বলবে আপনাদের কারো কাছে আমার আব্বার পাওনা
থাকলে স্বাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করুন, আমার
মরহুম পিতার পাওনা পরিশোধ করে তাকে আমি দ্বায়মুক্ত করে দেব। কিন্তু অজস্র মানুষের
কাছে তার মৃতপিতার যে অনেক অনেক পাওনা রয়েছে তা পরিশোধের ব্যাপারটি সে সুকৌশলে
এড়িয়ে গেল। পুত্র হয়েও জনমদাতা পিতার ঋণ পরিশোধের
কোন দ্বায়দায়িত্ব সে নিল না। সে যে এক্কেবারে
‘বাপকা বেটা, গাছ কা গোটা’।
মনে পড়ে ইদগাহ
শাখায় মেসার্স রহমান এন্টারপ্রাইজ নামক আরেকটি ম্যানিসুট আমি মোকাবেলা করি। এই
ভদ্রলোক দক্ষিণ সুরমার জালালপুর গ্রামের অভিজাত
চৌধুরী পরিবারের লোক। তিনি অল্প বয়সে ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে
ভাগ্য বিপর্য্যের শিকার হন। আচমকা এই চরম বিপদ
এসে তার ব্যবসা বানিজ্য, এমনকি জীবনকে তছনছ করে দেয়। তিনি মারা গেলে একদিন তার
বিধবা পত্নী চাচাত দেবরকে নিয়ে আমার চেম্বারে হাজির হন। ইসলামি ব্যাংকের অফিসার এই
দেবর আব্দুল মুমিন চৌধুরী মাসুম ছিলেন আমার কলেজ সহপাঠি। অল্পবয়স্কা
বিধবা ভদ্রমহিলা বোরকায় অঙ্গঢেকে সামনে বসে বিনয়ের সাথে বললেন, আমার স্বামী তার
সন্তানদেরকে ইয়াতিম করে অকালে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমার পরলোকবাসী স্বামীর
কোন দ্বায়দেনা আমি রাখতে চাইনা। ভাগ্যহীনা এই অকাল বিধবার সুইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়ে
ব্যবস্থাপক আমি যতটুকু সম্ভব ছাড়ের ব্যবস্থা করে দিলাম। একটিমাত্র চেকের মাধ্যমে
এই মন্দ সি সি (লিমিট) ঋণটির সব পাওনা স্থিতি তারা খতম করে দিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন