শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

তিনকোটি টাকা ডিপোজিট সংগ্রহ ও একজন ফিরোজ খানের গল্পঃ

 

তিনকোটি টাকা ডিপোজিট সংগ্রহ ও একজন ফিরোজ খানের গল্পঃ

২০০৬ এবং ২০০৭ সালে আমাদের ব্যাংক কতৃপক্ষ প্রফিটের জন্য সুতীব্র চাপ দেন। ২০০৬ সালে প্রচুর প্রফিট করে আমি তিনটি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পুরস্কার পাই। ২০০৭ সালেও প্রচুর প্রফিট করি কিন্তু স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট স্কিম তখন বন্ধ হয়ে যায়। মনে হল ব্যাংক আমাকে ঠকিয়েছে নতুবা এবারও আর তিনটি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পেয়ে যেতাম। ২০০৮ সালে প্রফিটের জন্য কোন চাপ ছিল না কিন্তু ডিপোজিটের জন্য এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরী প্রবল তাগদা দেন। এই বছর আমাদের ব্যাংকের ঋন ডিপোজিট রেশিও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত সীমারেখা স্পর্শ করে ফেলে। ডিপোজিটের অভাবে ঋণ  প্রদানে ব্যাংক বেশ চাপে পড়ে যায়।

তখন পূবালী ব্যাংকের তেমন গিফট ছিলনা। আমার চিকিৎসক গিন্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীকে ঔষধ কোম্পানিগুলো প্রচুর গিফট দিত। আমি এইসব গিফট অফিসে এনে বিতর করে অন্য ব্যাংক হতে ডিপোজিট সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করতাম। ডিপোজিট সংগ্রহের জন্য আমি ঔষধ কোম্পানির খাতা, কলম, পেপার ওয়েট, ভিটামিন ঔষধ ইত্যাদি নিয়ে দগাহের একজন গুপ্তধনি অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোকের দরবারে গিয়ে হাজির হলাম। তার সাথে আলাপ করে বুঝতে পারলাম আমি যে ধারণা নিয়ে তার সমীপে এসেছি তিনি তারচেয়ে অনেক অনেক উপরের স্থরের মালদার আদমিকয়লা খনি খুড়তে গিয়ে সেই গর্তে আমি যেন এক দামী হীরের খনির সন্ধান পেয়ে গেলাম

আশিউর্ধ আমার এই মুরব্বীর নাম ফিরোজ খান। বড় রাস্থার পাশে তার বাড়ির জমির পরিমান সাড়ে চার বিঘা, বাড়ির সামনের রাস্থাঘেষে তিনতলা সহজ ডিজাইনের একটি মার্কেট। বাড়িতে অনেকগুলো টিনের পাকাঘর। চুন কামের কোন বালাই নেই। ময়লা ওয়ালগুলো দাগে ভরে আছে। সাদা পাজামা এবং লুঙ্গি পরে পুরু চশমা চোখে তিনি আমার সামনে আসলেন। একটি পুরানো কাটের টেবিলে একপাশে একটি ভাঙ্গা চেয়ারে আমাকে নিয়ে বসলেন

তাকে একটি বিনীত সালাম দিয়ে বললাম আমি কাছের পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, বাড়ি দক্ষি সুরমার দাউদপুর। আমি আপনার দোয়া নিতে এসেছি। এবার তিনি বললেন এই গ্রামের লোক কাজিটুলার ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরীকে কি চেনেন? বললাম তিনি আমার আব্বার চাচাত ভাই ও পাশের বাড়ির লোক এবার তিনি ডাঃ আব্দুল হক চাচার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, ডাঃ হক সাহেব আমার ডাক্তার, আমি তাকে ছাড়া অন্য কারও কাছে কখনও চিকিৎসার জন্য যাই নি। আহারে তিনি নেই, আমরা আজ তাকে হারিয়ে একদম অসহায় হয়ে গেছি।

এবার আমি আসল কথাটি পাড়তেই ফিরোজ খান বললেন, আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন, আমি এতদিন ধরে পরামর্শের জন্য ব্যাংকের একজন ম্যানেজার খোঁজছিলাম। আপনি আসায় আমার মহা উপকার হয়ে গেল। এবার ফিরোজ খান সরবে হাক দেন, ওগো সজলের মা, ওগো বুশরার মা, তোমরা কে কোথায় গো? জলদি আমার ম্যানেজারের জন্য চানাস্তা নিয়ে এসো। ম্যানেজার সাহেব এসেছেন, তিনি তোমাদের মধ্যে এফডিআরের টাকা ভাগবাটুরা করে দেবেন।

এবার খান সাহেবের দুই নৌজোয়ানা বেগম সাহেবা দুইটি আলাদা পাকঘর হতে চানাস্তা এনে কভারহীন টেবিল সয়লাব করে দেন। সজলের মা বয়সে খানিকটা বড়, তিনি ফর্সা ও সুন্দরী বুশরার মা শ্যামলা গোলগাল কিন্তু একেবারে তরুণী। বুশরার মাকে সজলের মায়ের চেয়ে বেশি চালাক চালাক। লক্ষ্য করলাম আমাকে সালাম জানাতে দুই সতীনের মধ্যে একটা ছোট্ট প্রতিযোগিতা লেগে গেল

আর গল্প আছে, এবার ফিরোজ খান বললেন তার পহেলা বুড়ি বঊ অনেক অনেক আগে গত হয়েছেন। এই তরফের প্রথমপুত্র পাগল হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে তাকে জেলে দেন। সেখানে সে প্রা হারায়। দ্বিতীয় ছেলেটাকে ঈদগায় বাড়ি করে দিয়ে আলগা করে দিয়েছেন। এবার বললেন আমার আরেকজন যুবতী বউ আছেন, তিনি সালুকটিকরের গ্রামে শতবিঘার খামারবাড়িতে বাচ্ছাকাচ্চা নিয়ে বসবাস করেনতারা গ্রামের ক্ষেত গৃহস্থি দেখাশুনা করে, সেই খামারবাড়ির আয়ে তাদের খরচপাতি চলে। আমি মূহুর্তেই আশি পেরুনো বয়ঃবৃদ্ধ ফিরোজ খানের তিনজন সবলা যুবতী পত্নীর সন্ধান পেয়ে বেশ চমকিত হয়ে গেলাম। ভাবলাম ডিপোজিটের সন্ধানে এসে এযে এক সতীন মেলায় পড়লাম। বৃদ্ধ মুরব্বীর কাটি যে এখনও বেশ শক্ত ও সক্রিয় তা বুঝা গেল তার সব কজন বিবিকে ঘিরে থাকা তাঁরি ঔরসজাত এক এক দঙ্গল আন্ডাবাচ্চা বালবালিকার জটলা দেখে।

এবার খান সাহেব তার চাঁদবদন বালকপূত্র সজলকে ডাক দেন, সজল আমার আলমিরার চাবিটা নিয়ে আয়? পুরানো কাটের আলমিরার তালা খোলে ময়লা কাপড়ে পেঁচানো একটি পুটলা বের করে এনে টেবিলের উপর রাখলেন। পুটলা হতে বেরিয়ে আমার সামনে যা আসল তা দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। গুণেগুণে দেখলাম এগুলো পোষ্টঅফিস এবং জনতা ব্যাংকের তিনকোটি টাকার অনেকগুলো সঞ্চয়পত্র এবং এফডিয়ারভাবলাম এই বাড়ি বৃদ্ধ মুরব্বীর কেবল সুন্দরী বঊদের খনি নয়, একটা টাকারও খনি। এই রমণীগুলো টাকার মধুজলে সাঁতার কাটতে আসা রাজহংসীর দল, যারা অপেক্ষা করছে বুড়ো রাজহাঁসটা কখন মরবে আর তারা সব মধুদুগ্ধ চুমুক মেরে সাবাড় করে নেবে।

ফিরোজ খান এবার কাজের কথায় আসলেন। বললেন বেশ বয়স হয়েছে, আমি এই টাকা নিয়ে বেশ বিপদে আছি। আমি জীবিত থাকাকালে এই এফডিআরগুলো বউদের মাঝে ভাগবাটুরা করে দিতে চাই। তবে আমি যে কয়দিন জ্যান্ত আছি এফডিআরগুলো আমার নামেই থাকবে। আমি মারা গেলে সজলের মা পাবে এককোটি, বুশরার মা এককোটি, সালুটিকরের বিবি পঞ্চাশ লাখ এবং পহেলা বিবির জীবিতপুত পাবে পঞ্চাশ লাখ। আমি খান সাহেবকে বললাম, কোন আসুবিধা নেই, আমি আপনার নামে তিনকোটি টাকার চারটি এফডিআর করে দেব। আপনার ইচ্ছেমত তাদেরকে আপনি এক একটি এফডিআরের নমিনী করে দেবেন। এবার ফিরোজ খান বললেন আমি বুড়ো মানুষ সবকিছু বুঝি না। এই টাকাগুলো জনতা ব্যাংক এবং ডাকঘর হতে আপনাকেই নিয়ে আসতে হবে।

তাকে বললাম আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমার এই লালকারে আপনাকে সব জায়গায় নিয়ে যাব। একদিন বললেন আমার টুলটিকরের বড় মেয়েকে বহুদিন দেখি নি একটিবার দেখতে যাব, আমাকে নিয়ে চলেন? বললাম, আমি আপনার পুত্রের মত, আপনার আরজি কি ফিরিয়ে দিতে পারি? এক শুক্রবারে আমি তার বাসায় গিয়ে দেখলাম তিনি চকচকে সাদা পাঞ্জাবী ও পরিষ্কার লুঙ্গিপরে মেয়ের বাড়িতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। টুলটিকরের সেই কন্যার বাড়িতে ঢুকেই সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি আমার ম্যানেজার, আমাকে নিয়ে এসেছেনএখানে তারমত আমিও খুব অতিথেয়তা পেলাম।

এবার ফিরোজ খান তার সুদীর্ঘ জীবনের গল্প বলেন। বালক বয়স হতে কলকাতা ও সিলেটে নানা ব্যবসাপাতি করে এবং মামলা মোকদ্দমা ঘেটে তিনি এই বিরাট সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। একবার সুরমা নদীর ওপারের বরইকান্দির লোকেরা তার কেনা একটি বাসা গায়ের জুরে দখল করে নেয়। তিনি তার দুনালা বন্দুক নিয়ে ওদের সাথে বন্ধুক যুদ্ধে নামেন। মূহূর্তেই দুই জন দখলবাজ নিহত হয়, অন্যরা পালিয়ে গিয়ে প্রা বাঁচায়। মামলায় কিছুকাল তিনি জেল খাটেন। তার বড়ভাই ছিলেন বৃটিশ আমলের দারোগা। পুলিশের এই দারোগা ভাই সুদীর্ঘ মামলা চালিয়ে কেমন করে যেন তাকে রক্ষা করেন। দগাহের পুরানো লোকজনকে জিঞ্জেস করে আমি তার এই কথার সত্যতা পেয়ে গেলাম তারা আমাকে বলল, এখন লাটিভর দিয়ে চলাফেরা করা এই অতিবৃদ্ধ ফিরোজ খানকে আমরা অনেক আগ থেকেই চিনি, তিনি যৌবনে খুব দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন তারা আর বলল, তার পহেলা বিবির পহেলা পূত্রের কারাগারে পাগল হয়ে মৃত্যুবর করাও ছিল এক রহস্যজনক ঘটনা অনেকের বিশ্বাস তিনিই কৌশলে নিজ অবাধ্য ছেলেকে পুলিশের সাহায্যে জেলে খুন করান।     

আমি ফিরোজ খানের নামে আমার শাখায় একটি হিসাব খোলে যখন যে এফডিআর ডিঊ হয় সেটি ভাঙ্গিয়ে এখানে জমা করলাম। তারপর তার পছন্দমত নমিনী নিয়ে একটি একটি করে চারটি তিনকোটি টাকার এফডিআর করে দিলাম। চোখের পলকে শাখার ডিপোজিট তিনকোটি বেড়ে গেল। আমি তার যুবতী বিবিগণের নমিনী ফরমে ছবি ও দস্তখত আনতে তার বাড়িতে গিয়ে রাজকীয় সম্বর্ধণা পেতাম। তার বিবিগণের সৌজন্যে আমাকে নাস্তা খাওয়ানোর ধুম লেগে যেত। ফিরোজ খানের এই বাড়িতে ছিল প্রচুর নারকেল গাছ। ফরবার সময় ফিরোজ খান হুঙ্কার দিতেন, আমার ম্যানেজাকে তোমরা গাছের নারকেল দাও, অমনি তার বিবিগণের পালঙ্কের তলা হতে প্রচুর নারকেল এসে আমার কারের বেনেট পূর্ণ করে দিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন