শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

আমার অনুজ নিশাতের বিয়ে- ৭ আগস্ট ২০০৮ সালঃ

 

আমার অনুজ নিশাতের বিয়ে- ৭ আগস্ট ২০০৮ সালঃ

আমার অনুজ নিশাত কুরেশী আমার অতি আদরের ছোটভাই। ১৯৭৮ সালে সর্বকনিষ্ট ভ্রাতা  মিল্লাত শৈশবে অকালে বিদায় নিলে আমাদের সব স্নেহ তার উপর এসে পড়ে। গত বছরের আব্বার মৃত্যুশোক এখনও কাটেনি। আম্মার শরীরও খুব ভাল যাচ্ছেনা। দীর্ঘ্যকাল ধরে ডায়বেটিস ঘুনপোকার মত তার শরীরটাকে খেয়ে খেয়ে একদম জরজর করে ফেলেছে। নিশাত অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করে মদন মোহন কলেজের অর্থনীতির অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে কিছুকাল কাজ করে। কতটুকু সফল হয়েছে জানিনা তবে সে টুকটাক বেশকিছু ব্যবসায় হাত দেয়। এক ধরনের সুতার বোতাম গাঁয়ের বেকার মেয়েদেরকে দিয়ে তৈরি করে দবাই পাঠাতোএকধরনের হস্থশিল্পের সোফাসেট, চেয়ার, টেবিল, বসার টুল, গ্রাম্যদৃশ্য, খেলনা বাড়ি, হাস পাখি, ফল ফুল এবং ঘর সাজানোর সৌকিন দ্রব্যসামগ্রী দক্ষিণবাড়ির সেলিম ভাইয়ের সাথে বানিয়ে আম্বরখানায় একটি দোকান দেয়। অনেক ক্রেতা এই পন্যগুলো বেশ শখকরে কিনে নিততারপরও দেখলাম ব্যবসাটি চলছে না, নিভু নিভু করে জ্বলে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল।

বিগত দুই বছর আগ থেকে আমরা নিশাতের জন্য কনে খোজতেছি। কিন্তু কেন যেন হয় হয় করেও কোথায়ও সম্মন্ধ হয় না। আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে আল্লাহ যার যেখানে জোড় মেরে রাখেন সেখানে পৌছা না গেলে বিয়ে সংঘটিত হয়না। ইতিমধ্যে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পেনির একটি প্রথম শ্রেণির ভাল সরকারি চাকুরী তার হয়ে গেলে কনের হাটে বরের মূল্য অনেক বেড়ে গেলযেখানেই আলাপ দেই সেখানেই সাড়া পাই, কিন্তু সে এবার বেশ বাতবিছার শুরু করে দেয়। এই বাছাবাছি করে বছর দিন নষ্ট হল, ইতিমধ্যে আব্বা হঠাৎ এক আচমকা দৈব দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নিলেন। ইতিপূর্বে আব্বা আমাদের সাথে তার কনিষ্ঠ পূত্রের জন্য বেশ কিছু কনে দেখতে ও বিয়ের আলাপে অংশ নিতে যান। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তিনি তার এই কনিষ্ঠ প্রিয় পুত্রের বিয়ে খেয়ে যেতে পারলেন না। পুত্র কন্যা সবার বিয়ে তিনি নিজহাতে পরিচালনা করে যান, কেবল নিশাতের এই বিয়ের শুভকাজটি সমাধা করে গেলেই তার ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যেত।

আমার চাচাত ফরহাদ ভাইয়ের পুত্র কাওসার একদিন নিশাতকে একজন কনের সন্ধান দেয়এই কনে কাওসারের মামা ইমতিয়াজ চৌধুরীর জেটালীর জৈষ্টা কন্যা ফাহমিদা হোসেন লোমা। তাদের বাসা মৌলভীবাজার শহরের কাজিরগাও এবং গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার শহরের সন্নিকটে ত্রৈলোক্যবিজয়। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ হতে ‘একাউন্টিং’ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করে কনে এখন ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসার। একদিন কাওসার নিশাতকে নিয়ে গেল মৌলভীবাজার। কাওসার ট্রাস্ট ব্যাংকে তার নিশাত চাচাকে নিয়ে গিয়ে কনের মুখোমুখি করায়।

বর ও কনে দুইজনের পূর্বসম্মতির পর আলোচনা শুরু হল। আমার বাসায় ও কনের খালু ইমতিয়াজ চৌধুরীর উপশহরের বাসায় কনের নানা কামাল উদ্দিন চৌধুরী, পিতা এডভোকেট তজম্মুল হোসেন, মামা মৌলানা এমরান আহমদ চৌধুরী, আমার গিন্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী, বোন মান্না, দোলাভাই লিয়াকত চৌধুরী, বড়বোন রেহা এবং আমি দুই একবার আলাপে বসলাম। খুবএকটা দর কষাকষি ছাড়াই পানচিনি, সোনাদানা, কাবিন, বিয়ের তারিখ অল্পকথায় সমাধা হয়ে গেল। কনের মামা মৌলানা এমরান সাহেব সর্বক্ষেত্রে সুন্নতি নিয়ম অনুসর করলেন।

কিছুদিন আগে নয়নে বৃষ্টি ঝরার মত এক শোকের ঘটনা একটি পরিবারকে এলোমেলো করে দেয়, ভ্রাতা এমরান চৌধুরীর নতুন গাড়িচড়ে কোন এক গন্তব্যে যাবার পথে কনের মাতা লুৎফা হোসেন চৌধুরী এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে মৃত্যুবর করেন তখন তার বয়স আর কত হবে, বড়জুর সাতচল্লিশ কিংবা আটচল্লিশ। প্রিয় জৈষ্ট্যা আত্মজা ফাহমিদা হোসেন লুমার বিয়ে দেখার সৌভাগ্য ভদ্রমহিলার হয়নি। তিন কন্যা ফাহমিদা হোসেন লোমা, তাওহিদা হোসেন তামান্না, তানজিনা হোসেন ঝুমা এবং একমাত্র পুত্র এডভোকেট তানভীর হোসেন আলোকে আদর যতনে পালাপোষা করে তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগেই তিনি চিরবিদায় গ্রহ করলেন। এই চার সন্তানের বাবা এবং মায়ের দুই দায়িত্ব এসে পড়ল তাদের বাবা মৌলভীবাজার জেলাবারের দুইবারের সভাপতি এডভোকেট মোঃ তজম্মুল হোসেনের কাঁধে।

৭ আগষ্ট ২০০৮, আমরা সিলেট সাগরদিঘিপারের বাসা হতে মৌলভীবাজার ব্যাঙ্গল বিয়ে সেন্টার আসি। অল্প কিছুদিন আগে আপনজন হারানোর বিরহ যন্ত্রণায় কাতর দুই পরিবারে তেমন কোন জাঁকজমক ও আলোকসজ্জা করা হল না। গায়েহলুদ অনুষ্ঠানও হল একদম সাদামাটা। এই ব্যঙ্গল কমিউনিটি সেন্টারে  বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সুসম্পন্ন হলকনে এসে উঠলেন আমাদের বাসা জেফার ভবনে, ফুলসজ্জাও সাদামাটা করে সাজানো হল। ৯ম আগস্ট ২০০৮ সাল, কুমারপাড়ার মালঞ্চ কমিউনিটি সেন্টারে আমরা বৌভাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে মৌলভীবাজার বদলি করা হলে নিশাতের শ্বশুর এডভোকেট মোঃ তজম্মুল হোসেন আমাকে তার বাসায় থেকে অফিস করার জন্য বেশ পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু তিনি যতই অনুরোধ করেন না কেন? ছোট ভাইয়ের শ্বশুরের বাসায় কি আর চেপে বসা যায়? এখানে এসে তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার আমার সুযোগ হয়। কয়েকদিন পরপরই আমাকে তার বাসায় দাওয়াত করতেন। আমার অফিসের সহকর্মি এডভোকেট মোঃ আবু তাহেরের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করতেন। আমি তাই এডভোকেট মোঃ আবু তাহের সাহেবকে নিয়েও একবার তার বাসায় গিয়ে দাওয়াত খাই। সামনের মসজিদের ঈমাম মুয়াজ্জিনসহ বেশ কয়েকজন হুজুর, আত্মীয় ও পাড়াপড়শীর সাথে এখানে আমার পরিচয় হয়।

আমি তাকে একজন সজ্জন, ঈমানদার, আল্লাহভীরু লোক হিসাবেই দেখেছি। তিনি ছিলেন ডায়বেটিস রোগী, মিষ্টি খেয়ে ফেলতেন, তেমন সতর্কতা পালন করতেন না। ডায়বেটিস তার হৃদযন্ত্রকে আস্তে আস্তে বিকল করে দেয়। তার সন্থানরা সবাই বাসায় এসে বাবাকে শেষদেখার জন্য সমবেত হন।

৭ই মার্চ ২০১৭, বসন্তের এই উজ্জল নাতিশীতুষ্ণ দিনে পৃথিবী হতে তিনি বিদায় গ্রহ করেন। আমি ও আমার সহকর্ম মোঃ আবু তাহের  তাদের বাসায় গিয়ে শবযাত্রা মিছিলে শরিক হতে পাশে কাজিরগাওয়ের শাহ জুনায়েদ বাগদাদির(রঃ) মাজারের সামনের অনুচ্চ সবুজ টিলামাঠে সকাল ১১টায় নামাজে জানাজায় অংশগ্রহ করিমৌলভীবাজারের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এই জানাজায় জমায়েত হন। বিএনপি নেতা এডভোকেট মুজিবুর রহমাসহ অনেকে অশ্রুসজল নয়নে তাদের এই প্রিয়বন্ধু ও সহকর্মর স্মৃতিচার করেন। জানাজা শেষে তাকে তার নিজগ্রাম ত্রৈলোক্যবিজয় নিয়ে গিয়ে পারিবারিক কবরগায় দাফন করা হয়মহান আল্লাহতায়ালা এই ফরহেজগার মানুষকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন