প্রিয়
ঈদগাহ শাখা, তোমাকে বিদায় জানানোর বেলা হয়ে গেছে
২০০৯ সালের বিদায় ঘন্টা বাজছে।
শাহী ঈদগাহ শাখায় আমার এক দুঃসহ বছর পার করে এলাম। ইতিমধ্যে অফিসের নানা জটিলতা
আমার জীবিনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। এক একবার মনে হত চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাই। আমার
নিকটাত্মীয় ও শুভাকাঙ্খী ডিএমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীকে একদিন শাহজালাল উপশহরে তার
শ্বশুরের বাসায় পেয়ে বললাম, এত যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছেনা, চাকুরীটা ছেড়ে দেই। তিনি
হেসে হেসে বললেন, মামু চাকুরী ছেড়ে দিয়ে করবেনটা কি? চিকিৎসক মামীর কাধে সওয়ার হবেন
নাকি। আপনার না হয় জায়গা আছে কিন্তু আমার সম্মন্দী ওয়াহাব ভাইয়ের চাকুরী গেলে
সওয়ার হবারও কোন জায়গা নেই।
আভাস পেলাম যখন তখন আমি বদলি হয়ে
যেতে পারি, কারন একই অফিসে ব্যবস্থাপক হিসাবে আমার প্রায় চার বৎসর পার হতে চলেছে।
ব্যাংকের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি নিয়ে একে একে প্রিয় গ্রাহক ও আত্মীয়দের বাসায়
ছুটলাম। এসব বাসা ঈদগাহের আশেপাশে। আলমগীর কুরেশী ভাইয়ের টিলাতলার বাসা তখন ছিল
আমার এক আড্ডাখানা। তার ভাগ্নি মজাকরে চা নাস্তা করাতো।
আমার খালাত সম্মন্দী কেফায়ত ভাই
আমার শ্বশুরের জিম্মায় থেকে লেখাপড়া করেন। তাই তিনি আমার পত্নীর একজন খুব কাছের
মানুষ। আমি ঈদগায় আসার পর কেফায়েত ভাই প্রায়ই এসে আড্ডা দিতেন। তিনি ছেলে
মেয়েদেরকে পড়াতে রাউতখাই চৌধুরী বাড়ির সুপরিসর ভিটেমাটি ছেড়ে এসে ঈদগাহের বাসিন্দা
হন। অবসর পেলেই আমি পাশে তার বাসায় যেতাম। হবিগঞ্জকন্যা ভাবী বলতেন, ভাই আপনি
প্রতিদিন দুপুরের খাবার এখানে খাবেন। চাপে পড়ে বেশ কিছুদিন আমাকে তার বাসায় দুপুরে
খেতে হয়েছে।
আমার চাচাত ভাই ফজলুর রহমান
কুরেশী সৌদি আরবের মদীনা শরীফে জীবন কাটিয়ে অবসরে দাউদপুর গ্রামে ফিরে আসেন। বাড়ির
কাছে চৌধুরীবাজারে তিনি চালের ব্যবসায় নামেন। গায়ের গরিব লোকজন তার চাল বাকিতে কিনে
নিয়ে সব পুঁজি খেয়ে ফেলে। এইসব লোকদেরকে টাকা ফেরত দিতে তিনি কোন চাপাচাপি করতেন
না, বলতেন এরা গরিব মানুষ পারলে দেবে নইলে সবর। এখানে অনেক পুঁজি খুইয়ে তিনি এবার
শহরে এসে শাহজালালের দরগাহের মিনারতলে খাবারের ‘বারাকাত হোটেল’ খোলে বসলেন। হোটেলে
ভালই লাভ হত। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা ফেলে মদীনা প্রবাসী হওয়া ফজলু ভাইকে একদিন
বললাম হোটেলের হিসাব রাখেন কেমনে? বললেন প্রতিদিন চার হাজার টাকার খুচরা বাজার করে
দেই। বিকেলে ক্যাশে প্রায় দশ হাজার টাকা চলে আসে। এই দশ হাজার টাকা আয়ের মধ্যে চার
হাজার পরদিনের বাজার খরচ, দুই হাজার কর্মচারীদের বেতন, দুই হাজার দোকান ভাড়া,
গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি বাবদ খরচের পর প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার টাকা নেট
প্রফিট রয়ে যায়।
তিনি আমার শাখায় পঞ্চান্ন লক্ষ
টাকার একটি মেয়াদী আমানত করেন। এই মেয়াদী আমানত বন্ধক রেখে আমি লন্ডনগামী
ছাত্রদেরকে অনেক স্টুডেন্ট ঋণ প্রদান করি। কাছের টিলাঘেরা চিরসবুজ আরামবাগের বাসা
হতে তিনি প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার গ্র্যাজুয়েট পত্নী সৈয়দা রাবেয়া খানম বেশ
ফর্সা ও সুন্দরী। তিনি মৌলভীবাজারের বেকামুরা গ্রামের সৈয়দ বংশের কন্যা। বাল্যকালে
তাদের বিয়েতে মৌলভীবাজার শহরের ছয় মাইল আগে কাজিরবাজার থেকে একটু ভিতরে ঢুকে বেকামুরা
গ্রামে যাই। একটি বড়দিঘির পারে বাড়ি, একপাশে হজরত শাহজালালের(রঃ) সহপীর হজরত সৈয়দ
শাহ দরং(রঃ) ও হজরত সৈয়দ শাহ ফরঙ্গের(রঃ) মাজার বিদ্যমান। এই দিঘিপারের মসজিদে
জুমুয়ার নামাজ পড়ার স্মৃতি আজও মনে আছে।
ফজলু ভাই ছিলেন একজন সহজ সরল ভাল
মানুষ। আমি জীবনে প্রথম যে ঘড়িটি হাতে দেই, সেটি ছিল মদীনা হতে আমার জন্য নিয়ে আসা
তার উপহার। আমি সময় পেলেই তারসাথে আরামবাগের বাসায় যেতাম। আমার বড়চাচার ছয় পুত্রের
মধ্য তিনি ছিলেন সবার কনিষ্ট, অথচ তিনি চলে যান সবার আগে। কেবল তার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা
শামসুদ্দোহা চৌধুরী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সুচনায় ময়নামতি সেনানিবাসে দেশের
জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। ফজলু ভাই প্রায়ই আমার সাগরদিঘিরপারের বাসায় এসে অসুস্থ
আম্মাকে দেখে যেতেন। একদিন আচমকা তার দেহে মরনব্যাধী ক্যান্সার ধরা পড়ে। ভাগ্যের
কি নিদারুণ পরিহাস আমার অসুস্থ মায়ের আগেই তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হল। তার
দুইপুত্র শুভ ও সৌরভ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং একমাত্র কন্যা সুমনা এম সি
কলেজে ইংরেজীতে অনার্স পড়ছে। সাতবারের হাজী ফজলু ভাইয়ের এই অকালমৃত্যু আমার মনে
বেশ শক্ত আঘাত হানে। আল্লাহ তার এই ফরহেজগার বান্দাহকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
চারশত বছর আগে মোগল সম্রাট
আলমগীরের আমলে সিলেটের ফৌজদার ফরহাদ খান একটি টিলাপৃষ্টকে সমতল করে এই শাহী ঈদগাহ
নির্মাণ করেন। অনেক সিড়ি বেয়ে বাংলাদেশের এই শ্রেষ্ট সুন্দর ঈদ্গাহে আরোহন করতে
হয়। সামনে পুকুর ও পুকুর মাঝখানে সুন্দর ফোয়ারা রাতে জল ছড়িয়ে দেয়। নানা প্রজাতির
বৃক্ষ সারাটা ঈদ্গাহের সামনে পিছনে শোভা বর্ষণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি কেবল একটি ইদগাহ
নয়, যেন উন্নত দেশের আদলে সুসজ্জিত একটি পার্ক। আজ এই ইদগাহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে
মসজিদে নবূবীর মিনারের মত এক আলোকোজ্জল সুউচ্চ শাহিমিনার। মানুষ এখানের বৃক্ষতলে,
টিলার সিঁড়িতে, পুকুর ঘাটে হাটেন, বসেন ও দৌড়ান। এই শাহী ঈদগাহ ও তার চারপাশের
উদ্যান অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। বৃটিশ আমলে এখানে সিলেটের দ্বিতীয় বৃটিশ রেসিডেন্স
লিন্ডসে কোন এক আশুরার দিনে ভারতের প্রথম বৃটিশ বিরোধী দাঙ্গা দমন করেন। সেই
দাঙ্গাকালে ১৭৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া নামক দুইজন সৈয়দ
ভ্রাতা সিলেটের ইংরেজ শাসক লিন্ডসের গুলীতে শহীদ হন। ধারণা করা হয় এটিই ছিল বৃটিশ
শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের প্রথম গনবিদ্রোহ। এখানে আসেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সিলেটের মন্ত্রি
নেতানেত্রী সহ এমন কোন এলিট লোকজন নেই যারা জীবনে অন্ততঃ একবার এখানে ঈদের নামাজ
পড়েন নি।
এই ঈদগাহ মাঠে বিগত চারটি বছর
অনেক হেটেছি আমি। অফিসে কাজ করে ক্লান্ত হলেই ইদগাহের বৃক্ষছায়ায় গিয়ে হাঁটতাম। এক
শীতের দিনে সিড়িবেয়ে উপরে উঠে ঈদগাহের মিম্বরে চলে যাই। নিরব নিস্থব্দ চারপাশ,
লোকজনের কোন সাড়াশব্দ নেই। শীতের মিঠে রোদে আরাম আরাম লাগছিল। আমি এই নির্জন
মিম্বরের মেঝে ঘুমানোর অভিনয় করামাত্র চোখে ঘুম এসে যায়। প্রায় ঘন্টা খানেক ঘুম
দিয়ে উঠে দেখলাম কেঊ নেই। অর্থাৎ এই দিন
দুপুরে আমি ছাড়া আর কোন আদম এদিকে আসেনি, তাই খোলা আসমানের নিচে ঘুমন্ত আমাকে কেউই
দেখতে পায়নি। আরেক দিন ঈদগাহের পুকুর ঘাটে বসে তেলাপিয়া মাছের ঝাক দেখছিলাম। কিছু
খৈ কিনে জলে ছিটিয়ে দেই। তেলাপিয়ার ঝাক খাবারে ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় আচমকা শেওলা
পিচ্ছিল সিঁড়িতে এমন পিছলা খাই যে কোমর পর্যন্ত জলে ভিজে যায়। ভেজা প্যান্ট পরে
অফিসে যাই কেমনে। ঘাটে বসে দুইপা শীতের রোদে মেলে ধরলাম। কাজ হল, কিছুক্ষণের মধ্যে
মিষ্টিরোদ ও শরীরের তাপে আমার প্যান্ট শুকিয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন