মহেশখালী
দ্বীপের শ্যামল প্রান্তরেঃ
২০০৯ সালের সূচনায় প্রতি বছরের
মত আমি পূবালী ব্যাংকের জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলনে যোগ দিতে কক্সবাজার যাই। এবারের
কক্সবাজার ভ্রমন দুইটি কারনে আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। এবার আমার দোস্ত খলিল
সাহেবকে নিয়ে আমি কক্সবাজার সাফারী পার্কে ঘুরে আসি। বাসে করে আমরা দুইজন শহর হতে
বেশ দূরে এই পার্কে গমন করি। বঙ্গবন্ধুর বিশাল কালো ম্যুরালের পাশদিয়ে পার্কে ঢুকি।
এই প্রথম এখানে আমার সাদা বাঘ দেখা হয়। হরিন, কুমির, সিংহ ইত্যাদি চিড়িয়া দেখে
সুন্দর ন্যাচারপার্কে প্রায় দুই ঘন্টা হেটে প্রদক্ষিন করে আবার মূল গেটে ফিরে আসি।
সেইবার একদিন আমি, রুহুল আমিন ও
খলিল সাহেব মহেশখালী দ্বীপ দেখতে রওয়ানা হই। কক্সবাজার হতে বেবিট্যাক্সী চড়ে
মহেশখালী নদীঘাটে হাজির হলাম। এখান থেকে আমরা তিনজন একটি স্পীডবোটের যাত্রি হলাম। সমুদ্রবালি
চিরে বহে যাওয়া মহেশখালী একটি সুন্দর অগভীর নদী। দুইদিকে সুন্দর মনগ্রোভ প্যারাবন।
নদীর বুকে পরিস্কার জলে বুনোহাস সাতার কাটছে। তারা ডুব দিয়ে মাছ ধরার কসরত করছে। স্পীডবোটের
জলের ঝাপ্টায় তারা আকাশে উড়াল দিচ্ছে, আবার ঝাপিয়ে পরছে জলে। নদীপথে বেশ দূরত্ব
অতিক্রম করে আমরা মোহনায় চলে এলাম। উপকূল হতে দ্বীপটি খুব একটা দূরে নয়, মোহনা হতে
সাগর পেরিয়ে মহেশখালী দ্বীপে পৌঁছতে তাই দশপনের মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। মহেশখালী
দ্বীপের জেটিতে নেমে একটি সুদীর্ঘ্য সেতু পার হয়ে মূল দ্বীপে চলে আসি। দ্বীপের
সৈকত জুড়ে মনগ্রোভ প্যারাবন সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে দোল খেয়ে যাচ্ছে। এযেন
বাদাবনের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা এক সুন্দরী সমুদ্রকন্যা। কাছে অসংখ্য সামুদ্রিক জেলে নৌকা।
শুটকিপল্লীতে চিংড়ি, রুপচাদা ও লুইট্যা মাছের শুটকি তৈরি করে রোদে শুকানো হচ্ছে।
পাশেই দোকানে সামুদ্রিক মাছের খাটি শুটকি বেচাকেনা হচ্ছে।
দেখলাম মহেশখালীর ভূবন বিখ্যাত
মিষ্টিপানের বরজ। বাশের খোটার পর খোটা লকলক করে বেয়ে সর্পের মত জড়িয়ে আছে অজস্র পানের
সবুজ লতা। মনের অজান্তে গেয়ে উঠলাম সেফালী ঘোষের গান- ‘যদি সুন্দর একখান মুখ
পাইতাম, মহেশখালীর পানখিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম’। আর অবাক হলাম যাবার পথে লাললাল পাহাড়
দেখে। এই দ্বীপে এত পাহাড় আসল কেমনে? বই ঘেটে একটা উত্তর পেলুম, দ্বীপটি নাকি এক
সময় কক্সবাজারের মুল ভূখণ্ডের পাহাড়ি এলাকা ছিল। সুদুর অতীতে এক প্রচন্ড ভূমিকম্পে
মূল ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই পার্বত্য অঞ্চল দূর সাগরে চলে যায়। বিষয়টা সত্যই
মনে হল, কারন দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড হতে তেমন দূরে নয়। এই দূরত্ব বড়জুর আটদশ কিলোমিটার।
মহেশখালী সেন্টমার্টিনের মত কোন
ছোট্ট দ্বীপ নয়, এটি কক্সবাজার জেলার একটি স্বনামধন্য বৃহৎ উপজেলা। এই দ্বীপটির
আয়তন ৩৬২ বর্গ কিলোমিটার। ১৭বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সেন্টমার্টিন প্রবালসৃষ্ট দ্বীপ
হলেও মহেশখালী বাংলাদেশের প্রাচীন ভুখন্ডেরই অংশবিশেষ। এখানে সাগরপারে রয়েছে ময়লা লবনের
মাঠ। যেখানে পানি কাপড়ের উপর সাগরের জল শুকিয়ে বের করে নিয়ে আসা হয় প্রাকৃতিক লবন।
এবার দেখতে গেলাম আদিনাথ মন্দির।
মহেশখালী দ্বীপটা এক পার্বত্য দ্বীপ, পাহাড়চুড়ার আদিনাথ মন্দির তার কপালে রাজটিপ।
সিড়ির পর সিড়ি বেয়ে উপরের মন্দিরে উঠলাম। এইসব সিড়িতে বসে দ্বীপের মানুষ এবং রাখাইন
উপজাতির লোকজন ঝিনুকমালা, প্রবাল পাতর, উপজাতীয় কাপড়, ঝিনুকঝাড়, খেলনা ইত্যাদি
নানা পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছেন। পর্যটকরা শখের পন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মহান
সৃষ্টিকর্তার অরাধনায় নিমগ্ন হবার মত এক উপযুক্ত নির্জন স্থান এই আদিনাথ মন্দির,
অনেক নিচে সাগর এসে যেন তার পা ধুয়ে দিচ্ছে। এই সুপ্রাচীন মন্দিরে প্রাচীন দেবতা
আছেন, আছেন পুরোহিত সেইসাথে দুইচার জন পুজারী। তবে এখানে মুসলিম পর্যটকদের বন্যা
বইছে। উদার মন্দির কতৃপক্ষ সবধর্মের লোকজনের জন্য মন্দিরটি সদা উম্মুক্ত করে রেখেছেন।
মন্দিরের পিছনের অনুচ্চ পাহাড়ে আমরা ঘুরলাম। কে একজন বললেন স্থানটা নিরাপদ নয়।
কিছুদিন আগে এখানে হত্যাকান্ড হয়েছে। তাই ফিরে এলাম। তবে এখানে হেটে শৈশবে সিলেটের
টিলায় টিলায় হেঁটে বেড়ানোর মধুর স্বাধটি আবার যেন ফিরে পেলাম।
আমরা এই দ্বীপের রাখাইন উপজাতি
পল্লীতে ডুকে পড়ি। নারীরা লুঙ্গি ও ঘাগরা পরে আছেন, তাদের কপালে চন্দনের টিপ শোভা
পাচ্ছে। নরনারীগুলো শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা ছবির মত বেশ হৃষ্টপুষ্ট, তারা বাঙ্গালিদের
তুলনায় আর সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান। বৌদ্ধ মন্দিরে বসে আছেন ধ্যানমগ্ন মহাপ্রভু গৌতম
বুদ্ধ। বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে হলুদ বসনা ন্যাড়া মাথা ভিক্ষুরা তপস্যা করছেন এবং
পাশে পড়ে আছে অন্নপ্রসাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন