শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

২৮ জানুয়ারি ২০০৯ সাল, হারিয়ে যান আমার আদর্শ মানব ই. এ চৌধুরীঃ

 

২৮ জানুয়ারি ২০০৯ সাল, হারিয়ে যান আমার আদর্শ মানব. এ চৌধুরীঃ

তিনি ই এ চৌধুরী, তিনি আমার আদর্শ, তিনি আমার সব প্রেরনার উৎস। তিনি আমার বংশের এই প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ট পুরুষ প্রবর। তিনি একদিন সবফেলে চলে যাবেন, আমার ভাবনায়ই আসত না। আমার প্রিয় এই সিংহপুরুষের চাকুরি জীবনের সততা ও নিষ্ঠা তাকে বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। ঢাকার সিটি এসপি পদে থাকাকালে ১৯৬৪ সালে অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি পাকিস্তান পুলিশ মেডেলে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ গঠিত হয় এবং তিনি এর প্রথম কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণের পরও ই.. চৌধুরী সমান উদ্যমে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারী ব্যাংক পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে এই ব্যাংক দুর্বল অবস্থা থেকে আজিকার উন্নতির এই চরম শিখরে আরোহন করে।

. এ চৌধুরী দক্ষিণ সুরমা তথা সিলেটবাসীর এক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সম্মানীত ব্যক্তিত্বের নাম। তিনি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারি আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান এবং ৩০শে জানুয়ারী বাদ জুম্মা অজস্র মানুষের শেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অশ্রতে সিক্ত হয়ে নিজ জন্মভূমি সিলেটের শাহজালালের দরগা সংলগ্ন কবরগাহে চিরনিদ্রায় শায়িত হন

তাঁর পুরো নাম ইমাদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সিলেট শহর থেকে আট মাইল দক্ষিণে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামে বৃটিশ শাসনামলে ১৯২৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন আসাম লেজিসলেটিভ কাউনিসলের সদস্য (এম.এল.সি)সমাজসেবামূলক কাজের জন্য তিনি বৃটিশ সরকার কর্তৃক খান বাহাদুর (সাহসী সর্দার) উপাধি পান। তাঁর মাতা সারা খাতুন চৌধুরী ও পিতা গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী আপন চাচাতো ভাইবোন।

১৩০৩ সালে হযরত শাহজালাল(রঃ) সিলেট অঞ্চলে আগমন করেন। তার সাথে সর্বপ্রথম যে বারজন সঙ্গী আরব উপদ্বীপ হতে ইসলাম প্রচারে বের হন তাদেরই একজন পবিত্র মক্কা নগরীর হযরত শাহদাউদ কুরেশী (রঃ), যিনি দক্ষিণ সুরমা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। আর এই মহান ওলির বংশের অধস্তন পুরুষ হচ্ছেন ই. . চৌধুরী। তার বংশতালিকা নিম্নরূপ- ১৫) ইমাদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, >১৪) খান বাহাদুর গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী >১৩) মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী, > ১২) ইয়াকুব আলী চৌধুরী > ১১) মুহাম্মদ হাজের > ১০) মুহাম্মদ বাসের) মোহাম্মদ আমিন, > ) সালেহ মুহাম্মদ >) ইয়াকুব খান, > ) ইলিয়াস খান, > ) পীর মালিক ওরফে এখতিয়ার খান) শাহ মালিক) মিয়া মালিক, > ) রহিম দাদ কুরেশী(রঃ), > ) শাহদাউদ কুরেশী(রঃ)

দাউদপুর গ্রামে জন্ম আর সেই গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৫ সালে এমসি কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগে অনার্স ও ১৯৫০ সালে মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ছাত্র জীবনে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। হাইস্কুলে পাঠবস্থায় ১৯৪২ সালে তিনিসবুজ পতাকানামে ছাপার অক্ষরে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রকাশিত ম্যাগজিনের সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে ১৯৪৯ সালে তিনিপাকিস্তান ইয়ারবুক ১৯৪৯নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ফেনী কলেজে প্রভাষক হিসাবে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। তারপর ১৯৫৩ সালে তিনিপাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসপরীক্ষায় পাস করে ১৯৫৪ সালে এসিস্টেন্ট পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট পদে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে নিযুক্তি লাভ করেন। পুলিশ বিভাগে বিশেষ কৃতিত্বের  সাথে  একে একে সাফল্যের সবকটি সোপান অতিক্রম করে ১৯৮৪ সালের ১লা জানুয়ারি সিলেটিদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারল (আইজিপি) পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৮৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর সরকারি চাকুরি থেকে ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন

চাকুরী জীবনে তার সততা ও নিষ্ঠা তাকে বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে।  ঢাকার সিটি এসপি পদে থাকাকালে ১৯৬৪ সালে অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি পাকিস্তান পুলিশ মেডেলে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সালে তার নেতৃত্বে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠিত হয় এবং তিনি এর প্রথম কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণের পরও ই. এ চৌধুরী  সমান উদ্যমে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারী ব্যাংক পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বে এই ব্যাংক দুর্বল অবস্থা থেকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করে

২০০৫ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থ্যতাজনিত কারণে ব্যাংকের সুযোগ্য পরিচালক বর্তমান জাতীয় সংসদের এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদারকে বোর্ডের সম্মতিক্রমে চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। এছাড়া তিনি ঢাকা শহরে বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটবাসীর প্রতিষ্ঠান জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসাবে অনেক বৎসর অধিষ্ঠিত ছিলেন। কাওরান বাজারে অবস্থিত জালালাবাদ এসোসিয়েশনের জালালাবাদ ভবন তার একক প্রচেষ্টার ফসল। তাছাড়া ই. এ চৌধুরী সিলেট ও ঢাকায় বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি জালালাবাদ ভবন ট্রাষ্টমুহিব উদ্দিন শিক্ষা ট্রাষ্ট ও আফতাব জাহান কল্যাণ ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাছাড়া তিনি ন্যাশনাল হার্ট ফান্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সহ সভাপতি পদেও দায়িত্বপালন করেন। সিলেট লায়ন্স ক্লাব শিশু হাসপাতালের তিনি একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন

. এ চৌধুরী ৬ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ৩য় ছিলেন। তার বড় ভাই সামসুউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর উদ্দিন চৌধুরী প্রয়াত হন অনেক আগে। তাঁর অপর সহোদরা হচ্ছেন সাবেক সচিব ও সাহাব উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ইমাম উদ্দিন আহমদ চৌধুরীগ্রীন ডেল্টা ইন্সুরেন্স লিমিটেডের বর্তমান পরিচালক ও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষসাবেক চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি নাছির এ চৌধুরী ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাবেক সংসদ শফি এ চৌধুরী। ই. এ চৌধুরীর প্রথমপুত্র এজাজ আহমদ চৌধুরী ১৯৮৫ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার স্মৃতিধারণ করে আছে ১৯৮৬ সালে আমার লিখা একটি সনেট---দ্বিতীয় পুত্র রিয়াজ আহমদ চৌধুরী এইচ.এস.বি.সি ব্যাংকের বাংলাদেশ কাউন্ট্রি প্রধান। একমাত্র মেয়ে রুমানা চৌধুরী পূবালী ব্যাংক লিমিটেড ও গ্রীন ডেল্টা ইন্সুরেন্স লিমিটেডের বর্তমান পরিচালক তার স্বামী শামসুল আলা ডেল্টা-ব্রেক হাউজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শামসুল আলা লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে চার্টার্ড একাউন্টটেন্ট (সি এ) ডিগ্রি অর্জন করেন।

অত্যন্ত সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে আমরা শৈশব থেকেই ই এ চৌধুরীকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। মানুষের শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব পাবার মত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমার বংশের এই শ্রেষ্ট পুরুষ। চলনে বলনে আচার আচরণে তিনি আত্মমর্যাদাকে সব কিছু উপরে স্থান দিতেন। মানুষের উপকার করতে তিনি সর্বদা উন্মুখ থাকতেন। কারো কোন ধরনের ক্ষতি হোক এমন কিছু তিনি কখনো চাইতেন না। ১৯৮৮ সালে আমি পলিটেকনিক হতে সিভিলে ডিপ্লোমা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ প্রথম বর্ষ পরীক্ষা দেই, এই পরীক্ষা শেষে চট্টগ্রাম হতে ঢাকা গমন করি। তিনি তখন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। ব্যাংকের হেড অফিসের তৃতীয় তলায় তার সাথে দেখা করি। চাকুরী প্রার্থী হলে তিনি আমার কাছ থেকে আবেদন পত্র গ্রহন করেন এবং পরদিন ১০ বৎসরের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিয়ে অফিসের সবার সাথে পরিচয় করে দেন 

১৯৯০ সালে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগপত্র পেয়ে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করি। ব্যাংকে সুদের চাকুরী করব এমনটি ইতোপূর্বে কখনও চিন্তা করিনি। ভাবতাম আরো ভাল কিছুতে সুযোগ পেলে চলে যাবো কিংবা বিদেশে চলে যাব। কিন্তু ভাগ্য আমাকে আজও সুদের ঘর এই পূবালী ব্যাংকে বন্দি করে রেখেছে। তাঁর মাধ্যমে এই ব্যাংকে ঢুকে জীবনের অনেক বৎসর পার করেছি। মনে পড়ে একদিন আমাকে পূবালী ব্যাংকের রেষ্ট হাউসে ডেকে নেন কেবল উসমান মিয়া কর্তৃক নিয়ে আসা লাঞ্চ করানোর জন্য। আরেকদিন সিলেটে এসে ডেকে নেন। মনে হয় খুব জরুরি কাজে ডেকেছেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর যখন জানতে চাইলাম কি জন্য ডেকেছেন, জবাব পেলাম তোমাকে দেখার জন্য ডেকেছি। এই ছিলেন  . এ চৌধুরী, যার বক্ষ জুড়ে  ছিল এত স্নেহএত মায়া মমতা। তাকে আমরা ভুলবো কেমন করে। মধুকবির ভাষায়- জন্মিলে মরিতে হবেকে কোথা অমর কবেচিরস্থির করে নীড়হাররে জীবন-নদে।/ সেই ধন্য নরকুলেলোকে যারে নাহি ভুলেমনের মন্দিরে যারে সেবে সর্বজন।

তিনি বেঁচে থাকবেন আমার মত অসংখ্য মানুষের হৃদয় মন্দিরে। জীবন ছায়াহ্নে এসে বহুদিন তিনি রোগে বার্ধক্যে কষ্ট করেছেন। প্রায় দুই বৎসর পূর্বে গোলশানের বাসায় গিয়ে দেখে এসেছিলাম। তারপর দেখা হয়নি আর। দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু যাবো যাবো করেও নানা ব্যস্ততায় যাওয়া হলনা। সেই করুন দিনটায় মনে পড়ে গেল কবি জীবনান্দ দাসের কবিতার লাইন -“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে; ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রঙ্গ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ্গে ঝিলমিল, সবপাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন/ থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”।

তাঁর সাথে শেষ দেখা হল হযরত শাহজালাল(রহঃ) দরগায়যখন তাঁর জীবনের সব লেনদেন সমাপ্ত হয়ে গেছে। তিনি চলে গেছেন পরলোকের ঐশ্বরিক জীবনের অমরালয়ে। হজরত শাহজালালের(রঃ) দরগায় শবাধারে মহানিদ্রায় শায়িত তার অপরূপ সুন্দর চাঁদমুখ দেখে আমার চোখের কিনারায় সেদিন নেমে এসেছিল এক পশলা ভারী বৃষ্টির জলধারা।.এ চৌধুরী অমর হউনআল্লাহ তাকে ক্ষমা করুনতিনি মহান করুণাময় আল্লাহর দরবারে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে আসীন হউন আমিন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন