শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, বরইকান্দি শাখা, সিলেট।

 

পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, বরইকান্দি শাখা, সিলেট।

যোগদানঃ ২৮ এপ্রিল ২০১০ সাল  বিদায়ঃ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল।

অবস্থানকালঃ ৩ বৎসর ৯ মাস ১৫ দিন।

 

আমি সিলেট শাখায় অবস্থানকালে সিলেট শাখার বৈদেশিক বিনিময় বিভাগের প্রধান ছিলেন আহসানউল্লাহ। একদিন বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপকের পদে তার নিয়োগ আদেশ আসল। অতি মেধাবী আহসানউল্লাহের উপর সিলেট শাখার বৈদেশিক বিনিময় বিভাগ অতি নির্ভরশীল ছিল। তাই সিলেট শাখার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান তাকে ছাড়তে চাইলেন না। কিছুদিনের মধ্যে এই শক্তিশালী ব্রেইনের আহসানউল্লাহ সিলেট শাখার ঋণবিভাগের অনেক লোককে নরকের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে বড় বেতনে বড় পদে চাকুরি নিয়ে ভিন্ন ব্যাংকে চলে যান। ইত্যবসরে আডিট হল, কয়েকজনের উপর ব্যাংকের প্রচুর পাওনা তৈরী হল। তারা অবসর গ্রহনের পর অনেক কাটখড় পুড়িয়েও সার্বিস বেনিফিটের একটি টাকাও পেলনা। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আমি আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে এখানে জেনারেল ব্যাংকিং বিভাগে তিনমাস কাজ করার সময় আশপাশের টেবিলের এই আগুনের লেলিহান শিখার আচ পেলেও তার ছোঁয়া হতে সম্পুর্ন মুক্ত রয়ে যাই। শামসুদ্দোহা এসপিও, মতিউর রহমান চৌধুরী এজিএম, ব্যাবস্থাপক মশিউর রহমান খান এজিএম সহ অনেকে এই অগ্নিশিখায় দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে সহকারী মহাব্যবস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী ব্যাবস্থাপক মশিউর রহমান খানের ছুটি কিংবা ঢাকায় অবস্থানকালে নিতান্ত নিয়ম পালনে এলসি কিংবা পেড ভাউচারে বসের বিকল্প স্বাক্ষর দিয়ে ফেঁসে যান।

এবার আমার ভাগ্যে গোলাপ ফুটলো। ব্যবস্থাপক করার মত তেমন যোগ্য লোক না পেয়ে আঞ্চলিক প্রধান মোঃ মোসাদ্দিদ চৌধুরী আমার প্রতি তার আঙ্গুলির নিশানা তাক করলেন। তাই আহসানউল্লাহের পরিবর্তে বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক পদে আমার নামে সংশোধিত নিয়োগ আদেশ আসে। আমি হাসিমুখে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সাল। এই বসন্ত সকালে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব নিতে সুরমানদী পার হয়ে লাউয়াই রাস্থামুখে অবস্থিত পূবালী ব্যাংক লিমিটেড বরইকান্দি শাখায় হাজির হলাম। ব্যাবস্থাপক চেম্বারে যার সামনে বসি, তিনি শফিউল হাসান চৌধুরী। আমার ছোটভাই নিশাত কুরেশীর সহপাঠি শফিউল হাসান চৌধুরীর ডাকনাম শাকিল। আমার ছোট ভাইয়ের মতই আপন শাকিল ইতিপূর্বে সিলেট শাখায় আমার সাথে কাজ করেছে। ২০০১ সালে সিনিয়র অফিসার পদে যোগদানকারী শাকিল ফেণসুগজ্ঞ ঘিলাছড়ার এক অভিজাত পরিবারের সন্থান। বাবা ছিলেন এমসি কলেজের অধ্যাপক। শাকিল ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে যোগ দেয়া এক মেধাবিনীকে বিয়ে করে, যিনি পরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় চলে যান।

ব্যবস্থাপক তালিকায় চোখ রেখে দেখলাম বরইকান্দি শাখাটি বেশ ঐতিহ্যবাহী, এর জন্ম বাংলাদেশের জন্মের সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে এবং এই শাখাটির প্রথম ঐতিহাসিক ব্যাবস্থাপক ছিলেন এই পুবালী ব্যাংকের সেই সময়ের স্বনামধন্য ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী। পুবালী ব্যাংকের বর্তমান সিলেট অঞ্চল প্রধান মোসাদ্দিক চৌধুরীও এক সময় এখানে ব্যবস্থাপক ছিলেন।

শাকিলকে আমি রক্তমাংসে চিনি, তাই ভাবলাম বাঁচা গেল। দায়িত্ব বদলে এত ফাইল ঘাটাঘাঁটি করে দেখার এখানে কোন দরকার নেই। শাকিল ফাইল বের করে কয়েকটি সেটেলমেন্ট একাউন্ট দেখাল। বলল, এগুলো রিসেটেলমেন্ট করাতে হবে। আমি তাকে ধরে না রেখে দিন দুয়েকের মধ্যে ছেড়ে দিলাম। শফিউল হাসান চৌধুরী শাকিল এই শাখায় ছিল মাত্র কয়েক মাস। আমি শাখায় বসেই বেশ কিছু মামলা ও সেটেলমেন্টের ঝামেলায় পড়লাম।

এই শাখার প্রধান কর্মতৎপর অফিসার ছিলেন তোফায়েল আহমদ। তার বাড়ি সিলেট শহর হতে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে জৈন্তার দরবস্ত পল্লীতে। একদিন কোন এক কাজে তার গ্রামে গিয়ে বিষ্মিত হলাম, এতদূর হতে বরইকান্দি শাখায় প্রতিদিন যাওয়া আসা করে তিনি অফিসে এত পরিশ্রম করেন কি করে? বিকেলে অফিসের ক্লিনক্যাশ মিলাতে ৭/৮ টা বেজে যেত। অসংখ্য পেট্রোল পাম্পের ৪০/৫০ লক্ষ খুচরা টাকা পরিপাঠি করে প্রতিদিন সিলেট শাখায় পাঠিয়ে বাসা ফিরতে হত। তোফায়েল আহমদ অফিস হতে রাত ৮/৯ ঘটিকায় বেরিয়ে চলে যেতেন জৈন্তার দরবস্ত পল্লীতে। আমি শাখার স্বল্প মানবশক্তি যথাযত বিন্যাস করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় তোফায়েল আহমদকে ব্যবস্থাপক হিসাবে দরবস্ত শাখায় বদলি করা হল।

যাবার আগে শাকিল আমাকে সাবধান করে বলেছিল, কুরেশী ভাই তোফায়েলকে ছাড়বেন না, তাকে ছাড়লে শাখা চালাতে আপনি অসুবিধায় পড়ে যাবেন। সিলেট আঞ্চলিক অফিস হতে আগাম ইশারা পেলেও আমি তোফায়েল আহমদকে আটকানোর কোন চেষ্টা করলাম না, যদিও তাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল। আমি এমন একজন লোক, যে নিজের অসুবিধা চিন্তা না করে তোফায়েল সাহেবের সুবিধা বিবেচনায় নিলাম। তোফায়েল আহমদকে তার গ্রামের শাখায় যেতে ছেড়ে দেয়ার পর সত্যিই বিপদে পড়লাম। বিবাড়িয়ার আমিনুল হক, কুমিল্লার হাবিব মহসীন, ঢাকার আমিনুল ইসলাম জুয়েল সবাই শিক্ষানবিস অফিসার, তারা এখনও পরিপক্ষ হয়ে ওঠেনি। তোফায়েল এতই কর্মঠ ছিল যে সে একাই দুইতিন জনের সমান কাজ করত।

জেনারেল ব্যাংকিং বিভাগে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হলে আমি ক্যাশ বিভাগ হতে অর্পন কুমার নাথকে বের করে নিয়ে আসলাম। জুনিয়র অফিসার (ক্যাশ) অর্পন কুমার নাথ ঈদগাহের বাসিন্দা, তিনি ইতিপূর্বে ঈদগাহ শাখায় আমার সাথে কাজ করেছেন। তার উপর আমার আস্থা ছিল। যাক তিনি কোনমতে সামাল দিলেন। ভাল ও সুদর্শন ছেলে আমিনুল ইসলাম জুয়েল আমার সাথে থাকতে চেয়েছিল অথচ নিদারুন জনবল সংকটের কোন একদিনে উপরের আদেশে আমিনুল ইসলাম জুয়েলকে বিদায় জানাতে হল। সে দুচোখের অশ্রু ফেলে চলে গেল আমাদের চৌকিদেখি শাখায়।  

মোশাররফ হোসেন নামে একজন শিক্ষানবীস অফিসার ছিলেন একটু মাথাগরম। একবার তিনি ছুটি নিয়ে উদাও হয়ে যান। পরে জানলাম একপদ উপরে সিনিয়র অফিসারে সূযোগ পেয়ে তিনি সরকারি জনতা ব্যাংকে যোগদান করেছেন। এই খবরটা আমাকে এত গোপন করার কোনই প্রয়োজন ছিল না। তার মঙ্গল হচ্ছে দেখলে আমি তাকে আটকে রাখার চেষ্টা না করে বরং সহায়তা করতাম।  

ব্রাক্ষনবাড়িয়ার আমিনুল হক সিনিয়র অফিসার হিসাবে ব্যাংকে ঢুকেন। মেধাবী আমিনুল হক খুব সহজে সবকিছু হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পারতেন। তার কাজের মান ছিল উৎকৃষ্ট এবং নির্ভুল। তাকে ঋণ ও রিকোভারির দায়িত্ব দিলাম। তিনি চাকুরি নিশ্চিতকরনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে তার ব্যাচের সবার সাথে সাক্ষাৎকার পরীক্ষা দেন। এই স্বাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বোর্ডকে ব্যাংকের কতৃপক্ষের কিছু অনিয়মের ইঙ্গিত দিয়ে বসেন। আমাকে এসে একথা বললে আমার সন্দেহ হল ওরা তাকে আটকিয়ে দিতে পারে। তার কথা শুনে আমি বললাম আপনি ভূল করছেন, কতৃপক্ষ ইজ অল অলওয়েজ রাইট। পরে দেখলাম সবার চাকুরি কনফার্মেশন হয়ে গেলেও সুদক্ষ সিনিয়র অফিসার আমিনুল হককে বোর্ড ছাড়পত্র দেয় নি। কোন সঙ্গত কারন ছাড়াই আমিরুল হক তার ব্যাচের অন্য সবার চেয়ে এক বৎসর পিছিয়ে পড়লে আমি খুব দুঃখই পেলাম।

ইদগাহের অভিঞ্জতা আমাকে সাবধান করে দেয়, ঋণবিভাগে কেবল একজনের উপর নির্ভর করতে নেই। এই কর্মকর্তা হঠাৎ বদলি কিংবা অসুস্থ হলে শাখা সমুহ বিপদে পড়ে যায়। আমি আমিনুল হকের সাথে তাই শিক্ষানবীস অফিসার কাওসার আহমদকে ঋণ প্রদান ও আদায়ে যুক্ত করে দেই। কাওসার ছাতকের সন্থান। সে গণিতে অনার্স সহ মাস্টার্স। সে এম সি কলেজ হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিভাগ সহ প্রথম দশের ভিতর স্থান লাভ করে। তার গাণিতিক ব্রেইন খুব ধারালো। সে টেকনিক্যাল এনালাইসিসে দক্ষ হওয়ায় শেয়ারের বিশ্লেষণে তার সাথে মাঝে মাঝে আলাপ করতাম।   

আমিনুল প্রথমদিকে প্রতি সাপ্তাহে ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করলেও পরে চন্ডিপুলের কাছে ধরাধরপুর গ্রামে একটি বাসা ভাড়া নেন। একদিন রাতে ব্যাংকের সবার সাথে আমি ও সাবেক ব্যবস্থাপক শফিউল হাসান সাকিল সপরিবারে আমিনুলের বাসায় গিয়ে দাওয়াত খাই। খেয়েদেয়ে আমরা আচ করলাম আমিনুলের উচ্চশিক্ষিত বরিশালী পত্নী খুব ভাল রান্না জানেন। তখন তাদের একটি হালকা চিকন শিশুপুত্র ছিল। আমিনুল হকের সাথে আমি দীর্ঘ্যদিন নির্ভয়ে কাজ করি। আমার অসুবিধা বিবেচনায় না এনে আবার আমি তার ঢাকা বদলির আবেদনে সম্মতি জানাই। আবেদন মঞ্জুর হলে ২০১৩ সালে আমরা তাকে ঢাকার পুবালী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি পুবালী  সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বিদায় জানাই।

জুনিয়র অফিসার নির্মল কান্তি দাস আমার গ্রামের পশ্চিমপাড়ার সন্থান। তার বংশজাতক ডঃ ক্ষণদা মোহন দাস ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব। হাসিখুশি নির্মল বাবুকে পেয়ে আমি খুব প্রসন্ন হলাম। একদিন নির্মল বাবুর বাবা মারা গেলে আমার কার নিয়ে তাকে দেখতে দাউদপুর ছুটে গেলাম। পরিণত বয়সে মারা যাওয়া মুরব্বীর লাশ ঘিরে সবাইকে আহাজারী করতে দেখলাম। মনমোহন বাবু ও আমি নির্মলকে সান্তনা দিয়ে বরইকান্দি শাখায় ফিরে আসলাম। কিছুদিন পর নির্মল বাবুর পিতার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আমি সপরিবারে উপস্থিত হই। সাথে গিয়েছিলেন আমার এক চাচাত ভাবী নাসরিন চৌধুরী।

অফিসার আরিফ শাহরিয়ারের বাড়ি হেতিমগঞ্জে। তিনি সাহিত্যমনা লোক। আমি হজরত শাহজালালের(রঃ) জীবনী লিখতে গেলে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ এবং আল ইসলাহের হজরত শাহজালাল(রঃ) সংখ্যা আমাকে উপহার দেন, যা আমার বেশ কাজে লাগে। তার পিতার লেখা কিছু কবিতার সংগ্রহ আমার হাতে আসে। এক ঝুমবৃষ্টির বাদল দিনে ইসলামপুরে রাস্থার পানিতে হেটে সপরিবারে অফিসের সবাই গিয়ে আরিফের বাসায় দাওয়াত খাওয়ার স্মৃতি খুবই মনে পড়ে। আরিফ কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের একজন সক্রিয় সদস্য।   

শিক্ষানবিশ অফিসার আমিনুল ইসলাম নেত্রকোনার ছেলে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স করে এখানে যোগদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আমার ফুফুত ভাই রুকন উদ্দিন চৌধুরী। আমিনুল একদিন বাড়িতে গিয়ে টেলিফোন করে বলল আচমকা তার বিয়ে হয়ে গেছে। মাবাবা তাকে কনে দেখায়েই গলে ঝুলিয়ে দেন। আমি তাকে কিছুদিন ছুটির ব্যবস্থা করে দিলাম। একদিন সে তার পরমা সুন্দরী বউকে নিয়ে সিলেট ফিরে আসে। এখানে তার দুইটি সন্থান হল, প্রসুতি চিকিৎসক ছিলেন আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী।  

হবিগঞ্জের অভিজাত পরিবারের ছেলে জুনিয়র অফিসার (ক্যাশ) জহিরুল ইসলাম চৌধুরী। একদিন তাকে বিশ্বনাথে বদলি করে আমার ভাগ্না মুফতি মোঃ তানজীরকে আমার শাখায় পাঠানো হল। তাকে বেশ মনমরা অবস্থায় দেখে আমার মনে হল সে হয়তো মনে করবে আমি আমার ভাগ্নাকে এখানে আনার জন্য তাকে বিদায় করে দিয়েছি। আমার বস আঞ্চলিক প্রধান মোসাদ্দিক চৌধুরীকে ফোন করে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। তিনি তখন আমার ভাগ্না মুফতি তাঞ্জীরকে চৌধুরীবাজার শাখায় পাঠিয়ে দেন। বরইকান্দিতে আমার শেষ সময়ে যোগদান করেন জুনিয়র অফিসার(ক্যাশ) বাবুল হোসেন। তিনি সাস্টের সমাজকর্ম বিষয়ের মাস্টার্স, তার বাড়ি নরসিংদী। 

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রি জাহারাত রিশাত শাহজালালের(রহঃ) দরগাহের মোতাওয়াল্লি বাড়ির মেয়ে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে সে শিক্ষানবিস জুনিয়র অফিসার হিসাবে আমার কাছে এসে যোগদান করে, পরে বদলি হয়ে ঢাকায় তার স্বামীর কাছে চলে যায়। সুদর্শন ফয়সল আহমদ ক্যাশে কাজ করতেন, থাকতেন আমার বাসার কাছে সুবিদবাজার। আমি অফিস হতে আসার সময় ব্যায়ামরূপে কিছুপথ তার সাথে হেটে যেতাম। শওকত হোসেন নামক আরেকজন শিক্ষানবিস অফিসারের কথা মনে পড়ে। সে ঢাকায় বদলি হয়ে গিয়ে চাকুরী ছেড়ে চলে যায়। ফেন্সুগঞ্জের নুরপুরের রাজিয়া সুলতানা ছিল আমার মেয়ের মত। সে আমাকে পায়ে ধরে সালাম করত। দুঃখের বিষয় দুরন্ত স্বভাবের রাজিয়ার বিয়ে টেকেনি। আমি ওখানে থাকাকালেই ওর অল্প বয়সী সুদর্শন স্বামী ওকে ছেড়ে চলে যায়।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ মেধাবী ব্যাক্তিত্ব সুফিয়ান আহমদ, বাড়ি মৌলভীবাজার। তিনি লন্ডন গিয়ে আবার এমবিএ করেন। তার থলীতে ব্যাঙ্কিং ডিপ্লোমাও ছিল। দাড়িওয়ালা তরুণ সুফিয়ান পুবালীর ঢাকা হেডঅফিস এবং লন্ডন অফিসে কাজ করার অভিঞ্জতার নানা রসালো গল্প শুনাতেন। এই রসালো গল্পমালার অন্যতম নায়ক ছিলেন আমাদের একজন মহাব্যবস্থাপক জৈনিক চৌধুরী। তবে রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার এতসব কথামালা এখানে বলা যাবেনা। মেধাবী ও ইংলিশদক্ষ সুফিয়ান পরে বড়পদে চাকুরি পেয়ে সরকারি বেসিক ব্যাংকে চলে যান।   

আমি বরইকান্দি শাখায় এসে ক্যাশে একজন খুব ভাল মানুষকে পেয়ে যাই, তিনি কুমিল্লার আব্দুল বারি। নিরিহগোছের ভদ্রমানুষ, কোন ঝগড়াঝাটি না করে নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে কাজ করে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, তিনি একসময় কালিঘাটে চলে যান। এবার আসেন একজন জটিল মানুষ মনমোহন, যার বাড়ি সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল। তিনি প্রতিদিন দুই একটা জাল নোট নিয়ে আমার কাছে ধর্না দিতেন স্যার, আমি গরিব মানুষ, এই ছোট চাকুরী করে কত ভর্তুকি দেবো। একদম নাছুড়বান্দা তাই মাঝে মাঝে আমি পকেট হতে সাহায্য করতাম। তার সাথে পেরে উঠতে নাপেরে কখনো কখনো  ব্যাংকের কোন খরচ খাত হতেও দিতে বাধ্য হতাম। আপনারা দেখে শুনে টাকা নিবেন, আমি কোন সাহায্য করতে পারবনা, বললে তিনি চেচামেচি শুরু করে দিতেন। আমি কোনমতে চালিয়ে গেলেও আমার পরবর্তী ব্যবস্থাপক সৈয়দ ফয়জুর রহমানের সাথে তিনি তীব্র ঝগড়াঝাটি ও বাধানুবাদে লিপ্ত হন।  

মনমোহন বাবু একদিন একটি অনলাইন পেমেন্ট নিয়ে খোজারখলার একজন ব্যবসায়ীর সাথে প্রথমে ঝগড়াঝাটিতে লিপ্ত হন, পরে তা হাতাহাতিতে গড়ায়। এই ব্যবসায়ীকে আমি চিনতাম, তিনি এইপারের একজন প্রভাবশালী লোক ও আমাদের টেকনিক্যাল রোড শাখার একজন বড় সিসি ঋন কাস্টমার। মনমোহন বাবু নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করতেন, আমি তাকে শান্ত হতে বারবার ইশারা দিলেও তিনি কর্নপাত করলেন না। এই ব্যবসায়ীর পক্ষে হঠাৎ হাতে হকিস্টিক নিয়ে বেশ কিছু তরুণ এসে ব্যাংক ঘিরে ফেলার উপক্রম করে। আমি বের হয়ে উক্ত ব্যবসায়ীকে বুকে জড়িয়ে ধরি, তাকে আমার চেম্বারে এনে বসিয়ে চা নাস্তা করায়ে এই তরুনদেরকে শান্ত করে বিদায় জানা। আমাদের টেকনিকেল শাখার ব্যবস্থাপক সফিক উদ্দিন ভূঁইয়াকে প্রভাবক হিসাবে ব্যবহার করে বিষয়টা আর যেন জটিল না হয় সেই ব্যবস্থা করি 

তিনচার দিন আগে একরাতে রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে তাদের এক প্রহরীকে কিছু স্থানীয় বখাটে মাদকসেবীরা খুন করে। এখানে রাতে আড্ডা দিতে নিষেধ করে প্রান হারানো এই প্রহরীর কোন দায়িত্বই হাসপাতাল কতৃপক্ষ নিলনা। আমি মনমোহন বাবুকে বললাম, দেখুন এরা আশপাশের স্থানীয় লোক, আপনি বাহির হতে এসে এখানে চাকুরী করছেন। অফিসে আসা যাওয়ার পথে যদি আপনার বুকে ওরা ছুরি বসিয়ে দেয়, তা হলে হাসপাতালের ঐ নিহত গার্ডের মত পূবালী ব্যাংক কোন দায়িত্ব নেবেনা। বলবে ওটা রাস্থার ব্যাপার, অফিসের নয়। আবার এই ব্যবসায়ী আপনার বিরুদ্ধে হেড অফিসে অভিযোগ দিলে আপনি নির্ঘাত বিপদে পড়বেন। অফিসে একসভা ডেকে আমি সবাইকে সাবধান করে দিলাম এধরনের মাথাগরম হবার ঘটনা আর যেন না ঘটে। সিনিয়র বয়স্ক লোক মনমোহন বাবু হাইস্কুল শিক্ষকতা ছেড়ে একসময় ব্যাংকে আসেন, কিন্তু তার এসব কার্যকলাপের কারনে চাকুরিতে এসে তেমন কোন উন্নতি করতে পারেননি।

আমি বরইকান্দি শাখা ছেড়ে আসার কিছুদিন আগে যোগদান করেন সব্যসাচী সরকার ও মাইদুল ইসলাম। ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে রেখে সিলেটে এসে সব্যসাচী পুবালী ব্যাংকে শিক্ষানবিস অফিসার পদে যোগদান করে। অফিসে সে তাই এক অস্থিরতায় ভুগতো। আমি তাকে ঢাকায় পাঠানোর চেষ্টা করি কিন্তু সফল হতে পারিনি। সে আমাকে বেশ কিছু উচ্চমার্গের বই উপহার প্রদান করে, যা আমার পারিবারিক পাঠাগারে এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।

বলদি গ্রামের আতিক মিয়া ছিলেন ম্যাসেঞ্জার। তিনি বিদ্যুৎবিল গ্রহনে বসতেন। তিনি স্থানীয়, অথচ স্থানীয় লোকদের সাথে প্রায়ই তার ঝগড়াঝাটি লেগে যেত। আমি গিয়ে থামিয়ে আসতাম। বলদি গ্রামের আমার প্রিয় আহাদ ভাইয়ের কাছে জানলাম, আতিকের বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে আতিককে বলদি নিয়ে আসেন। তখন আমার বুঝতে বাকী রইলনা, শৈশবে একটু অবহেলার মধ্যে বড় হওয়ার জন্য আতিকের মধ্যে এই ধরনের মনঃবিকার সৃষ্টি হয়েছে। যাক একদিন আতিকের স্টেশন রোডের বাসায় নিমন্ত্রন খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়। সহজ সরল প্রহরী আনোয়ার হোসেন জকিগঞ্জের বলরামপুরের লোক। আনোয়ারের অহংকার তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং জকিগঞ্জের এম পি হাফিজ এ মজুমদারের গ্রামের লোক। অল্প বয়স্ক ভদ্র গার্ড আব্দুল হাকিম যশোরের লোক। সিলামের সুজন আলী ছিল টিবয়। আমি চলে আসার আগে তার চাকুরি স্থায়ী করে দিয়ে আসি। সে আমাকে প্রতিদিন কাপ কাপ চিনির চা পান করায়, ফলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আমার শরীরে ডায়বেটিস ধরা পড়ে। তারপর আমার ইচ্ছেমত মিষ্টি খাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

আমার শাখার ক্রেতাঋনের এজেন্ট ছিলেন জিল্লুর রহমান শোয়েব ভাই। তিনি দক্ষিন সুরমা উপজেলার জালালপুরের লোক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিঞ্জানে মাস্টার্স শোয়েব ভাইয়ের বাবা ছিলেন একজন আলেম। ছাত্রজীবন হতে তিনি বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আমাদের পরিচালক শফি চৌধুরী এম পির তিনি একজন ঘনিষ্ট লোক। এমপি সাহেবের প্রতিষ্টিত লতিফা শফি মহিলা কলেজে তিনি কিছুদিন প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শোয়েব ভাইয়ের এজেন্সি মেসার্স রহমান এন্টাপ্রাইজের কর্মী আব্দুল কাদের প্রতিদিন এই শাখায় বসে সিএলসের কাজ পরিচালনা করতেন। কমলগঞ্জের এই কাদির সাহেবকে আমি এসএমই ঋন দেই, যা পরে আদায় করতে বেশ বেগ পেতে হয়।   

সিলেটে মাঝে মাঝে কয়েকদিন ধরে নিঝুমধারায় বৃষ্টি হত। রাস্থায় হাটুপানি জমে যেত। আমি বরইকান্দি শাখায় এসে দারুন বন্যার কবলে পড়লাম। বৃষ্টি হলেই অফিসের সামনের রাস্থা ডুবে যায়। কয়েকটি ইট ফেলে এগুলোতে পা ফেলে ফেলে শাখায় ডুকার এতদিন ব্যবস্থা ছিল। আমি অঞ্চল প্রধান মোসাদ্দিক স্যারের অনুমতি নিয়ে সামনের সারাটা প্রাঙ্গন উচু করে ঢালাই দিয়ে বন্যার সমাধান করলাম। তখন শেখঘাটে সেতু ছিলনা। আমরা কিনব্রিজ হয়ে রিকশা কিংবা বেবিট্যাক্সি চড়ে অফিসে যাওয়া আসা করতাম। মাঝেমাঝে শেখঘাটে এসে খেয়ানৌকায় সুরমানদী পারহয়ে খোজারখলা গ্রামের বৃক্ষডাকা শ্যামল রাস্থা দিয়ে হেটেও অফিসে আসতাম। সাগরদিঘীরপার হতে আমার প্রাইভেট কার নিয়ে অফিসে গেলে উপশহর সংলগ্ন শাহজালাল সেতু হয়ে অনেক পথ ঘুরে যেতে হত। বৃষ্টিভেজা বন্যার দিনে অফিসে আমার কার নিয়ে যেতে বাধ্য হতাম। তখন মহসিন, আমিনুল, জুয়েল, আরিফ, কাওসার সবাইকে নিয়ে রাস্থায় বন্যার পানিবেয়ে কার চালিয়ে লাউয়াইয়ের সামনে বরইকান্দি শাখায় হাজির হতাম।

বরইকান্দি শাখায় অনেক বিবিএ স্টুডেন্ট শিক্ষানবিস ট্রেইনি হিসাবে দুইমাসের চাকুরী কোর্স করতে আসেন। তাদের মধ্যে অনেকের স্মৃতি আমার মনে স্থায়ী হয়ে আছে। লাউয়াই গ্রামের ফয়সল আহমদের বাবা পোষ্ট অফিসে চাকুরী করতেন। ফয়সল পরবর্তীকালে হিসাব বিভাগে সরকারী চাকুরী পেয়ে আমাকে ফোন করে জানায়। তার সহপাঠী রাশেদ ছিল বলদির বিখ্যাত ব্যবসায়ী বনফুল কনফেকশনারির মালিকের পুত্র। ভদ্রছেলে রাশেদ চাকুরির পিছনে দৌড়ঝাপ না দিয়ে তার বাবার ব্যবসায় নেমে পড়ে। সে এখন চন্ডিপুলের বনফুল এন্ড কনফেকশনারি সেন্টার পরিচালনা করছে। রিম্পি নামক মেয়েটি ছিল খুব স্নেহপ্রবন, তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা তবে শুনেছি তার বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে গেছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তুষার আমার এমবিএতে প্রজেক্ট প্রফাইল করতে খুবই সাহায্য করে। সে পরে বিআরটিএতে অফিসার হিসাবে যোগদান করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন